০৫. কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান
কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান খুব সৎ ও ধার্মিক। তার বাড়ি কুতুবপুর গ্রামের কাঁটাবাগান পাড়ায়। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো হলেও সংসারে অভাব অনটন নেই। মুশতাক বিশ্বাস টাকার জোরে কয়েকবার চেয়ারম্যান হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সৎ ও ধার্মিকতার কারণে অর্থবল না থাকলেও আজিজুর রহমানকে প্রতিবারেই জনগণ ভোট দিয়ে জিতিয়েছে। আর পনের বছর তিনি চেয়ারম্যানি করছেন। তার সুনাম সারা ইউনিয়নে। সরকারের কাছ থেকে যা কিছু সাহায্য আসে, তা জনগণের কল্যাণে ব্যয় করেন। তা থেকে তিনি এক কানাকড়িও যে আত্মসাৎ করেন না, সে কথা জনগণ জানে। তাই সকলের কাছ থেকে শ্ৰেণীমতো ভক্তিশ্রদ্ধা পান।
মুশতাক বিশ্বাস অল্প শিক্ষিত হলেও খুব চালাক চতুর লোক। তিনি গ্রামের মাতব্বর। লোক হিসাবে যে খুব খারাপ তা নয়, ধনীরা সাধারণত কৃপণ হয়, গরিবদের সাহায্যের নামে তাদের জমি-জায়গা আত্মসাৎ করে। কিন্তু তিনি সে রকম লোক নন। গরিবদের আপদে বিপদে সাহায্য করেন। নিয়মিত নামায রোজা করেন। হজ্বও করেছেন। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসার উন্নতির জন্য টাকা পয়সা দান করেন। তবু যে কেন তার সুনাম জনগণ না করে চেয়ারম্যান আজিজুর রহমানের সুনাম করে, তা তিনি বুঝতে পারেন না। এক ধরনের মানুষ থাকে তারা বড়লোকী জাহির করতে চায়, অহঙ্কারী হয়, তোষামোদ ভালবাসে, অপরের মুখে সুনাম শুনতে পছন্দ করে, মুশতাক বিশ্বাস ঐ ধরনের লোক। তাই নিজেই লোকদের সঙ্গে পরামর্শ করে কয়েকবার চেয়ারম্যান পদে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু হতে না পেরে আজিজুর রহমানের উপর ক্ষুব্ধ। কয়েকজন গুপ্তচর লাগিয়েছেন তার দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য, কিন্তু তাতেও সফল হতে পারেন নি। দুই রাজার মধ্যে যুদ্ধ হলে যিনি হেরে যান, তিনি যেমন রাজ্য হারাবার ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিজেতার বশ্যতা স্বীকার করে নেন, তেমনি আজিজুর রহমানের কাছে বারবার হেরে গিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মনের খায়েশ চেপে রেখেছেন। তবে একদম হাল ছাড়েন নি। সুযোগের অপেক্ষায় আছেন। ইদানিং হাবিব ডাক্তারের সুনাম লোকের মুখে মুখে জেনে পুরোনো স্বভাবটা চাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই তার পিছনেও লোক লাগিয়েছেন দোষত্রুটি খুঁজে বের করার জন্য।
গিয়াস খুব চতুর লোক। জমির ফসলে সারা বছরের খোরাকী হয়ে যায়। বাজার হাট করার জন্য মুশতাক বিশ্বাসের চামচাগিরি করে যা পায় তাতে চলে যায়। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ছোট সংসার। সারাদিন গ্রামে ঘুরে ফিরে লোকের ছিদ্র অন্বেষণ করে বেড়ায়, রাতে সে সব মুশতাক বিশ্বাসের কাছে তিলকে তাল করে বলে। মুশতাক বিশ্বাস তার উপরেই ভার দিয়েছেন হাবিব ডাক্তারের দোষ খুঁজে বের করার জন্য। বেশ কিছুদিন থেকে হাবিব ডাক্তারকে পশ্চিমপাড়ায় ঘন ঘন যেতে দেখে গিয়াস তাকে ফলো করে জানতে পারল, হেড মাস্টার আজরাফ হোসেনের সঙ্গে তার বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আরো জানতে পারল, পঙ্গু হাশেম আলিকে ফ্রি চিকিৎসা করে ভালো করেছে এবং তার দু’বার বিধবা হওয়া মেয়ে যীনাতের সঙ্গে নিরিবিলিতে আলাপ করে। ইদানিং মাঝে মধ্যে বেশ রাতে তাকে পশ্চিমপাড়া থেকে ফিরতেও দেখেছে। তার সন্দেহ হল, তা হলে কি যীনাতের সঙ্গে ডাক্তারের কোনো অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে? কথাটাতো মাতব্বর সাহেবকে জানান দরকার?
প্রতিদিন বৈঠক খানায় এশার নামাযের পর ঘণ্টা খানেক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে গ্রামের লোকজন মুশতাক মাতব্ববের কাছে আসে। আজও এসেছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর গিয়াসকে বসে থাকতে দেখে বললেন, কি গিয়াস, তুমি তো দেখছি কোনো কাজের লোক নও। প্রায় সাত আট মাস হয়ে গেল, হাবিব ডাক্তারের কোনো খোঁজ খবর দিতে পারলে না।
গিয়াস বলল, মাতব্বর সাহেব, এসব কাজ কি আর তাড়াতাড়ি হয়। এতদিনে যা জেনেছি, বলছি। তারপর হাবিব ডাক্তারের সম্পর্কে যা জেনেছে বলল।
মুশতাক বিশ্বাসের মুখে ক্রুর হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বললেন, খুব সাবধানে হাশেম আলির বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখবে। হাবিব ডাক্তার তার মেয়ের সঙ্গে অসামাজিক কাজে জড়িত আছে কিনা জানবে। বেটা ঘুঘু দেখেছে ফঁদ দেখে নি। ডাক্তার হয়ে হুজুরগিরী ছাড়িয়ে দেব।
গিয়াস বলল, মাতব্বর সাহেব, আর একটা খবর আছে, নাদের আলি দু’কামরা পাকা দালান বানাচ্ছে।
কি বললে গিয়াস, নাদের আলি দালান বাড়ি বানাচ্ছে? যে নাকি কামলাগিরী করে পেট চালায়, সে আবার দালান বাড়ি বানায় কি করে?
আমিও তাই বলি। একদিন নাদের আলিকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এত টাকা কোথায় পেলে, দালান বাড়ি করছ?
বলল, কোথায় আবার পাব? আল্লাহ দিয়েছে!
হুঁ বলে মুশতাক বিশ্বাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, নাদের আলির টাকার উৎস খুঁজে বের করবে।
সে কথা বলা লাগবে না মাতব্বর সাহেব। আপনি বলার আগেই কাজে নেমে পড়েছি। তেমন কোনো সন্ধান পাই নি। তবে মাঝে মধ্যে নাদের আলিকে কার্পাসডাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্সে যেতে দেখেছি। আর হাবিব ডাক্তারকেও নাদের আলির সঙ্গে মাঝে মধ্যে পথে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরে আলাপ করতেও দেখেছি।
তোমার কি মনে হয়, হাবিব ডাক্তার দালান বাড়ি করার জন্য নাদের আলিকে টাকা দিচ্ছে?
ঠিক তা মনে হয় নি। তবে একটু সন্দেহ হয় আর কি?
এই বুদ্ধি নিয়ে তুমি আমার চামচাগিরী কর? হাবিব ডাক্তারের কি এমন স্বার্থ যে, দালান বাড়ি করার জন্য নাদের আলিকে টাকা দেবে? শোন, নাদের আলির টাকার উৎস খোঁজার সাথে সাথে হাবিব ডাক্তারের সম্পূর্ণ পরিচয় জানার চেষ্টা করবে।
ঠিক আছে, তাই করব?
মুশতাক বিশ্বাস বুক পকেট থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে তার হাতে দিয়ে বললেন, এবার যাও।
গিয়াস দোতা হাসি দিয়ে বলল, আসি মাতব্বর সাহেব। তারপর সালাম দিয়ে চলে গেল।
মুশতাক বিশ্বাস তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, নাদের আলির টাকার উৎস যেমন করে তোক জানতে হবে। গিয়াস হাবিব ডাক্তারকে সন্দেহ করছে। কিন্তু সেই বা এত টাকা পাবে কোথায়? বেতন আর কত টাকা পায়? বড় জোর চার-পাঁচ হাজারের মতো? হঠাৎ মনে পড়ল, কয়েকমাস আগে হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে মেয়ের আলাপ করার কথা। ভিতর বাড়িতে গিয়ে মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, হাবিব ডাক্তার লোকটা কেমন বলতে পারিস?
আব্বাকে হঠাৎ এরকম প্রশ্ন করতে শুনে আতিকা অবাক হল। সেই সাথে একটু ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, কেমন লোক তাতো তুমিও জান। তোমার যখন কঠিন অসুখ হয়েছিল তখন তিনিই চিকিৎসা করে ভালো করেছিলেন।
আমি তো জানি সে ভালো ডাক্তার। লোক হিসাবে কেমন জিজ্ঞেস করেছি।
লোক হিসাবেও খুব ভালো। তার মতো ভালো মানুষ আর দেখি নি।
তোর সঙ্গে দেখা হয়?
