চাবি ঢুকিয়ে ড্রয়ার খুলল রাগিব। খালি। কিচ্ছু নেই। টাকা তো দূরে থাক, একটা কাগজ পর্যন্ত নেই। কিন্তু এরকম তো হওয়ার কথা না। ওর স্পষ্ট মনে আছে যে ও টাকাটা এই ড্রয়ারেই রেখেছিল। তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেলল ও ডেস্কের সবকটা ড্রয়ার। না, কোনো ড্রয়ারেই নেই। হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল রাগিবের। হাত-পা কাঁপছে তার, তবে শীতে নয়, ভয়ে। এই হাঁড় কাঁপানো শীতেও ঘেমে গেল ও।
৫০ লাখ টাকা। যা-তা ব্যাপার তো নয়। কিন্তু টাকাটা গেল কই? মাসের শুরু। সবাই যখন বেতন চাইবে, কি উত্তর দেবে সে তাদের? না, খুব বড় ভুল হয়ে গেছে। এতগুলো টাকা এভাবে রাখা উচিত হয়নি। আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল তার। কি করবে এবার ভাবে পাচ্ছে না সে। টাকাটা অন্য কোথাও রাখার প্রশ্নই ওঠে না। এখানেই রেখেছিল সে। কিন্তু টাকাটা ম্যাজিকের মত উধাও হয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই কেও টাকাটা চুরি করেছে। কিন্তু কিভাবে? তার ডেস্কের সবকটা ড্রয়ারেই অত্যাধুনিক তালা দেওয়া আছে। এই তালা খোলা যে কারোর পক্ষে সম্ভব না। তালাটা ভেঙে ফেললেও একটা ব্যাপার ছিল। কিন্তু তালা ভাঙা নয়। ঠিকই আছে।
যে টাকাটা সরিয়েছে সে যেমন করেই হোক ড্রয়ারের তালা খুলে টাকাটা নিয়ে আবার তালা লাগিয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ ভেবে-চিন্তে আহসান স্যারকে ব্যাপারটা জানানো সমীচীন মনে করল রাগিব। সাথে সাথে সে কোম্পানির CEO আহসানউদ্দিনের অফিসে ঢুকল। খুলে বলল সব। আহসানউদ্দিন এর বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। চোখে চশমা। সৎ মানুষ। চেহারায় একটা বোকা বোকা ভাব আছে। তবে তিনি মোটেই বোকা নন। নাহলে এতবড় একটা কোম্পানি তিনি এত সূচারুভাবে সামাল দিতে পারতেন না। এত টাকা গায়েব হয়ে গেছে শুনে আহসানউদ্দিন প্রথমে আঁতকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলেন দ্রুত। “আমাদেরকে এক্ষুণি ব্যাপারটা পুলিশকে জানাতে হবে,” বলেই পুলিশ স্টেশনের নাম্বার ডায়াল করা শুরু করলেন তিনি।
“কিন্তু স্যার এতে অফিসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা আছে। সবাই যদি শোনে যে তাদের বেতন চুরি হয়ে গেছে এবং এ মাসে তারা বেতন হাতে পাবে নাকি সে বিষয়ে সন্দেহ আছে তাহলে বিরাট ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে অফিসে,” রাগিব বলল “কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। এখন পুলিশকে জানালে পুলিশ অপরাধীকে ধরে টাকাটা আমাদের কাছেপৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু বেশি দেরি হয়ে গেলে কারোর আর কিচ্ছু করার থাকবে না,” বললেন আহসানউদ্দিন।পুলিশ আসল। অফিসের সবাইকে বাধ্য হয়েই ঘটনাটা জানাল আহসানউদ্দিন। অফিসে এখন তুমুল গুঞ্জন। কিভাবে চুরি হল টাকাটা, তা নিয়ে চলছে নানারকম জল্পনা-কল্পনা। প্রাথমিক তদন্ত শেষ করে আলাপ করার উদ্দেশ্যে আহসানউদ্দিনের অফিসে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর আশরাফুল ইসলাম। ডেস্কের সসামনে চেয়ার টেনে নিয়ে বসে আহসানউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর।
“আপনার অফিসের এই একাউন্টেন্ট কত বছর ধরে চাকরি করছে?”
“তাও প্রায় ৫ বছর হবে।” ডেস্কের ওপাশে বসা আহসানউদ্দিন জবাব দিলেন।
“লোকটা কেমন?”
“ভাল ছেলে। আমার খুবই বিশ্বস্ত। এতদিন ধরে একাউন্টেন্টের চাকরি করছে। চাইলেই অনেক টাকা এদিক-ওদিক করতে পারত। কিন্তু আজ পর্যন্ত ও নিজের বেতনের বাইরে অফিসের একটা পয়সাও নেয়নি।”
“কিন্তু যুবক মানুষ। বয়স ২৭-২৮ এর বেশি হবে না মনে হয়। হয়ত অতগুলো টাকার লোভ সামলাতে না পেরে নিজেই লুকিয়ে রেখে এখন আপনার কাছে ভাল সাজছে।”
“আপনার কথায় যদিও যুক্তি আছে কিন্তু আমি মানুষ চিনি ইন্সপেক্টর। রাগিব ওসব করার ছেলেই না।”
“কিন্তু ঘটনা দেখে তো ব্যাপারটাকে চুরি বলে মনে হচ্ছে না। ওই ড্রয়ারের তালা না ভেঙে কেও ওই ড্রয়ার খুলতে পারবে না। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, তালা না ভেঙেই চোর কাজটা সেরেছে।”
“সত্যিই, ব্যাপারটা রহস্যজনক!”
“আপনাদের অফিসে কোনো সিসি টিভি ক্যামেরা নেই?”
“আছে।”
“দেখান আমাকে।”
সিসি টিভি ফুটেজ চেক করতে গিয়ে আরো অবাক হলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর। ক্যামেরায় যে মেমরি আছে তা একেবারে নতুন। কিছুই রেকর্ড হয়নি। অফিসের সব ক্যামেরার এক দশা। একথা শুনে আহসানউদ্দিনও হতভম্ব হয়ে গেলেন। আপাতত কোনো সূরাহা না করতে পেরে ‘অপরাধীকে আমি খুঁজে বের করবই’ এ প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনকার মত অফিস থেকে বিদায় নিলেন ইন্সপেক্টর। ২ দিন পরের ঘটনা। ডেস্কে বসে কাজ করছিলেন আহসানউদ্দিন। হঠাৎ তার রুমের দরজার কাছে দেখলেন দাঁড়িয়ে আছে ইন্সপেক্টর। সাথে দুজন কনস্টেবল। তাদের দিকে তাকাতেই ইন্সপেক্টর বললেন,
“আসতে পারি?”
“জ্বী, আসুন। রহস্যের কোনো সমাধান পেলন?”
“জ্বী হ্যাঁ, পেয়েছি। অপরাধীকে অ্যারেস্ট করতেই এসেছি এখানে।”
“কে অপরাধী? কে চুরি করেছে?” বিস্ময় আর কৌতুহলে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে আহসানউদ্দিনের।
“যাকে সন্দেহ করেছিলাম, আপনার অ্যাকাউন্টেন্টেরই কাজ এটা।”
“কিভাবে বুঝলেন? আপনার কাছে কি প্রমাণ আছে?”
“আছে,” বলে নিজের ফোনটা আহসানউদ্দিনের হাতে দিলেন ইন্সপেক্টর।
আহসানউদ্দিন ফোনে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখলেন, তাতে দেখা যাচ্ছে রাতের অন্ধকারে মুখে রুমাল বাঁধা একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। তাদের কোম্পানির সামনের রাস্তা। লোকটার মুখ পুরোপুরি দেখা না গেলেও লোকটার হাঁটার ধরন, উচ্চতা আর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সে অন্য কেও না, তার অফিসেরই একাউন্টেন্ট রাগিব আরাফাত। রাগিব তাদের কোম্পানির বিল্ডিঙের সামনে থামল। পকেট থেকে বের করল চাবি। তারপর বিল্ডিং ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণ পরেই হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে সে বেরিয়ে এল বিল্ডিং থেকে।
“আপনি এ ভিডিও কোথায় পেলেন?” বিস্ময়ভরে প্রশ্ন করলেন আহসানউদ্দিন।
“আপনাদের কোম্পানির সামনের বিল্ডিঙের সিসি টিভি ক্যামেরা থেকে। রাগিব সাহেব কি অফিসে আছে?”
“আছে।”
“আর লুকিয়ে কিছু লাভ নেই, বলে ফেলুন রাগিব সাহেব।
আমি সব জানি। ক্লিপটা তো দেখলেনই। এখনো কি অস্বীকার করবেন? আপনি কাজটা কিভাবে করেছেন আমি সব বুঝে গেছি। রাতের অন্ধকারে অফিসে ঢুকে টাকাটা সাথে নিয়ে ভেগেছেন আপনি। সাথে একটা বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। সবকটা সিসি টিভি ক্যামেরার মেমরি বের করে নিয়েছেন আর ঢুকিয়ে দিয়েছেন নতুন মেমরি। সাথে ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল আর পজিশনও চেঞ্জ করে দিয়েছেন। কিন্তু আপনার মাথায় রাখা উচিত ছিল আইনের হাত অনেক লম্বা”, বললেন ইন্সপেক্টর। রাগিবকে গ্রেফতার করে তিনি থানায় এনেছেন। জেল হাজতে বসেই আসামীর স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা করছেন ইন্সপেক্টর। কিন্তু রাগিব কিছুতেই মুখ খুলছে না।
“আমি কিছু করিনি, তবে কে করেছে আমি জানি,” বলল রাগিব।
“অন্য কাওকে দোষারোপ করে লাভ নেই, আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ আমার হাতে।”
“চোখ সবসময় সত্যি কথা বলে না। আমরা যা দেখি তা অনেক সময় ভুল হয়। কিন্তু আমরা তা বিশ্বাস করতে চাই না।”
“আমি আপনার কাছে দর্শনের ক্লাস করতে আসিনি। যা বলার সরাসরি বলুন।” “প্রথম থেকেই বলি তাহলে। আপনি হয়ত জানেন না যে আমার একটা যমজ ভাই আছে। তার নাম রাবিব। তার আর আমার চেহারায় কোনো পার্থক্য নেই। আমরা একই সাথে একই বাড়িতে থাকি। দুজনই অবিবাহিত। আমি চাকরি করি, ইনকাম করি। কিন্তু ও সারাদিন বাড়ি বসে থাকে। কোনো ইনকাম করে না। চুরি হওয়ার আগের রাতে ওর সাথে আমার ঝগড়া একটা বিষয়ে।
ও বলে আর আমার টাকায় খাবে না। এবার নিজে ইনকাম করবে। একথা ও ইতোপূর্বে অনেকবারই বলেছে। কিন্তু কোনোবারই ইনকামের চেষ্টা করেনি। কিন্তু চুরির ঘটনা ঘটার পরদিন আমি দেখলাম ওর ঘরে একটা ব্যাগ। ব্যাগভর্তি টাকা। গুণে দেখলাম ৫০ লাখ। আমি এবার দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিলাম। ও বাথরুমে ছিল। তাই কিছু টের পায়নি। গতকাল আমি অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি যে ও বাসায় নেই। ব্যাগভর্তি টাকাও উধাও। আমি বুঝলাম যে ও টাকা নিয়ে পালিয়েছে। আমি আমার ভাইকে ভালবাসি। ও ছাড়া আমার কেও নেই। কলেজে পড়ার সময় বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে ও ছাড়া এ পৃথিবীতে আমার আর কেও নেই। আমি চাইনি ও কোনো বিপদে পড়ুক। তাই আসলে আপনাদেরকে জানাইনি। আমি জানি আমার কথা আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না। না হওয়ারই কথা তবে কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্যি।”
কথাগুলো ইন্সপেক্টরের কাছে পাকা মিথ্যা বলে মনে হল। হয়ত এ লোকের কোনো যমজ ভাই-ই নেই। পুরোটাই বানানো গল্প। তবে গল্পটা অদ্ভুত হলেও অসম্ভব না। তাই সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তিনি তদন্ত শুরু করলেন।
পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে থেকে জানা গেল যে, সত্যিই রাবিব নামে রাগিবের এক যমজ ভাই আছে। রাগিবের বাড়ি সার্চ করেও বোঝা গেল এখানে একজন না, দুজন থাকে। রাগিবের বাড়িতে দুটো বেডরুম। দুটো দুরকম-ভাবে সাজানো। একটা রুম খুব সুন্দর করে সাজানো, একদম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। রুমে একপাশের দেওয়ালে আয়াতুল কুরসি টানানো। বেডসাইড টেবিলে রাখা একটা ছবি।
একজন মধ্যবয়সী পুরুষ ও একজন মহিলা। সাথে একটা দশ বছর বয়সী ছেলে। বুঝা যায় এটা রাগিব ও তার মা-বাবার ছবি। অপর ঘরটা অগোছালো। জিনিসপত্র সব এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘরের দেওয়ালে কিছু ছবি টনানো। সব বিদেশি ব্যান্ডের মেম্বারদের ছবি। আরেকটা ছবি দেখলে রাগিবের ছবি মনে হয়। তবে ছবির লোকটার হেয়ার স্টাইল রাগিবের থেকে আলাদা। রাগিবের চুলের স্টাইল সাধারণ। তবে ছবির লোকটার চুল ব্যাকব্রাশ করা। এটাই হয়ত রাগিবের যমজ ভাই রাবিব।
ইন্সপেক্টর খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তাহলে কি রাগিবের বলা কথাগুলো সব সত্যি? তাহলে টাকাটা কি রাবিবের কাছে আছে? এমনও তো হতে পারে যে, রাগিবের একটা যমজ ভাই ঠিকই আছে, কিন্তু সে হয়ত টাকাটা চুরি করেনি। রাগিব নিজেই চুরি করে তার উপর দোষ চাপাচ্ছে। কোনোটারই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ইন্সপেক্টর তাই রাবিবের খোঁজ আরম্ভ করে দিলেন। আশেপাশের সব পুলিশ স্টেশনে রাবিবের ছবি পাঠিয়ে দিলেন। লোক লাগিয়ে দিলেন রাবিবকে খোঁজার জন্য। সমস্ত পত্র পত্রিকায় রাবিবের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিলেন ‘ধরিয়ে দিন’। তবে আহসানউদ্দীনের অনুরোধে তার কোম্পানির সুনাম রক্ষার্থে পুরো ঘটনাটা গোপন রাখলেন। রাগিবকে আপাতত ছেড়ে দিলেন। তবে তার পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে দিলেন কিছু। রাগিবের কর্মকাণ্ডে সন্দেহজনক কিছু দেখলে তারা তাকে রিপোর্ট করবে।
পুলিশ স্টেশনে নিজের ডেস্কের সামনে বসে আছেন ইন্সপেক্টর আশরাফুল। একটা কনস্টেবল ভেতরে ঢুকে বলল, “একজন লোক এসেছে স্যার। বলছে আপনার সাথে দেখা করা খুব প্রয়োজন। ভেতরে পাঠাবো?” মাথা দুলিয়ে ইশারায় অনুমতি দিলেন ইন্সপেক্টর। কনস্টেবল যাওয়ার সাথে সাথেই একজন লোক ভিতরে ঢুকল।ধবধবে সাদা চুল। বয়স ষাট ছুঁই-ছুঁই। কাধে একটা ব্যাগ। বেশ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারা লোকটার। “আসসালামু আলাইকুম,” বলল আগন্তুক। “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বসুন। আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” চেয়ার টেনে বসলেন ভদ্রলোক ডেস্কের অপরপাশে। ব্যাগ থেকে বের করলেন একটা খবরের কাগজ। রাবিবের ছবি দিয়ে ‘ধরিয়ে দিন’ বিজ্ঞাপনের দিকে নির্দেশ করে বললেন,
“এটা কি আপনার দেওয়া?”
“জ্বী আমারই দেওয়া। আপনি জানেন এই ব্যক্তির কোনো খোঁজ-খবর?”
“সেটা পরে বলছি। আগে বলুন আপনি একে কেন খুঁজছেন?
খানিকটা বিরক্ত হলেন এবার ইন্সপেক্টর। আগন্তুক হয়ত তার বিরক্তির ব্যাপারটা ধরতে পারল। তাই বলল, “দেখুন, আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। আমার নাম শফিউল ইসলাম। এই নিন আমার কার্ড। ঘটনার বিস্তারিত জানার আমার প্রয়োজন আছে বলেই জানতে চাচ্ছি, নাহলে বিনা কারবে আপনাকে বিরক্ত করতাম না,” বলে কার্ডটা এগিয়ে দিলেন তিনি ইন্সপেক্টরের দিকে। ইন্সপেক্টর কার্ডটা নিরীক্ষণ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ঠিক আছে। আমি সব ঘটনা বলছি। তবে এ ঘটনা যেন বাইরের কেও জানতে না পারে তার নিশ্চয়তা আপনাকে দিতে হবে।” “সে সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।” সব ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন ইন্সপেক্টর। বাদ দিলেন না কিছুই। সব ঘটনা শুনে কিচ্ছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন সাইকিয়াট্রিস্ট। বড়সড় একটা ধাক্কা খেয়েছে যেন। নীরবতা ভাঙলেন ইন্সপেক্টর,
“এবার আপনি বলুন এই কেইস সম্বন্ধে আপনি কি জানেন?”
“এক কথায় বলতে গেলে চুরিটা রাগিবি করেছে কিন্তু সে চুরি করেনি।”
“মানে?” এবার বিস্মিত হওয়ার পালা ইন্সপেক্টরের।
“এর পিছনে দীর্ঘ ইতিহাস আছে, ইন্সপেক্টর সাহেব। যদি আপনার ব্যস্ততা না থাকে তবে আমি এখন বলতে পারি।”
“বলুন।”
“আমি রাগিবের সাইকিয়াট্রিস্ট ছিলাম একসময়। সে অনেকদিন আগের কথা। রাগিব তখন ছোট ছিল। ওর বাবা-মা দুজনই ছিলেন চাকরিজীবী। রাগিব তাই তার ছয় মাস বয়স থেকেই বাসায় কাজের বুয়ার কাছে থাকত। যেখানে তার মায়ের ভালবাসা পাওয়ার কথা ছিল সেখানে সে পেল বুয়ার অবহেলা। রাগিব হাঁটতে ও কথা বলতে শেখার পর বুয়া রাগিবক খেলনার মাঝে বসিয়ে রেখে নিজে ঘুমাত। রাগিব একা একা খেলত। কিন্তু ওইটুকু বিয়স থেকেই সে অত্যন্ত নিঃসঙ্গ বোধ করা। ছোট বাচ্চারা একা একা থাকতে পছন্দ করে না। মানুষের সঙ্গ পছন্দ তাদের। কিন্তু রাগিব ছিল তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আবার রাগিবের ছোটবেলা থেকে ঘরের বাইরে যাওয়াও নিষেধ ছিল। বদ্ধ ঘরে ঘুমন্ত কাজের বুয়ার পাশে খেলনা নিয়ে বসে থেকেই কাটছিল তার শৈশব। হঠাৎ একদিন রাগিবের বাবা-মা লক্ষ করলেন, তাদের সন্তান নিজের মনেই কার সাথে যেন কথা বলে। প্রথমে ব্যাপারটাকে তারা তেমন গুরুত্ব দেননি, কিন্তু সমস্যাটা যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, তখন তারা রাগিবকে নিয়ে আসলেন আমার কাছে। রাগিবের বয়স তখন ৬।
আমি কিছুক্ষণ রাগিবের সাথে কথা বলেই রাগিবের রোগ ধরতে পেরেছিলাম। মাল্টি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার। এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক রোগ। এই রোগীদের মাঝে একাধিক সত্তা বিরাজ করে। মানুষ একজন কিন্তু সত্তা দুটো। একটা আসল, আরেকটা কাল্পনিক। রোগীর শরীরের মধ্যে একেক সময় একেকটা সত্তা বিরাজ করে। যদিও এটাকে সত্তা বলা ঠিক হচ্ছে কিনা জানি না, তবে এটাকে আর কি বলব বুঝতে পারছি না।” ইন্সপেক্টরের নির্বোধের মত চাহনি দেখে ব্যাপারটা আরেকটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলেন আগন্তুক, “ধরুন একজনের মাল্টি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার আছে এবং তার আসলে ইলিশ মাছ খুব পছন্দ। কিন্তু যখন সে তার কাল্পনিক সত্তার মধ্যে প্রবেশ করবে তখন সে পাল্টে যাবে, এমনও হতে পারে যে কাল্পনিক সত্তা ইলিশ মাছের গন্ধই সহ্য করতে পারে না।
ইতিহাসের অনেক বড় বড় অপরাধী মাল্টি পার্সোনালিটি ডিস অর্ডারের রোগী। তারা সাধারণত অত্যন্ত ভাল মানুষ। কিন্তু তারা যখন তাদের অপর সত্তায় প্রবেশ করে তারা হয়ে ওঠে হিংস্র, নরপিশাচ। আরেকটা মজার ব্যাপার হল, তারা যখন তাদের কাল্পনিক সত্তা থেকে বেরিয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়, তাদের কাল্পনিক সত্তায় করা কুকর্মগুলোর বিন্দু-বিসর্গও তাদের আর মনে থাকে না। অনেক সময় আবার এমনও হয় যে রোগী তার কাল্পনিক সত্তাকে একজন রক্ত-মাংসের মানুষ ভাবা শুরু করে। বাচ্চাদের পুতুল খেলায় একটা বিষয় নিশ্চয় দেখে থাকবেন। বাচ্চারা পুতুলের সাথে কথা বলে। সে নিজের কথা নিজে তো বলেই, আবার পুতুলের কথাও সে নিজেই বলে। মাল্টি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের রোগীও অনেকটা সেরকম করে।” কথা শেষ করে দম নিলেন সাইকিয়াট্রিস্ট।
“তার সাথে এই কেসের সম্পর্ক কি?” “দাঁড়ান বলছি। রাগিব ছোটবেলায় নিঃসঙ্গ থাকায় তার মস্তিষ্ক একটা কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করে। আর সেটাই রাবিব। সে ম্নিজের মনেই রাবিবের সাথে খেলত। প্রথমে সে নিজে জানত যে ব্যাপারটা একটা কল্পনা। কিন্তু ধীরে ধীরে সে রাবিবের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করা শুরু করল। তার কাছে মনে হতে লাগল যে রবিব সত্যিই একজন মানুষ। সে তার যমজ ভাই। কিন্তু আসলে সে নিজেই রাগিব, নিজেই রাবিব। আমি রাগিবের বাবা-মাকে রাগিবের চিকিৎসার পরামর্শ দিলাম। তারা রাজী হলেন।
চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ অনেকটাই সারিয়ে তুলেছিলাম আমি। হাই স্কুল লেভেলে ওঠার পর রাগিবকে সুস্থ ঘোষণা করলাম আমি। কিন্তু কলেজে ওঠার পর রাগিবের বাবা-মা’র একটা কার এক্সিডেন্টে মৃত্যু হয়। তাদের আত্মীয়-স্বজন বলতে তেমন কেও ছিল না। তাই রাগিব পুরোপুরি একা হয়ে যায়। কলেজ ছেড়ে দেয়। বাড়িভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় যে বাসায় তারা ভাড়া থাকত সেটা ছেড়ে দেয়। আমি পরে ওর ঠিকানা ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারিনি। খবরের কাগজে ছবি দেখে চিনতে পেরে আপনার কাছে ছুটে এসেছি। আপনার বর্ণনা শুনে আমি ঘটনা বুঝে ফেলেছি। আসলে রাগিবই টাকাটা চুরি করেছে। কিন্তু সে মনে করে যে তার যমজ ভাই রাবিব সেটা চুরি করেছে বাস্তবে আসলে যার কোনো অস্তিত্বই নেই।”
পরবর্তী ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। কেসটা কোর্টে ওঠে। এবং আদালত রাগিবকে চিকিৎসার জন্য মানসিক হাসপাতালে পাঠায়। কিন্তু আহসানউদ্দিন তার কোম্পানির টাকাটা ফেরত পায় না, কারণ রাগিবকে যত বারই জিজ্ঞেস করা হয়, “টাকাটা তুমি কোথায় রেখেছ?” সে বারবার একই উত্তর দেয়, “আমি চুরি করিনি। রাবিব চুরি করেছে। রাবিব টাকাটা কোথায় রেখেছে তা আমি কিভাবে জানব?