আমার শশুড়বাড়ি মফস্বলে, আঞ্চলিকতার রেশেই বিয়ের দিন আমাকে তথা বউকে দেখতে আশে-পাশের ২/৩গ্রামের মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিলো বাড়িতে। নতুন বউনতুন বউ রব সবার মুখে, সবাই যে যার মত শাড়ীর আচঁল সরিয়ে, মাথা তুলে নানান ভঙ্গিতে দেখছিল আমায়।কেউ একজন বললো দেখি বউ দেখি, তার কথা শুনে তারদিকে তাকাতেই আশেপাশের প্রায় সব মহিলারাই হোহো করে হেসে বলে বসলো, “ওমা বউ দেখি আবার তাকায়ও”।
যেহেতু আমার বাড়ি থেকে আমাকে কখনো এটা শিখিয়ে দেয়নি যে তাকানো যাবেনা, তাই আমিওহয়তো ভুল করেই তাকিয়ে আবার উত্তর দিয়ে বসেছিলাম, ” বাহ রে চোখ আছে তাকাবো না?” আমার কথাটা তখন দুয়েক টা কানে লাগলেও কি করেযেন মুখে মুখে ছড়িয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে বাড়ি সুদ্ধ মানুষ এবং কি আমার সদ্য হওয়া শশুড়-শাশুড়ির কানেও দারুণ ভাবে গিয়ে ব্যাখ্যা হলো যে, “কি সাংঘাতিক! বউ মুখে মুখে চোপা (তর্ক) করে!! মুহুর্তেই আমার শশুড়- শাশুড়ির মুখ অন্ধকার হয়ে গেলো, যেন তারা ভীষণ ভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পরলেন আমাকে নিয়ে।
যেহেতু আমার স্বামী আমার জীবনে একেবারেই নতুন ছিলেন, আগে সবে ৩০ মিনিটের একটা পরিচয় হয়েছিলদুজনের, তাই জীবনের প্রথম রাত টা নিজেদের জানতে জানতে আর চিনতেই কেটে গেলো! যেহেতু আগে আমি অকারণে গোসল নিয়মে দীক্ষিত ছিলাম না, সেহেতু পরদিন একটু বেলা গড়াতেই গোসল না করায় শশুড়বাড়ি লোক মুখে আমাকে শুনতে হয়েছিল, ” অপবিত্র, অপয়া!” বাড়ি ভর্তি এত অপরিচিত মেহমানদের ভিরে পর দিনে -ই ঘর, উঠান ঝাড়ু দেওয়ার দায়িত্ব টা আমার উপর বর্তানো হয়। ধানের গোলার পাশে দুয়েক কোয়া রসুন ফেলে সবাই শুরু করে সীতার সতীত্বের মত আমার লক্ষ্মী যাচাই পরীক্ষা।
হয়তো দেখেছিলাম তবুও গোলার কোণে পরে থাকা দুই কোয়া রসুন না উঠিয়ে ঝঁাড়ু আগায় লাগিয়েবেচারা রসুন গুলো কে ঘর ছাড়া করায় আমার চাচি শাশুড়িগণ গলার ভলিউম বাড়িয়ে বলছিলেন, “এই মেয়ে চরম অলক্ষ্মী! এর দ্বারা সংসারের উন্নতি অসম্ভব!” সেদিন ও মনে মনে মা কে বকছিলাম, কেনো যে এত জলদি মরতে গেলো! বেঁচে থাকলে তো আমায় বলেইদিতো যে দুই কোয়া রসুন অদেখায় ফেলে দিলে আমি হুট করেই এভাবে অলক্ষ্মী হয়ে যাবো। সংসারে চলার জন্য আমার বাবা মোটামুটি সবই দিয়েছিলেন, গায়ের গহনা থেকে ঘরের ঝাঁড়ু টুকু দিতেও কার্পণ্য করেন নি আমার ১৭ হাজার টাকা বেতনের স্কুল শিক্ষক বাবা। বাদ পরে গিয়েছিল কেবল সোফা আর ফ্রিজ। গ্রাম্য নিয়মানুযায়ী সাত গ্রামের সবাই পুরো সপ্তাহ জুড়েই দেখতে এলো আমায়, আর আমার বাবার বাড়ি থেকে আমদানি হওয়া জিনিসপত্র গুলোকে।
আমার শ্রদ্ধেয় শাশুড়ি মা সবাই কে ঘরে এনে যখন আমার ঘোমটা সরিয়ে গহনা আর ঘর ঘুরিয়ে জিনিস দেখাচ্ছিলেন তখনও আমার খারাপ লাগেনি, কিন্তু লেগেছে তখন যখন তিনি মুখে অরুচি এনে বলছিলেন, “চেইন, কানের দুল, হাতের বালা এইগুলাই দিছে, দিলেই আর কয় আনি সোনার দিছে? দেখো না কেমন ফ্যাতফ্যাতা হালকা সব জিনিস! ” পাশের জন বলছিলেন, “হ দেখতাছি ই তো, মাইয়া রে দিতেও এত হাত কাঁপে বাবার? বুবু ফিরিজ (ফ্রিজ) দেয় নাই? সোফা দেয় নাই? শহরে না বলে বিয়া করাইছো? আমার খালাতো বইনের পোলারে তো সব দিছে একদম ঘর ভইরা দিছে ওর শশুড়ে।”
এইবার আমার মাতৃতূল্য শাশুড়ি মা অনেকটা আশাহত হয়ে বললেন, “কি করমু কও, আমার পোলার কপালে নাই! তার উপর মা ছাড়া মাইয়া শশুড়বাড়ির আদর সোহাগ ও নাই পোলাডার কপালে!” শাশুড়ি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তখন রবী ঠাকুরের অপরিচিতা” গল্পটা চোখের সামনে ভাসছিলো, খুব আফসোস হচ্ছিলো যে “ইসস কেন যে কল্যাণী হলাম না!” তাহলে হয়তো প্রতিবাদ টা করেই বসতাম। এবার আর প্রতিবাদ করার দুঃসাহস দেখালাম না, পাছে যদি আবার নতুন কোন উপাধিতে ভূষিত হই সেই ভয়ে। বিয়ের ছ’মাসের মাথায় রমজান মাস আসে, বাড়িতে আমার অবিবাহিত বড় ভাই আর মধ্যবয়সী বাবা।
রোজায় বাড়িতে যাওয়া হবেনা জানতাম, তবে মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম বাবা আর ভাইয়া কে প্রথম দিন দাওয়াত করে খাওয়াবো নয়তো নিজের হাতে করা কিছুইফতার পাঠিয়ে দিবো। রোজা মুখে নিয়ে সকাল থেকে সাধ্য অনুযায়ী সকলের মন মত সব আয়োজন করলাম। আমার হাতের পায়েস টা বাবা বরাবরই খুব পছন্দ করেন, পায়েসের বাটির দিকে তাকাতেই বাবার কথা ভেবে মন ভালো হয়ে যাচ্ছিলো। বিকালে শাশুড়ি মায়ের থেকে অনুমতি নেওয়ার আগেই পাশের ঘরে তর্কাতর্কির আওয়াজ। শুনতে শুনতেই হুট করে আওয়াজ বেড়ে গেল, আমার শাশুড়ি মা চিৎকার করে কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার শশুড় কে বলছেন, “তুমি নষ্ট করছো আমার পোলার কপাল ডা, এবং কুঁইড়া ঘরের মাইয়ারে বিয়া করায়া আনছো যে বিয়ার প্রথম রোজায় শশুড়বাড়ির একমুঠ ছোলাও জুটলো না আমার পোলাডার কপালে ছিঃ! যাইয়া দেহো পাশের বাড়ি, বিয়া করছে ৫ বছর হইছে এখনও গাড়ি ভইরা ইফতার পাঠায় বউয়ের বাপে!”
আমার স্বামী দূরে ছিলেন না, ঘরে বসে তিনিও শুনছিলেন সব গুলো কথা কিন্তু উত্তর দেননি। এবার আমার আর রাগ হলো না বরং অভিমানে কান্না পেলো, কেন মা মারা গেলো? আমায় ইফতার দিতে হবে তা কি সে ও জানতো না? কেন দিয়ে মরলো না? বাবা তো পারেনা, সে না হয় বানিয়ে দিয়েই মরে যেতো! তবুও তো আমার পরিবার নিয়ে উঠতে বসতে কেউ কিছু বলতে পারতো না। বিয়ের দশ বছর পর এই প্রথম আমি বেশি সময়ের জন্য বাবার বাড়ি আছি, কারণ আমি এবারও তৃতীয় বারের মত কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছি। শশুড়বাড়ির সবার চাওয়া ছেলে হলেও আমি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছি পরপর তিন বার।
তাই আমার শাশুড়ি মা বেশ অসন্তুষ্ট হয়েই আমাকে বাবার বাড়ি রেখে গিয়েছেন, বংশের প্রদীপ রক্ষার্থে তিনি তার ছেলে কে আবারও বিয়ে করানোর জন্য মেয়ে খুঁজছেন। আমাকে দিয়ে যাওয়ার সময় আমার বাবার কাছে তিনি বলে গিয়েছেন, “বিয়াই সাহেব আর যাই হউক আমার একমাত্র পোলার ভবিষ্যৎ টা তো আমি মা হয়ে নষ্ট করতে পারিনা, পোলার আশায় যদি আবারও মাইয়া হয় পরে ঐটারে পালবো কে? বংশ রক্ষার একটা দায়িত্ব তো মা হিসাবে আমার আছে তাইনা? আপনার মাইয়া আপনার কাছেই থাকুক, ভরনপোষনের টাকা কয়েকটা আমি পাঠায়া দিমু নে মাসে মাসে।” আমার বাবা হয় বাকরুদ্ধ ছিলেন, নয়তো উনার কথার উত্তর দিতে নারাজ ছিলেন। বাবাকে নিরুত্তর পেয়ে শাশুড়ি মা কথা না বাড়িয়ে চলে গিয়েছিলেন।
শুনেছি আমি চলে আসার পরের মাসেই আমার ছোট ননদ টার ডিভোর্স হয়েছে, সন্তান হয়না তাই বন্ধ্যা তকমা লাগিয়ে ওর শশুড় ওকে রেখে গেছে। নাহ খুশি হইনি তবে কষ্ট লাগছিলো মেয়েটার জন্য, অন্যের পাপের শাস্তি টা কি করে তার ঘাড়ে পরে গেলো! একেই হয়তো নিয়তি বলে! আমার বড় মেয়ে টা আজ উঠানে চুন,রং দিয়ে আনাড়ি হাতে আলপনা দিচ্ছিলো, পাশের বাড়ির আমার এক চাচি এইটুকু মেয়ের এই গুণ দেখে বলছিলেন, “ভারী লক্ষ্মী মেয়েরে তোর!” কেন যেন কথাটা আমার কলিজায় গিয়ে লেগেছিল! লক্ষ্মী?? অসম্ভব, আমি চাইনা আমার কোন মেয়ে অন্তত লক্ষ্মী হয়ে বেড়ে উঠুক। আলপনা টা পায়ে দলিয়ে দিয়ে ওকে বুকে জাপটে ধরে সারা শরীর কাঁপছিল আমার!
ওর মুখটা দু’হাতে চেপে ধরে কেঁপে কেঁপে বলছিলাম, “মা আমায় কথা দে, কক্ষনো লক্ষ্মী হবি না? কথা দে? বড় হয়ে উদ্দাম, দস্যি, অসভ্য, বেয়াদব, দুর্বার হবি কথা দে?” আমার মেয়ের চোখে জল, হয়তো না বুঝেই কাঁদছে ও। তবে আমি চাই এই কান্না টাই ওর শেষ কান্না হোক, এ দু’ফোটা জলই ওকে বুঝাক, এই অসভ্য পৃথিবীতে মেয়েদের লক্ষ্মী হতে নেই, হলে পিষে মরতে হয়।