মেঘের কোলে রোদ: ০৩. নতুন হেলথ কমপ্লেক্স

মেঘের কোলে রোদ: ০৩. নতুন হেলথ কমপ্লেক্স

০৩. নতুন হেলথ কমপ্লেক্স

কার্পাসডাঙ্গায় বছর দুই হল নতুন হেলথ কমপ্লেক্স হয়েছে। এখানে দু’জন ডাক্তার। একজন হাবিব আর অন্যজন সাগীর। আর দু’জন নার্স ও দু’জন আয়া আছে। প্রথমে সাগীর এখানে জয়েন করে। বন্যার পর হাবিব অফিসার হিসাবে জয়েন করেছে। তারা হেলথ কমপ্লেক্স-এর কোয়ার্টারে থাকে। সাগীরের বয়স প্রায় চল্লিশ। সে ফ্যামিলী নিয়ে থাকে। তাদের শুধু একটা মেয়ে। নাম নাফিসা। সে সিক্সে পড়ে। হাবিব ডাক্তার তাদের কাছে খায়। অবশ্য সেজন্য মাসিক টাকা দেয়।

সকাল আটটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত হেলথ কমপ্লেক্সে প্রচুর রুগীর ভিড় হয়। তাদেরকে পরীক্ষা করে ওষুধপত্র দিতে দু’জন ডাক্তার হিমশিম খেয়ে যায়। বিকেলে রুগী দেখা হয় না। আর্জেন্ট কোনো রুগী এলে সাগীর দেখে। হাবিব বিকেল চারটের সময় সাইকেলে ডাক্তারী ব্যাগ ঝুলিয়ে কলে বের হয়। কল থাকুক বা না থাকুক প্রতিদিন বেরিয়ে আশপাশের গ্রামের গরিব ও দুস্থ যারা হেলথ কমপ্লেক্সে যেতে অক্ষম, তাদের চিকিৎসা করে। আজ বিকেলে কলে বেরোবার প্রস্তুতি নিচ্ছিল, এমন সময় নাদের আলি হন্তদন্ত হয়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, জলদি চলুন ডাক্তার সাহেব, পশ্চিমপাড়ায় আগুন লেগে অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। হাশেম চাচার মেয়ে মারাত্মক আহত হয়েছে। হেড স্যার আপনাকে এক্ষুণি যেতে বলেছেন।

হাবিব ডাক্তার আতঙ্কিত স্বরে বলল, হাশেম চাচার মেয়ের কি হয়েছে তুমি দেখেছ?

জি না। আমি আগুন নেভাতে গিয়েছিলাম। পৌঁছানর সঙ্গে সঙ্গে হেড স্যার ঐ কথা বলে আপনার কাছে পাঠালেন।

আগুন নেভান হয়েছে?

আমি যাওয়ার আগেই নেভান হয়েছে।

হাবিব ডাক্তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে নিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে বলল, তুমি এস, আমি যাচ্ছি।

.

কুতুবপুর মাধ্যমিক স্কুলের হেড মাস্টার আজরাফ হোসেনের বাড়ি পশ্চিমপাড়ায়। আর্থিক অবস্থা ভালো। তিনি গ্রামের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। প্রায় একযুগ আগে বিয়ে করেছেন; কিন্তু আজও সন্তানের মুখ দেখেন নি। বিয়ের চার-পাঁচ বছরের মধ্যে স্ত্রীর গর্ভে সন্তান না আসায় তারই জিদে ঢাকায় গিয়ে একজন বড় ডাক্তারের কাছে দুজনেরই পরীক্ষা করান। পরীক্ষার পর ডাক্তার বললেন, “আপনাদের কারো কোনো দোষ নেই। আপনার যেমন সন্তান জন্মাবার উপাদান আছে, আপনার স্ত্রীরও তেমনি সন্তান গর্ভে ধারণ করার ক্ষমতাও আছে। অনেক সময় অনেকের দেরিতে সন্তান আসে। এজন্য দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।” তারপর আজ যে সাত বছর হতে চলল, এখনও তাদের সন্তান হয় নি। অবশ্য এজন্য আজরাফ হোসেনের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু তার স্ত্রী তাসনিমা খাতুন সন্তানের জন্য অস্থির হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। গভীর রাতে গুমরে গুমরে কাঁদেন।

একরাতে আজরাফ হোসেনের ঘুম ভেঙ্গে যেতে স্ত্রীকে কাঁদতে দেখে বললেন, কী হয়েছে? কাদছ কেন? কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?

তাসনিমা খাতুন চোখ মুছে বললেন, আমি এমনই হতভাগী এতদিনেও তোমাকে একটা সন্তান দিতে পারলাম না।

আজরাফ হোসেন বললেন, তুমি কী সন্তান দেয়ার মালিক? মালিক তো আল্লাহ। তাঁর ইচ্ছায় সারা মাখলুকে সব কিছু চলছে। তিনি ইচ্ছা করলে আমাদেরকে সন্তান দেবেন। ইচ্ছা না হলে দেবেন না। এতে কাদার কি আছে? শোন, আল্লাহর ইচ্ছার উপর প্রত্যেক মানুষের, বিশেষ করে মুসলমানদের সন্তুষ্ট থাকা উচিত। নচেৎ ঈমান থাকবে না।

তাসনিমা খাতুন বললেন, আল্লাহ আমাদের এত কিছু দিয়েছেন, কিন্তু একটা সন্তান দিচ্ছেন না কেন?

এক্ষুনি বললাম না, সব কিছু আল্লাহর ইচ্ছা? সেদিন কুরআনের তফসিরে পড়লাম, হযরত ইয়াকুব (আঃ)-কে বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহ হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) নামে সন্তান দিয়েছিলেন। তখন তাঁর স্ত্রীর সন্তান ধারণের বয়স পার হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ সর্বশক্তিমান, তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। আমাদের এখনও সন্তান হওয়ার সময় আছে। অত নিরাশ হচ্ছ কেন? ভাগ্যে থাকলে নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের আশা পূরণ করবেন।

চল না, তারানগর ফকিরের দরগায় গিয়ে সন্তানের জন্য মানত করে আসি।

কী বললে? ফকিরের দরগায় মানত করবে? জান না, কোনো পীরের মাজারে বা দরগায় কোনো কিছু মানত করা, সিন্নী, আগরবাতি, মোমবাতি বা টাকা-পয়সা দেয়া হারাম। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে এটা শেরেক। আর শেরেক খুব কঠিন গোনাহ। যা আল্লাহ মাফ করবেন না।

কই, এরকম কথা তো আগে কখনও শুনি নি? কত লোক তো ঐসব জায়গায় গিয়ে মানত করে।

যারা করে, তারা ইসলামের এই হুকুম জানে না। মানত করতে হলে আল্লাহর কাছে করতে হয়। আমি তাঁর কাছে করেছি, তুমিও কর। কোনো মাজারে বা দরগায় মানত করার কথা কখনো মনে আনবে না।

তওবা করছি, আর কখনও মনে করব না। আল্লাহ আমাকে মাফ করুক। তারপর মানত করল, “আল্লাহ আমাদেরকে অন্তত একটা সন্তান দাও। আমি মসজিদে এক হাজার, মাদ্রাসায় এক হাজার টাকা দান করব। আর গ্রামের গরিব এতিম ছেলেমেয়েদেরকে ঈদের সময় এক হাজার টাকার নতুন জামা-কাপড় কিনে দেব।”

আজরাফ হোসেন আমিন বলে বললেন, আল্লাহ তুমি আমার স্ত্রীর মনের কামনা কবুল কর।

মানত করার মাস দুই পর তাসনিমা খাতুন কিছু খেতে পারছেন না। খেতে গেলে ওকি হয়। জোর করে খেলে বমি হয়ে যায়। স্ত্রীর এই রকম অবস্থা দেখে আজরাফ হোসেন একজন কাজের লোককে হাবিব ডাক্তারকে নিয়ে আসার জন্য পাঠিয়েছিলেন।

হাবিব ডাক্তার তখন মাত্র ছ’মাস হল কার্পাসডাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্সে জয়েন করেছে। আজরাফ হোসেনের বাড়িতে এসে সব কিছু শোনার পর রুগীর নাড়ী পরীক্ষা করে মৃদু হেসে বললেন, আপনার স্ত্রীর পেটে সন্তান এসেছে। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন।

আজরাফ হোসেন আনন্দে কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারলেন না। তারপর সামলে নিয়ে উৎফুল্লকণ্ঠে বললেন, সত্যি বলছেন ডাক্তার?

হাবিব ডাক্তার বললেন, জি।

আজরাফ হোসেন ঘরের মেঝেতেই সিজদায় গিয়ে কিছুক্ষণ চোখের পানি ফেলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর সিজদা থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, জানেন ডাক্তার, আজ একযুগ এই খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

হাবিব ডাক্তার অবাক হয়ে বলল, এতদিন তা হলে আপনাদের কোনো সন্তান হয় নি?

তবে আর বললাম কেন, এই খবর শোনার জন্য একযুগ অপেক্ষা করছি।

তাসনিমা খাতুনও ডাক্তারের কথা শুনে ঘোমটার ভিতর চোখের পানি ফেলে আল্লাহর শোকর আদায় করছিলেন। স্বামীর কথা শেষ হতে বললেন, ডাক্তার সাহেবকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসান। এই শুভক্ষণে মিষ্টি মুখ করাবেন।

মিষ্টি ঘরে ছিল, বারান্দায় বসার পর একটা মেয়ে মিষ্টি নিয়ে এসে সালাম দিল।

আজরাফ হোসেন সালামের উত্তর দিয়ে বললেন, কিরে, এক্ষুনি চলে এলি যে? চাচা আজ কেমন আছেন?

মেয়েটি বলল, একই রকম। তারপর আবার বলল, ভাবির শরীর খারাপ শুনে আব্বা থাকতে দিলেন না। কথা শেষ করে চলে গেল।

মেয়েলী কণ্ঠে সালাম শুনে হাবিব ডাক্তার তার দিকে তাকিয়ে অবাক। শাড়ি পরে থাকলেও ওড়না দিয়ে মাথা ও মুখ ঢেকে রেখেছে। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। সেই চোখের দিকে একপলক তাকাতে ডাক্তারের কলজে কেঁপে উঠল। সে বাস্তব জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। ভুলে গেল আজরাফ হোসেন বসে আছেন। এত মায়াবী চোখ সে জীবনে দেখে নি। তার মনে হল, মেয়েটির চোখে যাদু আছে। তা ছাড়া কোনো মেয়ের গলার স্বর যে এত মিষ্টি, তাও কোনো দিন শোনে নি। মেয়েটি চলে যাওয়ার পর আজরাফ হোসেন যখন বললেন, নিন ডাক্তার, একটু মিষ্টি মুখ করে নিন তখন বাস্তবে ফিরে এল।

মিষ্টির প্লেটে চামচ থাকা সত্ত্বেও হাবিব ডাক্তার জগ নিয়ে বারান্দার কিনারে গিয়ে দু’হাত ধুয়ে এসে বিসমিল্লাহ বলে, খেতে খেতে বলল, আপনার চাচার কি হয়েছে?

আজরাফ হোসেন বললেন, উনি এক রাতে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করে প্রায় দু’বছর ধরে বিছানায় পড়ে আছেন। চলাফেরাও করতে পারেন না।

হাবিব ডাক্তার বলল, আল্লাহ খায়ের করুক, খুব দুঃখের ব্যাপার। তা চিকিৎসা করান নি?

হ্যাঁ, খুব দুঃখের ব্যাপারই। যীনাত, মানে যে মেয়েটা মিষ্টি নিয়ে এল, ওর জীবনটাও খুব দুঃখের। আর চিকিৎসার কথা যে বললেন, তা করান হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কিন্তু কোনো ফল হয় নি।

সব কিছু আল্লাহর মর্জি। আমি আপনার চাচাকে একটু পরীক্ষা করব। তার আগে ওঁর সম্পর্কে সবকিছু জানতে চাই।

সবকিছু বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। সময়ও নষ্ট হবে আপনার।

তা হোক, তবু শুনব। সবকিছু না জানলে চিকিৎসা করব কী করে?

তার আগে আমার একটা কথা জানতে খুব ইচ্ছা করছে।

এমন সময় যীনাত দু’কাপ ধূমায়িত চা নিয়ে ফিরে এলে হাবিব ডাক্তার তার চোখের দিকে তাকাবার জন্য মনে প্রচণ্ড চাহিদা সত্ত্বেও তাকাল না। চলে যাওয়ার পর বলল, বলুন কি জানতে চান?

চামচে খাওয়া ডাক্তারী মতে নিষেধ; না ইসলামে নিষেধ, না এটা আপনার গোড়ামী?

ভাইয়ার কথা শুনে ডাক্তার কি বলে শোনার জন্য যীনাত দরজার বাইরে এসে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল।

হাবিব ডাক্তার বলল, কোনোটাতেই নিষেধ নেই। আর এটা গোড়ামীও নয়। আসল ব্যাপার হল, ইসলামের প্রতিটি বিধান বিজ্ঞান ভিত্তিক ও ইহকাল ও পরকালের ভালোর জন্যই। তাই মুসলমানদের প্রতিটি কাজ, যেমন খাওয়া দাওয়া, চলা-ফেরা, শোয়া-বসা, সভা-সমিতি, আচার-আচরণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, এমন কি পেশাব-পায়খানা থেকে স্ত্রী মিলন পর্যন্ত ধর্মের নিয়মানুসারে করা উচিত। এতে করে কিন্তু এইসব কাজ এতটুকু বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে না। আর একটা জিনিস হল, মুসলমানদের প্রতিটি কাজ ইবাদত। তবে কিভাবে প্রতিটি কাজ করলে ইবাদত হবে, তা তাদেরকে জানতে হবে। একটা উদাহরণ দিলে বুঝতে পারবেন। যেমন ধরুন, আপনি ভাত খাবেন, ইসলাম শিক্ষা দিচ্ছে, খাওয়ার আগে দু’হাতের কজি পর্যন্ত ভালো করে ধুবেন। খাওয়া শুরু করার আগে ডান হাতের শাহাদাত আঙ্গুলে সামান্য লবণ নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে মুখে দেবেন। তারপর নিজ পাশ থেকে ভাত নিয়ে মুখে দেয়ার আগে বলবেন, “বিসমিল্লাহি ওয়া আয়ালা বারকাতিল্লাহি।” এর অর্থ হল, আল্লাহর নামে শুরু করছি এবং এই খাবারে আল্লাহ তুমি বরকত দান কর। তারপর অল্প অল্প ভাত মুখে দিয়ে ভালো করে চিবিয়ে খাবে। পেট পুরে না খেয়ে আধপেট খাবে। বাকি অর্ধেকের একভাগ পানি দিয়ে পূর্ণ করবে। আর একভাগ খালি রাখবে। খাওয়ার পর প্লেটে ও হাতে লেগে থাকা খাবার জিহ্বা দিয়ে চেটে খেতে হবে। তারপর প্লেটে হাত না ধুয়ে আলাদা পাত্রে অথবা অন্যখানে আবার দু’হাত ভালো করে ধুতে হবে। শেষে পানি খেয়ে বলতে হবে, “আলহামদুলিল্লাহিল্লাজী আতআ’মানা ওয়া শাকায়না ওয়াজ আলনা মিনাল মুসলেমিন।” এর অর্থ হল, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে খাবার খাওয়ালেন, পানি পান করালেন ও মুসলমান দলভুক্ত করেছেন। যিনি আহার দিলেন, আহারের পর তাঁর প্রশংসা বা গুণগান করাই তো উচিত।

শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখার জন্য আমরা খাওয়া-দাওয়া করি। ধর্মীয় নিয়মে না খেলেও খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা মিটবে ঠিক, কিন্তু ইবাদত হবে না। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কিন্তু খাওয়ার ধর্মীয় নিয়মগুলো অতি উত্তম। আরো একটু খোলাসা করে বলি, খাওয়ার আগে ময়লা পরিষ্কার করার জন্য দু’হাত ধুতে বলা হয়েছে। এক হাতে নিশ্চয় তা সম্ভব নয়। তারপর অল্প একটু লবণ মুখে দেওয়ার উদ্দেশ্য জিবের লালা বের করা। এই লালাই আমাদের খাদ্য হজম করে। অল্প অল্প খাবার মুখে দিয়ে ভালো করে চিবানো মানে খাবারের সঙ্গে ঐ লালা বেশি করে মিশে যায় এবং হজমের সহায়তা করে। তারপর প্লেট ও হাত চেটে খাওয়া মানে অধিক পরিমাণ জিহ্বা থেকে লালা বের করা। যা নাকি হজমের জন্য লাগে। শেষে আবার দু’হাত খোবার অর্থ, এক হাতে ভালো করে ধোয়া হয় না। এখন আপনিই বলুন, কেউ যদি ধর্মীয় নিয়মে খাওয়া-দাওয়া করে, তাকে কী গোঁড়া বলবেন?

আজরাফ হোসেনকে না সূচক মাথা নাড়তে দেখে হাবিব ডাক্তার বললেন, এবার নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। ধর্মীয় বিধান মানুষের জন্য কত মঙ্গলময়? আরো একটা জিনিস নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, মুসলমানদের যে কোনো কাজের ফলাফল দু’টো। একটা ইহলৌকিক আর অন্যটা পারলৌকিক? ইসলামের বিধান প্রধানত তিনভাগে বিভক্ত। যেমন—ফরয, ওয়াজীব ও সূন্নত। অবশ্য নফল, মোস্তাহাবের কথাও ইসলামে উল্লেখ আছে। সেগুলো করলে সওয়াব আর না করলে কোনো দোষ নেই। ফরয হল, শরীয়তের বিধানানুসারে যে সকল বিষয় কুরআন ও সুন্নাহর অকাট্য প্রমাণ দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে এবং অবশ্য পালন করতে হবে, উহাকে ফরয বলে। ফরয পালন না করলে কবীরা গুনাহ হয় এবং অস্বীকার করলে কাফের হয়। ওয়াজীব হল, যে সকল শরীয়ত বিধান অস্পষ্ট প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হলেও অপরিহার্য বলে নির্ধারিত হয়েছে, উহাকে ওয়াজীব বলে। আর সুন্নত হল, যা করার জন্য হযরত নবী করিম (দঃ) তাগিদ দিয়াছেন এবং নিজে সদা সর্বদা তা করেছেন। তবে কোনো মুসলমানদের উচিত নয়, রাসুল (দঃ) এর সুন্নতকে ছোট মনে করা অথবা অবহেলা করা। তা না হলে পূর্ণ মুসলমান হতে পারবে না। কারণ আল্লাহ কুরআন পাকে বহু জায়গায় বলেছেন, “আল্লাহকে ও তাঁর রাসূল (দঃ) কে অনুসরণ কর।” অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দঃ) এর বিধান মেনে চল। আরো বলেছেন, “হে রাসূল বলুন, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস, তা হলে তোমরা আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদিগকে ভালবাসিবেন এবং তোমাদের যাবতীয় গুনাহ মাফ করিয়া দিবেন।” [সূরা : আল ইমরান, আয়াত-২৯, পারা-৩]

এবার চামচে না খেয়ে হাতে খাওয়ার ব্যাপারে বলছি। রাসূল (দঃ) কখনও চামচে খান নাই, হাতে খেয়েছেন। আমি তাকে অনুসরণ করেছি মাত্র। এটা তখনই গোঁড়া হত যদি আপনাকেও হাতে খাওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করতাম। আপনি জানেন কিনা জানি না, ইসলামে কিন্তু জোর জবরদস্তির স্থান নেই।

আজরাফ হোসেন বললেন, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দোষ কোথায় বলুন? মৌলবীরা শুধু সওয়াব হাসিল করার জন্য কুরআন-হাদিস থেকে বয়ান করেন। তারা যদি আপনার মতো সওয়াবের সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক যুক্তিগুলোও দেখাতেন, তা হলে ইসলামের কোনো কাজকেই মুসলমানরা অবহেলা করত না। এবং যারা ইসলামের অনুসারী তাদেরকে কেউ গোঁড়া বলতে পারত না।

হাবিব ডাক্তার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, আপনার কথাই ঠিক। আলেমদের এই ভুলের জন্য সারাবিশ্বে মুসলমানরা আসল ইসলাম থেকে বঞ্চিত হয়ে সওয়াব কামাবার জন্য শুধু খোলস নিয়ে টানাটানি করছে। আর সেইজন্য তারা বিশ্বের কাছে সাম্প্রদায়িক আখ্যা পাচ্ছে। অথচ ইসলামে সাম্প্রদায়িকতার এতটুকু স্থান নেই।

আজরাফ হোসেন বললেন, আপনি খুব দামী কথা বলেছেন। তারপর বললেন, আমি আশ্চর্য হচ্ছি, আপনি একজন ডাক্তার হয়ে ইসলামের এত জ্ঞান অর্জন করলেন কি করে? আপনি তো আর মাদ্রাসা থেকে ডিগ্রী নেন নি?

হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, মাদ্রাসায় না পড়লেও প্রতিটি মুসলমান নর-নারীর ইসলামের জ্ঞান অর্জন করা অবশ্য কর্তব্য। আর সে জন্যে আমাদের স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটির সিলেবাসে ইসলামী বই পাঠ্য করা উচিত। এটা করা হয় নি বলেই স্কুল, কলেজ ও ভার্সিটি থেকে যারা ডিগ্রী নিয়ে বেরোচ্ছে, তারা ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছে না। তাই ইসলামের প্রতি তারা এত উদাসীন এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এবার এসব কথা থাক। আপনার চাচার কথা বলুন, শোনার পর ওঁকে একটু দেখে যাব।

যীনাত এতক্ষণ তাদের কথা শুনছিল। এবার ভিতরে ঢুকে নাস্তার প্লেট ও চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল।

আজরাফ হোসেন যীনাতের দিকে তাকিয়েছিলেন। বেরিয়ে যেতে বললেন, জানেন ডাক্তার, একে নিয়ে আমার খুব দুশ্চিন্তা। হাশেম চাচা, মানে যীনাতের বাবা ওর দুইবার বিয়ে দিয়েছিলেন। প্রথমবার বিয়ের রাতে জামাই সাপের কামড়ে মারা যায়। বছর খানেক পরে আমি উদ্যেক্তা হয়ে আবার বিয়ে দিলাম। যীনাত দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে রাজি ছিল না। আমিই অনেক বুঝিয়ে রাজি করিয়েছিলাম। বৌ নিয়ে বর ও বরযাত্রী ফিরে যাওয়ার সময় পথে ঝড়-বৃষ্টি হয়। সেই সময় বজ্রপাতে ঐ জামাইও মারা যায়। এরপর থেকে ওকে গ্রামের সবাই অপয়া মেয়ে বলে। যীনাতও নিজেকে অপয়া ভাবে। আমি আবার ওর বিয়ে দিতে চাই; কিন্তু কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। আমার স্ত্রীকে বোঝাতে বলেছিলাম, রাজি না হয়ে বলেছে, আমার তকদীরে স্বামী নেই। যদি থাকত, তা হলে দু’দুটো স্বামী বিয়ের রাতে মারা গেল কেন? আবার যার সঙ্গে বিয়ে হবে সে যদি মারা যায়, তা হলে এ মুখ কাউকে দেখাতে পারব না। এমনই তো সবাই আমাকে অপয়া বলে। অথচ ওর মতো সুন্দরী ও গুণবতী মেয়ে দ্বিতীয় আর কেউ আছে কিনা জানা নেই। চাচী আম্মা, মানে ওর মাও খুব সুন্দরী, গুণবতী, ধার্মিক ও পর্দানশীল ছিলেন। হাশেম চাচা আমার থেকে চার পাঁচ বছরের বড় হলেও আমাদের মধ্যে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। আমি তো সম্পর্কে চাচী আম্মার ছেলে, তবু তিনি আমার সামনে আসতেন না। কথা বললে পর্দা করে বলতেন। গ্রামের কেউ তার পা পর্যন্ত দেখে নি। কোথাও গেলে বোরখা পরে হাতে পায়ে মোজা পরে যেতেন। আমার মা তাকে খুব ভালবাসতেন। মায়ের কাছে রাতে আসতেন। মায়ের কাছে তার সবকিছু শুনেছি। মা বলতেন, হাসেমের বৌ আল্লাহর খাস বান্দি। একটা ঘটনা বলছি শোন, তুই তখন আমার কোলে দু’বছরের। সেই সময় হাসেমের রান্নাঘরে আগুন লাগে। সেখান থেকে তাদের শোবার ঘরের চালে আগুন লাগে। হাশেম আলি ঘরে ছিল না। গ্রামের লোকজন আগুন নেভাতে এসে দেখল, শোবার ঘরের চালের আগুন ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। সবাই অবাক হয়ে আগুন নিভে যাওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ফিরে গেল। আশপাশের বাড়ির মেয়েরা হাশেম আলির বৌ-এর খোঁজ করে না পেয়ে ঘরের বন্ধ দরজা আঘাত করে ডাকতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর বৌটা দরজা খুলে বেরিয়ে এল। মেয়েরা বলল, তোমার ঘরের চালে আগুন লেগেছে আর তুমি দরজা বন্ধ করে ঘরে রয়েছ। এ কেমন কথা? বৌটা চুপ করে রইল। অনেকে ঘরের ভিতর উঁকি মেরে দেখল, নামায পাটি বিছানো রয়েছে। যখন অনেকবার প্রশ্ন করেও উত্তর পেল না তখন তারা ফিরে গেল। কথাটা শুনে কয়েকদিন পর আমি হাশেমের বৌকে ডেকে পাঠালাম। আসার পর ঘটনাটা জিজ্ঞেস করলাম। বলল, ঘরের চালে আগুন লেগেছে দেখে ভাবলাম, লোকজন যখন নেভাতে আসবে তখন আমি পর্দা রক্ষা করতে পারব না, তাই তাড়াতাড়ি অযু করে ঘরের ভিতর ঢুকে দরজা বন্ধ করে নামাযপাটি বিছিয়ে সিজদায় গিয়ে কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে জানালাম, “আমি বেপর্দার ভয়ে তোমার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি। তুমি আমাকে রক্ষা কর। তোমার ইশারাতেই আগুন লেগেছে। তুমি ইচ্ছা করলে নিভাতে পার। নমরুদ যখন হযরত ইবরাহিম (আঃ) কে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দিয়েছিল তখন তুমি সেই অগ্নিকুণ্ডকে ফুলের বাগান করে দিয়েছিলে। ইচ্ছা করলে তুমি আমাদের ঘরের আগুন নিভিয়ে দিতে পার। অথবা আমাকেসহ এই ঘর পুড়িয়ে দিতে পার। আমি তোমার কাছে নিজেকে সোপর্দ করলাম। আরো অনেক কিছু বলে কান্নাকাটি করতে লাগলাম। তার অপার করুণায় ও কুদরতে ঘরের আগুন আপনা থেকে নিভে যায়।” চাচী আম্মা কিভাবে মারা যান বলছি শুনুন, যীনাতের বয়স তখন দশ কি বার, একদিন রাত তিনটের সময় চাচী আম্মা তাহাজ্জুদের নামায পড়ার সময় সিজদায় গিয়ে মারা যান। তারপর চাচা আর বিয়ে করেন নি। যীনাত মায়ের সবগুণ পেয়েছে। প্রাইমারীতে বৃত্তি পেয়েছিল। চাচী আম্মা আর পড়াতে চান নি। আমিই বুঝিয়ে সুঝিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি করি। এখন যেভাবে ওড়না পরেছে দেখলেন; ক্লাস সিক্স থেকে ঐভাবেই ওড়না পরে স্কুলে যেত। এস.এস.সি.তেও মেধা তালিকায় স্থান পেয়ে পাশ করেছিল। ওকে দামুড়হুদা ওদুদশাহ কলেজে ভর্তি করতে চেয়েছিলাম। যীনাত রাজি হল না। বলল, বাসে লোকজনের গা ঘেষাঘেষি করে যাতায়াত করতে পারবে না। হাশেম চাচার অবস্থা তখন স্বচ্ছল ছিল। উনিও খুব ধার্মিক। স্ট্রোক করে প্রথমদিকে একু-আধটু চলাফেরা করতে পারতেন। কিছুদিন থেকে তাও পারেন না। উনি বেঁচে থাকতে যীনাতের আবার বিয়ে দিতে চান। আমিও চাই; কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। কথায় আছে, বসে বসে খেলে রাজার ধন ভাণ্ডারও শেষ হয়ে যায়। হাশেম চাচা জমি-জায়গা বিক্রি করে এতদিন সংসার চালিয়েছেন, নিজের চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন একদম নিঃস্ব। বাস্তুভিটা ছাড়া কিছুই নেই। আমি ওদেরকে যতটা পারি সাহায্য করি। যীনাত সারাদিন আমাদের সংসারে কাজকর্ম করে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঘরে গিয়ে বাপের সেবা করে। ওরা সবাই এত ধার্মিক, তবু কেন আল্লাহ ওদের উপর এত বিপদ দিলেন বলতে পারেন?

হাবিব ডাক্তার বললেন, যারা বেশি ধার্মিক তাদেরকে আল্লাহ কঠিন কঠিন বিপদে ফেলে পরীক্ষা করেন। এর বেশি কিছু বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। আজ আর নয়, চলুন, আপনার চাচাকে দেখে তারপর যাব।

আজরাফ হোসেন একটু উঁচু গলায় বললেন, যীনাত, এদিকে একটু আয় তো বোন।

যীনাত রান্না করছিল। ভাইয়ার কথা শুনে এসে একপাশে দাঁড়াল।

আজরাফ হোসেন বললেন, চাচাকে ডাক্তার দেখবেন। তুই ঘরে যা। আমরা আসছি।

হাবিব ডাক্তার হাশেম আলিকে পরীক্ষা করে বলল, আজরাফ স্যারের কাছে আপনার সব কথা শুনেছি। আমার যতদূর বিশ্বাস আপনি মানসিক দিক দিয়ে খুব ভেঙ্গে পড়েছেন। আর মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করেন। অবশ্য এরকম হওয়াই স্বাভাবিক। তবু বলব আপনি ধার্মিক লোক হয়ে এতটা ভেঙ্গে পড়া ঠিক হয় নি। জানেন তো, সবকিছু আল্লাহর মর্জিতেই হয়। তাঁর মর্জির উপর সন্তুষ্ট থাকা মুমীন মুসলমানদের কর্তব্য। তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাদের কঠিন কঠিন বিপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। নবী হযরত আইয়ুব (আঃ) এর কথা জানেন বোধহয়? তাকে আঠার বছর কুষ্ঠ রোগ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। শুধু তাই নয় তাঁর বাণিজ্যিক জাহাজগুলো ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলেমেয়েদের মৃত্যু দিয়েছিলেন। শেষে বাড়ি ছাড়া করে জঙ্গলে পাঠাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। এতকিছু সত্ত্বেও হযরত আইয়ুব (আঃ) আল্লাহর উপর এতটুকু অসন্তুষ্ট হন নি। বরং সব সময় তার জিকিরে মশগুল থাকতেন। তিনি পরীক্ষায় পাশ করেছিলেন। তাই আল্লাহ তাকে ব্যাধিমুক্ত করেন এবং ধন-সম্পদ ফিরিয়ে দেন ও ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়ে দেন। আমি আপনার চিকিৎসা করব। আপনি আল্লাহর উপর ভরসা রেখে বুকে সাহস রাখুন। তার কাছে গুনাহ খাতা মাফ চেয়ে রোগ মুক্তির জন্য কান্নাকাটি করুন। আর সবর করার তওফিক চান। ইনশাআল্লাহ। আপনি কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠবেন। আর আপনার মেয়ের জন্য এতটুকু দুশ্চিন্তা করবেন না। আল্লাহ প্রত্যেকের ভাগ্য নির্ধারণ করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। কোনো মানুষই তা পরিবর্তন করতে পারবে না। একথা আপনি জেনেও কেন তার জন্য এত দুশ্চিন্তা করেন? আমি মাঝে মাঝে আপনাকে দেখতে আসব। আজই ওষুধ পাঠিয়ে দেব। খাওয়ার নিয়ম কাগজে লিখে দেব। ঠিকমতো ওষুধগুলো খাবেন। তারপর আজরাফ হোসেনকে বলল, কাউকে পাঠাবেন, তার হাতে ওষুধগুলো দিয়ে দেব।

আজরাফ হোসেন বললেন, আপনাকে ওষুধ পাঠাতে হবে না। আপনি প্রেসক্রিপশন করে দিন, আমি কিনে নেব।

হাবিব ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে বলল, ওষুধগুলো এখানে পাবেন কিনা জানি না, যদি না পান, ঐ লোককে আমার কাছে যেতে বলবেন। তারপর যীনাতের দিকে তাকিয়ে বলল, একটা বোতলে পানি ভরে নিয়ে আসুন।

যীনাত বোতলে পানি ভরে নিয়ে এলে আজরাফ হোসেনকে বলল, কিছু মনে করবেন না, আপনি ওকে নিয়ে ঘরে চলে যান। আমি ইনার সঙ্গে কিছু আলাপ করে চলে যাব।

আজরাফ হোসেন একটু অবাক হলেও কিছু না বলে যীনাতকে নিয়ে চলে গেলেন।

হাবিব ডাক্তার হাশেম আলিকে জিজ্ঞেস করল, প্রায় প্রতিরাতে আপনার স্ত্রীকে স্বপ্নে দেখেন তাই না?

হাশেম আলি অবাক হয়ে বললেন, হ্যাঁ দেখি।

কি অবস্থায় ওঁকে দেখেন?

আমি যেন এই খাটে শুয়ে আছি, আর আমার স্ত্রী ঘরের এককোণে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি জিজ্ঞেস করি, কাঁদছ কেন? কোনো উত্তর না দিয়ে কাঁদতেই থাকে। কাছে আসতে বললেও আসে না।

আমি খাট থেকে নেমে কাছে গেলে তাকে আর দেখতে পাই না।

প্রায় প্রতি রাতে একই স্বপ্ন দেখেন তাই না?

হ্যাঁ তাই।

হাবিব ডাক্তার বিড় বিড় করে কিছু পড়ে হাশেম আলির গায়ে ও বোতলের মুখে ফু দিল। তারপর বলল, সকালে ও সন্ধের পর বোতলের পানি এক ঢোক করে খাবেন। আর রাতে ঘুমাবার সময় হাতে অল্প একটু পানি নিয়ে চোখে মুখে দেবেন। তা হলে স্বপ্নে আর আপনার স্ত্রীকে দেখবেন না। আবার বলছি, যীনাতের ব্যাপারে কোনো দুশ্চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ আপনি কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবেন। আল্লাহর ইচ্ছায় পাত্র নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দেবে। এবার আসি, কয়েকদিন পর আসব। আর শুনুন, এসব কথা কাউকে বলবেন না। এমন কি আজরাফ স্যার বা আপনার মেয়েকেও না। কথাটা খুব খেয়াল রাখবেন বলে হাবিব ডাক্তার সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

কয়েক মাসের মধ্যে হাশেম আলি সম্পূর্ণ না হলেও বেশ কিছুটা সুস্থ হয়েছেন। হাঁটাচলা করতে পারেন। পাড়ার পাঞ্জেগানা মসজিদে নামায পড়তে যেতে পারেন। জুম্মা মসজিদ বিশ্বাস পাড়ায়। দূর বলে জুম্মা পড়তে যেতে পারেন না। হাবিব ডাক্তারের চিকিৎসায় পঙ্গু হাশেম আলি চলাফেরা করতে পারে জানার পর সারা গ্রামের মানুষের কাছে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে।

আজরাফ হোসেন গ্রামের সবার মতো তাকে একজন ভালো ডাক্তার ও কামেল নোক মনে করেন। তার অনুরোধে হাবিব ডাক্তার প্রতি মাসে একদিন এসে তাসনিমা খাতুনকে চেকআপ করে। সেই সাথে হাশেম আলিকেও করে।

হাবিব ডাক্তারের সব কিছু দেখে শুনে যীনাত মুগ্ধ। বর্তমান যুগে এরকম মানুষও থাকতে পারে, তা তাকে না দেখলে বিশ্বাস করত না। চব্বিশ-ঘণ্টা তার কথা ভাবে। আব্বাকে দেখতে এলে যতটুকু পারে ভালো আপ্যায়ন করাবার চেষ্টা করে। সে সময় একে অপরের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে। তার সম্পূর্ণ পরিচয় জানার খুব ইচ্ছা হয় যীনাতের। ইচ্ছাটাকে জোর করে দমন করে রাখে।

গত মাসে যখন হাবিব ডাক্তার হাশেম আলিকে দেখতে এসে সুযোগ পেয়ে যীনাতকে বলেছিল, আজরাফ স্যারের কাছে আপনাদের সবকিছু শুনেছি, আপনি যে আর বিয়ে কতে চান নি ও নিজেকে অপয়া ভাবেন, তাও শুনেছি। এটা কিন্তু ঠিক নয়। দুনিয়াতে অনেক মুসলিম মহিয়সী নারী ছিলেন, যারা একটা, দু’টো, এমনকি তিনটে স্বামী মারা যাওয়ার পরও নিজেদেরকে অপয়া না ভেবে আবার বিয়ে করেছেন। আর ধর্মে এ ব্যাপারে কোনো নিষেধও নেই।

উত্তরে যীনাত বলেছিল, সেইসব মুসলিম মহিয়সী নারীদের জীবনী পড়েছি এবং স্বামী তালাক দিলে অথবা মারা গেলে ধর্মেও যে দ্বিতীয় তৃতীয় অথবা চতুর্থ বিয়ে করতে নিষেধ নেই, তাও জানি। ঐসব মহিয়সী নারীরা উপযুক্ত পাত্র পেয়েছিলেন, তাই একটা, দু’টো এমনকি তিনটে স্বামী মারা যাওয়ার পর আবার বিয়ে করেছিলেন।

হাবিব ডাক্তার অল্পক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিল, কোনো উপযুক্ত পাত্র যদি বিয়ের প্রস্তাব দেয়, তা হলে?

আমার তো মনে হয় অপয়া মেয়ে বলে আমার যে অপবাদ গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে, জেনেশুনে কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে না। আর যদি না জেনে কেউ আসে, তবে তাকে জানিয়ে দেব। তখন নিশ্চয় সে প্রস্তাব ফিরিয়ে নেবে।

ধরুন কেউ জেনেশুনে প্রস্তাব দিল, তখন?

তখন যদি পাত্রকে উপযুক্ত মনে করি, তা হলে অন্য কথা।

সেদিন আর কিছু না বলে হাবিব ডাক্তার ফেরার সময় চিন্তা করেছিল, একসময় আজরাফ স্যারকে যীনাতকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেবে। কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে দেয়া হয় নি। কয়েকদিন আগে তার স্ত্রীকে চেকআপ করতে গিয়ে চা-খাওয়ার সময় বলল, স্যার, আপনি যদি অভয় দেন, তা হলে একটা কথা বলতে চাই।

আজরাফ স্যার এতদিনে হাবিব ডাক্তারকে খুব সৎ, ধার্মিক ও সাহসী বলে জেনে এসেছেন। তাই আজ তার কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে বললেন, অভয় দেয়ার কথা বলছেন কেন বুঝতে পারছি না।

না, মানে আমি তো বাইরের লোক, কথাটা আপনাদের আত্মীয় সম্পর্কে। শুনে যদি আমাকে ভুল বোঝেন, তাই বলে থেমে গেল।

আজরাফ হোসেন আরো অবাক হয়ে বললেন, আপনাকে ভুল বুঝবো ভাবলেন কী করে? আপনি নিশ্চিন্তে বলুন।

যীনাত কি এখানে আছে?

হাবিব ডাক্তারের মুখে যীনাতের নাম শুনে আজরাফ হোসেন আর একবার অবাক হলেন। কারণ এর আগে কখনও তার মুখে শোনেন নি। বললেন, না নেই। ওদের ঘরে গেছে।

আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। তবে খুব গোপনে। আপনারা দু’জন, আপনার চাচা, বিশ্বস্ত একজন লোক ও যিনি বিয়ে পড়াবেন, এই পাঁচজন ছাড়া অন্য কেউ যেন জানতে না পারে।

আজরাফ হোসেন এত অবাক হলেন যে, অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। সেই সাথে আনন্দিতও কম হলেন না। ভাবলেন, আল্লাহ যীনাতকে এর সঙ্গে জোড়া করে রেখেছিলেন বলে হয়তো তার দু’বার বিয়ে হলেও কোনো স্বামীই তাকে স্পর্শ করার সুযোগ পায় নি। আর এই জন্যই বোধহয় আল্লাহ হাবিবকে ডাক্তার করে এই এলাকায় পাঠিয়েছেন।

তাকে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকতে দেখে হাবিব ডাক্তার বলল, কথাটা বলে বোধহয় ভুল করে ফেলেছি, অনুগ্রহ করে মাফ করে দিন।

আজরাফ হোসেন মৃদু হেসে বললেন, আপনি ভুল করেন নি। আল্লাহর কুদরতের কথা চিন্তা করছিলাম। আপনার কথা শুনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। আমার স্ত্রীকে দিয়ে আপনার কথা যীনাতকে জানাব। যদি রাজি না হয়,

আমি বোঝাব। এবার আমি একটা কথা বলব, রাখবেন বলুন।

হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, আমার পরিচয় জানতে চাইবেন তাই না?

আজরাফ হোসেন আবার অবাক হলেন। বললেন, কি করে বুঝলেন?

বোঝার আর অসুবিধে কোথায়? পাত্রের সবকিছু না জেনে কি মেয়ের গার্জেনরা বিয়ে দেন? না দেয়া উচিত?

আজ কিন্তু আপনি বারবার আমাকে অবাক করছেন?

হাবিব ডাক্তার আবার মৃদু হেসে বললেন, আমার পরিচয় শুনলে তো আবার অবাক হবেন।

তাই না কি? তা হলে দেরি না করে বলে ফেলুন।

তার আগে আপনাকে ওয়াদা করতে হবে, যা শুনবেন, তা কাউকে বলবেন না।

ঠিক আছে, ওয়াদা করলাম, আপনি বলুন।

হাবিব ডাক্তার অল্প সময় চুপ করে থেকে বলল, খাঁপাড়ার নাদের আলির পূর্ব-পুরুষদের সময় থেকে বিশ্বাসপাড়ার মুশতাক বিশ্বাসদের শত্রুতা কেন বলতে পারেন?

আজরাফ হোসেন বললেন, মায়ের কাছে শুনেছি, মুশতাক বিশ্বাসের দাদা হারুন বিশ্বাস খায়েদের একটা মেয়েকে ভালবেসে গোপনে বিয়ে করেছিলেন। সে বিয়ে হারুন বিশ্বাসের বাবা রহিম বিশ্বাস মেনে নেন নি এবং ঐ বৌকে ঘরেও তুলেন নি। কিন্তু হারুন বিশ্বাস বাবার অগোচরে স্ত্রীর কাছে যাতায়াত করতেন। আর স্ত্রীকে ও তার বাপ-চাচাদের বলতেন, বাবার রাগ পড়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ছেলে খাঁপাড়ায় যাতায়াত করে জেনে রহিম বিশ্বাস তার আবার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। ততদিনে ঐ মেয়ের একটা ছেলে হয়েছে। তখন তার বয়স দুই মাস। হারুন বিশ্বাস আবার বিয়ে করবে শুনে খায়েরা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বাস বাড়িতে এসে প্রতিবাদ করেন এবং বৌ ঘরে তুলে নিতে বলেন। রহিম বিশ্বাস খায়েদের যা তা বলে অপমান করে তাড়িয়ে দিতে চাইলে উভয় পক্ষ তর্ক বিতর্কে মেতে উঠেন। এক পর্যায়ে রহিম বিশ্বাস রেগে গিয়ে মেয়ের বাবাকে গুলি করেন। কিন্তু তার আগে মেয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ায় এবং গুলি খেয়ে মারা যায়। তারপর অনেক দিন মামলা মোকদ্দমা চলেছিল। খায়েদের থেকে বিশ্বাসরা অনেক বেশি ধনী। টাকার জোরে তারা মামলায় জিতে গেলেন। মেয়েটার যে দুই মাসের ছেলে ছিল, তাকে আর এক খালা নিয়ে গিয়ে মানুষ করে। সেই ছেলে বড় হয়ে সেখানেই বিয়ে শাদী করে থেকে যায়। সে আর এই গ্রামে ফিরে আসে নি। এই পর্যন্ত বলে আজরাফ হোসেন বললেন। কিন্তু আপনি এসব কথা জানতে চাইলেন কেন?

হাবিব ডাক্তার বলল, আপনি যে মেয়ে ও তার দুই মাসের ছেলের কথা বললেন, তারা হলেন আমার বড় মা ও দাদাজী।

আজরাফ হোসেন চমকে উঠে অবাককণ্ঠে বললেন, কী বলছেন আপনি?

এতটুকু শুনেই চমকে উঠলেন? এরপর যা বলব, শুনে তা হলে কী করবেন? বলছি শুনুন,

আমি যখন বিদেশ থেকে বড় ডাক্তার হয়ে ফিরে এলাম তখন দাদাজী একদিন আমাকে তার মা-বাবার পরিচয় ও মায়ের করুণ মৃত্যুর কথা বলে বললেন, তোর বাবাকে প্রতিশোধ নিতে বলেছিলাম। সে তখন বলছিল নেবে। কিন্তু আজও কিছুই করে নি। সে শুধু টাকার পেছনে ঘুরছে। তোর বাবা যে কাজ করে নি, এখন তুই যদি সেই কাজটা করিস, তা হলে শান্তি পেতাম।

বললাম, ঠিক আছে দাদু, আমি আব্বার সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করে আপনাকে জানাব।

দাদাজী বললেন, তার সঙ্গে যা আলাপ করার আমিই করব। তুই ওয়াদা কর, কাজটা করে আমাকে শান্তি দিবি? আমাকে আমার খালা মানুষ করেছেন। তিনি মারা যাওয়ার সময় বলেছিলেন, তুই তো তোর মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারলি না, তোর ছেলেকে বলিস, সে যেন নেয়। কি জানিস, মায়ের মৃত্যুর কথা মনে পড়লে আজও বুকের ভিতর দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠে। আল্লাহ আমাদেরকে অনেক অর্থ সম্পদ দিয়েছেন। তোর বাবা ও তোর তিন ভাই টাকার পাহাড় জমাচ্ছে। তুইও যেন তাদের মতো টাকার পিছনে ঘুরিস না। আমি চাই, তুই সেই টাকার কিছু অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব মানুষদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ও তাদের উন্নতির জন্য এবং ইসলামের খিদমতে খরচ করবি। বড় ডাক্তার যখন আল্লাহ তোকে করেছেন তখন কুতুবপুরের মতো অজপাড়াগাঁয়ে গিয়ে গরিবদের চিকিৎসা কর। আর সেই সাথে আমার মায়ের খুনের প্রতিশোধ নিবি। বাকি আমার মায়ের ও আমার পৈত্রিক সম্পত্তি পাওয়ার ব্যবস্থা তোর বাবাকে দিয়ে করাব। আমি খোঁজ-খবর নিয়ে জেনেছি, মুশতাক বিশ্বাসের একটা অবিবাহিত অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে আছে। তাকে তুই ছলেবলে কৌশলে বিয়ে করে তোর বড়মার হত্যার প্রতিশোধ নিয়ে বিশ্বাসদের অহংকার ধুলোয় মিশিয়ে দিবি। বল দাদু, তুই আমার বুকের আগুন নেভাবি? তারপর চোখ মুছে বললেন, চুপ করে আছিস কেন? তুই ও কী তোর বাবার মতো আমার কথা না শুনে টাকার পিছনে ঘুরবি?

বড়মার মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণ জেনেও দাদাজীর চোখের পানি দেখে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। বললাম, হ্যাঁ দাদাজী, আব্বা আপনার কথা না রাখলেও ইনশাআল্লাহ আমি রাখব। ওয়াদা করছি, আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও বড় মায়ের হত্যার প্রতিশোধ নেব এবং আপনার অন্যান্য মনের বাসনা পূরণ করব।

দাদাজী আলহামদুলিল্লাহ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুই শুধু মুশতাক বিশ্বাসের মেয়েকে বিয়ে করবি। আর বাকি কাজগুলোও আমি তোকে দিয়েই করাব। এতে তোর জীবনের উপর ঝুঁকি আসবে। ভয় করবি না। আল্লাহর উপর সবকিছুতে সব সময় ভরসা রাখবি। আর আমি তোর বড় ভাইয়ের দ্বারা তাকে প্রটেকশন দেয়ার ব্যবস্থা করব।

দাদাজী কিছু দিনের মধ্যে এখানে পোস্টিং করার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখানে আসার দু’এক মাসের মধ্যে মুশতাক বিশ্বাসের মেয়ে আতিকাকে পাওয়ার পথে কিছুটা অগ্রসর হয়েছিলাম। কিন্তু যখন জানতে পারলাম, আতিকা খাঁপাড়ার বড় মায়ের বংশের নাদের আলিকে স্কুল জীবন থেকে ভালবাসে এবং নাদের আলিও তাকে ভালবাসে তখন ভাবলাম, আল্লাহ খাঁ বংশের গরিব ও এতিম ছেলেকে দিয়েই বিশ্বাসদের সম্মানে আঘাত হানতে চান। তখন ঐ পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যাতে করে ওদের বিয়ে হতে পারে সেই পথে অগ্রসর হচ্ছি। জানি না, আল্লাহ কতদিনে আমার মনের আশা পূরণ করবেন। অনুগ্রহ করে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না, উত্তর দিতে পারব না।

সবকিছু শুনে আজরাফ হোসেন এত অবাক হলেন যে, কথা বলতে ভুলে গেলেন। অনেকক্ষণ পর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ, কোনো প্রশ্ন করব না। তবে একটা প্রশ্ন না করে পারছি না। ধরুন, নাদের আলির সঙ্গে আতিকার বিয়ে হল। তারপর যদি আপনার দাদাজীর মায়ের মতো ঘটনা নাদের আলির জীবনে ঘটে।

আল্লাহর মর্জি থাকলে ঘটবে। তবে আমার বিশ্বাস তা ঘটবে না। তার আগেই আমি মুশতাক বিশ্বাসকে আমার পরিচয় জানিয়ে বড় মায়ের ও দাদাজীর সম্পত্তি দাবি করব। অবশ্য তিনি আমাকেও যে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন তা জানি। আর সেই জন্য আমি পাকা ব্যবস্থা করে এখানে এসেছি।

নাদের আলি ও আতিকার বিয়ের আগেই কি আপনি যীনাতকে বিয়ে করতে চান?

হ্যাঁ, তাইতো গোপনে করতে চাই। ওকে আমার ভীষণ পছন্দ। যতদূর বিশ্বাস যীনাত রাজি হবে। তবে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।

আচ্ছা, বিশ্বাসদের ব্যাপারে আমি যদি আপনাকে সাহায্য করতে চাই?

আশা করি, সাহায্যের দরকার হবে না। হলে আপনি না বললেও সাহায্য চাইতাম।

শুনে খুশি হলাম।

যীনাতকে আসতে দেখে হাবিব ডাক্তার বলল, আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। এবার আসি বলে উঠে দাঁড়াল।

তাসনিমা খাতুন এতক্ষণ আড়াল থেকে তাদের কথা শুনছিলেন। স্বামী কিছু বলার আগে বললেন, দুপুর হয়ে গেছে, খেয়ে যাবেন।

স্ত্রীর কথা শুনে আজরাফ স্যারও বললেন, হ্যাঁ খেয়ে তারপর যাবেন।

মাফ করবেন, আজ খেতে পারব না। হেলথ কমপ্লেক্স থেকে অনেকক্ষণ হয়ে গেল বেরিয়েছি। সাগীর ডাক্তার একা রুগীদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। আজ চলি, অন্য একদিন খাব। আর হ্যাঁ, আপনার স্ত্রীকেও এসব কথা কাউকে বলতে নিষেধ করে দেবেন। তারপর সালাম বিনিময় করে চলে গেল।

হাবিব ডাক্তার চলে যাওয়ার পর তাসনিমা খাতুন বারান্দায় এসে স্বামীর পাশে বসে বললেন, তোমাদের সব কথা শুনেছি। আমার মনে হয় ডাক্তারের প্রস্তাবে যীনাত রাজি হয়ে যাবে।

আজরাফ হোসেন কুঁচকে বললেন, হঠাৎ তোমার এরকম মনে হল কেন?

হঠাৎ নয়, যেদিন ডাক্তার প্রথম আমাকে দেখতে আসে, সেদিন থেকে যীনাতের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। কি যেন ভাবে, অনেক সময় মুখ ভার করে থাকে। মাঝে মাঝে খুব অন্যমনস্ক থাকে। ডাকলে সাড়া পাওয়া যায় না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ তাই। ওর এরকম পরিবর্তন দেখে মনে সন্দেহ হতে ব্যাপারটা জানার জন্য সচেতন হলাম। হঠাৎ একদিন লক্ষ্য করলাম, ডাক্তার এসেছে শুনে ওর মুখে খুশির আমেজ ফুটে উঠল। ভাবলাম, একটু আগে দেখলাম মুখ ভার করে কি যেন চিন্তা করছে, আর ডাক্তার আসার কথা শুনে খুশি হল কেন? তা হলে কি ডাক্তারকে ওর পছন্দ? আবার ভাবলাম, ওতো নিজেকে অপয়া মনে করে আর বিয়ে করতে চায় না। খুশি হওয়ার অন্য কারণ হয়তো থাকতে পারে অথবা আমার দেখার ভুলও হতে পারে। অন্যদিন ডাক্তার এলে এ রকম কিছু পরিবর্তন হয় কিনা দেখার জন্য সচেতন থাকলাম। তারপর যখনই হাবিব ডাক্তার আসেন তখনই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে আমার সন্দেহটা দৃঢ় হয়েছে। তাই বললাম, ডাক্তারের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে।

তোমার কথা যেন আল্লাহ কবুল করেন। তবু কিন্তু আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, প্রায় বছর খানেক আগে আমার সহকারী শিক্ষক জাহাজপোতার আব্দুল বাসেত আমাদের বাড়িতে একদিন এসেছিল। সে সময় যীনাতকে দেখে পছন্দ করে। পরে একদিন স্কুলে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিল। যীনাতের যে আগে দু’বার বিয়ে হয়েছে সে কথা বলার পরও বিয়ে করতে চেয়েছিল। পাত্র হিসাবে আব্দুল বাসেত যে সবদিক থেকে যীনাতের উপযুক্ত তা জানতাম। তাই আমি রাজি হয়ে যীনাতকে অনেক বুঝিয়েছিলাম; কিন্তু ওতো সাফ বলে দিল আর বিয়ে করবে না।

তোমার কথা ঠিক। আব্দুল বাসেত মাস্টারকে হয়তো যীনাতের পছন্দ হয় নি। ওর কথা থাক। আমি আজই ডাক্তারের প্রস্তাব দেয়ার কথা বলে ওর মতামত পরীক্ষা করব।

ঠিক আছে। তাই কর বলে আজরাফ হোসেন বললেন, যোহরের নামাযের সময় হয়ে এল। যাই গোসল করে আসি।

বিকেলে যীনাত যখন ভাবির মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিচ্ছিল তখন তাসনিমা খাতুন বললেন, হাবিব ডাক্তার মানুষটা কেমন বলতে পারিস?

যীনাত ভাবির চালাকি ধরতে পারল না। বলল, গ্রামের মানুষ তো হাবিব ডাক্তার বলতে পাগল। সবার মুখে মুখে তার সুনাম।

আর তোর মুখে বুঝি বদনাম?

যীনাত হেসে ফেলে বলল, তা কেন? তারমতো ভালো মানুষ জীবনে দেখি নি।

হ্যাঁ, তুই ঠিক কথা বলেছিস, আমারও তাই মনে হয়। আমিও তোর ভাইয়া চিন্তা করেছি, ডাক্তারের সঙ্গে তোর আবার বিয়ে দেব।

কথাটা শুনে যীজাতের হৃদয়ের রক্ত আনন্দে তোলপাড় শুরু করল। হাতের চিরুনী হাতে রয়ে গেল। হাতে যেন এতটুকু শক্তি নেই। স্ট্যাচুর মতো চুপ করে বসে রইল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তাসনিমা খাতুন বললেন, কী রে, কিছু বলছিস না কেন? চুলও আঁচড়াচ্ছিস না?

যীনাত সামলে নিয়ে চুলে চিরুনী চালাতে চালাতে বলল, তোমরা চিন্তা করলেও উনি আমার মতো অজপাড়াগাঁয়ের গরিব লোকের অপয়া মেয়েকে বিয়ে করতে যাবেন কেন? হয়তো ঢাকার বড়লোকের মেয়ে ওঁর জন্য অপেক্ষা করছে। ভাইয়াকে এ ব্যাপারে ডাক্তারকে কিছু বলতে নিষেধ করো।

তার কথা শুনে তাসনিমা খাতুন বুঝতে পারলেন, ডাক্তারের সঙ্গে বিয়েতে রাজি। বললেন, আর ডাক্তার যদি নিজে তোর ভাইয়ার কাছে প্রস্তাব দেয়?

উনি তা দিতেই পারেন না?

ধর, যদি দেন?

ততক্ষণে চুল আঁড়চান হয়ে গেছে। খোঁপা বেঁধে দিয়ে বলল, বললাম তো, উনি এরকম প্রস্তাব দিতেই পারেন না।

আর যদি বলি আমরা কিছু বলার আগেই আজ উনি প্রস্তাব অলরেডী দিয়ে ফেলেছেন।

হৃদয়ের আলোড়ন যীনাত এতক্ষণ সামলাতে পারলেও আর পারল না। পিছন দিক থেকে ভাবি বলে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে বলল, এই অপয়া হতভাগির কি এত সৌভাগ্য হবে?

আল্লাহ তক্বদীরে রাখলে অসম্ভবও সম্ভব হয়। ওবেলা সত্যি সত্যি উনি তোকে বিয়ের করার জন্য তোর ভাইয়ার কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন। তাই তো তোর মতামত জানার জন্য এতকিছু বললাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত