০৬. হাবিব ডাক্তার ঢাকা থেকে
হাবিব ডাক্তার ঢাকা থেকে দু’দিন পরে ফেরার কথা বলে গেলেও ব্যাংক থেকে টাকা তোলার ব্যাপারে এক সপ্তাহ দেরি হল। বিকেলে পৌঁছে সাগীর ডাক্তারের মুখে সূতাপাড়ায় রুগীর মুমূর্ষ অবস্থার কথা শুনে দেখতে গিয়েছিল। সেই সাথে টাকাটা নাদের আলিকে দেয়ার জন্য খাঁপাড়ায় গিয়েছিল।
আজ পারভেজকে দেখে ভাবল, সেদিনের ঘটনার ব্যাপারে মুশতাক বিশ্বাস ছেলেকে পাঠান নি তো? সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করল, কারো অসুখ বিসুখ করেছে না কী?
পারভেজ বলল, না। আব্বা আপনাকে কাল সকালের দিকে যেতে বলেছেন।
কারো যখন কিছু হয় নি তখন বিকেলে গেলে হয় না? সকালের দিকে ঠাকুরপুরে দু’তিনটে রুগী দেখতে যাব।
ঠাকুরপুরে বিকেলে যাবেন। আব্বা আপনাকে অতি অবশ্য সকালে যেতে বলেছেন।
ঠিক আছে, সকালের দিকেই যাব।
তা হলে আসি বলে পারভেজ বিদায় নিয়ে চলে এল।
আজ শুক্রবার। হেলথ কমপ্লেক্স বন্ধ। তাই হাবিব ডাক্তার সকাল আটটার দিকে কুতুবপুর রওয়ানা দিল। মুশতাক বিশ্বাসের বাড়ির কাছে এসে দেখল, অনেক লোকজনের সমাগম। বৈঠকখানার উঠোনের একপাশে বড় ডেগচিতে বাবুর্চিরা রান্নাবান্না করছে। আর একদিকে তিনটে গরু ও চারটে খাসি জবাই করা হয়েছে। লোকজন সেগুলোর গোস্ত কাটাকাটি করছে। অবাক হয়ে ভাবল, আজ আতিকার বিয়ে নয় তো? সেই জন্যই কি মুশতাক বিশ্বাস আজ সকালে আসার জন্য পারভেজকে পাঠিয়েছিলেন? আবার ভাবল, তা কি করে সম্ভব? আতিকা এত সহজে রাজি হওয়ার মতো মেয়ে তো নয়? না তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে?
গ্রামের লোকজন সবাই তাকে চেনে। কয়েকজন দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, ডাক্তার সাহেব যে, আসেন আসেন।
হাবিব ডাক্তার সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? এত রান্নাবান্না কিসের?
তাদের একজন বলল, সেকথা পরে শুনবেন। এখন চলুন বৈঠকখানায় বসবেন।
পারভেজ বাবুর্চিদের সঙ্গে কথা বলছিল। তাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, আসুন আমার সঙ্গে।
যেতে যেতে হাবিব ডাক্তার বলল, কী ব্যাপার বলুন তো? এত আয়োজন কি জন্য?
আজ আমার দাদাজীর মৃত্যুবার্ষিকী। আপনি এসেছেন, আব্বা খুব খুশি হবেন। আপনার আসতে দেরি দেখে একটু আগে আব্বা কার্পাসডাঙ্গায় যেতে বলছিলেন। বৈঠকখানায় এসে বলল, বসুন, আব্বাকে ডেকে নিয়ে আসছি।
একটু পরে মুশতাক বিশ্বাসকে আসতে দেখে হাবিব ডাক্তার দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে মুশতাক বিশ্বাস বললেন, ভালো। তারপর তাকে বসতে বলে নিজেও একটা চেয়ারে বসে বললেন, শুনলাম ঢাকা গিয়েছিলেন, কবে ফিরলেন?
তিন চারদিন হল।
ওখানকার, মানে তোমাদের বাড়ির সব খবর ভালো?
মুশতাক বিশ্বাস তাকে যে একটু বাঁকা চোখে দেখেন, তা হাবিব ডাক্তার জানে। তাই আজ তার কতাবার্তায় আন্তরিকতা দেখে একটু অবাক হল। বলল, জি, সব খবর ভালো।
এমন সময় পারভেজ কয়েক পদের নাস্তা নিয়ে এলে মুশতাক বিশ্বাস বললেন, নাস্তা খেয়ে ওর সঙ্গে গল্প কর। জেনেছ বোধহয়, আজ পারভেজের দাদাজীর মৃত্যুবার্ষিকী। মসজিদে শবিনা খতম হচ্ছে। জুম্মার নামাযের পর বখশানো হবে। দুপুরে গ্রামের লোকজনদের খাওয়ান হবে। সবকিছু দেখাশোনা করতে হচ্ছে। এখন যাই, পরে আপনার সঙ্গে একটা জরুরী আলাপ করব।
কুতুবপুর গ্রামের মধ্যে বিশ্বাসপাড়ায় জুম্মা মসজিদ। তাই গ্রামের সবাই এখানে জুম্মার নামায পড়তে এসেছে। বইরাপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার চারজন শিক্ষক ও ছাত্ররাও এসেছে। জুম্মার নামাযের শেষে মিলাদ ও দোয়া দরুদ পড়ার পর বখশানোর সময় ইমাম সাহেব, হাফিজিয়া মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক যিনি হাফিজ ও মুফতি, তাকে দোয়া করার কথা বললে তিনি আবার ইমাম সাহেবকেই দোয়া করতে বললেন।
হাবিব ডাক্তার মাঝখান থেকে বলে উঠল, আপনারা বেয়াদবি নেবেন না। আমার মনে হয় মাতব্বর সাহেবরই দোয়া করা উচিত।
হাবিব ডাক্তারের কথা শুনে সমস্ত মুসুল্লী অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। মসজিদের ভিতর ও বাইরে কিছুক্ষণ নীরবতা বিরাজ করতে লাগল।
এবার হাবিব ডক্তার দাঁড়িয়ে উঠে বলল, আপনারা কেউ কিছু বলছেন না কেন, আমি কি ভুল কিছু বলে ফেললাম?
আজরাফ হোসেন জানেন, হাবিব ডাক্তার ধর্মের প্রচুর জ্ঞান রাখেন। নিশ্চয় এ ব্যাপারে কিছু বলতে চান। তাই কেউ কিছু বলার আগে বললেন, কিন্তু এখানে বেশ কয়েকজন হাফেজ ও আলেম রয়েছেন, তাঁদের উপস্থিতিতে সাধারণ একজন মানুষের দোয়া করা কি ঠিক হবে?
হাবিব ডাক্তার বলল, আমি জানি অন্যান্য ইবাদতের মতো দোয়া করাও একটা ইবাদত। শুধু তাই নয়, হাদিসে আছে, নবী (দঃ) বলেছেন, “প্রার্থনা (দোয়া) ইবাদতের মজ্জা (মূল)।” [বর্ণনায় হযরত আনাস (রাঃ)-তিরমিযী।] তা হলে চিন্তা করে দেখুন, সেই দোয়া নিজে না করে হাদিয়া-তোফা দিয়ে অন্যকে দিয়ে কি করান উচিত? তা ছাড়া যে উদ্দেশ্যে মাতব্বর সাহেব এই দোয়ার আঞ্জাম করেছেন, তাঁরই তো করা উচিত। কারণ নিজের মরহুম আব্বার ও মুরব্বীদের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করার সময় ওঁর দিল যতটা কাঁদবে, অন্য কারো দিল কী ততটা কাঁদবে? আরো দু’একটা কথা না বলে পারছি না, মৃত্যুবার্ষিকী বলে ইসলামে কোনো দলিল নেই। যদি থাকত, তা হলে সাহাবীরা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (দঃ)-এর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করতেন। মনে রাখবেন, ইসলামের যে সব জিনিসের কোনো অকাট্য দলিল নেই, সেই সব কাজ যদি সওয়াবের আশায় করা হয় এবং তা সমাজে প্রচলিত হয়ে যায়, তা হলে তাকে বেদয়াত বলে। এই যে মাদ্রাসার উস্তাদ ও ছাত্রদের দিয়ে কুরআন খতম করান হয়েছে, নিশ্চয় তাদেরকে টাকা-পয়সা। নজরানা বা হাদিয়া দেবেন। এটা ও ইসলামে জায়েজ নয়। আলেম, হাফেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রদের নজরানা বা হাদিয়া দেয়া খুব সওয়াবের কাজ, এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং এসব দেয়াও ধনীদের উচিত। কিন্তু ঐসব দিয়ে তাদের দ্বারা কুরআন খতম করান বা দোয়া করান মোটেই উচিত নয়। কারণ এসব আল্লাহর কাছে কবুল হবে না বরং এই টাকা-পয়সা দেয়া নেয়াও না-জায়েজ হবে। প্রচলিত খতমে শবিনা সম্পর্কে মুফতি মুঃ ইবরাহীম খান, খাদেম মেখল হামিউসসুন্নাহ মাদ্রাসা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম, তার লিখিত শরীয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার বইতে লিখেছেন, “খতমে শবিনা এবং শবিনা খতম মানে, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায়ই দুই তিনজন হাফেজ সাহেব মিলে, পালাক্রমে একরাতে কুরআনের খতমের প্রথা দেখা যায়। এটা ধর্মের কিছুই নয়, বরং বিদআতে সাইয়্যেয়াহ এবং মাকরূহে তাহরীমা। কেননা কুরুনো সালাসায় (তিন স্বর্ণযুগ)-এ বিশেষ পদ্ধতিতে খতমের কোনো নাম গন্ধও ছিল না। ইবাদতের আকারে ইহা সম্পূর্ণ একটি নতুন কাজ। হুজুর (দঃ) ফরমান—এবং গায়রে দ্বীনকে দীন মনে করা এবং ইহা সাওয়াবের কাজ বলে বিশ্বাস করা অবশ্যই সীমা অতিক্রম করা। কুরআন-হাদিসে অকাট্য দলিল হল,….”সাধারণভাবে কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করা হল মুস্তাহাব। আর ইহা শ্রবণ করা ওয়াজিব।” আল্লাহ কুরআন মজিদে বলেছেন, “আর যখন কুরআন পাঠ করা হয় তখন মনোনিবেশের সহিত উহা শ্রবণ করিও এবং চুপ থাকিও, যেন তোমাদের উপর রহমত বর্ষিত হয়।”[সূরা-আল আরাফ, আয়াত—২০৪, পারা—৯।] সর্বাবস্থায় সকলের জন্য কুরআন তেলাওয়াত শ্রাবণ করা, বিশেষ করে যারা মাজুর, রোগী বা প্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্তশীল, তাদের জন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অথচ শ্রবণকারী মাত্রই শ্রবণ করা ওয়াজীব। সুতরাং শ্রবণ
ত্যাগ করার কারণ যেহেতু তেলাওয়াতকারী ও এর আমন্ত্রণকারী হয়েছে। তাই। গুনাহগার তারাই হবেন। কেননা ঐ সমস্ত লোক শ্রবণ থেকে মাজুর।
আলমগীর কেতাবে আছে, “ফিকাহের কিতাব লেখায় মগ্ন ব্যক্তির নিকট যদি কেউ কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করে আর কিতাব লেখার কারণে তার জন্য শ্রবণ করা সম্ভব না হয়, তা হলে তেলওয়াতকারীই গুনাহগার হবে, লেখকের কোনো গুনাহ হবে না। এমনিভাবে রাত্রিবেলায় ঘরের ছাদের উপর যদি কেউ উচ্চস্বরে কুরআন মজিদ তেলাওয়াত করে, তা হলে সে গুনাহগার হবে। এ বর্ণনাটুকু আলোচ্য বিষয়ের সাথে মিল রাখে। হযরত আবদুল্লাহ বিন অমর এর বর্ণনা—মিশকাত শরীফ: “তিন দিনের কমে যে কুরআন খতম করে সে কুরআনের অর্থ বুঝে নাই। মিশকাত শরীফের টীকায় আল্লামা তিবি (রঃ) থেকে বর্ণিত।” সিদ্ধান্তমূলক কথা হল, কুরআন মজিদ খতম করার ব্যাপারে চল্লিশ দিনের বেশি বিলম্ব করা এবং তিনদিনের কমে শেষ করা উভয়টাই মাকরুহ।
যে সমস্ত বুজুর্গগণ একরাত্রে ও একদিনে কুরআন খতম করেছেন বলে প্রসিদ্ধ, তা ছিল সাধনামূলক। তাও আবার অতি গোপনে ও নির্জনে, প্রকাশ্যে নয়। এটা ছিল প্রভুর প্রগাঢ় ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। দাওয়াত গ্রহণ করে টাকার বিনিময়ে ছিল না। খুবই বুঝার বিষয়। আবার মাইকে পড়ার মধ্যে দ্বিগুণ গুনাহ হবে। কেননা ঐ সময় মনোযোগের সাথে শ্রবণ করা সকলের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। অথচ শ্রবণ করা ওয়াজিব। সুতরাং শবিনা খতম নিঃসন্দেহে বিদয়াত সাইয়্যেয়া এবং মাকরুহে তাহরীমা বিধায় ইহা পরিত্যাগ করা ওয়াজিব। এবং সামর্থ শক্তি অনুসারে প্রত্যেক দায়িত্ববান আলেমের জন্য এর প্রতিরোধ করা ওয়াজিব।
যেহেতু অধিকাংশ হাফেজই অন্ধ ও গায়বে আলেম বিধায় কুরআন হাদিস ও ইলমে ফিকাহ বুঝতে তারা সম্পূর্ণ অপারগ। টাকার লোভে তারা আখেরাতের ব্যাপারে আরো অন্ধ হয়ে যায়। তাকওয়া পরহেজগারীও তেমন থাকে না। অথচ ইসলামে সওয়াব হিসাবে খতমে শবিনা পড়ে পারিশ্রমিক নেয়া ও দেয়া উভয়ই হারাম। পবিত্র কালামে তার সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে। “আমার কুরআন অল্প মূল্যে বিক্রি করিও না।” [সূরা মায়েদাহ, ৩৪নং আয়াতের শেষের দিকের অংশ, পারা—৬।]
উক্ত আয়াত তেলওয়াত করে সঠিক অর্থ বুঝার ব্যাপারে অন্ধ। স্বল্প মূল্যের অর্থ তাফসীরে খাজেনে বলা হয়েছে, দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে যাবতীয় সম্পদ। পবিত্র হাদিসে আছে “তোমরা বিনিময় ব্যতীত কুরআন তেলওয়াত কর।” ফতোয়ায়ে শামীতে আছে “দাতা ও গ্রহীতা উভয়ই গুনাহগার হবে।”—৫নং খণ্ড ৪৫ পৃষ্ঠা।
খতমে শবিনা নাজায়েজ সম্পর্কে মুসলিম শরীফে আছে, “হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, হুজুর পাক (দঃ) একরাত্রে সমস্ত কুরআন তেলওয়াত করিয়াছেন। এবং সমস্ত রাত্রি ব্যাপী নামায পড়িয়াছেন বলে আমার জানা নেই। রমযান ব্যতীত অন্য কোনো সময় পূর্ণ মাস রোযা রাখেন নাই।”
সত্যায়িত
মুফতিয়ে আজম ফায়েজ উল্লাহ সাহেব (রঃ)।
শবিনা খতমের ব্যাপারে এতক্ষণ যা বললাম, মুফতি মুঃ মাওলানা ইব্রাহিম খান রচিত “শরিয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার বই এর ১৭৫ পৃষ্ঠা থেকে ১৭৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত।”
আমাদের দেশে চাল্লিশা বা মৃত্যুবার্ষিকী বা মরহুম পিতা-মাতা ও মুরুব্বীদের নামে বছরে একবার যে ওরশ করে দোয়া খায়ের করা হয়, এটারও অকাট্য দলিল নেই। আর তিন স্বর্ণযুগেও ছিল না। আপনারা শুনে অবাক হবেন, ভারত, বাংলাদেশে ও পাকিস্তান ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো ইসলামী রাষ্ট্রগুলোতে মিলাদ শরীফ পড়ান ও এইসব জিনিসের প্রচলন নেই। এমন কি মক্কা-মদিনাতেও নেই। এখন চিন্তা করে দেখুন, আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করে যেভাবে ধুমধামের সঙ্গে মৃত্যুবার্ষিকীর জন্য মিলাদ বা ওরশ ও দোয়ার ব্যবস্থা আমরা যে করে থাকি, তা কি ঠিক? আর এরকম এতকিছু করার পিছনে যদি মান-সম্মানের উদ্দেশ্য জড়িত থাকে, তা হলে তো এই সব কিছু আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। আসলে মরহুম মুরুব্বীদের রুহের মাগফেরাতের জন্য যদি ছেলেমেয়েরা কিছু করতে চান, তা হলে বছরের যে কোনো দিন গরিব মিসকীনদের খাওয়াবেন, তাদেরকে জামাকাপড় দান করবেন, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউ গরিব থাকলে তাদেরকে সবার আগে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করবেন। মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় দান করবেন অথবা গরিবদের উন্নতির জন্য উৎপাদনমূলক কোনো প্রতিষ্ঠান করে ওয়াকফ করে দিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহ করার ব্যবস্থা করবেন। আর দিনে হোক বা রাতে হোক নির্জনে একাকী কেঁদে কেঁদে এই সমস্ত কাজের অসিলা দিয়ে আল্লাহর কাছে তাদের মাগফেরাতের দোয়া করবেন। একটা কথা জেনে নিন, দোয়া হল নফল ইবাদত। নফল ইবাদত দিনে হোক, রাতে তোক গোপনে করতে হয়। এই রকম জামায়াতবদ্ধ হয়ে লোক দেখান দোয়া করার কোনো অকাট্য দলিল নেই। এমন কি ফরয নামাযের পর জামায়াতের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মোনাজাত করারও কোনো অকাট্য দলিল নেই। এ সম্পর্কে মুফতি ইবরাহিম খান রচিত “শরীয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার” বই-এর ১৪০ পৃষ্ঠার শেষ পরিচ্ছদ থেকে ১৪২ পৃষ্ঠার শেষ লাইনের উপর পর্যন্ত লেখা আছে, “আর জানা আবশ্যক, হাল জামানায় মানুষের মধ্যে ফরয নামাযের পর এক বিশেষ মোনাজাতের প্রচলন প্রসিদ্ধ। ইহাতে ইমাম মোক্তাদী সকলেই একসাথে হাত উত্তোলন করে এবং মোক্তাদীগণ আমিন আমিন বলতে থাকে। মোনাজাতের শেষ লগ্নে আল্লাহুম্মা আমিন ইয়া আরহামার রাহেমীন বলে দোয়া শেষ করে। এটাকে নামাযের মোনাজাত বলে। অনেক এলাকায় নামাযের পর মুসুল্লীগণ বসে থাকে, সুন্নত নামাযসমূহ শেষ হলে সকলে দোয়ায় মশগুল হয়। ইহাকে আখেরী মোনাজাত বলে। অথচ এ জাতীয় দোয়া হযরত নবী করিম (দঃ), খোলাফায়ে রাশেদীন ও আম্বিয়ায়ে মুজতাহিদীনগণ থেকেও কোনো দলিল বা নজীর কিছুতেই পাওয়া যায় নি। এর সম্পর্কে সহিহ তো দূরের কথা, কোনো দুর্বল হাদিসও নেই। যা অনুসন্ধানকারীগণের নিকট গোপন নয়।
জানা দরকার যে, দোয়া হল নফল কাজ এবং নফল আমলের ব্যাপারে শরীয়তভিত্তিক স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হল, একক ও গোপনভাবে করা। যৌথ ও প্রকাশ্যভাবে নয়। অর্থাৎ প্রত্যেক নফল কাজ গোপনভাবে এবং একাকীভাবে করাই হল শরীয়তের দাবি ও হুকুম। জামায়াতবদ্ধভাবে ও প্রকাশ্যভাবে নয়।
মাজহাবে হানাফির সুপ্রসিদ্ধ ও একমাত্র নির্ভরযোগ্য কিতাব হিদায়ার মধ্যে আছে, দোয়ার প্রকৃত নিয়ম হল গোপনীয়তা অবলম্বন করা; কিন্তু এস্তেসকার (বৃষ্টি বর্ষণ) ও কুসুফের (চন্দ্র গ্রহণ) নামাযের ব্যতিক্রম। এই দুটি নামায যদিও বা নফল, কিন্তু যেহেতু এ ব্যাপারে হাদিস শরীফে সম্মিলিত ও প্রকাশ্যে করার প্রমাণ রয়েছে। কাজেই উক্ত নামায জামায়াত ভিত্তিক প্রকাশ্যভাবে আদায় করতে হবে এবং এরপর দোয়াও সম্মিলিতভাবে হাত উত্তোলন করে করতে হবে। কেননা নবীয়ে করিম (দঃ) থেকে এমনিভাবে করার প্রমাণ রয়েছে। পক্ষান্তরে অন্য কোনো নফল ইবাদতের মধ্যে সম্মিলিত এবং প্রকাশ্যে করার নিয়ম নেই। বলাবাহুল্য যে, হুজুর (দঃ) এর নবুয়তী জিন্দেগীর তেইশ বছর পর্যন্ত দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের ইমামতীর কাজ নিজেই সম্পন্ন করেছেন। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে যদি মুক্তাদীগণসহ একবারও ফরয নামাযের পর সম্মিলিতভাবে দোয়া করতেন, (যা বর্তমানে করা হয়), তা হলে অবশ্যই সমস্ত বর্ণনাকারীগণ অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বর্ণনা করার প্রয়াস পেতেন। বর্তমানে দোয়া প্রমাণ করার জন্য কিয়াসের প্রয়োজন হত না। কিন্তু সহিহ, দুর্বল তো দূরের কথা, একটা মউজু (মনগড়া) দ্বারা বিশেষ আকারে প্রচলিত মোনাজাতের প্রমাণ যেমন হুজুর (দঃ) এর কাছ থেকে পাওয়া যাই নি, তেমনি সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ), তাবেয়িন (রঃ) আজমায়ে মুজতাহিদীগণের থেকেও তার কেশাগ্র পরিমাণও প্রমাণ নেই।
যে সমস্ত হযরাতে কেরামগণ উক্ত বিশেষ আকারে মোজাত করাকে মুস্তাহাব বলেন, তাদের যুক্তিভিত্তিক দলিল হল, “তারা বলেন, রেওয়ায়েত আছে। ফরয নামাযের পর দোয়া কবুল হয় এবং কতক দোয়ার মধ্যে হুজুর (দঃ) থেকে হাত উঠানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। সুতরাং বিশেষ আকারে এ দোয়া ও মোনাজাত সুন্নত হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ দলিল ও যুক্তি শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘হাবায়াম মানসুরা’ অর্থাৎ বিক্ষিপ্ত ধূলিকণার মতো সম্পূর্ণ দুর্বল ও অসার বই কিছুই নয়। তাদের এই কিয়াসের শরীয়তের নিকট কোনো মূল্য নেই। এ সাধারণ জ্ঞানতো প্রায় সকলেরই আছে যে, যেখানে পরিষ্কারভাবে শরীয়তের দলিল বিদ্যমান ফরয নামাযের পর হুজুর পাক (দঃ) কি করেছেন, তা হরফে হরফে প্রতিটি অবস্থা বর্ণনা সুরক্ষিত। সেখানে অনুমানভিত্তিক অসার কিয়াসের কোনো মূল্য নেই, থাকতেও পারে না। যদি তা মেনে নেয়া হয়, তা হলে আর দ্বীন থাকবে না। তওরাত, ইঞ্জিল, ইত্যাদির মতো দ্বীন বিকৃত হয়ে যাবে। বরং শরীয়তভিত্তিক স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হল, যতটুকু আমল করার প্রমাণ পাওয়া যায়, ততটুকুরই আনুগত্য করা। আর যার প্রমাণ নেই, তা পরিত্যাগ করা।
হুজুর পাক (দঃ) অন্ধকার রাত্রে গোপনীয়ভাবে কোথায় কি করেছেন, তাও অনুসন্ধান করে সাহাবাগণ (রাঃ) ভবিষ্যৎ উম্মতের জন্য বর্ণনা করে দিয়েছেন। নবী করিম (দঃ) এর চাল-চলনের প্রতিটি অবস্থাই বর্ণনাকারীগণ অতি যত্নের সাথে বর্ণনা করেছেন। পক্ষান্তরে প্রকাশ্যকৃত গুরুত্বপূর্ণ কাজের বর্ণনা থাকবে না, তা সম্পূর্ণ অসম্ভব ও অবান্তর কথা।”
মোনাজাতের ব্যাপারে যা কিছু বললাম, তা মাওলানা মুফতি ইবরাহিম খান রচিত “শরীয়ত ও প্রচলিত কুসংস্কার বই থেকে।”
একটা কথা প্রতিটি মুসলমানের জেনে রাখা উচিত, যে কোনো কাজ বা প্রথার যদি অকাট্য দলিল না থাকে এবং এ জাতীয় নতুন কাজ বা প্রথা দ্বীনের হেফাজত বা নির্ভরশীল না হয়, আর সেটাকে ইবাদত বা সওয়াবের কাজ বলে মানুষ মনে করে, তা হলে এসব বেদায়াতে সাইয়্যেহা অর্থাৎ মাকরুহে তাহরীমা হবে। আরো একটা কথা জানা উচিত, ইসলামের সবকিছু পরিপূর্ণ করার কথা হযরত নবী করিম (দঃ) বিদায়ী হজ্বের নয় তারিখে শুক্রবার আরাফাতের ময়দানে লক্ষাধিক পবিত্র আত্মা তথা সাহাবাগণের (রাঃ) সম্মিলিত সমাবেশে আসরের পর আয়াতে করিমা অবতীর্ণের মাধ্যমে আল্লাহ পাক ঘোষণা করলেন—”আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করিয়া দিলাম। আর আমি তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে ইমলামকেই পছন্দ করিলাম।”[ সূরা-মায়িদাহ, ৩নং আয়াতের শেষের দিকের অংশ, পারা—৬।] হাদিসে আছে, “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, আমাদের এই ধর্মে যাহা নাই এমন কোনো নতুন বিষয় যদি কেহ প্রবর্তন করে, সে অভিশপ্ত।”[ বর্ণনায় : হযরত আয়েশা (রাঃ) বুখারী, মুসলিম।] হাদিসে আরো আছে, “রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, নিশ্চয়ই সর্বাপেক্ষা উত্তম বাণী আল্লাহর কুরআন এবং সর্বাপেক্ষা উত্তম হেদায়েত (পথ প্রদর্শন) মুহাম্মদের হেদায়েত, সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট ব্যাপার নব-বিধান এবং প্রত্যেক নব-বিধানই বেদায়াত (পথ-ভ্ৰষ্টকারী)।”[ বর্ণনায় : হযরত যাবের (রাঃ)—মুসলিম।] এরপরও কি ইসলামে যার কোনো অকাট্য দলিল নেই, সেই সব নব-বিধান আমাদের মেনে চলা উচিত?
যাক, আপনাদের অনেক সময় নষ্ট করলাম, সেজন্য মাফ চাইছি। আমার কথাগুলো যদি আপনাদের মনঃপূত না হয় অথবা বিশ্বাস না হয়, তা হলে কোনো হাক্কানী আলেম অথবা কোনো মুফতি সাহেবের কাছে থেকে জেনে নিতে পারেন। অথবা মুফতি মাওলানা ইবরাহিম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আর একটা কথা না বলে থাকতে পারছি না, দেখলাম, অনেকে ক্ষীর (চালের পায়েস), জিলিপী ও বাতাসা শিনী হিসাবে নিয়ে এসেছে। এগুলো যদি তারা মানত হিসাবে এনে থাকে, তা হলে আমাদের মধ্যে যারা সাহেবে নেসাবের অধিকারী, তাদের খাওয়া না জায়েজ হবে। শুধু যারা গরিব ও সাহেবে নেসাবের অধিকারী নন, তারা খেতে পারবেন। এখন প্রচলিত প্রথামতো দোয়া না করে মাতব্বর সাহেবসহ আমরা প্রত্যেকে নিজে নিজে তাঁর মরহুম পিতার রুহের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করি আসুন বলে হাবিব ডাক্তার দু’হাত তুলে অনুচ্চস্বরে দোয়া করতে লাগল।
হাবিব ডাক্তারকে গ্রামের সবাই, বিশেষ করে গরিব অশিক্ষিতরা পীরের মতো মনে করে। তাই তাকে দোয়া করতে দেখে তারাও যখন হাত তুলে দোয়া করতে লাগল, তখন অন্যরাও তাই করতে লাগল।
খাওয়া-দাওয়ার পর পারভেজকে নিয়ে মুশতাক বিশ্বাস আলাপ করার সময় হাবিব ডাক্তারকে বললেন, মসজিদে আপনার কথা শুনে অনেকে নানারকম কথা বলছে, অনেকে আপনার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। যাক ওসব কথা, আপনাকে আসতে বলেছি একটা কথা বলব বলে। আপনি যদি মনে কিছু না করেন, তা হলে বলতে পারি।
মুশতাক বিশ্বাস এতদিনে তাকে তুমি সম্বোধন করে এসেছেন। আজ সকালেও বলেছেন। এখন আপনি করে বলতে শুনে হাবিব ডাক্তার বেশ অবাক হলেও তা প্রকাশ না করে বলল, আপনি মুরুব্বী মানুষ। এতদিন ছেলের মতো মনে করে আমাকে তুমি করে বলে এসেছেন, এখন আবার আপনি করে বলছেন কেন? তুমি করে বললে খুশি হব। আর আপনার কথা শুনে কিছু মনেই বা করব। কেন? নিশ্চিন্তে বলুন।
হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিক কথাই বলেছ। এতদিন তোমাকে ছেলের মতই দেখে এসেছি। তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, আমার মেয়ে আতিকাকেতো খুব ভালো করেই চেনো। ওর জন্য অনেক পাত্র দেখেছি, কিন্তু উপযুক্ত কাউকেই পাই নি। এই এলাকায় আসার পর থেকে তোমার সবকিছু দেখে শুনে আমরা আতিকার জন্য তোমাকে পছন্দ করেছি। কথা শেষ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
হাবিব ডাক্তার এই কথা শোনার জন্য অনেকদিন থেকে অপেক্ষা করছিলেন। তাই মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, আমার সম্পর্কে কতটুকু জেনেছেন জানি না, আমি কিন্তু বিবাহিত। আমাদের বংশ হল খাঁ। আমাদের বংশের নিয়ম হল, খ বংশ ছাড়া অন্য বংশে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেয়া হয় না। আমি অবশ্য এই নিয়ম মানি না। তাই অন্য বংশে বিয়ে করেছি।
তার কথা শুনে মুশতাক বিশ্বাস অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু আমরা তো জেনেছি তুমি এখনো বিয়ে কর নি? তারপর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমিও তো একদিন তাই বলেছিলে?
পারভেজ কিছু বলার আগে হাবিব ডাক্তার বলল, আপনারা ঠিক কথাই শুনেছিলেন। মাত্র চার-পাঁচ মাস আগে যে বিয়ে করেছি। তাই এখানকার কেউ এখনো জানে না।
মুশতাক বিশ্বাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আল্লাহ যার সঙ্গে যার জোড়া করেছেন, তার সঙ্গেই তার বিয়ে হয়। তা বাবা, তোমার বাড়ি তো ঢাকায়, সেখানে তোমার জানাশোনা কোনো ভালো ছেলে থাকলে আতিকার জন্য একটু চেষ্টা করে দেখ না। দরকার মনে করলে ওর কয়েকটা ফটো তোমাকে দেব।
ওসবের দরকার নেই। আমি আতিকাকে বোনের মতো মনে করি, তাই আগে থেকে ওর জন্য আপনাদের গ্রামেরই একটা ছেলেকে পছন্দ করে রেখেছি।
মুশতাক বিশ্বাস বেশ অবাক হলেও গম্ভীর স্বরে বললেন, ছেলেটা কে?
খাঁপাড়ার নাদের আলি। বেশি লেখাপড়া না করলেও খুব ভালো ছেলে। রুগী দেখতে আশপাশের সব গ্রামেই গেছি, নাদের আলির মতো এত ভালো ছেলে আর দেখি নি। যেমন স্বাস্থ্য তেমনি…..।
মুশতাক বিশ্বাস হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে খুব রাগের সঙ্গে বললেন, কী বলছ তুমি ডাক্তার? ঐ ছোটলোকের বাচ্চার কথা আর মুখে আনবে না। দাওমতো পেলে ওকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দেব।
তার রাগের কারণ হাবিব ডাক্তার জানে। তাই ভনিতা করে বলল, নাদের আলিকে ছোটলোকের বাচ্চা বলছেন কেন? আমি তো জানি খায়েরা খুব খান্দানী বংশ। আগে আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল। এখন না হয় গরিব হয়ে গেছে।
মুশতাক বিশ্বাস এবার খুব বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তুমি মাত্র এক দেড় দু’বছর হল এই এলাকায় এসেছ। খায়েদের সম্পর্কে আর কতটুকু জেনেছ? খাঁ বংশটাই ছোটলোক।
কিন্তু আমি তো তাদের কোনো ছোটলোকী কাজ কারবার দেখি নি। যদি তারা সে রকম হত, তা হলে নিশ্চয় কিছু না কিছু বুঝতে পারতাম।
মুশতাক বিশ্বাস গরম মেজাজে বললেন, ওদের কথা আর বলো না। যা জান না, তা নিয়ে কথা বলতে চাই না। শুধু একটা ব্যাপার বলছি, পূর্বপুরুষ থেকে খায়েদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা। আর বিশ্বাস গুষ্টি ছাড়া আমরা অন্য গুষ্টির সঙ্গে আত্মীয়তা করি না।
হাবিব ডাক্তার বললেন, বেয়াদবি নেবেন না, এ ব্যাপারে আমি দু’একটা কথা বলতে চাই। অবশ্য আপনি যদি অনুমতি দেন।
মুশতাক বিশ্বাস অসন্তুষ্টকণ্ঠে বললেন, বল কী বলতে চাও।
পূর্বপুরুষ থেকে খায়েদের সঙ্গে আপনাদের শত্রুতার কারণ আমি জানতে চাই না। তবে এখনও সেই শত্রুতা জিইয়ে রাখা কোনো পক্ষেরই উচিত হয় নি। কারণ, কুরআনে আল্লাহ বলিয়াছেন, “এক মুমীন অন্য মুমীনের ভাই।”[ বর্ণনায় হযরত আবু হোরাইয়া (রাঃ) মুসলিম।] আর হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, “এক মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। তাহাকে সে অত্যাচার করে না, অপমান করে না। এবং (বুকের দিকে ইঙ্গিত করিয়া) এইস্থানে অবস্থিত তাহার ধর্মভীরুতাকে অবজ্ঞা করে না। মুসলমান ভাইকে অবজ্ঞা করার জন্য যে পাপ হয়, উহার বিবেচনায় তিনি তিনবার স্বীয় বুকের দিকে ইঙ্গিত করিলেন। এক মুসলমান অন্য মুসলমানের জন্য হারাম। তাহার জান-মাল এবং তাহার সমান।” তিনি আরো বলেছেন, “তিনদিনের অতিরিক্ত কোনো মুসলমানের পক্ষে তাহার ভ্রাতাকে পরিত্যাগ করিয়া থাকা হালাল নহে। যে তিন দিবসের অতিরিক্ত তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া থাকে অতঃপর তাহার মৃত্যু হয়, সে দোযখে যাইবে।”[ বর্ণনায় হযরত আবু হোরাইয়া (রাঃ)—আহম্মদ, আবু দাউদ।] হাদিসে আরো আছে, রাসুলুল্লাহ (দঃ) বলেছেন, সোমবার ও বৃহস্পতিবার বেহেস্তের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। তখন শিরক (অংশীবাদী) ভিন্ন প্রত্যেক লোককে ক্ষমা করা হয়। যে দুইজনের মধ্যে বিবাদ থাকে, তাহাদিগকে ক্ষমা করা হয় না। উহাদিগকে বলা হয়, যে পর্যন্ত মীমাংসা না কর, সেই পর্যন্ত অপেক্ষা কর।”[ বর্ণনায় হযরত আবু হোরাইয়া (রাঃ)-মুসলিম।]
শুনুন মাতব্বর সাহেব মুমীন মুসলমান হয়ে শুধু খায়েদের সঙ্গেই নয়, যে কোনো মানুষের সঙ্গে শত্রুতা থাকলে মিটিয়ে ফেলুন। নচেৎ কি হবে, তাতো কুরআন হাদিসের বাণীতে শুনলেন। আপনি হজুও করেছেন, বয়সও হয়েছে। পূর্ব পুরুষরা খায়েদের সঙ্গে যে শত্রুতার বীজ বপণ করে গেছেন, তা মিটিয়ে ফেললে, আপনার ও আপনার ভবিষ্যৎ বংশধরদের ইহকালে ও পরকালে মঙ্গল হবে। এবং মরহুম পূর্বপুরুষদেরকেও আল্লাহ আপনার অসিলায় নাযাত দিতে পারেন।
