আনা ফ্রাঙ্ক এর ডায়েরি: ০৩. আবার এলোমেলো

আনা ফ্রাঙ্ক এর ডায়েরি: ০৩. আবার এলোমেলো

০৩. আবার এলোমেলো

বুধবার, ১৩ জানুয়ারী, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

আজ সকালে আবার সবকিছু আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। ফলে, একটা জিনিসও আমি ঠিকমত করে উঠতে পারিনি।

বাইরেটা সাংঘাতিক। দিনরাত ওরা আরও বেশি করে ঐ সব অসহায় দুঃখী মানুষগুলোকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। পিঠে একটা বোচকা আর পকেটে সামান্য টাকা ছাড়া ওদের নিজের বলতে আর কিছু থাকছে না। পথে সেটুকুও ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সংসারগুলো ছিটিয়ে গিয়ে স্ত্রী-পুরুষ ছেলেমেয়েরা সব পরস্পরের কাছ থেকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইস্কুল থেকে ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরে দেখছে মা-বাবা নিখোঁজ। মেয়েরা বাজার করে বাড়ি ফিরে দেখছে দরজায় তালা ঝোলানো, পরিবারের লোকজনের হাওয়া হয়ে গেছে। যারা জাতে ওলন্দাজ, তারাও খুব চিন্তাগ্রস্ত। তাদের ছেলেদের ধরে ধরে জার্মানিতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সকলেরই মনে ভয়।

প্রত্যেকদিন রাত্রে শ’য়ে শ’য়ে প্লেন। হল্যাণ্ডের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে জার্মান শহরগুলোতে। সেখানে বোমায় বোমায় মাটি চষে ফেলা হচ্ছে। রুশদেশে আর আফ্রিকায় প্রতি ঘন্টায় শ’য়ে শ’য়ে হাজারের হাজারে মানুষ খুন হচ্ছে। কেউই এর বাইরে থাকতে পারছে না, লড়াই সারা বিশ্ব জুড়ে। যদিও তুলনায় মিত্রপক্ষ এখন ভালো অবস্থায়, তাহলেও কবে যুদ্ধ শেষ হবে বলা যাচ্ছে না।

আমাদের কথা ধরলে, আমরা ভাগ্যবান। নিশ্চয় লক্ষ লক্ষ লোকের চেয়ে আমাদের ভাগ্য ভালো। এখানে নির্ঝঞ্ঝাটে, নিরাপদে আছি। বলতে গেলে, আমরা রাজধানীতে বাস করছি। এমন কি আমরা এতটা স্বার্থপর যে কথায় কথায় বলি, যুদ্ধের পর, নতুন জামা নতুন কাপড়ের কথা ভেবে আমরা উৎফুল্ল হই–অথচ আমাদের সত্যিকার প্রত্যেকটা পাইপয়সা বাঁচানো উচিত, অন্য মানুষজনদের সাহায্য করা উচিত এবং যুদ্ধের পর ধ্বংস হয়েও যেটুকু অবশিষ্ট থাকবে সেটুকু রক্ষা করা উচিত।

বাচ্চারা এখানে ছুটোছুটি করে, গায়ে শুধুমাত্র এটা পাতলা পিরান আর শিলি পরে; না আছে কোট, না আছে টুপি, না আছে মোজা। কেউ তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়ায় না। সব সময় তাদের পেটগুলো পড়ে থাকে, কবেকার শুকনো একটা গাজর দাঁতে কাটতে। কাটতে তারা ক্ষিধের ভেঁচকানি ঠেকিয়ে রাখে। কনকনে ঠাণ্ডা ঘরগুলো থেকে বেরিয়ে তারা যায় কনকনে ঠাণ্ডা রাস্তায়; যখন ইস্কুলে ইস্কুলঘর তার চেয়েও ঠাণ্ডা। দেখ, হল্যাণ্ডের হাল এখন এত খারাপ যে, অসংখ্য ছেলেপুলে রাস্তার লোকদের ধরে এক টুকরো রুটির জন্যে হাত পাতে। যুদ্ধের দরুন মানুষের যাবতীয় দুঃখযন্ত্রণার ওপর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতে পারি। কিন্তু তাতে নিজেকে আমি আরও ম্রিয়মাণ করে তুলব। যতদিন দুঃখের শেষ হয়, ততদিন যথাসম্ভব শান্তচিত্তে অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই। ইহুদীরা আর খ্রিষ্টানরা অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে সারা জগৎ; সেইসঙ্গে বেশ কিছু লোক মৃত্যুর জন্যে দিন গুনছে।

তোমার আনা

.

শনিবার, ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

রাগে টগবগ করে ফুটছি, কিন্তু বাইরে প্রকাশ করব না। ইচ্ছে হচ্ছে পা দাবিয়ে চিৎকার করি, মা-মণিকে আচ্ছা করে ঝাকিয়ে দিই, কান্নায় ফেটে পড়ি, এবং আর কী করব জানি না কারণ, প্রতিদিন আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয় যত সব অকথা-কুকথা, বাঁকা বাঁকা চোখের দৃষ্টি এবং যত রাজ্যের নালিশ, এবং টান করে বাঁধা জ্যা-মুক্ত শরের মত সেগুলো যথাস্থানে লাগে এবং শরীরে বেঁধার মতই সেগুলো তুলে ফেলা আমার পক্ষে কঠিন হয়।

আমি মারগটকে, ফান ডানকে, ডুসেলকে এবং বাবাকেও চিৎকার করে বলতে চাই ‘আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও, আমি যাতে চোখের পানিতে আমার বালিশ না ভিজিয়ে, চোখের জ্বলুনি ছাড়া, মাথা দবদবানি বাদ দিয়ে অন্তত একটি রাত ঘুমোতে পারি। আমাকে নিষ্কৃতি দাও এই সবকিছু থেকে, এই পৃথিবী থেকে হলে সেও বরং ভালো। কিন্তু আমার তা করা চলবে না; ওরা যেন জানতে না পারে যে, আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি; ওদের তৈরি মতিগুলো ওরা যেন দেখতে না পায়, ওদের সমবেদনা আর দয়ালু চিত্তের পরিহাসগুলো আমার সহ্য হবে না, বরং তাতে আমার আরও ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করবে। আমি কথা বললে সবাই মনে করে আমি চালিয়াতি করছি; চুপ করে থাকলে ওরা মনে করে আমি উদ্ভট। জবাব করলে বলে অভদ, ভালো কিছু মাথায় এলে বলে ধূর্ত, ক্লান্ত হয়ে পড়লে বলে আলসে, একগ্রাস বেশি খেলে বলে স্বার্থপর; বলে বোকা, ভীতু, সেয়ানা ইত্যাদি, ইত্যাদি। দিনভর কেবল আমাকে শুনতে হয় আমি নাকি অসহ্য খুকী; অবশ্য আমি এসব নিয়ে হাসি এবং এমন ভাব দেখাই যেন ওসব বললে আমার কিছু হয় না, কিন্তু আলবৎ হয়। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার চেয়ে নিতে ইচ্ছে করে, আলাদা ধরনের প্রকৃতি, যাতে লোকে আমার প্রতি বিমুখ না হয়। কিন্তু তা সম্ভব নয়। আমার যে স্বভাব সেটা আমাকে দেওয়া হয়েছে, নিশ্চয়ই তা খারাপ হতে পারে না। আমি প্রাণপণে সকলের মন রেখে চলতে চেষ্টা করি, সেটা যে কত বেশি। ওরা তা ধারণাও করতে পারবে না। আমি এসব হেসে উড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি, কেননা আমি দুঃখ পাচ্ছি এটা ওদের দেখাতে চাই না। একাধিকবার হয়েছে, অন্যায় ভাবে একগাদা বকুনি খাওয়ার পর আমি চটে গিয়ে মা-মণিকে বলেছি, তুমি কি বলো না বলো আমি থোড়াই কেয়ার করি। আমাকে ছাড়ান দাও; যে যাই করো, আমার কিছু হওয়ার নয়। স্বভাবতই তখন আমাকে বলা হল আমি অসভ্য এবং কার্যত দুদিন ধরে আমাকে দেখেও হল না; এবং তারপর হঠাৎ এক সময়ে বিলকুল ভুলে গিয়ে আমার সঙ্গে অন্য পাঁচজনের মতই ব্যবহার করা হতে লাগল। আজ মুখ মিষ্টি করে, ঠিক পরের দিনই আবার দাতের বিষ ঝেড়ে দেওয়া এ জিনিস আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি বরং বেছে নেব হিরণয় মধ্যপন্থা (অবশ্য সেটা খুব হিরণীয় নয়), চুপচাপ নিজের মনে থাকব, এবং ওরা আমার প্রতি যা করে, সেই রকম ওদের দেখাদেখি জীবনে অন্তত একবার আমিও ওদের প্রতি নাক সিটকে থাকব। ইস্, যদি তা পারতাম!

তোমার আনা।

.

শুক্রবার, ৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩

আদরের কিটি, যদিও আমাদের চিৎকার-চেঁচামেচির ব্যাপারে অনেকদিন কিছু লিখিনি, তাহলেও অবস্থা এখনও যে-কে সেই। অনেক আগেই এই মন-কষাকষি, আমরা মেনে নিয়েছি, কিন্তু মিস্টার ডুসেলের কাছে প্রথম প্রথম এটা একটা সর্বনেশে কাণ্ড বলে মনে হয়েছিল। তবে এখন সেটা তার গা-সহ্য হয়ে আসছে এবং উনি চেষ্টা করেন ও নিয়ে মাথা না ঘামাতে। মারগট আর পেটার, দুজনের কেউই, যাকে তোমরা ‘ছেলেমানুষ’ বলবে, তা নয়। দুজনেই বড় গোমড়ামুখো আর আমি প্রচণ্ড ভাবে ওদের নিলেমন্দ করি এবং আমাকে সব সময় শোনানো হয়, মারগট আর পেটারকে দেখবে কখনো অমন করে না–ওদের দেখে কেন শেখো না? শুনলেই গা জ্বালা করে। তোমাকে বলতে দোষ নেই, মারগটের মতন হওয়ার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। ওরকম কাদার তাল আর ঘাত-কাত মেয়ে আমার পছন্দ নয়; যে যাই বলুক ও শুনবে আর সব কিছুই ঘাড় পেতে মেনে নেবে। আমি শক্ত চরিত্রের মেয়ে হতে চাই। কিন্তু এ সব ধারণার কথা কাউকে বলি না; আমার মনোভাবের ব্যাখ্যা হিসেবে এই প্রসঙ্গ যদি তুলি ওরা আমাকে শুধু উপহাস করবে। খাবার টেবিলে সবাই সাধারণত গুম হয়ে না থাকে, যদিও ভাগ্যক্রমে ‘সুপখোররা রাশ টেনে রাখে বলে কোনো অনাসৃষ্টি ঘটতে পারে না। ‘সুপখোর’ বলতে অফিসের যে লোকগুলো বাড়িতে এলে এক কাপ করে সুপ খেতে পায়। আজ বিকেলে মিস্টার ফান ডান ইদানীং মারগটের কম খাওয়া নিয়ে আবার বলছিলেন। সেই সঙ্গে ওকে খেপাবার জন্যে বললেন, ‘তুমি বুঝি তন্বী হতে চাইছ।’ মারগটের পক্ষ নেবার ব্যাপারে মা-মণি সব সময়ে এক পায়ে খাড়া। উনি ফোস করে উঠলে, আপনার বোকা-বোকা কথা আমার আর সহ্য হয় না।’ মিস্টার ফান ডানের কান লাল হয়ে উঠল, সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তার বারোধ হয়ে গেল। আমরা অনেক সময় এটা-সেটা নিয়ে হাসাহাসি করি; এই কয়দিন আগেই মিসেস ফান ডান এমন কথা বললেন যার একেবারেই মানে হয় না। তিনি অতীতের কথা বলছিলেন, ওর বাবার সঙ্গে ওঁর কত সুন্দর বনিবনা ছিল এবং উনি কি রকম বখা মেয়ে ছিলেন। উনি বলে গেলেন, আর বুঝলে, আমার বাবা আমাকে শেখাতেন, যদি দেখ কোনো পুরুষ মানুষ একটু বেশি রকম গায়ে পড়তে চাইছে, তুমি তাকে অবশ্যই বলবে, ‘দেখুন, মিস্টার অমুক, মনে রাখবেন আমি এজন ভদ্রমহিলা’। তাহলেই লোকটি বুঝবে তুমি তাকে কী বলতে চাইছ। আমরা মনে করলাম চমৎকার একটা হাসির কথা আর হো-হো করা হাসিতে ফেটে পড়লাম। পেটার সচরাচর চুপচাপ থাকলেও মাঝে মাঝে বেশ হাসির খোরাক যোগায়। বিদেশী শব্দ ব্যবহারের। দিকে ওর এমনিতেই খুব ঝোক। কোন শব্দের কী অর্থ অনেক সময়েই ও অবশ্য তা জানে না। একদিন বিকেলে অফিস ঘরে বাইরের লোক থাকায় আমরা পায়খানামুখো হতে পারিনি। এদিকে পেটারের এমন অবস্থা যে আর তর সয় না, সুতরাং ও আর হুড়কো দেওয়ার। মধ্যে গেল না। আমাদের জানান দেওয়ার জন্যে ও করল কী–পায়খানার দরজায় একটা নোটিশ লিখে লটকে দিল–এস.ভি.পি. গ্যাস। ও লিখেছিল এই মনে করে সাবধান, গ্যাস’। ও ভেবেছিল এটা লিখলে আরও সভ্য দেখাবে। বেচারার ধারণাই ছিল না এস.ভি.পি-র মানে হল–গ্রহণ করে কৃতার্থ করুন।’

তোমার আনা

শনিবার ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৩

আদরের কিটি, পিম আশা করেছেন যে কোনদিন আক্রমণাভিযান শুরু হবে। চার্চিলের নিউমোনিয়া হয়েছে, আস্তে আস্তে সেরে উঠছেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতাপ্রেমিক গান্ধী এইবার নিয়ে কতবার যে অনশন করলেন। মিসেস ফান ডান দাবি করেন তিনি অদৃষ্টে বিশ্বাসী। কামান থেকে যখন গোলা ছোড়া হয়, তখন কে সবচেয়ে বেশি ভয়ে কেঁচো হয়ে যায়? পেট্রোনেলা।

গির্জায়-যাওয়া লোকদের কাছে লেখা বিশপের চিঠির একটা কপি হেংক এনেছিলেন। আমাদের পড়াবার জন্যে। চিঠিটা বড় সুন্দর এবং পড়ে প্রেরণা জাগে। নেদারল্যাণ্ডসের মানুষ, গা এলিয়ে বসে থেকো না। প্রত্যেকে তার দেশ, দেশের মানুষ আর তাদের ধর্মের স্বাধীনতার জন্যে নিজস্ব অস্ত্রে লড়ছে।’ গীর্জার বেদী থেকে তারা সোজাসুজি বলছে, সাহায্য দাও, দরাজ হও এবং আশা হারিও না।’ কিন্তু ওতে কি ফল হবে? আমাদের ধর্মের লোকদের বেলায় ওতে কাজ হবে না।

আমাদের এখন কী দশা হয়েছে তুমি ধারণায় আনতে পারবে না। এ বাড়ির মালিক ক্রালার আর কুপহুইসকে না জানিয়ে বাড়িটা বেচে দিয়ে বসে আছে। নতুন মালিক একদিন সকালে সঙ্গে একজন স্থপতিকে নিয়ে বাড়িটা দেখাবার জন্যে দুম করে এসে হাজির। ভাগ্যিস, মিস্টার কুপহুইস তখন উপস্থিত ছিলেন এবং ‘গুপ্তমহল’টা বাদ দিয় বাকি সবটাই তিনি ভদ্রলোককে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। কুপহুইস এমন ভাব দেখান যেন ওপাশে যাওয়ার যে দরজা তার চাবিটা আনতে তিনি ভুলে গেছেন। নতুন মালিক ও নিয়ে আর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেননি। ভদ্রলোক যতদিন না আবার ফিরে এসে ‘গুপ্তমহল’টা দেখতে চাইছেন ততদিন সব ঠিক আছে–কেননা দেখতে চাইলেই তো চিত্তির।

বাপি আমার আর মারগটের জন্যে একটা কার্ড-ইনডেক্স বক্স খালি করে তাতে কার্ড ভরে দিয়েছেন। এটা হবে বই বিষয়ক কার্ড প্রণালী; এরপর আমরা দুজনেই লিখে রাখব কোন কোন বই পড়লাম বইগুলো কার কার লেখা ইত্যাদি। বিদেশী ভাষার শব্দ টুকে রাখার জন্যে আমি আরেকটা খাতা যোগাড় করেছি।

ইদানীং মা-মণি আর আমি আগের চেয়ে নিয়ে চলতে পারছি, কিন্তু এখনও আমরা পরস্পরের কাছে মনের কথা বলি না। মারগট এখন আগের চেয়েও বেশি হিংসুটে এবং বাপি কিছু একটা চেপে যাচ্ছেন, তবে বাপি আগের মতই মিষ্টি মানুষ।

খাবার টেবিলে মাখন আর মারগারিনের নতুন বরাদ্দ হয়েছে। প্রত্যেকের পাতে ছোট্ট এক টুকরো চর্বি রাখা থাকে। আমার মতে, ফান ডানেরা মোটেই ঠিক ন্যায্যভাবে ভাগগুলো করেন না। আমার মা-বাবা এ নিয়ে কিছু বলতে ভয় পান, কেননা বললেই একটা কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে। খুব দুঃখের কথা। আমি মনে করি ওসব লোকদের বেলায় যেমন কর্ম তেমনি ফল হওয়াই উচিত।

তোমার আনা।

বুধবার, ১০ মার্চ, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

কাল সন্ধ্যেবেলায় ইলেকট্রিকের তার জ্বলে গিয়েছিল। তার ওপর সারাক্ষণ দমাদ্দম কামান ফাটার আওয়াজ। গোলাগুলি আর প্লেন-ওড়া সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপারে আমার ভয় এখনও আমি কাটিয়ে উঠিতে পারিনি; ফলে প্রায় রোজ রাতেই আমি ভরসার জন্যে বাপির বিছানায় গুঁড়ি মেরে ঢুকে পড়ি। এটা যে ছেলেমানুষি আমি তা জানি, কিন্তু সে যে কী জিনিস তুমি জানো না। বিমানে গোলা-ছেড়া কামানের প্রচণ্ড গর্জনে নিজের কথাই নিজে শোনা যায় না। মিসেস ফান ডান এদিকে অদৃষ্টবাদী, কিন্তু তিনি প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কি। বেজায় কাঁপা কাচা ক্ষীণ গলায় বললে, ‘ওঃ, এত বিতকিচ্ছিরি! আঃ, এত দমাদ্দমভাবে গোলাগুলি ছুঁড়ছে, এই বলে আসলে উনি বোঝাতে চান ‘আমার কী যে ভয় করছে, কী বলব।’

মোমবাতির আলোয় যত, অন্ধকারে তার চেয়ে ঢের বেশি খারাপ লাগে। আমি থর থর করে কাপছিলাম, ঠিক যেন আমার জ্বর হয়েছে। করুণ গলায় বাপিকে বললাম মোমবাতিটা আবার জ্বেলে দিতে। বাবাকে নড়ানো গেল না; আলো নেভানোই রইল। হঠাৎ একদফা মেশিনগান কড় কড় করে উঠল, তার আওয়াজ গোলাগুলির চেয়েও দশগুণ বেশি কান-ফাটানো। সেই শুনে মা-মণি বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে মোমবাতি জ্বেলে দিলেন। বাপি খুব বিরক্ত হলেন। তার আপত্তি উত্তরে মা-মণি বললেন, ‘যত যাই হোক, আনা তো আর ঠিক পাকাঁপোক্ত সৈনিক নয়।’ ব্যস, ঐ পর্যন্ত।

মিসেস ফান ডানের অন্য ভয়গুলোর কথা তোমাকে আমি বলেছি কি? বুলিনি বোধ হয়। ‘গুপ্তমহলে’র সব ঘটনা সম্পর্কে তোমাকে যদি আমার ওয়াকিবহাল রাখতে হয়, তাহলে এ ব্যাপারটাও তোমার জেনে রাখা দরকার। এক রাতে মিসেস ফান ডানের মনে হল তিনি চিলেকোঠায় সিঁদেল-চোরের আওয়াজ পেয়েছেন; তাদের পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে উনি ওর স্বামীকে জাগিয়ে দিলেন। ঠিক তক্ষুনি সিঁদেল-চোরেরা হাওয়া এবং মিস্টার ফান ডান সেই ভয়তরাসে অদৃষ্টবাদী মহিলার বুক ধড়ফড় করার আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলেন না। ‘ও পুট্টি (মিস্টার ফান ডানের ডাক নাম), ওরা নিশ্চয় আমাদের সসেজ আর সমস্ত কড়াইশুঁটি আর বিন নিয়ে চলে গেল। আর পেটার নিরাপদে বিছানায় শুয়ে আছে কিনা তাই বা কে জানে?’ ‘পেটারকে ওরা নিশ্চয় ঝোলার মধ্যে পুরে নিয়ে যাবে না। বলছি, কথা শোনো–ওসব নিয়ে ভেবো না। আমাকে বুঝতে দাও।’ কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না। ভয়েময়ে মিসেস ফান ডান সে রাত্তিরে আর দুই চোখের পাতা এক করতে পারলেন না। তার কয় রাত পরে ভূতুড়ে শব্দ শুনে ফান ডানদের পরিবারের সকলেরই ঘুম ভেঙে যায়। হাতে টর্চ নিয়ে পেটার চিলেকোঠায় যেতেই–খুসুরমুসুর আর খসুরমুসুর! ছুটে ছুটে কী পালাচ্ছিল বলো তো? ইয়া ইয়া একপাল ধেড়ে ইঁদুর। যখন আমরা জেনে ফেললাম চোরের দল কারা, তখন মুশ্চিকে আমরা চিকেকোঠায় শুতে দিলাম ব্যস, তারপর আর অনাহুত অতিথিরা ফিরে ওমুখো হয়নি। অন্তত রাতের বেলা।

দিন দুই আগে সন্ধ্যেবেলায় পেটার সিঁড়ির ঘরে উঠেছিল কিছু পুরনো কাগজ আনতে। কলআঁটা দরজাটা শক্ত করে ধরে ধাপে ধাপে ওর নামবার কথা। না তাকিয়ে যেই ও হাত দিয়ে চেপেছে হঠাৎ আচমকা ব্যথা পেয়ে সিঁড়ি থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। নিজের অজান্তে একটা বড় ধেড়ে ইঁদুরের গায়ে হাত পড়ে যাওয়ায় ইঁদুরটা মোক্ষমভাবে তাকে কামড়ে দেয়। ও যখন আমাদের কাছে এসে পৌঁছল, তখন ও কাগজের মত সাদা, হাটু দুটো ঠকঠক করে কাঁপছে, ওর পাজামা রক্তে ভিজে গেছে। আসলে তা হওয়ারই কথা; বড় ধেড়ে-ইঁদুরের গায়ে থাবা দেওয়া, কাজটা খুব মনোরম নয়; আর তার দরুন কামড় খাওয়া সত্যিই ভয়ঙ্কর ব্যাপার।

তোমার আনা।

শুক্রবার, ১২ মার্চ, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

তোমার সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দিই; ইনি হলেন মা-ঠাকুরন ফ্রাঙ্ক, তারুণ্যের রক্ষাকর্তা। তরুণদের জন্যে বাড়তি মাখন; আধুনিক তরুণ-তরুণীদের সমস্যা; সব কিছুতেই মা-মণি তরুণ-তরুণীদের হয়ে লড়েন এবং খানিকটা টানা-হেঁচড়া করে শেষপর্যন্ত সব সময়ই নিজের গো বজায় রাখেন। একটা বোতলে শোলমাছ রাখা ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে গেছে; মুশ্চি আর বোখার তাতে ভালো ভোজ হবে। বোখাকে এখনও তুমি দেখনি অবশ্য আমরা অজ্ঞাতবাসে আসার আগে থেকেই ও এখানে ছিল। ও হল গুদামের আর অফিসের বেড়াল; গুদামঘরগুলোতে ইঁদুরদের ও ঢিট রাখে। ওর বেয়াড়া ধরনের রাজনৈতিক নামের একটা ব্যাখ্যা দরকার। কিছুকাল কোম্পানির ছিল দুটো বেড়াল; গুদামের জন্যে একটা আর চিলেকোঠার জন্যে একটা। মাঝে মাঝে হত কী, দুই বেড়ালের দেখা হত; আর তার ফলে দুজনের হত ভয়াবহ লড়িই। গুদামের বেড়ালটাই সবসময় আগে ঝাপিয়ে পড়ত; এ সত্ত্বেও চিলেকোঠার বেড়ালটাই কী করে যেন জিতে যেত–দেশজাতের লড়াইতে ঠিক যেমন হয়।

কাজেই গুদামের বেড়ালটার নাম দেওয়া হয়েছিল জার্মান বা ‘বোখা’; আর চিলেকোঠার বেড়ালের নাম দেওয়া হয়েছিল ইংরেজ বা টমি। পরে টমিকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল; আমরা নিচের তলায় গেলে বোখা আমাদের আপ্যায়ন করে।

কিড়নি বিন আর হ্যারিকিট বিন খেয়ে খেয়ে আমাদের এমন অরুচি ধরে গেছে যে এখন ওসব আমার দুই চক্ষের বিষ। এমনকি মনে হলেও আমার গায়ের মধ্যে পাক দেয়। সন্ধ্যেবেলায় এখন আর পাউরুটি দেওয়া হয় না। বাবা এইমাত্র বললেন ওঁর মেজাজ ভালো নেই। ওঁর চোখ দুটো আবার এত বিষন্ন দেখাচ্ছে–বেচারা!

একটা বই পড়ছি। দরজায় কে কড়া নাড়ে’। লেখক ইনা বোড়িয়া বাকার। বইটা একদণ্ড ছাড়তে পারছি না। পরিবারের কাহিনীটা অসাপ্রারণভাবে লেখা হয়েছে। তাছাড়া এতে আছে যুদ্ধ, লেখকদের জীবন, স্ত্রী স্বাধীনতা; এবং সত্যি বলতে, ওসবে আমার অতটা আগ্রহ নেই।

জার্মানির ওপর হয়েছে ভয়াবহ বিমান হামলা। মিস্টার ফান ডানের মেজাজ বিগড়ে আছে; কারণ-সিগারেটের অভাব। টিনের সব্জি আমরা ব্যবহার করব কি করব না, এ নিয়ে আলোচনায় রায় হল আমাদের পক্ষে।

মাত্র একজোড়া জুতোয় আর আমার চলছে না। স্কি-বুট আছে বটে, কিন্তু বাড়ির মধ্যে ওতে তেমন কাজ হয় না। ৬.৫০ ফ্লোরিনে কেনা একজোড়া আটপৌরে চটি আমার পায়ে মাত্র এক হপ্তার বেশি গেল না, এখন ওটা পরার বাইরে। মিপ হয়ত চোরাপথে কিছু একটা জুটিয়ে আনবেন। আমাকে বাপির চুল ছাটতে হবে। পিম্ এখনও বলে যাচ্ছেন যে, আমি নাকি চুল ছাঁটার কাজে এতই পোক্ত যে, যুদ্ধের পর উনি কখনই আর দোস্রা কোনো নাপিতের কাছে যাবেন না। তাও যদি প্রায়ই ওঁর কানে খোঁচা লাগিয়ে না দিতাম।

তোমার আনা।

বৃহস্পতিবার, ১৮ মার্চ, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

তুরস্ক লড়াইতে যোগ দিয়েছে। দারুণ উত্তেজনা। খবরটার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

তোমার আনা।

শুক্রবার, ১৯ মার্চ, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

এক ঘণ্টা পরে হরিষে বিষাদ ঘটল। তুরস্ক এখনও যুদ্ধে যোগ দেয়নি। শুধু ওদের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য কথাপ্রসঙ্গে বলেছে যে তাদের শীগগিরই নিরপেক্ষতা বিসর্জন দিতে হবে। ড্যামে (রাজপ্রাসাদের সামনের একটি চক) একটি কাগজ নিয়ে হকার চেঁচাচ্ছিল, ‘ইংলণ্ডের পক্ষে তুরস্ক’। লোকটার হাত থেকে কাগজগুলো লোকে ছিনিয়ে নেয়। সুসংবাদটা এমনি। ভাবে আমাদের কানে পৌঁছে যায়; ৫০০ আর ১০০০ গিল্ডারের নোট বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কালোবাজারী এবং ঐ ধরনের লোক, তবে তার চেয়েও বেশি যাদের হাতে অন্য রকমের ‘কালো’ টাকা আছে, আর সেই সঙ্গে যারা আত্মগোপন করে আছে তাদের। কাছে এটা একটা ধরা পড়ার ফাদ। তুমি যদি একটা ১০০০ গিল্ডারের নোট নিয়ে যাও, তোমাকে কবুল করতে এবং প্রমাণ করতে সক্ষম হতে হবে যে, ঠিক কিভাবে তুমি নোটটা পেয়েছ। ঐ নোটে এখনও ট্যাক্স জমা দেওয়া যাবে, তবে মাত্র পরের সপ্তাহ অব্দি। ডুসেল একটা সেকেলে পায়ে চালানো ডেন্টিস্টের ঘুরণ-কল পেয়েছেন, আশা করছি উনি শীগগিরই একবার আমাকে আদ্যোপান্ত পরীক্ষা করে দেখবেন। সর্বজার্মানের নেতা, ফুয়ার আলার গেৰ্মানেন, আহতদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কান পেতে তা শোনা কষ্টকর। সওয়াল-জবাব হচ্ছিল এইভাবে

‘আমার নাম হাইনরিশ শেপেল।

‘জখম হয়েছ কোথায়?’

‘স্তালিনগ্রাদের কাছে।’

‘আঘাত কী ধরনের?’

‘দুটো পা ঠাণ্ডায় জমে খসে গেছে এবং বাম বাহুর সন্ধির হাড় ভেঙে গেছে।’

রেডিওতে ভয়াবহ পুতুল নাচের চিত্রটা ছিল হুবহু এই রকম। মনে হচ্ছিল আহত লোকগুলো তাদের জখমের জন্যে গর্বিত আঘাত যত বেশি হয় তত ভালো। ওদের একজন ফুলারের সঙ্গে করমর্দন করতে পেরে (অবশ্য করমর্দন করার হাত তখনও যদি তার থেকে থাকে।) ভাবাবেগে এতই গদগদ যে, মুখ দিয়ে তার শব্দ যেন বেরোচ্ছিল না।

তোমার আনা।

বৃহস্পতিবার, ২৫ মার্চ, ১৯৪৩

আদরের কিটি, কাল মা-মণি, বাপি, মারগট আর আমি একসঙ্গে হয়ে খোশমেজাজে বসে আছি, পেটার হঠাৎ এসে বাপির কানে ফিসফিস করে কী যে বলল। আমি এই রকমের কিছু শুনলাম একটা পিপে আড়তে গড়িয়ে পড়েছে এবং কেউ একজন কাছে এসে হাতড়াচ্ছে। মারগটের কানেও সেটা গেছে। বাপি আর পেটার তৎক্ষনাৎ চলে গেল; তখন মারগট এসে আমাকে খানিকটা শান্ত করার চেষ্টা করল, কেননা স্বভাবতই আমার মুখ কাগজের মতন সাদা হয়ে গিয়েছিল আর আমি একটুতেই ভয়ে চমকে চমকে উঠছিলাম।

আমরা তিন মায়ে ঝিয়ে টান-টান হয়ে অপেক্ষা করছি। দু-এক মিনিট পরে মিসেস ফান ডান ওপরে এলেন; অফিসের খাসকামরায় বসে তিনি রেডিও শুনছিলেন। উনি বললেন পিম্ এসে তাকে বলেছেন রেডিও বন্ধ করে দিয়ে চুপিসাড়ে ওপরে চলে যেতে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কি রকম হয় তোমরা জানো। যত তুমি আস্তে চলতে চাও, প্রত্যেক ধাপে পুরনো ঝরঝরে সিঁড়িতে ক্যাচ কোচ করে শব্দ হয় যেন দ্বিগুণ। পাঁচ মিনিট পরে বাপি আর পেটারের আবার দেখা মিলল। ওদের চুলের গোড়া পর্যন্ত ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ওরা ওদের অভিজ্ঞতার কথা বলল।

সিঁড়ির নিচে লুকিয়ে থেকে ওরা কান খাড়া করে ছিল। প্রথমে কোনো ফল পাওয়া যায়নি। কিন্তু হঠাৎ, হ্যাঁ, তোমাকে বলা দরকার, ওরা দুটো ধুমধাড়াক্কা আওয়াজ পায়, ঠিক যেন এ বাড়ির দুটো দরজায় কে বা কারা ধাক্কা দিচ্ছে। পিম্ এক লাফে ওপরে চলে আসেন, পেটার গিয়ে প্রথমে ডুসেলকে সাবধান করে দেয়, ডুসেল একগাদা ধুপধাপ আওয়াজ করে কোনো রকমে তো শেষটায় ওপরতলায় এসে হাজির হলেন। এরপর আমরা সকলে মিলে মোজা-পরা অবস্থায় এর পরের তলায় ফান ডানদের ডেরায় এসে জমা হলাম। মিস্টার ফান ডানের বেজায় ঠাণ্ডা লেগে যাওয়ায় আগেই উনি বিছানায় শুয়ে পড়েছিলেন। সুতরাং আমরা সবাই ওর বিছানা ঘিরে ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে বসে ওঁকে আমাদের সন্দেহের কথা বললাম।

মিস্টার ফান ডান যতবারই জোরে কেশে ওঠেন, ততবারই মিসেস ফান ডান ভয় পেয়ে অজ্ঞান হওয়ার যোগাড় হন। এই রকম চলতে থাকার পর একজনের মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল যে, ওঁকে খানিকটা কোডিন খাওয়ানো যাক। ব্যাস, তাতেই সঙ্গে সঙ্গে কাশির উপশম হল। তারপর আবার ঠায় চলল আমাদের অপেক্ষা করে থাকার পালা। কিন্তু আর কোনো আওয়াজ পেয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা সবাই এই সিদ্ধান্তে এলাম যে, এমনিতে নিশ্ৰুপ বাড়িটাতে পায়ের শব্দ কানে যেতেই চোরের দল পিঠটান দিয়েছে।

কিন্তু এটা হওয়া উচিত হয়নি যে, নিচের তলার রেডিওতে তখনও ছিল ইংলণ্ডের স্টেশন ধরা এবং রেডিওর চার পাশে সুন্দর ভাবে চেয়ারগুলো সাজানো। দরজা ভেঙে ঢুকে এ-আর পির লোকদের যদি সেটা নজরে পড়ত এবং পুলিসকে তারা যদি খবর দিত, তাহলে তার ফল হত খুবই খারাপ। সুতরাং মিস্টার ফান ডান উঠে পড়ে কোট আর টুপি চাপিয়ে বাপির পিছু পিছু পা টিপে টিপে নিচে চললেন, পেছনে রইল পেটার বলা যায় না, হঠাৎ যদি দরকার হয়, সেই জন্যে তার হাতে বড় গোছের একটা হাতুড়ি। ওপর তলার মহিলারা (মারগট আর আমি সমেত) দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। যাক, মিনিট পাঁচেক পরে ভদ্রলোকের দল ফিরে এসে খবর দিলেন বড়িতে এখন আর কোনো ঝামেলা নেই।

আমরা ঠিক করেছিলাম যে, পায়খানায় আমরা পানি দেব না এবং হুড়কো লাগাব না। কিন্তু উত্তেজনার দরুন আমাদের বেশির ভাগেরই পেটে চাপ পড়ায় আমরা একে একে যখন সেখানে হাজিরা দিয়ে এলাম, তুমি কল্পনা করতে পারো তার ফলে আবহাওয়ার অবস্থাটা কী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

যখন ঐ ধরনের কিছু ঘটে, তখন আরও গুচ্ছের জিনিস যেন সব একসঙ্গে এসে হাজির হয়, যেমন এখন হচ্ছে। এক নম্বর হল, ভেস্টার-টোরেনের যে ঘড়ির টং টং শুনলে সব সময় আমার ধড়ে প্রাণ আসে, সেটা বাজেনি। দু নম্বর হল, মিস্টার ফোসেন আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় অন্যান্য দিনের চেয়ে আগেভাগে চলে যাওয়ায় আমরা এটা জানি না যে এলি ঠিক চাবিটা নিতে পেরেছিল কিনা এবং হয়ত বা দরজা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিল। রাত্তির বলতে তখনও সন্ধ্যে এবং আমরা তখনও সন্দেহের দোলায় দুলছি; অবশ্য এটা ঠিক যে, তখন সিঁদেল-চোরের ভয়ে বাড়িটা তটস্থ হয়ে ছিল, তখন সেই আটটার কাছাকাছি সময় থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত আর কোনো আওয়াজ না পেয়ে মনে মনে আমরা একটু আশ্বস্ত হয়েছিলাম। আরও একটু ভেবে দেখার পর আমরা সাব্যস্ত করলাম–রাস্তায় তখনও যেহেতু লোক চলাচল করছে, সেইহেতু সন্ধ্যের অত গোড়ায় গোড়ায় চোর এসে দরজা ভেঙে ঢুকবে এটা স্বাভাবিক নয়। তাছাড়া আমাদের মধ্যে একজনের মাথায় এল, আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে যে, পাশের বাড়ির গুদামের তত্ত্বাবধায়ক তখনও কাজ করছিল, কেননা উত্তেজনার মাথায় এবং দেয়ালগুলো পাতলা হওয়ায় খুব সহজেই কেউ ভুল করে বসতে পারে এবং তার। চেয়েও বড় কথা, এই ধরনের সঙ্কটজনক সময়ে অনেক কিছুই নিছক কল্পনায় ঘটে যেতে পারে।

সুতরাং আমরা সবাই শুতে চলে গেলাম; কিন্তু কারো চোখেই ঘুম এল না। বাপির সঙ্গে মা-মণি আর মিস্টার ডুসেল জেগে রইলেন এবং একটুও বাড়িয়ে বলছি না, আমিও এক ফোঁটা ঘুমোইনি বললেই হয়। আজ সকালে বাড়ির পুরুষ মানুষেরা নিচের তলায় গিয়ে দেখে এলেন সদর দরজা তখনও বন্ধ কিনা। দেখা গেল, সব কিছু নিরাপদ। আমরা সেই হাত-পা। হিম করে দেওয়া ঘটনার কথা জনে জনে বিস্তারিতভাবে বললাম। ওরা তাই নিয়ে মজা। করল, অবশ্য পরে ওসব জিনিস নিয়ে হাসাহাসি করা সহজ। একমাত্র এলি আমাদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন।

তোমার আনা।

শনিবার, ২৭ মার্চ, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

আমাদের শর্টহ্যাণ্ডের পাঠক্রম শেষ হয়েছে; এবার আমরা লিখে স্পীড তোলার চেষ্টা করছি। আমরা বেশ চালাক চতুর হয়ে উঠছি না কি? তোমাকে আরেকটু বলব আমার কালক্ষয়ী বিষয়গুলো সম্বন্ধে (নামটা আমার দেওয়া, কেননা দিনগুলো যথাসম্ভব দ্রুত পার করে দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই–যাতে এখানকার মেয়াদ তাড়াতাড়ি শেষ হয়); পুরাণ বলতে আমি পাগল, বিশেষ করে গ্রীস আর রোমের দেবদেবী। এখানে ওঁরা মনে করেন দুদিনের শখ; নইলে আমার বয়সী কোনো নাবালক পুরাণে আসক্ত, এ জিনিস বাপের জন্মে ওঁরা শোনেননি। বহুৎ আচ্ছা, আমি না হয় প্রথমই হলাম।

মিস্টার ফান ডানের সর্দি, বরঞ্চ বলা ভালো গলায় ওঁর ছোট বীজ কুঁড়ি হয়েছে। তাই নিয়ে উনি চব্বর বাধিয়ে দিয়েছেন। ক্যামোমিল পানিতে ফুটিয়ে তাই দিয়ে গাৰ্গলিং, টিংচার অব মির দিয়ে গলায় পেণ্ট করা, বুকে নাকে, দাঁতে আর জিভে ইউক্যালিপ্টাস মালিশ করা; এবং এত কিছু করার পরও সেই প্যাঁচার মত মুখ করে থাকা।

এক জার্মান চাই রাইটার এক বক্তৃতা দিয়েছে। ১লা জুলাইয়ের আগে সমস্ত ইহুদীদের মার্জান-অধিকৃত দেশগুলো থেকে হটাবাহার হতে হবে। ১লা এপ্রিল থেকে ১লা মে-র মধ্যে উট্রেট প্রদেশ পরিষ্কার করে ফেলতে হবে (যেন ইহুদীরা হল আরশোলা)। ১লা মে থেকে ১লা জুনের মধ্যে উত্তর আর দক্ষিণ হল্যাণ্ড।’ এই হতভাগা মানুষগুলোকে একপাল রুগ্ন অবজ্ঞাত গরুছাগলের মতন নিঘিন্যে কশাইখানায় পাঠানো হচ্ছে।

একটা ছোট্ট ভালো খবর হল, অন্তর্ঘাতকেরা শ্রমিক বিনিময়ের জার্মান বিভাগে আগুন লাগিয়েছে। তার দিনকয়েক পর রেজিস্ট্রারের দপ্তরেরও একই হাল হয়। জার্মান পুলিসের উর্দি পরে তারা কোনোরকমে পাহারাদারদের বেঁধে ফেলে গুরুত্বপূর্ণ দলিল দস্তাবেজ নষ্ট করে দেয়।

তোমার আনা।

বৃহস্পতিবার, ১ এপ্রিল, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

আমি কিন্তু সত্যিই এপ্রিল-ফুল করছি না (তারিখটা দেখ), বরং তার উল্টো; আমি আজ স্বাচ্ছন্দে বলতে পারি সেই প্রবাদ–’বিপদ কখনও একা আসে না।’ প্রথমে ধর, মিস্টার কুপহুইস, যিনি সব সময় আমাদের উৎফুল্ল রাখেন, তার পেট থেকে রক্ত পড়েছে; কম করে তিন সপ্তাহ তাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত, এলির হয়েছে ইনফ্লুয়েঞ্জা। তৃতীয়ত, আসছে সপ্তাহে মিস্টার ফোসেন যাচ্ছেন হাসপাতালে। ওঁর বোধ হয় তলপেটে আলসার হয়েছে। এবং চতুর্থত, কিছু জরুরী ব্যবসায়িক কথা হবে, যার প্রধান প্রধান বিষয় মিস্টার কুপহুইসের সঙ্গে বাপি আগেই বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করে রেখেছিলেন, কিন্তু এখন আর মিস্টার ক্রালারের সঙ্গে সে সব কথা আদ্যোপান্ত খোলাসা করে বলার সময় নেই।

যে ভদ্রলোকদের আসার কথা ছিল তারা যথাসময়ে এসে গেছেন। ওঁরা আসার আগে থেকেই কথাবার্তা কেমন হয় এই নিয়ে বাবা দুশ্চিন্তায় ছটফট করছিলেন। উনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিলেন, ‘ইস্, আমি যদি ওখানে থাকতে পারতাম আমি নিজে যদি একতলায় থাকতে পারতাম।’ ‘যাও না, মেঝেতে এক কান চেপে শুয়ে পড়, তাহলেই সব শুনতে পাবে।‘ বাপির মুখের ওপর থেকে মেঘ কেটে গেল। কাল সাড়ে দশটায় মারগট আর বাপি (একটা কানের চেয়ে দুটো কান প্রশস্ত) মেঝের ওপর যে যার জায়গা বেছে সটান লম্বা। হলেন। সকালের কথাবার্তা শেষ হল না, কিন্তু বিকেলে বাপির শরীরের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ায় কান-পাতার অভিযানে তাকে ইস্তফা দিতে হল। এ রকম অস্বাভাবিক আর অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে পড়ে থাকার ফলে বাপির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ প্রায় অসাড় হয়ে গেল। যাতায়াতের রাস্তাটাতে গলার আওয়াজ পাওয়া মাত্র আড়াইটের সময় আমি বাপির জায়গা নিলাম। মারগট আমার সঙ্গে রইল। মাঝে মাঝে কথাবার্তাগুলো এতই তানানানা তানানানা করে চলছিল এবং এতই ক্লান্তিকর হচ্ছিল যে, ঠাণ্ডা শক্ত লিনোলিয়ামের মেঝেতে হঠাৎ আমি একদম ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মারগটের সাহস হয়নি আমার গায়ে হাত দিয়ে ডাকার, পাছে ওরা টের পেয়ে যায়–কথা বলার তো প্রশ্নই ওঠে না। বেশ আধঘণ্টা ঘুমোবার পর জেগে উঠে আমার মুখ শুকিয়ে গেছে–হায় রে, অমন জরুরী আলোচনার এক বর্ণও যে আমার মনে নেই। বরাত ভালো, মারগট ঢের বেশি মন দিয়ে সব শুনেছিল।

তোমার আনা।

শুক্রবার ২ এপ্রিল, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

মরেছি! আমার নামের পাশে আরেকটা কালো ঢেঁড়া পড়েছে। কাল সন্ধ্যেবেলায় আমি বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করছি বাপি এসে স্তোত্র পড়িয়ে আমাকে শুভরাত্রি বললেন। এমন সময় মা-মণি আমার ঘরে ঢুকে বিছানায় বসে খুব সস্নেহে বললেন, ‘আনা, বাপি এক্ষুনি আসতে পারছেন না, আজ রাত্তিরে তুমি কি আমার সঙ্গে স্তোত্র বলবে?’ আমি উত্তর দিলাম, ‘না, মা-মণি।’

মা-মণি উঠে পড়ে এক মুহূর্ত আমার বিছানার পাশে এসে থেমে আস্তে আস্তে দরজার দিকে হেঁটে চললেন। তারপর হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মুখটাকে পাচার মত করে বললেন, ‘আমি রাগ করিনি। ভালবাসা জোর করে হয় না।’ বলে ঘর ছেড়ে বেরোবার সময় দেখলাম ওঁর চোখে টস্টস্ করছে পানি।

আমি স্থির হয়ে বিছানায় শুয়ে রইলাম, তক্ষুনি এটা অনুভব করতে পারলাম যে মা মণিকে আমার অমন রূঢ়ভাবে দূরে ঠেলে দেওয়াটা জঘন্য কাজ হয়েছে। কিন্তু আমি এও জানতাম, ও ছাড়া আর কোনো উত্তর আমি দিতে পারতাম না। দিয়ে কোনো ফল হত না। মা-মণির কথা ভেবে আমার খুব কষ্ট হল। কত যে কষ্ট হল বলার নয়। কেননা জীবনে এই প্রথম দেখলাম আমাকে মুখ ফেরাতে দেখে উনি সেটা গায়ে মাখছেন। যখন উনি ভালবাসা জোর করে না হওয়ার কথা বলছিলেন তখন আমি ওর মুখে দেখেছিলাম দুঃখের ছাপ।

সত্যি কথা বললে কড়া শোনায়, তবু সেটাই তো সত্যি। উনি নিজেই আমাকে দূরে ঠেলেছেন; ওঁর অবিবেচক সব মন্তব্য, যাতে আমার আদৌ হাসি পায় না এমন সব বদরসিকতা–এ সবের ফলে আমার মনের মধ্যে ঘঁটা পড়ে গেছে; এখন আর ওঁর দিকের কোনো ভালোবাসা আমার মনে সাড়া দেয় না।

ওঁর কড়া কড়া কথায় আমি যেন সিটিয়ে যাই, ওঁরও মনের মথ্যেটা সেই রকম করে উঠেছিল যখন উনি জানলেন যে আমাদের মধ্যে ভালবাসা নেই। অর্ধেক রাত অবধি উনি কান্নাকাটি করেছেন এবং সারা রাত ঘুমোননি বললেই হয়। বাপি আমার দিকে তাকান না, আর যদিও বা একদণ্ড তাকান, আমি দেখতে পাই, ওঁর চোখে লেখা আছে–তুমি কী করে ‘এত নিষ্ঠুর হতে পারো, কী করে তুমি প্রাণে ধরে তোমার মায়ের মনে এতটা দুঃখ দিতে পারো?’

ওঁরা আশা করছেন আমি ক্ষমা চেয়ে নেব; কিন্তু এটা এমন যে, এর জন্যে আমি ক্ষমা চাইতে পারি না। কেননা আমি সত্যি কথা বলেছি এবং আজ হোক কাল হোক, যে-কোন প্রকারে মা-মণিকে সেটা জানতেই হবে। মনে করা হচ্ছে মা-মণির চোখের পানি আর বাপির চাহনি আমি দেখেও দেখছি না–কথাটা ঠিক; তার কারণ, আমি যা বরাবর অনুভব করে এসেছি, সে সম্বন্ধে ওঁদের এই প্রথম হুশ হয়েছে। মা-মণির জন্যে এই ভেবে আমার দুঃখ না হয়ে পারে না যে, এতদিন বাদে এখন ওঁর এটা চোখে পড়ছে, অবিকল ওঁর ভাবটাই আমি গ্রহণ করেছি। আমার দিক থেকে আমি মুখ বুজে এবং এড়ো-এড়ো ভাবে আছি। আর আমি সত্যকে দূরে সরিয়ে রাখব না, কেন না যত বেশি দেরি করা হবে ওঁদের পক্ষে তখন শুনে তা সহ্য করা তত কঠিন হয়ে পড়বে।

তোমার আনা।

মঙ্গলবার, ২৭ এপ্রিল, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

গোটা বাড়ি গাক গাঁক করে চেঁচাচ্ছে এমন ঝগড়া। মা-মণি, ফান ডানরা আর বাপি। মা মণি, মিসেস ফান ডান–সবাই সবার ওপর খাপ্পা। সুন্দর পরিবেশ, তাই না? আনার চিরাচরিত ত্রুটির ফর্দটি আবার ঝুলি থেকে বের করে আদ্যেপান্ত রটিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মিস্টার ফোসেন ইতিমধ্যে বিনেনগাস্টহুইস হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মিস্টার কুপহুইস আবার ঠেলে উঠেছেন, সাধারণত যা সময় লাগে তার আগেই তার রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। উনি আমাদের জানিয়েছেন যে, দমকল বাহিনী শুধু আগুন না নিভিয়ে গোটা জায়গা পানিতে ভিজিয়ে দেওয়ায় রেজিস্ট্রারের অফিস অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। আমি তাতে খুশি।

কার্লটন হোটেল ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। আগুনে বোমায় টাসা দুটো ব্রিটিশ বিমান ‘ওফিৎসিয়েশঁহাইমের একেবারে ওপরে এসে পড়েছিল। পুরো ফিৎসেলট্রাইসিঙ্গেলের শেষ মুড়োটা পুড়ে ছাই হয়েছে। জার্মান শহরগুলোর ওপর বিমান আক্রমণ দিন দিন জোরদার হচ্ছে। একটি রাতও আমাদের শান্তিতে কাটেনি।

না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমার চোখের কোলে কালি পড়েছে। আমাদের খাওয়াদাওয়ার যা হাল হয়েছে তা কহতব্য নয়। প্রাতঃরাশের জায়গায় শুকনো রুটি আর কফি। রাতের খাওয়া–পনেরো দিন এক নাগাড়ে পালং শাক অথবা লেটুস। আলু বিশ সেন্টিমিটার লম্বা, মিষ্টি আর পচা-পচা খেতে। যারাই খাওয়া কমিয়ে রোগা হতে চায়, তাদের উচিত ‘গুপ্তমহলে’ এসে থাকা। ওপর তলার লোকেরা মুখ তেতো করে নালিশ জানাচ্ছে, কিন্তু এটাকে ততটা শোকাবহ ব্যাপার বলে আমরা মনে করি না। ১৯৪০ সালে যে লোকগুলো লড়েছে অথবা যাদের পল্টনে তলব করা হয়েছিল তাদের ‘ডের ফুরারে’র জন্যে যুদ্ধবন্দী হিসেবে কাজ করার ডাক পড়েছে। স্থলাভিযান ঠেকানোর জন্যে ওরা এটা করতে পারে।

তোমার আনা।

শনিবার, ১ মে, ১৯৪৩

আদরের কিটি, এখানে আমরা কিভাবে আছি এটা ভাবলেই সাধারণত আমার মনে না হয়ে পারে না যে, যেসব ইহুদী আত্মগোপন করে নেই তারা যেভাবে দিন কাটাচ্ছে সে তুলনায় আমরা তো স্বর্গে আছি। এ সত্বেও পরে আবার যখন সব স্বাভাবিক হয়ে আসবে, তখন ভেবে অবাক লাগবে যে, নিজের বাড়িতে যে-আমরা এত ঝকঝকে তকতকে হয়ে বাস করতাম, সেই আমরা কতটা নিচু স্তরে নেমে গিয়েছিলাম।

এটা বলতে আমি বোঝাচ্ছি যে, আমাদের আচার-ব্যবহারের অধঃপতন ঘটেছে। যেমন ধরো, আমরা যবে থেকে এখানে এসেছি, আমাদের টেবিলে অয়েল ক্লথ বলতে একটাই; বহুব্যবহৃত হওয়ার ফলে এখন আর সেটাকে আদৌ পরিষ্কার বলা যায় না। অবশ্য এটা বলতে হবে যে, আমি প্রায়ই একটা নোংরা ন্যাকড়া দিয়ে সেটা সাফ করার চেষ্টা করি, কিন্তু ছিঁড়েখুঁড়ে ন্যাকড়াটার আর কিছু পদার্থ নেই।

হাজার ঘষামাজা সত্বেও টেবিলটার যা হাল হয়েছে, তাতে কেউ আমাদের সুখ্যাতি করবে না। ফান ডানেরা সারা শীতকাল একই ফ্ল্যানেলের চাদরে শুয়েছেন; চাদরটা এখানে। কাচা সম্ভব হয় না, তার কারণ রেশনে আমরা যে সাবানের গুঁড়োটুকু পাই তাতে কুলোয় না। এবং জিনিসটাও তত ভালো নয়। বাপির ট্রাউজার জালজাল করছে আর তার টাইও ঝরঝরে হয়ে এসেছে। মার করসেট আজ ফেঁসে গেছে, ওগুলো এখন রিপু করারও বাইরে আর মারগটকে এখন দুই সাইজ ছোট ব্রেসিয়ার পরে চলতে হচ্ছে।

মা-মণি আর মারগট গোটা শীতকাল তিনটে গেঞ্জি ভাগ করে পরে চালিয়েছে, আমারগুলো এত খাটো যে, তাতে পেট পর্যন্ত ঢাকে না।

নিশ্চয় এ জিনিসগুলো এমন যা জয় করা যায়। তবু মাঝে মাঝে আমি হঠাৎ ভাবিত হয়ে পড়ি। আমার প্যান্ট থেকে বাপির দাড়ি কামানোর বুরুশ পর্যন্ত যতসব জীর্ণ ক্ষয়ে যাওয়া জিনিস নিয়ে আজ আমরা এই যে চালাচ্ছি–কীকরে আবার আমরা যুদ্ধের আগেকার পর্যায়ে ফিরে যেতে পারব?

কাল রাত্তিরে এত অসহ্য রকমের গোলাগুলি ফেটেছে যে চারবার উঠে আমি আমার নিজের বলতে যা কিছু সব এক জায়গায় করেছি। পালাবার পক্ষে অত্যাবশ্যক জিনিসগুলো আমি সুটকেসে ভরেছি।

কিন্তু মা-মণি খুব নায্যতই বলেছেন–’পালিয়ে কোথায় যাবি তুই?’ দেশের নানা অংশে ধর্মঘট চলতে থাকায় সারা হল্যাণ্ডকে নাড়া দেওয়া হচ্ছে। সুতরাং আক্রান্ত অবস্থা জারি করা হয়েছে এবং প্রত্যেককে একটি করে মাখনের কুপন কম পেতে হবে।

ছোট বাচ্চারা ভারি দুষ্ট।

তোমার আনা।

মঙ্গলবার, ১৮ মে, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

জার্মান আর বৃটিশ বিমানের এক প্রচণ্ড হাওয়াই যুদ্ধ আমি চাক্ষুষ করলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে ৪ জন দুই মিত্রপক্ষের সৈন্যকে জ্বলন্ত বিমান থেকে লাফিয়ে পড়তে হয়েছিল। হালভেগে থাকেন আমাদের দুধওয়ালা; তাদের মধ্যে একজন ডাচ ভাষা গড়গড় করে বলে। সিগারেট ধরাবার জন্যে লোকটা আগুন চেয়েছিল এবং বলেছিল যে তাদের দলে ছিল ছ’জন লোক। পাইলট যে, সে আগুনে পুড়ে মারা যায় এবং পঞ্চম লোকটি কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। জার্মান পুলিস এসে সুস্থ নিটোল চারটি লোককে ধরে নিয়ে যায়। আমি এই ভেবে অবাক হই যে, পারাসুট নিয়ে ঐ রকম ভয়াবহ ঝাঁপ দেওয়ার পরেও কী করে ওরা মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পেরেছিল।

এখন বেশ গরম পড়ে গেছে; এ সত্বেও তরিতরকারির খোসা আর আবর্জনা পোড়ানোর জন্যে একদিন অন্তর আমাদের আগুন জ্বালাতে হচ্ছে। জঞ্জালের ঝুড়িতে আমরা কিছু ফেলতে পারি না, কারণ আড়তের ঝাড়ুদারকে আমাদের সমঝে চলতে হয়। একটু অসাবধান হলে খুব সহজেই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে।

যেসব ছাত্ররা এ বছর ডিগ্রি পেতে চায় কিংবা পড়াশুনো চালিয়ে যেতে চায়, তাদের সবাইকেই এই মর্মে সই করতে হবে যে, তারা জার্মানদের পক্ষাবলম্বী এবং নব-বিধানের সমর্থক। শতকরা আশীজন তাদের বিবেকবিরুদ্ধ কাজ করতে অস্বীকার করেছে। এর জন্যে স্বভাবতই তাদের ফল ভোগ করতে হয়েছে। সই-না-করা সমস্ত ছাত্রকে জার্মানিতে মেহনতী শিবিরে যেতে হবে। জার্মানে গিয়ে সবাইকে যদি হাড়ভাঙা মেহনত করতে হয়, তাহলে এদেশে নওজোয়ান বলতে কী আর অবশিষ্ট থাকবে? গোলাগুলির আওয়াজের দরুন মা-মণি কাল জানলা এটে দিয়েছিলেন; আমি ছিলাম পিমের বিছানায়।

আমাদের ওপরতলার মিসেস ফান ডান বিছানা ছেড়ে তড়াক করে লাফ দেন; যেন মুশ্চি ওঁকে কামড়ে দিয়েছে। আর তার ঠিক পরক্ষণেই এক প্রচণ্ড কান-ফাটানো আওয়াজ। শুনে মনে হল, আমার বিছানার ঠিক পাশেই যেন একটা আগুনে বোমা এসে ফেটেছে। আমি তারস্বরে চেঁচালাম, ‘আলো জ্বালো, আলো জ্বালো।’ পিম বাতিটা জ্বেলে দিল। আমি ভেবেছিলাম মিনিট কয়েকের মধ্যে অন্তত দেখব ঘরটা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। তেমন কিছুই ঘটল না। আমরা তাড়াতাড়ি ছুটলাম ওপরতলায় কী ব্যাপার দেখতে। খোলা জানালা দিয়ে ফান ডান দম্পতি একটা লাল ঝলকানি দেখতে পান। মিস্টার ফান ডান ভাবলেন পাড়ায় আগুন লেগেছে এবং তার স্ত্রীর ধারণা হল আমাদের বাড়িটাতেই আগুন ধরে গেছে। বোমা ফাটার আওয়াজের আগেই হাঁটু কাঁপতে কাঁপতে ভদ্রমহিলা উঠে পড়েছেন। কিন্তু ঘটনার ওখানেই ছেদ পড়ায় আমরা শুটিসুটি মেরে যে যার বিছানায় ফিরে এলাম।

মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই আবার গোলাগুলি শুরু হয়ে গেল। মিসেস ফান ডান সঙ্গে সঙ্গে সটান লাফিয়ে উঠলেন এবং স্বামীর সাহচর্যে শান্তি না পেয়ে তিনি হাড় জুড়োবার জন্যে নিচের তলায় মিস্টার ডুসেলের ঘরে চলে এলেন। ডুসেল তাঁকে ‘এসো বাছা, আমার কাছে শোও’ বলে আপ্যায়ন করায় আমরা আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। কামানের গর্জন আর আমাদের বিচলিত করল না, আমাদের ভয় তখন চলে গেছে।

তোমার আনা।

রবিবার, ১৩ জুন, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

আমার জন্মদিন উপলক্ষে বাপির লেখা কবিতাটি এত সুন্দর যে তোমাকে না শুনিয়ে পারছি না। পিম সাধারণত পদ্য লেখেন জার্মান ভাষায়, মারগট নিজে যেচে তার অনুবাদ করেছে। মারগটের অনুবাদ খোলতাই হয়েছে কিনা তুমি নিয়ে বুঝে দেখ। বছরের ঘটনাবলীর একটা সংক্ষিপ্তসার দেওয়ার পর, কবিতায় বলা হচ্ছে–

এখানে কনিষ্ঠ বটে, ছোট নও এখনও তা বল
জীবন অতিষ্ঠ তবু, যে কারণে সমান সকলে
গুরু বনে গিয়ে কানে মন্ত্র দিতে চায় এই মতো–
আমরা ঝানু, জেনে নাও কত ধানে চাল হয় কত।
এসব করেছি আগে, সুতরাং আমরা সব জানি।
বড়দা সদাই ভালো, জেনো এই মহাজনবাণী।
জীবনের শুরু থেকে এই হল নিয়ম, অন্তত–
চোখেই পড়ে না দোষ নিজেদের, এত ছোট ছোট।
ফলে, খুব স্বচ্ছন্দেই দেওয়া যায় অন্যদের গাল,
অন্যদের ত্রুটিগুলো হয়ে ওঠে তিল থেকে তাল।
আমরা হই মাতাপিতা, আমাদের ওপর চ’টো না।
তোমাকে দরদ দিয়ে ন্যায্য ভাবে করি বিবেচনা।
সংশোধন মেনে নিও মাঝে মাঝে, হোক অনিচ্ছায়
যদ্যপি তোমার মনে হবে তেতো বড়ি গেলো প্রায়।
এটাই প্রশস্ত বলে জেনো যদি শান্তি রাখতে হয়।
যদ্দিন ভোগান্তি আছে করে যেতে হবে কালক্ষয়।
বই মুখে করে বসে পড়ো তুমি সারাদিন প্রায়
এভাবে বেঁচেছে এই পৃথিবীতে কে কবে কোথায়?
কিছুতে বিরক্তি নেই, স্নিগ্ধ হাওয়া আনো তুমি নিজে
তোমার একমাত্র খেদ, গায়ে দিই কী যে!
আমার নিকার নেই, পরিধেয় সমস্তই টেঁটি
গেঞ্জিতে বাঁচে না লজ্জা, হায় হায়, কী করে যে বেটি!
জুতো পায়ে দিতে গেলে কাটতে হয় পায়ের আঙুল,
ভেবে ভেবে সোনামণি পাই না যে কূল।’

এই সঙ্গে খাবারের বিষয়ে কিছুটা ছিল। মারগট তা ছন্দে তর্জমা করতে পারেনি বলে এখানে আমি আর সেটা তুলে দিলাম না। তোমার কি মনে হয় না যে, আমার জন্মদিনের কবিতাটা খাসা হয়েছে? আরও নানাভাবে একদম আমার মাথা খাওয়া হয়েছে এবং অনেক সুন্দর সুন্দর জিনিস পেয়েছি। অন্যান্য জিনিসের মধ্যে পেয়েছি আমার প্রিয় বিষয়–গ্রীস আর রোমের পূরাণ সংক্রান্ত একটা মোটা বই। মিঠাই যে কম পেয়েছি তা বলার উপায় নেই প্রত্যেকেই তাদের বাঁচানো শেষ ভাগটুকু আমাকে উজাড় করে দিয়েছে। অজ্ঞাতবাসে থাকা পরিবারের বেঞ্জামিন হিসেবে আমি সত্যিই আমার পাওনার বেশি খাতির পেয়েছি।

তোমার আনা।

মঙ্গলবার, ১৫ জুন, ১৯৪৩

আদরের কিটি,

অনেক কিছু ঘটে গেছে। কিন্তু অনেক সময়ই আমি ভাবি যে, আমার একঘেয়ে বকবকানি তোমার বিরক্তিকর ঠেকে এবং খুব বেশি চিঠি না পেলেই তুমি খুশি হও। আমি তোমাকে সংক্ষিপ্ত খবরাখবর দেব।

ডুওডেনাল আলসারের দরুন ফোসেনের যে অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। যখন তাকে অস্ত্রোপ্রচারের টেবিলে শোয়ানো হয় তখন তার পেট খুলে কানসার ধর পড়ে। ক্যানসার তখন এতই এগিয়েছে যে তখন আর অস্ত্রোপচারে কিছু হওয়ার নয়। সুতরাং পেট সেলাই করে ভাল পথ্য দিয়ে তিন সপ্তাহ শুইয়ে রাখার পর শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয়। ওঁর জন্যে আমার খুব কষ্ট হয় এবং আমরা বাইরে যেতে পারি না বলে খুব বিচ্ছিরি লাগে, কেননা সেক্ষেত্রে প্রায়ই ওঁর সঙ্গে দেখা করে নিশ্চয়ই ওঁর মনটা প্রফুল্ল রাখার চেষ্টা করতাম।

আমাদের এটা দারুণ দুর্ভাগ্য যে, কোথায় কী ঘটছে এবং আড়ত ঘরে ওর কী কী জিনিস আছে তা কানে আসছে এ সম্বন্ধে আমাদের বহু দিনের চেনা মানুষ ফোসেন আর আমাদের অবহিত করতে পারবেন না। উনি আমাদের সবচেয়ে বড় সহায়ক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরামর্শদাতা ছিলেন। আমরা এর প্রচণ্ড অভাব অনুভব করছি।

পরের মাসে আমাদের রেডিওটা হাত বদল করার কথা। কূপহুইসের বাড়িতে একটা এইটুকু রেডিও-সেট আছে; আমাদের ঢাউস ফিলিপসের বদলে সেইটা উনি আমাদের দেবেন। আমাদের চমৎক্কার সেটটা দিয়ে দিতে হবে ভেবে বিশ্রী লাগছে; কিন্তু যে বাড়িতে লোকে গা ঢাকা দিয়ে আছে, সেখানে কোনো অবস্থাতেই এমন বেয়াড়া ঝুঁকি নেওয়া যায় না যাতে কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। ছোট্ট রেডিওটা আমরা ওপরে নিয়ে গিয়ে রাখব। লুকোনো ইহুদী, লুকোনো টাকা আর লুকিয়ে কেনাকাটার ওপর যোগ হবে একটা লুকোনো রেডিও। ‘বল-ভরসার উৎসটা না দিয়ে প্রত্যেক চেষ্টা করছে একটা পুরানো সেট যোগাড় করে সেটা হস্তান্তর করতে। এটা ঠিক যে বহির্জগতের খবর দিন দিন যে রকম খারাপ হচ্ছে, তাতে এই রেডিও সাহায্য করছে তার আশ্চর্য কণ্ঠস্বর দিয়ে আমাদের মনোবল বাচিয়ে রাখতে এবং একথা ফিরে ফিরে বলতে–ঘাড় উঁচু করে রাখো, দাঁতে দাঁত দিয়ে থেকে চালিয়ে যাও, সুদিন আসবেই আসবে।

তোমার আনা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত