০৪. মিউনিক
অবশেষে আমি এলাম মিউনিকে, সেটা ১৯১২ সালের বসন্তকাল। শহরটা আমার পূর্বপরিচিত; কারণ এ শহরের চার দেওয়ালের গণ্ডির মধ্যে আমার বেশ কয়েকটা বছর কেটেছে। এর কারণ হল আমার স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশুনার জন্য জার্মান প্রধান শহরগুলো শিল্পের কেন্দ্র হওয়াতে আমার দৃষ্টি নিবন্ধ ছিল মিউনিকের দিকে। জার্মানিকে চিনতে গেলে মিউনিক না দেখলে জার্মান শিল্পকলা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান আহরণ করাও সম্ভব নয়।
এসব জিনিস বিচার করলে দেখা যাবে, যুদ্ধ-পূর্ব জীবনটা আমার অনেক সুখের ছিল। যদিও আমার রোজগার অত্যন্ত অল্প ছিল, তবু শুধু ছবি আঁকার জন্য আমি জীবন ধারণ করিনি। আমি ছবি এঁকেছি প্রাণ ধারণের জন্য যতটুকু প্রয়োজন তাই যোগাতে আর পড়াশুনা করার নিমিত্তে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আমি নিশ্চয়ই পৌঁছাব এবং এ বিশ্বাসই আমার দৈনন্দিন ছোট ছোট দুঃখগুলোকে পেরিয়ে নিয়ে যেতে যথেষ্ট ছিল; যার জন্য আমি কখনই উদ্বিগ্ন বোধ করিনি।
উপরন্তু আমার প্রবাসের প্রথম মুহূর্ত থেকেই এ শহরটাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম, যা আমি আর অন্য কোন জায়গার প্রতি-ই উপলব্ধি করিনি। এ হল জার্মান শহর! নিজের মনেই আমি বারবার উচ্চারণ করতাম। ভিয়েনার থেকে কত আলাদা। আরেকটা আনন্দের বিষয় হল এখানে লোকে জার্মান ভাষায় কথা বলে, যেটা ভিয়েনার অন্য ভাষার চেয়ে আমার নিজের বলার ভাষায় অনেক কাছাকাছি। মিউনিকের বাক পদ্ধতি আমার ছেলেবেলার কথা স্মরণ করিয়ে দিত, বিশেষ করে যারা লোয়ার ব্যাভেরিয়া থেকে মিউনিকে আসত। হাজার বা তারও বেশি জিনিস ছিল যা আমি অন্তর থেকে ভালবাসতাম; অথবা মিউনিকে থাকাকালে যাদের প্রতি ভালবাসার জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলাম। কিন্তু যা আমাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল, তাহল শহরের শিল্পপ্রেরণার সঙ্গে গ্রামের মাটির কলা চাতুর্যের বন্ধন, যার সুন্দর ছন্দ হোব্রা হাউস থেকে ওডেন পর্যন্ত, অক্টোবর উৎসব থেকে পিনাকোনোক পর্যন্ত বিস্তৃত। মিউনিকের মত আর কোন জায়গা আমার হৃদয়ের সুতোয় এত জড়ানো নয়; কারণ আমার ব্যবহারিক জীবনের উন্নতির সঙ্গে এ মিউনিক শহর ওতপ্রোতভাবে জড়ানো এবং সত্যি বলতে কি, এ শহরটা দর্শনের পর থেকেই আমার অন্তরে খুশির বান ডাকে, বিশেষ করে এ সুন্দর শহর আমার আত্মতৃপ্তিও এনে দেয়। আমার মনে হয় যাদের ভেতরে সৌন্দর্যবোধের আশীর্বাদ ঈশ্বর দিয়েছেন, বাণিজ্যিক শিল্পকলা ব্যতিরেকে তারাই এ শহরকে ভাল না বেসে থাকতে পারবে না।
আমার পেশাগত কাজ ছাড়াও বর্তমান রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে আমি যথেষ্ট পড়াশুনা করতাম। বিশেষ করে বৈদেশিক সম্পর্কিত বিষয়গুলোই আমাকে বেশি করে আকৃষ্ট করত। আমি পুরো ব্যাপারটাই জার্মান নীতি কুটুম্বিতার দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতাম, যদিও ভিয়েনা শহরে দিনগুলো কাটানোর পর আমার ধারণা হয়েছিল, সমস্ত ব্যাপারটাই ভুলে ভর্তি। কিন্তু ভিয়েনাতে থাকাকালীন আমি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারিনি ঠিক জার্মান সাম্রাজ্য কত আত্মভ্রমের পথে এগিয়ে গেছে। ভিয়েনার দিনগুলোতে আমার এ ধারণা হয়েছিল যা বলা যেতে পারে, আমি নিজেকে বুঝিয়েছিলাম যাতে জার্মানদের ভুলগুলো হাল্কাভাবে নিতে পারি বা কম নজরে আসে। হয়ত বা জার্মানের শাসকবর্গের জানা ছিল বাস্তবে এ ধরনের সম্পর্কের মূল্য কতটুকু। কিন্তু কোন একটা রহস্যজনক কারণে তারা জনসাধারণের কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা গোপন করে গেছে। তাদের ধারণা ছিল বিসমার্কের মাধ্যমে যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে, তাকে তাদের সমর্থন জানিয়ে যাওয়া উচিত। হঠাৎ কিছু করে বসার ফলাফল ভাল দাঁড়াবে না; এছাড়া অন্য কোন কারণ সম্ভবত নেই যার জন্য বিদেশী রাষ্ট্রগুলো এ দেশের ভেতরের সঙ্কীর্ণমনা লোকগুলোর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।
কিন্তু জনসাধারণের সঙ্গে আমার যোগাযোগের ফলে, ভয়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম যে আমার চিন্তাধারা ভুল ছিল। সবচেয়ে অবাক লাগল দেখে যে যারা প্রায় সব বিষয়েই ভালরকম খবরাখবর রাখে, তাদের পর্যন্ত হাবুবুর্গ রাজতন্ত্র সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। সাধারণ জনসাধারণের ভেতরে বাঁধাধরা একটা ধারণা ছিল যে অস্ট্রিয়া গণনার মধ্যে ধরার মত শক্তিশালী এবং তারা বিপদের সময় পেছনে এসে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়াবে। সাধারণ মানুষ তখন পর্যন্ত অস্ট্রিয়াকে জার্মান রাষ্ট্র বলেই বিবেচনা করে এসেছে, এবং ভেবে এসেছে যে ওদের ওপর সত্যিই নির্ভর করা যায়। জার্মানির মতই লক্ষ লক্ষ জনসাধারণ দিয়ে ওদের শক্তির পরিমাপ করা ছিল। প্রথমত, তারা ভাবতে পারেনি যে অস্ট্রিয়া কোন জার্মান সাম্রাজ্যই নয়, দ্বিতীয়ত অস্ট্রিয়ার বর্তমান অবস্থা তাকে দুঃসাহসে ভর করে ধ্বংসের একেবারে মুখে ঠেলে এনে ফেলেছে।
সে সময়ে অস্ট্রিয়ার আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্পর্কে আমার জ্ঞান যে কোন পেশাদারী কুটনীতিজ্ঞদের চেয়ে বেশি ছিল। বদ্ধচক্ষুবশত দেখতে অক্ষম এসব কুটনীতিজ্ঞদের দল হোঁচট খেতে খেতে ধ্বংসের দিকে চলে। সরকারি অফিসগুলো থেকে যে প্রচলিত মতবাদে তাদের কর্ণপটহ বিদীর্ণ করা হয়েছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে সেই মতবাদেরই প্রতিধ্বনি শোনা যেত।
এবং এ সরকারি অফিসারের দল এ কুটুম্বিতার কাছে হাটু গেড়ে এমন ভাব করত যেন তারা সোনার বাছুরের কাছে নতজানু হয়েছে। তারা বোধহয় ভাবত যে তাদের বিনয় এবং অমায়িকতায় অন্য পক্ষের সততার অভাব ঢাকা পড়ে যাবে। এভাবে তারা প্রতিটি নির্দেশের পুর্ণ মর্যাদা দিত।
এমন কি ভিয়েনাতে থাকাকালীন মাঝে মাঝে সরকারি অফিসারদের ভাষ্য এবং ভিয়েনার সংবাদপত্রের বিষয়বস্তুর মধ্যে পার্থক্য দেখে রেগে যেতাম। কিন্তু তবু ভিয়েনা ছিল জার্মান শহর; অন্তত দূর থেকে দেখতে তো বটেই। তাই ভিয়েনা ছেড়ে বেরোলেই সবাইকে অন্য ধরনের অবস্থার মুখোমুখি হতে হত। বিশেষ করে শ্লাভ কোন দেশে গেলে। প্রাগের সংবাদপত্রগুলোর প্রতি নজর দিলে এক লহমায় বোঝা যেত এ তিন কুটুম্বের বাজীকরের ভেল্কী কত উন্নত। প্ৰাগে অবশ্য সেই সুদক্ষ রাজনীতির ভাগ্যে গালাগাল আর ঘৃণা মিশ্রিত নাক সিটকানো ছাড়া আর কিছু জোটেনি। এমন কি শান্তির সময় বিজয় উৎসবে যখন দুই সম্রাট পরস্পরের কপালে চুম্বন করে বন্ধুত্বের চিহ্ন স্বরূপ, সেইসব সংবাদপত্রগুলো তখনো বিশ্বাস করতে রাজী নয় যে–মুহূর্তে হঠাৎ ঝিকমিক করে জ্বলে ওঠা গৌরব নিবালির্দেনের আদর্শ বাস্তবে রূপায়িত করতে গেলে তা নিভে যাবে।
কয়েকবছর পর প্রচণ্ড ক্রোধ জেগে ওঠে; এ মৈত্রী বাস্তবের পাথরে পরীক্ষার জন্য টেনে আনা হয়। ইতালি যে ত্রি-পাক্ষিক মৈত্রীর জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে যায় শুধু তাই নয়, অপর দুজনকে একা ফেলে রেখে সে গিয়ে শত্রুশিবিরেও যোগ দেয়। ইতালি অস্ট্রিয়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে এক সারিতে যুদ্ধ করেছে, — এ কথা অবিশ্বাস্য। অবশ্য কুটনীতজ্ঞদের মত যদি সে অন্ধত্বরোগে না ভোগে। ঠিক এ ধারণাটা অস্ট্রিয়ার লোকদের তখন ছিল।
অস্ট্রিয়াতে একমাত্র হাবুবুর্গ আর অস্ট্রিয়ার জার্মানরা এ মৈত্রী সমর্থন করেছিল। হাবুসবুর্গ অত্যন্ত ধুর্তামীর সঙ্গে আঁক কষে এবং নিজেদের স্বার্থে ও প্রয়োজনে এ কাজ করেছিল। জার্মানরা সরল বিশ্বাস এবং রাজনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় এ মৈত্রীকে সমর্থন জানিয়েছিল। তাদের এ সরল বিশ্বাস ছিল যে এ ত্রি-পাক্ষিক মৈত্রীকে সমর্থন জানিয়ে তারা জার্মান সাম্রাজ্যের সেবা করছে এবং তাদের প্রতিরক্ষাকে শক্ত ও একত্রিত করায় সাহায্য করছে। তবু বলতে বাধা নেই, এ ধরনের ধ্যান ধারণার জন্য তাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। আসলে এ ধারণার বশবর্তী হয়ে কাজ করায় তা জার্মান সাম্রাজ্যের সাহায্যের বদলে, আসলে একটা মৃতকল্প রাষ্ট্রের সঙ্গে শৃঙ্খল দিয়ে বাঁধা হয়েছে–যার যে কোন মুহূর্তে কবরের সঙ্গে গাটছাড়া বাঁধার সম্ভাবনা ছিল। সর্বোপরি, এ রাস্তায় হাবুবুর্গ নীতি অস্ট্রিয়াকে জার্মান শূন্য করতে সাহায্যই করেছে।
এ মৈত্রীর জন্য হাবুসবুর্গের বিশ্বাস ছিল যে রাজ্যের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে জার্মান সম্রাট নাক গলাবে না। সুতরাং তারা এ জার্মান শূন্য করার কাজটা সহজেই কোনরকম দায়সারা ভাবে করে যেতে পারবে। তাদের আভ্যন্তরীণ নীতি ছিল ধীরে ধীরে অস্ট্রিয়াকে জার্মান শূন্য করা। শুধু জার্মান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, কোনদিক থেকেই প্রতিবাদ আসার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু একজনের পক্ষে এ জার্মান অস্ট্রিয়ার মৈত্রী কখনই ভোলা সম্ভব হয়নি এবং সেই কারণেই তাদের স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তারা তিরস্কারের যোগ্য এ কারণে যে এ নীতির মাধ্যমে তারা এ দ্বৈত রাজতন্ত্রের ভেতরে শ্লাভ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় রত।
অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী জার্মানরা কি করতে পারে, যখন জার্মান সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা প্রকাশ্যেই তাদের বিশ্বাস এবং আস্থা হাবুবুর্গ শাসকের কাছে জানিয়ে দিয়েছেতাদের কে এতে বাধা দেবে? তবে তো প্রকাশ্যেই সবাই বলে বেড়াবে যে এরা এদের জ্ঞাতিবর্গের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে নিজেদের জাতীয় স্বার্থে, তারা যারা এত যুগ ধরে এত ত্যাগ স্বীকার করে এসেছে।
একবার যদি কোনক্রমে অস্ট্রিয়ার ওপর থেকে জার্মান প্রভাব মুছে ফেলা যায়, তবে আর এ মৈত্রীর মূল্য কতটুকু! যদি এ ত্রি-পাক্ষিক মৈত্রী জার্মানদের পক্ষে লাভজনক হত তবে উচিত ছিল না অস্ট্রিয়াতে জার্মানদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখা? অথবা, কারোর পক্ষে কি বিশ্বাস করা সম্ভব যে জার্মানি হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের মৈত্রী সংঘে টিকে থাকতে পারে যার নেতৃত্ব শ্লাভদের অধিকারে?
জার্মান কুটনীতিজ্ঞদের সরকারি ধ্যান ধারণা এবং সাধারণ জনতার হাবুবুর্গের আভ্যন্তরীণ সম্পর্কে চিন্তাধারা শুধু বোকামীরই পরিচায়ক নয়, সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞও বটে। এ মৈত্রীকে শক্ত পটভূমি ধরে নিয়ে তারা সত্তর লক্ষ একটা জাতির ভবিষ্যত নিরাপত্তা এবং অস্তিত্ব তাদের হাতে সঁপে দিয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে তার অংশীদারকে সেই শক্ত পটভূমি ভাঙার ক্ষমতা দিয়েছে, যা সে যথারীতি এবং স্থির সংকল্পে করে চলেছে। এমন একদিন আসবে যখন ভিয়েনার রাজনীতিজ্ঞদের সঙ্গে কাগজে সই করা চুক্তি ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। শেষপর্যন্ত জার্মানির কাছে এ মৈত্রীটাই হারিয়ে যাবে। ইতালি অবশ্য একাজ আগেই আরম্ভ করে দিয়েছিল।
যদি জার্মানির লোকেরা ইতিহাস পড়ত এবং কিছুটা মনস্তত্ত্বও বুঝতে পারত তবে কখনই মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করত না যে ভিয়েনা রাজদুর্গ একত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে এসে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াবে। সম্পূর্ণ ইতালি আগ্নেয়গিরির মত জ্বলে উঠত যদি একজন ইতালিয়ানকেও হাবুসবুর্গ যুদ্ধের জন্য পাঠানো হত।
এদের প্রতি ইতালিয়ানদের ঘৃণা এতই তীব্র ছিল যে ইতালিয়ানরা যুদ্ধ ক্ষেত্রে এদের শক্র ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারত না। একাধিকবার আমি এ ঘটনার সাক্ষী যখন, তখন ইতালিয়ানদের এ মৈত্রীর বিরুদ্ধে ক্রোধে ফেটে পড়তে দেখেছি। হাবুসবুর্গ রাজতন্ত্র অনেক শতাব্দী ধরে ইতালির মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে তা ভোলা অসম্ভব; এমন কি প্রচণ্ড সদিচ্ছা থাকলেও। কিন্তু এ সদিচ্ছা কারোর ভেতরেই ছিল না; না জনসাধারণ — না সরকার। সুতরাং ইতালির সামনে ছিল দু’টো পথ খোলা–মৈত্রী অথবা যুদ্ধ। প্রথমটাকে বেছে নেওয়ার সুবিধে হল ধীরে ধীরে দ্বিতীয়টার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ।
বিশেষ করে অস্ট্রিয়া এবং রাশিয়ার সম্পর্কটা যখন যুদ্ধের মাধ্যমে নিষ্পত্তির দিকে এগোচ্ছিল, তার মৈত্রী সম্বন্ধে জার্মান নীতি শুধু অর্থহীন-ই নয়, বিপজ্জনকও বটে। এটাই হল কোন উদার অথবা যুক্তিপূর্ণ চিন্তাধারার অভাবের উজ্জ্বল উদাহরণ।
কিন্তু তাহলে এ মৈত্রীর কারণটা কি? জার্মান রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য এ মৈত্রীর চেয়ে নিজেদের উৎসের ওপর নির্ভর করা উচিত ছিল। কিন্তু জার্মান রাষ্ট্রের জার্মানদের ভবিষ্যত নিরাপত্তার প্রশ্নটাই তুলে ধরে বেশি করে।
তাহলে বাকি যে প্রশ্ন রইল, তা হল এরকম : নিকট ভবিষ্যতে জাতির স্বরূপটা কি হবে? বলা যেতে পারে, সময়টা এমন হওয়া উচিত যাতে পূর্বাভাস করা যায়। এবং কিভাবে ইউরোপের জাতিদের মধ্যে শক্তির বণ্টন হওয়া উচিত যাতে জাতির সার্বিক উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সম্ভব?
জার্মানির বিদেশ নীতি যে রাজনীতিবিদ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তার পরিষ্কার বিশ্লেষণ করলে নিচের ধারণায় পৌঁছানো যায়?
জার্মানির লোক উৎপাদন তখন বছরে প্রায় ন’লক্ষ। এ বিরাট কলেবর নতুন আসা নাগরিকদের প্রয়োজনীয় সবকিছু দেওয়ার অক্ষমতা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের ওপর বিপর্যয়কারী ঘটনা হিসেবে নেমে আসবে, যদি না এ বিষয়ে পূর্বে কোন ব্যবস্থা নির্ধারণ করা যায়। তবে নিশ্চিত যে তাদের ওপর দুঃখ এবং অনাহার নেমে আসবে। এ বিভৎস বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার চারটে পথ আছে।
প্রথমত এ ব্যাপারে ফরাসী উদাহরণ গ্রহণ করে কৃত্রিম উপায়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে এ বিশাল জনতার উপস্থিতি বন্ধ করা সম্ভব।
কয়েকটি অবস্থায় বিপদের মুখে অথবা প্রাকৃতিক দৈবদুর্যোগে বা মাটি যদি পর্যাপ্ত ফসল না দেয় তবে প্রকৃতি এভাবে কোন কোন দেশে এবং জাতের মধ্যে নিজে থেকেই জন্ম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কিন্তু পদ্ধতিটি যথেষ্ট পরিমাণেই নিষ্ঠুর। তবে এতে জননক্ষমের কার্যক্ষমতাকে বাধা দেওয়া হয় না; কিন্তু যারা অতো শক্তিশালী অথবা সুস্বাস্থ্যের অধিকারী নয় এভাবে তাদের বংশাবলী অস্তিত্ব হারিয়ে কোন এক অজানাকে আলিঙ্গনে বাঁধে। যারা এ অস্তিত্বরক্ষার কঠিন পথ বেয়ে বেঁচে থাকে তাদের ইতিমধ্যেই সহস্রগুণ পরীক্ষা হয়ে গেছে যে তারা যে কোন অবস্থাতেই বেঁচে থাকতে পারে এবং জননক্ষম। সুতরাং ব্যাপারটার তো পুনরাবৃত্তি হয়েই চলেছে। এভাবে নির্দয়তার সঙ্গে ব্যক্তির লড়াই যে মুহূর্তে সে প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে অক্ষম হবে, তাকে স্মরণ করিয়ে দেবে। প্রকৃতিই জাতির শক্তি বজায় রাখে এবং উন্নততর শ্রেণীর অন্তর্গত শ্রেণী উৎপাদন করে এবং তাকে বাড়িয়ে নিয়ে চলে।
সংখ্যার অবরোহণ কিন্তু শক্তির উচ্চতাই ডেকে আনে। অবশ্যই একক ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। এবং শেষে পুরো প্রজাতিটাকেই বলশালী করে তোলে।
মানুষ প্রকৃতির বন জঙ্গলের খণ্ড খণ্ড অংশ নয়। সে মনুষ্যত্ব নামক মাল মশলার তৈরি তার জ্ঞান নির্দয়া জ্ঞানের রাণীর চেয়ে অনেক বেশি। সে একক ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব রক্ষায় বাধা দেয় না। কিন্তু জননক্রিয়ায় বিরত থাকতে পারে। একক ব্যক্তিত্বের কাছে, যে শুধু নিজের কথাই ভাবে, সমস্ত জাতির কথা নয়; এ ধরনের চিন্তাধারা তার কাছে অনেক বেশি মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন বলে মনে হবে এবং অপরটায় মনুষ্যত্ব ব্যাপারটাকেই সে খুঁজে পাবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ব্যাপারটার পরিণতি সম্পূর্ণরূপে উল্টো।
এ জননক্রিয়া বন্ধ না করে এবং একক ব্যক্তিত্বকে প্রস্তুত থাকার সংগ্রামে তৈরি করে নিতে পারলে, প্রকৃতি তার মধ্যে থেকে শ্রেষ্ঠ মানুষটাকে বেছে নেবে এবং উন্নত একটা প্রজাতিএ পদ্ধতির মাধ্যমে তৈরি হবে স্বাভাবিক উপায়ে। কিন্তু মানুষ নিজে থেকেই এ জননক্রিয়া সীমাবদ্ধ রাখে এবং জেদী হয়ে যে এসেছে তাকে যে কোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে। ইশ্বরের ইচ্ছাকে শুদ্ধিকরণ মনে হয় এবং যেন অনেক বেশি জ্ঞানের পরিচায়ক এবং মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন। প্রকৃতির ওপর জিততে পেরে সে আনন্দে উফুল্ল হয় এবং এভাবে দেখা যায় প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতেও পারা যায়। সেই সর্বশক্তিমান পিতার প্রিয় বানরটি এ ভেবে খুশি হয় যে সেই সংখ্যাবিষয়ক সীমাবদ্ধতায় সে কিছুটা আলোড়ন আনতে পেরেছে। কিন্তু তাকে যদি বলা যায় যে পদ্ধতিটি ব্যক্তিত্বের গুণ অধোগতি করে দেয়, তবে সে নিশ্চয়ই সুখী হবে না।
যে মুহূর্তে এ জননক্ষম কার্যক্ষমতাকে বাধা দেওয়া হয়, জন্মের সংখ্যাও সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে; অস্তিত্বরক্ষার জন্য স্বাভাবিক সংগ্রাম, যা শুধু স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী ব্যক্তিকেই বাঁচিয়ে রাখে, তার বদলে ক্ষীণ, দুর্বল এবং রুগ্নদের পর্যন্ত যে কোন মূল্যে বাঁচিয়ে রাখার প্রতিযোগিতায় মানুষ উন্মত্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু এ নীতি যদি চালিয়ে যেতে দেওয়া যায় তার শেষ ফলাফল হবে জাতি তার অস্তিত্বটাই হয়ত বা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলবে। যদিও মানুষ কিছুদিনের জন্য জননক্রিয়ার চিরসত্য আইনটাকে উপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু সত্বর অথবা কিছু পরে প্রতিহিংসা ঠিকই মাথা উঁচু করবে। একটি শক্তিশালী জাতি দুর্বল হয়ে পড়ে সমস্ত জাতিকে উচ্ছেদের পথ টেনে নিয়ে যাবে। শেষে চাপা পড়া আকুতি ধীরে ধীরে একসময় রূপ নিয়ে একক ব্যক্তিত্বের তথাকথিত মনুষ্যত্ববোধটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে প্রকৃতি তার স্বাভাবিক কাজ করে যাবে, যা সবলকে স্থান করে দেবার জন্য দুর্বলকে মুছে ফেলবে।
যে কোন নীতি যা জন্ম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জাতির অস্তিত্ব রক্ষায় সচেষ্ট, তা কিন্তু সেই জাতির ভবিষ্যৎ হরণ করে।
দ্বিতীয় সমাধান হল অন্ত উপনিবেশনে। এ কথাটা নিয়ে আমাদের সময়ে অনেক নাড়াচাড়া হয়েছে এবং প্রায় প্রত্যেকেরই হৃদয় ভরে উঠেছে ব্যাপারটায়। এ উপদেশের অর্থটা খুব ভাল। তবে অনেকেই এটা ভুল বুঝেছে।
এটা অতি সত্যি যে জমির উৎপাদন ক্ষমতা একটা সীমাবদ্ধ ক্ষমতার মধ্যে বাড়নো যেতে পারে, সেই জমির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে জার্মানির ক্রমবর্ধমান জন্মের একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সুরাহাও করা চলতে পারে, যাতে অনাহারটা এড়ানো যায়। কিন্তু আমাদের বোঝা উচিত যে জন্মের থেকেও জীবন-যাপনের মান অনেক বেশি দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে। খাদ্য এবং পোশাকের চাহিদা বছরে বছরে অনেক বেশি বেড়ে চলেছে। এবং সেই চাহিদার পরিমাপের সঙ্গে আমাদের প্রপিতামহদের সময়কার চাহিদার কোন তুলনাই হয় না। অন্ততপক্ষে শ’খানেক বছর আগেকার ব্যাপার ধরলে। সুতরাং এ ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল যে জমির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে পারলেই ক্রমবর্ধমান জনতার খাদ্যের চাহিদা মেটানো সম্ভব। না। সেটা কিছুদূর পর্যন্ত সম্ভব। জমি যে পরিমাণে বেশি উৎপাদন করবে, তার একটা ভাগ তো দিনে দিনে যে চাহিদা বেড়ে চলেছে তাদেরই দাবি মেটাতে চলে যাবে। এমন কি যদি এ চাহিদা সবচেয়ে নিচু রেখায় টেনে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, এবং আমরা যদি আমাদের সমস্ত শক্তি নিবিড় চাষে নিয়োজিত করি, তবু আমরা এমন একটা সীমায় এসে থমকে দাঁড়াব, যা প্রকৃতির সহজাত স্বাভাবিক ক্ষমতা। আমরা কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যত পরিশ্রমই করি না কেন, তবু আমরা মাটির উৎপাদন ক্ষমতার সীমার বাইরে কি করে যাব। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সেই ধ্বংসের সময়টা আমরা কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে দিতে পারলেও শেষপর্যন্ত তা একদিন এসে হাজির হবেই। প্রথমে মাঝে মাঝে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে, ঠিক খারাপ শস্য উৎপাদনের পরেই ইত্যাদি। দিনে দিনে যত লোক বেড়ে চলবে, দুর্ভিক্ষও ঘন ঘন হবে–দুই দুর্ভিক্ষের মধ্যবর্তী সময়টা কমে গিয়ে। শেষে একমাত্র প্রচুর ফসল উৎপাদনের সময় ছাড়া–দুর্ভিক্ষ হবে নিত্যদিনের সঙ্গী।
অবশেষে এমন একসময় আসবে, যখন প্রচুর ফসলের বছরগুলোতেও আর কুলানো যাবে না। সুতরাং ক্ষুধা আবার জাতির দরজায় এসে আঘাত করবে। প্রকৃতি আবার পা ফেলে এগিয়ে আসবে এবং কারা বাচার যোগ্য তা বাছতে শুরু করবে। অথবা, মানুষ যদি তার নিজের সংখ্যাধিক্য না বাড়াবার জন্য কৃত্রিম উপায়ে গ্রহণ করে, তার জন্য কী ভীষণ ফলাফলের মুখোমুখি তাকে তার জাতি বা প্রজাতির জন্য হতে হবে তা আমি আগেই বলেছি।
এখানে হয়ত বা কেউ আপত্তি জানিয়ে বলবে, মানুষ্যত্ববোধের জন্যই ভবিষ্যত, এবং একক কোন জাতি বা ব্যক্তির পক্ষে এখনই তা এড়ানো সম্ভব নয়।
প্রথম নজরে মনে হবে, এ আপত্তির পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে; কিন্তু আমাদের নিচের ব্যাপারগুলোকেও গণনার মধ্যে আনা উচিত।
নিশ্চয়ই সেদিন আসবে, যখন সমস্ত মানব জাতিকেই তার প্রজাতিদের বৃদ্ধি বন্ধ রাখতে হবে। কারণ তখন আর সম্ভব হবে না জমির উৎপাদনের সঙ্গে তাল রেখে এ নিত্য বর্ধিত জনসংখ্যাকে পোষণ করার। প্রকৃতিকে তখন তার পদ্ধতি কাজে লাগাতে দিতে হবে। অথবা মানুষ সেই সীমাবদ্ধতার কাজ নিজে হাতেই তুলে নেবে। এবং আজকে যা প্রচলিত তার থেকে উন্নত কোন ভারসাম্য সম্পন্ন পথ খুঁজে বার করতে হবে। কিন্তু তখন সমস্যাটা হয়ে দাঁড়াবে সমস্ত মনুষ্যজাতির; আজ যেখানে আরো বেশি জমি দখল করার জন্য প্রচুর শক্তি এবং বীর্য নেই বলে যে সমস্ত জাতিকে কষ্ট পেতে হচ্ছে যাতে তাদের প্রয়োজন মেটে, আজকের যা অবস্থা, সারা পৃথিবীতে বহু অনাবাদী জমি পতিত পড়ে আছে, সেই জমিগুলো শুধু কর্ষণের অপেক্ষা। এবং এটা ধ্রুব সত্যি যে প্রকৃতি সেই জমিগুলো কোন জাতি বা প্রজাতির জন্য পশুচারণের ক্ষেত্র ভেবে ফেলে রেখে দেবে না। এগুলো ভবিষ্যতের জন্য প্রকৃতিরই সঞ্চয় করে রাখা ভাণ্ডার। এ জমিগুলো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে, যারা নিজেদের শক্তিতে সেগুলো দখল করে পরিশ্রমের দ্বারা সেগুলো আবাদী জমিতে পরিণত করবে।
রাজনৈতিক সীমান্ত বলতে প্রকৃতি কিছু বোঝে না। পৃথিবীতে প্রাণ সঞ্চার করে দিয়ে তার কাজ হচ্ছে শক্তির লড়াই চুপ করে দেখা। যারা শক্তিমান, সাহসী এবং পরিশ্রমী তাদের সে বুকের কাছে টেনে নেয়। এবং তারা তার রাজ্যে বাঁচার একছত্র সম্রাট।
যদি একটা জাতি নিজেদের উপনিবেশে আবদ্ধ রাখে, অপরদিকে অন্য জাতিরা তাদের জমির সীমারেখা নিত্য বাড়িয়ে চলেছে, পৃথিবীতে সেই জাতি তখন বাধ্য হয় জন্ম নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিতে, যখন অন্য জাতিরা তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে, এ অবস্থা শেষমেষ এসে দাঁড়াবেই। যদি জাতিটার দখলে জমির পরিমাণ কম হয়, তবে অবস্থাটা সত্বর এ পর্যায়ে এসে উপস্থিত হবে; বর্তমানে এটা দুর্ভাগ্যজনক যে শ্রেষ্ঠ জাতিসমূহ–অথবা, খুব স্পষ্ট করে বলতে গেলে একমাত্র সংস্কৃতিসম্পন্ন জাতিরাই মানব জাতির প্রগতির ধ্বজার একমাত্র বাহক,–তারা অন্ধভাবে যুদ্ধ বর্জন বাঞ্চনীয় এবং সম্ভব এ মতবাদ মেনে নিয়েছে; এভাবে তারা আর নতুন জমিও দখল করছে না। শুধু নিজেদের উপনিবেশটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট হয়ে রয়েছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অনেক নিচু গুণসম্পন্ন জাতিরা উপনিবেশের জন্য পৃথিবীর অনেক জায়গা দখল করে রেখেছে; অবস্থাটা শেষ পর্যন্ত কোথায় এসে দাঁড়াবে নিচে তার ফলাফল দেওয়া হল :
যে সব জাতি সাংস্কৃতিক ব্যাপারে অন্য জাতের চেয়ে উঁচু, কিন্তু কম নির্দয়, তারা তাদের লোকসংখ্যা বৃদ্ধি রাখতে বাধা হবে; কারণ তাদের সীমাবদ্ধ জমির আয়তনের জন্য–যার দ্বারা এর বেশি লোকসংখ্যাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়; কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম সংস্কৃতিসম্পন্ন জাতিরা তাদের লোকসংখ্যা বাড়িয়েই চলতে পারে, কারণ তাদের কাছে তো প্রচুর জমি পড়ে রয়েছে। অন্য কথায়, এ ব্যাপার যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে দেওয়া হয়, এক সময় সমস্ত পৃথিবীটারই দখল নিয়ে বসবে এ অপেক্ষাকৃত কম সংস্কৃতিসম্পন্ন জাতিরা, যাদের শক্তি এবং কাজ করে চলার ক্ষমতা বর্তমান।
এমন এক সময় আসবে, সুদূর ভবিষ্যতে হলেও, যখন বিকল্প হিসেবে মাত্র দুটো পথ খোলা থাকবে : হয় পৃথিবীটা শাসিত হবে আমাদের আধুনিক গণতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা হিসেবে; তখন প্রতিটি মতামত লোকসংখ্যার শক্তিশালী জাতির পক্ষে যাবে। অথবা পৃথিবীটা শাসিত হবে প্রকৃতির শক্তি বন্টনের মাধ্যমে; সেক্ষেত্রে সেইসব জাতিই জয়ী হবে, যারা নির্দয় এবং আত্মবঞ্চনায় রাজী হয়নি।
কারোর হয়ত বা এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে এ পৃথিবীতে একদিন অস্তিত্ব বজায় রাখার প্রতিদ্বন্দীতায় মনুষ্য জাতির মধ্যে বীভৎস সংগ্রাম শুরু হয়ে যাবে। শেষে মানবতাবোধের আগুন গলাধঃকরণ করার পূর্বে, যা একমাত্র নির্বোধ ভীরুতা এবং বৃথা
অহংকারের সমন্বয়ে গঠিত, একদিন তা মার্চের প্রখর রৌদ্রতেজে গলে যাবে। মানুষ। মহান হয়েছে নিত্য সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পথ চলার জন্য, এ চিরস্থায়ী শান্তিতে তার সে মহত্ব নিচে নামতে বাধ্য।
আমাদের অর্থাৎ জার্মানদের পক্ষে ‘অর্ন্ত উপনিবেশ’ কথাটাই ভয়ানক; কারণ এটা আমাদের বিশ্বাস করতে উৎসাহিত করবে যে আমরা আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি বিশ্বজনীন শান্তিবাদ অনুসারে একটা পথ খুঁজে পেয়েছি এবং যা আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন তা জোগাড় না করে অর্ধ-নিদ্রিত অবস্থায় অস্তিত্ব রক্ষা করে চলবে। এ শিক্ষা যদি আমাদের লোকেরা মনেপ্রাণে মেনে নেয়, তবে পৃথিবীতে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট সঠিক জায়গা আর কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারব না। যদি গড়পড়তা জার্মান একবার এ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে যে এ পদ্ধতিতেই সে তার প্রয়োজনীয় জীবন-যাপন এবং ভবিষ্যতের নিরাপত্তা খুঁজে পাবে, তবে সে আর কিছুতেই গা হাত পা নেড়ে লাভজনক জীবন-যাপনের পথ মাড়াবে না। তখন আমাদের দেশের সামনের সবচেয়ে মূল্যবান এবং বড় প্রশ্ন বাঁচার সংগ্রামটাই নিরর্থক হয়ে দাঁড়াবে। জাতি কি এটা মেনে নিয়ে মূল্যবান এবং প্রয়োজনীয় বৈদেশিক নীতিকে মৃত কবরের সমতুল্য বলে মনে করে তাদের আশাভরা ভবিষ্যতও হেলায় দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
আমরা যদি উপলব্ধি করতে পারি যে ‘অর্ন্ত উপনিবেশ’ তত্ত্বের ফলাফল মাত্র একটা ঘটনা নয়, তাহলে আমাদের বুঝতে কষ্ট হবে যে এ ক্ষতিকর চিন্তাধারা যারা আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে, তাদের প্রথম সারিতে রয়েছে ইহুদীরা। সে তার নিজের কোমলতার কথা ভালভাবেই জানে। কিন্তু বুঝতে অক্ষম যে প্রতিটি নোংরা কাজের শিকার হল তারা; যেটা ওপর থেকে সোনা মোড়া প্রতিশ্রুতির মত লোভনীয় মনে হয়। যা প্রকৃতিকে শ্রেষ্ঠতর কৌশলে পরাজিত করবে এবং তাদের অতিরিক্ত কিছু এনে দেবে — যার সাহায্যে তারা এ নির্দয় অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে জয়ী হতে পারবে। শেষ পর্যন্ত সম্রাট বলে নিজেদের কল্পনায় ভেবে নেবে; যখন সুযোগ অল্প কিছু কাজ করার, তা হাসিমুখে করবে।
এটা জোর করে বলা যায় না যে জার্মান অর্ন্ত উপনিবেশ স্থাপন করতে হলে প্রথম সামাজিক অভাব অভিযোগগুলো দূর করতে হবে। অন্ত উপনিবেশন পদ্ধতির প্রথম ধাপে জমিগুলোকে মুক্ত করে স্বাধীন করতে হবে; কিন্তু এটাই একটা জাতির ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য যথেষ্ট নয়; তাকে নতুন জমি দখল করতেই হবে।
অবশেষে যদি ভিন্ন পদ্ধতি বেছে নিই, তবে দেখতে পাব জমিগুলো এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যখন তার বেশি ফসল উৎপাদন এদের পক্ষে আর সম্ভব নয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে জনশক্তির চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে যাবে জাতি, যার থেকে তাকে আর বাড়ানো যাবে না।
অবশেষে নিচের বক্তব্যগুলো রাখা উচিত :
এটা সত্যি যে অন্ত উপনিবেশ স্থাপন একটা সীমাবদ্ধ ব্যবস্থা; জাতীয় সীমার সীমাবদ্ধ অবস্থায় সে জমির পরিমাণ তুলনায় খুবই কম এবং তার ফলে জননক্ষম কার্যক্ষমতাকেও সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য–এ দুটো জিনিস জাতির সাময়িক এবং রাজনৈতিক জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করবে।
কতখানি পর্যন্ত জাতীয় সীমা প্রয়োজনে তা স্থির হবে জাতির বহিঃশক্তি কি পরিমাণে শক্তিশালী। জমির পরিধি যত বড় হবে, জাতির আত্মরক্ষার সুযোগও তত বেড়ে যাবে। সামরিক তৎপরতা অনেক বেশি সত্বর, সহজে এবং অনেক বেশি পরিপূর্ণভাবে নেওয়া সম্ভব হবে যদি বিরুদ্ধ জাতির জমির পরিমাণ সীমাবদ্ধ হয়। অপরদিকে যে রাষ্ট্রের জমির পরিমাণ বেশি তাদের বিপক্ষে সামরিক অভিযান চালানোও কষ্টকর। উপরন্ত সীমা বহু বিস্তৃত হলে ভয় থাকে না যে চট করে অপর কোন জাতি সে দেশ আক্রমণ করার দায়িত্ব নেবে। কারণ সেক্ষেত্রে সংগ্রাম অনেক দীর্ঘতর এবং জয় বিলম্বিত হওয়ায় বিরুদ্ধ পক্ষের শক্তি নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। সেই আক্রমণের দায়িত্ব এত বেশি যে খুব বিশেষ কারণ না থাকলে বহিঃ আক্রমণ কেউ করবেই না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সীমান্তের ওপর জাতির স্বাধীনতা বহুল পরিমাণে নির্ভরশীল। অপরদিকে যে জাতির জমির সীমা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ, আক্রমণকারীরা তার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাবেই।
সত্যি বলতে কি, জার্মান রাষ্ট্র এ দুটো কারণ এবং তার ফলাফল নিয়ে কখনই চিন্তা করেনি, তাহলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে সীমান্তটাকে সেই তুলনায় বাড়িয়ে যেত। অবশ্য এর কারণগুলোর আমি যে ব্যাখ্যা দিয়েছি তার চেয়ে অনেক আলাদা। কয়েকটা নৈতিক চারিত্রিক কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে রোধ করার চেষ্টা করা হয়নি। অন্ত উপনিবেশ স্থাপনের প্রস্তাবও রোষবশতই বাতিল করা হয়, কারণ তাদের ছিল এ ধরনের কোন ব্যবস্থা বড় জমিদারের স্বার্থে আঘাত হানবে। এ ধরনের আঘাত ব্যক্তিগত মালিকানায় প্রচণ্ড আঘাত হানার অগ্রগামী দূত হিসেবে কাজ শুরু করবে।
পরবর্তী সমস্যার সমাধান অর্থাৎ অন্ত উপনিবেশ সম্পর্কে যা কিছু কথা হয়েছিল তা শুধু বড় জমিদারের সংশয় উদ্রেক করার জন্য।
কিন্তু যে উপায়ে উপনিবেশ স্থাপনের প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল তা খুব কৌশল সম্পন্ন ছিল না। বিশেষ করে এ বাতিলের প্রশ্ন জনসাধারণের ওপর তার গভীর প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। যাহোক সমস্যার গভীর মূল পর্যন্ত কখনই যাওয়া হয়নি।
মাত্র আর দুটো পথ খোলা ছিল, যাতে এ বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় কাজ এবং রুটি জোগাড় হতে পারে।
তৃতীয়, নতুন নতুন জমি দখল করার চিন্তা করা উচিত ছিল, যাতে প্রতি বছরে এ নিত্য বর্ধিত জনসাধারণ বসবাস করতে পারে।
চতুর্থ, আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এভাবে সুসংগঠিত করা উচিত যাতে রপ্তানী বৃদ্ধি পায়, এবং বৈদেশিক ব্যবসা বাণিজ্যের লভ্যাংশের দ্বারা আমাদের জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতাও বাড়ানো যাবে, যা বর্ধিত জনসংখ্যাকে ভরণ-পোষণে সাহায্য করবে।
সুতরাং সমস্যাটা হল : কোন নীতি নেওয়া উচিত? দেশের সীমান্ত বাড়ানো অথবা উপনিবেশ স্থাপন, নাকি ব্যবসা বাণিজ্য। অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার বিবেচনার পর দুটো নীতিকেই বাতিল করা হয়; এবং তার ফলে দ্বিতীয় পন্থাটাকেই বাছা হয়। অবশ্য সন্দেহ নেই প্রথমটাই ছিল অনেক বেশি বলিষ্ঠ নীতি।
নতুন জমি দখল করে সীমান্ত বাড়ানোর আদর্শ, যাতে বর্ধিত জনসংখ্যাকে বদলানো যেতে পারে, অনেক বেশি সুযোগ পাওয়া যাবে তাতে; বিশেষ করে আমরা যদি আজকের বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যতের হিসেবটাকেও কষে দেখি।
প্রথমত এ ধরনের নীতি গ্রহণের জন্য খুব বেশি একটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত নয় যা। আমাদের কৃষক সম্প্রদায়কে জাতী সম্প্রদায়ের মধ্যে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য। আমাদের বর্তমানের অনেক শয়তানীর মূল শিকড় হল পৌর গ্রাম্য জনসংখ্যার মধ্যের অসমতা।
আজকের সামাজিক ব্যাধিগুলোর বিরুদ্ধে ভালরকম ছোট এবং মাঝারী গোছের চাষীরা আশ্রয় পেয়ে এসেছে। উপরন্তু, ঘরোয়া জাতীয় অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে এটাই একমাত্র সমস্যা সমাধানের পথ, যার দ্বারা জাতি প্রত্যেক নাগরিকের নিত্যকার ক্ষুধার রুটি জোগাতে পারে।
এ অবস্থা যদি একবার বহাল করা যায়, তবে ব্যবসা বাণিজ্য তাদের অস্বাস্থ্যকর শীর্ষস্থান থেকে জাতীয় অর্থনীতির সাধারণ পদ্ধতি নিজের জায়গায় এসে স্থান নেবে, আজকের মত জাতীয় অর্থনীতিকে সাধারণ স্থান দখল করে বসে থাকবে না; চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যেও একটা সমতা বজায় রাখবে। এভাবে শিল্প এবং বাণিজ্য জাতীয় ভিত হিসেবে কাজ না করে, একটা সাহায্যকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে। তাদের যথাযথ কাজ চালিয়ে নিতে দিয়ে, জাতীর উৎপাদন এবং জাতীয় চাহিদার মধ্যে সমতা এনে দিলে এরা জাতির ভিত দৃঢ় করার কাজ স্বাধীনভাবেই করতে পারবে, যা প্রতিটি স্বাধীন দেশেই হয়ে থাকে। এবং জাতিকে মুক্ত এবং স্বাধীন রাখতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। থাকবে, বিশেষ করে ইতিহাসের এ কুটিল সন্ধিক্ষণে।
এ সীমান্ত নীতি প্রাচ্যে সফল না হলেও একান্তভাবেই ইউরোপের জিনিস; একজনের স্থিরভাবে এবং সরাসরি এ সত্যের মুখোমুখি হওয়া উচিত। সর্বশক্তিময় ঈশ্বর তার বন্টনের রাজ্যে একটা জাতিকে অপর জাতির থেকে কখনই পঞ্চাশ গুণ বেশি দেবে না। এ আজকের ব্যাপার পর্যালোচনা করে, কারোরই উচিত নয় রাজনৈতিক সীমান্তকে চারিদিক থেকে টানাটানি করে শক্ত বিচারবুদ্ধির আদর্শগুলোর থেকে বিচ্যুত হওয়া। এ পৃথিবীতে যদি সবার প্রচুর পরিমাণে বসবাসের জায়গা নির্দিষ্ট থেকে থাকে, তবে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অংশটুকু আমাদের বুঝে নেওয়া উচিত।
অবশ্যই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে জায়গা কেউ ছেড়ে দেবে না। ঠিক এ জায়গায় আত্মসংরক্ষণের নীতি তার কাজ করবে। এবং যখন বন্ধুত্বপূর্ণ উপায়ে এ সমস্যাগুলো সমাধান করা সম্ভব হবে না, দৃঢ় মুষ্টিতে তা ধরতে হবে যা বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করতে দেয়নি। অতীতে যদি আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা আজকের মত শান্তিবাদী বোধহীনতায় নির্ভর করে থাকে, তবে আমাদের আজকের বা সীমান্ত তার তিনভাগের এক ভাগের বেশি পাওয়া উচিত নয়, এবং সম্ভবত তাহলে ইউরোপে তার ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার জন্য আর কোন জার্মানই অবশিষ্ট থাকবে না।
আমরা আমাদের সাম্রাজ্যের দুই সীমান্তের কাছে ঋণী, জার্মান, অস্ট্রিয়া হল দক্ষিণের পূর্ব সীমান্ত এবং ইষ্ট প্রুশিয়া হল উত্তরে পূর্ব সীমান্ত, যা আমাদের পূর্ব পুরুষেরা অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে নিরপেক্ষভাবে স্থির করেছিল। এবং এ সগ্রামের মধ্যেই আমরা আমাদের অন্তশক্তির বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছি, যা আমাদের শুধু জাতিগত এবং রাজনৈতিক সীমান্ত বজায় রাখতেই সাহায্য করেনি, আজ পর্যন্ত আমাদের অস্তিত্বও বজায় রেখেছে।
অনেক সমকালীন ইউরোপীয় দেশগুলো পিরামিডের মত তাদের শৃঙ্গের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ সব দেশের ইউরোপের সীমান্ত আশ্চর্যজনকভাবে ছোট, যখন তাদের উপনিবেশ এবং বৈদেশিক ব্যবসা বাণিজ্যের বোঝার সঙ্গে তুলনা করা হয়। অবশ্য এ প্রসঙ্গে এটা বলা চলতে পারে যে তাদের শৃঙ্গ ইউরোপে থাকলেও ভিত্ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে। ঠিক আমেরিকার উল্টো, যার ভিত্ রয়েছে আমেরিকা মহাদেশে আর শৃঙ্গ ছুঁয়ে রয়েছে সারা পৃথিবীতে। যা আমেরিকাকে অতুলনীয় অন্তশক্তি এনে দিয়েছে। এবং অপরদিকে এর উল্টো অবস্থার জন্যই ইউরোপের উপনিবেশ স্থাপনকারী শক্তিগুলো এত দুর্বল।
এ চিন্তাধারার বিরুদ্ধে ইংল্যাণ্ডের বলার কিছু থাকতে পারে না। যদিও বৃটিশ সাম্রাজ্যের মানচিত্রের ওপর চোখ বুলালে অনেকেরই হয়ত সমগ্ৰ অ্যাংলো-স্যাক্সন পৃথিবীটা নজর এড়িয়ে যাবে। ইংল্যান্ডের অবস্থার সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য কোন রাষ্ট্রের তুলনা চলে না; কারণ যে বিশাল সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন ভাষার উপাদানে এ মহাদেশের সামাজিক পটভূমিকা গঠিত তার সঙ্গে একমাত্র আমেরিকারই তুলনা চলে।
সুতরাং জার্মানিকে যদি বলিষ্ঠ সীমান্ত নীতি কাজে পরিণত করতে হয়, তবে ইউরোপে তাকে নতুন জায়গা দখল করতে হবেই। উপনিবেশগুলো কখনই এ উদ্দেশ্য সফল করতে পারবে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত সেগুলো বৃহৎ ভাবে ইউরোপীয়ানদের বসবাসের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। উনবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের কলোনী শান্তিপূর্ণ উপায়ে দখল করার কোন উপায় ছিল না। তাই এ ধরনের উপনিবেশ স্থাপনের চেষ্টা করার অর্থ ই ছিল প্রচুর পরিমাণে সামরিক প্রস্তুতি। সেই কারণে সামরিক সংগ্রাম ইউরোপের মধ্যেই জায়গা দখল করা সাগরের ওপারে কোন জমি দখল করার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব সম্মত ছিল।
অবশ্য এ মতবাদের জন্য প্রয়োজন জাতির একত্রিত শক্তি এ উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করা; এ ধরনের নীতি সফল করার জন্য এতে জড়িত প্রত্যেকের প্রতি আনন্দ, উৎসাহ এবং শক্তির প্রয়োজন, কখনই হেলাফেলায় চিত্তবিক্ষিপ্ত অবস্থাতে এর রূপায়ণ সম্ভব নয়। জার্মান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই সময়ে এর উদ্দেশ্য সফলের নিমিত্তে নিয়োজিত করা উচিত ছিল। এ কাজ সম্পাদন করার আগে আর কোন কাজে হাত দেওয়া উচিত হয়নি। এবং এর সম্পাদনা সুচারুরূপে শেষ করার উপায় খুঁজে বার করাই ছিল এ নেতৃত্বের প্রধান কাজ।
জার্মানির এ সত্য উপলব্ধি করা উচিত ছিল যে এ ধরনের কাজ একমাত্র যুদ্ধ দ্বারাই সম্পাদন করা সম্ভব; সুতরাং সেই যুদ্ধে আগে থেকে সবরকম সংকল্প নিয়ে নামা উচিত ছিল।
পুরো মৈত্রী সম্পর্কটার মুখোমুখি এবং মূল্যায়ণ করা উচিত ছিল এ দৃষ্টিকোণ থেকে, যদি ইউরোপে নতুন অঞ্চল অধিকার করতেই হত, তবে তা করা উচিত ছিল রাশিয়ার জমি থেকে, এবং নতুন জার্মান সাম্রাজ্যের সেই আগেকার রাস্তাতেই চলা উচিত ছিল, যে একদা টিউটনিক নাইটদের পদাঘাতে লাঞ্ছিত। এবারে অবশ্য জার্মান লাঙলের জন্য জমি জার্মান তরবারী দিয়েই দখল করতে হবে, যাতে জাতিকে তার নিত্য প্রয়োজনীয় রুটি সরবরাহ করা যায়।
এ নীতি সফলভাবে রূপায়ণের জন্য ইউরোপের মাত্র একটা দেশের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করা উচিত। সেটা হল ইংল্যান্ড।
একমাত্র ইংল্যান্ডের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনের দ্বারাই এ নতুন জার্মান ধর্ম-যুদ্ধে তার রথের পেছনের চাকা রক্ষা করতে সমর্থ। এ অভিযানের স্বপক্ষে যুক্তি এত বলিষ্ঠ, পূর্ব পুরুষেরা। এর বিপক্ষে যেসব যুক্তি দেখিয়েছে সেগুলো অত নির্ভরশীল মোটেই নয়। পূর্বদেশের অধিকৃত জমিতে উৎপাদিত শস্যের দ্বারা তৈরি রুটি খেতে শান্তিবাদীরা কখনই গররাজী হবে না, যদিও প্রথম লাঙলকে ব্যবহার করতে তরবারী হিসেবেই বলা হয়েছে।
কোন ত্যাগই মহান নয়, যদিও ইংল্যান্ডের বন্ধুত্বের নিমিত্ত এটা প্রয়োজন। উপনিবেশ এবং নৌ-শক্তিতে একছত্র সম্রাট হওয়ার স্বপ্ন দেখা পরিত্যাগ করা উচিত এবং বৃটিশ শিল্পের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করাটাও উচিত হবে না।
একমাত্র সুস্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট নীতির সাহায্যে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। এ নীতি অবশ্য পৃথিবীর বাজার জয়ের চেষ্টাটাকে পরিহার করতে বলবে। এবং সঙ্গে সঙ্গে উপনিবেশ স্থাপন এবং নৌ-যুদ্ধে শক্তিমান হওয়ার আশাটাকেও পরিত্যাগ করতে হবে। রাষ্ট্রের সমস্ত শক্তি এ স্থল যুদ্ধে নিয়োজিত করার আবশ্যক। এ নীতি বলিষ্ঠ এবং মহান ভবিষ্যতের জন্য বর্তমানে কিছুটা আত্মত্যাগ স্বীকার করতে বলবে।
এমন এক সময় ছিল যখন ইংল্যান্ড এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে একটা রফায় আসত; ইংল্যান্ড ভালভাবেই বুঝেছিল, নিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে জার্মানির সমস্যাটা। ইংল্যান্ডের সাহায্যে ইউরোপে অথবা পৃথিবীর অন্য কোন প্রান্তে তার জমি দখল নিতান্তই প্রয়োজন।
এ দৃষ্টিভঙ্গিই হয়ত বা এ শতাব্দীর শেষে লন্ডনকে জার্মানির এত কাছাকাছি টেনে এনেছিল।
এ প্রথম জার্মানির মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যার পরিণতি নেহাত-ই করুণ। লোকে এ অসুখী ধারণা নেয় যে পরে হয়তো বা আমরা ইংল্যান্ডের কাছে তাদের বাদাম আগুন থেকে উদ্ধার করে দেওয়ার জন্য তৈরি থাকবে। এ যেন একটা মৈত্রী সম্পর্ক, শুধু দেওয়া নেওয়ার পরিবর্তে আর যে কোন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে বেড়ে উঠতে পারে। এবং ইংল্যান্ডকেও সেই পারস্পরিক দর কষাকষির দলে ফেলা যায়। ব্রিটিশ কুটনীতিজ্ঞরা তখনো যথেষ্ট বুদ্ধিমান, যে কাজ ইতিমধ্যেই করেছে, তারা জানে এর সমতুল্য প্রাপ্তি আসন্ন।
ধরে নেওয়া যাক, ১৯০৪ সালে আমাদের জার্মানদের বৈদেশিক নীতি অত্যন্ত ধূর্তামির সঙ্গে পরিচালিত হয়েছিল, যা জাপানীদের সঙ্গে আমাদেরও অংশগ্রহণে বাধ্য করে। এর ফলাফলের তীব্রতা সহজে বোঝা সম্ভব নয়, যার ফলাফল জার্মানিকেই ভোগ করতে হয়েছিল।
মহাযুদ্ধ না হতেই ১৯০৪ সালে যা রক্তপাত হয়েছে–১৯১৪ পর্যন্ত তার এক দশমাংশ রক্তপাত হত কিনা সন্দেহ। এবং আজকে পৃথিবীর মানচিত্রে জার্মানি কত উঁচুতে স্থান পেত।
যে কোন শর্তে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মৈত্রীর বন্ধন তখন অসম্ভব ছিল।
এ গলিত শবের মত রাষ্ট্রটা কখনই জার্মানির সঙ্গে নিজেকে জড়াত না যুদ্ধের উদ্দেশ্যে। বরং চিরস্থায়ী শান্তি বজায় রাখত, যার দ্বারা ধীরে ধীরে জার্মানদের এ দ্বৈত রাজতন্ত্রের থেকে নির্মূল করা যায়।
চরিত্রের এ অস্বাভাবিকতার আরেকটা দিক হল জার্মান জাতীয় স্বার্থরক্ষায় ওরা কখনই সক্রিয়ভাবে পাশে এসে দাঁড়াত না। কারণ তখন ওরা নিজেরাই উপলব্ধি করত যে নিজেদের নীতি, অর্থাৎ নিজেদের সীমান্তের ভেতরেই জার্মানদের নির্মূল করার কাজ চালিয়ে যাওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি জার্মানি নিজেরাই দৃঢ় জাতীয় মনোভাবের সাহায্যে এবং যথেষ্ট পরিমাণ নির্দয়তার সঙ্গে এ হাবুসবুর্গ রাষ্ট্রের দশলক্ষ অধিবাসীর ভাগ্য নির্ধারণের খেলায় না জড়াত। তবে হাবুসবুর্গ কখনই মহান এবং সাহসী জার্মানদের মদত দিত না। পুরনো জার্মান রাষ্ট্রের মনোভাব অস্ট্রিয়ার প্রতি হল জাতির বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করার ক্ষমতার পরীক্ষার মত।
যাহোক, জার্মানদের ওপর নির্যাতনের নীতি অস্ট্রিয়াকে চালিয়ে যেতে দিতে কখনই উচিত হয়নি, বাধা দেওয়া দূরে থাক। বরং বছর বছর তা বেড়ে গিয়ে শক্তিশালীই হয়েছে। অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মৈত্রীর মূল্যায়ণ সঠিক হত যদি সেখানকার জার্মানদের ওপরে তুলে ধরা যেত। কিন্তু তা করা হয়নি।
তারা স্বপ্ন দেখেছিল পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের; কিন্তু ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখে বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে তারা দাঁড়িয়ে।
এ শান্তির জন্য স্বপ্ন দেখার পেছনে এক গভীর অর্থ নিহিত ছিল, কারণ ওপরে উল্লিখিত তৃতীয় পথ অর্থাৎ ভবিষ্যৎ জার্মানির সম্প্রসারণকে বেছে নেওয়ার কথা কর্তব্যের মধ্যে ধরা হয়নি। ব্যাপারটা হল নতুন জমি দখল করে সীমান্ত বাড়ানো একমাত্র পূর্বদিকেই সম্ভব ছিল; কিন্তু তা করতে গেলে যুদ্ধ অনিবার্য, তখন তারা যে কোন মূল্যে শান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছে। জার্মানির এক সময়ের বৈদেশিক নীতির ধুয়া ছিল; জার্মান জাতির সংরক্ষণে যে কোন পথ বেছে নাও। এখন সেটার পরিবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কোন উপায়ে পৃথিবীর শান্তি রক্ষা করতে হবে। আমরা অবশ্য এর ফলাফল জানি। আমি এ বিষয়ের ওপর আরো বিশদভাবে পরে আলোচনা করব।
তবে আরেকটা বিকল্প পথ হল, যাকে আমরা চতুর্থ বলতে পারি। এটা হল শিল্প এবং পৃথিবীব্যাপী বাণিজ্য, নৌ-শক্তি এবং উপনিবেশ স্থাপন।
এ ধরনের উন্নতি অনেক তাড়াতাড়ি এবং সহজে করা সম্ভব। কোন জায়গায় উপনিবেশ স্থাপন এক অতি ধীর গতিসম্পন্ন পদ্ধতি; প্রায়ই সেটা পুরো শতাব্দী জুড়ে করতে হয়। তবু বলতে হবে, এর জন্য প্রয়োজন অন্তশক্তির। হঠাৎ অতি উৎসাহের বশে এ কাজ করা কখনই সম্ভব নয়, বরং ধীরে ধীরে অনেক বাধা বিঘ্ন সহ্য করেই এটা করা যায়, যা শিল্প উন্নতির চেয়ে একেবারে ভিন্ন। শিল্পোন্নতি কয়েক বছর সময়ের মধ্যে বিজ্ঞাপনের দ্বারা করা সম্ভব। অবশ্য এর ফলাফল খুব একটা দৃঢ় ভিত্ সম্পন্ন হয় না। বরং দুর্বল, যাকে সাবানের বুদবুদের মত ক্ষণস্থায়ী বলা যেতে পারে। নতুন সীমান্ত অধিকার করে সেখানে কৃষক বসিয়ে কৃষি কাজের জন্য ক্ষেত প্রস্তুত করার চেয়ে একটা পুরো নৌ-বহর গড়ে তোলা অনেক বেশি সহজ কাজ।
কিন্তু একথাও সত্যি যে পুরো নৌ-বহর ধ্বংসও কৃষিক্ষেত্রের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি হয়। এ পদ্ধতিকে অনুসরণ করার অর্থই হল আজ হোক কাল হোক জার্মানিকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া, এটা জার্মানির বোঝা উচিত ছিল। একমাত্র ছোট ছেলেমেয়েদের পক্ষেই বিশ্বাস করা সম্ভব যে মিষ্টি এবং তৈলাক্ত মধুর সম্ভাষণ অবিরত অকপট স্বীকার দ্বারাই তাদের কলার ভাগ পেতে পারে, যা তারা ধরে নিয়েছিল জাতিগুলোর বন্ধুত্বের বিনিময়ে পাবে, এবং তার জন্য কখনো তাদের যুদ্ধে নামতে হবে না।
একবার আমাদের এ পথ বেছে নেওয়ার অর্থই হল আজ হো কাল হো ইংল্যাণ্ড আমাদের শত্রু হতে বাধ্য। অবশ্য আমাদের বোকার মত ধারণার সঙ্গে এটা ঠিক খাপ খেয়ে গিয়েছিল। তবুও আমাদের ঘৃণা-মিশ্রিত রোষ বাড়ানো এর দ্বারা অমূলক ছিল। সত্যি বলতে কি, এমন একদিন এল যখন ব্রিটিশ আমাদের শান্তি প্রিয়তার মোকাবিলা করল নির্দয় চরম হিংস্র স্বার্থবাদীতার মাধ্যমে।
স্বাভাবিকভাবেই আমরা এ কাজ কখনই করতাম না।
রাশিয়র বিরুদ্ধে ইউরোপের সীমান্ত দখল নীতি সফল করা সম্ভব হত যদি আমরা ইংল্যান্ডের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারতাম। অপরদিকে একমাত্র রাশিয়ার সাহায্যেই উপনিবেশ স্থাপন এবং পৃথিবীব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব ছিল। কিন্তু সে ক্ষেত্রে এ নীতির আগাগোড়া ফলাফল ভেবে সচেতন মন নিয়ে গ্রহণ করা উচিত। সবচেয়ে আগে যেটা প্রয়োজন অস্ট্রিয়াকে সবার আগে বাতিল করা।
শতাব্দীর শেষে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মৈত্রী প্রকৃত অর্থেই সমস্ত দিক থেকে নিরর্থক হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য রাশিয়ার সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনের কথা কেউ চিন্তা করেনি, তেমনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য ইংল্যান্ডের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনের কথাও কেউ ভাবেনি। কারণ উভয়ক্ষেত্রেই ফলাফল গিয়ে যুদ্ধে পরিণতি লাভ করত এবং একমাত্র যুদ্ধ এড়াতেই শিল্প এবং বাণিজ্য নীতিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। এটা তৎকালে বিশ্বাস করা হয়েছিল, যে শক্তির সাহায্যে চিরদিনের জন্য পৃথিবী জয়ের বদলে ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা পৃথিবীটা জয় করা সম্ভব; এবং এটা শান্তিপূর্ণ নীতিও বটে।
অবশ্য মাঝে মাঝে এ নীতিটা সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ যে থাকত না, তা নয়। বিশেষ করে বেশ কয়েকবার যখন ইংল্যান্ডের দিক থেকে ধারণার অতীত সাবধান বাণী উচ্চারিত হল, — এ কারণেই নৌ-বহর তৈরি করা হয়েছিল। ইংল্যান্ডকে আক্রমণ বা লাঞ্ছিত করার উদ্দেশ্য নয়। একমাত্র পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের মতবাদটাকে সংরক্ষণের নিমিত্তে,–যা ওপরে বলা হয়েছে, এবং সেই শান্তিপূর্ণ উপায়ে পৃথিবীটা জয়ের উদ্দেশ্যেই এ কাজ করা হয়েছিল। সে কারণে এ নৌ-বহর একটা নির্দিষ্ট পরিসীমার মধ্যে ধরে রাখা হয়েছিল। নৌ সংখ্যা এবং ওজনের দিক থেকে নয়, যুদ্ধার্থে প্রস্তুতির দিক থেকেও। এ উদ্দেশ্যের পেছনে এ নীতিই কাজ করেছে। আমরা প্রমাণ করতে তৎপর যে এ নৌ-বহরের সৃষ্টি শান্তি স্থাপনের জন্য প্রয়োজন,–যুদ্ধের কারণে নয়।
বাণিজ্যিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে পৃথিবী জয়ের ব্যাপারটা সম্ভবত রাষ্ট্রের আদর্শ পরিচালনার ব্যাপারে সবচেয়ে নিরর্থক বড়। এ নিরর্থক ব্যাপারটা বোকামীর চরম পর্যায়ে ওঠে যখন ইংল্যান্ডকে এ ব্যাপারে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে বলা হয় যে ব্যাপারটা বাস্তবে কিভাবে প্রয়োগ করতে হয়। ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের মতবাদ এবং রাজ্য সম্বন্ধে আমাদের তথাকথিত পাণ্ডিত্যপূর্ণ ধ্যান-ধারণা অপূরণীয় ক্ষতি করেছে এবং আমাদের লোকেরা না বুঝে কিভাবে ইতিহাস শেখে। সত্যি বলতে কি, বাণিজ্যিক উপায়ে পৃথিবীটা জয়ের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড হল যুক্তিপূর্ণ উদাহরণ। ইংল্যান্ড ছাড়া পৃথিবীতে আর কোন জাতি বাণিজ্যিক উপায়ে পৃথিবী জয়ের জন্য তরবারী ধরেনি এবং অপর কোন জাতি এত নির্দয়তার সঙ্গে এ বিজয়কে সংরক্ষণও করেনি। ব্রিটিশ রাজনীতি বিদ্যা বিশারদদের কি এটা চারিত্রিক গুণ নয়, যে তারা জানে রাজনৈতিক শক্তিটাকে অর্থনীতির সাফল্যে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, এবং বিপরীতভাবে অর্থনীতির সাফল্যটাকে রাজনীতির শক্তি হিসেবে কিভাবে ব্যবহার করতে হয়? কি বিস্ময়র ভূল এটা ভেবে নেওয়া যে ইংল্যান্ড তার নিজস্ব অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের জন্য নিজের রক্ত ঢালবে। ইংল্যান্ডের নিজস্ব জাতীয় সৈন্যদলে এ সত্যের কোন মূল্য নেই। সেই ব্যাপারে এ মুহূর্তে এটা সামরিক প্রধান রাজ্যও নয়, বরং হাতের কাছে যা সৈন্য পাওয়া যায় তা দিয়ে কাজ সারে–মনের জোরে আর গন্তব্যে পৌঁছনোর স্থিরতায়। ইংল্যান্ডের প্রয়োজন মাফিক সৈন্য দল সবসময়ই ছিল এবং আছে। সে সবসময়েই যুদ্ধ করে এসেছে সেইসব অস্ত্র দিয়ে যা যুদ্ধ জয়ের জন্য প্রয়োজনীয়। যতক্ষণ পর্যন্ত পর্যাপ্ত বেতন দেওয়া সম্ভব, ততক্ষণ পর্যন্ত বেতন ভোগী সৈন্যদলের সাহায্যেই সে লড়ে এসেছে। কিন্তু যখন আত্মত্যাগের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে–সেই মুহূর্তে বিজয়ের জন্য জাতির রক্ত ঢালতে সে কসুর করেনি। এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে এ সগ্রাম করার ইচ্ছা, একগুয়ে মনস্থিরতা এবং নির্দয় সামরিক ব্যবহার একভাবে বজায় রেখেছে।
এ অসংগতিপূর্ণ ধ্যান ধারণা ধীরে ধীরে কিন্তু যত্নের সঙ্গে জার্মান জীবনের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে গেছে। এ অবমূল্যায়ণের জন্য আমাদের ভাল মতই জরিমানা দিতে হয়েছে; এ প্রবঞ্চনা এত গভীরে যে ইংরেজদের আমরা ধূর্ত ব্যবসায়ী হিসেবে ঘৃণাই করে এসেছি; এবং ব্যক্তিগতভাবে ধরে নিয়েছি এরা অবিশ্বাস্যভাবে অতি নিচু ধাপের কাপুরুষ। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের ইতিহাসের গর্বিত শিক্ষকরা তাদের ছাত্রদের কাছে এ সত্য কখনই উদঘাটিত করেনি যে শুধুমাত্র প্রতারণা আর জোচ্চুরি দ্বারা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মত এতবড় একটা সাম্রাজ্য কখনই গড়ে তোলা সম্ভব নয়। যে কয়েকজনের চোখে পড়েছিল এ সত্য, হয় তারা চুপ করে থেকেছে, নয় এড়িয়ে গেছে। আমি স্পষ্ট স্মরণে আনতে পারি আমার কয়েকজন সহকর্মীর মুখাবয়ব, যখন তারা যুদ্ধক্ষেত্রে গোরা সৈন্যদলের প্রতাপ দেখে বোকার মত পরস্পরের মুখ নিরীক্ষণ করেছে। কয়েকদিন যুদ্ধের পর আমাদের সৈন্যরা উপলব্ধি করে যে এ স্কটগুলো ঠিক তাদের মত নয়, যা জার্মানরা এতদিন ধরে বলে এসেছে বা ব্যাঙ্গাত্মক বর্ণনাকারীর পর পত্রিকায় এবং সরকারি ইস্তাহারে প্রকাশ করেছে।
এ সময়েই আমি প্রথম এ বিভিন্ন ধরনের প্রচার ব্যবস্থাগুলোর যোগ্যতা বিচার করি।
এ মিথ্যা প্রকাশ, যারা বুঝিয়েছিল তাদের উদ্দেশ্য সাধন করে। ইংরেজদের প্রতি এ ব্যঙ্গ, যা মিথ্যা হলেও শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাণিজ্য দ্বারা যে পৃথিবী জয় সম্ভব সেই ধারণার সহায়ক হয়েছিল। ইংরেজরা যেভাবে সফল হয়েছে, আমাদের সাফল্যও সেইভাবে আসবে। আমাদের অনেক বেশি সাধুতা এবং স্বাধীনতা তথাকথিত বিশ্বাসঘাতক ইংরেজদের থেকে অনেক বড় সম্পদ যা আমাদের পক্ষের শক্ত হাতিয়ার। সুতরাং ধরে নেওয়া হয়েছিল যে ছোট ছোট জাতের মহানুভূতি এবং শক্তিশালী জাতিবর্গের অবস্থা আমাদের পক্ষে অর্জন করা খুব সহজেই হবে।
আমরা উপলব্ধি করিনি, যে আমাদের সাধুতা অন্যদের আমাদের প্রতি বিরূপ করে তুলেছে, কারণ আমরা নিজেরাই এটাতে বিশ্বাস করিনি। বাকি পৃথিবীটা আমাদের ব্যবহারকে ধূর্ত প্রবঞ্চনাপূর্ণ ব্যবহারের প্রকাশ বলে ধরে নেয়; কিন্তু যখন বিপ্লব আসে তখন বিস্ময়ে তারা দেখে যে আমাদের মানসিক ভাবধারা আন্তরিকতাপূর্ণ হলেও নিবুদ্ধিতার সীমার বাইরে।
একবার যদি আমরা বুঝতে সক্ষম হই যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে বাণিজ্য দ্বারা পৃথিবী জয়ের কল্পনা কতখানি নিরর্থক, তবে আমরা স্পষ্ট অন্য বিষয় ত্রি-পাক্ষিক মৈত্রীর নিষ্ফলতাও উপলব্ধি করতে পারব। কি অবস্থায় এ মৈত্রী গড়ে তোলা হয়েছিল? অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মৈত্রীতে, এমন কি ইউরোপেও আমাদের পক্ষে সীমান্ত বাড়ানো সম্ভব হয়নি। এ সত্যটাই ত্রি-পাক্ষিক মৈত্রীর ভেতরকার দুর্বলতা। একজন বিসমার্ক তার নিজের কিছু প্রয়োজনের বদলে অন্য জিনিস ব্যবহার করতে সক্ষম, কিন্তু তার কদর্য উত্তরাধিকারীদের পক্ষে এটা কখনই সম্ভব নয়, এবং সর্বোপরি বিসমার্ক যে ভিতের উপর ত্রি-পাক্ষিক মৈত্রী গড়ে তুলেছিল, তার যখন আর কোন অস্তিত্বই নেই।
বিসমার্কের সময়ে তবু অস্ট্রিয়াকে জার্মান রাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করা চলত; কিন্তু ধীরে ধীরে সার্বজনীন ভোটাধিকার পূর্ব শুরু হওয়ার পর দেশটা সংসদীয় হট্টগোলের জায়গায় পরিণত হয়, যেখানে জার্মানদের কণ্ঠস্বর কদাচিৎ শোনা যেত।
জাতিগত নীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে এ মৈত্রী সর্বনাশা। একটা নতুন শ্লাভ মহাশক্তি জার্মান সাম্রাজ্যের সীমান্ত বরাবর জেগে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ এ শক্তির জার্মান সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা রাশিয়ার থেকে ভিন্ন প্রকৃতির। এ মৈত্রী তাই শূন্যগর্ভ এবং দুর্বল হতে বাধ্য; কারণ এর সদস্যরা তাদের ক্ষমতা হারিয়ে একে একে সরকারি অফিসগুলো থেকে দূরে সরে যেতে থাকে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর কাছাকাছি অস্ট্রিয়ার সঙ্গে এ মৈত্রীর সম্পর্কটা ঠিক অস্ট্রিয়া আর ইতালির মৈত্রী সম্পর্কের পর্যায় এসে দাঁড়ায়।
এখানেও একমাত্র একটাই বিকল্প ছিল; হয় হাবুসবুর্গ রাজতন্ত্রকে সমর্থন জানানো, না হয় অস্ট্রিয়াতে জার্মানির নির্যাতনের প্রতিবাদ করা। কিন্তু বিশেষভাবে বলতে গেলে কেউ যদি এ পথ ধরে এগোয়, শেষপর্যন্ত তা গিয়ে শেষ হবে প্রকাশ্য সংঘর্ষে।
মনস্তত্বের দিক থেকেও এ ত্রি-পাক্ষিক মৈত্রীর মূল উদ্দেশ্য আত্মরক্ষার ব্যবস্থা হ্রাস করা। অথচ অপরপক্ষে এ ধরনের মৈত্রীর উদ্দেশ্যই হল পরস্পরের শক্তি সংযোজন করা, যে দল যত বাড়বে ততই তা বাস্তবে লক্ষ্য বস্তুর প্রতি সম্প্রসারণ হওয়া উচিত। এখানেও সর্বক্ষেত্রের মত সংরক্ষণে শক্তির প্রকাশ নয়, আক্রমণই হল সত্যিকারের শক্তির পরিচয়।
এ সত্য অন্যান্যরা উপলব্ধি করলেও তথাকথিত সংসদীয় সদস্যরা দুর্ভাগ্যবশত তা বুঝতে সক্ষম হয়নি। ১৯১২ সালের প্রথমপাদে লুডেনডর্ফে যে সামরিক বাহিনীর কর্ণেল এবং অফিসার ছিল, একটা স্মারকলিপিতে মৈত্রীর এ দুর্বল দিকটাকে তারা তুলে ধরে। কিন্তু রাষ্ট্রনেতারা সেই দলিলের কোন রকম গুরুত্ব দেয় না। সাধারণভাবে মনে হয়, এ ধারণা মানুষদের কাছে প্রযোজ্য, কিন্তু উন্নততর প্রজাতি যারা কুটনীতিজ্ঞ নামে পরিচিত, তাদের ক্ষেত্রে এ ধারণা অচল।
জার্মানির ভাগ্য বলতে হবে যে ১৯১৪ সালের যুদ্ধ সোজাসুজি এ কারণে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে বাধে যার জন্য হাবুসবুর্গ এ যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য হয়। যদি এ যুদ্ধের শিকড় অন্যরকম হত জার্মানিকে তার নিজের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে একা ফেলে দিত। হাবুসবুর্গ কখনই এমন কোন যুদ্ধে নিজেকে জড়াত না বা অংশ নিতে রাজী হত না যার শিকড় জার্মানিতে; অথবা যে যুদ্ধের জন্য জার্মানি দায়ী। এক্ষেত্রে যেসব অবমাননাকর ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, অস্ট্রিয়াও সেই পথেই যেত। সোজা কথা বলতে গেলে, যদি জার্মানিকে নিজস্ব কোন কারণে যুদ্ধে নামতে হত তবে অস্ট্রিয়া তার নিজের স্বার্থরক্ষায় অর্থাৎ যাতে কোনরকম বিপ্লব না বাধে, তার জন্য যুদ্ধ আরম্ভের সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে নিরপেক্ষ রাখত।
শ্লাভেরা জার্মানিকে সাহায্যের অনুমতি দেওয়ার চেয়ে ১৯১৪ সালেই এ দ্বৈত রাজতন্ত্রকে গুঁড়িয়ে দিত; কিন্তু সেই সময়ে অতি অল্প সংখ্যক মুষ্টিমেয় লোকই বুঝতে পেরেছিল এ দানুবিয়ান রাজতন্ত্রের সঙ্গে মৈত্রীর বিপদ।
প্রথমত অস্ট্রিয়ার শক্ৰসংখ্যা অনেক ছিল যারা সাগ্রহে এ জীর্ণ শীর্ণ রাষ্ট্রটাকে পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে দখল করার তালে ছিল; সুতরাং এরা ধীরে ধীরে জার্মানির প্রতি একধরনের তীব্র ঘৃণা পোষণ করতে শুরু করে। কারণ জার্মানি হল এ দ্বৈত রাজতন্ত্র ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ার পথের একমাত্র বাধা। এ দ্বৈত রাজতন্ত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ুক এটাই ওদের আশা এবং এ ব্যাপারে তাদের তীব্র স্পৃহা ছিল। ওদের ধারণা গড়ে ওঠে যে বার্লিনের মধ্যে দিয়েই একমাত্র ভিয়েনাতে যাওয়া সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, এ নীতি গ্রহণ করে জার্মানিকে অন্যান্যদের সঙ্গে মৈত্রী গড়ার সবচেয়ে ভাল সুযোগ নষ্ট করে। এসব সম্ভাবনার বদলে যে কেউ অনুভব করতে পারত জার্মানির সঙ্গে রাশিয়া, এমনকি ইতালিও সম্পর্কের একটা টানাপোড়েন চলেছে। এবং এসব সত্ত্বেও এটা সত্যি যে অস্ট্রিয়ার প্রতি রোমের মনোভাব বিদ্বেষ ভাবাপূর্ণ হলেও, জার্মানির প্রতি তাদের ধারণা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল। এ শত্রু পক্ষীয় মনোভাব প্রতিটি ইতালিয়ানের ভেতরেই সুপ্ত অবস্থায় ছিল, এবং যে কোন ছুতানাতায় তা ব্যাপকভাবে রূপ নিত।
বাণিজ্য এবং শিল্প নীতি গ্রহণ করায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের কোনপ্রকার ইচ্ছেই কারোর মধ্যে ছিল না। একমাত্র জার্মান এবং রাশিয়া, এ দেশের শত্রুরাই এ অবস্থায় ভেতরে যুদ্ধ বাধাবার জন্য সক্রিয় ছিল। সত্যি বলতে কি, একমাত্র ইহুদী এবং মার্কসীষ্টরাই উত্তেজিত করার চেষ্টা করত।
তৃতীয়ত, এ মৈত্রী নিরাপত্তার পক্ষে একটা চিরস্থায়ী বিপদ হয়ে দেখা দেয়। যে কোন বৃহৎ শক্তি যারা বিসমার্ক সাম্রাজ্যের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন ছিল তাদের পক্ষে সেই রাষ্ট্রগুলোর সৈন্য সমাবেশ করা সহজ ছিল, কারণ অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হলে জার্মানকে লুণ্ঠন করার সুযোগ পাওয়া যাবে–স্রেফ প্রলোভনে লুব্ধ হয়ে।
অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ইউরোপের পূর্ব দেশগুলোকে একত্রিত করা কিছুমাত্র কঠিন কাজ ছিল না, বিশেষ করে রাশিয়া আর ইতালিকে। রাজা এডোয়ার্ডের নেতত্বে পৃথিবীর যেসব। দেশ সম্মেলনে যোগ দেয়, তা কখনই সত্যে পরিণত হত না, যদি না জার্মানির মিত্র অস্ট্রিয়া তাদের লুষ্ঠিত দ্রব্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এতটা প্রলুব্ধ না করত। এ সত্যটাই একমাত্র সম্ভব করে তুলেছিল এতগুলো রকমারি রাষ্ট্রের পাঁচ মিশেলি, যাদের স্বার্থ একটা বিন্দু থেকে নানাদিকে বিচ্ছুরিত, যা তাদের সবাই মিলে একটা সৈন্যশ্রেণী সুসংবদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। প্রতিটি সদস্য কল্পনা করছে অস্ট্রিয়ার খরচায় নিজেদের ধনী করতে পারবে যদি তারা জার্মান আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। তুকী পর্যন্ত এ দুর্ভাগ্যজনক মৈত্রীর মৌন সমর্থকের দলে ভিড়ে জার্মানির বিপদটাকে বাড়িয়ে খুব বিপজ্জনক সীমায় নিয়ে গেছে।
ইহুদী আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থা এ টোপ স্রেফ জার্মানিকে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিল। কারণ অন্যান্য দেশের মত জার্মানি ব্যবসা বাণিজ্যের দিক থেকে কখনই তাদের নেতৃত্বকে মেনে নেয়নি।
এ উপায়েই অনেকগুলো রাষ্ট্রকে এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছিল যাতে অন্ততপক্ষে দলে ভারী হওয়া যায়, যা দৈহিক সংঘর্ষের শিঙ বিশিষ্ট সীগফ্রীডের* সঙ্গে কাজে লাগবে।
হাবুসবুর্গ রাজতন্ত্রের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্কে অস্ট্রিয়া থাকাকালীন আমি অত্যন্ত ঘৃণা করতাম এবং ব্যাপারটা গভীরভাবে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল; নিজের সঙ্গে অবিরত বোঝাপড়ার চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত আমি এ উপসংহারে আসি যা আগে বলেছি।
যে ছোট্ট গোষ্ঠীর মধ্যে আমি যোরাফেরা করতাম, সেখানেও আমি আমার মনোভাব গোপন করিনি যে এমন একটা রাষ্ট্রের সঙ্গে এ দুর্ভাগ্যজনক চুক্তি, শুধু দুঃখ কষ্ট পাওয়ার জন্যই যার ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত। যদি জার্মান তার থেকে মুক্ত না হয়, তবে তার ভাগ্যে মহাদুর্ঘটনা ডেকে আনবে। আমি এক মুহূর্তের জন্যও সেই অভিমত থেকে সরে দাঁড়াই নি। এমন কি বিশ্বযুদ্ধের ঝড় যখন কার্যকারণের জাহাজটাকে ভগ্নাবশেষ করে দিয়ে তার কার্যক্ষমতা প্রায় শেষ করে এনে তার জায়গায় নিয়েছে অন্ধ উৎসাহ, এমন কি সেই গোষ্ঠীর মধ্যেও শীতল এবং শক্ত বিষয়ের প্রতি বস্তৃতান্ত্রিক চিন্তাধারা আন্দোলিত হতে শুরু করেছে। ট্রেঞ্চের মধ্যেও এ সমস্যাগুলোর অবতারণা হলেই আমি বেশ উঁচুস্তরেই আমার মতামত তুলে ধরতাম। আমার অভিমত ছিল যে জার্মানি যদি হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের সঙ্গে তার সম্পর্কচ্ছেদ করে, তবে তার ক্ষতি কিছু হবে না, বরং শত্রু কমবে। লক্ষ লক্ষ জার্মান শিরস্ত্রাণ পরেছিল একটা দুর্নীগ্রিস্ত রাজবংশকে রক্ষা করার জন্য নয়, জার্মানদের পরিত্রাণের জন্য।
যুদ্ধের আগে একদল জার্মানের অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জার্মানির এ মৈত্রী সম্পর্কে সামান্য সংশয় ছিল; মাঝে মাঝে জার্মান গোঁড়া গোষ্ঠী এ মৈত্রীর ওপর বেশি আত্মবিশ্বাস রাখার বিরুদ্ধে সাবধান বাণী উচ্চারণ করত। কিন্তু অন্য অন্য উপদেশাবলীর মত এটাকেও হাওয়ায় ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছিল। সাধারণের ধারণা হল পৃথিবী জয়টা সমুচিত, তাতে আত্মত্যাগ নামমাত্র, কিন্তু সাফল্য প্রচণ্ড।
আবার একবার অদীক্ষিত মানুষগুলোর করার কিছু ছিল না, শুধু সোজা ধ্বংসের দিকে হেঁটে চলা ছাড়া এবং তাদের প্রিয়জনকে একই কাজ করতে প্রলুব্ধ করত, যেমন করে ইঁদুরগুলো হ্যামলিনের বাঁশীওয়ালাকে অনুসরণ করছিল।
আমরা যদি গভীরভাবে ব্যাপারটাকে পর্যালোচনা করি যা পৃথিবী জয়ের অনর্থক কল্পনা এতগুলো লোকের কাছে সত্য বলে প্রতিভাত হয়েছে, যে ব্যবসা-বাণিজ্য দ্বারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে পৃথিবী জয় সম্ভব, এবং জাতির চরম লক্ষ্য এটাই হওয়া উচিত। আমরা খুঁজে দেখলে দেখতে পাব যে এটা দেহ মনের ব্যাধি থেকে উৎপন্ন যা জার্মান রাজনৈতিক চিন্তার দেহটাতে অনুপ্রবেশ করেছিল।
প্রযুক্তি বিজ্ঞানের জার্মানিতে বিজয় এবং জার্মান শিল্পের চমৎকার প্রগতি এবং সমৃদ্ধি বাণিজ্য আমাদের ভুলিয়ে দিয়েছিল যে একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র হয়ে ওঠার পক্ষে এগুলো পূর্ব-আবশ্যক।
উপরন্তু নির্দিষ্ট গোটাকয়েক গোষ্ঠী তত্ত্বটার অনুভূতি সম্পর্কে প্রকাশ করতে শুরু করে যে একটা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এসব অদ্ভুত ব্যাপারের ওপরেই নির্ভরশীল। সর্বোপরি অর্থনৈতিক স্বার্থ দেখার জন্য একটা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান করা উচিত। সুতরাং তারা এ অভিমতেই আসে যে অর্থনৈতিক গঠনশীলের ওপর রাষ্ট্র নির্ভরশীল। এ ব্যাপারটাকে গৌরবান্বিত করে দেখা এবং বলিষ্ঠ আর, স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া হয়।
এখন সত্য হল যে একটা রাষ্ট্রের ব্যক্তিগতভাবে কোন অর্থনৈতিক ধ্যান ধারণা বা প্রগতির ব্যাপারে করণীয় কিছু নেই। এটা পরস্পর প্রতিদ্বন্দী দলের থেকে উদ্ভূত কোন আঁটসাঁট ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য কোন সীমাবদ্ধ পরিসীমা। রাষ্ট্র হল বেঁচে থাকা প্রাণীদের একটা সামাজিক ব্যবস্থা যা গোষ্ঠীর শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক ব্যবস্থার প্রতিপালন করে থাকে, এবং সময়োচিত আয়োজন দ্বারা সে সেইসব জাতি বা শাখার শুধু অস্তিত্বই বজায় রাখে না; লালন পালনও করে। অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য আরো কয়েকটা সহায়ক পথের মত একটা পথ মাত্র। কিন্তু তাই বলে অর্থনৈতিক কার্যকলাপই রাষ্ট্রের একমাত্র উদ্দেশ্য বা মেরুদণ্ড নয়, যদি তা না মিথ্যা এবং অতিপ্রাকৃত কোন বস্তুর ওপরে তার ভিত হয়ে থাকে। এবং এটাই ব্যাখ্যা করার পক্ষে যথেষ্ট যে এ কারণেই কোন রাষ্ট্রকে কোন নির্দিষ্ট সীমান্তের ভেতরে থাকতেই হবে, এমন কোন কারণ নেই যা রাষ্ট্রের উন্নতির একটা কারণ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। এ শর্ত হল অত্যাবশ্যক তাদের কাছে যারা তাদের জাতিবর্গকে তাদের সত্তা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেবে তাদের শিল্পের মাধ্যমে, এর অর্থ হল তারা তাদের কর্মের মাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সচেষ্ট।
যে সব লোক তাদের পথ থেকে গোপনে সরে গিয়ে অন্যের রাজনৈতিক দেহে পরগাছার মত অপরের দ্বারা নিজেদের কাজ করিয়ে নেয় বিভিন্ন রকমের ভাগ করে, তারা যে রাষ্ট্র গড়বে সেই রাষ্ট্রে কোন নির্দিষ্ট সীমার প্রয়োজন নেই। এটা বিশেষ করে কোন পরগাছা জাতির ক্ষেত্রে প্রয়োজন, বর্তমান সময়ে যারা মনুষ্যত্বের সততার দিকটার দোহাই পাড়ে; আমি অবশ্য সেই ইহুদীদের সম্পর্কে বলছি।
ইহুদী রাষ্ট্র কখনই একটা সীমার মধ্যে ছিল না। এটা সমস্ত পৃথিবী ব্যাপী ছড়ানো, কোথাও কোন সীমান্ত ছাড়া। সব সময়ই তাদের সদস্যরা বিশেষভাবে একটা জাতির থেকেই এসেছে। সেই কারণেই ইহুদীরা সর্বদা রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র তৈরি করেছে। একটা প্রধান প্রতিভাশালী কৌশল হল যা সব সময় অভিসন্ধিমূলক, ইহুদীরা তাদের রাষ্ট্র নামক জাহাজটাকে সব সময় ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে নিয়ে গেছে, কারণ বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাস সম্পর্কে আর্যদের বিশ্বাস অপরিসীম। কিন্তু এ কারুকার্যময় আইনের অর্থ আর কিছুই নয়, এ মতবাদের আড়ালে নিজেদের অর্থাৎ ইহুদী জাতির সংরক্ষণ। সুতরাং এ আইন তাদের সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনৈতিক বিজ্ঞান, সব ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়েছে শুধু লক্ষ্যে পৌঁছবার নিমিত্ত।
একটা প্রজাতির নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সহজাত প্রবৃত্তি হল তাদের সামাজিক সংগঠন করার প্রাথমিক কারণ।
সুতরাং রাষ্ট্র হল জাতিগত যান্ত্রিক গঠন, অর্থনৈতিক কোন সংস্থা নয়। এ দুটি বিষয়ের পার্থক্য এত বেশি যে ব্যাপারটা ধারণার অতীত যা আমাদের সমকালীন রাষ্ট্রনেতারা বোঝে না। তার জন্য তারা মনে করে যে রাষ্ট্র একটা অর্থনৈতিক গঠনশৈলীর ওপরে নির্ভরশীল, কিন্তু সত্য ব্যাপার হল যে এটা উদ্ভূত হয়েছে প্রজাতি এবং জাতিবর্গের সংরক্ষণের চেষ্টা থেকে। কিন্তু এ গুণগুলো সব সময়েই কাব্য সংস্কৃতির ওপরে নির্ভরশীল, বাণিজ্যিক অহমিকায় নয়। প্রজাতিদের সংরক্ষণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন একক ব্যক্তিত্বের আত্মত্যাগ। কবির নিচের কথাগুলোর মানেই হল :
যদি তোমার জীবনটাকে পণ না কর,
তবে তুমি তোমার জীবনটাকে জয় করতে পারবে না।
শিলার : ভ্যালেনস্টাইন।
একক ব্যক্তিত্বের অস্তিত্বের আত্মত্যাগ জাতির রক্ষায় অতি প্রয়োজনীয়। সুতরাং এটা হল জাতি স্থাপনে এবং সংরক্ষণের অতীব প্রয়োজনীয় একটা শর্ত, যা সমস্বার্থতা এবং একই জাতীয় চরিত্রের ওপরে নির্ভরশীল এবং একই বিষয়গুলো রক্ষণের নিমিত্ত যে কোন মূল্য দিতে স্থির সংকল্পে অবিচল থাকা দরকার। যে সব লোকেরা তাদের নিজেদের সীমান্তের ভেতরে বসবাস করে তারা স্বভাবতই এ কারণে তাদের বিশ্বাসঘাতকতা এবং ছলচাতুরীর দিকটাই উন্নত করে, যদি না আমরা স্বীকার করি যে এ চরিত্র তাদের সহজাত এবং রাজনৈতিক ধরন ধারণের ওপর এত পরিবর্তন নির্ভর করে যা এ পরগাছা জাতির সহজাত অভিব্যক্তি।
রষ্ট্রের প্রথম অবস্থায় মানুষের চরিত্রের এ বীরত্বপূর্ণ দিকটায় অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়, যা আমি আগে বলেছি। এবং যারা এ অস্তিত্বরক্ষার সংগ্রামে পরাজিত হয়, অর্থাৎ যারা অধীনতা স্বীকার করে নেয়, আজ হোক কাল হোক তাদের অদৃশ্য হয়ে যেতেই হবে, এবং একই পথের পথিক তাদেরও হতে হবে যারা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বলিষ্ঠতা না দেখিয়ে অস্তিত্বরক্ষার সগ্রামে নামবে বা অহমিকার বৃথা চর্চায় মনোনিবেশ করবে। এসব ক্ষেত্রে পরাজয়ের কারণ বুদ্ধিমত্তার অভাবের জন্য নয়, সাহস এবং দৃঢ় সংকল্পের অভাবের জন্যই এটা হয়ে থাকে। এ ব্যাপারটাকে গোপন করার জন্য মানুষের অনুভূতি শক্তি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
রাষ্ট্র সংগঠনের ভিত কখনই অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। উপরন্তু, অর্থনীতির সঙ্গে এর সম্পর্ক অতি অল্প বা নেই বললেই চলে। এবং এটা সুস্পষ্ট যে রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত শক্তির সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের একত্রে মিল খুব কমই থাকে। এর অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, যখন দেখা যায় অর্থনৈতিক প্রগতি সত্ত্বেও রাষ্ট্র ধ্বংসের মুখে এগিয়ে চলেছে। মানুষের সামাজিক ব্যবস্থা অর্থনৈতিক উন্নতির সময়ে রাষ্ট্রের শক্তিও সর্বোচ্চ হওয়া উচিত। বরং উল্টো হওয়াই বিচিত্র।
বিশেষ করে এটা বোঝা অত্যন্ত কষ্টকর যে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক শক্তি দ্বারা সমৃদ্ধ এবং সংরক্ষণ করা সম্ভব এ বিশ্বাসের প্রচলন হয়, যদিও ইতিহাস এর বিরুদ্ধেই বারে বারে রায় দিয়েছে। প্রুশিয়ার ইতিহাসই পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে নৈতিক চালই একটা রাষ্ট্র গঠন করে, এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপারে কোন ভূমিকা নেই। এ নৈতিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে অর্থনীতি উন্নতি করা সম্ভব এবং তা ফুলে ফেঁপে ওঠে যতদিন না পর্যন্ত সৃজনশীল রাজনৈতিক ক্ষমতা হ্রাস পায়। এবং তার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক গঠনশৈলীও ভেঙে পড়ে, যা আমাদের চোখের সামনে ভয়াবহভাবে ঘটে চলেছে। মনুষ্য জাতির বস্তৃতান্ত্রিক উন্নতি বলিষ্ঠ নৈতিকতার ছায়াতেই একমাত্র বেড়ে ওঠা সম্ভব। যে মুহূর্তে তাদের জীবনের প্রাথমিক ধ্যান ধারণা হিসেবে গণ্য করা হবে, সেই মুহূর্তেই তা তাদের অস্তিত্বটাকেই ধ্বসিয়ে দেয়।
যখনই জার্মানির রাজনৈতিক শক্তি বিশেষভাবে শক্তিশালী ছিল, তখনই অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি হয়েছে। কিন্তু যখনই মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক অবস্থা প্রধানতম স্থান নিয়েছে, তখনই জীবনের শ্রেষ্ঠ আদর্শগুলোকে ঠেলে পেছনে সরিয়ে দিয়েছে; সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের ভিত্ ধ্বসে পড়ে পেছনে পেছনে অর্থনৈতিক ধ্বংসও ডেকে এনেছে।
আমরা যদি সৃষ্টি এবং সংরক্ষণের জন্য কি কি প্রয়োজন, এ প্রশ্নটাকে বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাব :
কর্মক্ষমতা আর সবার উন্নতির জন্য একক ব্যক্তিত্বের আত্মত্যাগ–এ গুণগুলোর মধ্যে অর্থনীতির কোন সম্পর্কই নেই। একথা অতি সত্য, বৈষয়িক কোন উন্নতির জন্য মানুষ আত্মত্যাগ করে না। অন্য কথায় সে তার আদর্শের জন্য মৃত্যুবরণ করতে পারে, কিন্তু ব্যবসার জন্য নয়। জনসাধারণের মনস্তত্ত্বের চমকপ্রদ দিকটা যা ইংরেজরা মহাযুদ্ধের সময়ে তুলে ধরেছিল, আমার মনে হয় এর চেয়ে ভাল করে সাধারণের মনস্তত্ত্ব আর কেউ বুঝতে পারে নি। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম রুটির জন্য; কিন্তু ইংরেজ ঘোষণা করে যে এটা তাদের মুক্তিযুদ্ধ। এবং তাও তাদের নিজেদের মুক্তির জন্য নয়। তারা তাদের ছোট্ট জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে চলেছে। জার্মানরা ইংরেজদের এ দৃষ্টতায় হেসেছিল, এবং বলতে বাধা নেই মনে মনে ক্রুদ্ধও কম হয়নি। কিন্তু এভাবে তারা প্রমাণ করে দিয়েছিল যে আমাদের কূটনীতিজ্ঞদের মধ্যেও রাজনৈতিক সচেতনতা যুদ্ধের আগেই কত কমে গিয়েছিল, এ সব তথাকথিত কুটনীতিজ্ঞদের বিন্দুমাত্র ধারণাও ছিল না যে কী শক্তি মানুষকে স্বেচ্ছায় এবং দৃঢ় সংকল্পে মৃত্যুর মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে।
১৯১৪ সালে যুদ্ধে যখন জার্মানরা বিশ্বাস করত যে তারা একটা আদর্শের জন্য যুদ্ধ করছে, ততদিন পর্যন্ত তারা দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থেকেছে। যেইমাত্র বলা হয়েছে যে তারা দৈনন্দিন রুটিন তাগিদায় যুদ্ধ করছে, তক্ষুনি তারা যুদ্ধ পরিত্যাগ করে সরে দাঁড়িয়েছে।
ধূর্ত রাষ্ট্রনেতারা এ পরিবর্তিত অনুভূতিতে বিস্ময়াভূত হয়ে পড়ে। তারা একথাটা কখনই বুঝে উঠতে পারেনি যে যখন মানুষকে নিছক বস্তৃতান্ত্রিক কারণে ডাকা হবে, তখন তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবে মৃত্যু এড়িয়ে যেতে; মৃত্যু এবং বৈষয়িক ফলশক্তির উপভোগ পরস্পর বিরোধী ধারণা। এমন কি দুর্বলতম মহিলাও নায়িকা হয়ে দাঁড়াবে যদি তার সন্তানের জীবন বিপজ্জনক অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। সর্ব যুগে দেশ, জাতি এবং রাষ্ট্রকে রক্ষা করার তীব্র ইচ্ছাই মানুষকে তার শত্রুর অস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড় করায়।
নিচের ব্যাপারগুলোকে সত্য বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে যা সব সময় ভাল বলে প্রতিপন্ন হয়েছে :
একটা রাষ্ট্রে অভ্যুদয় কখনই বাণিজ্যিক কারণে হয় না। এমন কি শান্তিপূর্ণ বাণিজ্যিক সেবাতেও নয়। রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের কারণ হল একটা গোষ্ঠীর প্রতিপালনের সহজাত প্রবৃত্তির থেকে। এ সহজাত প্রবৃত্তির অভিব্যক্তি বীরত্ব ব্যঞ্জক বা ছল-চাতুরী পূর্ণ, যা-ই হোক না কেন। প্রথম অবস্থায় আমাদের রাষ্ট্র ছিল আর্য রাষ্ট্র; যার ভিত্ ছিল কর্মের আদর্শে এবং সাংস্কৃতিক প্রসারতার ওপরে নির্ভরশীল। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, আমাদের রাষ্ট্রে ইহুদীদের পরগাছা উপনিবেশে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে অর্থনৈতিক স্বার্থ জাতি প্রীতি এবং সংস্কৃতির ওপরে প্রভুত্ব বিস্তার করে, তালাক বা রাষ্ট্র যার ভেতরেই হোক না কেন, এ অর্থনৈতিক স্বার্থ এসব কারণগুলোকে আগা করে দিয়ে পরাভব এবং অত্যাচার ডেকে আনে।
যুদ্ধের পূর্বে জার্মানিতে এ বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে জার্মানির পৃথিবী জয় একমাত্র বাণিজ্যিক এবং উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমেই সম্ভব যা সত্যিকারের রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্য অর্থাৎ জাতির সংরক্ষণ এবং অত্যুদয় সেই লক্ষ্যেই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সংকল্প, দূরদৃষ্টি, ও বাস্তবতার দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। যে গুণগুলো রাষ্ট্রের সঠিক উন্নতির প্রধান সোপান। মহাযুদ্ধ এবং এর ফলাফল এ গুণগুলোকে একেবারে দেউলিয়া করে ছাড়ে।
যারা ব্যাপারটাকে নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেনি, তাদের কাছে জার্মানদের মনোভাব বিশেষভাবে অদ্রবণীয় হেঁয়ালী বলে মনে হয়েছে। সর্বোপরি, জার্মানি নিজেই একটা সাম্রাজ্যের সুন্দর উদাহরণ যা সম্পূর্ণ রূপে ক্ষমতার নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। প্রাশিয়া, যা নাকি জার্মান সাম্রাজ্যের উৎপাদনক্ষম কোষ বলে পরিগণিত, তৈরি হয়েছিল নায়কোচিত কার্যকল্প দ্বারা। অর্থনৈতিক বা ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর ভিত্তি করে নয়। এবং সম্রাট নিজে এ নেতৃত্বের চমৎকার যোগ্য ব্যক্তি, যে নেতৃত্বে ক্ষমতার নীতি এবং সামরিক শৌর্য বীর্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত।
তবে সেই একই জার্মানদের রাজনৈতিক সহজাত প্রকৃতির এতটা অধঃপতন হল কি করে? এটা শুধু একটা একক ব্যাপারের ওপর নির্ভর করে এ অবক্ষয়িত অবস্থায় এসে পৌঁছায় নি, দেহমনের ব্যাধি দ্বারা উৎপন্ন রোগাদির অসংখ্য লক্ষণ প্রচণ্ডভাবে রাজনৈতিক দেহে ফুটে উঠেছিল। যা জাতির দেহটাকেই কুরে কুরে খেয়ে ফেলেছিল বিষাক্ত ঘায়ের মত। মনে হচ্ছিল কেউ যেন অলক্ষ্যে এ নায়কোচিত দেহের রক্তে রহস্যজনক হাতে কোন বিষাক্ত তরল পদার্থ ঢুকিয়ে দিয়েছে, যা ব্যপ্ত হয়ে পড়েছে সর্বত্র। এবং ধীরে ধীরে ডেকে এনেছে শরীরের এ পঙ্গুতা, যার জন্য নিজেদের সংরক্ষণের সহজাত প্রবৃত্তিটাই হারিয়ে ফেলেছে।
১৯১২-১৪ সালে আমি এ সমস্যাগুলো নিয়ে নিত্য নিজের মনে তোলপাড় করতাম, যার সঙ্গে এ ত্রি-পাক্ষিক মৈত্রী এবং অর্থনৈতিক নীতি সম্পর্কটাকে সম্রাট অনুসরণ করত। আবার আমি এ মতে উপস্থিত হই যে এ হেয়ালীর একমাত্র কারণ হল সেই শক্তির প্রভাব যার সঙ্গে আমার পরিচয় ভিয়েনাতে। যদিও তা আমি অন্য ধরনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছি। যে শক্তির কথা আমি বলেছি তা হল মার্কসীয় শিক্ষা। সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি–সমগ্র জাতির মধ্যে যার পরিব্যাপ্তি।
আমি আবার দ্বিতীয়বার জীবনে এ বিধ্বংসী শিক্ষার গভীরভাবে বিশ্লেষণ করি। এবারে অবশ্য আমি আমার নিত্যকারের পরিবেশ এবং প্রভাব মুক্ত হয়ে বিশ্লেষণের তাগিদায় প্রশ্নটাকে বিচার বিবেচনা করিনি। বরং জার্মানির রাজনৈতিক জীবনের ব্যাপার স্যাপারগুলোর ওপরেই আমার পর্যবেক্ষণ সীমাবদ্ধ রেখেছি। এ নতুন পৃথিবীর তত্ত্বের দিকটা মানসিক কোদাল দিয়ে খনন করতে গিয়ে আমি এ শিক্ষানীতির সুস্পষ্ট ফলাফল দেখতে পাই, মার্কসীয় নীতির তাত্ত্বিক দিকটার সঙ্গে আজকের ঘটা সংস্কৃতি, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যাপারগুলোর তুলনা করি।
আমার জীবনে প্রথম আমি এ মহামারীর পরাজয়ের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি।
বিস্মার্কের অপূর্ব আইন প্রণয়ন প্রণালী অনুধাবন করি; এর ধ্যান ধারণা, প্রয়োগ এবং ফলাফল। ধীরে ধীরে আমার নিজস্ব মতামতের একটা দৃঢ় ভিত্তি গড়ে ওঠে, যা পাথরের ন্যায় দৃঢ়; যে কারণে ভবিষ্যতে সাধারণ সমস্যাগুলোর জন্য আর আমাকে মন পরিবর্তন করতে হয় নি। এর সঙ্গে সঙ্গে আবার আমি মার্কসিষ্ট এবং ইহুদীজাতির ভেতরকার সম্পর্কটা বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করি।
আমার ভিয়েনায় প্রবাসের দিনগুলোতে জার্মানিকে আমি দেখতাম শান্ত বিশাল প্রতিমূর্তি বিশেষ। তবু মাঝে মাঝেই প্রচণ্ডরকমের সন্দেহ এবং অবিশ্বাস আমাকে অস্থির করে তুলত। নিজের মনে মনে এবং ছোষ্ট্র যে গোষ্ঠীর সঙ্গে আমি মিশতাম, জার্মান বৈদেশিক নীতি নিয়ে তাদের সঙ্গে আমি পর্যালোচনা করতাম এবং আমার চিন্তাধারায় মার্কসিস্টদের অবিশ্বাস্য আগা পথে তাদের প্রতি ব্যবহার করা হত; যদিও তখন। জার্মানির এটা একটা মূল সমস্যা ছিল। আমি বুঝতে পারি না এ চরম বিপদের মধ্যে কি করে তারা বদ্ধ চক্ষুবশত হোঁচট খেত, যার প্রতিক্রিয়া ছিল আবশ্যক যদি প্রকাশ্যে ঘোষিত মার্কসীয় নীতি বাস্তবে রূপায়িত করা হত; এমনকি সেদিন, অত শীঘ্র আমি আমাকে ঘিরে থাকা লোকদের সতর্ক করে দিয়েছিলাম, আমি বৃহত্তর দশককেও তাই করেছি যে এ সমস্ত শান্ত করা স্লোগান হল অলস এবং বিফল : আমাদের কিছু হবে না। এ একই ধরনের রোগের সংক্রমণে ইতিমধ্যেই বিরাট একটা সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছে। যে আইন সমস্ত মানবজাতিকে দাসে পরিণত করে, তার বাইরে কি জার্মানি যেতে পারবে?
১৯১৩-১৯১৪ সালে প্রথম আমি আমার মতামত বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ব্যক্ত করি; যার মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক এখন ন্যাশনাল স্যোশালিস্ট মুভমেন্টের সদস্য। কিভাবে জার্মান জাতি তার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা পেতে পারে তা নির্ভর করছে কিভাবে মার্কসীয় মতবাদকে নিমূল করা যাবে।
আমি বিশ্বাস করি ত্রি-পাক্ষিক মৈত্রীর সর্বনাশকর কার্যকলাপ হল মার্কসীয় শিক্ষার আংশিক প্রতিক্রিয়া; এ নীতি সবার অলক্ষ্যে বলিষ্ঠ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভিতে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। যারা ঘন ঘন এ চিন্তাধারায় নিজেদের কলুষিত করেছে, তারা এ সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির থেকে উদ্ভুত বিপদ এবং তাদের উদ্দেশ্যটাকে ধরতে পারেনি; যদিও তা’ তারও আগে সংক্রামক ব্যাধি দ্বারা আক্রান্ত ছিল, যা মাঝে মাঝে জাতির অস্তিত্বটাকেই বিনষ্ট করে টুকরো টুকরো করে দিতে উদ্যত হয়েছে। কখনো কখনো চিকিত্সার সাহায্যে রোগের লক্ষণগুলোকে তারা দূর করবার চেষ্টা করেছে, যা তাদের ধারণায় হল মূল কারণ। কিন্তু কেউ প্রকৃত রোগের কারণ বা তার শিকড়টাকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করেনি। এ পথে মার্কসের নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেও কোন ফল না পেয়ে তারা স্রেফ হাতুড়ে বদ্যির মলম দিয়ে রোগ সারাবার প্রচেষ্টায় নেমেছে।
———-
*কার্লাইলের রূপকথায় বর্ণিত, শিঙবিশিষ্ট সীগফ্রীড।