০৯. আতিকার বিয়ের দিন ঠিক
আতিকার বিয়ের দিন ঠিক হয়ে যেতে নাদের আলি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কি করবে না করবে চিন্তা করে ঠিক করতে না পেরে হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য কার্পাসডাঙ্গা গেল। সালাম ও কুশল বিনিময় করে কথাটা জানাল।
হাবিব ডাক্তার বলল, তোমাদেরকে তো বলেছি এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা করবে না, যা করার আমিই করব? কথাটা শুনে আমি আতিকার সঙ্গে দেখা করেছি। যা বলছি শোন, বিয়ে তো শুক্রবার। বুধবার দিনগত রাত তিনটের সময় আমি বিশ্বাসপাড়ার রাস্তার মোড়ে থাকব, তুমি আসবে। আতিকাকেও ঐ সময়ে আসতে বলেছি। আজ তুমি না এলে কাল আমি তোমার কাছে যেতাম। তোমাদেরকে ফার্স্ট বাসে ঢাকায় আমাদের বাসায় পাঠিয়ে দেব। সেখানে তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছি। ঘরে গিয়ে খালাআম্মাকে সবকিছু বুঝিয়ে চিন্তা করতে নিষেধ করবে। এখন তুমি যাও।
জি করব বলে নাদের আলি বিদায় নিয়ে ফিরে এল। তারপর থেকে কাজকাম করলেও মনে এতটুকু শান্তি নেই। কেবলই মনে হয়, অত রাতে আতিকা আসতে পারবে তো? যদিও আসে, কেউ দেখে ফেললে কি করবে?
আজ বুধবার। কোনো কাজ করতে ভালো লাগছিল না বলে নাদের আলি সকাল থেকে ঘরেই রইল। যোহরের নামায পড়ে খাওয়ার পর হাবিব ডাক্তারের কথাগুলো ফুফুকে বলে বলল, কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে, কোথায় গেছি জান না।
হানিফা খাতুন আতঙ্কিত স্বরে বললেন, মাতব্বর রেগে গিয়ে কি করবে ভেবেছিস? যদি লোকজন পাঠিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর করে?
এসব ভেবে মন খারাপ করো না। ডাক্তার ভাই থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই। কেউ তোমার কিছু করবে না। আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকবে। আজরাফ স্যার দু’একদিনের মধ্যে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসবেন। তাকে সবকিছু বলে তাদের ঘরেও থাকতে পার। এমন সময় হালিমকে আসতে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলল, কী খবর হালিম?
হালিম পেট কাপড় থেকে একটা ভাঁজ করা চিঠি বের করে বলল, বুবু দিয়েছে। আর এই চিঠির উত্তর দিতে বলেছে।
নাদের আলি সেখানেই চিঠি খুলে পড়তে শুরু করল–
নাদের আলি ভাই,
সালাম নেবে। পরে জানাই যে, এই ক’দিন খুব দুশ্চিন্তায় কিভাবে যে কাটছে তা আল্লাহ জানেন। ডাক্তার ভাইয়ের কথামতো আজ রাত তিনটের সময় রাস্তার মোড়ে আসব। তিনি আগের থেকে ওখানে থাকবেন বলেছেন। তোমাকেও নিশ্চয় ঐ সময়ে আসতে বলেছেন। সাড়ে তিনটে পর্যন্ত অপেক্ষা করব। যদি না আস, তা হলে সঙ্গে যে বিষের শিশি থাকবে, ডাক্তার ভাই বোঝার আগেই খেয়ে ফেলব। তবু ঘরে ফিরে যাব না। আশা করি, ঐ সময়ের মধ্যে নিশ্চয় আসবে। দোয়া করি, আল্লাহ যেন আমাদের মনের আশা পূরণ করেন। আমার মন বলছে, তুমি আসবে। তবু সিওর হওয়ার জন্য এই চিঠি লিখে হালিমকে পাঠালাম। আর হ্যাঁ, ডাক্তার ভাই যে বোরখাটা তোমাকে দিয়েছেন, সেটা নিয়ে আসতে ভুল করবে না।
ইতি
তোমার আতিকা
চিঠি পড়া শেষ করে হালিমকে জিজ্ঞেস করল, খেয়েছিস?
জে।
তুই গিয়ে তোর বুবুকে বলবি, ঠিক সময়ে আমি আসব। আর দেরি করিস, তাড়াতাড়ি চলে যা। কেউ দেখে ফেলতে পারে।
হালিম চলে যাওয়ার পর নাদের আলি ফুফুকে চিঠির কথা বলে বলল, যা যা বললাম, সেই মতো করবে।
সারারাত নাদের আলি যেমন ঘুমাতে পারল না, তেমনি আতিকাও পারল না। তারপর ঠিক সময়মতো দু’জনে প্রায় একসঙ্গে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে পৌঁছাল।
হাবিব ডাক্তার কিছুক্ষণ আগে এসে তাদের অপেক্ষায় ছিল। সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, তোমাদেরকে কেউ দেখে নি তো?
দু’জনেই বলল, না।
হাবিব ডাক্তার তাদেরকে নিয়ে কার্পাসডাঙ্গায় নিজে রুমে এসে প্রথমে সবাই ফজরের নামায পড়ল। তারপর চা-নাস্তা খাইয়ে বাসে তুলে দেয়ার সময় একটা চিঠি নাদের আলিকে দিয়ে বলল, আমার আব্বা তোমাদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাসস্ট্যান্ডে গাড়ি নিয়ে থাকবেন। গতরাতে আমি তাকে ফোন করে তোমাদের যাওয়ার কথা জানিয়েছি। একটু পরে আবার ফোন করে যাওয়ার কথা ও তোমাদের পোশাকের কথা জানিয়ে দেব। উনি তোমাদেরকে চিনে ফেলবেন। তাকে এই চিঠিটা দিও।
আজ তিন দিন হাবিব ডাক্তার তাদেরকে ঢাকায় নিজেদের বাসায় পাঠিয়েছে। তার বাবা খলিলুর রহমান প্রায় প্রতিদিন ফোন করে খবরা-খবর নেন। গত রাতে জানিয়েছেন, ঐদিনই বাসায় কাজি নিয়ে এসে তাদের বিয়ে পড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তারা ভালো আছে।
আজ বেলা দেড়টা পর্যন্ত রুগী দেখা শেষ করে রুমে যাবে, এমন সময় রসু এসে হাজির। বলল, কী খবর রসু?
রসু সালাম বিনিময় করে বলল, মাতব্বর সাহেব হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আপনাকে যেতে হবে।
হাবিব ডাক্তার বলল, ঠিক আছে, আপনি যান। আমি যোহরের নামায পড়ে খাওয়া দাওয়া করে আসছি।
বিকেল চারটের সময় হাবিব ডাক্তার মুশতাক বিশ্বাসের বাড়িতে এসে দেখল, বৈঠকখানায় লোক গিজ গিজ করছে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অন্যান্য পাড়ার মুরুব্বীরা, চেয়ারম্যান ও আজরাফ স্যারও রয়েছেন। মাতব্বর সাহেব তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। সাইকেল স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে সালাম দিয়ে মুশতাক বিশ্বাসকে উদ্দেশ্য করে বলল, রসুর কাছে শুনলাম আপনি খুব অসুস্থ! কিন্তু আপনাকে দেখে তো তা মনে হচ্ছে না?
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, আমার কিছু হয় নি। ঐ কথা বলে তোমাকে আনার জন্য রসুকে পাঠিয়েছিলাম। ওখানে বস বলে একটা খালি চেয়ার দেখালেন।
হাবিব ডাক্তার বসে বলল, মনে হচ্ছে, গ্রামের কোনো ব্যাপারে সালিশ ডেকেছেন। এর মধ্যে আমাকে ডেকে পাঠালেন কেন বুঝতে পারছি না?
মুশতাক বিশ্বাস চেয়ারম্যানকে বললেন, যা বলার এবার আপনি বলুন।
চেয়ারম্যান আসার পর মুশতাক বিশ্বাস তাকে নাদের আলি ও আতিকা হাবিব ডাক্তারের যোগসাজসে ঢাকা পালিয়ে যাওয়ার কথা ও পশ্চিমপাড়ার হাশেম আলির মেয়ে যীনাতের সঙ্গে তার কুসম্পর্কের কথা জানিয়ে যখন বিচারের কথা বলেন তখন তিনি মনে মনে হাবিব ডাক্তারের প্ল্যানের প্রশংসা না করে পারলেন না। বললেন, ঘটনা সত্য প্রমাণ হলে হাবিব ডাক্তারের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, আজরাফ মাস্টারকে খবর দেন নি?
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, কয়েকদিন আগে সে শ্বশুরবাড়ি সপরিবারে গিয়েছিল। গতকাল সন্ধ্যেয় ফিরেছে। তাকেও খবর দেয়া হয়েছে। এমন সময় আজরাফ হোসেনকে আসতে দেখে বললেন, ঐতো এসে গেছে।
আজরাফ হোসেন সালাম ও কুশল বিনিময় করে চেয়ারম্যানের পাশে বসলেন। তারপর মুশতাক বিশ্বাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, হঠাৎ ডেকে পাঠালেন কেন?
চেয়ারম্যানকে যে সব কথা মুশতাক বিশ্বাস বলেছিলেন, সে সব কথা তাকেও বললেন।
আজরাফ হোসেন শুনে ভাবলেন, হাবিব ডাক্তার কিভাবে ম্যানেজ করে দেখা যাক। তাই কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।
মুশতাক বিশ্বাসের কথায় চেয়ারম্যান হাবিব ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললেন, সালিশী বসেছে আপনাকে নিয়ে। কোনো কারণে আপনি যদি না আসেন, তাই মাতব্বর সাহেব নিজের অসুখের কথা বলে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আপনার বিরুদ্ধে দু’টো নালিশ আছে। তার একটা হল, পশ্চিমপাড়ার হাশেম আলির বাড়িতে আপনাকে রাতে যাতায়াত করতে অনেকে দেখেছে। শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে সেখানে রাতেও থাকেন। এখন যীনাতের পেটে বাচ্চা এসেছে জেনে তারা মাতব্বর সাহেবের কাছে আপনাকে দায়ী করে বিচার দাবি করেছে। হাশেম আলি ও তার মেয়েকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠান হয়েছিল। তারা আসে নি। বলেছে, সালিশীতে যা রায় হবে, তা তারা মেনে নেবে। দ্বিতীয় নালিশ হল, মাতব্বরের মেয়ে আতিকাকে নিয়ে নাদের আলির ঢাকা পালিয়ে যাওয়ার পিছনে যে আপনার যোগসাজস আছে, তার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। এখন আপনার কিছু বলার থাকলে বলতে পারেন।
হাবিব ডাক্তার কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি বলবে ভেবে নিয়ে বলল, প্রথম নালিশের জওয়াবে বলব, যীনাতকে আমি প্রায় ছয় সাত মাস আগে বিয়ে করেছি। তারপর পরিস্থিতি দেখার জন্য চুপ করে রইল।
তার কথা শুনে চেয়ারম্যান ও আজরাফ হোসেন ছাড়া সবাই খুব অবাক হয়ে কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
প্রথমে মুশতাক বিশ্বাস বললেন, শুধু মুখে বিয়ে করেছি বললে তো হবে না, প্রমাণ দেখাতে হবে।
হাবিব ডাক্তার বলল, বিশেষ কারণে আমি বিয়েটা গোপনে করেছি। আর যারা বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, তাদেরকেও কথাটা গোপন রাখতে বলেছিলাম। তাই তারা, হাশেম চাচা ও তার একজন আত্মীয় ছাড়া আর কেউ জানেন না।
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, যারা তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, তাদের নাম বল।
যে কারণে আমি গোপনে বিয়ে করেছি, সেই একই কারণে তাদের নাম বলতে পারব না। আমি খুব অবাক হচ্ছি, আপনারা হাশেম আলি চাচার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করেন নি কেন? তিনি মেয়ের বাবা, তাকে জিজ্ঞেস করলে সত্য মিথ্যা জানতে পারতেন।
এবার দ্বিতীয় নালিশের জওয়াবে বলব, দু’টো তরতাজা ফুলের মতো জীবনকে বাঁচবার জন্য আমাকে এই কাজ করতে হয়েছে। এখানে আসার কিছুদিনের মধ্যে ওদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে দু’জনকেই অনেক বুঝিয়ে এই পথ থেকে ফিরে আসতে বলি; কিন্তু নাদের আলি কিছুটা বুঝলেও আতিকা বুঝল না। তার এক কথা, নাদের আলিকে ছাড়া সে বাঁচবে না। যদি বাবা মা জোর করে অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, তা হলে বিয়ের আগেই বিষ খাবে। তাই সে একটা বিষের শিশি সব সময় কাছে রাখত। এসব জানার পর কিছুদিন আগে আমি মাতব্বর সাহেব ও তার ছেলের সঙ্গে ওদের বিয়ে দিয়ে দেয়ার ব্যাপারে আলাপ করি। ওঁরা আমার কথায় কান না দিয়ে অন্য জায়গায় আতিকার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। আমি একথা জানতাম না। একদিন সূতাপাড়া থেকে রুগী দেখে ফেরার সময় আতিকার সঙ্গে দেখা। সে বিয়ের কথা জানিয়ে বলল, আপনি তো আমার জন্য কিছুই করতে পারলেন না। তারপর বিষের শিশি দেখিয়ে বলল, এটা নিশ্চয় আমাকে সাহায্য করবে। আমি যে তাকে নিজের বোনের মতো মনে করি, তাও মাতব্বর সাহেবকে ঐদিন বলেছিলাম। তাই বড় ভাই হিসাবে ছোট বোনকে বাঁচবার জন্য বাধ্য হয়ে তাদেরকে ঢাকায় পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার জন্য সহযোগিতা করেছি। শুধু তাই নয়, তাদেরকে আমাদের বাসায় পাঠিয়ে বিয়ে পড়াবার ব্যবস্থাও করেছি। তারা বিয়ের পর আমাদের বাসাতেই সুখে দিন কাটাচ্ছে। এতে যদি আমার অন্যায় হয়ে থাকে, তবে যে। শাস্তি আপনারা দেবেন তা মাথা পেতে নেব। তারপর আমার আর কিছু বলার নেই বলে হাবিব ডাক্তার চুপ করে গেল।
যীনাতকে বিয়ে করার কথা শুনে সবাই যতটা না অবাক হয়েছিল, আতিকা ও নাদের আলির ব্যাপারে সবকিছু শুনে আরো বেশি অবাক হয়ে অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। তারপর লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। অনেকে বলাবলি করতে লাগল, হাবিব ডাক্তারের মতো ভালো মানুষের নামে মাতব্বর সাহেবের সালিশ ডাকা ঠিক হয় নি। ওনার মতো লোক এই জামানায় আছে কিনা সন্দেহ। ভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে যার তার কথায় সালিশ ডাকা কি উচিত হয়েছে?
আজরাফ হোসেন সবাইকে চুপ করতে বলে বললেন, যীনাত আমার চাচাত বোন। হাবিব ডাক্তার আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করার সময় তাকে দেখে ও তার সবকিছু জেনেও আমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমিই গদের বিয়ের ব্যবস্থা করি। তিনি বিয়ের কথা গোপন রাখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, তাই প্রকাশ করি নি। ওদের কুসম্পর্কের কথা জানার পর মাতব্বর সাহেবের উচিত ছিল, আমার সঙ্গে বা হাশেম চাচার সঙ্গে আলাপ করা। কেন যে উনি তা না করে সালিশ ডাকলেন বুঝতে পারছি না। আমি এই কয়েকদিন বাড়িতে ছিলাম না। গত সন্ধ্যায় ফিরেছি। আজ সকালে মাতব্বর সাহেবের লোক আসার জন্য খবর দিতে এসেছি। যাই হোক, মানুষ মাত্রই ভুল করে। আমার মনে হয়, উনি ভুলই। করেছেন। তারপর চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি বলেন?
চেয়ারম্যান বললেন, হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়। উনি আপনার সঙ্গে বা হাশেম আলির সঙ্গে আলাপ না করে ভুলই করেছেন। তারপর মুশতাক বিশ্বাসকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আতিকা ও নাদের আলির ব্যাপারে হাবিব ডাক্তারকে কি শাস্তি দিতে চান আপনিই বলুন।
যীনাতের ব্যাপারে যে ভুল করেছেন, তা বুঝতে পেরে মুশতাক বিশ্বাস নিজের কাছে নিজে খুব ছোট হয়ে গেলেন। তাই চেয়ারম্যানের কথা শুনে কি বলবেন চিন্তা করতে লাগলেন।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে হাবিব ডাক্তার বলল, মাতব্বর সাহেব যা শাস্তি দেবেন তা মাথা পেতে নেব একটু আগে বলেছি। তার আগে আপনাদের সবাই-এর কাছে অনুরোধ, নতুন মাদ্রাসার ভীত দেয়া না হওয়া পর্যন্ত উনি যেন শাস্তির কথা ঘোষণা না করেন। তার কারণ উনি একটা সমস্যা সমাধানের জন্য আমার কাছে সাহায্য চেয়েছেন। আমি সাহায্য করার ওয়াদা করেছি। আশা করি, ইনশাআল্লাহ নতুন মাদ্রাসার ভীত দেয়ার আগেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারব।
কেউ কিছু বলার আগে আজরাফ হোসেন বলে উঠলেন, আমি হাবিব ডাক্তারের অনুরোধ অনুমোদন করলাম।
তিনি থেমে যেতে চেয়ারম্যান বললেন, আমিও অনুমোদন করছি।
তারপর অন্যান্য গণ্যমান্য লোকেরাও তাই বললেন।
মুশতাক বিশ্বাস কিছু না বলে চুপ করেই রইলেন।
পারভেজ আগে হাবিব ডাক্তারকে সবাই-এর মতো ভালো মনে করত। এখন তার কথা শুনে খুব মহৎ মনে হল। আব্বার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, আব্বার পক্ষ থেকে আমিও অনুমোদন করছি।
নাদের আলির ফুফু হানিফা খাতুনকে এতক্ষণ হাবিব ডাক্তার লক্ষ্য করে নি। এখন দেখতে পেয়ে তার দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করে বলল, ঐ বৃদ্ধাকে সালিশীতে ডেকে আনা উচিত হয় নি। দোষ করলে নাদের আলি করেছে, উনি তো করেন নি? একজনের দোষে অন্যজনকে শাস্তি দেয়ার অধিকার ইসলাম কাউকে দেয় নি।
চেয়ারম্যান হানিফা খাতুনকে বললেন, আপনাকে ডেকে আনার জন্য সবাই এর পক্ষ থেকে আমি মাফ চাইছি। আপনি ঘরে চলে যান।
হানিফা খাতুন চাদরমুড়ি দিয়ে ও ঘোমটা দিয়ে একপাশে গুটিশুটি হয়ে বসেছিলেন। চেয়ারম্যানের কথা শুনে উঠে চলে গেলেন।
চেয়ারম্যান সালিশীর কাজ শেষ ঘোষণা করে সবাইকে চলে যেতে বললেন। সবাই চলে যাওয়ার পর মুশতাক বিশ্বাসকে বললেন, আসলে হাবিব ডাক্তার খুব সৎ ছেলে। তার নামে সালিশ ডাকার আগে আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত ছিল। তারপর পারভেজকে বললেন, তোমার আব্বা না হয় ভুল করেছেন, শিক্ষিত ছেলে হয়ে তোমারও ভুল করা উচিত হয় নি। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। একটা কথা না বলে পারছি না, পূর্ব-পুরুষদের শত্রুতার জের জিইয়ে না রেখে মিটিয়ে ফেলাই ভালো। আপনারা যে কাজ পারেন নি, হাবিব ডাক্তার সেই কাজ করার চেষ্টা করেছেন। মনে রাখবেন, আপনাদের একটিমাত্র মেয়েকে বাঁচানোর জন্য তিনি যা করেছেন, তা দোষের নয়, বরং প্রশংসনীয়। তা ছাড়া ভেবে দেখুন, আপনি তার নামে সালিশ ডাকার পরও আপনার সমস্যার সমাধান করে দেবেন বললেন। এটা কি তার মহৎ গুণের পরিচয় নয়? কথাগুলো চিন্তা করে দেখবেন। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।