কুরআন-হাদিসের বাণী শুনে মুশতাক বিশ্বাসের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হলেও বংশ মর্যাদার কথা ভুলতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, বিশ্বাসদের মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তির তুলনায় খায়েরা অনেক ছোট। তুমিই বল, তাদের সঙ্গে কী আমরা আত্মীয়তা করতে পারি? নাদের আলির না আছে বংশ মর্যাদা, না আছে ধন-সম্পদ, কি দেখে তাকে আমরা জামাই করব। তুমি তো আমাদের অবস্থার কথা জান। আতিকা কত সুখে মানুষ হয়েছে। আমাদের ঐ একটাই মেয়ে। নাদের আলি কি তাকে সেইভাবে রাখতে পারবে? তা ছাড়া আমি গ্রামের পাঁচজনের কাছে মুখ দেখাব কি করে?
হাবিব ডাক্তর বলল, আপনি খুব ভালো কথা বলেছেন। ইসলামেও কুফু অর্থাৎ সমপর্যায়ে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিতে বলা হয়েছে। তবে কুফুর ব্যাখ্যা অনেক। সে সব বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। তাই অল্পকিছু আলোচনা করছি। বিয়ের ব্যাপারে ছেলে বা মেয়ের বংশ ভালো না মন্দ অবশ্যই দেখতে হবে। যদি কোনো বংশের সমাজিক ও পারিবারিক জীবনে ধর্মের অনুশীলন থাকে, ছেলে বা মেয়ে ধার্মিক হয়, হালাল হারাম বেছে চলে এবং আর্থিক অবস্থা খুব ভালো না হলেও মোটামুটি স্বচ্ছল, তা হলে তারা কুফুর অন্তর্গত। সেখানে বংশ মর্যদার কথা চিন্তা না করে ইসলাম আত্মীয়তা করতে বলেছে। সেক্ষেত্রে বংশের গৌরব খাটে না। নাদের আলির অনেক ধন-সম্পদ না থাকলেও তার কোনো অভাব নেই। ইদানিং জমি-জয়গা করেছে, নতুন বাড়ি করেছে। তা ছাড়া তার বাপ-চাচারা যথাসম্ভব ধর্ম কর্ম মেনে চলেন। সুদের ব্যবসা করেন না, মদ-তাড়ি খান না, তা নিশ্চয় আপনি জানেন।
মুশতাক বিশ্বাস দৃঢ়স্বরে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, জানি। তবু নাদের আলির সঙ্গে আতিকার বিয়ে হবে না, হতে পারে না।
আপনি জানেন কিনা জানি না, ওরা কিন্তু স্কুলে পড়ার সময় থেকে একে অপরকে পছন্দ করে। কথাটা শেষ করে মুশতাক বিশ্বাসের মুখের দিকে হাবিব ডাক্তার তাকিয়ে রইল চেহারার কোনো পরিবর্তন হয় কিনা দেখার জন্য।
মুশতাক বিশ্বাসের মুখে রাগের চিহ্ন ফুটে উঠতে দেখে হাবিব ডাক্তার আবার বলল, আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারের কথা বলে বোধ হয় আমি ভুল করে ফেললাম, মাফ করে দিন।
পারভেজ এতক্ষণ চুপ করে সবকিছু শুনছিল। কুরআন-হাদিসের বাণী শুনে তার মনও নরম হয়েছিল। পছন্দ করার কথা শুনে খুব রেগে গেল। রাগের সঙ্গে বলল, একথা বিশ্বাস করি না। আতিকা আমার বোন। তাকে আমার থেকে কেউ বেশি জানে না। সে কিছুতেই নাদের আলিরমতো একটা, হা-ভাতে ছেলেকে পছন্দ করতে পারে না।
হাবিব ডাক্তার তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, পারভেজ ভাই, মনে হচ্ছে আপনি আমার কথা শুনে খুব রেগে গেছেন। কথাটা বিশ্বাস না হলে, আপনার স্ত্রীকে দিয়ে আতিকার কাছ থেকে সত্য মিথ্যা জানতে পারবেন। তারপর মুশতাক বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে বলল, একটু আগে বললাম না, আতিকাকে আমি বোনের মতো মনে করি? তাই তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে নাদের আলির সবকিছু খোঁজ খবর নিই। একমাত্র আর্থিক দিক ছাড়া অন্য সবকিছুতে আতিকার উপযুক্ত। আপনার এক ছেলে এক মেয়ে। আপনি মারা যাওয়ার পর আতিকা অনেক সম্পত্তি পাবে। ইচ্ছা করলে বিয়ের সময় তাকে তার অংশ দিয়ে দিতে পারেন। তা হলে নাদের আলি গ্রামের ধনীদের একজন হয়ে যাবে। এতে করে আপনার সুনামও বাড়বে। ওদের কথাটা অনেকদিন থেকে আপনাকে জানাব ভেবেছিলাম, সময় সুযোগের অভাবে জানাতে পারি নি। আজ আপনি আতিকার বিয়ের কথা তুলতে বললাম। এখন আপনাদের মর্জি। এবার যাওয়ার অনুমতি দিন বলে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মুশতাক বিশ্বাস গম্ভীরস্বরে বললেন, একটা কথার উত্তর দিয়ে যাও।
বেশ তো বলুন।
গত বন্যায় নাদের আলি পথের ভিখারী হয়ে গিয়েছিল, এই একদেড় বছরের মধ্যে কি করে এত উন্নতি হল বলতে পার?
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, তা আমি কি করে বলব? সে তো এই গ্রামের ছেলে। আপনাদেরই তো জানার কথা। তবে এতটুকু বলতে পারি, সবই আল্লাহর ইচ্ছা। তিনি মুহূর্তে আমীরকে ফকির ও ফকিরকে আমীর করতে পারেন।
মুশতাক বিশ্বাস একইস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ওদের দু’জনের পছন্দের কথা তুমি জানলে কী করে? নিশ্চয় নাদের আলি বলেছে?
আমাকে বলার মতো সাহস নাদের আলির নেই। কে বলেছে জানতে চাচ্ছেন কেন? তারা যে এখনো দেখা সাক্ষাৎ করে, তা শুধু আমিই নই, গ্রামের অনেকেই জানে। সাহস করে কেউ আপনাকে জানাতে পারে নি। তাই বলছিলাম, কথাটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ার আগে ওদের বিয়ে দিয়ে দিলে চাপা পড়ে যেত। আপনাদের মান-সম্মানেরও হানি হত না। তারপর আসি বলে সালাম বিনিময় করে হাবিব ডাক্তার চলে গেল।
আতিকা ও নাদের আলির সম্পর্কের কথা শোনার পর থেকে পারভেজ রেগে রয়েছে। হাবিব ডাক্তার চলে যাওয়ার পর রাগের সঙ্গে আব্বাকে বলল, আপনি নাদের আলির সঙ্গে আতিকার সম্পর্কের কথা জানতেন?
ছেলে খুব রেগে আছে মুশতাক বিশ্বাস বুঝতে পেরে বললেন, মাথা গরম করবে না। যা করার চিন্তা ভাবনা করে করতে হবে।
তা না হয় করা যাবে? ওদের সম্পর্কের কথা জানতেন কিনা বলুন।
আগে জানতাম না, কিছুদিন আগে বইরাপাড়া হাফেজিয়া মাদ্রাসার মিটিং সেরে ফেরার সময় মাঝপাড়ার রশিদ শেখের পুকুরপাড়ে আতিকাকে নাদের আলির সঙ্গে কথা বলতে দেখি। সঙ্গে গিয়াস ছিল, সেও তাদেরকে দেখেছে। ঐদিনই গিয়াসকে তার লোকজন নিয়ে গভীর রাতে নাদের আলির হাত-পা ভেঙ্গে দিতে বলি। গিয়াস লোকজন নিয়ে গিয়েছিল, তারপর যা ঘটেছে বললেন।
আব্বার কথা শুনে পারভেজের রাগ পড়ল। বলল, নাদের আলির বাস্তুতে জিন থাকে, কই, আমি তো কখনো শুনি নি?
তুমি তো সেদিনের ছেলে, আমিই কোনো দিন শুনি নি। এখন ওসব কথা বাদ দাও। আমি চিন্তা করছি, হাবিব ডাক্তারের কথা। সে কেন নাদের আলির সঙ্গে আতিকার বিয়ে দেয়ার এত আগ্রহী?
পারভেজ বলল, উনি মহৎ লোক, হয়তো বিয়ের মাধ্যমে দু’বংশের শত্রুতা মিটিয়ে দিতে চান।
মনে হচ্ছে তোমার কথা ঠিক। তবু আমার যেন কেমন মনে হচ্ছে, তার আরো কোনো উদ্দেশ্য আছে।
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না। আর যদি থেকেও থাকে, তা হলে ভালো ছাড়া মন্দ হতে পারে না। কেননা ওঁর মতো ছেলে কারো ক্ষতি করতে পারেন না। তবে নাদের আলির সঙ্গে আতিকার বিয়ে কিছুতেই হতে পারে না।
তাতো নিশ্চয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভালো ছেলে দেখে আতিকার বিয়ে দিতে হবে। আমার আর একটা ব্যাপার সন্দেহ হচ্ছে, নাদের আলির উন্নতির পিছনে হাবিব ডাক্তারের হাত আছে।
আপনার এরকম মনে হল কেন?
তা না হলে হঠাৎ করে নাদের আলি এত টাকা-পয়সা পেল কোথায় যে, এই দেড় বছরের মধ্যে এতকিছু করে ফেলল। গ্রামে এমন কেউ কি আছে, যে নাকি তাকে শুধু শুধু টাকা-পয়সা দেবে? আল্লাহ ইচ্ছা করলে যাকে ইচ্ছা ধনী-গরিব করতে পারেন ঠিক, তবে তিনি তা কারো দ্বারা করিয়ে থাকেন। এবার আমার সন্দেহের কারণটা নিশ্চয় বুঝতে পারছ?
জি পেরেছি।
তা হলে এক কাজ কর, হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে তোমার তো খুব জানাশোনা, বুদ্ধি করে তার কাছ থেকে জানার চেষ্টা কর।
পারভেজ বলল, ঠিক আছে আব্বা, তাই জানার চেষ্টা করব।