দেখা হয়, তবে ইদানিং দেখা হয় নি।
কিছুদিন আগে দেখলাম, তুই রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ তার সঙ্গে কথা বলছিলি? তার পরিচয় জানিস না কি?
এই কথা শুনে আতিকা আরো ঘাবড়ে গেল। ভাবল, সেদিন আমাদের কথাবার্তা আব্বা শুনে নি তো? সামলে নিয়ে বলল, না আব্বা জানি না। তবে ভাইয়া জানে; সে হেড মাস্টার আজরাফ স্যারের কাছে শুনেছে।
ঠিক আছে তুই যা। তারপর মুশতাক বিশ্বাস চিন্তা করলেন, ছেলের কাছে জানার আগে আজরাফ মাস্টারের কাছেই শোনা দরকার।
সেখানে মুশতাক বিশ্বাসের স্ত্রী শাফিয়া বানু ছিলেন। মেয়ে চলে যাওয়ার পর বললেন, তোমার অসুখের সময় আমি হাবিব ডাক্তারকে দেখেছি, আতিকার কথাই ঠিক। আমার কাছেও খুব ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছে।
মুশতাক বিশ্বাস স্ত্রীকে আদর করে শুধু বানু বলে ডাকেন। তার কথা শুনে বললেন, বলত বানু, হাবিব ডাক্তার কি আমার থেকে ভালো মানুষ?
শাফিয়া বানু এরকম প্রশ্নের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। থতমত খেয়ে বললেন, এ আবার কি রকম কথা বলছ? “কি সে কী, আর পান্তাভাতে ঘি।” জান না, মেয়েদের কাছে স্বামী সবার থেকে বড়। তোমার মতো স্বামী পেয়ে আমি ধন্য।
মুশতাক বিশ্বাস তৃপ্তির হাসি হেসে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তোমার মতো স্ত্রী পেয়ে আমিও ধন্য।
শাফিয়া বানু বললেন, ছাড় ছাড়, কেউ এসে পড়বে। বুড়ো হলে তবু আগের মতো রয়ে গেলে।
মুশতাক বিশ্বাস হাসতে হাসতে বললেন, আরে বানু, মানুষ বুড়ো হলেও মন তো আর হয় না। মন চিরকাল কচিই থাকে।
থাক তুমি তোমার কচি মন নিয়ে। আমি চললাম সবাইকে খেতে দিতে হবে বলে শাফিয়া বানু চলে গেলেন।
পরের দিন সকালে রসু নামে আর একজন চামচাকে সঙ্গে নিয়ে মুশতাক বিশ্বাস পশ্চিমপাড়ায় আজরাফ মাস্টারের বাড়িতে গেলেন।
আজ কিসের জন্য যেন স্কুল বন্ধ। আজরাফ হোসেন বাড়িতে ছিলেন। তাদেরকে দেখে এগিয়ে এসে সালাম বিনিময় করে বললেন, কি সৌভাগ্য, মাতব্বর সাহেব হঠাৎ গরিবের বাড়ি? তারপর বৈঠকখানায় নিয়ে এসে বসতে বললেন।
বসার পর মুশতাক বিশ্বাস বললেন, শুনলাম এত বছর পর তোমার ছেলে হয়েছে?
হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। সব কিছুই আল্লাহর ইচ্ছা। দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন ওকে হায়াতে তৈয়েরা দান করেন।
তাতো করবই। তা তোমার হাশেম আলি চাচা কেমন আছে?
উনি তো এখন প্রায় সুস্থ। সংসারের কাজকর্ম করতে পারেন। তবে ডাক্তার ভারি কোনো কাজ করতে ও বেশি হাঁটাহাঁটি করতে নিষেধ করেছেন।
হাবিব ডাক্তারের চিকিৎসায় নাকি সুস্থ হয়েছে?
হ্যাঁ, এখনো চিকিৎসা চলছে। সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ হিসাবে হাবিব ডাক্তারের মতো ছেলে হয় না।
এমন সময় যীনাত তিন কাপ চা ও বিস্কুট একটা ট্রেতে করে নিয়ে এসে সালাম দিয়ে বলল, মাতব্বর চাচা কেমন আছেন?
মুশতাক বিশ্বাস তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না।
যীনাত কিছু বলার আগে আজরাফ হোসেন বললেন, চিনতে পারলেন না? ওতো হাশেম আলি চাচার মেয়ে যীনাত।
কি করে চিনব বল, ওড়না দিয়ে যেভাবে মুখ ঢেকে রেখেছে।
একথা শুনে যীনাত ট্রে রেখে চলে গেল।
আজরাফ হোসেন বললেন, ওতো কখনও মুখ খোলা রেখে কারো সামনে আসে না। হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় থেকে ঐভাবে মুখ ঢেকে স্কুলে যেত। আমি তো ওর চাচাত বড় ভাই। আমার সামনেও ঐভাবে মুখ ঢেকে আসে।
তাই নাকি? এতটা কিন্তু ভালো না। বড় ভাই বা বাপ-চাচার বয়সী লোকেদের সামনে মুখ খোলা রাখলে দোষ কি?
আমি ওকে একদিন সে কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলল, শরীয়তে যে চোদ্দজনকে বিয়ে করা হারাম বলা হয়েছে, তাদেরকে ছাড়া সবাইকেই পর্দা করতে হবে। যীনাত তো তবু পর্দা করে আমার সামনে আসে, চাচি আম্মাতো পর্দা করেও আসতেন না।
আজকাল তো শরীয়তের আইন কেউই মেনে চলে না। ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে লেখাপড়া করছে? চাকরি-বাকরি করছে।
কেউ মেনে না চললেও যে মেনে চলে, তাকে কিছু বলা উচিত নয় বরং তাকে শ্ৰেণীমতো ভক্তি শ্রদ্ধা করা উচিত।
এই প্রসঙ্গ এড়াবার জন্য মুশতাক বিশ্বাস বললেন; ওকে আগে একবার দেখেছিলাম, এখনতো দেখছি বেশ মোটা-সোটা হয়েছে। তাই চিনতে পারি নি। তারপর হাশেম আলির বাস্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ওখানে পাকা দালান দেখেছি, ওটা কার?
হাশেম আলি চাচার।
মুশতাক বিশ্বাস অবাক হয়ে বললেন, সে তো সব জমি-জায়গা বিক্রি করে দিয়েছে, পাকা দালান করল কি করে?
হাবিব ডাক্তার যীনাতকে বিয়ের আগে পাকা বাড়ি করে দিয়েছে। সে কথা কাউকে জানাতে নিষেধ করে দিয়েছিল। তাই আজরাফ হোসেন বললেন, আমিই করে দিয়েছি। বন্যায় মাটির বাড়ি ধ্বসে গিয়েছিল। ভাবলাম, মাটির বাড়ি করলে আবার যদি বন্যায় ধ্বসে যায়, তাই পাকাই করে দিলাম।
আজরাফ হোসেন যে খুব দিল-দরিয়া লোক, তা মুশতাক বিশ্বাস জানেন। বললেন, ভালই করেছেন, হাজার হোক চাচা তো। তা হাবিব ডাক্তার এদিকে আসে?
রুগী দেখতে এলে আসেন। তা ছাড়া আগে আমার স্ত্রীর পেটে যখন সন্তান আসে তখন থেকে মাসে একবার দেখতে আসতেন। চাচার অসুখের কথা জেনে তার চিকিৎসা করার জন্য আসতেন। এখনও আমার সন্তানকে ও চাচাকে দেখতে আসেন।
আচ্ছা মাস্টার, গ্রামের সবার মতো তুমিও তার প্রশংসা করলে; কিন্তু তার পরিচয় জেনেছ?
আপনি বোধহয় জানেন না, মানুষের ব্যবহারই তার বংশের পরিচয়।
তা আর জানব না? আমি বলছি কার ছেলে? কোথায় বাড়ি, এসব জান কিনা?
আজরাফ হোসেন জানেন, মাতব্বর কোনো মতলব ছাড়া স্বশরীরে কোথাও হাজির হন না। তাই তাকে একজন চামচাসহ আসতে দেখে যা অনুমান করেছিলেন, এতক্ষণ আলাপের মাধ্যমে তা দৃঢ় হল। বললেন, জানব না কেন? সুপ্রিমকোর্টের বিখ্যাত ব্যারিস্টার খলিলুর রহমানের চার ছেলের মধ্যে হাবিব ডাক্তার ছোট। ওর বাবার ঢাকায় কয়েকটা বাড়ি আছে। বড় ভাই পুলিশ বিভাগের ডি.জি.। মেজ ও সেজ ব্যবসা করে।
মুশতাক বিশ্বাস অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আজরাফ হোসেনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, হাবিব ডাক্তার বুঝি তোমাকে তাই বলেছে?
হ্যাঁ, আপনার কী বিশ্বাস হচ্ছে না?
বিশ্বাস হওয়া কি সম্ভব? ও যে তোমার কাছে গুল ছেড়েছে, এই সামান্য ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না? যদি অত নামি-দামি বড়লোকের ছেলে হবে, তা হলে শহরের আরাম-আয়েশ ছেড়ে এই অজপাড়াগাঁয়ে ডাক্তারী করতে আসবে কেন?
আমি তাকে যতটুকু জেনেছি, তাতে মনে হয়েছে, তিনি মহৎ গুণের অধিকারী। তাই অজপাড়াগাঁয়ের গরিব মানুষের সেবা করতে এসেছেন।
কথাটা মুশতাক বিশ্বাস অস্বীকার করতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, কি জানি, হয়তো তোমার কথা ঠিক। যাক, এবার আসি হলে বলে মুশতাক বিশ্বাস চামচাকে বললেন, চল রে রসু, অনেক বেলা হয়ে গেল।
ফেরার পথে চিন্তা করলেন, যীনাত তার মায়ের মতো পর্দানশীল মেয়ে। সে কখনও ডাক্তারের সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে না। আর ডাক্তারও সে ধরণের ছেলে নয়। হাশেম আলির চিকিৎসা করতে গেলে সে সময় হয়তো দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা হয়। আর সেটা দেখেই গিয়াস তাদের সম্পর্কে ঐরকম কথা বলেছে। সে রকম কিছু হলে আজরাফ মাস্টার নিশ্চয় জানতে পারত। জানার পর ডাক্তারের সঙ্গে সম্পর্কও রাখত না। আরো চিন্তা করলেন, আতিকা বলল, পারভেজ ডাক্তারের সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। তাকেও জিজ্ঞেস করতে হবে। ডাক্তারদের পদবী কী জানতে হবে। সবকিছু মিলে গেলে আতিকার সঙ্গে বিয়ে দিলে ভালোই হবে।
বাড়িতে এসে এক সময় ছেলেকে বললেন, হাবিব ডাক্তারের সুনাম গ্রামের লোকের মুখে মুখে, সে কি সত্যিই ভালো?
পারভেজ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছে আব্বা তোষামোদী খুব পছন্দ করেন। কারো সুনাম সহ্য করতে পারেন না। সব সময় পরের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়ান। সেজন্য দু’চারজন চামচা ধরনের লোক নিযুক্ত করেছেন। কারো দোষ-ত্রুটির খবর পেলে বিচার করেন। নিজের সুনাম শুনতে খুব ভালবাসেন। সেজন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রতিবছর যাকাত দেন। মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুলে অনেক টাকা দান করেন। গ্রামের গরিবদেরও কিছু কিছু দান করেন। পারভেজ আব্বার এসব কাজে সন্তুষ্ট না থাকলেও কখনো কিছু বলে নি। হজ্ব করে আসার পর পারভেজ ভেবেছিল, আব্বা এবার হয়তো ঐসব খেয়াল ত্যাগ করে আল্লা বিল্লাহ করে কাটাবেন। কিন্তু আগের মতই সবকিছু করতে দেখে একদিন বলল, আপনি মাতব্বরী ছেড়ে দেন। মাতব্বরী করতে গিয়ে যে সময় নষ্ট করেন, সে সময় আল্লাহর জিকির আজকার করুন।
মুশতাক বিশ্বাস ছেলেকে নিজের মতো করে মানুষ করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সফল হন নি। এক ছেলে বলে তেমন শাসনও করতে পারেন নি। তবে নিজে অল্প শিক্ষিত হলেও ছেলে বি.এ. পাশ করছে তাতেই গর্বিত। ছেলের কথা গর্বের সঙ্গে গ্রামের লোকজনের কাছে বলে বেড়ান। ছেলে যে তার প্রতি এইসব কাজের জন্য অসন্তুষ্ট তা বোঝেন। তাই তিনিও ছেলের প্রতি অসন্তুষ্ট। এখন তার কথা শুনে বললেন, এসব কেন করি, এতদিনে তোমার বোঝা উচিত ছিল। বুঝলে একথা বলতে না। মনে করেছিলাম, আমার বয়স হয়েছে, এবার তোমাকে মাতব্বরীটা দেব; কিন্তু তুমি তো আবার এসব পছন্দ কর না। যাক, এসব ব্যাপার নিয়ে আর কোনো কথা বলবে না।
এরপর থেকে পারভেজ আব্বাকে কিছু বলে নি। আজ হাবিব ডাক্তার ভালো কিনা জিজ্ঞেস করতে ভাবল, তার সুনাম আব্বা সহ্য করতে পারছেন না। বলল, গ্রামের সবাইয়ের মুখে যখন হাবিব ডাক্তারের সুনাম তখন নিশ্চয় তিনি ভালো।
গ্রামের সবাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করি নি, তোমার মতামত জানতে চাইছি?
তার মতো ভালো মানুষ আজকালের যুগে দেখা যায় না।
তুমি তার পরিচয় জান?
জানব না কেন? তার সঙ্গে আমার খুব ভালো জানাশোনা।
কোথায় বাড়ি? কার ছেলে? তিনি কি করেন? এসব জান?
হাবিব ডাক্তারের সম্পর্কে আজরাফ হোসেন যা বলেছিলেন, পারভেজও তাই বলল।
মুশতাক বিশ্বাস অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমিও তাকে ভালো মনে করি। তাই কতটা ভালো তোমার কাছে জানতে চাইলাম। আচ্ছা, ডাক্তার বিয়ে করেছে কিনা জান?
না, উনি এখনো বিয়ে করেন নি।
তাই নাকি? আমি তো মনে করেছিলাম, বৌ, ছেলেমেয়ে আছে। ওদের পদবী কি জান?
হাবিব ডাক্তারের দাদাজী হাসিবুর রহমান বিশ্বাস বংশের ঔরসে জন্ম নিলেও তার খালা-খালু খাঁ বংশের এবং তারা তাকে মানুষ করেছিলেন বলে তিনি খান পদবী গ্রহণ করেন। তাই হাবিব ডাক্তার পারভেজকে বলেছিল, তাদের পদবী খান। এখন মুশতাক বিশ্বাস ছেলেকে তাদের পদবী জিজ্ঞেস করতে পারভেজ বলল, খান।
পদবী শুনে মুশতাক বিশ্বাস কপাল কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
পারভেজ বলল, ডাক্তারের পদবী খান শুনে মনে হচ্ছে বিরক্ত হয়েছেন?
মুশতাক বিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে বললেন, ভেবেছিলাম, ওর সঙ্গে আতিকার বিয়ে দেব; কিন্তু তুমি তো আমাদের বংশ গৌরব ও বংশের রীতিনীতি জান। বিশ্বাস বংশ ছাড়া অন্য কোনো বংশে আমরা ছেলেমেয়ের বিয়ে দিই না। বিশেষ করে খাঁ বংশকে আমরা কেন ঘৃণা করি, তা তুমিও জান। তাই ডাক্তার খা বংশের ছেলে জেনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
আব্বার অসুখের সময় যখন হাবিব ডাক্তারকে নিয়ে এসে চিকিৎসা করিয়েছিল, তখন তাকে আতিকার মতো পারভেজেরও খুব ভালো লেগেছিল। তারপর হেড স্যার আজরাফের কাছে পরিচয় জেনে তার প্রতি আরো ভক্তি-শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। তখন থেকে একটা কথা বারবার তার মনে হয়, ডাক্তারের সঙ্গে আদরের একমাত্র বোন আতিকার বিয়ে হলে সে সুখী হবে। কিন্তু আব্বা যে বিশ্বাস বংশ ছাড়া অন্য বংশে কিছুতেই আতিকার বিয়ে দেবেন না, তা জানে। তাই মনের ইচ্ছা এতদিন চেপে রেখেছিল। এখন আব্বার কথা শুনে সেই ইচ্ছাটা প্রবল হল। ভাবল, আব্বাকে যেমন করে তোক রাজি করাতেই হবে। তাই সাহস করে নিজের ইচ্ছার কথা বলে বলল, আজকাল কেউ বংশ বিচার করে না। বিচার করে ছেলের চরিত্র ও তাদের খানদান ভালো না মন্দ। ছেলে হিসাবে হাবিব ডাক্তার যে কত ভালো, তা আপনি, আমি ও গ্রামের সবাই জানে। আর তার বাবার সম্পর্কে যা জেনেছি, তাতে মনে হয়, তিনি ধনী ও উচ্চ খানদানী বংশের ছেলে। আমার মনে হয়, বিয়ের আগে বা পরে তার বাবার পরিচয় জানার পর কেউ বংশ নিয়ে কথা তুলবে না। তা ছাড়া আপনি বোধহয় জানেন না, ইসলাম শুধু নিচু বংশে মানে যারা নাকি ছোটলোক অসভ্য, নীচ তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে নিষেধ করছে। নচেৎ ইসলামে উঁচু নিচু বংশ বলে কিছু নেই। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে যারা আল্লাহকে ভয় করে তাঁর ও তাঁর রাসূল (দঃ) এর পথে জীবন পরিচালিত করে, তারাই দুনিয়াতে যেমন উচ্চ বংশ বলে পরিচিত, তেমনি পরকালেও আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা বেশি। আপনি আর অমত করবেন না আব্বা।
শাফিয়া বানু কিছুক্ষণ আগে এসে তাদের কথা শুনছিলেন, ছেলে থেমে যেতে বললেন, ডাক্তারকে আমারও খুব পছন্দ। আতিকার সঙ্গে মানাবে ভালো। পারভেজ ঠিক কথা বলেছে, তুমি রাজি হয়ে যাও।
মুশতাক বিশ্বাস ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, তুমি এখন যাও। চিন্তা-ভাবনা করে দেখি। আর শোন, ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হলে একবার আমার কথা বলে আসতে বলবে।
পারভেজ চলে যাওয়ার পর শাফিয়া বানু বললেন, মেয়ের বয়স কত হল খেয়াল আছে? কবে থেকে তো পাত্র খুঁজছ, কই, কিছু করতে পারলে? আমি বলি কি হাবিব ডাক্তারকে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না। খায়েদের হলে তো কী হয়েছে? ভালো ঘর ভালো ছেলে আজকাল পাওয়া খুব মুশকিল। এমন সোনার চাদ ছেলে পাবে কোথায়?
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, আমিও হাবিব ডাক্তারকে জামাই করতে চাই; কিন্তু গ্রামের লোক যখন জানবে খায়েদের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি তখন কী হবে?
কী আবার হবে? বিশ্বাস বংশের মধ্যে উপযুক্ত ছেলে না পাওয়া গেলে মেয়েকে কী চিরকাল আইবুড়ী করে ঘরে রেখে দেবে? তা ছাড়া ডাক্তার শহরের ছেলে, কোন বংশের ছেলে তা কি গ্রামের লোক জানছে? আর জানলেই বা কি? তোমার বিরুদ্ধে কারো কিছু বলার সাহস আছে নাকি?
স্ত্রীর শেষের কথা শুনে মুশতাক বিশ্বাস খুশি হলেন। বললেন, তুমি ঠিক কথা বলেছ। ডাক্তারকে আসার জন্য পারভেজকে বলেছি, এলে আলাপ করে তার মতামত জানা যাবে।
শোন, ডাক্তার যদি আতিকাকে গ্রামের মেয়ে ভেবে বিয়ে করতে রাজি না হয়, তা হলে জমি-জায়গা ও টাকা পয়সার লোভ দেখিয়ে হলেও রাজি করাবে।
মুশতাক বিশ্বাস মৃদু হেসে বললেন, পারভেজের মা, সেকথা তোমার না বললেও চলতো। এমন গুটি চালব, ডাক্তার বেটা রাজি না হয়ে পারবে না।
শাফিয়া বানুও মৃদু হেসে বললেন, এত বছর তোমাকে নিয়ে সংসার করছি, আজ পর্যন্ত তোমাকে কোনো কাজে হারতে দেখি নি, এ কাজেও তুমি হারবে না, তা আমিও জানি। তবু একটু স্মরণ করিয়ে দিলাম আর কি।
এই জন্যইতো তোমাকে এত ভালবাসি বলে মুশতাক বিশ্বাস এদিক ওদিক তাকিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন।
শাফিয়া বানুও এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন, একি করছ? ছাড় ছাড়। এত বয়স হল, তবু রস কমল না।
মুশতাক বিশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বললেন, বয়স হলে মেয়েদের রস কমে যায় কেন বলতে পার?
শাফিয়া বানু কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, বলতে পারব না। তুমি তোমার রস নিয়ে থাক বলে সেখান থেকে চলে গেলেন।
কয়েকদিন পর এক বিকেলে বইরাপাড়া হাফিজিয়া মাদ্রাসায় মিটিং ছিল। চামচা গিয়াসকে নিয়ে যাওয়ার সময় মুশতাক বিশ্বাস জিজ্ঞেস করলেন, হাবিব ডাক্তারের পরিচয় জানতে পারলে?
জি না মাতব্বর সাহেব। তবে চেষ্টায় আছি।
তোমাকে আর চেষ্টায় থাকতে হবে না। আর হাশেম আলির বাড়ির দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে না। আমি নিজেই জেনেছি, হাবিব ডাক্তারের মতো ভালো ছেলে আর হয় না।
গিয়াস খুব অবাক হয়ে ভাবল, মাতব্বর সাহেব কয়েকদিন আগে পর্যন্ত হাবিব ডাক্তারের উপর ক্ষ্যাপা ছিলেন। তার সম্পর্কে কার কাছে কি এমন শুনলেন যে, এখন আবার তার সুনাম করছেন! কিছু বুঝে উঠতে না পেরে চুপচাপ হাঁটতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর মুশতাক বিশ্বাস বললেন, তোমার কাছে ব্যাপারটা ঘোলাটে মনে হচ্ছে, তাই না?
গিয়াস বলল, আপনার মতো বুদ্ধিমান মানুষ শুধু এই গ্রামে না, আশপাশের কয়েকটা গ্রামেও নেই। তাই তো সব গ্রামের সালিশীতে আপনার ডাক পড়ে।
আমি মূখ লোক, একটু খোলাসা করে না বললে বুঝব কী করে?
মুশতাক বিশ্বাস নিজের প্রশংসা শুনে খুশি হয়ে বললেন, বলছি শোন, আমি পাঁচ-ছ’দিন আগে পশ্চিমপাড়ায় আজরাফ মাস্টারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়াছিলাম। আজরাফ মাস্টার কেমন লোক তাতো জান। তার কাছেই হাবিব ডাক্তারের সবকিছু জেনেছি।
প্রায় সাত আট মাস আগে গিয়াসের দশ বছরের মেয়ে যয়নাবের ডাইরিয়া হয়ে মরামরা অবস্থা হয়েছিল। ঘরে কান্নাকাটিও পড়ে গিয়েছিল। সেই সময় হাবিব ডাক্তারকে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখে একজন ডেকে নিয়ে আসে। তার চিকিৎসায় যয়নাব বেঁচে যায়। গ্রামের সবার মতো গিয়াসও হাবিব ডাক্তারকে
পীরের মতো ভক্তিশ্রদ্ধা করে। মাতব্বর সাহেবকে শুধু খুশি রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে একটু-আধটু মিথ্যে বলে। এখন মাতব্বরের কথা শুনে অবাক হলেও খুব। খুশি হল। তা প্রকাশ না করে চুপ করে রইল।
কী হল, ভালো মন্দ কিছু বলছ না যে?
আপনি সবকিছু জেনে যা বললেন, তা ভালো ছাড়া কখনও মন্দ হতে পারে। তবে হাশেম আলির মেয়ের ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখলে ভালো হত।
মুশতাক বিশ্বাস হেসে উঠে বললেন, তুমি অবশ্য ঠিক কথা বলেছ। তবে আমি কথায় কথায় ব্যাপারটা আজরাফ মাস্টারের কাছ থেকে জেনেছি। আসল ঘটনা হল, হাবিব ডাক্তার হাশেম আলিকে চিকিৎসা করছে। তাই মাঝে মাঝে যায়। সে সময় তার মেয়ের সঙ্গে হয়তো কিছুক্ষণ আলাপ করে। তুমিও তো জান, হাশেম আলির মেয়ে খুব পর্দানশীল। আর হাবিব ডাক্তার যে খুব ধার্মিক তাও তো জান?
গিয়াস হাসি মুখে বলল, আপনি যখন বলছেন, তখন আর কোনো চিন্তা নেই।
তা হলে বল, হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে আতিকার বিয়ে দিলে কেমন হবে?
খুব ভালো হবে। দোয়া করি, আল্লাহ যেন তাড়াতাড়ি সেদিন দেখান।
মুশতাক বিশ্বাস গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, গিয়াস।
মাতব্বর সাহেবের গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে গিয়াস ঘাবড়ে গেল। ভাবল, কিছু ভুল বলে ফেললাম না তো? মিনমিনে গলায় বলল, জি মাতব্বর সাহেব বলুন।
কথাটা যেন আর কেউ না জানে।
গিয়াস স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, জি-জি, তাতো বটেই।
মিটিং সেরে ফেরার পথে খাপাড়া ছেড়ে মাঝপাড়ায় রশিদ শেখের পুকুরপাড়ের কাছে এসে মুশতাক বিশ্বাস পুকুরে ওপাড়ের একটা বড় নীম গাছের আড়ালে একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। যদিও সন্ধ্যায় আবছা অন্ধকার নেমেছে, তবু তাদেরকে চিনতে পারলেন। আতিকা নাদের আলির সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে।
মুশতাক বিশ্বাসের পিছনে গিয়াস ছিল। মাতব্বরকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সেও দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও বোঝার ভান করে বলল, দাঁড়ালেন কেন মাতব্বর সাহেব। চলুন মাগরিবের নামাযের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মুশতাক বিশ্বাস দৃষ্টি সরিয়ে কিছুটা পথ আসার পর বললেন, কিছু দেখেছ?
জি, নাদের আলির পাখা গজিয়েছে।
পাখা কেটে দাও।
জি, তাই দেব।
শুধু পাখা নয়, আজ রাতেই ওকে একেবারে শেষ করে দেবে।
সেটা কি ঠিক হবে মাতব্বর সাহেব? তার চেয়ে পাখাটা কেটে দিলেই ভালো হবে। একেবারে শেষ করে দিলে, পুলিশের ঝামেলা হবে। ওরা গন্ধ শুকে শুকে একদিন না একদিন খুনীকে আবিষ্কার করবে। তা ছাড়া নাদের আলি হাবিব ডাক্তারের পেয়ারের। সেও কম কিছু করবে না।
ঠিক আছে, আপাতত পাখা কেটে দেয়ার ব্যবস্থা কর।
জি, সেটাই ভালো হবে।
এবার তুমি যাও বলে মুশতাক বিশ্বাস মসজিদের দিকে চলে গেলেন। নামায পড়ে গম্ভীর মুখে বাড়িতে ঢুকলেন।
শাফিয়া বানু জানেন, স্বামী মাদ্রাসার মিটিং-এ বইরাপাড়ায় গেছে। তাকে খুব গম্ভীর মুখে ফিরতে দেখে ভাবলেন, মিটিং এ ফলাফল ওনার মনের মতো হয় নি। কাছে এসে বললেন, শরীর খারাপ লাগছে?
মুশতাক বিশ্বাস স্ত্রীর কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, আতিকা কোথায়? কেন?
এই তো নামায পড়ল।
সন্ধ্যের আগে কোথায় ছিল?
তা বলব কি করে। আসরের নামায পড়ে হয়তো চাচাদের কারো বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল।
সেয়ানা মেয়ে কোথায় যায়, কি করে, খোঁজ রাখবে না?
ওকি ছোট যে, সব সময় ওর দিকে লক্ষ্য রাখব। মা হিসাবে যতদিন লক্ষ্য রাখার ততদিন রেখে মানুষ করেছি। এখন বড় হয়েছে, লেখাপড়া করেছে, এবার বাবা হিসাবে তোমার কর্তব্য, ভালো ঘরে ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দেয়া। ওর জুড়ি সব মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। তারা বাপের বাড়ি এলে তাদের সঙ্গে মেলামেশা করে। ওর মনের দিকটা চিন্তা করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু বাপ হয়ে সেই উচিত কাজটা তুমি করছ না কেন?
স্ত্রীর কথা শুনে মুশতাক বিশ্বাসের রাগ পড়ে গেল। বললেন, হ্যাঁ তুমি ঠিক কথা বলেছ। তবে আমি যে পাত্রের খোঁজ করি নি তা নয়। উপযুক্ত পাত্র পাচ্ছি না বলে দেরি করছি।
কেন? সেদিন তো হাবিব ডাক্তারের কথা বললে? তার সঙ্গে আলাপ কর নি?
পারভেজের হাতে তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম, সে নাকি ঢাকা গেছে, দু-একদিনের মধ্যে ফিরবে। এখন যা বলছি শোন, মিটিং থেকে ফেরার সময় মাঝপাড়ায় রশিদ শেখের পুকুরপাড়ে নাদের আলির সঙ্গে আতিকাকে আলাপ করতে দেখলাম, ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো ঠেকছে না।
শাফিয়া বানু চমকে উঠে সামলে নিলেন, বললেন, তুমি হয়তো ভুল দেখেছ। আতিকা নাদের আলির সঙ্গে আলাপ করতে যাবে কেন?
মুশতাক বিশ্বাস গম্ভীর স্বরে বললেন, আমি একা দেখলে হয়তো তাই মনে হত; কিন্তু গিয়াসও সঙ্গে ছিল। সে তো আর ভুল দেখে নি? ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে, ওদের সম্পর্ক অনেক দিনের। শালা ফকিন্নীর বাচ্চার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি, খ বংশের কুত্তার বাচ্চা আমার মেয়ের সঙ্গে কিনা…কথাটা রাগে শেষ করতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, পিঁপড়ের পাখা গজায় মরার জন্য। ঐ কুত্তার বাচ্চাটারও পাখা গজিয়েছে। আজ রাতেই বাছাধন কতধানে কত চাল বুঝতে পারবে।
আজ রাতেই স্বামী যে লোক দিয়ে নাদের আলির ক্ষতি করবে, তা শাফিয়া বানু বুঝতে পেরে আতঙ্কিত হলেন। বললেন, নাদের আলি কতটা দোষী সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে কিছু করা ভালো। নচেৎ গ্রামে সালিশী বসলে তোমার সম্মান থাকবে? আমি চাই না, হঠাৎ করে কিছু করে তুমি সালিশের সম্মুখীন হও।
মুশতাক বিশ্বাস হো হো করে হেসে উঠে বললেন, শুধু এই গ্রামের নয়, আশপাশের পাঁচ-দশটা গ্রামের এমন কারো বুকের পাটা নেই, আমার নামে সালিশ ডাকবে।
এত বছর এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছি, সে কথা আর জানি না?
তা হলে কোনো দুশ্চিন্তা করো না। শুধু দেখে যাও কি করি। আর শোন, এ ব্যাপারে আতিকাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। তবে কখন কোথায় যায় লক্ষ্য রাখবে।
শাফিয়া বানু বললেন, ঠিক আছে, তুমি বস, চা-নাস্তা নিয়ে আসি।
হাবিব ডাক্তার নিষেধ করার পর আতিকা ও নাদের আলি পাঁচ-ছ’মাস কেউ কারো সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে নি। কিন্তু আজ আতিকা থাকতে না পেরে গোপনে নাদের আলির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল। মাঝপাড়ায় রহিম শেখের পুকুর পাড়ের কাছে তার সঙ্গে দেখা হয়। তারপর তাকে নিয়ে পুকুরের ওপারের পাড়ে গিয়ে বলল, তোমাকে এতদিন না দেখে খুব খারাপ লাগছিল, তাই তোমাদের ঘরে যাচ্ছিলাম। এবার থেকে প্রতি সোমবার এখানে এই সময়ে থাকবে, আমি আসব।
নাদের আলি ভয় পেয়ে বলল, কিন্তু একদিন না একদিন কেউ দেখে ফেলবে। তখন কী হবে ভেবেছ?
আমি এভাবে গায়ে মাথায় কাপড় দিয়ে আসব, কেউ চিনতে পারবে না।
তবু নাদের আলির ভয় কাটল না। বলল, হাবিব ডাক্তার আমাদেরকে দেখা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি জানতে পারলে হয়তো আমাদের জন্য কিছুই করবেন না।
আজ এক বছরের বেশি হয়ে গেল, কই, কিছু করতে পেরেছেন?
উনি তলে তলে অনেক কিছু করছেন।
কি করেছেন শুনি?
একদিন আমি জিজ্ঞেস করতে শুধু বললেন, “আতিকাকে এনে রাখবে কোথায়? খাওয়াবে কি? সে বড় লোকের আদরের মেয়ে। এই বেড়ার ঘরে ডাল ভাত খেয়ে থাকবে নাকি? আগে বাড়িঘর পাকা কর, জমি-জায়গা কিনে নিজে চাষবাস করে উন্নতি কর। তারপর আতিকাকে ঘরে তোলার ব্যবস্থা আমি করব।”
হাবিব ডাক্তারের কথামতো এসব করতে করতে তুমি যেমন বুড়ো হয়ে যাবে, আমিও তেমনি বুড়ী হয়ে যাব। তা ছাড়া মা-বাবা অতদিন আমাকে আইবুড়ী করে ঘরে রেখে দেবে বুঝি?
আমি তাকে সে কথা বলেছিলাম। বললেন, “ইনশাআল্লাহ এক দেড় বছরের মধ্যে তুমি সবকিছু করতে পারবে।”
তা এই এক বছরের মধ্যে তুমি কিছু এগোতে পেরেছ?
কিছু জমি-জায়গা কিনে চাষবাস করছি, দু’কামরা পাকা বাড়ির কাজও প্রায় শেষ করে এনেছি।
আতিকা অবাক হয়ে বলল, তাই না কী? তা তুমি এত টাকা-পয়সা পেলে কোথায়?
নাদের আলি কিছু না বলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।
আরে, কিছু না বলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছ যে? মনে হচ্ছে আলাউদ্দিনের চেরাগ পেয়েছ?
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ, আলাউদ্দিনের চেরাগই পেয়েছি।
দূর, ওটা তো আগের যুগের কল্পকাহিনী। আসল ব্যাপারটা বল তো।
আসল ব্যাপারটা বললে আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো কল্পকাহিনী মনে হবে।
তা হোক, তবু বল।
বলা যাবে না। তবে এতটুকু বলতে পারি। “আল্লাহ যারে দেয়, ছাপ্পর ফাইড়া দেয়।”
ওটা তো একটা কথার কথা, আসল ব্যাপারটা বলা যাবে না কেন?
তাও বলা যাবে না। কারণ জানাজানি হয়ে গেলে আমি বিপদে পড়ে যাব। তবে যখন বিপদে পড়ার সম্ভাবনা কেটে যাবে তখন বলব।
আতিকা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ঠিক আছে, তা হলে থাক, বলতে হবে না। পরেই না হয় শুনব।
এমন সময় নাদের আলির দৃষ্টি রাস্তার দিকে পড়তে মুশতাক বিশ্বাস ও গিয়াসকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠে বলল, এই, তোমার আব্বা ও গিয়াস চাচা আমাদেরকে দেখছেন।
কথাটা শুনে আতিকাও চমকে উঠে যখন রাস্তার দিকে তাকাল তখন মুশতাক বিশ্বাস ও গিয়াস মুখ ফিরিয়ে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন। তাদেরকে চলে যেতে দেখে জিজ্ঞেস করল, তুমি ঠিক দেখেছ, আব্বা ও গিয়াস চাচা আমাদেরকে দেখেছে?
নাদের আলির মনে তখন ভয়ের ঝড় বইছে। কোনো রকমে বলল, হ্যাঁ, ওনারা আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমার কিন্তু খুব ভয় করছে।
আতিকা বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমার মনে হয়, এতদূর থেকে আমাদেরকে চিনতে পারে নি। চিনতে পারলে আব্বা নিশ্চয় গিয়াস চাচাকে দিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে যেতে পাঠাত।
কি জানি, তোমার কথা হয়তো ঠিক। এবার তুমি যাও। তোমার আব্বা ঘরে গিয়ে তোমার খোঁজ করবেন। আর শোন, আমার মনে হয়, এখানে দেখা করা ঠিক হবে না। দু’একমাস যাক, তারপর না হয় দেখা যাবে।
আতিকা বলল, ঠিক আছে, আমি হালিমের হাতে খবর দিলে আসবে। তারপর তারা যে যার পথে চলে গেল।
মুশতাক বিশ্বাস ঘরে আসার আগে অন্য রাস্তা দিয়ে আতিকা ঘরে এসে নামায পড়ল। তারপর আব্বা ঘরে এসে মায়ের সঙ্গে যা কিছু কথাবার্তা বলেছে আড়াল থেকে তাদের সব কথা শুনে জানতে পারল, আব্বা ও গিয়াস চাচা তাদেরকে ঠিকই দেখেছে। আরো জানতে পারল, আব্বা-আম্মা হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে তার বিয়ে দিতে চায়। আব্বা তাদেরকে দেখেছে জেনে ভয় পেলেও হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে তার বিয়ের কথা জেনে ভয় পেল না। আম্মা চা-নাস্তা আনতে গেলে নিজের রুমে এসে ভাবল, যাক বাচা গেল। যখন এসব কথা জানাতে আম্মাকে নিষেধ করল তখন সেও নিশ্চয় আপাতত আমাকে কিছু বলবে না। সঙ্গে সঙ্গে আজ রাতেই নাদের আলির পাখা ভেঙ্গে দেয়ার কথা মনে পড়তে চমকে উঠল। তাকে সাবধান করার জন্য তখনই রওয়ানা দিল। এখন খাঁপাড়ায় যাওয়া তার যে উচিত নয়, সে কথা একবারও মনে পড়ল না। ততক্ষণে রাতের অন্ধকার নামলেও রাস্তায় লোকজন চলাচল করছে। মাথার কাপড়টা মুখের উপর কিছুটা ঝুলিয়ে লোকজনকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল। দু’একজন জিজ্ঞেস করল, কে তুমি, কোথায় যাবে? আতিকা না শোনার ভান করে তাদেরকে পাশ কেটে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।
যারা বাড়ির কাজ করছে তাদেরকে বিদায় করে নাদের আলি ফুফুর সঙ্গে কথা বলছিল। এমন সময় আতিকাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। বলল, কী ব্যাপার? এই রাতের বেলায় আবার এলে কেন? কোনো বিপদ হয় নি তো?
আতিকা দ্রুত হেঁটে এসে হাঁপিয়ে পড়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আমার কোনো বিপদ হয় নি। তবে আজ রাতে তোমার বিপদ হবে। গিয়াস চাচা তার লোকজন নিয়ে তোমাকে মারধর করতে আসবে শুনে তোমাকে সাবধান করতে এলাম। এখন চলি, জানাজানি হয়ে গেলে আব্বা আম্মা আস্ত রাখবে না। তুমি আজ রাতে ঘরে থেক না বলে যেমন দ্রুত এসেছিল, তেমনি দ্রুত অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
আতিকার কথা শুনে নাদের আলি ভয় পেলেও দ্রুত তার পিছন পিছন আসতে আসতে বলল, একটু দাঁড়াও, আমি তোমাকে কিছু দূর এগিয়ে দিই।
আতিকা না দাঁড়িয়ে যেতে যেতে বলল, এগিয়ে দিতে হবে না। তোমাকে আমার সঙ্গে কেউ দেখে ফেললে তখন দু’জনেরই বিপদ হবে। যা বললাম তাই করবে।
নাদের আলি থমকে দাঁড়িয়ে অন্ধকার পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ফিরে এসে ফুফুকে বলল, আমাকে ভাত দিয়ে তুমিও খেয়ে নাও। তোমাকে নিয়ে পশ্চিমপাড়ায় আজরাফ স্যারের বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাব।
নাদের আলির ফুফু হানিফা খাতুনের তিনবার বিয়ে হয়। প্রথম স্বামী পাঁচ বছর তাকে নিয়ে সংসার করে। এই ক’বছরে পেটে বাচ্চা আসে নি বলে বাজা ভেবে তালাক দিয়ে সেই স্বামী আবার বিয়ে করে। দ্বিতীয় স্বামীও তাকে নিয়ে পাঁচ-ছ’বছর সংসার করে এবং একই কারণে তালাক দিয়ে আবার বিয়ে করে। আবার তৃতীয় স্বামী বিয়ের দু’বছরের মাথায় মারা যায়। তারপর বাপ-ভাই বিয়ে দিতে চাইলেও তিনি রাজি হন নি। সেই থেকে বাপ-ভাইদের সংসারে থাকেন। মা-বাপ অনেক আগে মারা গেছেন। ভাই-ভাবিও বন্যার বছরে মারা গেছেন। মা-বাবাকে হারিয়ে ফুফুই এখন নাদের আলির সব। তা ছাড়া হানিফা খাতুন যে বছর বিধবা হয়ে ফিরে আসেন। তখন নাদের আলি ছোট ছিল। তিনিই একরকম তাকে মানুষ করেছেন। স্কুলে পড়ার সময় যখন আতিকা তাদের বাড়িতে আসত তখন তার পরিচয় জানবার পর একদিন তিনি নাদের আলিকে মুশতাক বিশ্বাসের সঙ্গে তাদের পূর্বপুরুষদের শত্রুতা ও শত্রুতার কারণ জানিয়ে বলেছিলেন, আতিকার সঙ্গে তুই মেলামেশা করবি না। আর তাকেও বলে দিবি, সে যেন এ বাড়িতে না আসে।
সে কথা নাদের আলি একদিন আতিকাকে বলে। আতিকা তখন তরুণী। সেদিন ঘরে এসে মাকে জিজ্ঞেস করে খায়েদের সঙ্গে নাকি আমাদের অনেকদিনের শত্রুতা?
শাফিয়া বানু বললেন, হ্যাঁ। খবরদার, খায়েদের কোনো ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করবি না।
খাঁয়েদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা কেন আম্মা?
তুই এখন ছেলে মানুষ, ওসব কথা জানার দরকার নেই। যখন আরো বড় হবি তখন নিজেই জানতে পারবি।
মায়ের কথায় আতিকা খুশি হতে পারল না। তাই একদিন দাদিকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছিল।
জানার পর ভেবেছিল, নাদের আলির সঙ্গে আর মেলামেশা করবে না। কিন্তু ততদিনে তাকে ভালবেসে ফেলেছে। তাই খুব বেশি দিন তার সঙ্গে দেখা না করে থাকতে পারে নি।
নাদের আলিরও একই অবস্থা। তবু আতিকাকে অনেক বুঝিয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয় নি।
তারপর তারা যে সম্পর্ক রেখেছে ও গোপনে দেখা সাক্ষাৎ করে তা হানিফা খাতুন জানতেন না। কয়েক মাস আগে যেদিন হাবিব ডাক্তার নাদের আলির সঙ্গে এসে পরিচয় দিয়ে বলল, সে তাদেরই বংশের ছেলে এবং যেমন করে হোক নাদের আলির সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আতিকাকে বৌ করে করে আনবে সেদিন জানতে পারেন। তারপর হাবিব ডাক্তার যে নাদের আলিকে জমি-জায়গা কিনে দিয়েছে ও পাকা বাড়ি করে দিচ্ছে তাও জানেন। তাই আজ আতিকা যখন বিপদের কথা বলে সাবধান করে দিয়ে চলে গেল এবং নাদের আলি পশ্চিমপাড়ায় আজরাফ মাস্টারের বাড়িতে রাত কাটাবার কথা বলল তখন জিজ্ঞেস করলেন, আজরাফ মাস্টার হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ও তোর ও আতিকার সম্পর্কের কথা জানে?
নাদের আলি বলল, হ্যাঁ জানে।
তা হলে এক কাজ কর, খেয়ে তুই চলে যা, আমি এখানে থাকি।
এ তুমি কি বলছ ফুফু? তোমাকে একা রেখে গেলে ওরা আমাকে না পেয়ে তোমার উপর অত্যাচার করবে।
এমন সময় হাবিব ডাক্তারের গলা শুনতে পেল।
নাদের আলি ঘরে আছ না কি?
তার গলা পেয়ে নাদের আলির ভয় কেটে গেল। বলল, আসুন ডাক্তার ভাই। হাবিব ডাক্তার পরিচয় দেয়ার পর নাদের আলি তাকে ডাক্তার ভাই বলে ডাকে।
হাবিব ডাক্তার কাছে এসে সালাম বিনিময় করে বলল, তোমাদের সব কথা শুনেছি। কাউকেই কোথাও যেতে হবে না। মাঝপাড়ায় রুগী দেখতে এসেছিলাম, পথে আতিকার সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার কাছে সবকিছু শুনে এখানে এলাম। তারপর হানিফা খাতুনকে উদ্দেশ্য করে বলল, খালাআম্মা, কোনো চিন্তা করবেন না। আজ আমিও আপনাদের সঙ্গে থাকব।
হানিফা খাতুন বললেন, কিন্তু ওরা যদি দলে ভারি হয়।
হাবিব ডাক্তার বলল, আল্লাহ ভরসা। তারপর নাদের আলিকে বলল, লাঠি দু’গাছা যত্ন করে রেখেছ তো?
নাদের আলি বলল, হ্যাঁ রেখেছি।
হাবিব ডাক্তার বলল, ওরা রাত বারটার পরে আসবে তো আগে আসবে না। আমি পশ্চিমপাড়ায় যাচ্ছি, আজরাফ স্যারের সঙ্গে একটু দেখা করে আসি। ওখান থেকে এসে খাওয়া-দাওয়া করব। তারপর কেউ কিছু বলার আগে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
রাত একটার দিকে গিয়াস ছয় সাতজন লোক নিয়ে নাদের আলিকে মেরে তার হাত পা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য খপাড়ায় এল। তারপর তার ঘরের কাছে গিয়ে অন্ধকারের মধ্যে গিয়াস আবছা দেখতে পেল, উঠোনের মাঝখানে সাদা পোশাকে লম্বা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার কাছে পাঁচ ব্যাটারী টর্চ ছিল, টর্চ জ্বেলে যা দেখল, তাতে সবাইয়ের আত্মারাম খাচা। মাথায় সাদা পাগড়ী, চোখ ছাড়া সাদা কাপড়ে মুখ পেচান, গায়ে লম্বা সাদা ঝুল পিরান, হাতে একটা বড় লাঠি। চোখ দুটো যেন আগুনের ভাটার মতো জ্বলছে। গিয়াসের সঙ্গীরা ওরে বাবারে জিন বলে ছুট দিল। গিয়াস সবার পিছনে পড়ে গেল।
হাবিব ডাক্তার নাদের আলিকে কিছু পরামর্শ দিয়ে এই পোশাকে লাঠি হাতে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিল। আর নাদের আলি বাস্তুর কিনারের বড় আমগাছের আড়ালে লাঠি হাতে লুকিয়েছিল। হাবিব ডাক্তারের পরামর্শ মতো পলায়নপর গিয়াসের ডান পায়ে প্রচণ্ড জোরে লাঠি দিয়ে আঘাত করল।
গিয়াস বাবারে মেরে ফেলল রে বলে আর্তচিৎকার করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। লাঠির আঘাতে তার পা ভেঙ্গে গেলেও জান বাঁচাবার জন্য ভাঙ্গা পা নিয়ে একপায়ে নেংচি কাটতে কাটতে ছুটল। কিছুটা এসে যখন চলতে পারল না তখন সঙ্গীদের ডাক দিয়ে বলল, তোরা আমাকে ধরে ধরে নিয়ে যা, আমার একটা পা ভেঙ্গে গেছে।
সঙ্গীরা বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে তাকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে লাগল।
নাদের আলি যে গিয়াসের পায়ে লাঠির বাড়ী দিয়েছে, গিয়াস তা জানতে পারে নি। তাই বলল, জিনটা উঠোন থেকে লাঠি ফিকে মেরেছে। যে রকম যন্ত্রণা হচ্ছে, তাতে করে মনে হয় পাটা ভেঙ্গে গেছে।
সঙ্গীদের একজন বলল, নানার কাছে জিনের গল্প শুনেছিলাম, আজ চোখে দেখলাম। বারেক তুমি টর্চ জ্বেলেছিলে, নচেৎ জিনটা সবাই এর পা ভেঙ্গে দিত।
গিয়াস যাদেরকে নিয়ে এসেছিল, তারা সবাই লেঠেল। তাদের একজন শুধু তার চাচাত ভাই। আর বাকি সবাই কামড়ীপাড়ার লোক। তারা গিয়াসকে তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল। গিয়াস ও ঐ লোকটির বাড়ি মাঝপাড়ায়।
পরের দিন অনেক বেলা পর্যন্ত গিয়াস আসছে না দেখে মুশতাক বিশ্বাস বদরুল নামে একজন লোককে তাকে ডেকে নিয়ে আসতে মাঝপাড়ায় পাঠালেন।
গিয়াস পায়ের ব্যথায় সারারাত ছটফট করেছে। সকালে ছেলে লতিফকে কার্পাসডাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্সে হাবিব ডাক্তারকে আনতে পাঠিয়েছিল।
হাবিব ডাক্তার এসে পায়ের অবস্থা পরীক্ষা করে বলল, এ যে দেখছি কেউ শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করে পায়ের হাড় ভেঙ্গে দিয়েছে। আল্লাহ না করুক, হাড় জোড়া না লাগলে হাঁটুর নিচ থেকে কেটে বাদ দিতে হবে।
গিয়াস হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, অমন কথা বলবেন না ডাক্তার সাহেব। পা কেটে বাদ দিলে ছেলেমেয়েদের মুখের আহার জোটাব কি করে? আপনি খুব আল্লাহওয়ালা ডাক্তার। পা যাতে কেটে বাদ দিতে না হয় সেই ব্যবস্থা করুন। আমার বিশ্বাস আপনি চেষ্টা করলে আমার পা ভালো করে দিতে পারবেন।
আমি ভালো করার কে? সবকিছু করার মালিক একমাত্র আল্লাহ। ডাক্তারী বিদ্যামতো চেষ্টা করব। বাকি তিনি যা করার করবেন। তবে কয়েকটা কথা বলব, সেগুলো মেনে চলে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করুন। তিনি গফুর রহিম, ইচ্ছা করলে আপনার পা কেটে বাদ না দিয়েও ভালো করে দিতে পারেন।
আপনি বলুন ডাক্তার সাহেব, আপনার সব কথা মেনে চলব।
হাবিব ডাক্তার এতক্ষণ পায়ে প্লাস্টার করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
এবার কাজ শুরু করে বললেন, তার আগে যা জিজ্ঞেস করব, সত্য উত্তর দেবেন। পাটা এভাবে ভাঙল কী করে?
সত্য মিথ্যা কোনোটাই বলতে না পেরে গিয়াস চুপ করে রইল।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হাবিব ডাক্তার বলল, কী হল, চুপ করে আছেন কেন?
একজন লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরেছিল।
কে বাড়ি মেরেছে? আর কেনই বা মেরেছে?
এই কথারও উত্তর দিতে না পেরে গিয়াস চুপ করে রইল।
হাবিব ডাক্তার আর কোনো প্রশ্ন না করে প্লাস্টারের কাজ শেষ করল। তারপর বলল, আপনি বোধ হয় জানেন, সত্য কোনোদিন গোপন থাকে না। দু’দিন আগে পরে সবাই জেনে যাবেই। এখন বলতে দ্বিধা করছেন কেন? কি এমন ঘটনা হয়েছিল, লোকটা লাঠি মেরে আপনার পা ভেঙ্গে দিল?
গিয়াস লজ্জায় ঘটনাটা বলতে না পেরে মাথা নিচু করে বসে রইল।
হাবিব ডাক্তার বলল, ঘটনাটা বলতে যখন লজ্জা করছে তখন আপনার ঈমান ও বিবেক দু’টোই আছে। হাদিসে আছে, আমাদের নবী (দঃ) বলেছেন, “লজ্জা ঈমানের অর্ধেক। যার লজ্জা নেই, তার ঈমানও নেই।” আর যার ঈমান আছে তাকে মুসলমান বলে। “এক মুসলমান আর এক মুসলমানের ভাই।” এটাও কুরআন হাদিসের কথা। এক ভাই আর এক ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারে কী? যদি কেউ করে, তবে একদিন না একদিন তার দ্বারা অথবা অন্যের দ্বারা তারও ক্ষতি হবে। শুনুন, আমি এখানে দু’বছরের বেশি হয়ে গেল এসেছি, ডাক্তার হিসাবে আশপাশের গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই রুগী দেখতে গিয়ে সবার সঙ্গে কম বেশি পরিচয় হয়েছে। কে কেমন তাও কিছু কিছু বুঝেছি। আপনি শক্তি সামর্থবান লোক হয়ে একজনের পিছন পিছন ঘঘারেন, সত্যি মিথ্যা বলে তোষামোদ করেন ও তার কথামতো বিবেক বিসর্জন দিয়ে অন্যের ক্ষতি করেন। এসব করা কী উচিত? আল্লাহ যতটুকু জমি-জায়গা দিয়েছেন, চাষবাস করুন। তাতে সংসার না চললে অন্য কোনো সৎ পথে রুজী রোজগার করার চেষ্টা করুন। তাতে করে ইহকাল ও পরকালের জীবনে সুখ-শান্তি পাবেন। এই যে আজ এরকম বিপদে পড়লেন, কেন পড়লেন চিন্তা করেছেন? নিশ্চয় কারো ক্ষতি করতে গিয়েছিলেন? ছেলেমেয়েরা সাধারণত মা-বাবাকে অনুসরণ করে। আপনার ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে, তাদের কাছে সৎ বাবা হওয়ার চেষ্টা করুন। আপনাকে অসৎ দেখলে তারাও বড় হয়ে অসৎ হবে। যাক, আজ আর বেশি কিছু বলব না। শুধু এতটুকু বলব, যারা অন্যের ক্ষতি করে, পারতপক্ষে তারা নিজেরই ক্ষতি করে। আর যারা অন্যের ভালো করার চেষ্টা করে, আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেন। আর সেই সাহায্য কোনো একজনের দ্বারা করান। সৎভাবে সংসার চালাতে গেলে যদি অভাব অনটনে পড়েন, তা হলে ব্যবসা করুন। টাকা পয়সা লাগলে আমি আপনাকে কর্জে হাসানা দেব। যখন সুযোগ সুবিধে হবে তখন শোধ করে দেবেন। তবে এসব কথা কাউকে বলবেন না। তারপর প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে বলল, ওষুধ কেনার টাকা না থাকলে আপনার ছেলেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। এবার আসি বলে সালাম বিনিময় করে হাবিব ডাক্তার চলে গেল।
গিয়াস আগে হাবিব ডাক্তারকে যতটা না আল্লাহওয়ালা বলে জানত, এখন তার কথা শুনে আরো বেশি আল্লাহওয়ালা বলে মনে হল। ভাবল, আজকালের যুগের এরকম মানুষও তা হলে আছে? সিদ্ধান্ত নিল, সে আর মুশতাক বিশ্বাসের চামচাগিরী করবে না। পা ভালো হয়ে গেলে গতর খাটিয়ে সংসার চালাবে এবং হাবিব ডাক্তারের কাছ থেকে টাকা হাওলাত নিয়ে বাজারে যে কোনো ব্যবসা করবে।
এমন সময় তার ছেলে লতিফ এসে বলল, বদরুল চাচা এসেছে।
গিয়াস বলল, এখানে আসতে বল।
বদরুল এসে তার একটা পা প্লাস্টার করা দেখে অবাক হয়ে বলল, কাল তোমাকে ভালো দেখলাম, কি এমন ঘটনা ঘটল যে, পা প্লাস্টার করতে হল? আজ তুমি যাওনি বলে মাতব্বর সাহেব তোমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাঠালেন।
ঘটনা বলা যাবে না। তুমি মাতব্বর সাহেবকে বলবে, তার কাজ করতে গিয়ে আমার এই অবস্থা হয়েছে। তাই যেতে পারি নি।
বদরুল ফিরে গিয়ে গিয়াসের কথাগুলো মুশতাক বিশ্বাসকে বলল।
মুশতাক বিশ্বাসের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে মিলিয়ে গেল। বদরুলকে বলল, ঠিক আছে, তুমি তোমার কাজে যাও।
বদরুল চলে যাওয়ার পর চিন্তা করতে লাগলেন, গিয়াসের পা ভেঙ্গেছে ভাঙ্গুক, কিছুদিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে; কিন্তু নাদের আলির কি করল জানাল না কেন?
বিকেলে গিয়াসের বাড়িতে গিয়ে তার অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনা বলতো শুনি।
ঘটনা যা কিছু ঘটেছিল গিয়াস সে সব বলে বলল, নাদের আলির কেউ কখনও এতটুকু ক্ষতি করতে পারবে না। তার বাড়িতে জিন থাকে। যারা যাবে তাদের অবস্থা আমার মতই হবে।
মুশতাক বিশ্বাস বললেন, তোমার দলবলের সবার কী একই অবস্থা হয়েছে?
না, তারা জিনটাকে দেখে আগেই দৌড় দিয়েছিল। আমি পিছনে পড়ে গিয়েছিলাম। তাই জিনের লাঠির বাড়ি আমার উপরেই পড়েছে।
মুশতাক বিশ্বাস চিন্তিত মুখে বললেন, ওদের বাস্তুতে জিন থাকে কই, তাতো কখনো শুনি নি? বাপ-দাদাদের মুখেও শুনি নি। তুমি হয়তো ভুল দেখেছ।
ভুল দেখি নি মাতব্বর সাহেব। পাঁচ ব্যাটারীর টর্চ জ্বেলে দেখেছি। তা ছাড়া সঙ্গে যারা ছিল, তারাও কী ভুল দেখেছে?
মুশতাক বিশ্বাস চিন্তিত মুখে বললেন, তা হলে নাদের আলিকে শায়েস্তা করবে কী করে?
গিয়াস বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, আমি তাকে শায়েস্তা করতে পারব না। একটা লাঠির ঘা মেরে জিনটা বলল, আবার যদি নাদের আলির কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করিস, তা হলে তোকে একবারে জানে শেষ করে দেব। তাই ভেবেছি, আর কারো ক্ষতি করার মতো কাজ আর করব না। নিজের যতটুকু আছে তাতে গতর খাটিয়ে একবেলা একসন্ধে খেয়ে হলেও সংসার চালাব।
তার কথা শুনে মুশতাক বিশ্বাস বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, তোমার সঙ্গে কারা গিয়েছিল?
আমার চাচাত ভাই রফিক আর চারজন কামড়ীপাড়ার লাঠিয়াল, তারপর তাদের নাম বলল।
মুশতাক বিশ্বাস গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, পা প্লাস্টার করল কে?
হাবিব ডাক্তার।
সে তো ঢাকায় গিয়েছিল শুনেছিলাম? ফিরল কবে?
তাতো জানি না। সকালে লতিফকে কার্পাসডাঙ্গায় পাঠিয়েছিলাম তাকে ডেকে নিয়ে আসতে। দুপুরের আগে এসেছিলেন।
মুশতাক বিশ্বাস আর কিছু না বলে ফিরে এসে রসুকে কামড়ীপাড়ায় পাঠালেন, ঐ চারজন লেঠেলকে ডেকে নিয়ে আসার জন্য।
সন্ধ্যের পর তারা এলে মুশতাক বিশ্বাস তাদের কাছে ঘটনাটা জানতে চাইলেন।
গিয়াস যা যা বলেছিল, লেঠেলরাও তাই বলল। আরো বলল, আমরা আর কোনো দিন নাদের আলির ক্ষতি করার চেষ্টা করব না।
গিয়াসের কথা মুশতাক বিশ্বাস, বিশ্বাস করতে না পেরে তার সঙ্গী লেঠেলদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তারাও যখন একই কথা বলল তখন বিশ্বাস
করে পারলেন না। তাদেরকে বিদায় করে রসুকে বললেন, নাদের আলিকে মেরে তার হাত-পা ভেঙে দেয়ার জন্য গিয়াস এদেরকে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর যা ঘটেছে, সবকিছু তো শুনলে, তুমি চেষ্টা করে দেখবে না কী?
রসুর বাড়ি দরগাতলা পাড়ায়। মুরব্বীদের মুখে শুনেছে, এখানে কোনো এক পীরের দরগা ছিল। তখন গভীর রাতে ঐ দরগায় অনেক জিন যাতায়াত করত। এখন দরজা না থাকলেও জিনদেরকে ঐ এলাকায় যাতায়াত করতে অনেকে দেখেছে। একবার রসুর এক দাদা গভীর রাতে প্রকৃতির ডাকে ঐদিকে গিয়েছিল। তাকে নাকি জিনেরা মেরে ফেলে। সকালে সেখানে তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে ঐ জায়গাটা বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। রসু তখন আট-দশ বছরের ছেলে। দাদার লাশ দেখে ও জিনে মেরে ফেলেছে শুনে খুব ভয় পেয়েছিল। সেই থেকে জিনকে রসু ভীষণ ভয় পায়। এখন আবার লেঠেলদের মুখে নাদের আলির বাস্তুতে জিন আছে শুনে সেই ভয় আরো বেড়ে গেল। মুশতাক বিশ্বাসের কথা শুনে ভয়ার্তস্বরে বলল, না মাতব্বর সাহেব, জিনকে আমি খুব ভয় করি।
মুশতাক বিশ্বাস দমবার পাত্র নন। রসুকে বিদায় করে চিন্তা করলেন, প্রথমে কোনো একজন বড় খোনকার এনে নাদের আলির বাস্তুর জিনকে তাড়াতে হবে। তারপর নাদের আলির ব্যবস্থা করবেন। তার আগে হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে আতিকার বিয়ের কাজটা মিটিয়ে ফেলতে হবে।
এশার নামায পড়ে ছেলেকে ডেকে বললেন, পরশু শুক্রবার তোমার দাদাজীর মৃত্যুবার্ষিকী। হাবিব ডাক্তার ঢাকা থেকে ফিরেছে। কাল তুমি নিজে গিয়ে তাকে আমার কথা বলে আসতে বলবে। তোমার দাদাজীর মৃত্যুবার্ষিকীর কথা জানাবে না।
পারভেজ বলল, ঠিক আছে আব্বা, তাই হবে।