চেয়ারম্যান চলে যাওয়ার পর পারভেজ আব্বাকে বলল, আপনাকে কবে থেকে বলছি, মাতব্বরী ছেড়ে দেন, আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করে বাকি জীবন কাটান। আমার কথা শুনলে গ্রামের সবার কাছে আজ অপদস্থ হতেন না।
মুশতাক বিশ্বাস দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, তোমার কথা না শুনে ভুলই করেছি। আর সেই ভুলটা তুমি ছেলে হয়ে শুধরে দিতে না পারলেও আজ হাবিব ডাক্তার পেরেছে।
এই ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর একদিন চেয়ারম্যান কার্পাসডাঙ্গা গিয়ে হাবিব ডাক্তারকে মাদ্রাসার জন্য জমি রেজিস্ট্রি ও টাকা পয়সা আদায়ের কথা জানিয়ে বললেন, আপনি তো বলেছিলেন আপনার দাদাজী ভীত দেবেন। আপনার বাবা ও ভাইয়েরাও সঙ্গে থাকবেন। এবার তাদের সঙ্গে আলাপ করে দিন ঠিক করুন।
হাবিব ডাক্তার বলল, তাদের সঙ্গে আলাপ করা লাগবে না। কাল শুক্রবারের পরের শুক্রবার ভীত দেয়া হবে, একথা সবাইকে জানিয়ে দিন। তারা আগের দিন এসে যাবেন। এরমধ্যে মাদ্রাসার নামের সাইনবোর্ডটা তৈরি করিয়ে রাখার ব্যবস্থা করবেন।
তাতো করবই। আচ্ছা, মাতব্বর সাহেবের কি যেন সমস্যা সমাধান করে দেবেন বলেছিলেন, তা করছেন?
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, মাদ্রাসার ভীত দেয়ার সময় দাদাজী সমাধান করে দেবেন। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। আপনি কিন্তু ঐদিন সকাল সাতটার মধ্যে চলে আসবেন। একসঙ্গে নাস্তা খেয়ে সবাই রওয়ানা দেব।
ঠিক আছে আসব। এখন তাহলে আসি?
দয়া করে আর একটু বসুন, এতক্ষণ শুধু আলাপই হল। এবার চা-নাস্তা খান, তারপর যাবেন।
পরের দিনই চেয়ারম্যান কয়েকজনকে দিয়ে নিজেদের ও আশপাশের সব গ্রামে ঢেড়া পিটিয়ে দিলেন, “যে মহৎ লোকের উদ্যোগে ও যার মোটা অঙ্কের দানে কুতুবপুর গ্রামে আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তিনি……..তারিখে শুক্রবার সকাল দশটায় ভীত দেয়ার জন্য আসবেন। আপনাদের সবাইকে ঐ সময়ের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।”
কথাটা শোনার পর মুশতাক বিশ্বাস একদিন হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে বললেন……তারিখে মাদ্রাসার ভীত দেয়া হবে। তুমি তো বলেছিলে তার আগেই উকিল নোটিশের নিষ্পত্তি করে দেবে? সে ব্যাপারে তো কিছু করলে না?
হাবিব ডাক্তার বলল, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। মাদ্রাসার ভীত দেয়ার দিনই ইনশাআল্লাহ নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
মুশতাক বিশ্বাস অবাক কণ্ঠে বললেন, মাদ্রাসার ভীত দেয়ার সঙ্গে উকিলী নোটিশের কি সম্পর্ক, বুঝতে পারছি না।
মাফ করবেন, এখন আপনাকে বোঝাতে পারব না। তবে যা বললাম, তা হবেই।
মুশতাক বিশ্বাস রেগে উঠে বললেন, তুমি কী আমাকে ছেলেমানুষ পেয়েছ? যা বলবে তাই বুঝে নেব?
ছি ছি, এ কী বলছেন? আপনাকে আমি বাবার মতো মনে করি। তাই ছেলে হিসাবে যা করা উচিত, ঐদিন তাই করব। দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। তারপর আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিল।