০৪. মানুষ করার প্রসঙ্গে
রবিবার, ১১ জুলাই, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
এই নিয়ে যে কতবার মানুষ করার প্রসঙ্গে আসব তার লেখাজোখা নেই। কিন্তু তার আগে তোমাকে বলা দরকার যে, আমি এখন সত্যিই চেষ্টা করছি ভালো মেয়ে এবং বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে সবাইকে সব কাজে সাহায্য করতে এবং আমার সাধ্যমত সব কিছু করতে যাতে দাঁত ঝাড়া দেওয়ার তুমুল বর্ষণের ধার কমে সেটা ইল্সেগুড়িতে এসে ঠেকে। যে লোকগুলো তোমার অসহ্য, তাদের সঙ্গে অমন আদর্শ ব্যবহার করে চলা খুবই কঠিন কাজ, বিশেষভাবে যখন তোমতর মনে এক আর মুখে আর এক। কিন্তু প্রকৃতই আমি দেখছি যে, একটু ছলাকলার আশ্রয় নিতে পারলে মিলেমিশে থাকা সহজ হয়। আগে আমার স্বভাব ছিল উল্টো–সবাইকে আমি চ্যাটাং চ্যাটাং করে যা মনে হত বলতাম (যদিও কেউই কোনোদিন আমার মত জিজ্ঞেস করত না এবং আমার বক্তব্যের তারা কোন দামই দিত না)।
অনেক সময় আমার জ্ঞান থাকে না; কোনো একটা অবিচার দেখে হয়ত ফেটে পড়ি। ব্যস্ তারপর টানা চারটি সপ্তাহ ধরে সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর শুনতে হয় যে, আমার মত ধিঙ্গি বেহায়া মেয়ে দুনিয়ায় দুটো নেই। তোমার কি মনে হয় না যে, মাঝে মাঝে আমার ক্ষাপার ন্যায্য কারণ থাকে? এটা ভালো যে, আমি সব সয় গজগজ করি না। কেননা তাতে মেজাজটা খিচিয়ে থাকে এবং একটুতেই রাগ হয়।
আমি ঠিক করেছি শর্টহ্যাণ্ড এখন কিছুদিন থাক; তাতে প্রথমত আমার অন্যান্য বিষয়গুলোতে আমি আরও বেশি সময় দিতে পারব এবং দ্বিতীয়ত আমার চোখের জন্যও বটে। খুব ক্ষীণদৃষ্টি হয়ে পড়ায় আমার অবস্থা খুবই কাহিল আর শোচনীয় হয়ে পড়েছে; অনেক আগেই আমার চশমা নেওয়া উচিত ছিল (উঃ, কী পাচার মতন আমাকে দেখাবে), কিন্তু তুমি তো জানো, অজ্ঞাতবাসে থেকে সেটা সম্ভব নয়। মা-মণি আমাকে মিসেস কুপহুইসের সঙ্গে চোখের ডাক্তারের কাছে পাঠানোর প্রস্তাব করায় কাল প্রত্যেকেই শুধু আমার চোখ নিয়ে কথা বলেছে। খবরটা শুনে আমি কিছুটা ভরিয়ে উঠেছিলাম, কেন না জিনিসটা ছেলেখেলা নয়। কল্পনা করো, বাড়ির বাইরে যাব, প্রকাশ্য রাস্তায়–ভাবা যায় না! গোড়ায় আমি থ হয়ে গিয়েছিলাম, পরে আনন্দ হল। কিন্তু বললেই তো আর হয় না, এ ধরনের ব্যবস্থা করতে গেলে যাদের সম্মতি নিতে হয় তারা চট করে একমত হতে পারলেন না। কী কী অসুবিধে এবং বিপদের ঝুঁকি আছে, আগে তা ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে; মিপ অবশ্য আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে এক পায়ে রাজি।
ইতিমধ্যে আমি আলমারি থেকে আমার ছাই-রঙের কোটটা বার করে ফেলেছি; কিন্তু সেটা এত খাটো যে দেখে মনে হয় আমার ছোট বোনের।
শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় দেখার জন্যে আমি মুখিয়ে আছি। তবে মতলবটা খাটবে বলে আমার মনে হয় না; কারণ, বৃটিশরা এখন সিচিলিতে অবতরণ করেছে এবং বাপি আবারও আশা করছেন লড়াই চটপট হতে হবে।
আমাকে আর মা-মণিকে একগাদা অফিসের কাজ দিয়েছেন এলি; এতে আমাদের দুজনেরই যেমন বেশ একটু পায়াভারী ঠেকছে, তেমনি এলির কাজেও যথেষ্ট সাহায্য হচ্ছে। চিঠিচাপাটি ফাইলবন্দী করতে এবং বিক্রির হিসেব লিখতে যে কেউ পারে, তবে আমরা সে কাজ বিশেষ রকম গা লাগিয়ে করি।
মিপ যেন ঠিক ধোপার গাধা, কত কী যে যোগাড়যন্ত্র করে তাঁকে বয়ে আনতে হয়। প্রায় প্রত্যেক দিনই আমাদের জন্য কিছু না কিছু সজী মিপ এখান-সেখান থেকে জুটিয়ে আনেন এবং সমস্তটাই আনেন বাজারের থলিতে পুরে ওঁর সাইকেলে। আমরা সারা সপ্তাহ শনিবারের জন্যে হাপিত্যেশ করে বসে থাকি; সেদিন আমাদের বই আসে। ঠিক যেমন ছোট ছেলেমেয়েরা উৎসুক হয়ে থাকে উপহারের জন্যে।
আমরা যারা এখানে বন্ধ হয়ে আছি, আমাদের কাছে বই যে কী জিনিস তা সাধারণ লোকের মাথাতেই ঢুকবে না। পড়া, জানা আর রেডিও শোনা–আমাদের কাছে আমোদ প্রমোদ বলতে এই সব।
তোমার আনা।
মঙ্গলবার, ১৩ জুলাই, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
বাপির মত নিয়ে, কাল বিকেলে আমি ডুসেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম উনি অনুগ্রহ করে (ভদ্রলোক যেহেতু খুবই শিষ্ট) আমাদের ঘরের ছোট টেবিলটা হপ্তায় দুদিন বিকেলবেলায় চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা আমাকে একটু ব্যবহার করতে দেবেন কি? ডুসেল যখন ঘুমোন, তখন রোজ আড়াইটে থেকে চারটে আমি টেবিলে গিয়ে বসি, তবে তা নইলে টেবিল সমেত ঘরটা আমার অধিকারের বাইরে। ভেতর দিকে, আমাদের বারোয়ারী যে ঘর, সেখানে বড় বেশি হৈ-হট্টগোল; সেখানে বসে কাজ করা অসম্ভব। তাছাড়া বাপি লেখার টেবিলটাতে বসতে চান এবং মাঝে মাঝে কাজও করেন।
সুতরাং অনুরোধটা ছিল যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত এবং প্রশ্নটা করা হয়েছিল খুবই সবিনয়ে। সত্যি, তুমি ভাবতে আরো তখন পণ্ডিত ডুসেল কী উত্তর দিলেন? উনি বললেন, না। সোজা। সিধে কথায়–’না’। আমার খুব রাগ হল এবং অত সহজে দমে যেতে রাজী হলাম না। সুতরাং আমি ওঁর ‘না’ বলার কারণ জানতে চাইলাম। কিন্তু ওঁর কথা শুনে আমার কানের মধ্যে ভো ভো করতে লাগল। ওঁর আর আমার মধ্যে এই মর্মে খুব একচোট হয়ে গেল
‘আমাকেও কাজ করতে হবে, আর আমি বিকেলগুলোতে কাজ করতে না পারলে আমার আর কোনো সময়ই থাকছে না। হাতের কাজ আমাকে শেষ করতেই হবে, নইলে শুরু করারই আর কোনো মানে থাকে না। যাই হোক, তুমি এমন কিছু কাজের কাজ করো না। তোমার পৌরাণিক উপাখ্যান, ওটা আবার কেমন ধারা কাজ। বোনা আর পড়া কোনোটাই কাজ নয়। আমি টেবিলে বসে আছি, বসেই থাকব।’
আমার উত্তর হল–’মিস্টার ডুসেল, আমি যেটা করি সেটা কাজের কাজ এবং বিকেলে আর কোথাও বসে আমার কাজ করার জায়গা নেই। আপনাকে আমি ব্যগ্রতা করছি, আমার অনুরোধের কথাটা আপনি আবার ভেবে দেখুন।‘
এই বলে মনঃক্ষুণ্ণ আমি সেই ডাক্তার পণ্ডিতের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াই, তাকে আদৌ। গ্রাহ্যের মধ্যে না এনে। আমি তখন রাগে ফুলছি এবং ভাবছি ডুসেল কী সাংঘাতিক অভদ্র মানুষ (নিশ্চয়ই উনি তাই) আর আমি কী অমায়িক।
সন্ধ্যেবেলা পিকে ধরতে পেরে তাকে বললাম কি ভাবে ব্যাপারটা কেঁচে গেছে এবং এরপর আমি কী করব সে বিষয়ে আলোচনা করলাম, কেননা আমি সহজে ছাড়ছি না। বললাম এর ফয়সালা আমি নিজেই করতে চাই।
পিম্ আমাকে বলে দিলেন কিভাবে ব্যাপারটা সামলাতে হবে; সেই সঙ্গে আমাকে পই পই করে বললেন কাল পর্যন্ত ব্যাপারটা আমি যেন ঝুলিয়ে রাখি, কেননা আজ আমি খুবই তেতে আছি। আমি এই উপদেশ চুলোয় যেতে দিয়ে বাসন ধোয়া শেষ করে ডুসেলের জন্যে অপেক্ষা করে থাকলাম।
আমাদের ঠিক পাশের ঘরেই পিম বসে ছিলেন, নিজেকে ঠাণ্ডা রাখতে সেটা আমাকে সাহায্য করেছিল। আমি বলা শুরু করলাম—‘মিস্টার ডুসেল, আপনি বোধহয় মনে করেন না। ব্যাপারটা নিয়ে আর কথা বলে কোনো লাভ আছে, কিন্তু আপনাকে আমি বলব আবার ভেবে দেখতে।’ ডুসেল তখন ওঁর মুখে মধুরতম হাসি ফুটিয়ে বললেন–এ নিয়ে আলোচনা করতে আমি যখন তখন যে কোনো সময়েই রাজী, কিন্তু ঠিক যা হবার তা তো হয়েই গেছে।
ডুসেলের অনবরত কথার মধ্যে কথা বলা সত্ত্বেও আমি বকে চললাম–আপনি প্রথম যখন এখানে এলেন তখন আমরা ঠিক করেছিলাম ঘরটা হবে আমাদের দুজনার, আমরা যদি ন্যায্য ভাবে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতাম, তাহলে সকালটা পেতেন আপনি আর আমি পেতাম বিকেলটা পুরোপুরি। কিন্তু আমি অতখানিও চাইছি না। আমি মনে করি, সত্যি আমার দুটো বিকেলের দাবি সম্পূর্ণভাবে ন্যায়সঙ্গত।’ এ কথায় ডুসেল একেবারে লাফ দিয়ে উঠলেন, কেউ যেন তাঁর গায়ে উঁচ ফুটিয়ে দিয়েছে। এখানে তুমি তোমার অধিকারের কথা বলতেই পারো না।
এখন কোথায় যাব আমি তাহলে? মিস্টার ফান ডানকে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করব চিলেকোঠায় উনি আমার জন্যে একটা ছোট্ট কুঠুরি বানিয়ে দেবেন কিনা। আমি তাহলে সেখানে গিয়ে বসতে পারি। আমি যেখানে-সেখানে বসে কাজই করতে পারি না। তোমাকে নিয়ে সবাইকেই গোলমালে পড়তে হয়। তোমার দিদি মারগট, ওর বরং ঢের বেশি যুক্তি আছে চাইবার–মারগট যদি ঐ সমস্যা নিয়ে আমার কাছে আসত, আমি তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতাম না, কিন্তু তুমি, তোমার সঙ্গে কোনো কথাই চলে না। তুমি এমন। যাচ্ছেতাই রকমের একালচেঁড়ে, নিজে তুমি যেটা চাও সেটা পাওয়ার জন্যে আর সবাইকে কোণঠাসা করতে তোমার কিছু বাধে না, এরকম দুরন্ত বাচ্চা আমি কখনও দেখিনি। তবে সবকিছু সত্ত্বেও, আমাকে বোধহয় তোমার আবদার বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হবে, কেননা তা না হলে পরে আমাকে শুনতে হবে যে, আনা ফ্রাঙ্ক পরীক্ষায় ফেল করেছে তার কারণ মিস্টার ডুসেল তাকে টেবিল ছেড়ে দিতে চাননি?’
এইভাবে অনেকক্ষণ ঝিরঝিরিয়ে চলার পর এমন তোড়ে শুরু হল যে আমি আর তার সঙ্গে তাল রাখতে পাররাম না। একটা সময়ে আমার মনে হল, এখুনি ওর মুখে এমন একটা কষে মারবো যে, মিথ্যের ঝুড়ি নিয়ে উড়ে লোকটা মটুকায় গিয়ে ঠেকবে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে বললাম, ‘শান্ত হয়ে থাকো! মশা মেরে হাত নষ্ট করার কোন মানে হয় না।
শেষবারের মতন প্রচণ্ড ভাবে গায়ের ঝাল ঝেড়ে মিস্টার ডুসেল ক্রোধ আর জয়ের মিশ্রিত ভাব মুখে ফুটিয়ে পকেটে-খাবার-ঠাসা কোট গায়ে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমি এক ছুটে বাপিকে গিয়ে ওর না-শোনা বাকি কাহিনীটা বললাম। পিম্ ঠিক করলেন সেইদিন সন্ধ্যেবেলাতেই ডুসেলের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন।
কথা তিনি বলেছিলেন। আধঘণ্টার বেশি তাদের কথা হয়। ওঁদের কথার বিষয়বস্তু ছিল অনেকটা এই রকম–আনা টেবিলে বসবে কি বসবে না এটার একটা হেস্তনেস্ত করতে গোড়ায় কথা হয়।
বাপি বললেন ডুসেলের সঙ্গে উনি একমত–ছোটদের সামনে ডুসেলকে অন্যায্য প্রতিপন্ন করতে তখন তিনি চাননি।
তবে তখন ডুসেল ঠিক করছেন বলে ওঁর মনে হয়নি। ডুসেল বলেছিলেন আমার এমন ভাবে কথা বলা উচিত নয় যাতে মনে হয় ডুসেল যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছেন এবং সবকিছু নিজের কুক্ষিগত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাপি এ ব্যাপারে খুবই কড়াভাবে আমার পক্ষ নেন, কারণ আমি যে ও-ধরনের কোন কথাই বলিনি সেটা উনি স্বকর্ণে শুনেছিলেন।
একবার উনি বলেন তো একবার ইনি বলেন, এই ভাবে চলল। বাপি আমার স্বার্থপরতা আর ‘তুচ্ছ’ কাজ সংক্রান্ত কথার জবাব দেন, ডুসেল সমানে গজগজ করতে থাকেন।
শেষ পর্যন্ত ডুসেলকে অতঃপর হার মানতে হর, এবং সপ্তাহে দুটো করে বিকেল আমি পাঁচটা পর্যন্ত অবাধে কাজ করার সুযোগ পেলাম। ডুসেল আমার দিকে নাক সিটকে তাকান, দুদিন আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন এবং তাও পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা টেবিলে সেটে বসেন। চূড়ান্ত রকমের ছেলেমানুষি ব্যাপার।
চুয়ান্ন বছর বয়স হয়েছে, কী পাণ্ডিত্যের ভান আর কুচুটে মন! লোকটার স্বভাবই ঐরকম। ও স্বভাব শোধরাবার নয়।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ১৬ জুলাই, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
আবার সিঁদেল চোর। কিন্তু এবারেরটা সত্যিকার। আজ সকালে রোজকার মতন সাতটায় পেটার গিয়েছিল গুদামে এবং তৎক্ষণাৎ ওর নজরে পড়ে গুদামের দরজা আর রাস্তার ধারের দরজা হাট করে খোলা। পিকে গিয়ে ও বলে। পিম্ তখন খাসকামরার রেডিও কাটা জার্মানির দিকে ঘুরিয়ে রেখে দরজাটা তালাবদ্ধ করেন। তারপর দুজনে মিলে যান ওপরতলায়।
এইসব ক্ষেত্রের জন্যে যেসব চিরাচরিত নিয়ম আছে সেগুলো যথারীতি পালন করা হয় পানির কোনো কল খোলা নয়; সুতরাং কোনো কাচাকাচি নয়, কোনো শব্দ নয়, আটটার মধ্যে সব চুকিয়ে ফেলতে হবে এবং পায়খানা বন্ধ।
এটা ভেবে আমার খুশি যে এমন অঘোরে আমরা ঘুমিয়েছি যে, কিছুই আমাদের কানে যায়নি। সাড়ে এগারোটার আগে আমরা কিছু জানতে পারিনি। ঐ সময় মিস্টার কুপহুইসের কাছে আমরা জানলাম যে সিঁদেল-চোররা শিক গলিয়ে দিয়ে বাইরের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে তারপর গুদামের দরজাটা ভাঙে।
যাই হোক, সেখানে চুরি করার মত খুব বেশি কিছু না পেয়ে ভাগ্য পরীক্ষার জন্যে যায় ওপরতলায়। সেখানে তারা চুরি করে চল্লিশ ক্লোরিন সমেত দুটো ক্যাশবাক্স, কিছু পোস্টাল অর্ডার আর চেক বই। এবং তাছাড়া, সবচেয়ে খারাপ হল, ১৫০ কিলো চিনির সব। কটা কুপন।
মিস্টার কুপহুইসের ধারণা, ছ’সপ্তাহ আগে যে দলটা পর পর তিনটে দরজা ভাঙার চেষ্টা করেছিল, এরা সেই দলেরই লোক। তখন তারা না পেয়ে ফিরে গিয়েছিল।
বাড়িটাতে এ নিয়ে বেশ হৈ-চৈ পড়ে গেছে। তবে এই ধরনের চাঞ্চল্য ছাড়া ‘গুপ্ত মহলের চলতে পারে বলে মনে হয় না। আমাদের জামাকাপড়ের আলমারিতে রোজ সন্ধ্যেবেলায় যে সব টাইপরাইটার আর টাকাকড়ি তুলে এনে রাখা হয় তাতে হাত পড়েনি। দেখে আমরা খুব খুশি।
তোমার আনা
.
সোমবার, ১৯ জুলাই, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
রবিবার উত্তর আমস্টার্ডামে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ হয়েছে। মনে হয়, ক্ষয়ক্ষতি যা হয়েছে তা সাংঘাতিক। রাস্তা-কে রাস্তা ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়েছে। সমস্ত লোককে খুঁড়ে বের করতে প্রচুর সময় লাগবে। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দুশো আর আহতের কোনো ইয়ত্তা নেই; হাসপাতালগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। শোনা যায়, মা-বাবাকে খুঁজতে গিয়ে বাচ্চারা ধুমায়মান ধ্বংসস্তুপে নিখোঁজ হয়েছে। দূরে চাপা গুনগুন গুড়গুড় আওয়াজের কথা মনে হলেই শিউরে উঠি, আমাদের কাছে সেটা আসন্ন ধ্বংসের লক্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তোমার আনা।
শুক্রবার, জুলাই ২৩, ১৯৪৩
আদরের কিটি, নিছক তামাশা। সেই হিসেবেই তোমাকে বলব আমাদের প্রত্যেকের প্রথম কী ইচ্ছে যখন আমরা এখান থেকে বাইরে যেতে পারব। মারগট আর মিস্টার ফান ডানের ইচ্ছে সবকিছুর আগে উপচানো গরম পানিতে গোসল এবং আধ ঘন্টা ধরে তাতে গা ডুবিয়ে রাখা। মিসেস ফান ডান চান সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে আগে ক্রিমকেক খেতে, ডুসেল তাঁর স্ত্রী রোডিয়েকে দেখার কথা ছাড়া আর কিছু ভাবেন না; মা-মণি চান জমিয়ে এক কাপ কফি; বাপি প্রথমেই যাবেন মিস্টার ফসেনকে দেখতে; পেটার চায় সেই শহর আর একটা সিনেমা। অন্যদিকে বেরোবার কথায় প্রাণে আমি যে কী শান্তি পাই, অথচ কোথা থেকে শুরু করব আমি জানি না! তবে আমি সবচেয়ে বেশি করে চাই নিজেদের একটা বাড়ি, চাই ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়াবার স্বাধীনতা এবং শেষ অবধি আমরা কাজে ফিরে পেতে চাই কিছুটা সাহায্য অর্থাৎ-ইস্কুল।
এলি নিজে থেকে বলেছেন আমাদের জন্যে কিছু ফলমূল যোগাড় করে আনবেন। প্রায় পানির দাম–প্রেপফল কিলোপ্রতি ৫.০০ ফে, গুজুবেরি পাউণ্ড প্রতি ০.৭০ ফে, একটি পিচফল ০.৫০ ফে, এক কিলো ফুটি ১.৬০ ফে। (ডলারে যথাক্রমে আনুমানিক ১.৪০ ড, একুশ সেন্ট, চৌদ্দ সেন্ট এবং বিয়াল্লিশ সেন্টের সমতুল্য)। তবে খবরের কাগজগুলোতে প্রতি সন্ধ্যাতেই দেখবে বড় বড় অক্ষরে লেখা হয়েছে ও ন্যায্য পথে চলো এবং দাম কমের মধ্যে রাখো।
তোমার আনা।
সোমবার, ২৬ জুলাই, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
গতকাল গেছে শুধু হট্টগোল আর হৈচৈ-এ; আমরা এখনও গোটা ব্যাপারটা নিয়ে বেশ তেতে আছি। তুমি অবশ্য বলতেই পারো, কিছু না কিছু উত্তেজনা ছাড়া কোন্ দিনই বা তোমাদের যায়? আমরা যখন প্রাতরাশে বসেছি সেই সময় প্রথম হুঁশিয়ারী সাইরেন বেজে ওঠে, তবে আমরা আদৌ ওর কোনো মুল্য দিই না; প্লেনগুলো উপকূল ভাগ পার হয়ে এল ওতে শুধু এইটুকুই বোঝায়।
মাথাটা খুব ধরেছিল বলে প্রাতরাশের পর আমি গিয়ে ঘন্টাখানেক বিছানায় গড়াই। তারপর নিচের তলায় আসি। ঘড়িতে তখন প্রায় দুটো। মারগট তার অফিসের কাজ শেষ করে আড়াইটের সময়; জিনিসপত্র সে এক সঙ্গে মুড়ে রাখতে না রাখতে সাইরেন বাজতে শুরু করে দেয়, সুতরাং আমি আবার ওর সঙ্গে ওপরে উঠে আসি। ওপর তলায় আমরা এসেছি আর তার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওরা তুমুল গোলাগুলি ছোঁড়া শুরু করে দেয়। এত বেশি মাত্রায় শুরু হয়ে যায় যে, আমাদের সরে গিয়ে যাতায়াতের গলিতে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। আর হ্যাঁ, বাড়িটা তখন গুড়গুড় শব্দে কাঁপছে আর সেই সঙ্গে নেমে আসছে বৃষ্টির মত বোমা।
একটা ধরবার কিছু চাই বলে আমি আমার সকান-দেওয়ার ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে বসে আছি, পালাবার কথা ভেবে নয়, কেননা যাবার তো আর কোনো জায়গাই নেই। অবস্থা চরমে উঠলে আমাদের যদি এখান থেকে কখনও পালাতেই হয়, রাস্তা হবে ঠিক বিমান হানার মতই বিপজ্জনক। এবারেরটা থিতিয়ে গেল আধ ঘণ্টা বাদে, কিন্তু বাড়ির মধ্যেকার ক্রিয়াকলাপ তাতে বেড়ে গেল। চিলেকোঠায় তার চৌকি দেওয়ার জায়গাটা থেকে পেটার নিচে নেমে এল।
ডুসেল ছিলেন সদর দপ্তরে; মিসেস ফান ডান নিজেকে নিরাপদ বোধ করেছিলেন খাসকামরায়। মিস্টার ফান ডান নজর রাখছিলেন ঘুলঘুলি থেকে। আমরা যারা ছোট দালানে ছিলাম, আমরাও ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম। বন্দরের মাথায় যে সব ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওঠার কথা মিস্টার ফান ডান আমাদের বলেছিলেন, তা দেখবার জন্যে আমি ওপরে উঠলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই পোড়ার গন্ধ পাওয়া গেল; বাইরেটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন কুয়াশার একটা মোটা পর্দা সমস্ত জায়গাটা জুড়ে ঝুলছে।
ঐ ধরনের বিরাট অগ্নিকুণ্ডের দৃশ্য খুব সুখকর নয়, তবে সৌভাগ্যক্রমে আমাদের দিক থেকে ব্যাপারটার ঐখানেই ইতি ঘটে, এবং তারপর আমরা যে যার কাজে লেগে যাই। ঐদিন সন্ধ্যেবেলায় নৈশ আহারে বসতেই আবার বিমান-হানার হুঁশিয়ারি। খাবারটা বেশ ভালো ছিল, কিন্তু সাইরেনের শব্দ কানে যেতেই ক্ষিধে আমার মাথায় উঠল। কিছুই ঘটল না এবং তিন কোয়ার্টার পরেই বিপদ কেটে যাওয়ার সঙ্কেত হল। বাসনকোসন মাজার জন্যে সবে উঁই করা হয়েছে, অমনি বিমান-হানার হুঁশিয়ারি, বিমান-বিধ্বংসী কামানের গোলা, আসছে তো আসছেই গাদাগুচ্ছের প্লেন। আমরা সবাই মনে মনে বলছি, রক্ষে করো, দিনে। দুবার, বডড বেশি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বলে কোনই ফল হল না।
এবারও বোমা পড়ল মুষলধারে, এবারে অন্য দিকে। ব্রিটিশদের ভাষ্য অনুযায়ী, পিপল এর (আমস্টার্ডামের বিমানবন্দর) ওপর। প্লেনগুলো গোত্তা মেরে নেমে তারপর আকাশে চড়াও হচ্ছিল, আমরা ইঞ্জিনের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছিলাম, শব্দটা কী বিকট! প্রতি মুহূর্তে আমি ভাবছিলাম–’এইবার একটা বই পড়ল। ঐ আসছে।’
জেনে রাখো, নটার সময় যখন আমি শুতে গেলাম আমার পা দুটোকে কিছুতেই আমি বশে রাখতে পারছি না। আমার ঘুম ভেঙে গেল তখন কাটায় কাঁটায় বারোটা–ঝাকে ঝাকে প্লেন।
ডুসেল কাপড় ছাড়ছিলেন। আমি সেসব না মেনে, গোলাগুলির প্রথম শব্দেই, বিছানা থেকে তড়াক করে লাফ দিলাম। আমার তখন ঘুমের দফারফা। বাপির কাছে দুই ঘণ্টা ছিলাম, তবু প্লেন আসছে তো আসছেই। তারপর গোলাগুলি বন্ধ হতে তখন আমি শুতে যেতে পরলাম। আমার ঘুম এল আড়ইটেয়।
ঘড়িতে সাতটা। আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। মিস্টার ফান ডান আর বাপির মধ্যে কী কথা হচ্ছে। আমার প্রথমেই মনে হল সিঁদেল-চোর। মিস্টার ফান ডানকে বলতে শুনলাম ‘সব কিছু। আমি ভাবলাম সর্বস্ব চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু তা নয়, এবার দারুণ খবর; মাসের পর মাস কেন, বোধ হয় সারা যুদ্ধের বছরগুলোতেই এত ভালো খবর আমরা শুনিনি। মুসোলিনি ইস্তফা দিয়েছে, ইতালির রাজা সরকার হাতে নিয়েছে। আমরা আনন্দে লাফাতে লাগলাম। কাল ঐ ভয়ঙ্কর রকমের দিন যাবার পর, শেষ অবধি আবার ভালো কিছু এবং আশী। এর শেষ হবে, এই আশী। যুদ্ধ মিটে গিয়ে শান্তি আসবে, এই আশা।
ক্রালার এসেছিলেন। উনি আমাদের বললেন ফোক্কার কারখানার সাংঘাতিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ইতিমধ্যে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে প্লেন উড়ে যাওয়ায় আরেকটি বিমান হামলার হুশিয়ারি হয়েছে এবং আরও একবার সাইরেন বেজেছে। হুঁশিয়ারিতে হুশিয়ারিতে আমাদের যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে, বেজায় ক্লান্ত লাগছে এবং হাত পা নাড়তে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এখন ইতালির বুকে অনিশ্চয়তা এই আশা জাগিয়ে তুলবে যে, অচিরে এর অবসান। হবে, হয়ত এমন কি এই বছরের মধ্যেই।
তোমার আনা।
বৃহস্পতিবার, ২৯ জুলাই, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
মিসেস ফান ডান, ডুসেল আর আমি বাসনপত্র ধুচ্ছিলাম। আমি ছিলাম অসাধারণ রকমের চুপচাপ, সচরাচর হয় না। কাজেই ওঁরা নিশ্চয় সেটা লক্ষ্য করে থাকবেন।
গোলমাল এড়াবার জন্যে আমি তাড়াতাড়ি চাইলাম বেশ একটা নিরীহ গোছের প্রসঙ্গ তুলতে। ভাবলাম, ‘অপর দিক থেকে হেনরী’ বইটা আর উপযোগী হবে। কিন্তু আমার ভুল হল। মিসেস ফান ডানের হাত থেকে যদি বা ছাড়ান পাওয়া যায়, তো ডুসেল নাছোড়। ফলে, এই হল ব্যাপার–মিস্টার ডুসেল আমাদের বলেছিলেন, পড়ে দেখ, চমৎকার বই। মারগটের আর আমার আদৌ চমকার বলে মনে হয়নি। ছেলেটির চরিত্র সুন্দর ভাবে আঁকা হয়েছে, সন্দেহ নেই; কিন্তু বাকি সব আমার উচিত ছিল সে সম্বন্ধে কিছু না বলা। বাসন ধুতে ধুতে ঐ প্রসঙ্গে কী যে বলে ফেলেছিলাম। আর যাবে কোথায়!
মানুষের মনস্তত্ব তুমি কী বুঝবে! বাচ্চারটা বোঝা শক্ত নয়(!)। ও-বই পড়বার এখনও তোমার বয়স হয়নি; কুড়ি বছরের একজন ধাড়িরও ও-বই মাথায় ঢুকবে না।’ (তবে যে উনি মারগটকে আর আমাকে বিশেষ ভাবে সুপারিশ করে বলেছিলেন ও-বই পড়তে?) এবার ডুসেল আর মিসেস ফান ডান একজোট হয়ে শুরু করলেন–’যা তোমার যোগ্য নয়, সেসব জিনিস সম্পর্কে তুমি অতিরিক্ত বেশি রকম জেনে বুঝে ফেলেছ। তোমাকে বেয়াড়া ভাবে মানুষ করা হয়েছে। পরে যখন তোমার বয়স বাড়বে, তখন কিছুতেই কোনো রস পাবে না, তুমি তখন বলবে, ‘বিশ বছর আগেই ও আমি বইতে পড়েছি।’ যদি তুমি বর চাও কিংবা প্রেমে পড়তে চাও বরং সেটা তাড়াতাড়ি করে ফেলো–নইলে পরে সব কিছুতেই তোমার আশা ভঙ্গ হবে। তত্ত্বের দিক থেকে ইতিমধ্যেই তুমি পেকে উঠেছ, এখন তোমার শুধু দরকার হাতে-কলমে সেটা ফলানো!
আমার সঙ্গে আমার মা-বাবাকে লড়িয়ে দেওয়ার ওঁদের সব সময় যে চেষ্টা, বোধকরি সেটাই ওঁদের ভালোভাবে মানুষ হওয়ার ধারণা, কেননা প্রায়ই তারা সেটা করে থাকেন। আর আমার বয়সী কোনো মেয়েকে ‘সাবালক’ বিষয় সম্পর্কে কিছু না বলা, তেমনি এও এক সুন্দর পদ্ধতি! এই জাতের মানুষ করার ফল তো হামেশাই চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি।
ওঁরা যখন ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে অপদস্থ করছিলেন, সেই মুহূর্তে আমি ঠাস করে ওঁদের গালে চড় লাগিয়ে দিতে পারতাম। রাগে তখন আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। আমি এখন দিন গুনছি কবে ওই সব লোকের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাব।
মিসেস ফান ডান খাসা লোক! সুন্দর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন উনি…করেন বৈকি। একেবারেই বদ দৃষ্টান্ত। ওঁকে সবাই জানে–উনি ঝালে-ঝোলে-অম্বলে, উনি স্বার্থপর, ধূর্ত, হিসেবী এবং কিছুতেই উনি তুষ্ট নন। ঠেকার আর ছেনালি–তালিকায় এ দুটোও যোগ করতে পারি। উনি যে অকথ্য রকমের বিচ্ছিরি মানুষ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মহাশয়ার বিষয়ে আমি সাতকাণ্ড রামায়ণ লিখে ফেলতে পারি; কে জানে, হয়ত একদিন লিখেও ফেলব। যে কেউ তার বাইরেটাতে সুন্দর একপোচ রং লাগিয়ে নিতে পারে। বাইরের উটকো লোক এলে বিশেষ করে পুরুষ মানুষ, মিসেস ফান ডান ভারি অমায়িক ব্যবহার করেন; কাজেই ওঁকে কম সময়ের জন্যে দেখলে ওঁর সম্পর্কে সহজেই লোকে ভুল করে বসেন। মা মণি মনে করেন ভদ্রমহিলা এতই নির্বোধ যে, ওঁর সম্পর্কে বাক্যব্যয় করা বৃথা, মারগট ওঁকে এলেবেলে লোক বলে মনে করে, পিম্ ওঁকে বলেন হতকুচ্ছিত (অভিধা ও ব্যঞ্জনা, দুই অর্থেই), এবং ওঁকে দীর্ঘকাল ধরে দেখে কেননা একেবারে গোড়ায় ওঁর সম্পর্কে আমার কখনও কোনো জাতক্রোধ ছিল না। আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, একাধারে উনি ঐ তিনটি তো বটেই, তদুপরি উনি আরও কিছু! ওর মধ্যে এত রকমের বদ্ গুণ যে, কোনটা ছেড়ে কোটা দিয়ে শুরু করব?
তোমার আনা।
পুনশ্চ : পাঠক কি এটা বিবেচনায় আনবেন যে, এই কাহিনী যখন লেখা হচ্ছিল তখনও লেখিকা রেগে টং হয়ে ছিলেন।
.
মঙ্গলবার, ৩ আগস্ট, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
রাজনীতির খবর চমৎকার। ইতালিতে ফ্যাশিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বহু জায়গায় লোকে ফ্যাশিস্টদের বিরুদ্ধে লড়ছে–এমন কি সৈন্যবাহিনীও এই লড়াইতে কার্যত যোগ দিয়েছে। এ রকম একটা দেশ কি ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে পারে?
এইমাত্র হাওয়াই হামলা হয়ে গেল, এই নিয়ে তিনবার; মনে সাহস আনার জন্যে আমি দাঁতে দাঁত দিয়ে ছিলাম। মিসেস ফান ডান, যিনি সবসময় বলে এসেছেন, একেবারেই শেষ
হওয়ার চেয়ে বরং ভয়ঙ্কর ভাবে শেষ হওয়া ভালো’–এখন দেখা যাচ্ছে, উনিই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে কাপুরুষ। আজ সকালে উনি বাঁশপাতার মত তিরতির করে কাঁপছিলেন, এমন কি উনি ভ্যা করে কেঁদেও ফেলেছিলেন। এক সপ্তাহ ধরে স্বামীর সঙ্গে চুলোচুলি ঝগড়া করার পর সদ্য উনি সেটা মিটিয়ে নিয়েছিলেন। ওঁর স্বামী যখন ওঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন তখন একমাত্র ওর মুখের অবস্থা দেখে আমার মনটা প্রায় গলে গিয়েছিল।
মুশ্চি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বেড়াল পোষার সুফল আর কুফল দুই-ই আছে। সারা বাড়ি উঁশ মাছিতে ভরে গেছে। আর দিনকে দিন তার উৎপাত বাড়ছে। মিস্টার কুপহুইস হলুদ রঙের গুড়ো প্রত্যেক আনাচেকানাচে ছড়িয়ে দিয়েছেন বটে, কিন্তু উঁশমাছিগুলো সেসব আদৌ গায়ে মাখছে না। এতে আমরা খুবই ঘাবড়ে যাচ্ছি, মনে করা হচ্ছে হাতে পায়ে এবং শরীরের নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যেন বীজকুঁড়ি বীজকুঁড়ি বেরিয়েছে; তার ফলে, আমরা অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানা রকম কসরত করছি যাতে ঘাড় বেঁকিয়ে বা পা উল্টে পেছন দিকটা দেখা যায়। সে রকম নমনীয় নই বলে এখন আমাদের তার দরুণ মাশুল গুনতে হচ্ছে–ঠিক ভাবে এমন কি এদিক ওদিক ফিরতে গেলেও ঘাড়টা শক্ত হয়ে থাকছে। প্রকৃত শরীরচর্চা ঢের আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
তোমার আনা।
.
বুধবার, ৪ আগস্ট, ১৯৪৩
আদরের কিটি, আজ এক বছরের ওপর হয়ে গেল আমরা এই গুপ্তমহলে আছি; আমাদের জীবনের কিছু কিছু বৃত্তান্ত তুমি জানো, কিন্তু কিছু আছে যা একেবারে বর্ণনার অসাধ্য। বলবার মতো এত কিছু রয়েছে, সাধারণ সময়ের থেকে এবং সাধারণ মানুষের জীবনের থেকে সব কিছু এত তফাত। এ সত্ত্বেও, তুমি যাতে আমাদের জীবনগুলো আরেকটু কাছ থেকে দেখতে পাও, তার জন্যে তোমার সামনে আমি আমাদের একটা মামুলি দিনের ছবি থেকে থেকে তুলে ধরতে চাই। আজ আমি সন্ধ্যে আর রাতের কথা দিয়ে শুরু করছি।
সন্ধ্যে ন’টা। ‘গুপ্তমহলে’ শুতে যাওয়ার ব্যবস্থা শুরু হল এবং সব সময়ই এই নিয়ে রীতিমত একটা চব্বর বেঁধে যায়। চেয়ারগুলো এখানে সেখানে দুড়দাড় করে সরানো হয়, বিছানাগুলো টেনে নামানো হয়, কম্বলগুলোর ভাঁজ খোলা হয়, দিনের বেলার জিনিস কোনোটাই আর যেখানকার সেখানে থাকে না। ছোট ডিভানটাতে আমি শুই, দৈর্ঘ্যে সেটা দেড় মিটারের বেশি হবে না। কাজেই লম্বা করার জন্যে তার সঙ্গে একাধিক চেয়ার জড়তে হয়। লেপ, চাদর, বালিশ, কম্বল সমস্তই দিনের বেলায় তোলা থাকে ভুসেলের খাটে; সেখান থেকে সেগুলো এনে নিতে হয়। পাশের ঘরে সাংঘাতিক ক্যাচর-কোচর শব্দ হয়; মারগটের ঐকতানিক খাটটি টেনে বের করা হচ্ছে। কাঠের পাটিগুলো আরেকটু বেশি আরামপ্রদ করার জন্যে আবার ডিভান, কম্বল আর বালিশ বিলকুল ওঠানো নামানো শুরু হয়ে যায়। মনে হয় যেন মাথার ওপর কড় কড় করে মেঘ ডাকছে; তা নয়, আসলে জিনিসটা মিসেস ফান ডানের খাট ছাড়া কিছু না। ওটাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানলার দিকে, বুঝলে, যাতে তরতাজা হাওয়ায় গোলাপী–শোয়ার জামা-পরা মহামান্য রানীসাহেবার সুদর্শন নাসারন্ধ্রে সুড়সুড়ি দেওয়া যায়।
পেটারের হয়ে গেলে আমি গিয়ে ঢুকি কলঘরে; আপাদমস্তক ধোয়ামোছা করি এবং তারপর সাধারণভাবে প্রসাধন করি। কখনও কখনও এমনও হয় (কেবল তেতে-ওঠা সপ্তাহ বা মাসগুলোতে) যে, পানির মধ্যে এটা ক্ষুদে উঁশমাছি পাওয়া গেল। তারপর দাঁত মাজা, চুল কোঁকড়ানো, নখে রং লাগানো এবং হাইড্রোজেন পেরোক্সাইড দেওয়া হয় আমার তুলোর প্যাড পরা (কালো গোঁফের রেখাগুলো সাদা করা) সব আধ ঘণ্টার মধ্যে।
সাড়ে ন’টা। চট করে গায়ে ড্রেসিং গাউন চড়িয়ে, এক হাতে সাবান আর অন্য হাতে মগ, চুলের কাটা, প্যান্ট, চুর কোকড়াবার জিনিস আর তুলোর বাণ্ডিল নিয়ে গোসলখানা থেকে হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ি; কিন্তু সাধারণত যে আমার পরে যায়, তার ডাকে আমাকে একবার ফিরে যেতে হয়। কেননা বেসিনে নানা ধরনের কেশে আঁকাবাঁকা রেখার অলঙ্করণ তার মনঃপূত নয়।
দশটা। সব নিষ্প্রদীপ করো। শুভ রাত্রি! অন্তত মিনিট পনেরো ধরে বিছানাগুলোতে ক্যাচর ক্যাচর শব্দ আর ভাঙা স্প্রিঙের দীর্ঘশ্বাস। তারপর সব চুপচাপ অন্তত যদি আমাদের ওপরতলার প্রতিবেশীরা বিছানায় শুয়ে কোন্দল শুরু করে না দেয়।
সাড়ে এগারোটা। বাথরুমের দরজার ক্যাঁচর ক্যাঁচ আওয়াজ। ঘরের মধ্যে এসে পড়ে সরু এক ফালি আলো। জুতোর মচ্ মচ্ শব্দ, একটা ঢাউস কোট, যে পরে রয়েছে তার চেয়েও বড়–ক্রালারের অফিসে রাতের কাজ সেরে ফিরলেন। দশ মিনিট ধরে মেঝের ওপর পা ঘষে বেড়ানো, কাগজের মুড় মুড় শব্দ (ঠোঙায় করে খাবারদাবার সঞ্চয় করা হবে), এবংতারপর বিছানা পাতা হল। অতঃপর সেই মূর্তিটা আবার উধাও এবং এরপর মাঝে মধ্যে পায়খানায় সন্দেহজনক সব শব্দ হতে শোনা গেল।
তিনটে। টিনের টুকরিতে আমাকে ছোট্ট একটা কাজ সারতে উঠতে হবে। লিক করার ভয়ে টুকরিটা আমার বিছানার তলায় একটা রবারের পাতের ওপর বসানো আছে। যখন এটা সরাতে হয়, আমি সব সময় দম বন্দ করে থাকি, কেননা টিনের গায়ে পাহাড়ের ঝোরার মতো ছ্যার ছ্যার করে সজোরে শব্দ হয়। তারপর টুকরিটা যথাস্থানে এবং সাদা নাইট গাউন পরা মূর্তিটা বিছানায় প্রত্যাবর্তন করে। মারগট আমার এই নাইট গাউনটা দেখলেই রোজ সন্ধ্যেবেলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ইস, আবার সেই অসভ্য রাতের পোশাক!
এরপর একজন নৈশ আওয়াজগুলোর প্রতি কান খাড়া করে মিনিট পনেরোর মতো জেগে থাকে। প্রথমত, নিচের তলা কোনো সিদের-চোর ঢুকেছে কিনা, তারপর ওপরে, পাশের ঘরে এবং আমার ঘরে কোন্ বিছানায় কি রকমের শব্দ হচ্ছে, যা থেকে এটা বোঝা যায় যে, বাড়ির সবাই কে কি রকম ঘুমোচ্ছে, না কেউ রাত্তিরটা জেগে কাটাচ্ছে।
ঘুম-না আসা লোক নিয়ে ভারি জ্বালা। বিশেষ করে তিনি যদি বাড়ির এমন একজন হন যার নাম ডুসেল। প্রথমে মাছের খাবি খাওয়ার মতন একটা আওয়াজ পাই, নয় দশ বার এর পুনরাবৃত্তি হয়, তারপর পরম উৎসাহে, মধ্যে মধ্যে খানিকটা চকচক শব্দ তুলে, জিভ দিয়ে ঠোটগুলোকে ভেজানো হতে থাকে, তারপর অনেকক্ষণ ধরে চলে বিছানায় এপাশ ওপাশ করা এবং বার বার বালিশগুলো ওলটপালট করা। ডাক্তার কিছুক্ষণের জন্যে তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকার পর পাঁচ মিনিটের পূর্ণ বিরতি; ব্যস, তারপর আবার সেই যথাক্রমে আগের পুনরাবৃত্তি শুরু হয় কম করে আরও তিন বার। এমনও হতে পারে যে রাত্তিরে কিছুটা গোলাগুলি চলতে লাগল, রাত একটা থেকে চারটের মধ্যে কোনো একটা সময়ে। অভ্যেসবশে বিছানা ছেড়ে তড়াক করে দাঁড়িয়ে না ওঠা পর্যন্ত আমি সেটা কখনও ঠিক মাথায় নিতে পারি না। কখনও কখনও আমি স্বপ্নে এমন বুদ হয়ে থাকি–তখন আমার মন জুড়ে থাকে ফরাসী ভাষার অনিয়মিত ক্রিয়াগুলো কিংবা ওপরতলার কোনো ঝগড়াঝাটি। ফলে, কামান ফাটছে এবং আমি ঘরের মধ্যে আছি–এ সম্বন্ধে আমার হুঁশ আসতে খানিকটা দেরি হয়। তবে ওপরে যেভাবে বর্ণনা করলাম সেই ভাবেই এটা ঘটে। ঝট করে একটা বালিশ আর রুমাল থাবা দিয়ে তুলে গায়ে ড্রেসিং গাউন আর পায়ে চটি গলিয়ে নিয়ে তড়বড়িয়ে বাপির কাছে ছুটে যাই, মারগট যেভাবে জন্মদিনের কবিতায় লিখেছিল?
গোলার প্রথম আওয়াজ নিশুতি রাত
চুপ, চুপ! দেখ, খুট করে দ্বার খোলে
ছোট্ট একটি মেয়ে ঢোকে সেই সাথে
জড়িয়ে একটি বালিশ নিজের কোলে।
বড় বিছানায় ধপাস করে একবার পড়লে, ব্যস্, আর চিন্তা নেই–যদি গোলাগুলির হাল খুব খারাপ হয়ে না পড়ে।
পৌনে সাতটা। টু ঝু ঝু ঝু অ্যালার্ম ঘড়িতে গলা বের করার কোনো সময় অসময় নেই (কেউ যদি সেটা চায় এবং কখনও কখনও না চাইলেও) আক্ পিং–মিসেস ফান ডান চাবি বন্ধ করে দিলেন। ক্যাচর মিস্টার ফান ডান উঠলেন। পানি ভরে নিয়েই বাথরুমে ভো দৌড়।
সোয়া সাতটা। ক্যাচ শব্দে দরজা আবার খুলে গেল। স্বচ্ছন্দে ডুসেল বাথরুমে যেতে পারেন। একারটি নিজেকে একা পেয়ে আমি নিষ্প্রদীপ উপভোগ করি–আর ততক্ষণে ‘গুপ্তমহলে’ শুরু হয়ে যায় নতুন একটা দিন।
তোমার আনা।
.
বৃহস্পতিবার, ৫ আগস্ট, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
আজ আমি মধ্যাহ্ন ভোজের সময় নেব।
এখন সাড়ে বারোটা। পুরো পাঁচমিশেলী ভিড়টা আবার জান ফিরে পেয়েছে। গুদামের ছোকরাগুলো এখন যে যার বাড়ি ফিরে গেছে। মিসেস ফান ডানের সুন্দর এবং একমাত্র কার্পেটের ওপর তার ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালানোর ধর্ধর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মারগট কয়েকটা বই বগলদাবা করে চলেছে—‘যে ছেলেমেয়েদের কোনো জ্ঞানোন্নতি হয় না’–তাদের ডাচ ভাষার অনুশীলনের জন্যে–কেননা ডুসেলের মনোভাব তাই। পিম্ তার অচ্ছেদ্য ডিকেন্স সঙ্গে নিয়ে কোথাও একটু শান্তিতে বসবার জন্যে একটা কোণে চলে যাচ্ছেন। মা মণি হন্তদন্ত হয়ে ওপরে যাচ্ছেন পরিশ্রমী গিন্নীটিকে সাহায্য করার জন্যে। আর আমি বাথরুমে চলেছি একই সঙ্গে নিজেকে এবং ঘরটাকে সাফসুফ করার জন্যে।
পৌনে একটা। জায়গাটা লোকজনে ভরে উঠছে। প্রথমে মিস্টার ফান সান্টেন তারপর কুপহুইস বা ক্রালার, এলি আর কখনও-সখনও মিও।
একটা। আমরা সবাই পুঁচকে রেডিও সেটটা ঘিরে বসে বি-বি-সি শুনছি; এই হচ্ছে একমাত্র সময় যখন ‘গুপ্ত মহলের লোকেরা একে অন্যের কথার মধ্যে কথা বলে না, কেননা এ সময় এমন একজন বলে যার কথার মধ্যে কথা বলার সাধ্যি এমন কি মিস্টার ফান ডানেরও নেই।
সওয়া একটা। জবর ভাগাভাগি। নিচের লোকেরা প্রত্যেকে পায় এক কাপ করে সুপ এবং যদি কখনও পুডিং থাকে, তাহলে তারও খানিকটা। মিস্টার ফান সাপ্টেন খুশি হয়ে ডিভানে গিয়ে বসেন কিংবা লেখার টেবিলে হেলান দেন। ওঁর সঙ্গে থাকে খবরের কাগজ, কাপ আর সাধারণত বেড়াল। উনি যদি দেখেন তিনটির একটি নেই, তাহলেই গাঁইগুই করতে শুরু করে দেবেন। কুপহুইস বলেন শহরের হালফিল খবর, ওর কাছ থেকে সত্যি অনেক কিছু জানতে পারা যায়। ক্রালার হুড়মুড়িয়ে ওপরে চলে এসে আস্তে ঠক করে দরজায় শব্দ করেন এবং হাত কচলাতে কচলাতে ভেতরে ঢোকেন। যেদিন মন ভালো থাকে সেদিন খোশমেজাজে খুব বকবক করেন, নইলে তিরিক্ষি মেজাজে মুখে কুলুপ এটে বসে থাকেন।
পৌনে দুটো। সবাই টেবিল ছেড়ে উঠে যে যার কাজে চলে যায়। মারগট আর মা-মণি এঁটো বাসন তোলেন। মিস্টার আর মিসেস ফান ডান ওঁদের ডিভানে গিয়ে বসেন। পেটার যায় চিলেকোটায়। বাপি নিচের তলার ডিভানে। ডুসেল গিয়ে বিছানায় লম্বা হল আর আনা তার কাজে বসে। এর পরেকার সময়টা সবচেয়ে শান্তিতে কাটে; কারো কোনো ঝামেলা থাকে না। ডুসেল উপাদেয় খাবারদাবারের স্বপ্ন দেখেন–ওঁর মুখের ভাবভঙ্গিতে সেটা ধরা পড়ে, কিন্তু উর্ধ্বশ্বাসে সময় চলে যায় বলে আমি বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে পারি না। এরপর চারটের সময় ঘড়ি হাতে নিয়ে দিগগজ ডাক্তারটি দাঁড়িয়ে থাকেন, কেননা ওঁকে টেবিল খালি করে দিতে একটি মিনিট আমার দেরি হয়ে গেছে।
তোমার আনা।
.
সোমবার, ৯ আগস্ট, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
‘গুপ্ত মহলে’র দৈনিক নির্ঘণ্টের পূর্বানুবৃত্তি চলেছে। এবার আমি বর্ণনা করব সান্ধ্যভোজ।
মিস্টার ফান ডান আরম্ভ করেন। দিতে হবে তাকেই প্রথমে; তার যা যা পছন্দ তিনি তা নেবেন প্রচুর পরিমাণে। সাধারণত খেতে খেতে কথা বলেন, এমন ভাবে মতামত দেন যেন একমাত্র তার কথাই শোনবার যোগ্য, যেন তিনি যখন বলেছেন তখন আর তার কথার ওপর কোনো কথাই চলে না। যদি কেউ কোনো প্রশ্ন তোলার ধৃষ্টতা দেখায়, তাহলে উনি তৎক্ষণাৎ রেগে অগ্নিশর্মা হবেন। বেড়ালের মতন, ওঃ, উনি কী ফ্যা ফ্যা করতে পারেন–আমি তোমাকে বলছি, আমি বাপু ওঁর সঙ্গে তর্ক করতে যাব না–একবার যে সে চেষ্টা করেছে, দ্বিতীয়বার আর সে তা করবে না। ওর হল জলখ কথার এক কথা, উনি হলেন প্রায় সবজান্তা। আচ্ছা, না হয় মেনে নিলাম ওঁর মাথা আছে, কিন্তু তুঙ্গ স্পর্শ করেছে ভদ্রলোকের আত্মপ্রসাদ’।
শ্ৰীমতী। সত্যি বলতে, আমার নীরব থাকাই উচিত। বিশেষত যদি মেজাজ খিছড়ে যেতে থাকে, তাহলে কোনো কোনো দিন ওঁর মুখের দিকে তুমি তাকাতেই পারবে না। একটু খুঁটিয়ে দেখলে ধরা যায় সব বাদানুবাদে উনিই নাটের গুরু। বিষয়টা নয়। না, না। ও ব্যাপারে প্রত্যেকেই একটু সরে থাকতে চায়, তবে ওঁর সম্বন্ধে বোধ হয় বলা যায় যে, উনিই ‘উস্কানিদাতা’। গোলমাল পাকিয়ে দেওয়া, কী মজা। আনার সঙ্গে মিসেস ফ্রাঙ্কের; বাপির সঙ্গে মারগটকে লাগিয়ে দেওয়ার কাজটা তত সহজ হয় না।
কিন্তু খাবার টেবিলে মিসেস ফান ডান একবার বসলে হল, ওঁর অল্পে হয় না। যদিও মাঝে মধ্যে উনি তাই মনে করে থাকেন। সবচেয়ে কুচো আলু, যেটা সবচেয়ে মিষ্টি সেটা গালভর্তি, সবকিছুর সেরা জিনিস; হুমড়ি খেয়ে পড়ে তুলে নেওয়া ওঁর নিয়ম। অন্যরা নিজেদের পালা আসার জন্যে অপেক্ষা করুক, আমি তো সেরা জিনিসগুলো নিয়ে নিই। তারপর বকবক বক। কারো আগ্রহ থাক বা না থাক, কেউ শুনুক বা না শুনুক–তাতে ওঁর কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। আমার ধারণা, উনি মনে করেন, মিসেস ফান ডান যাই বলবেন সবাই আগ্রহভরে শুনবে।’ ঢলানিমার্কা হাসি, চালচলনে সবজান্তার ভাব, সবাইকে একটু করে উপদেশ আর পিঠ চাপড়ানি–নির্ঘাত এ সমস্তই উনি করেন অন্যের কাছে নিজেকে তোলার জন্যে। কিন্তু ঠায় একটু চেয়ে থাকলেই ওঁর স্বরূপ ধরা পড়ে।
এক, ভদ্রমহিলা পরিশ্রমী, দুই হাসিখুশি, তিন ছেনাল এবং কখনও-সখনও সুচ্ছিরি। ইনিই হলেন পেট্রোনেলা ফান ডান।
খাওয়ার টেবিলের তৃতীয় সাথীটি। ওকে তেমন টা ফো করতে শোনা যায় না। তরুণ শ্ৰীমান ফান ডান খুব চুপচাপ এবং ওর দিকে কারো বড় একটা দৃষ্টি পড়ে না। ওর ক্ষিধের কথা বলতে গেলে : সেটা যেন (গ্রীক পুরানের) দেনাইদিনের সেই পাত্র, যা কখনই ভর্তি হয় না। চর্বচোষ্য করে ভরপেট খাওয়ার পরও অম্লানবদনে সে বলবে আবার দিলে আবারও সে খেতে পারে।
চার নম্বর–মারগট। নেংটি ইঁদুরের মতন কুট কুট করে খায় এবং কোনো রা কাড়ে। গলা দিয়ে একমাত্র যায় তরিতরকারি আর ফলমূল। ফান ডানদের বিচারে ‘মাথা খাওয়া’; আমাদের মতে, যথেষ্ট খোলা হাওয়া এবং খেলাধুলোর অভাব।
সে বাদে–মা-মণি। ক্ষিধের সঙ্গে খান, বড় বেশি কথা বলেন। মিসেস ফান ডান যেমন, তেমন কারো মনেই হয় না; ইনিই হলেন গৃহকত্রী। তফাতটা কোথায়? তফাত হল গিয়ে মিসেস ফান ডান করেন রান্না, আর মা-মণি করেন মাজাঘষা।
নম্বর ছয় আর সাত। বাপি আর আমার সম্বন্ধে বেশি কিছু বলব না। প্রথমোক্ত জন। হলেন খাওয়ার টেবিলে সবচেয়ে সাদাসিধে মানুষ। তিনি আগে দেখে নেন সবাই কিছু কিছু করে পেয়েছে কিনা। তার নিজের কিছু না পেলেও চলে, কেননা সেরা জিনিসগুলো পাবে ছোটরা। উনি হলেন এমন দৃষ্টান্ত যার কোনো ঘাট নেই।
ওঁর পাশে ‘গুপ্ত মহলে’র ‘বদমেজাজী’ ডাক্তার ডুসেল। নিতে কার্পণ্য করেন না। বিনাবাক্যে ঘাড় গুঁজে খেয়ে যান। কেউ মুখ খুললে, দোহাই, কেবল খাওয়ার কথা হোক। এ নিয়ে কে আর কোন্দল করে, করে শুধু বাফাট্টাই। ভদ্রলোক নেন কজি ডুবিয়ে, খেতে ভালো হলে কখনই আর ‘না’ বলেন না, খারাপ হলে বলেন মাঝে মধ্যে। বুকের কাছে টানা ট্রাউজার, লাল কোট, শোবার ঘরের কালো চটি আর শিঙের তৈরি চশমার ফ্রেম। ছোট্ট টেবিলটাতে ওঁর এই চেহারাটা চোখে ভাসে–সব সময় কাজ করছেন, তারই ফাঁকে ফাঁকে। দিবান্দ্রিা, খাওয়ার পর্ব, আর-তার প্রিয় জায়গা পায়খানা। দিনে তিন, চার, পাঁচবার দোরগোড়ায় অস্থির হয়ে দাঁড়ানো, একবার এ-পায়ে একবার ও-পায়ে ভর দিয়ে এমন ভাবে শরীরটাকে দোমড়ানো মোচড়ানো যে বোঝাই যায় আর সামলানো যাচ্ছে না। তাতে কি উনি অতিষ্ঠ হন? একটুও না! সওয়া সাতটা থেকে সাড়ে সাতটা, সাড়ে বারোটা থেকে একটা, দুটো থেকে সওয়া দুটো, চারটে থেকে সওয়া চারটে, ছটা থেকে সওয়া ছটা, সাড়ে এগারোটা থেকে বারোটা। সময়গুলো মনে করে রেখে দেওয়া ভালো–এগুলো হল রোজকার ‘বৈঠকী সময়। দরজায় যদি আসন্ন বিপদের জানান-দেওয়া, কাতর কণ্ঠস্বর শোনা যায়! ওঁর ভারি বয়েই গেছে বেরিয়ে আসতে কিংবা তাতে কান দিতে।
নয় নম্বরটি গুপ্ত মহলের পরিবারভুক্ত নন, কিন্তু এ বাড়ির এবং খাওয়ার টেবিলের সঙ্গীসাথী। এলির রয়েছে সুস্থ সবল মানুষের ক্ষিধে। ওঁর প্লেটে কিছু পড়ে থাকে না এবং ওঁর ওটা খাব না সেটা খাব না নেই। একটুতেই এলি সন্তুষ্ট হন এবং ঠিক সেই কারণেই আমরা আনন্দ পাই। সদাপ্রফুল্ল এবং ঠাণ্ডা মেজাজ কোনো কিছুতে ‘না’ বলা নেই এবং ভালো মানুষ–এই সব ওঁর চরিত্রের গুণ।
তোমার আনা।
.
মঙ্গলবার, ১০ আগস্ট, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
নতুন মতলব মাথায় এসেছে। খাওয়ার সময় অন্যদের সঙ্গে কম কথা বলি, বেশি বলি নিজের সঙ্গে। দুটো কারণে এটা প্রশস্ত। প্রথমত, সারাক্ষণ আমি মুখে খই না ফোঁটালে সবাই খুশি হয়, এবং দ্বিতীয়ত, অন্যেরা কী বলে না বলে তা নিয়ে আমার বিরক্ত হওয়া উচিত নয়। আমি মনে করি না, আমি বোকার মতন ফোড়ন কাটি; অন্যেরা মনে করে। সুতরাং আমার কথা আমার মনে মনে রাখাই ভালো। আমি একই জিনিস করি যখন আমাকে এমন কিছু খেতে হয় যা আমার দু’চক্ষের বিষ। আমি প্লেটটা আমার সামনে রেখে খাবারটা যেন অতি উপাদেয় এইভাবে মনকে চোখ ঠারি, পারতপক্ষে সেদিকে তাকাই না বললেই হয়, এবং কোথায় আছি সে সম্বন্ধে হুশ হওয়ার আগেই জিনিসটা লোপাট হয়। আরেকটা খুব বিচ্ছিরি প্রক্রিয়া হল সকালে ওঠা। বিছানা থেকে পা ছুঁড়ে উঠে পড়তে পড়তে নিজের মনে বলি–‘আসছি, এক সেকেণ্ড’–বলে জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়ে নিষ্প্রদীপের গ্রন্থি খুলি, জানলার ফাঁকে নাক লাগিয়ে থেকে কিছুক্ষণ পরে খানিকটা তাজা হাওয়ার অনুভুতি পাই, তখন আমি জেগে যাই। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি বিছানাটা তুলে ফেললে ঘুমোবার প্রলোভন চলে যায়। এই ধরনের জিনিসকে মা-মণি কী বলেন জানো? বাচার কলাকৌশল’। কথাটা যেন কেমন কেমন। গত হপ্তায় সময়ের ব্যাপারে আমরা সবাই কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি। তার কারণ, আমাদের বড় আদরের ভেস্টারটোরেন ঘণ্টা-বাজা ঘড়িটা বাহ্যত যুদ্ধের প্রয়োজনে নিয়ে চলে গেছে। ফলে, দিনে বা রাত্রে ঠিক কটা বাজল আমরা জানতে পারি না। আমি এখনও কিছুটা আশা করছি যে, ওঁরা ওর একটা বদলির (টিনের তামার বা ঐ ধরনের কিছুতে তৈরি) কথা ভাববেন যা ঐ বড় ঘড়িটাকে কতকটা মনে পড়িয়ে দেবে।
ওপর তলায় বা নিচের তলায়, যখন যেখানেই থাকি, আমার পায়ের দিকে সবাই হাঁ করে চেয়ে থাকে, আমার পায়ে একজোড়া অসাধারণ ভালো জুতো (আজকালকার কথা ভাবলে) চকচক করতে থাকে। দ্রাহ্মাসবের রং দেওয়া সুয়েড-লেদারে তৈরি, বেশ উঁচু হিতোলা এই জুতোজোড়া মিপ কোথা থেকে যেন ২৭.৫০ ফ্লোরিনে কিনে এনেছিলেন। পরলে রণপায় দাঁড়িয়েছি বলে মনে হয়। এবং আমাকে অনেক বেশি ঢ্যাঙা দেখায়।
ডুসেল পরোক্ষে আমাদের জীবন বিপন্ন করে তুলেছেন। আসলে মুসোলিনি আর হিটলারকে গালাগাল দেওয়া একটা নিষিদ্ধ বই উনি মিকে আনতে দেন। আসবার সময় ঝটিকা বাহিনীর একটি গাড়ি মিপের প্রায় ঘাড়ে এসে পড়েছিল। মিপ্ চটে গিয়ে বলে ওঠেন, হতভাগা নচ্ছার কাহাকা।’ বলে সাইকেল চালিয়ে দেন। ওঁকে যদি ওদের সদর দপ্তরে পাকড়াও করে নিয়ে যেত তাহলে যে কী হত সে কথা না ভাবাই ভালো।
তোমার আনা!
.
বুধবার, ১৮ আগস্ট, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
এই লেখাটার শিরোনাম হল : ‘আজকের যৌথ কর্তব্য–আলু ছোলা।’
একজন খবরের কাগজ আনে, আরেকজন ছুরি (অবশ্যই, সেরা ছুরিটা সে নিজে নেয়), তৃতীয়জন আনে আলু আর চতুর্থজন এক ডেকচি পানি।
শুরু করেন মিস্টার ডুসেল, সব সময় ওঁর ছোলা ভালো হয় না, তবু ডাইনে বাঁয়ে তাকিয়ে অনবরত ছুলে যান। সবাই কি ওঁর পন্থা অনুসরণ করে? উঁহু! এই আনা, এদিকে তাকাও; এইভাবে আমি ছুরিটা ধরছি, তারপর ওপর থেকে নিচের দিকে ছুলছি! উঁহু, ওভাবে নয়-এই ভাবে!’
আমি আমতা আমতা করে বলি, ‘মিস্টার ডুসেল, এইভাবে আমার ভালো হয়!’
‘তাহলেও, সবচেয়ে ভালো হয় এইভাবে। তবে তোমার দ্বারা এটা হবে না। স্বভাবতই ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। করতে করতে এটা তোমার জানা হবে।’ আমরা ছুলে চলি। আমার পাশের লোকের দিকে আমি আড়চোখে তাকাই। উনি কী যেন ভাববে ভাবতে আরেকবার মাথা নাড়ান (বোধ হয়, আমাকে মনে করে), কিন্তু রা কাড়েন না।
আমি আবার দুলতে থাকি, বাপি যে দিকটাতে বসে আছেন, এবার আমি সেইমুখো তাকাই। ওঁর কাছে আলু ছোলার ব্যাপারটা নেহাত একটা নগণ্য কাজ নয়, এটা রীতিমত একটা সূক্ষ্ম কাজ। বাপি যখন বই পড়েন, ওঁর মাথার পেছন দিকের চামড়ায় গভীর টোল পড়ে, কিন্তু আলু, বিন্ আর অন্যান্য তরিতরকারি কাটাকুটো করবার সময় মনে হয় ওঁর মাথায় আর কিছু ঢোকে না। তখন উনি পরে নেন ‘আলুর মুখচ্ছবি এবং নিখুঁত ভাবে না। ছুলে কোনো আলু কিছুতেই উনি হাতছাড়া করবেন না; একবার ঐ মুখচ্ছবি ধারণ করলে সে প্রশ্নই আর ওঠে না।
তারপর আবার কাজ করতে করতে এক মুহূর্তের জন্যে একবার মুখ তুলি; ঘটনাটা আমার বিলক্ষণ জানা, মিসেস ফান ডান চেষ্টা করছেন ডুসেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। প্রথমে উনি ভুসেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন, ডুসেল সেটা খেয়াল করেন বলে বোধ হয় না। এরপর চোখের ইশারা করেন; ডুসেল ঘাড় গুঁজে কাজ করে যান। তখন উনি হাসতে থাকেন, ডুসেল। মুখ তোলেন না। এরপর মা-মনিও হাসতে থাকেন; ডুসেল গ্রাহ্য করেন না। মিসেস ফান ডান কিছু করতে না পেরে, তখন অন্য উপায় অবলম্বন করার কথা ভাবলেন। খানিক চুপ করে থেকে তারপর বললেন : পুড়ি, একটা অ্যাপ্রন জড়িয়ে নাও না। নইলে কাল তোমার স্যুট থেকে ঘষে ঘষে সব দাগ আমাকে তুলতে হবে।’
‘আমি মোটেই স্যুট নোংরা করছি না!’
আরেক মুহূর্ত সব চুপচাপ।
‘পুট্টি, তুমি বসছ না কেন?’
দাঁড়িয়ে থেকে আমি আরাম পাচ্ছি। এই বেশ ভালো। চুপ।
‘পুট্টি ডু স্পাটস্টশন! (পিণ্ডি পাকাচ্ছ!’)।
‘আমার খেয়াল আছে গো, খেয়াল আছে।’
মিসেস ফান ডান বিষয়াত্তর খোঁজেন। ‘আচ্ছা, পুট্টি, বলো তো ইদানীং ইংরেজদের হাওয়াই হামলা নেই কেন?’
‘আবহাওয়া এখন সুবিধের নয় বলে।‘
‘কালকের দিনটা তো চমৎকার ছিল, কই ওদের প্লেন তো এল না।‘
‘ওসব নিয়ে কথা না বলাই ভালো।‘
‘কেন, আলবৎ বলব। আমরা আমাদের মতো বলতে পারি।’
‘কেন নয়?’
‘চুপ করে থাকো।’
‘মিস্টার ফ্রাঙ্ক সব সময় ওঁর স্ত্রীর প্রশ্নের উত্তর দেন। কী, দেন না?’
মিস্টার ফান ডান নিজের সঙ্গে লড়েন। এটা তার ব্যথার জায়গা, এটা এমন জিনিস যা তাঁর সহ্যের বাইরে এবং মিসেস ফান ডান আবার শুরু করেন—‘মনে হচ্ছে স্থলাভিযান কোনোদিনই হবে না!’
মিস্টার ফান ডান সাদা হয়ে গেলেন; সেটা লক্ষ্য করে মিসেস ফান ডান লাল হয়ে গিয়ে আবার বলে চললেন: ‘বৃটিশরা কচু করছে।’ ব্যস্, বোমা ফাটল!
‘আর একটা কথা নয়, ডনারভেটার-নখ-আইনমাল!’ (‘কালবোশেখি আবার!’)
মা-মণি আর হাসি চাপতে পারেন না। আমি সোজা সামনের দিকে তাকাই।
প্রায় রোজই এই এক ধরনের ঘটনা। ওঁদের মধ্যে খুব একচোট ঝগড়া হয়ে গেলে অবশ্য এর ব্যতিক্রম হয়। কেননা তখন দুজনেই মুখ বন্ধ করে থাকেন।
আমাকে চিলেকোঠায় উঠে গিয়ে কিছু আলু নিয়ে আসতে হয়। পেটার বেড়ালের উকুন বেছে দিচ্ছিল। পেটার মুখ তুলে তাকাতেই বেড়ালটার নজরে পড়ে–হু–খোলা জানালা দিয়ে সোজা সে নালীর মধ্যে উধাও হয়। পেটার এই মারে তো সেই মারে। আমি হো হো করে সটকে পড়ি।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
মালখানার লোকেরা ঠিক সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি চলে যায়। তারপর আমরা ঝাড়া হাত পা।
সাড়ে পাঁচটা। এলি এসে আমাদের অর্পণ করেন সান্ধ্য স্বাধীনতা। সঙ্গে সঙ্গে আমরা আমাদের কাজকর্মে লেগে পড়ি। প্রথমে এলির সঙ্গে আমি ওপরতলায় যাই, এলি সাধারণত আমাদের দ্বিতীয় ক্রমের খাবার থেকে নিয়ে চাখতে শুরু করে দেন।
এলি বসবার আগইে মিসেস ফান ডান ভেবে ভেবে বের করতে থাকেন কী কী জিনিস তার চাই। সে সব প্রকাশ হতে দেরি হয় না; ‘দেখ, এলি, আমার একটা ছোট্ট জিনিস চাই…।’ এলি আমাকে চোখ টেপে; ওপরে যেই আসুক, মিসেস ফান ডান কাউকে কখনও বলতে ছাড়েন না যে তার কোন্ জিনিসটা চাই। লোকজনেরা যে ওপরতলায় আসতে চায় না এটা নিশ্চয় তার একটা কারণ।
পৌনে ছটা। এলি বিদায় নেন। দু’তলার সিঁড়ি ভেঙে নিচে গিয়ে আমি একবার চারদিক দেখে আসি। প্রথমে রান্নাঘরে, তারপর অফিসের খাস কামরায়, এরপর মুশ্চির জন্যে কল আঁটা দরজাটা খুলতে কয়লার গর্তে। বেশ অনেকক্ষণ ধরে সবকিছু দেখাশুনো করার পর শেষে গেলাম কালারের কামরায়। ফান ডান ড্রয়ার আর পোর্টফোলিওগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছিলেন আজকের কোনো ডাক আছে কিনা। পেটার গেছে মালখানার চাবি আর বোখাকে আনতে; পিম্ টাইপরাইটারগুলো টেনে টেনে ওপরে তুলছেন; মারগট একটা নিরিবিলি। জায়গা খুঁজছে যাতে সে তার অফিসের কাজগুলো করতে পারে; মিসেস ফান ডান গ্যাসের উনূনে কেটলি চাপাচ্ছেন; মা-মণি আলুর ডেকচি নিয়ে নিচে নেমে আসছেন; প্রত্যেকেই জানে কার কী কাজ।
পেটার একটু বাদেই মালখানা থেকে ফিরে এল। প্রথম সওয়াল হল-রুটি। রান্নাঘরের আলমারিতে সব সময়ই রুটি রাখেন মহিলারা; কিন্তু সেখানে নেই। রাখতে ভুলে গেছেন। ওরা? পেটার সদর দপ্তরের খোঁজ করতে চাইল। যাতে বাইরে থেকে দেখা না যায় তার জন্য। নিজেকে গুটিয়ে যথাসম্ভব ছোট করে দরজার সামনে সে গুটিসুটি মেরে বসে হাতে আর হাঁটুতে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলল স্টীলের আলমারির দিকে; রুটি সেখানেই রাখা ছিল; রুটিটা হস্তগত করে পেটার হাওয়া হল; অন্তত, সে চেয়েছে হাওয়া হয়ে যেতে, কিন্তু ঘটনাটা ভালোরকম মালুম হওয়ার আগেই মুশ্চি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সোজা গিয়ে গাট হয়ে বসেছে লেখার টেবিলের তলায়।
পেটার ফ্যাল ফ্যাল করে এদিক ওদিক তাকায়–এইও, মুশ্চিকে দেখতে পেয়ে, আবার হামাগুড়ি দিয়ে অফিসে ঢুকে গিয়ে মুশ্চির ল্যাজ ধরে টানতে থাকে। মুশ্চি ফঁাচ ফ্যাচ করে, পেটার ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু তাতে ফল কী দাঁড়াল? মুশ্চি এবার জানলার পাশে উঠে বসে পেটারের হাত এড়াতে পেরে মহাসুখে গা চাটছে। পেটার ওকে ভজাবার জন্যে বেড়ালটার নাকের নিচে একখণ্ড রুটি ধরে শেষ চেষ্টা দেখছে। মুশ্চি ওতে ভুলবে না, দরজা
বন্ধ হয়ে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে আমি আগাগোড়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। আমরা বসে নেই। খুট, খুট, খুট। দরজায় তিনটে শব্দ মানে খাবার দেওয়া হয়েছে।
তোমার আনা।
.
মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ১৯৪৩
আদরের কিটি
‘ুহপ্ত মহলে’র দৈনিক নির্ঘণ্টের বাকি কিস্তি। ঘড়িতে সকাল সাড়ে আটটা বাজলেই মারগট আর মা-মণি ছটফট করতে থাকেন, চুপ, চুপ…বাপি, আস্তে অটো, চুপ…পিম।‘ ‘সাড়ে আটটা বাজে, এদিকে চলে এসো, এখন আর পানির কল খোলা চলবে না; পা টিপে টিপে চলে এসো।‘ বাথরুমে বাপিকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে এমনি সব অনুশাসন দেওয়া হতে থাকে। ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজা মাত্র তাঁকে বসবার ঘরে হাজির হতে হবে। কলে এক ফোঁটাও পানি পড়বে না, কেউ পায়খানায় যাবে না, পায়চারি করা চলবে না, কোথাও কোনো টু শব্দ হবে না। অফিসে যতক্ষণ লোকজন না থাকে, মালখানায় সব কিছু শ্রুতিগোচর হয়। আটটা বেজে কুড়ি মিনিট হলে ওপরতলার দরজা খুলে যায় এবং তার কিছুক্ষণ পরেই মেঝের ওপর টুক টুক্ করে তিনবার আওয়াজ হয়–আনার পরিজ। আমি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আমার কুকুরছানা’র প্লেটটা হস্তগত করি। তারপর আবার একছুটে আমার ঘরে। সব কিছুই করা হয় প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে। চুল আঁচড়ে নিই, আমার আওয়াজ করা টিনের টুকরিটা সরিয়ে ফেলি, বিছানাটা যথাস্থানে রাখি। এই চুপ, ঘড়িতে ঘণ্টা বাজছে! ওপর তলায় মিসেস ফান ডান জুতো খুলে ফেলে বেডরুম স্লিপারে পা গলাচ্ছেন। মিস্টার ফান ডানও তাই করছেন; চারিদিক নিস্তব্ধ। এতক্ষণে আমরা ফিরে পাচ্ছি একটুখানি সত্যিকার পারিবারিক জীবন। আমি এখন পড়াশুনো করতে চাই। মারগটও চায়, আর সেই সঙ্গে চান বাপি আর মা-মণি। ঝুলে পড়া, ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করা খাটের একপ্রান্তে বসে বাপি (হাতে চিরাচরিত ডিকন্স আর অভিধান); একটু ভদ্রগোছের গদিও তাতে নেই; ওপর নিচে দুটো পাশ-বালিশ জোড়া দিলেও কাজ চলে যায়, বাপি তখন ভাবেন : ‘কাজ নেই ওসবে, এমনিতেই আমি চালিয়ে নেব।’
বাপি যখন পড়েন, মুখ তোলেন না, এদিক ওদিক তাকানও না। থেকে থেকে হাসেন আর তখন বিস্তর চেষ্টা করে কোনো একটা ছোট্ট গল্পে মা-মণির আগ্রহ জাগাতে। উত্তর পান–’আমার এখন সময় নেই। বাপি এক সেকেও একটু দমে যান, তারপর আবার পড়তে থাকেন; খানিক পরে, যখন বাড়তি মজাদার কিছু পান, তখন আবার চেষ্টা করেন : এই জায়গাটা তোমার পড়া উচিত, মা-মণি।’ মা-মণি ‘ওপক্লাপ’ (ওলন্দাজদের এক ধরনের খাট, সামনে পর্দা খাঁটিয়ে দেয়ালে ভাজ করে রাখলে বুককেসের মতন দেখায়) চৌকিতে বসে বসে যখন যেমন ইচ্ছে বইপত্র পড়েন, সেলাই করেন, বোনেন অথবা কাজ করেন। তখন হঠাৎ একটা কিছু তার মনে পড়ে যায়। তড়বড় করে বলে ওঠেন : ‘আনা, তুই জানিস…মারগট, লিখে নে…!’ খানিক পরে আবার সব মিটমাট হয়ে যায়।
মারগট ফটাস করে তার বই বন্ধ করে। বাপি তার ভুরুজোড়া তুলে অদ্ভুত ভাবে বাকান, তার চোখ কুঁচকে পড়বার ধরনটা আবার স্পষ্ট হয় এবং আবার একবার তিনি বইয়ের মধ্যে ডুবে যান; মা-মনি মারগটের সঙ্গে বকবক করতে থাকেন, আমিও কান খাড়া করে। শুনি। পিম্ সেই আলোচনায় ভিড়ে যান…ঘড়িতে নটা। প্রাতরাশ এখন।
তোমার আনা?
.
শুক্রবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি, যখনই আমি তোমাকে লিখতে বসি, যেন একটা বিশেষ কিছু ঘটে, কিন্তু ঘটনাগুলো প্রীতিকর হওয়ার বদলে প্রায়ই অপ্রীতিকর হয়। যাই হোক, এখন অবিশ্বাস্য কিছু ঘটছে। গত বুধবার সন্ধেবেলায়, ৮ই সেপ্টেম্বর, আমরা গোল হয়ে বসে সাতটার খবর শুনছিলাম। প্রথম খবরই হল : ‘সারা যুদ্ধের সেরা খবর শুনুন এবার। ইতালি আত্মসমর্পণ করেছে।’ ইংলণ্ড থেকে ডাচ ভাষায় খবর শুরু হল সওয়া আটটায়। শ্রোতাবৃন্দ এক ঘণ্টা আগে আজকের ঘটনাপঞ্জি লেখা যখন সবে শেষ করেছি, সেই সময় ইতালির আত্মসমর্পণের অবিশ্বাস্য খবরটা এসে পৌঁছোয়। বিশ্বাস করুন, লেখা নোটগুলো বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিতে এত আনন্দ এর আগে কখনও পাইনি। গড সেভ দি কিং’, আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত এবং ইন্টারন্যাশনাল’ বাজানো হল। বরাবরের মতই ডাচভাষার প্রোগ্রামটা ছিল মন-চাঙ্গা-করা, কিন্তু খুব একটা আশাবাদী নয়।
আমাদের মুশকিলও আছে বেশ; মুশকিলটা মিস্টার কুপহুইসকে নিয়ে। তুমি জানো উনি আমাদের খুব প্রিয়জন; সবসময় ওঁর মুখে হাসি এবং আশ্চর্যরকমের সাহসী মানুষ, যদিও কখনই ওঁর শরীর ভালো নয়, নিদারুণ যন্ত্রণা পান, ওর পেট ভরে, খাওয়া আর বেশি হাঁটাচলা করা বারণ। মা-মনি কদিন আগে খুব খাঁটি কথাই বলেছিলেন, ‘মিস্টার কুপহুইস ঘরে পা দিলে, রোদ হেসে ওঠে।’ ওঁকে এখন হাসপাতালে যেতে হয়েছে। তলপেটে একটা খুব বিচ্ছিরি ধরনের অস্ত্রোপচারের জন্যে। অন্তত চার সপ্তাহ তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হবে। তুমি যদি দেখতে কি রকম আটপৌরে ভাবে উনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন–যেন কিছুই নয়, যেন উনি একটু কোনাকাটা করতে বেরোচ্ছেন।
তোমার আনা।
.
বৃহস্পতিবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
আমাদের ভেতরকার সম্পর্ক দিন দিন আরও খারাপ আকার ধারণ করেছে। খেতে বসে কেউ মুখ খুলতে (খাবারের গ্রাস তোলা ছাড়া) সাহস পায় না, পাছে কিছু বললেই কারো গায়ে লাগে কিংবা কেউ উল্টো বোঝে। দুশ্চিন্তা এবং মানসিক অবসাদ থেকে বাচার জন্যে আমি ভালেরিয়ান পিল্ গিলছি, কিন্তু তাতে পরের দিন আমার অবস্থা আরও শোচনীয় হওয়া আটকাচ্ছে না। দশটা ভালেরিয়ান পিল্ খাওয়ার চেয়েও বেশি কাজ হত প্রাণ খুলে একবার হাসতে পারলে কিন্তু আমরা যে ভুলেই গিয়েছি কেমন করে হাসতে হয়। মাঝে মাঝে আমার ভয় হয় যে, অত গুরুগম্ভীর হয়ে থাকতে থাকতে আমার মুখচ্ছবি হয়ত পঁাচার মত হয়ে মুখের দুটো কোণ ঝুলে যাবে। অন্যদেরও গতিক তেমন সুবিধের নয়, শীত হলে সেই মহা বিভীষিকা যার দিকে প্রত্যেকেই সভয়ে আর সংশয়িত চিত্তে তাকায়। আরেকটি জিনিসও আমাদের আদৌ খুশি করছে না–সেটা হল এই যে, মালখানদার ফ.ম. ‘গুপ্ত মহল’ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উঠেছে। ফ.ম. এ বিষয়ে কী ভাবছে না ভাবছে তা নিয়ে আমরা প্রকৃতপক্ষে মাথাই ঘামাতাম না যদি লোকটা অত বেশি ছেক-ছোক না করতো, যদি ওর চোখে ধুলো দেওয়া শক্ত না হত, আর তাছাড়া, ও এমন যে ওকে বিশ্বাস করা যায় না। একদিন ক্রালার চাইলেন একটু বেশি রকম সাবধান হতে; একটা বাজার দশ মিনিট আগে কোট গায়ে দিয়ে উনি মোড়ের কাছে ওষুধের দোকানে গেলেন। পাঁচ মিনিটও হয়নি, উনি ফিরে এসে চোরের মত গুটিসুটি মেরে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে সোজা আমাদের ডেরায় চলে এলেন। সওয়া একটার সময় উনি যখন ঠিক করলেন ফিরে যাবেন, তখন এলি এসে ওঁকে এই বলে হুঁশিয়ার করে দিলেন যে, ফ.ম. তখনও অফিসে রয়েছে। ক্রালার আর ও-মুখো না হয়ে আমাদের সঙ্গে দেড়টা অবধি বসে কাটালেন। তারপর জুতোজোড়া খুলে ফেরে মোজা-পরা পায়ে চিলেকোঠার দরজার মুখে গিয়ে ধাপে ধাপে নিচের তলায় নেমে গেলেন; সেখানে যাতে ক্যাচ ক্যাচ শব্দ না হয় তার জন্যে পনেরো মিনিট ধরে তাল সামলে ক্রালার বাইরের দিক থেকে ঢুকে নির্বিঘ্নে অফিস-ঘরে অবতরণ করলেন। ইতিমধ্যে ফ.ম.-কে কাটিয়ে এলি আমাদের ডেরায় উঠে এলেন ক্রালারকে নিয়ে যেতে। কিন্তু ক্রালার তার ঢের আগেই চলে গেলেন; তখনও তিনি খালি পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন। রাস্তার লোকে যদি দেখত ম্যানেজার সায়েব বাইরে দাঁড়িয়ে জুতো পরছেন, তাহলে কী ধারনা হত তাদের শুধু মোজা পায়ে ম্যানেজার সায়েব!
তোমার আনা।
.
বুধবার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
আজ মিসেস ফান ডানের জন্মদিন। আমরা ওঁকে জ্যাম দিয়েছি এক পাত্র, সেই সঙ্গে পনির, মাংস আর রুটির কুপন। ওঁর স্বামী, ডুসেল আর আমাদের ত্রাণকর্তাদের কাছ থেকে উনি পেয়েছেন নানা খাবারদাবার আর ফুল। এমনই এক সময়ে আমরা বাস করছি।
এই সপ্তাহে এলির মেজাজ ঠিক থাকে নি; দ্যাখ-না-দ্যাখ ভাঁকে বাইরে পাঠানো হয়েছে; বার বার তাঁকে বলা হয়েছে দৌড়ে গিয়ে এই জিনিসটা আনো, যার মানে বাড়তি ফরমাশ খাটা অথবা প্রকারান্তরে বলা যে এটা এলির ভুল হয়েছে। নিচের তলায় অফিসের কাজ পড়ে আছে এলিকে সেসব সারতে হবে, কুপহুইস অসুস্থ, ঠাণ্ডা লেগে মিপ বাড়িতে তাছাড়া এলির নিজেরও গোড়ালিতে মচকানোর ব্যথা, মনের মানুষকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা, এবং তার ওপর খুঁতখুঁত করা বাবা–এসব কথা মনে রাখলে বোঝা যায় এলির কেন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আমরা এলিকে এই বলে প্রবোধ দিই যে, দু-একবার উনি জোর করে বলুন যে ওঁর সময় নেই। তাহলে বাজারের ফর্দ আপনা থেকেই হালকা হয়ে আসবে।
মিস্টার ফান ডানের ব্যাপারে আবার কোনো গোলমাল পাকিয়েছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি শীগগিরই একটা কিছু বাধবে। কি কারণ যেন বাপি খুব ক্ষেপে আছেন। একটা কোনো বিস্ফোরণ ঘটবে, কিন্তু সেটা কী ধরনের তা জানি না। শুধু আমি যদি এই সব ঝগড়াঝাটিতে অতটা জড়িয়ে না পড়তাম তো ভালো হত! আমি যদি এ থেকে বেরিয়ে যেতে পারতাম! ওরা শীগগিরই আমাদের পাগল করে ছাড়বে।
তোমার আনা।
.
রবিবার, ১৭ অক্টোবর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
কী ভাগ্যিস, কুপহুইস ফিরে এসেছেন। এখনও ওঁর ফ্যাকাশে ভাব যায় নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও উনি হাসিমুখে ফান ডানের জামাকাপড় বিক্রির ভার কাঁধে তুলে নিয়েছেন। একটা বিশ্রী
ব্যাপার হল, ফান ডানদের হাতে এই মুহূর্তে কোনো টাকাকড়ি নেই। মিসেস ফান হাতছাড়া। করবেন না। মিস্টার ফান ডানের স্যুট সহজে বিক্রি হবে না, কেননা ওঁর খাই খুব বেশি। শেষ পর্যন্ত যে কী হবে এখনও বোঝা যাচ্ছে না। মিসেস ফন ডানকে তার চারকোট। হাতছাড়া করতেই হবে। ওপর-তলায় এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে প্রচণ্ড বচসা হয়ে গেছে; এখন চলছে ওঁদের ‘ও সোনার পুট্টি’ এবং ‘আদরের কেলি’ বলে মানভঞ্জনের পালা।
গত মাসে এই পুন্যবান বাড়িতে যে পরিমাণ গালিগালাজ বিনিময় হয়েছে তাতে আমি হকচকিয়ে গিয়েছি। বাপি মুখে কুলুপ এঁটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন; কেউ ওঁকে ডেকে কিছু বললে উনি চমকে উঠে এমনভাবে মুখ তুলে তাকান যেন ওঁর ভয় আবার কার সঙ্গে কার কী খিটিমিটি হয়েছে ওঁকে তা মেটাতে হবে। উত্তেজনার দরুন মা-মণির গালে লাল ছোপ পড়েছে। মারগটের সব সময় মাথা ধরে আছে। ডুসেল অদ্রিায় ভুগছেন। মিসেস ফান ডান সারাদিন গজগজ করেন আর আমার হয়েছে সম্পূর্ণ মাথা-খারাপের অবস্থা! সত্যি বলছি; মাঝে মাঝে আমার মনে থাকে না কার সঙ্গে আমাদের আড়ি চলছে আর কার সঙ্গেই বা ভাব। এসব জিনিস থেকে মনটাকে সরিয়ে রাখার একমাত্র উপায় হল–পড়াশুনা নিয়ে থাকা এবং আমি এখন প্রচুর পড়ছি।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর, ১৯৪৩
আদরের কিটি, মিস্টার আর মিসেস ফান ডানের মধ্যে কয়েকবার তুমুল ঝগড়া হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ঘটেছিল এই রকম–তোমাকে আমি আগেই বলেছি, ফান ডানদের টাকাপয়সা সব ফুরিয়ে গেছে। কিছুদিন আগে একদিন কথায় কথায় কুপহুইস বলেছিলেন ফার-ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে; তাতে স্ত্রীর কার-কোটটা বেচার কথা ফান ডানের মাথায় আসে। ফার কোটটা খরগোসের চামড়ায় তৈরি এবং ভদ্রমহিলা সতেরো বছর ধরে সেটা সমানে পরেছেন। ওটা বেচে ভদ্রলোক পেয়েছেন ৩২৫ ফ্লোরিন প্রচুর টাকা। যাই হোক, মিসেস ফান ডান চেয়েছিলেন যুদ্ধের পর কাপড়চোপড় কেনার জন্যে টাকাটা রেখে দিতে; ধানাই পানাই করার পর ফান ডান তার স্ত্রীকে পরিষ্কার বলেন যে সংসারের জন্যে টাকাটা এখুনি দরকার।
সে যে কী চিৎকার আর চেচামেচি পা-দাপানো আর গালাগালি–তুমি ধারণা করতে পারবে না। সে এক ভয়ানক ব্যাপার আমার পরিবারের সবাই সিঁড়ির নিচে রুদ্ধ নিশ্বাসে দাঁড়িয়ে, দরকার হলে টেনে হিঁচড়ে ওদের ছাড়িয়ে দেবার জন্যে তৈরি। এইসব গলাবাজি আর কান্না আর স্নায়বিক উত্তেজনা এমন অস্বস্তিকর এবং এত ক্লান্তিকর যে সন্ধ্যেবেলায় আমি কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় ঢলে পড়লাম আর সৃষ্টিকর্তাকে এই বলে ধন্যবাদ দিলাম যে, কখনও কখনও আমি আধ ঘণ্টা সময় পাই যা আমার নিজস্ব।
মিস্টার কুপহুইস আবার আসছেন না; পাকস্থলী নিয়ে ওর ভোগান্তির একশেষ। রক্ত। পড়া বন্ধ হয়েছে কিনা উনি জানেন না। যখন উনি বললেন ওঁর শরীর ভালো যাচ্ছে না এবং বাড়ি চলে যাচ্ছেন, তখন সেই প্রথম ওঁকে খুব কাহিল দেখলাম।
আমার ক্ষিদে হচ্ছে না, এ ছাড়া মোটের ওপর আমার খবর ভালো। সবাই বলছে ‘দেখে মনে হচ্ছে, তুমি মোটেই সুস্থ নও।’ আমাকে এটা স্বীকার করতেই হবে যে, আমাকে ঠিক রাখার জন্যে ওরা যথাসাধ্য করছে। গ্লুকোজ, কডলিভার অয়েল, ইস্ট ট্যাবলেট আর ক্যালসিয়াম–সব একধার থেকে খাওয়ানো হচ্ছে।
প্রায়ই আমি মানসিক স্থৈর্য হারিয়ে ফেলি; বিশেষ করে আমার মেজাজ খিচড়ে যায় রবিবারগুলোতে। সিসের মত ভারী এমন বুকচাপা আবহাওয়া, খালি হাই ওঠে। বাইরে একটি পাখিও ডাকে না, চারিদিকে মারাত্মক নৈঃশব্দ্যের ঘেরাটোপ, আমাকে ধরে বেঁধে যেন পাতালের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।
যখন এইরকম হয়, তখন বাপি, মা-মণি আর মারগট, কারো সম্বন্ধেই আমার কোনো পৃহা থাকে না। একবার এ-ঘর একবার ও-ঘর, একবার নিচে একবার ওপরে আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াই, মনে হয় আমি যেন সেই গান-গাওয়া পাখি যার ডানা দুটো কেটে দেওয়া হয়েছে আর সে যেন নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে খাচার গরাদে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে। আমার ভেতর থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলে, ‘যাও না বাইরে, হেসেখেলে বেড়াও, গায়ে খোলা হাওয়া লাগাও, কিন্তু তাতেও আমার কোনো সাড়া জাগে না। আমি গিয়ে ডিভানে শুই, তারপর ঘুমিয়ে পড়ি, যাতে আরও তাড়াতাড়ি কাটে সময়, আর স্তব্ধতা আর সাংঘাতিক ভয়, কেননা তাদের কোতল করার কোনো উপায় নেই।
তোমার আনা।
.
বুধবার, ৩ নভেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
আমরা যাতে এমন কিছু করতে পারি, একাধারে যা শিক্ষামূলকও হবে, তার জন্যে বাপি লিডেনের টিচার্স ইনস্টিটিউটে প্রস্পেক্টাস চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন। মারগট ঐ মোটা বইটা অন্তত তিনবার খুঁটিয়ে পড়েও তাতে এমন কিছু পায়নি যা তার মনে ধরে কিংবা যা তার সাধ্যায়ও। বাপি তার আগেই ঠিক করে ফেলেছেন, উনি প্রাথমিক লাটিন শিক্ষার পরীক্ষামূলক অনুশীলনী চেয়ে ইনস্টিটিউটে চিঠি লিখতে চান।
আমিও যাতে নতুন কিছু লিখতে শুরু করতে পারি, বাপি কুপহুইসকে তার জন্যে একটি শিশুপাঠ্য বাইবেল আনতে বলেছেন; তাতে শেষ পর্যন্ত নিউ টেস্টামেন্ট সম্পর্কে আমি কিছুটা জানতে পারব। মারগট খানিকটা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘খানুকার জন্যে আনাকে তোমরা বুঝি বাইবেল দেবে?’ বাপি জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তা-সেন্ট নিকোলাস ডে হলে আরও ভালো হয় খানুকার (দ্রষ্টব্য–৭ ডিসেম্বর, ১৯৪২) সঙ্গে যীশু ঠিক চলে না।’
তোমার আনা।
.
সোমবার সন্ধ্যা, ৮ নভেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
তুমি যদি আমার চিঠির তাড়া একটার পর একটা পড়ো, তুমি নিশ্চয়ই দেখে অবাক হবে কত রকমারি মেজাজে চিঠিগুলো লেখা হয়েছে। এখানকার আবহাওয়ার ওপর আমি এত বেশি নির্ভরশীল যে, এতে আমার বিরক্তিই ধরে; তাই বলে আমি একা নই–আমাদের সকলেরই এক অবস্থা। কোনো বই যদি আমার মনে রেখাপাত করে, অন্য কারো সঙ্গে মেশবার আগে নিজেকে আমার শক্ত হাতে ধরে রাখতে হয়; তা নইলে ওরা ভাববে আমার মনটা কি রকম অদ্ভূত হয়ে আছে। এই মুহূর্তে তুমি হয়ত লক্ষ্য করে থাকবে, আমি একটু মনমরা হয়ে আছি। আমি তোমাকে এর কারণ বলতে পারব না, তবে আমার বিশ্বাস আমি ভীরু প্রকৃতির মানুষ বলে, এবং তাতেই আমি সারাক্ষণ ধাক্কা খাই।
আজ সন্ধ্যেবেলায়, এলি তখনও এখানে, দরজায় খুব জোরে অনেকক্ষণ ধরে তীক্ষ্ণস্বরে বেল বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আমি সাদা হয়ে গেলাম, আমার পেট ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল আর বুক ধড়ফড় করতে লাগল–বিলকুল ভয়ে। রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে আমি দেখি মা মণি নেই, বাপি নেই–এক অন্ধকার গুদামঘরে আমি একা। কখনও কখনও দেখি হয় রাস্তার ধার দিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি, নয় ‘গুপ্ত মহলে’ আগুন লেগেছে, নয় রাত্রে হানা দিয়ে ওরা। আমাদের নিয়ে চলেছে। যা কিছুই দেখি, মনে হয় বাস্তবিকই সেটা ঘটেছে; এ থেকে কেমন যেন আমার মনে হয় এ সমস্তই আমার ভাগ্যে অতি সত্ত্বর ঘটতে চলেছে। মিলু প্রায়ই বলে থাকেন আমাদের এখান এমন অনাবিল শান্তি দেখে ওঁর হিংসে হয়। সেটা হয়ত সত্যি, কিন্তু আমাদের তাবৎ ভয়ের কথা উনি হিসেবে আনেন না। আমি একদম ভাবতে পারি না পৃথিবীটা আবার কখনও আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে ধরা দেবে। আমি বলি বটে ‘যুদ্ধের পর’, কিন্তু সেটা শূন্যে সৌধ নির্মাণ মাত্র, যা কখনই বাস্তবে ঘটবে না। যখন পুরনো কথাগুলো মনে করি-আমাদের সেই বাড়ি, আমার মেয়ে বন্ধুরা, ইস্কুলের সেই মজাতখন মনে হয় সেসব আমার নয়, যেন অন্য কারো জীবনে ঘটেছে।
আমাদের গুপ্ত মহলে এই যে আমরা আটজন মানুষ আমি দেখি আমরা যেন ঘন কালো জলদ মেঘে এক ফালি ছোট্ট নীল আকাশ। যে গোলাকার সুনির্দিষ্ট জায়গায় আমরা দাঁড়িয়ে, এখনও তা বিপদসীমার বাইরে, কিন্তু চারদিক থেকে মেঘগুলো ক্রমশ আমাদের হেঁকে ধরছে এবং আসন্ন বিপদ থেকে আমাদের পৃথক করে রাখা বৃত্তটি ক্রমে তার গণ্ডি ছোট করে আনছে। এখন আমরা বিপদাপদে আর অন্ধকারে এমন ভাবে ঘেরাও হয়ে পড়েছি যে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে গিয়ে আমরা পরস্পরের সঙ্গে ঠোকাঠুকি খাচ্ছি। আমরা সবাই নিচের দিকে তাকিয়ে দেখছি সেখানে মানুষজনেরা নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি করছে, ওপরে তাকিয়ে দেখছি কী শান্ত সুন্দর। তার মধ্যে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সেই বিশাল অন্ধকার, যে আমাদের ওপরে যেতে দেবে না, যে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অভেদ্য প্রাচীরের মত; সে আমাদের পিষে মারতে চায়, কিন্তু এখনও পারছে না। আমি কেবল চিৎকার করে ব্যর্থতা জানাতে পারি; ‘ইস্, কালো বৃত্তটা যদি পিছিয়ে গিয়ে আমাদের পথ একটু খোলসা করে দিত।’
তোমার আনা।
.
বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
এই অধ্যায়ের একটা ভালো শিরোনাম পেয়েছি। আমার ফাউন্টেন পেনের উদ্দেশ্যে স্মৃতিতর্পণ। আমার কাছে বরাবর আমার ফাউন্টেন পেনটি ছিল সবচাইতে অমূল্য একটি সম্পদ; বিশেষ করে তার মোটা নিবের জন্যে কলমটি আমার এত আদরের, কেননা একমাত্র মোটা নিব হলে তবেই আমার হাতের লেখাটা পরিপাটি হয়। আমার ফাউন্টেন পেনের পেছনে রয়েছে এক অতি দীর্ঘ আগ্রহ-জাগানো কলম-জীবন, তার কথা সংক্ষেপে আমি তোমাকে বলব।
আমার যখন ন’বছর বয়স, তখন আমার ফাউন্টেন পেনটি এসেছিল একটি প্যাকেটে (তুলো দিয়ে মোড়ানো অবস্থায়), বিনামূল্যের নমুনা হিসেবে; পেনটি এসেছিল সুদূর আখেন থেকে; সহৃদয় উপহারদাতা আমার দিদিমা সেখানে থাকতেন। ফ্র হয়ে আমি তখন শয্যাগত, ফেব্রুয়ারির হাওয়া তখন বাড়ির চারদিকে হুঙ্কার দিয়ে ফিরছে। জমকালো সেই ফাউন্টেন পেনের ছিল একটা লাল চামড়ার খাপ। পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত বন্ধুকে সেটা দেখানো হয়ে গেল। আমি, আনা ফ্রাঙ্ক, একটি ফাউন্টেন পেন থাকার গর্বে গরবিনী। যখন আমি দশ বছরের হলাম তখন আমাকে কলমটি ইস্কুলে নিয়ে যেতে দেওয়া হল এবং শিক্ষত্রিয়ী এমন কি তা দিয়ে আমাকে লেখবারও অনুমতি দিলেন।
যখন আমার বয়স এগারো, আমাকে আবার আমার সম্পত্তিটি সরিয়ে ফেলতে হল; কেননা ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষত্রিয়ী ইস্কুলের দোয়াত কলমে ছাড়া আমাদের লিখতে দিতেন না।
বারো বছর বয়সে যখন আমি ইহুদী লিসিয়ামে (এক ধরনের মাধ্যমিক ইস্কুল যেখানে বিশেষভাবে প্রাচীন বিষয়াদি শেখানো হয়। ইউরোপের প্রায় সর্বত্র এর চলন আছে) ভর্তি হলাম তখন সেই বিরাট ঘটনা উপলক্ষে আমার ফাউন্টেন পেন পেল একটি নতুন খাপ; তাতে পেনসিল রাখারও ব্যবস্থা ছিল এবং জিপার টেনে বন্ধ করা যেত বলে খাপটা দেখতে আরও বাহারে হল।
আমার তেরো বহুরে ফাউন্টেন পেনটি আমাদের সঙ্গে এসে উঠল ‘গুপ্ত মহলে’ সেখানে সে আমার হয়ে অসংখ্য ডায়রি আর রচনার ভেতর দিয়ে সজোরে ছুটেছে।
এখন আমার বয়স চৌদ্দ; আমাদের শেষ বছরটা আমরা একসঙ্গে কাটিয়েছি।
সেদিন ছিল শুক্রবার বিকেল পাঁচটা বেজে গিয়েছিল। আমি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে লিখবার জন্যে টেবিলে বসতে যাব, এমন সময় আমাকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বাপিকে নিয়ে আমার জায়গায় গিয়ে বসল মারগট। ওরা ‘লাটিন’ নিয়ে রেওয়াজ করবে। টেবিলে ফাউন্টেন পেনটা বেকার পড়ে রইল আর তার মালিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাধ্য হয়ে টেবিলের ছোট্ট একটা কোণে বসে বিগুলো ডলতে আরম্ভ করল। ‘বি ডলা’ বলতে ছাতা পড়া বিগুলোকে ফের চকচকে করে তোলা। পৌনে ছ’টার সময় মেঝে ঝাট দিয়ে খারাপ বিসুদ্ধ জঞ্জালগুলো খবরের কাগজে মুড়ে উনুনে বিসর্জন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে দেখে আমার ভালই লাগল। কেননা আমি ভাবিনি যে প্রায় নিভন্ত আগুনে জিনিসটা ওরকম দপ করে জ্বলে উঠবে। এরপর আবার সব চুপচাপ, ‘লাটিন পড়ুয়াদের অনুশীলন শেষ, তারপর আমি টেবিলে গিয়ে বসে লেখার জিনিসগুলো গোছগাছ করতে শুরু করে দিলাম। কিন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোথাও আমার ফাউন্টেন পেনটা দেখতে পেলাম না। আরও একবার খোঁজাখুঁজি করলাম, মারগটও খুঁজল, কিন্তু কোথাও আমার ফাউন্টেন পেনের হদিশ করতে পারলাম না। না তা হতেই পারে না! সেদিন সন্ধ্যেবেলায় ফাউন্টেন পেনটা না পেয়ে আমরা সবাই ধরে নিলাম যে, এটা নিশ্চয়ই আগুনে পুড়েছে, আরও এই কারণে যে সেলুলয়েড জিনিসটা সাংঘাতিক রকমের দাহ্য।
পরে আমাদের মন-খারাপ-করা ভয়টাই সত্যি বলে প্রমাণ হল; পরদিন সকালে উনুন পরিষ্কার করতে গিয়ে ছাইয়ের মধ্যে বাপি পেন আটকানোর ক্লিপটা দেখতে পেলেন। সোনার নিবটার কোনো পাত্তা পাওয়া গেল না। বাপির ধারণা–ওটা নিশ্চয় আগুনে গলে গিয়ে পাথরে বা আর কিছুতে সেঁটে গেছে।’
খুব ক্ষীণ হলেও আমার একমাত্র সান্ত্বনা ও কলমটির সত্ত্বার হয়েছে, ঠিক আমি যা পরে এক সময়ে চাই!
তোমার আনা।
.
বুধবার, ১৭ নভেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
এমন সব ঘটনা ঘটছে যে আমাদের মাথায় হাত। এলির বাড়িতে ডিপৃথিরিয়া, ফলে ছ’সপ্তাহ ধরে আমাদের এখানে ওঁর আসা বন্ধ। খাবার-দাবার আর কেনাকাটার ব্যাপারে আমরা মহাফাঁপড়ে পড়েছি। তাছাড়া এলির সাহচর্য থেকে আমাদের বঞ্চিত হওয়া তো আছেই। কূপহুইস এখনও শয্যাগত এবং তিন সপ্তাহ ধরে ওঁর পথ্য বলতে শুধু পরিজু আর দুধ। ক্রালার নিশ্বাস ফেলার সময় পাচ্ছেন না।
মারগট তার লাটিন অনুশীলনীগুলো ডাকে দেয়, একজন শিক্ষক সেসব সংশোধন করে ফেরত পাঠান। মারগট এটা করে এলির নামে। শিক্ষকটি চমৎকার মানুষ এবং সেই সঙ্গে তার রসবোধ আছে। অমন বুদ্ধিমতী ছাত্রী পেয়ে উনি নিশ্চয়ই খুব খুশী।
ডুসেল খুব ম্রিয়মাণ হয়ে আছেন, আমরা কেউই জানি না কেন। এটা শুরু হয় যখন দেখা গেল ওপরতলায় উনি একেবারেই মুখ খুলছেন না; মিস্টার এবং মিসেস ফান ডানের সঙ্গে ওঁর একেবারেই কথা নেই। এটা প্রত্যেকেরই নজরে পড়ে; দুদিন ধরে এটা চলবার পর মা-মণি তাকে সাবধান করে দিয়ে বলেন যে, উনি যদি এরকম করেন তাহলে মিসেস ফান ডান তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলতে পারেন। ডুসেল বলেন যে, মিস্টার ফান ডানই প্রথম তার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেন এবং তিনি নিজে কিছুতেই আগ বাড়িয়ে কথা বলবেন না।
তোমাকে এখন বলা দরকার যে, গতকাল ছিল ষোলই নভেম্বর–ঐদিন ‘গুপ্ত মহলে’ ডুসেলের আসার এক বছর পূর্ণ হল। এই উপলক্ষে মা-মণি একটি গাছ উপহার পান, কিন্তু কিছুই পেলেন না মিসেস ফান ডান, যিনি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একথা গোপন করেননি যে, তাঁর মতে ডুসেলের উচিত আমাদের খাওয়ানো।
আমরা যে নিঃস্বার্থভাবে ডুসেলকে আমাদের মধ্যে নিয়েছি, তার জন্যে একদিন এই প্রথম ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা দুরের কথা, সে প্রসঙ্গে তিনি একটিও কথা বললেন না। ষোল তারিখ সকালে আমি যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম যে, আমি অভিনন্দন জানাব, না শোক প্রকাশ করব–উনি তার উত্তরে বললেন–ওঁর কিছুতেই কিছু আসে যায় না। মা-মণি চেয়েছিলেন মধ্যস্থ হয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে দিতে, কিন্তু ওঁর পক্ষে এক পা-ও এগোনো সম্ভব হল না; শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা যে-কে সেই থেকে গেল।
ডের মান হাট আইনেন গ্রোসেন গাইস্ট
উণ্ড ইস্ট সো ক্লাইন ফন টাটেন।
(মানুষের মন দরাজ, কত ছোট তার কাজ)
তোমার আনা।
.
শনিবার, ২৭ নভেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
কাল রাত্তিরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে হঠাৎ কে আমার চোখের সামনে এসে দাঁড়াল, বলো তো? লিস্! আমি দেখলাম শতচ্ছিন্ন বস্ত্রে জীর্ণ শীর্ণ মুখে সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রকাণ্ড বড় বড় চোখ মেলে বিষণভাবে আর ভৎসনার দৃষ্টিতে আমার দিকে সে তাকিয়ে ছিল; যেন তার চোখ দিয়ে আমাকে সে বলছিল–’ওহে আনা, কেন আমাকে তুমি ত্যাগ করেছ? এই নরক থেকে তুমি আমাকে বাঁচাও, আমাকে টেনে তোলো!’
আমার তো তাকে সাহায্য করার ক্ষমতা নেই, আমি শুধু চেয়ে দেখতে পারি, অন্যরা কিভাবে কষ্ট পাচ্ছে আর মারা যাচ্ছে। তাকে আমাদের কাছে এনে দাও বলে আমি শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে পারি।
আমি কেবল লিসকে দেখেছি; অন্য কাউকে নয়; এখন আমি এর অর্থ বুঝতে পারছি। আমি ওকে বিচার করেছিলাম ভুলভাবে; আমি তখন খুব ছোট বলে ওর মুশকিলগুলো বুঝিনি। ওর তখন এক নতুন মেয়ে-বন্ধুর ওপর খুব টান এবং ওর এটা মনে হয়েছিল যে, আমি যেন তাকে ওর কাছছাড়া করতে চাইছি। বেচারার মনে কতটা লেগেছিল আমি জানি; আমি নিজেকে দিয়ে জানি মনের অবস্থা কেমন হয়।
কখনও কখনও এক ঝলকে তার জীবনের কোনো কিছু আমার চোখে ভেসে উঠেছে, পরক্ষণেই স্বার্থপরের মত আমি আমার নিজস্ব সুখস্বাচ্ছন্দ্য আর সমস্যার মধ্যে ডুবে গিয়েছি। আমি তার প্রতি যে ব্যবহার করেছি তা খুবই খারাপ এবং এখন সে ফ্যাকাসে মুখে আর করুণ দৃষ্টিতে কী অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু আমি যদি তাকে সাহায্য করতে পারতাম। হে সৃষ্টিকর্তা, আমি যা ইচ্ছে করি তাই আমি পাই, আর ও বেচারা কী সাংঘাতিক নিয়তির ফেরে পড়েছে। আমি তো ওর চেয়ে বেশি পুণ্য করিনি; লিসও তো চেয়েছিল ন্যায়ের পথে থাকতে। তবে কেন আমার ভবিতব্য হল বেঁচে থাকা আর ওর সম্ভবত মৃত্যু? আমাদের মধ্যে কী তফাত ছিল? আজ কেনই বা আমরা পরস্পর থেকে এতটা দূরে?
স্বীকার করছি, কত যে মাস; হ্যাঁ, তা প্রায় একটা বছর, আমি তার কথা ভাবিনি। সম্পূর্ণ যে ভুলেছিলাম তা নয়। তবে দুঃখে ভেঙে পড়া অবস্থায় তাকে দেখার আগে তার কথা এভাবে কখনও ভাবিনি।
ও লিস্, যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত যদি তুই বেঁচে থাকিস, আবার আমাদের মধ্যে ফিরে আসবি; আমি তখন আবার তোকে কাছে টেনে নেব; তোর প্রতি যে অন্যায় করেছি আমি কোনো না কোনোভাবে সেই দোষ স্খলন করব।
তবে আমি যখন তাকে সাহায্য করতে সক্ষম হব, তখন হয়ত আজকের মত এত চরমভাবে সাহায্যের তার দরকার হবে না। আমার জানতে ইচ্ছে করে, লিস্ কি আমার কথা ভাবে? ভাবলে, ওর মনের মধ্যে কি রকম হয়?
হে মঙ্গলময় প্রভু, ওকে তুমি রক্ষা করো, ও যাতে অন্তত নিঃসঙ্গ না হয়। প্রভু, ওকে দয়া করে একটু বলো আমি প্রীতি আর সমবেদনার সঙ্গে ওর কথা ভাবি, তাতে হয়ত ওর সহ্যশক্তি আরও বাড়বে।
আমি আর এ নিয়ে ভাবব না, কেননা ভেবে কোনো লাভ নেই। আমার সামনে সারাক্ষণ ভাসতে থাকে তার দুটো ড্যাবডেবে চোখ, আমি কিছুতেই তা থেকে নিজেকে সরাতে পারি না। যে জিনিস তার ঘাড়ে এসে পড়েছে, সেটা ছাড়াও আমার জানতে ইচ্ছে করে, নিজের ওপর সত্যিকার ভরসা আছে তো তার?
আমি সেসব জানি না, কোনোদিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করিনি।
লিস, লিস, শুধু আমি যদি তোকে তুলে আনতে পারতাম, যদি তোর সঙ্গে আমার সব সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভাগ করে নিতে পারতাম। আমি নিরুপায়, অনেক দেরি হয়ে গেছে কিংবা আমি যে ভুল করেছি এখন তা ঠিক করে নেওয়ার কোনো উপায় নেই। কিন্তু আমি আর কখনো তাকে ভুলছি না, আমি সর্বক্ষণ তার জন্যে প্রার্থনা করব।
তোমার আনা।
.
সোমবার, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
সেন্ট নিকোলাস ডে যখন আসন্ন, তখন আমাদের সকলেরই মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল গত বছরের সেই সুন্দর করে সাজানো ঝুড়িটার কথা; বিশেষ করে আমার মনে হল, এ বছর কিছুই না করলে খুব বাজে লাগবে। এই নিয়ে অনেক ভেবে ভেবে শেষ পর্যন্ত একটা জিনিস আমার মাথায় এল, তাতে বেশ মজাই হবে।
পিমের সঙ্গে আমি এ নিয়ে কথা বললাম। এক সপ্তাহ আগে প্রত্যেকের জন্যে আমরা একটি করে ছোট্ট পদ্য লেখা শুরু করেছিলাম।
রবিবার সন্ধ্যেবেলায় পৌনে আটটা নাগাদ ময়লা কাপড় রাখার বড় ঝুড়িটা ধরাধরি করে ওপরতলায় আমরা হাজির হলাম। তার গায়ে ছোট ছোট মূর্তি আঁকা আর সেই সঙ্গে গিট বাধা নীল আর গোলাপী কার্বন কাগজ। একটা বড় বালির কাগজ দিয়ে ঝুড়িটা ঢাকা, তাতে আলপিন দিয়ে গাঁথা একটা চিঠি। আজব গাটরির আকার দেখে সবাই বেশ অবাক।
বালির কাগজ থেকে চিঠিটা বের করে নিয়ে আমি পড়তে থাকি :
সান্টা ক্লজের পুনরাগমন
তা বলে নয় কো আগের মতন
গতবার হয়েছিল যত ভালো
হবে না এবার তত জমকালো।
তখন যে ছিল উজ্জ্বল আশা
ভবিষ্যৎকে মনে হত খাসা,
স্বাগত জানাব ভাবেই নি কেউ
সান্টাকে পুনরপি এবারেও।
হাত খালি, কিছু নেইকো দেবার
তবুও জাগাব আত্মাকে তাঁর,
ভেবে ভেবে বের করা গেছে কিছু
যে যার জুতায় দেখ হয়ে নিচু।
ঝুড়ি থেকে যার যার জুতো বের করে নিতেই প্রত্যেকের সে কী হো হো করে হাসি। প্রত্যেকটি জুতোর মধ্যে কাগজের একটি ছোট মোড়ক, তাতে জুতোর মালিকের ঠিকানা লেখা।
তোমার আনা।
.
বুধবার, ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
এমন খারাপ ধরনের ফ্লু হয়েছিল যে, এর মধ্যে আর তোমাকে লিখে উঠতে পারিনি। এই জায়গায় অসুখে পড়লে ভোগান্তির একশেষ। একবার, দুবার, তিনবার–কাশতে হলেও আমাকে কম্বলের তলায় গিয়ে দেখতে হবে যেন আওয়াজ বাইরে না যায়। সাধারণত এর একমাত্র ফল হয় এই যে, সারাক্ষণ গলা সুড়সুড় করে; তখন দূধ আর মধু, চিনি কিংবা লজেন্সের শরণাপন্ন হতে হয়।
যে পরিমাণ দাওয়াই আমার ওপর চাপানো হয়েছে ভাবলে মাথা ঘুরে যায়। গা দিয়ে ঘাম বের করা, গরম সেঁক, বুকে জলপট্টি, বুকে শুকনো পট্টি, গরম পানীয়, গার্গ করা, গলায় বেল্ট লাগানো, চুপচাপ শুয়ে থাকা, বাড়তি উষ্ণতার জন্যে কুশন, গরম পানির বোতল, লেমন স্কোয়াশ, এবং তার ওপর, দু ঘণ্টা পর পর থার্মোমিটার।
এভাবে কি সত্যিই কেউ ভালো হয়ে উঠতে পারে? সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার হয় তখনই, যখন মিস্টার ডুসেল ভাবেন যে তিনি ডাক্তারি করবেন; উনি এসে আমার খালি গায়ে বুকের ওপর তার মাথা রাখবেন, যাতে ভেতরকার শব্দ শোনা যায়।
একে তো ওর চুলের দরুন ‘অসহ্য রকমের সুড়সুড়ি লাগে, তার ওপর মরমে মরে যাই হোক না, কবে তিরিশ বছর আগে উনি মেডিকেল পড়েছিলেন এবং ওঁর একটা ডাক্তার খেতাব আছে। ভদ্রলোক এসে কেন আমার বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বেন। আর যাই হোক, উনি তো আমার প্রেমিক নন! আর তাছাড়া, আমার ভেতরটা সুস্থ, না অসুস্থ উনি তো তার আওয়াজও পাবেন না; দিন দিন উনি যে রকম ভয়াবহ ধরনের কম শুনছেন, তাতে আগে তো ওঁর কানের ভেতরেই নল ঢোকানো দরকার।
ঢের হয়েছে, অসুখের কথা থাক। আমি আবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছি, লম্বা হয়েছি আরও এক সেন্টিমিটার, ওজন বেড়েছে দুই পাউণ্ড, রং হয়েছে ফ্যাকাসে, সেই সঙ্গে জ্ঞানলাভের সত্যিকার স্পৃহা বেড়ে গেছে।
তোমাকে দেবার মত খুব বেশি খবর নেই। এখন আর আগের মত নয়, আমরা সবাই মিলেমিশে আছি। ঝগড়াঝাটি নেই–অন্তত ছ’মাস ধরে এখানে বিরাজ করছে একটানা শান্তি। আগে কখনও এমন হয়নি। এলি এখনও আমাদের কাছ ছাড়া।
আমরা বড়দিনের জন্যে বাড়তি তেল, মিষ্টি আর সিরাপ পেয়েছি; প্রধান উপহার’ হল একটা ক্ৰচ–আড়াই সেন্টের মুদ্রা দিয়ে তৈরি সুন্দর ঝকঝকে দেখতে। যাই হোক, জিনিসটা এত ভালো যে, ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
মা-মণিকে আর মিসেস ফান ডানকে মিস্টার ডুসেল একটা চমৎকার কেক দিয়েছেন; উনি মিপকে দিয়ে কেকটা তৈরি করিয়েছেন। মিপ আর এলির জন্যে আমিও কিছু জিনিস রেখেছি। আমার পরিজ থেকে, বুঝলে, অন্তত ছমাস ধরে আমি চিনি বাঁচিয়েছি; কুপহুইসের সাহায্যে তাই দিয়ে আমি মিঠাই বানিয়ে নেব।
বিশ্রী বাদুলে আবহাওয়া, উনুনে সোঁদা গন্ধ, প্রত্যেকের পেটের মধ্যে খাবার গ্যাজ গ্যাজ করছে, তার ফলে চারদিকে মেঘ-ডাকা আওয়াজ। যুদ্ধ এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে আছে, মনোবলের অবস্থা যাচ্ছেতাই।
তোমার আনা।
.
শুক্রবার, ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
আগেই লিখেছি এখানকার আবহাওয়ায় আমরা কতটা আক্রান্ত হচ্ছি; আমি মনে করি আমার ক্ষেত্রে এই অসুবিধে ইদানীং আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
‘হিমেলহোখ ইয়াউখুসেণ্ড ইৎসুম টোডা বেটরুট (গয়টের বিখ্যাত পঙক্তি–সুখের। স্বর্গে নয় দুঃখের রসাতলে’) এটা রীতিমত এখানে খাপ খায়। আমি যখন অন্য ইহুদী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুলনা করে শুধু নিজেদের সৌভাগ্যের কথা ভাবি তখন মনে হয় আমি আছি সুখের স্বর্গে’; আর ‘দুঃখের রসাতলে আছি মনে হয় যখন, যেমন আজকে, মিসেস কুপহুইস এসে বলছিলেন তার মেয়ে করি-র হকি ক্লাব, ডোঙায় করে জলযাত্রা, থিয়েটার করা আর সেই সঙ্গে তার বন্ধুদের কথা। এটা নয় যে করিকে আমি হিংসে করি, আসলে আমার খুব ইচ্ছে হয় একবার প্রচুর আনন্দ করি এবং হাসতে হাসতে যেন পেটে খিল ধরে যায়। বিশেষ করে বড়দিন আর নববর্ষের এই ছুটির মরসুম আর এখন কিনা আমরা এখানে আটক হয়ে আছি একঘরের মতন।
তবু এটা আমার লেখা উচিত নয়, কেননা তাতে মনে হবে আমি অকৃতজ্ঞ এবং অবশ্যই আমি তিলকে তাল করছি। এ সত্ত্বেও, আমাকে তুমি যাই ভাবো, আমি সব কিছু চেপে রাখতে পারি না, সুতরাং আমি তোমাকে মনে করিয়ে দেব আমার সেই গোড়ার কথাগুলো; ‘কাগজের সবই সয়।’
যখন কামাকাপড়ে হাওয়া আর মুখগুলোতে হিম লাগিয়ে লোকে বাইরে থেকে আসে, তখন কবে আমরা খোলা হাওয়ার গন্ধ নেবার সুযোগ পাব?’–এই ভাবনা মনে যাতে উদয় হয় তার জন্যে কম্বলে মুখ গুঁজে রাখতে পারি। আর যেহেতু আমি কম্বলে মুখ তো পুঁজবই, বরং করব তার উল্টো আমাকে মাথা উঁচু রাখতেই হবে, সাহসে বুক বাঁধতে হবে, ভাবনাগুলো আসবে একবার নয়, আসবে অসংখ্যবার।
বিশ্বাস করো, যদি তুমি দেড় বছর ধরে আটক থাকো, কখনও কখনও তোমার তা অসহ্য বলে মনে হবে। সুবিচার আর কৃতজ্ঞতা সত্ত্বেও, তোমার অনুভূতিগুলোকে তুমি পিষে মারতে পারো না। সাইকেল চালানো, নাচা, শিস্ দেওয়া, পুথিবীকে চোখ মেলে দেখা, তারুণ্যকে অনুভব করা–আমি তার জন্যে মরে যাই; তবু বাইরে এটা প্রকাশ করা চলবে না, কেননা সময় সময় আমি ভাবি যদি আমরা আটজন সবাই নিজেদের নিয়ে খেদ করতে থাকি আমরা হাঁড়িমুখ করে ঘুরে বেড়াই, তাতে আমাদের কী দশা হবে?
মাঝে মাঝে আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করি, ‘আমি একজন কাঁচা বয়সের মেয়ে, কিছুটা হাসিখেলা আমার না হলেই নয়–এটা কি ইহুদী বা ইহুদী নয় যারা, তারা কি অনুধাবন করতে পারে?’ আমি জানি না; এ কথা কাউকে বলতেও পারিনি, কারণ আমি জানি করতে গেলে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ব। কাঁদলে বুকটা কী যে হালকা হয়।
আমার সব তত্ত্বজ্ঞান এবং আমার শত চেষ্টা সত্ত্বেও প্রতিদিন আমার মনে হয় এমন। একজন সত্যিকার জননী নেই–যিনি আমার এবং আমাকে বুঝতে পারেন। তাই যাই করি। আর যাই লিখি, আমি সেই মা-সোনার কথা ভাবি যা আমি পরে আমার সন্তানদের ক্ষেত্রে হতে চাই। সেই ‘মা-সোনা’, যিনি সাধারণ কথাবার্তায় যা বলা হয় তার সব কিছুতেই অতখানি গুরুত্ব দেবেন না, অথচ যিনি আমার কথাগুলো নিশ্চয়ই গুরুত্ব দিয়ে শুনবেন। কী করে তা বলতে পারব না, তবে আমি লক্ষ্য করেছি মা-সোনা’ কথার মধ্যেই সব কিছু বলা আছে। জানো আমি কী খুঁজে পেয়েছি?
‘মা-মণি’কে আমি প্রায়ই ও মা বলে ডাকি, যাতে কাছাকাছি ধ্বনি থেকে আমি মা সোনা’ বলার অনুভূতিটা পাই; তা থেকে আসে মা গো, সেটা যেন ‘মা-সোনা’রই অসম্পূর্ণ রূপ; ‘সোনা’ যোগ করে আমি তাকে কত সম্মানিত করতে চাই, কিন্তু হলে কী হবে, উনি সে সব বোঝেন না। এটা ভালো, কেননা জানলে উনি অসুখী হতেন।
এই প্রসঙ্গে যথেষ্ট হল, লেখার ফলে ‘দুঃখের রসাতলে’র ভাব কিছুটা কেটে গেছে।
তোমার আনা।
.
সোমবার, ২৭ ডিসেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
শুক্রবার সন্ধ্যেবেলা জীবনে এই প্রথম বড়দিনে কিছু পেলাম। কুপহুইস, ক্রালার আর মেয়ের দল আবার মনোরম চমক লাগিয়েছেন। মিপ একটা ভারি সুন্দর বড়দিনের কেক বানিয়েছিলেন, তাতে লেখা ‘শান্তি ১৯৪৪’। এলি দিয়েছিলেন যুদ্ধের আগে যে রকম ভালো মিষ্টি বিস্কুট পাওয়া যেত সেই রকম বিস্কুট এক পাউণ্ড। পেটার, মারগট আর আমার জন্যে এক বোতল দই আর বড়দের প্রত্যেকের জন্যে এক বোতল করে বীয়ার। প্রত্যেকটি জিনিস সুন্দর ভাবে সাজানো ছিল এবং বিভিন্ন প্যাকেটের ওপর ছবি সাটা ছিল। এ বারে বড়দিন এত তাড়াতাড়ি চলে গেল যে আমাদের বুঝতেই দিল না।
তোমার আনা।
.
বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৪৩
আদরের কিটি,
কাল সন্ধ্যেবলায় আবার মনটা খুব খারাপ হয়েছির। ঠাকুমা আর লিসির কথা আমার মনে পড়ে গিয়েছিল। দিদু, ও আমার দিদু, কী কষ্ট পেয়েছিলেন! কী ভালো ছিলেন! আমরা তার কতটুকু বুঝেছিলাম। এসব ছাড়াও, সারাক্ষণ তিনি অন্যের কাছ থেকে সযত্নে গোপন করে রেখেছিলেন একটি ভয়ঙ্কর জিনিস (একটি গুরুতর আন্ত্রিক ব্যাধি)।
দিদু ছিলেন বরাবর কত অনুগত, কত ভালো একজন মানুষ; আমাদের একজনকেও কখনও তিনি বিপদে পড়তে দেননি। আমি যাই করি, যত দুটুই হই–দিদু সব সময় আমার পাশে দাঁড়াতেন।
দিদু, তুমি কি আমাকে ভালবাসতে, নাকি তুমিও আমাকে বুঝতে পারোনি? আমি জানি না। কেউ কখনও দিদুকে নিজেদের বিষয়ে কথা বলেনি। দিদু নিশ্চয়ই নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করতেন, আমরা থাকা সত্ত্বেও তিনি কত একা ছিলেন। বহুজনে ভালবাসলেও একজন নিঃসঙ্গ বোধ করতে পারেন, কেননা তিনি তো কারো কাছেই এক এবং একমাত্র নন।
আর লিস্, এখনও কি সে বেঁচে আছে? কী করছে সে? হে সৃষ্টিকর্তা, তুমি লিকে দেখো, তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে এনো। লিস, আমি সবসময় তোমার মধ্যে দেখি আমার কপালে যা ঘটতে পারত, আমি তোমার জায়গায় নিজেকে রেখে দেখে থাকি। এখানে যা ঘটে তা নিয়ে কেন তবে আমি প্রায়ই মন খারাপ করি? যে সময়ে আমি তার এবং তার সঙ্গীদের বিপদের কথা ভাবি, তখন ছাড়া অন্য সবসময়ে আমার কি আনন্দিত, সন্তুষ্ট আর। সুখী হওয়া উচিত নয়? আমি স্বার্থপর আর ভীতু। কেন আমি সব সময় সাংঘাতিক সাংঘাতিক দুঃস্বপ্ন আর বিভীষিকা দেখি–কখনও কখনও আমি ভয়ে আর্তনাদ করে উঠতে চাই। কারণ, এখনও এত কিছু সত্ত্বেও, ঈশ্বরে আমার যথেষ্ট বিশ্বাস নেই। আমাকে তিনি কত কিছু দিয়েছেন–আমি যা পাবার অধিকারী নই তবু আমি প্রতিদিন কত কিছু করি করা ঠিক নয়। তুমি যদি তোমার স্বজাতীয় মানুষজনের কথা ভাবো, তোমার তাহলে ডাক ছেড়ে কাদতে ইচ্ছা করবে, সারাদিন কেঁদেও তুমি কুল পাবে না। একটাই করবার আছে, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করা–তিনি এমন অলৌকিক কিছু করুন যাতে তাদের কেউ কেউ বেঁচে থাকে। সেটাই আমি করছি–এই আমার আশা।
তোমার আনা।