কাল রঙের পরী

কাল রঙের পরী

ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছেন রাজিয়া বেগম। সাথে তার স্বামী আর ছেলেও এসেছে। মেয়ের বাবা, চাচা আর বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে মেয়ের মা মেয়েকে নিয়ে বসার ঘরে প্রবেশ করলো। ঘোমটা সরিয়ে মেয়ের শ্যামবর্ণের মায়ামাখা চেহারা দেখেই রাজিয়া বেগম বলে উঠলো,

‘ মেয়ে তো কালো। এই মেয়ের সাথে আমার ছেলের বিয়ে দিব না।’

রাজিয়া বেগমের এমন কথায় তার স্বামী আর ছেলে চমকে গেল। এমন হুট করে বেখাপ্পা ধরনের কথা তারা রাজিয়া বেগমের কাছে আশা করেনি। এদিকে এমন কথা শুনে মেয়ে আর মেয়ের পরিবারের সবাই মুষড়ে পড়লো। এই নিয়ে চার বার তাদের মেয়েকে ছেলেপক্ষ দেখে পছন্দ করলো না। রাজিয়া বেগম একটু পরেই নিজের বলা কথাটার জন্য লজ্জিত বোধ করলো। তারপর মেয়েকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলো। যদিও রাজিয়া বেগম মনে মনে ঠিক করে রেখেছেন তিনি তার ছেলের জন্য পরীর মত মেয়ে খুৃঁজে তবেই বিয়ে দিবেন।

মেয়ের হাতে হাজার টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে রাজিয়া বেগম ফিরলেন বাসায়। মনে মনে এই মেয়ের খোঁজ দেয়া সেই প্রতিবেশির চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করলেন। শুধু শুধু সময় নষ্ট হলো তার। তিনি পণ করলেন পরীর মত মেয়ে না হলে তিনি তার ছেলের বিয়ে দিবেন না। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ঘরে সবাই ঘুমাতে চলে গেল। কিন্তু রাজিয়া বেগমের কেন যেন ঘুম আসছিল না। কিছুক্ষন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে তিনি উঠে বসলেন। পাশেই তার স্বামী বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। ঘরের ভেতর কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছিল তার। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থেকে সে উঠে দাঁড়ালো ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।

বাইরে তখন পূর্ণিমার আলোয় ঝকঝক করছে চারদিক। ছাদে উঠতেই তার নাকে খুবই মিষ্টি একটা ঘ্রাণ এসে ধাক্কা খেলো। রাজিয়া বেগম ছাদে শাক সবজির পাশাপাশি বিভিন্ন রকম ফুলের গাছ লাগিয়ে রেখেছে। সেখান থেকেই হয়তো কোন একটা ফুলের ঘ্রাণ রাজিয়া বেগম কে মোহিত করে ফেলল। এই ঘ্রান খুবই অচেনা। ‘এই ফুল গাছ গুলো আপনি লাগিয়েছেন তাই না? ফুল গাছ আমার খুবই প্রিয়। ফুল আরো বেশি প্রিয়। তবে সমস্যা হলো পৃথিবীর বেশিরভাগ ফুলই দিনের বেলা ফোটে। ’

রাজিয়া বেগম এক মনে তখন তাকিয়ে ছিলেন আকাশের দিকে। চাঁদটাকে অনেকটা রুটির মতো মনে হচ্ছে। তাকিয়ে থেকে চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন, তখনই হঠাৎ কে যেন পিছন থেকে কথাগুলো বলে ওঠে। চমকে পেছনে ঘুরে তাকায় রাজিয়া বেগম। লাউয়ের মাচার কোণায় কে যেনো দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদের আলোয় বোঝা যাচ্ছে যে অবয়বটা মেয়ের। তবে চেহারা দেখা যাচ্ছে না।

‘কে কে ওখানে?’ কিছুটা ভয় জড়ানো কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো রাজিয়া বেগম। উনি একটু ভয় পেয়েছেন। আর ভয় তো পাবারই কথা। কারণ এই সময় ছাদে একটা মেয়ে থাকা কোন স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। কারণ রাজিয়া বেগম ছাড়া এই বাড়িতে আর কোন মেয়ে নেই। তাই ছাদে কোন মেয়ে আসার প্রশ্নই আসেনা।

‘ আহ আপনি এভাবে চেঁচাচ্ছেন কেন? দেখছেন না আকাশে কি সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে? চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয় নীরবতার মধ্যে। এমন চেঁচানোর দরকার নাই। আমি কোন ভূত পেত্নী না।’ মেয়েটা কথাগুলো বলে মিষ্টি করে হাসলো। সে হাসি শুনে রাজিয়া বেগম আরো চমকে গেল। হাসির শব্দটা কেমন যেন লাগল তার কাছে। একটু যেন অস্বাভাবিক, তবে খুবই মিষ্টি। নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছেন রাজিয়া বেগম।

‘ তুমি কে? ছাদে উঠলে কিভাবে? আর থাকো কোথায়? ’

‘ বাপরে বাপ! তিনটা প্রশ্ন একসাথে করলেন। এখন কোনটার জবাব আগে দেবো কোনটার জবাব পরে দেবো বুঝতে পারছি না। আপনি বলেন তো কোনটার জবাব আগে দেব? ’

কথা বলতে বলতে মেয়েটা খুবই কাছে চলে আসলো। রাজিয়া বেগম কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন। একটু পরে তিনি টের পেলেন যে তিনি ছাদের রেলিং এর সাথে ঠেকে গেছেন । মানে আর পিছিয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। এতক্ষণ যে ঘ্রাণটা রাজিয়া বেগমের নাকে লাগছিল এখন সেটা আরো তীব্র হয়ে নাকে লাগছে। রাজিয়া বেগমের সন্দেহ হলো যে ঘ্রাণটা এই মেয়েটার শরীর থেকে আসছে।

‘ সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই দাও একের পর এক। ’

‘ আচ্ছা দিচ্ছি। আমার নাম রেহনুমা। আমি উড়ে উড়ে ছাদে এসেছি। আর আমি এসেছি অনেক দূর থেকে। জায়গার নাম বললে আপনি চিনবেন না। তাই নামটা বলছি না। ’

রাজিয়া বেগম মেয়েটার উত্তর শুনে অবাক হলেন। একে তো হঠাৎ করে ছাদে এই মেয়ের আগমন তার উপর উল্টাপাল্টা উত্তর। রাজিয়া বেগম মনে মনে চিৎকার দেওয়ার কথা ভাবলেন। হঠাৎ তার খেয়াল হল তার হাতে তার মোবাইল ফোনটা রয়েছে। উনি চাইলে এখন ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতে পারেন। লাইট জ্বালিয়ে উনি মেয়েটার চেহারা দেখতে চান।

‘ এইযে শুনুন, চিৎকার দিবেন কেন বলেন তো? আমাকে দেখে কি ভয় পেয়েছেন? আর ফ্লাশ লাইটের আলোয় আমাকে দেখা যাবে না। আলো জ্বালালে আমি গায়েব হয়ে যাব। আপনি কি আমার চেহারা দেখতে চান? আলো জ্বালাতে হবে না। আপনি এমনিতেই দেখতে পাবেন।’ রাজিয়া বেগম মেয়েটার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। চিৎকার দেওয়ার কথা এবং ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালানোর কথা তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন। মেয়েটা জানলো কিভাবে? এবার তিনি সত্যি সত্যি ভয় পেলেন, প্রচন্ড রকমের ভয়। কে এই মেয়েটা? কি চায় সে?

‘ আমি কিছু চাইনা। পূর্ণিমা রাতে আমাদের পৃথিবীতে ঘুরতে আসার অনুমতি দেওয়া হয়। আমরা ফুলের বাগানে ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করি। আপনাদের এখানে তো ফুলের বাগান নেই বললেই চলে। তাই বাধ্য হয়ে আপনার ছাদে নামতে হয়েছে আমাকে। আমার অন্য বোনেরা হয়তো অন্য কারো ছাদে গিয়ে ঘোরাফেরা করছে।’ মেয়েটার কথাগুলো রাজিয়া বেগমের কানে গেল কিনা কে জানে? সে প্রাণপণে চাইছে মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বালাতে। কিন্তু ভয়ে এমন পরিমাণ জমে গিয়েছেন তিনি যে আঙ্গুলগুলো নড়াতে পারছিলেন না। হঠাৎ তার মুখ দিয়ে তার অজান্তেই বের হয়,

‘ তুমি কি মানুষ না? মানুষ না হলে তুমি কি? ভুত না পেত্নী?’ রাজিয়া বেগমের প্রশ্নে মেয়েটা আবার হাসলো। তারপর হাসতে হাসতে বলল, ‘ আমি ভূত না পেত্নী ও না, আমি পরী! আপনি অনেকক্ষণ ধরে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালানোর চেষ্টা করেও পারছেন না। আপনি আমার চেহারা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছেন বুঝতে পারছি। আচ্ছা চোখটা একবার বন্ধ করে আবার তাকান আমার দিকে।’

মেয়েটার কথা শুনে রাজিয়া বেগম নিজের অজান্তেই চোখ বন্ধ করলেন। তারপর চোখ খুললেন। প্রচন্ড আলোর ঝলকানিতে তার চোখ আবার বন্ধ হয়ে গেল। তিনি আবার চোখ মেললেন। যা দেখলেন তার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। সবুজ পোশাক পরা একটা মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। একেবারে আলকাতরার মত কালো। তার পেছনদিকে পাখির ডানার মতো এক জোড়া ডানা দেখা যাচ্ছে। রাজিয়া বেগম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তাহলে এই মেয়েটা কি সত্যি সত্যি পরী? কিন্তু এত কালো কেন তাহলে? পরী তো হয় সুন্দর! ছোটবেলায় দাদীর কাছে শোনা গল্প কিংবা কোন রূপকথায় পরীদের সৌন্দর্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে তারা খুবই ফর্সা হয় ।কিন্তু পরী কালো হয় এমনটা তো কখনো শোনেনি রাজিয়া বেগম‌।

‘ আপনি রূপকথায় বা দাদীর কাছে যেসব গল্প শুনেছেন সেসবই বানানো। পরী মানেই যে ফর্সা এমনটা নয়। ফর্সা ছাড়া যে পরী হয় না এমনটা কিন্তু না। মানুষের মধ্যে যেমন ফর্সা এবং কালো আছে, পরীদের মধ্যেও এমনটা আছে। আমার বোনদের মধ্যে বেশিরভাগ সবাই ফর্সা, আমার তিন বোন শ্যামলা, আর দুই বোন আমার মতই কালো, কুচকুচে কালো।’ রাজিয়া বেগম মন্ত্রমুগ্ধের মত মেয়েটার কথাগুলো শুনছিলেন। হঠাৎই মেয়েটা আবার আগের মত হয়ে গেল। তারপর খুবই ব্যস্ত ভঙ্গিতে হেঁটে ছাদের রেলিং এর কাছাকাছি চলে গেল। তারপর রাজিয়া বেগমের দিকে ফিরে বলল,

‘ চাঁদের আলো কমে আসছে। আমাদের সবাইকে ফিরতে হবে। আপনার সাথে কথা বলে ভালো লাগলো। যদিও আপনি শব্দ করে কথা কম বলেছেন। আমার বাবা বলে দিয়েছেন যে পৃথিবীতে মানুষ নামে কিছু প্রাণী থাকে যারা উচ্চস্বরে কথা বলার চেয়ে মনে মনে কথা বলা বেশি পছন্দ করে। আজ আপনাকে দেখে বুঝতে পারলাম বাবা ঠিকই বলেছেন। আমি আসি তাহলে। আবার হয়তো কোন এক পূর্ণিমা রাতে আপনার সাথে কথা হবে, যদি আপনি ছাদে থাকেন তাহলে।’ এ কথা বলতে বলতেই মেয়েটা তার ডানার সাহায্যে উড়তে শুরু করে। রাজিয়া বেগম তাকিয়ে থাকে চাঁদের দিকে। কারণ কাল রঙের ওই পরী টা চাঁদের দিকে উড়ে যাচ্ছে।

কয়েক মাস পর রাজিয়া বেগম তার পুত্রবধূ কে সাথে নিয়ে ছাদে বসে আছেন। চারদিকে চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে। যে মেয়েটাকে কালো বলে রিজেক্ট করে দিয়েছিলেন সেই মেয়েটাই আজ রাজিয়া বেগমের পুত্রবধূ। তারা দুজনে অপেক্ষায় আছেন একটা পরী দেখার জন্য। কুচকুচে কালো রঙের পরী। যদিও তার পুত্রবধূ এই ব্যাপারটা এখনও জানে না। তবে হয়তো অতি শীঘ্রই জেনে যাবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত