তুলির হাসি

তুলির হাসি

তুলিকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেল, ওর মা খুব কান্না করছে, ৫ বছরের চটপটা তুলি, কি যে হবে! আবির, সায়লা আর আবিরের ছোটবেলার কিছু বন্ধু, ওরাও এসেছে। সবার চোখেমুখে একটা চিন্তার ছাপ। তুলি আবির,সায়লা বা ওর বন্ধুদের কেউ-ই নয়। এই পৃথিবীতে ওর মা ছাড়া আর কেউ নেই। কয়দিন আগে এই হাসপাতালেই তুলি আর ওর মায়ের সাথে দেখা হয়েছিল আবির আর সায়লার।সায়লা আবিরের চাচাতো বোন। সেদিনের কথাগুলো ভেসে উঠল আবিরের সামনে। ২০ রোজা ছিল, আবির এইবার একটু আগেই বাড়ি এসেছিল ।কারণ, রোজার কিছুদিন আগে সায়লার ছোট বোন একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়, সায়লার কোনো ভাই না থাকায় আর ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আবিরকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।

সেদিন সকালে আবির ঘুম থেকে উঠে দেখে সায়লা ওর মায়ের সাথে কথা বলছে, আবিরকে দেখে জানালো যে, ওর বাবাকে নিয়ে একটু হাসপাতালে যেতে হবে। আবির গোসল করে,রেডি হয়ে ওর চাচাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে গেল। সায়লাও ওদের সাথে গেছিল। ওর চাচা যখন ডাক্তারের কাছে, সায়লা আর আবির অপেক্ষা করছিল, কখন উনার ডাক্তার দেখানো শেষ হয়। হঠাৎ ওরা দেখতে পেল যে,একটা মহিলা এক ডাক্তারের পা জড়িয়ে ধরে কান্না করছে আর বলছে, “যে কইরাই হোক আমার তুলিকে বাঁচাইয়া দেন, এতো ট্যাকা আমি কই পামু! ওই মাইয়াডা ছাড়া আমার আর কেউ নাই!” কিন্তু ডাক্তারেরা তো আর দয়ার ভান্ডার না! আর তাছাড়া উনারা প্রতিদিন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, তাই এগুলো যেন উনাদের কাছে কমন ব্যাপার হয়ে গেছে।

উনি নিজের পা ছাড়িয়ে কঠিন মুখে বলছিলেন যে, টাকার জোগাড় করতে পারলে উনি অপারেশন এর ব্যবস্থা করতে পারবেন। ডাক্তার চলে যাওয়ার পরেও মহিলাটা ওখানেই ঠায় বসে রইলেন। উনার পাশেই উনার মেয়ে দাঁড়িয়ে এতক্ষণে আবির আর সায়লা খেয়াল করল। রোগাপাতলা একটা মেয়ে, গায়ের রঙ ততটাও কালো নয়, যতটা মনে হচ্ছে, সে যে কোনো এক রোগে ভুগছে, তা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আবির আর সায়লা ওই মহিলার দিকে এগিয়ে গিয়ে জানতে পারল যে, উনার মেয়ে তুলির নাকি কি একটা রোগ হয়েছে, চিকিৎসা করাতে ৯ হাজার টাকা লাগবে। ৫দিনের মধ্যে অপারেশন না করাতে পারলে বাচানো কষ্ট হয়ে যাবে, মারাও যেতে পারে।

উনি আরো জানালেন যে, উনার স্বামী অটো চালাতো, কয়দিন আগে একটা এক্সিডেন্টে মারা গেছে, সেখান থেকে কিছু টাকা দিয়েছিল যা তুলির চিকিৎসায় শেষ, এখন আবার ৯ হাজার টাকা সে কোথায় পাবে! তাও আবার ৫দিনের মধ্যে। উনার এমন কেউ নেই যে তাকে সাহায্য করবে। কথাগুলো শুনে সায়লার চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছিল। ওর ছোট বোনটার কথা খুব মনে পড়ছিল। ততক্ষণে সায়লার বাবা ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন আর সায়লা ওর বাবার কাছে তুলির জন্য ১০হাজার টাকার আবদার করে বসল। ওর বাবার পক্ষে ওই সময়টাতে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়ত একটু কষ্ট ছিল,, তবে অসম্ভব নয়।

কাল সায়লার বাবা মেয়ের অনুরোধ রাখতে আর তার মেয়ের মতো একটা মেয়ের জীবন বাঁচাতে ১০ হাজার টাকা জোগাড় করে আবিরের হাতে তুলে দিয়েছে। আজ মেয়েটার অপারেশন চলছে। সবাই দোয়া করছে যেন ভালোয় ভালোয় সব মিটে যায়। অপারেশন শেষে ডাক্তার বের হতেই তুলির মা কান্না করতে করতে ডাক্তারের কাছে এগিয়ে গেল মেয়ের অবস্থা জানতে, বাকি সবাইও গেল, ডাক্তার জানালো সব ঠিক আছে, জ্ঞান ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে। তুলির মা সায়লাকে কীভাবে ধন্যবাদ দিবে সেই ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছে। আজ তুলিকে দেখে সবাই চলে আসল, শুধু ওর মা রয়ে গেল। আজ আবির আর সায়লা তুলিকে দেখতে এসেছে।

মেয়েটাকে দেখে সায়লার খুব ভালো লাগছে। ও ওর মাকে জিজ্ঞেস করল যে, ঈদ শেষ হয়ে গেছে কিনা! এতদিন হাসপাতেলে থাকায় ও ভেবেছে যে, হয়ত ঈদ শেষ হয়ে গেছে। ওর মা জানালো না আরো দুইদিন আছে। শুনে তুলি যে অনেক খুশি হয়েছে তা ওর মুখ দেখলে যে কেউ বুঝে যাবে। মেয়েটা তখন ওর মায়ের কাছে ঈদের নতুন জামার কথা বলতেই উনার মুখটা কেমন উদাস হয়ে গেল। উনি কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই সায়লা তুলির হাতে একটা জামার প্যাকেট তুলে দিল। নতুন জামা দেখে তুলির মিষ্টি মুখে ফুটে উঠল ভুবনজয়ী একটা হাসি! যা অনেক টাকার জিনিস দিয়েও হয়ত অনেকের মুখে ফুটে উঠেনা!!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত