ইউটার্ন

ইউটার্ন

ছাত্রের বড়বোন আমার দিকে আড়চোখে তাকায়,বেশ কদিন ধরেই বিষয়টা লক্ষ করছি। সপ্তাহে তিনদিন উত্তরা যাই ক্লাস এইটের এক ছাত্রকে পড়াতে।নাম আলভী।বাবা সুপ্রিম কোর্টের উকিল,মা গভর্নমেন্ট কলেজের প্রিন্সিপ্যাল।বোন একজন আছে,ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।হাইফাই পাঁচতলা বাসা,এসি করা প্রতিটা রুম।রংবেরঙের লাইট,শো-পিচ আর পুতুল দিয়ে রুমগুলো সাজানো।

আমার এক বন্ধুর মাধ্যমে এই টিউশনিটা পেয়েছিলাম কয়েকমাস আগেই।বড়লোক ঘর,বেতন যা দেয় তা আমার প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি।শুনেছি আলভীর ছোট আরেকটা ভাইও আছে।যদি আলভীর পরে তাকেও পড়াতে পারি,তাহলে আমার দু/একটা টিউশনি ছেড়ে দিয়ে কেবল এখানে পড়ালেও মন্দ হবেনা।তাই প্রথম থেকেই আলভীকে মনোযোগ দিয়ে পড়ানোর চেষ্টা করি,ওয়েল-ড্রেসআপ ম্যান্টেন করে আসাযাওয়া করি।কিন্তু না চাইতেই ব্যাপারটা যে এভাবে ঘুরে যাবে ভাবিনি।

আলভীর বড়বোন ত্রয়ী,আমার দিকে কদিন ধরেই কেমনকরে যেন তাকাচ্ছে।ঘাবড়ে যাচ্ছি মাঝেমাঝে।আগে প্রতিদিনই পড়ানোর শেষদিকে আলভীর আম্মা আমাকে নাস্তা দিয়ে যেতেন,ছাত্রের ভালোমন্দ খবর নিতেন।ইদানীং এই কাজটা তার বড়বোন করছে।

সেদিন দেখি নাস্তা নিয়ে এসে আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছে।আমি ঘাবড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ পর নড়েচড়ে বসলে সে চোখ ফিরিয়েছে।আলভীকেও দেখি,ইদানীং আমাকে আগের চেয়েও একটু বেশি সম্মান-শ্রদ্ধা দেখাচ্ছে।সন্দেহ হচ্ছে একটু।

বেশ কয়েকদিন পরই বুঝতে পারলাম আমার সন্দেহগুলো একেবারেই মিথ্যা নয়।আলভীকে পড়াচ্ছিলাম,তার মা আমার পাশে এসে চেয়ার টেনে বসলেন।সালাম দিয়ে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করে আবার পড়ানোতে মন দিলাম।মিনিট পাঁচ/দশেক নিশ্চুপে বসে থেকে তিনি মুখে কথা ফোটালেন,

-এখন তো পড়াচ্ছো,একটু কথা বলতে পারব? চোখ ফিরিয়ে বললাম,”জ্বী আন্টি বলুন।সমস্যা নেই। আলভীর আম্মু আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-তুমি থাকো কোথায়?

বললাম,”খিলক্ষেত।”

-বাড়িতে কে কে আছে?

-বাবা,মা গ্রামে থাকে।ছোটবোন আছে।ঢাকায় কয়েকজন বন্ধু মিলে মেসে থাকি।

-ও আচ্ছা।পড়াশোনা কেমন চলছে?

-আলহামদুলিল্লাহ।পরীক্ষার আর বেশিদিন নেই।দোয়া করবেন।

আন্টির সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ পর্দার আড়ালে চোখ পড়ল।আলভীর বড়বোন ত্রয়ীও দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছে।একটু সতর্ক করে নিলাম নিজেকে,কথাবার্তা গুছিয়ে যেন বলতে পারি।

আলভীর আম্মু আবার জিজ্ঞেস করলেন,

-তো বাবা,তোমার ফিউচার প্ল্যান কী?

একমুহূর্ত ভেবে নম্র গলায় বললাম,”আন্টি,আসলে আজকাল যা অবস্থা,বিসিএস ছাড়া তো ভবিষ্যৎ একেবারেই অন্ধকার।তাই ওদিকে চিন্তা করছি।

আন্টি খুশি হলেন।পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো আলভীর বড়বোন ত্রয়ীও অদ্ভুত একটা তৃপ্তির হাসি দিল।বিসিএসটা যে উদ্দেশ্যে বলেছিলাম তাতে সফল হয়েছি দেখে মনটা একটু নেচে উঠল আমারও।আন্টি আরো দু/একটা কথা বলে বিদায় নিলেন। সেদিন থেকেই বেশ বুঝেছিলাম আমার সামনে হয়তো কিছু অপেক্ষা করছে।ব্যাপারটা দিনকে দিন আরো গভীর হতে লাগল। শ্বাসকষ্টের কারণে একদিন আলভীকে পড়াতে যেতে পারিনি।রুমে বসে ইনহ্যালার টানছিলাম।হঠাৎ মোবাইলের রিংটোন বেজে উঠল।আলভীর মায়ের নাম্বার।ইনহ্যালার রেখে কল ধরলাম তাড়াতাড়ি,নাহ!আলভীর মা নয়,ওর বড়বোন।

-আজকে আসলেন না কেন? আমি কেনজানি একটু খুশি হলাম।বললাম,”শ্বাসকষ্টটা বেড়েছে।”

-আপনি জানেন না আলভী পড়াশোনা কম করে!এভাবে মিস দিলেতো হবেনা।ওর রেজাল্ট খারাপ করলে কে দায়ী থাকবে? আসল বিষয়টা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।তাই বকা শুনেও মনে আঘাত পাইনি।নম্র গলায় বললাম,”আচ্ছা শুনুন,আমি কাল গিয়ে বেশি করে পড়িয়ে দেব।চিন্তা করবেন না,ওর রেজাল্ট ভালো হবে।

-ওর রেজাল্ট ভালো হবে কিন্তু !আচ্ছা কাল আসবেন কিন্তু।সামনে ওর পরীক্ষা।

আনন্দে আমি ফোন কাটলাম।মেয়েটা কিছু একটা বলতে চেয়েছিল।অসমাপ্ত বাক্যটায় শব্দ যোজন করে মনের মতো গুছিয়ে নিলাম। পরদিন পড়াতে গিয়ে যতটুকু দেখলাম,ততটুকু আমার আশার বাইরে।লিফট মেলে যাওয়া মাত্রই দেখলাম দরজার সামনে আলভীর বড়বোন রাগী চোখে দাঁড়িয়ে।আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থকলাম কিছুক্ষণ।

-কাল আসেননি।শ্বাসকষ্ট ছিল?

-জ্বী।আসলে !

-আলভীর যে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে? বললাম,

-চিন্তা করবেন না।আমি আছি।

-থাকলে কী হবে? আচ্ছা যান,সে ওয়েট করছে।

আমি মাথানিচু করে মুচকি হেসে ভেতরে গেলাম।আলভীকে পড়াচ্ছি।অঙ্ক করতে দিয়ে আমি খবরের কাগজে চোখ বুলাচ্ছিলাম।হঠাৎ-ই নাস্তা হাতে ত্রয়ীর প্রবেশ।

-পেপার রাখুন।পড়ানোতে মনোযোগ দিন।শরীর কেমন আছে এখন? পেটারটা রেখে ত্রয়ীর দিকে একপলক তাকিয়ে বললাম,”জ্বী।আলহামদুলিল্লাহ।”

-অসুস্থ হোন কেন?বাড়িতে কী করেন? একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম,

-ইয়ে মানে কী করি বলতে?

-মানে বাড়িতে আপনি অবসর সময়ে কী করেন?

-ও আচ্ছা আচ্ছা!এই তো,শুয়ে বসে থাকি।গল্প করি।

-কার সাথে গল্প করেন?

-এইতো,বন্ধুদের সাথে।

-ও আচ্ছা।বন্ধুদের সাথে করলে ভালো।বন্ধুরা কেমন?ভালো তো?

-জ্বী,জ্বী।খুবই অমায়িক।

-আচ্ছা।আর মিস দেবেন না।আপনি না এলে চিন্তা হয়।ইয়ে মানে আসলে আলভীর খুব খারাপ অবস্থা তো! আমি মুচকি হেসে মাথা নামালাম।

-হাসছেন কেন?

-হুম?না,না!কিছুনা।

দিনগুলো এভাবেই যাচ্ছিল।কল্পনার সাগরে আস্তে আস্তে মেয়েটা নৌকা হয়ে ভাসতে শুরু করেছে।তবে মাঝেমাঝে আমারও চিন্তা হচ্ছিল।কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?আমার বাড়িতে আম্মা-আব্বা বিষয়টাকে মেনে নেবেন এত সহজেই।লোকে আমাকে খারাপ বলবে না?চিন্তার সাগরে উত্তাল ঢোউয়ের কমতি নেই,সেই ঢেউয়ে আমার ভালোবাসার ছোট্ট নৌকোটা কেবলই টিকে থাকার লড়াই করছে,ডুবছেনা কিছুতেই,সরাতে পারছিনা তাকে কল্পনা থেকে।

আলভীর বাবা একদিন আমাকে প্রশ্ন করলেন,দিনকাল কেমন যাচ্ছে,কেন অসুবিধা হচ্ছে কিনা,এইসেই।শান্তভাবে জবাব দিলাম।ভালো লাগছিল সব,চিন্তাও বাড়ছিল ক্রমে।বুঝতে পারছিলাম না ত্রয়ীর সাথে আমার ব্যাপারটা ভালো হচ্ছে কিনা।পরিণতিও কী হবে জানা নেই।তবুও তার গভীর ভালোবাসার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির যাদুবলে তাকে ভুলা যেন ধীরেধীরে অসম্ভব হয়ে উঠছিল। সেদিন দেখি,বেশ সময় ধরে ত্রয়ী আমার দিকে তাকিয়ে আছে।পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে আড় চোখে আমিও তাকাচ্ছিলাম তার দিকে।চোখে তার কত কথা,তবুও ঠোঁট কত নির্বাক।বলতে চেয়েও পেছনে চলে যাচ্ছে সে।

বেশ কিছুক্ষণ পর বোধ হল তার লজ্জার পর্দা সরেছে।আমার কাছে কেমনভাবে তাকিয়ে থেকে আমতা আমতা করে বলল,”একটা কথা ছিল আসলে…বলব?” তাকে আর কষ্ট দিতে চাইনা।সকল সংকোচ কাটিয়ে সে যে এতদূর এসেছে,এটাও আমার বিশাল পাওনা।তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একখানা হাসি পেড়ে বললাম,”আজ আমিই প্রথমে বলি?” সে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।মনে হলো ভালোবাসার কথাটা শোনার গভীর অপেক্ষায় তার চোখমুখ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।সব বুঝেও বললাম,”ভালোবাসবে আমাকে?”

ভালোবাসার মানুষের এমন অপ্রত্যাশিত অবাক করা উত্তরে ঐ অদ্ভুত মুহূর্তে চোখমুখ উল্টে সেদিন আমি অবাক হয়েছিলাম বারবার,”শয়তান,বদমাশ!!আমি আগেই বুঝেছিলাম তুই নষ্ট!তোর শ্বাসকষ্ট,না?তোর ঠোঁটের দিকে তাকালেই তো বোঝা যায় তুই বিড়িখোর!তোর এদিকওদিক তাকানো দেখলেই বোঝা যায় তোর নজর খারাপ!আমার ভাইকেও শেষ করবি তুই!আব্বা!এই আম্মা আসুন এদিকে!দেখুন,বলেছিলাম না! একে কদিন ফলো করলেই বোঝা যাবে এটা বেয়াদব!নষ্ট!এর সবকিছুতেই নষ্টামি!বের করে দেন এটাকে এক্ষুণি!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত