০১. কার্পাসডাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্স
কার্পাসডাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্স-এর হাবিব ডাক্তার কুতুবপুর গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় রুগী দেখতে গিয়েছিল। ফেরার পথে পিছনের চাকায় হাওয়া নেই দেখে। সাইকেল হাতে ধরে হেঁটে আসার সময় ভাবল, হয়তো রাস্তার পাশে বাবলা গাছের কাঁটা অথবা অন্য কিছু টায়ার ভেদ করে টিউবে ঢুকে চোরা লিক হয়েছে।
খাঁপাড়ার নাদের আলি দুধেল গাভীর জন্য ক্ষেতের আল থেকে কাঁচা ঘাস কেটে রাস্তায় জমা করছিল। দূর থেকে হাবিব ডাক্তারকে সাইকেল ধরে হেঁটে আসতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে ভাবল, উনি ডাক্তার না হয়ে মাওলানা বা পীর সাহেব হলেই ভালো হত। পাজামা-পাঞ্জাবী, টুপি-দাড়িওয়ালাও যে ডাক্তার হয়, ইনাকে না দেখলে বিশ্বাসই করত না। রুগীকে ওষুধও দেন, আবার পানিপড়াও দেন, ঝাড়ফুকও করেন। রুগী দেখতে গেলে দেখার আগেই রুগী অর্ধেক ভালো হয়ে যায়। গরিবদের কাছ থেকে ফি নেন না, বরং রুগীর পথ্য ও ওষুধ কেনার টাকা দেন। তাই গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মতো নাদের আলির বিশ্বাস, ইনি নিশ্চয় কামেল লোক।
ততক্ষণে হাবিব ডাক্তার কাছে এসে যেতে বলল, স্লামালেকুম ডাক্তার সাহেব।
ওয়া আ’লায়কুমুস সালাম বলে হাবিব ডাক্তার বলল, নাদের আলি, তোমার কিন্তু সালাম দেয়া ঠিক হয় নি।
নাদের আলি অবাক হয়ে বলল, কেন? আপনিই তো সেদিন বললেন, এক মুসলমান আর এক মুসলমানের ভাই। দেখা হলে একে অপরকে সালাম দেবে। আরো বললেন, যে আগে দেবে তার সওয়াব বেশি।
হ্যাঁ, তা বলেছি।
তা হলে আমার সালাম দেয়া ঠিক হয় নি বলছেন কেন?
হাবিব ডাক্তার জানে নাদের আলি অল্প শিক্ষিত সহজ-সরল ছেলে। তাই মৃদু হেসে বলল, সালাম দেয়া ঠিক হলেও তোমার উচ্চারণ ঠিক হয় নি।
কিন্তু আজকাল শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাইতো এই কথা বলে সালাম দেয়। আমি তাদেরটা শুনে শিখেছি।
তাদেরটাও ঠিক হয় নি। আমি শুদ্ধ উচ্চারণ করছি শিখে নাও, “আস সালামু আলায়কুম।”
নাদের আলির স্মরণশক্তি ভালো। মনে মনে কয়েকবার উচ্চারণ করে বলল, “আস সালামু আলায়কুম।”
হাবিব ডাক্তার আবার মৃদু হেসে বলল, হ্যাঁ, এবার ঠিক হয়েছে।
নাদের আলি হাবিব ডাক্তারকে কদমবুসি করে বলল, আপনি না শেখালে চিরকাল ভুল সালাম দিতাম।
তুমি কিন্তু আবার একটা ভুল করে ফেললে।
কি ভুল করলাম বলুন, আমি শুধরে নেব।
মা-বাবা ও মুরুব্বীদের অথবা আল্লাহওয়ালা লোকদের ছাড়া যাকে তাকে কদমবুসি করতে নেই। আমি একজন সামান্য ডাক্তার, আমাকে করা ঠিক হয় নি।
গ্রামের লোকজন আপনাকে খুব কামেল ও আল্লাহওয়ালা বলে মনে করে। আমিও মনে করি। আপনার মতো ভালো মানুষ জীবনে দেখি নি। আপনাকে কদমবুসি করব নাতো কাকে করব? ওকথা বাদ দেন, সাইকেল থাকতে হেঁটে আসছেন কেন বলুন। তারপর পিছনের চাকায় হাওয়া নেই দেখে আবার বলল, মনে হয় যখন রুগী দেখছিলেন তখন কোনো দুষ্টু ছেলে হাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।
আপনার মনে না হলেও আমি কসম কেটে বলতে পারি কোনো ছেলে দুষ্টুমী করে হাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।
হঠাৎ তোমার এরকম কথা মনে হল কেন?
নাদের আলি মৃদু হেসে বলল, ছোটবেলায় চান্স পেলেই কত লোকের সাইকেলের হাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। একবার ধরা পড়ে বকুনী ও চড় হজম করতে হয়েছে। তারপর জিজ্ঞেস করল, আমার ও আতিকার ব্যাপারটা নিয়ে এগোতে পেরেছেন?
এ ব্যাপারে পরে কথা বলব, এখন সবর করে থাক। অনেক দেরি হয়ে গেল। বাজারে গিয়ে সাইকেলের লিক সারাতে হবে।
ঠিক আছে যান, স্লামালেকুম, থুক্কু, আস সালামু আলায়কুম।
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে সালামের উত্তর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল।
নাদের আলি ঘাস কাটতে কাটতে চিন্তা করল, ডাক্তার সাহেবের বয়স কত হতে পারে? দাড়ির জন্য চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ মনে হয়। আসল বয়সটা কত একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে।
বিশ্বাসপাড়ার ভিতর থেকে রাস্তা। রাস্তার ধারে মুশতাক বিশ্বাসের বাড়ির সদর। সদরের কাছে এসে রাস্তায় আতিকাকে দেখে হাবিব ডাক্তার সালাম দিয়ে বলল, কেমন আছেন?
সালামের উত্তর দিয়ে আতিকা বলল, কতবার বলেছি আমাকে তুমি করে বলবেন, তবু আপনি করে বলেন কেন?
ওকথা থাক, রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন বলুন। কারো অসুখ-বিসুখ করে নি তো?
না, কারো কিছু হয় নি। আপনি আমার কথার উত্তর দিলেন না যে?
দেখুন, আমি হলাম একজন সামান্য ডাক্তার। আর আপনি হলেন এই গ্রামের সব থেকে ধনী মুশতাক বিশ্বাসের মেয়ে। তার উপর এস.এস.সি. পাশ। আপনি করে বলাইতো উচিত। তা ছাড়া একজন শিক্ষিত মানুষকে তুমি করে বললে অসম্মান করা হয়।
তা হয়, কিন্তু আমি তো আপনার থেকে বয়সে অনেক ছোট? আপনিই বলুন।, ছোটকে কী কেউ আপনি করে বলে?
তা বলে না, তবে আপনাকে আমি তুমি করে বলতে পারব না।
কেন?
কেনর উত্তরও দিতে পারব না। এবার আসি বলে হাঁটতে শুরু করল।
আতিকা দ্রুত এগিয়ে এসে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে বলল, কেন পারবেন।, না বললে আমিও যেতে দেব না।
হাত সরান, কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে?
সে যাই ভাবুক, তাতে আমার কোনো যায় আসে না। আগেও বলেছি এখনও বলছি, আমি আপনার ছোট বোনের মতো। তবু তুমি করে বলতে পারছেন না কেন বলতে হবে।
আপনি তো খুব জিদ্দী মেয়ে? নাদের আলিকে দেখলাম, ক্ষেতের আলে ঘাস কাটছে। দেখে ফেললে কি মনে করবে?
আতিকা অনেক দিন হল নাদের আলিকে দেখে নি। দোতলার রুম থেকে মাঠ দেখা যায়। অনেক সময় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাস্তার দিকেও নজর রাখে। কখন সখন নাদের আলি মাঠে কাজ করতে এলে অথবা রাস্তা দিয়ে কোথাও গেলে তাকে দেখে। আজও অনেক দূরে তার মতো কাউকে ঘাস কাটতে দেখে সেদিকে তাকিয়েছিল। হাবিব ডাক্তারকে তার সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। হাবিব ডাক্তার সাইকেল ধরে হেঁটে আসছে দেখে নেমে এসে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়েছিল ঐ ছেলেটা নাদের আলি কিনা জানার জন্য। কিন্তু লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারে নি। হাবিব ডাক্তার দেখে ফেলার কথা বলতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ছেড়ে দিয়ে মুখ নিচু করে বলল, দেখলেও কিছু মনে করবে না। সে আপনাকে পীরের মতো মানে। তারপর বলল, আপনি এত লোকের উপকার করে বেড়াচ্ছেন, আমার আর নাদের আলি ভাইয়ের কোনো উপকার করতে পারলেন না।
হাবিব ডাক্তার একটু গম্ভীর স্বরে বলল, এসব কাজে তাড়াহুড়ো করতে নেই। কথায় আছে না, “ধৈর্যই সাফল্যের চাবি?” নাদের আলির বাপ-দাদাদের সঙ্গে আপনার বাপ-দাদাদের অনেকদিন আগে থেকে শত্রুতা। তা ছাড়া নাদের আলি এইট পাশ। তার উপর গত বছরের বন্যায় তার মা-বাবা মারা গেছেন। এক বিধবা ফুফু ছাড়া তার কেউ নেই। ঘরবাড়ি বন্যায় ভেসে গেছে। নাদের আলি কোনো রকমে একটা বেড়ার ঘর করে ফুফুকে নিয়ে থাকে। আপনার আব্বা বা ভাই কিছুতেই আপনাদের ভালবাসা মেনে নেবেন না। আমি আপনাদের ব্যাপারে মাথা গলাতাম না। শুধু দুই বংশের শত্রুতা দূর করে মিত্রতা করার জন্য মাথা গলিয়েছি। কারণ এটা করা প্রত্যেক মুমীন মুসলমানের কর্তব্য।
আতিকা বলল, শুনেছি আপনি কামেল মানুষ। অনেক রুগীকে পানিপড়া দিয়ে ও ঝাড়ফুক করে ভালো করেন। আমাকে পানিপড়া দিয়ে যান। আমি আব্বাকে ও ভাইয়াকে খাওয়াব। তা হলে তারা আমাদের ভালবাসা মেনে নেবে।
হাবিব ডাক্তার মৃদু হেসে বলল, এসব আজেবাজে কথায় কান দেবেন না। রুগীকে ওষুধ দিই। সেই সাথে আল্লাহর কালাম পড়ে গায়ে ফুক দিই। আপনি আল্লাহর উপর ভরসা করে সবর করুন। নাদের আলিকেও একটু আগে সবর করতে বলে এসেছি। বাকি আল্লাহর মর্জি। তাঁর মর্জি থাকলে কিছু একটা করতে পারব বলে ভরসা রাখি। এখন আসি, অনেক দেরি হয়ে গেল বলে সালাম বিনিময় করে হাঁটতে শুরু করল।
আতিকা তার দিকে তাকিয়ে নাদের আলির মতো চিন্তা করল, ডাক্তারের বয়স কত হতে পারে? মাস ছয়েক আগে আব্বার অসুখের সময় ভাইয়া যেদিন তাকে নিয়ে এসেছিল, সেদিন পোশাক দেখে খুব অবাক হয়ে ভেবেছিল, হুজুররাও তা হলে ডাক্তার হয়। তারপর আরো কয়েকদিন আব্বাকে দেখতে এলে এবং আব্বা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলে তার প্রতি আতিকার ভক্তি-শ্রদ্ধা জন্মায়। পরে ক্রমশ তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লে সেই ভক্তি-শ্রদ্ধা আরো বেড়ে যায়। ভাইয়ার গলা পেয়ে আতিকার চিন্তা ছিন্ন হয়ে গেল।
স্কুল ছুটির পর পারভেজ বাড়ি ফিরছিল। দূর থেকে বোনকে হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে। কাছে এসে বলল, দেখলাম হাবিব ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছিলি। কারো কিছু হয়ে থাকলে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতিস?
আতিকা বলল, না ভাইয়া, কারো কিছু হয় নি। এমনিই একটু আলাপ করছিলাম।
পারভেজ ভাবল, ওর নিজের কিছু অসুবিধের কথা হয়তো ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করছিল। বলল, চল, ঘরে চল।
যেতে যেতে আতিকা বলল, হাবিব ডাক্তার লোকটা কেমন বল তো?
পারভেজ হেসে উঠে বলল, ওঁকে তুই লোক বলছিস কেন? এখনও তো বিয়েই করেন নি। দাড়ি রেখেছেন বলে বয়স একটু বেশি দেখায়।
আতিকা অবাক হয়ে বলল, তাই না কী? আমি তো মনে করেছিলাম উনি তিন চারটে ছেলেমেয়ের বাপ।
পারভেজ আবার হেসে উঠে বলল, তোর আর দোষ দেব কি, গ্রামের অনেকেই ডাক্তারকে তাই মনে করে। আমিও আগে তাই মনে করতাম। একদিন হেডমাস্টারের কাছে তার সবকিছু জেনে খুব অবাক হয়েছিলাম। অবশ্য আমার সঙ্গে এখন ডাক্তারের ভালো সম্পর্ক।
হেডমাস্টার ওঁর সবকিছু জানলেন কি করে?
ততক্ষণে বাড়ির ভিতরে চলে এসেছে। পারভেজ বলল, এখন যা, পরে শুনিস। আসরের আজান হয়ে গেছে, নামায পড়ব।