০৮. জার্মান শ্রমিক দল
একদিন হঠাৎ আমার ওপরে আদেশ আসে একটা সংঘ যাকে আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক দল বলে মনে হয়, তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার। এরা নিজেদের বলত ‘দ্য জার্মান লেবার পার্টি এবং শীঘ্রই তারা একটা মিটিং ডাকছে যাতে গফি বক্তৃতা দেবে। আমার ওপরে আদেশ হল সেই মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে এবং পরিস্থিতির বিশদ বিবরণ জানতে।
যে রহস্যময়তার চোখে সৈন্যবাহিনীর কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোকে দেখত তা ভালভাবেই জানতাম। বিপ্লব সৈন্যবাহিনীকে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু যারা এ সুযোগ নিয়েছে,অভিজ্ঞতা বলতে তাদের নেহাত-ই খুব কম ছিল। কিন্তু যতদিন না পর্যন্ত কেন্দ্র এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অনিচ্ছাভরে জোর করে বুঝতে পেরেছে যে, সৈনিকদের সহানুভূতি বিপ্লবের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দিকে গেছে এবং জাতির ভোট দেওয়ার অধিকার এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করেনি।
সত্যি বলতে কি কেন্দ্র এবং মার্কসবাদের এ নীতি রীতিমত শিক্ষাপ্রদ; কারণ তারা যদি ভোটাধিকার খর্ব না করত–যা বিপ্লবের পথে সৈন্যবাহিনীর রাজনৈতিক দাবি বলে স্বীকৃত; যে সরকার ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কয়েক বছরে তাকে উপড়ে ফেলে দিত তাতে জাতির অসম্মান ও দুর্দশা আরো বেশি দীর্ঘায়িত হত। সেই সময় সৈন্য এবং জাতির মধ্যে সম্পর্কটা ছিল রক্তশোষক পিশাচের মত, যার কাজ হল অন্তমৈত্রী বজায় রাখা। কিন্তু এটাও সত্যি যে তথাকথিত জাতীয় দল অত্যুৎসাহের সঙ্গে অপরাধী মনোবৃত্তির মনোভাব সম্পন্ন লোকদের নির্বাচিত করেছিল, যারা ১৯১৮ সালের বিপ্লবকে সমর্থন জানিয়ে সৈন্যবাহিনীকে জাতির জাগরণের ক্ষেত্রে একটা অকেজো যন্ত্রে পরিণত করেছে। এবং এ সত্যটাকে একদল সহজে প্রতারিত মানুষ মেনেও নেয়।
বুর্জয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনোভাব জমে গিয়ে এমন পাথরের মত শক্ত হয়ে গিয়েছিল যে, তারা মনে মনে সত্যিই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে সৈন্যবাহিনী আবার নিজেদের জায়গাতেই ফিরে আসবে, যা নাকি জার্মান শৌর্যবীর্যের দুর্গ প্রাচীর বলে পরিগণিত।
এ সময় কেন্দ্রীয় দল এবং মার্কসবাদীরা জাতীয়তাবাদীর বিষাক্ত দাঁতগুলো তুলতে ব্যস্ত। তাছাড়া সৈন্যবাহিনী একটা বৃহত্তর পুলিশ দলে পরিণত হবে তাদের সামরিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে; এবং তাহলে তো বহিঃশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করাই তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পরের ঘটনাবলী দ্বারা এর সত্যাসত্য যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিষ্ঠিত হয়।
আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা কি বিশ্বাস করেছিল যে, আমাদের সৈন্যবাহিনীর অগ্রগতি জাতীয়তাবাদীতার পথে নয়, অন্যদিকে? সম্ভব এ বিশ্বাসই তাদের। মধ্যে ছিল। কারণ যুদ্ধের সময়ে তো তারা প্রকৃত সৈন্য ছিল না, ছিল একদল বাচাল। অন্য কথায় বলা যেতে পারে, তারা ছিল সংসদীয় সদস্য এবং যে কারণে সাধারণ জনসাধারণের হৃদয়-সম্পর্কে এতটুকু খোঁজখবর রাখত না। যারা অতীতের স্মৃতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকত এবং সর্বদা স্মরণ করত যে একদা তারা সর্বশ্রেষ্ঠ সৈনিক বলে পরিগণিত ছিল।
আমি স্থির করি যে এ মিটিংয়ে যোগদান করতেই হবে, যা নাকি আমার কাছে একেবারেই অজানা। আমি যখন ভূতপূর্ব স্টারনেকার পানশালার অতিথি ঘরে হাজির হই, যা এখন আমাদের কাছে ঐতিহাসিক একটা বস্তু বলে পরিগণিত–দেখি কুড়ি পঁচিশজন লোক উপস্থিত, বেশিরভাগই সমাজের নিচু স্তর থেকে আসা।
ফেডারের বক্তৃতার ধ্যান-ধারণার সঙ্গে আমার আগেই পরিচিতি ছিল; কারণ আমি যে তার বক্তৃতা আগেই শুনেছি তা তো বলেছি। সুতরাং সঙ্টার পর্যবেক্ষণের কাজে আমি মনোনিবেশ করি।
এদের সম্পর্কে আমার ধারণা খারাপ হয় না, আবার ভালও হয়নি। আমার মনে হয় সেই সময় ভুইফোড় অনেক সঙ্ সমিতির মধ্যে এটাও একটা। সেই দিনগুলোতে প্রত্যেকেই এক একটা নতুন দল গড়তে চাইত। অর্থাৎ যে সমকালীন ঘটনাবলী সম্পর্কে ভীতশ্রদ্ধা বা তখনকার দিনের দলগুলো সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। সুতরাং এ সঙ্গুলো যেমন হঠাৎ রাতারাতি গজিয়ে উঠত, তেমনি নিমেষে মিলিয়েও যেত; আর কোন প্রতিক্রিয়া কোথাও অনুভব করত না। সত্যি বলতে কি এসব স সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে অসংখ্য লোককে একত্রিত করে সঙ্ঘ বা সমিতি প্রতিষ্ঠার অর্থ কি বা আন্দোলন বলতে ব্যাপারটা কি বোঝায়। সুতরাং এসব ভূঁইফোড়দের সঙ্গুলো রাতারাতি অদৃশ্য হত। তাদের পরিস্থিতির প্রয়োজন সম্পর্কে কোন ধ্যান-ধারণাই ছিল না।
ঘণ্টা দুয়েক ওদের কার্যবিবরণী শোনার পর জার্মান লেবার পার্টি সম্পর্কে আমার ধারণা খুব একটা বদলায় না। ফেডার শেষমেষ তার বক্তৃতা সাঙ্গ করলে পরে আমি সুখী হই। আমার ততক্ষণে যথেষ্ট পর্যবেক্ষণ হয়ে গিয়েছিল এবং যখন আমি প্রায় উঠতে উদ্যত, তখনই ঘোষণা করা হয়–যে কেউ এর ওপর খোলা বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে পারে। এটা শুনে আমি সেখানে থাকাটাই স্থির করি। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আমার ধারণা হয়, বিতর্কটা প্রয়োজনীয় ব্যাপারগুলো ছেড়ে দিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গ নিয়েই যেন বেশি মেতে উঠেছে, তখনই হঠাৎ ‘অধ্যাপক’ কথা বলতে শুরু করে। তার বক্তৃতার মুখবন্ধই হয়, ফেডার যেসব বিষয়ে বলেছিল তাতে সন্দেহ প্রকাশ করে। এবং ফেডার তার প্রত্যুত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপকটি ‘তত্ত্বের গভীরে’ বলে আলোচনার মোড় ঘোরায়। কিন্তু এর আগে তার বক্তব্য ছিল যে ব্যাভরিয়া প্রুশিয়া ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য এ নতুন দলটির প্রধান পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। এবং একান্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে এ মানুষটি বলে যে জার্মানি-অস্ট্রিয়ার উচিত ব্যাভেরিয়ার সঙ্গে সংযুক্তি, তবেই শান্তি আরো ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সে আরো একটা অবিবেচকের মত বক্তব্য রাখে, এ সময়ে আমি কিছু বলার জন্য সভার অনুমতি প্রার্থনা করি এবং সেই শিক্ষিত লোকটিকে। আমার চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করি। ফলে সেই সম্মানিত ব্যক্তিটি যে শেষ বক্তৃতা করেছিল চাবুক খাওয়া খেকি কুকুরের মত, তার জায়গা ছেড়ে দিয়ে নিপে পলায়ন করে। আমি যখন আমার বক্তব্য রাখছিলাম, শ্রোতারা একমুখ বিস্ময় নিয়ে আমার বক্তব্য শুনছিল। ঠিক যখন আমি সভাকে শুভরাত জানিয়ে বিদায় নিতে উদ্যত, একজন লোক সত্বর আমার কাছে এসে নিজের পরিচয় দেয়। আমি তার নামটা সঠিক ধরতে পারিনি; কিন্তু সে আমার হাতে একটা ছোট্ট বই ধরিয়ে দেয়, যা নাকি হল একটা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন, এবং সে আমাকে সবিনয়ে অনুরোধ করে সেটা পড়ার জন্য।
সত্যি বলতে কি, ব্যাপারটাতে আমি খুশি-ই হই; কারণ এ রাস্তায় সংঘের উদ্দেশ্য বুঝতে অনেক বেশি সাহায্য হবে; যার জন্য ক্লান্তিকর মিটিংগুলোতে উপস্থিত হবার প্রয়োজন নেই। উপরন্তু লোকটাকে সাধারণ মজুরের মত দেখতে বলে আমার মনের ওপর ভাল একটা ছাপ রেখে যায়। এরপর আমি সভাগৃহ ছেড়ে যাই।
সেই সময়ে আমি দ্বিতীয় পদাতিক বাহিনীর একটা ব্যারাকে থাকতাম। আমার ছোট্ট ঘরটাতে তখনো বিপ্লবের ছাপ আমাকে বিরক্ত করে তুলত। দিনের বেলাতে তো বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরে কাটাতাম, একচল্লিশ নম্বরের হাল্কা পদাতিক বাহিনীর কোয়ার্টারে অথবা অন্য কোথাও বক্তৃতা শোনার ধান্ধায়, যা নাকি সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত হত। বসবাস উপলক্ষে শুধুমাত্র রাতটাই আমি আমার কোয়ার্টারে কাটাতাম। যেহেতু ভোর পাঁচটাতে আমার ঘুম ভেঙে যেত সেইজন্য বাকি সময়টা আমি নেংটি ইঁদুরগুলো যে ঘরময় ছুটাছুটি করত, তাদের দেখেই কাটাতাম। একখণ্ড রুটির শক্ত টুকরো বা গুঁড়ো মেঝেতে ছড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম, ছোট্ট প্রাণীগুলো সেই খাবারের চারপাশে খেলা করছে, এবং ভীষণ আনন্দে তাদের কাছে উপাদেয় খাবার খাচ্ছে। আবার ঘুম না আসাতে হঠাৎ আমার সেই ছোট্ট রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে যায়, যেটা নাকি একজন শ্রমিক মিটিংয়ে দিয়েছিল। ছোট্ট বইটার লেখকও সেই বইটাতে বর্ণনা দিয়েছে কেমন করে সে গলার থেকে মার্কসবাদের শৃখলটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে সুন্দর শব্দ দ্বারা সাজানো ট্রেড ইউনিয়নকেও। এবং তারপরেই সে জাতীয়তাবাদী আদর্শে ফিরে এসেছে। সেই কারণেই বইটার নাম রেখেছে ‘আমার রাজনৈতিক জাগরণ’; বিজ্ঞাপনটা পড়ার প্রথম মুহূর্ত থেকেই আমার মনকে টানে এবং শেষ পর্যন্ত সেই উসাই সমভাবে বজায় থাকে। যে পদ্ধতির বর্ণনা এখানে রয়েছে, দশবছর আগের আমার অভিজ্ঞতাও একই রকমের। অবচেতন মনে আমার নিজের অভিজ্ঞতা যেন নড়ে চড়ে ওঠে। সেইদিন আমি যা পড়েছি তা বারবার আমার মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি মনস্থির করি যে ব্যাপারটায় আর মনোযোগ দেব না। প্রায় সপ্তাহখানেক পরে আমি একটা পোস্টকার্ড পাই, এবং বিস্ময়ে পড়ে দেখি যে আমাকে জার্মান লেবার পার্টির সদস্যভুক্ত করে নেওয়া হয়েছে। আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল যোগাযোগ করতে এবং পরের বুধবারের পার্টিকমিটির মিটিংয়ে যোগদানের জন্য।
এভাবে সভ্য করার ব্যাপারটা আমাকে কিছুটা হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই; এবং আমি ভেবেই পাইনি যে ব্যাপারটাতে রাগ করব নাকি হাসব। কেননা তখন পর্যন্ত বর্তমান কোন পার্টির সভ্য হওয়ার ইচ্ছে আমার ছিল না। বরং নিজের একটা পার্টি গড়ে তোলার দিকেই আমার ঝোঁক ছিল। এ ধরনের নিমন্ত্রণ আমি কখনো কল্পনাতেও আনতে পারিনি।
আমি প্রায় একটা উত্তর লিখে ফেলেছিলাম; কিন্তু কৌতুকের দরুণ উত্তর না দিয়ে সেই মিটিংয়ে নির্দিষ্ট দিনে যোগ দেওয়াটাই মনস্থির করি। যাতে ব্যক্তিগতভাবে এদের কাছে আমার আদর্শগুলোকে তুলে ধরতে পারি।
অবশেষে বুধবার এল। যে শুঁড়িখানায় এ মিটিংয়ের বন্দোবস্ত হয়েছিল, সেটা হল হেরেনস্ত্রানের ‘আল্টে রোজেনবাড’, যাতে হঠাৎ ছাড়া খদ্দের সচরাচর ঢুকত না। ১৯১৯ সালে এটা কোন আশ্চর্যজনক ব্যাপার নয়। যখন বিলগুলো বেশ উঁচু অঙ্কের আসত যদিও ভাণ দেখানো হত এমন কিছু নয়; কিন্তু খদ্দেরদের পক্ষে তা লোভনীয় নয়। যাহোক, এ রেস্তরাঁর নাম আমি আগে কখনো শুনিনি।
প্রায় অন্ধকার খদ্দেরদের বসার ঘর দিয়ে ঢুকে, সেখানে অবশ্য একটা খদ্দেরও বসে নেই, পাশের ঘরে যাওয়ার দরজা হাতড়াই; এবং দরজা খুলে দেখি সেখানেই সভা বসেছে। গ্যাসের মলিন আলোর নিচে জনা চারেক লোক একটা টেবিল ঘিরে বসে। তার মধ্যে একজন সেই বিজ্ঞাপনপত্রের লেখক। সে আমাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সাদরে জার্মান পাটির একজন নতুন সদস্য হিসেবে বরণ করে।
সত্যি বলতে কি যখন শুনলাম দলের প্রেসিডেন্ট তখনো এসে পৌঁছায়নি, একটু নিরুদ্যম হয়ে পড়ি। যাহোক মনে মনে তৎক্ষণাৎ স্থির করে ফেলি যে সে এসে উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে প্রকাশ করব না। শেষে একসময় প্রেসিডেন্টের আবির্ভাব হয়। স্টারনেকার শুঁড়িখানার মিটিংয়ে, যেখানে ফেডার বক্তৃতা দিয়েছিল এবং যে চেয়ারম্যানের পদ অধিকার করেছিল, এ সেই ব্যক্তি।
আমার কৌতূহল জেগে ওঠে এবং সাগ্রহে অপেক্ষা করি কি হতে যাচ্ছে তা দেখার জন্য। আমি তখন সেই নামগুলো এবং ভদ্রলোকদের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ পাই, এ দলে যারা সর্বেসর্বা। দেশব্যাপি দলের প্রেসিডেন্ট হল মিস্টার হেরার আর মিউনিক জেলা পার্টির প্রেসিডেন্ট হল এনটুন ড্রেসেলার।
আগের দিনের সভার কার্য বিবরণী পড়া হয় এবং ভোটে তা যথাসময়ে গৃহীতও হয়। এরপরে আসে কোষাধ্যক্ষের রিপোর্ট। সমিতির সবশুদ্ধ মোট তহবিল হল সাত মার্ক পঞ্চাশ ফেনিগ। (তখনকার ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় তিরিশ টাকার মত।) সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য কোষাধ্যক্ষ তার মতামত ব্যক্ত করে যে সমিতির সভ্যদের ওপর তার পূর্ণ আস্থা বিদ্যমান। এটাও সভার কার্য বিবরণীর মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়। এরপরে আসে চেয়ারম্যান যেসব পত্রাদির উত্তর ইতিমধ্যে দিয়েছে, সেইগুলো পড়া হয়। প্রথমে কীল থেকে আসা একটা চিঠি, এর পরেরটা ডুসেলডর্ফের, শেষেরটা এসেছে শহর বার্লিন থেকে। তিনটে চিঠির উত্তরই যথাযথ দেওয়া হয়েছে বলে সমিতির অনুমোদন লাভ করে; এরপরে পড়া হয় সদ্য আসা চিঠিগুলো। বার্লিন, কীল এবং ডুসেন্ডফ থেকে আসা। ভাবভঙ্গিতে বোঝা যায় এ চিঠিগুলো আসাতে সবাই খুব খুশি। কারণ এ চিঠিগুলো আসাতে প্রমাণিত হয় যে জার্মান লেবার পার্টি সাধারণের জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। কিন্তু তারপর? তারপরে আসে সদ্য আসা চিঠিগুলোর কি উত্তর দেওয়া হবে, তার ওপর লম্বা বিতর্ক।
ব্যাপারটা দুঃখজনক। দলবেঁধে আড্ডা মারার এটা হল নিকৃষ্টতম একটা উদাহরণ। আর আমাকে কিনা এ ধরনের একটা সমিতির সভ্য হতে হবে?
নতুন সভ্য সংখ্যার ব্যাপারটাও আলোচিত হয়–এককথায় বলা যায় সমস্ত আলোচনাটার উদ্দেশ্যই হল আমাকে কিভাবে ফাঁদে ফেলা যায়।
আমি এবার প্রশ্ন করতে শুরু করি। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারি কয়েকটা ভাল আদর্শ ছাড়া এদের কোন পরিকল্পনা নেই। বিজ্ঞাপনপত্র নেই, ছাপা বলতে কিছুই নেই। মেম্বারশিপের কার্ড, এমন কি দলের রবার স্ট্যাম্পও নেই। আছে শুধু বিশ্বাস আর কিছু ভাল কাজ করার ইচ্ছা।
আমার আর হাসি আসে না। এসব কিসের জন্য করা হচ্ছে। এসব হচ্ছে হতবুদ্ধিতা আর চরম নৈরাশ্যের চিহ্ন যা প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোই গায়ে সেঁটে বসে আছে। তাদের কোন পরিকল্পিত দৃষ্টিভঙ্গি নেই। যে অনুভূতির দ্বারা প্রবৃত্ত হয়ে এ কয়েকটা যুবক ছেলে এ কাজে নেমেছে, ওপর থেকে তা হাস্যকর দেখালেও অন্তরের প্রেরণাই তাদের বলেছে,–স্বতঃপ্রণোদিত হলেও সজ্ঞানে–সমস্ত দলীয় শক্তি যেভাবে বর্তমানে নিয়োজিত, তা ঠিক এমন ধরনের শক্তি অবশ্যই নয় যা জার্মান জাতিকে পুনরুদ্ধার করতে পারে বা অতীতে জার্মানরা জাতির যে ক্ষতিসাধন করেছে, জাতির অক্ষমতা দখল করে তা সারানো সম্ভব নয়। আমি তাড়াতাড়ি আদর্শগুলোর ওপরে চোখ বুলিয়ে নেই, যে আদর্শগুলোকে ভিত্তি করে পার্টি গড়া হয়েছে। একটা টাইপ করা কাগজে লিস্টটা ছাপানো। এখানেও আবার আমি বুঝতে পারি যে এরা আকুল হয়ে কিছু খুঁজে চলেছে, কিন্তু কার সঙ্গে যে সংগ্রাম করে চলেছে তার কোন চিহ্ন এতে নেই। যে অনুভূতির দ্বারা এরা চালিত হচ্ছে, আমি তা উপলব্ধি করতে পারি। এটা যে আন্দোলনের পথের সন্ধান করে চলেছে, তাকে দলের ওপরে ঠাঁই দিতে হবে এবং শুধু শব্দের মালা গাঁথলেই হবে না।
সন্ধ্যেবেলায় যখন আমি আমার ব্যারাকে ফিরে আসি, ততক্ষণে সমিতিটা সম্পর্কে আমি একটা নির্দিষ্ট ধারণা করে ফেলেছি এবং জীবনে একটা কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হই। এ দলে যোগদান করবো, নাকি একে অস্বীকার করব?
বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে আমার প্রতিটি চিন্তাধারা এ দলে সভ্য হিসেবে যোগদান করতে বাধা দিতে থাকে। কিন্তু আমার অনুভূতিগুলো আমাকে জ্বালাতন করতে শুরু করে। যত বেশি আমি নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করি যে এ সঘটায় যোগদান করা কতখানি নিরর্থক, তত বেশি আমার অনুভূতি সেদিকেই ঝুঁকে পড়ে। এ দিনগুলো আমার অস্থিরভাবেই কাটে।
আমি এর স্বপক্ষে এবং বিপক্ষের যুক্তিগুলো নিজের মনের মধ্যে আলোচনা করতে শুরু করি। দীর্ঘদিন ধরেই স্থির করেছি যে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করব। এবং এটা আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার যে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নিতে হলে আমি কোন একটা আন্দোলনের মাধ্যমেই তা করব। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত মনের ভেতরে সত্যিকারের কোন তাড়না এ সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের জন্য অনুভব করিনি। আমি সেই দলের লোক নই, যারা নতুন কিছু লোভে আজ একটা কিছু করে, আবার কালই তার থেকে সরে দাঁড়ায়। কারণ তার জন্য আমার সব স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হওয়া প্রয়োজন, অথবা একেবারেই শুরু না করা উচিত। কেননা আমি জানতাম যদি একবার অভিমত দেই, তবে সেই মতামত আমাকে সারাজীবনের জন্য বেঁধে ফেলবে, যার থেকে ফেরার আর কোন পথ নেই। আমার পক্ষে আলস্য করে সময় নষ্ট করা সম্ভব নয়, যা কিছু করব দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং গভীর আগ্রহের সঙ্গেই তা সম্পাদনা করব। আমার মনের মধ্যে এমনিতেই যারা সবকিছু করতে এগিয়ে এসে শেষ পর্যন্ত সমাপ্তিতে পৌঁছায় না, তাদের প্রতি গভীর অনীহা বর্তমান। এ তথাকথিত সব বিষয়ের পণ্ডিতদের আমি ঘৃণা করি এবং এটাও আমার ধারণা যে এদের পক্ষে কোন রকম কাজ না করে চুপচাপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
ভাগ্য আমার আগামী রাস্তার প্রতি অঙ্গলি নির্দেশ করে। আমি কখনই বৃহৎ কোন দলে নাম লেখাব না; কারণটা পরে বিস্তারিত বলছি, এ হাস্যকর ছোট্ট সমিতিটা, সঙ্গে মুষ্টিমেয় সদস্য নিয়ে আমার ধারণায় প্রস্তরৎ অস্থি পিঞ্জরে পরিণত হবে না এবং এখানে। সম্ভবত ব্যক্তিগতভাবে কোন কাজ দেখানোর বা করার সুযোগ পাওয়া যাবে। যেহেতু আন্দোলনটা এখনো ছোট্ট গণ্ডীর ভেতরে আবদ্ধ, সুতরাং সেখানে এখনো সক্রিয় কোন কাজ করা সম্ভব। প্রয়োজন শুধু এর অবয়ব গঠনের। আন্দোলনটার চরিত্র গঠন করা যাবে। কি লক্ষ্য এবং কোন রাস্তায় গিয়ে সেই সমাপ্তিতে নিয়ে যাওয়া যায়,–এ জিনিসগুলো বড় কোন পার্টিতে গিয়ে স্থির করা সম্ভব নয়।
যত আমি চিন্তা করি তত যেন আমার মনে হতে থাকে যে জাতির পুনরুত্থানের জন্য এটাকে যন্ত্র হিসেবে চমৎকার ব্যবহার করা যাবে। কিন্তু কোন সংসদীয় রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে এ কাজ করা কখনই সম্ভব নয়। তারা কতগুলো সেকেলে ধ্যান-ধারণাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। অথবা নতুন কোন শাসন প্রণালীকে সমর্থনের জন্য উদগ্রীব। এখানে বর্তমানে যা প্রয়োজন তাহল সর্বজন স্বীকৃত একটা মতবাদ, ভোটের জন্য। কান্নাভরা আবেদন নয়।
কিন্তু চিন্তা করা এক জিনিস আর সেই চিন্তাধারাকে রূপ দেওয়া আরেক জিনিস; পরের অংশটা সত্যই কষ্টকর। কি কি গুণ থাকলে এ ধরনের চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব?
সত্যি বলতে কি আমি গরীব, এবং রুজি রোজগার বলতেও আমার কিছু ছিল না; তাই আমার ধারণায় বাস্তব দুঃখ-কষ্টগুলোকে আমি সহজেই বহন করতে পারব। কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হল যে আমি একেবারেই অপরিচিত। আমি হলাম সেই লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে একজন, ভাগ্যের জোরেই যারা টিকে আছে, বা টিকে থাকার অধিকার হারিয়েছে। পরের দরজার প্রতিবেশীরও যার অস্তিত্ব অজানা। আরেকটা ব্যাপারে অসুবিধে দেখা দেয় যে আমি নিয়মিত স্কুলে পড়াশুনা করিনি।
তথাকথিত বুদ্ধিমানেরা এখন পর্যন্ত অশেষ অহঙ্কারের সঙ্গে তাদের দিকে তাকায়, যাদের স্কুলের প্রশংসাপত্র নেই এবং যথেচ্ছ জ্ঞান তারা তাকে দিয়ে চলে। একটা মানুষ কি করতে পারে, সেই প্রশ্ন তারা কখনো জিজ্ঞাসা করে না; বরং তাদের যত জিজ্ঞাসা তাহল সে কতদূর পড়াশুনা করেছে, সেই প্রশ্নকে ঘিরে। তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরা স্কুল কলেজের প্রশংসাপত্র সঁটা ক্ষীণ দুর্বল মানুষকে সত্যিকারের সক্ষম ব্যক্তির থেকে অনেক উঁচুতে স্থান দেয়, কারণ সে ব্যক্তির গায়ে চিত্রবিচিত্র করা প্রশংসাপত্র সাঁটা। সুতরাং আমার কাছে সহজেই অনুমেয় এ শিক্ষিত লোকেরা আমাকে কি চোখে দেখবে এবং এখানেও আমি ভুল করেছিলাম। কারণ আমার ধারণায় বেশির ভাগ লোকই ভাল; কিন্তু বাস্তবের শীতল আলোতে আমার এ ধারণা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কারণ তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন ব্যক্তিক্রম এবং বোধগম্য। আমি কিছুদিনের মধ্যে এদের ভেতরকার পার্থক্যটা বুঝতে শিখি, যারা সর্বদা স্কুলের দেওয়ালের সঙ্গে সঁটা এবং যাদের ভবিষ্যতে বাস্তব জ্ঞানের সম্ভাবনা আছে।
অনেক চিন্তা-ভাবনার পরে আমি এ মতামত নেওয়ার জন্য মনস্থির করি।
এটা ছিল আমার পক্ষে চূড়ান্ত রকমের একটা মতামত নেওয়ার পালা। কারণ এদিক থেকে ভবিষ্যতে আর মুখ ফেরানো সম্ভব নয়।
এ ভেবে আমি জার্মান লেবার পার্টির সদস্য হবার তালিকাভুক্তির জন্য স্বীকৃতি জানাই এবং অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই সাময়িক সদস্যভুক্তির সার্টিফিকেট পেয়ে যাই। আমার ক্রমসংখ্যা নির্দিষ্ট হয় সাত।