মাইন ক্যাম্ফ – অ্যাডলফ হিটলার: ০৩. ভিয়েনায় প্রবাসের দিনগুলোয় আমার

মাইন ক্যাম্ফ – অ্যাডলফ হিটলার: ০৩. ভিয়েনায় প্রবাসের দিনগুলোয় আমার

০৩. ভিয়েনায় প্রবাসের দিনগুলোয় আমার

রাজনৈতিক চিন্তাধারা তিরিশ বছর বয়স হবার আগে কোন পুরুষের প্রকাশ্যে কোন রাজনৈতিক ঘটনাতে অংশগ্রহণ করা উচিত নয় বলেই আমি মনে করি। অবশ্য প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমের মত এক্ষেত্রেও যদি ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা তার থাকে, তবে তা স্বতন্ত্র কথা। এটা বলাবাহুল্য আমার মতামত। এর কারণ হল তিরিশ বছর পর্যন্ত মানুষের মানসিকতাটা গড়ে ওঠে দৈনন্দিন যেসব সমস্যার উদ্ভব হয়, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে, সেসব অভিজ্ঞতাগুলোকে উল্টেপাল্টে এদিক ওদিক সরিয়ে সে একটা নির্দিষ্ট চিন্তায় স্থির হতে পারে; আর এটাই তাকে ভবিষ্যত রাজনৈতিক চিন্তাধারার ভিত্ গড়তে সাহায্য করে। তার পক্ষে সব বিষয়ে মনস্থির করে একটা নির্দিষ্ট পথ নেওয়া সম্ভব হয়। একজন পুরুষের পক্ষে প্রথম উচিত হল সাধারণ জ্ঞানের একটা ভান্ডার নিজের মধ্যে গড়ে ভোলা, যাতে জীবন সম্পর্কে তার নিজস্ব চিন্তাধারার একটা সুসংবদ্ধতা লাভ করতে পারে। অর্থাৎ যাকে এককথায় জীবন দর্শন বলে। তাহলে তার একটা নিজস্ব মানসিক ব্যারোমিটার গড়ে ওঠে, যেটা ছাড়া তার পক্ষে দৈনন্দিন কোন সমস্যা সম্পর্কে নিজের বিচার বিবেচনা গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। এবং এটাই তাকে কোন রাজনৈতিক বিষয়ে দৃঢ় এবং স্থির সংকল্প নিতে সাহায্য করবে। আপাতদৃষ্টিতে এ ধরনের পুরুষ তার রাজনৈতিক চরিত্রের দিক থেকে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের যোগ্যতা রাখে।

এ ধরনের মানসিক জমি প্রস্তুত না করে যদি কেউ রাজনীতিতে প্রবেশ করে, তবে সে উভয় সংকটে পড়তে বাধ্য। প্রথমে সে উপলব্ধি করবে জরুরী কতগুলো ঘটনায় তার চিন্তাধারা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত, তার চিন্তাধারা অসমর্থনীয় হওয়াতে তার আগের মতবাদ সমর্থন না পাওয়ায় স্বভাবতই তাকে আরও ভাল জ্ঞান এবং পরিপূর্ণ বিচারের আশায় ছুটতে হবে। যদি সে তার আগের চিন্তাধারাটাকে আঁকড়ে পড়ে থাকে, তবে অতি শীঘ্র এমন এক সংকটপূর্ণ জায়গায় এসে দাঁড়াবে যে সেটা অতিক্রম করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য। কারণ তা হলে তার চিন্তাধারায় এত বেশি অসংগতি দেখা যাবে যে তাকে কেউ নেতা বলে আগের মত মানবে না। আর তার অধীনস্থ পাটির লোকেরা সহজেই বুঝে ফেলবে যে যাকে তারা এত দিন নেতা বলে মেনে নিয়েছে, তার চরিত্রে পরিবর্তন তাদের মধেও নৈরাশ্য এনে দেবে, যেটা তাদের নেতা আগে কখন সহ্য করত না।

যদি সে দ্বিতীয় পথ অবলম্বন করে যেটা ইদানীং অহরহ ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রে। জনসাধারণকে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির পেছনে নিজের মানসিক প্ররোচনা কাজ করে না। এটার উর্ধ্বগতিতে তাকে বেশি করে ভাবিয়ে তোলে। এবং বিষয়বস্তুর ওপরেই ভাসিয়ে নিয়ে বেড়ায়। ভেতরে ঢুকতে দেয় না। সুতরাং আত্মরক্ষার খাতিরে তাকে নোংরা পথ বাধ্য হয়েই অবলম্বন করতে হয়। যেহেতু সে নিজেই তার স্বপ্নের পেছনে দৃঢ়ভাবে। দাঁড়ায় না, তাই কোন মানুষই মনেপ্রাণে সেই মতবাদকে বিশ্বাস করে না এবং তার জন্য

জীবন দিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রস্তুতও হয় না। তখন সে তার অনুবতীদের কাছ থেকে। আরও বেশি কিছু দাবি করে। সত্যি বলতে কি, যত বেশি পরিমাণে তার নিজের চিন্তাধারার স্বচ্ছতা এবং মানসিক গতিবেগ হ্রাস পায়, তত বেশি চাপ আসে তার অনুগত কর্মীদের ওপর। শেষপর্যন্ত সত্যিকারের নেতৃত্বের খোলসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে সে শুধু খেলাই করে। এভাবে দিনে দিনে তার দৈনন্দিন কাজকর্মের অসংলগ্নতা সামঞ্জস্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়। এর সঙ্গে যোগ হয় অসত্যতা আর একগুয়েমী মনোভাব,—যেটার সমাপ্তি হওয়া সম্ভব একেবারে চরমে উঠে। দলিত মানুষদের দুর্ভাগ্যের জন্য এ ধরনের লোকেরা নিজেদের দুধের বোতলটাকে দৃঢ় হাতে ধরে নিয়ে বসে পার্লামেন্টে, আর নিজের সন্তান-সন্ততি এবং পরিবারের সমস্ত রকম বিলাসিতার খরচ জোগাড় করতেই রাজনৈতিক খেলা দেখায়।

পরিবারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে তার রাজনৈতিক খেলাও বাড়তে থাকে। সে কারণে যে মানুষ নিজেকে রাজনীতির খেলায় যত বেশি দক্ষ বলে মনে করে, নিজেই সে নিজের তত বড় শত্রু। প্রতিটি নতুন সংগ্রামের ক্ষেত্রে সে নিজেকেই ধাক্কা দিয়ে নিচের দিকে নামিয়ে নিয়ে চলে এবং তার চেয়ে যোগ্যতর যে কোন ব্যক্তিকেই সে নিজের আলোয় অযোগ্য বলে মনে করে।

এ সমস্যার গভীরে ঢোকার সময় এ ধরনের নিচ লোকগুলো পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে কিভাবে ওপরে ওঠে তার বিশদ ব্যাখ্যা করব।

একজন মানুষ যখন তার ত্রিশ বছরের বন্দরে পা রাখে, তখন তার সমুদ্রযাত্রার অনেক বাকি। অর্থাৎ তার সামনে শিক্ষণীয় অনেক কিছু পড়ে থাকে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে তার আগের চিন্তাধারাটাকেই আঁকড়ে ধরে বসে থাকে,—যেটা তার জীবনের সংগে ততদিনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে গেছে। নতুন যেগুলো সে শোনে, সেগুলো আগেকার আদর্শগুলোকে পরিত্যক্ত করতে পারে না, বরং মনের অবচেতনে গভীরভাবে গেঁথে দেয়। তার সহকর্মীরা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় না যে তারা তার চিন্তাধারা বা আদর্শ নিয়ে প্রতারিত হচ্ছে। উপরন্তু তাদের নেতাদের নতুন চিন্তাধারাকে পরিপাক করার ক্ষমতা দেখে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। সুতরাং তার অনুগামীদের মধ্যে নেতার মতবাদে আরও বিশ্বাস আনে। তাদের চোখে এ ধরনের প্রতিটি ঘটনা তাদের নেতার উন্নতির স্বর্ণোজ্জ্বল স্বাক্ষর।

একজন নেতা যাকে একদিন নিজের ভুলের ভিতের ওপর স্থাপিত পটভূমি ছেড়ে দিতে হয়, তখন সে আবার সম্মানের সঙ্গে কাজ শুরু করতে পারে, যদি তার পক্ষে ভুলগুলোকে ভুল বলে মেনে নিয়ে বাস্তবকে স্বীকার করার মত মানসিক জোর থাকে। এ সমস্ত ক্ষেত্রে গণজীবনের রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে তার সরে আসাটাই উচিত। একবার যখন সে ধ্বংসের পথে পা বাড়িয়েছে, দ্বিতীয় বারেও যে সেদিকে সে যাবে না তার স্থিরতা কোথায়। যাহোক এক্ষেত্রে অন্তত তার অনুগামীদের কাছ থেকে নৈতিক দাবি স্বপক্ষে থাকা উচিত নয়।

বর্তমান রাজনৈতিক নেতাদের চারিত্রিক দুনীতিপরায়ণতার এগুলো হল প্রধান কারণ। তাই আজকের রাজনৈতিক আকাশে একজনকেও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে এ দুর্নীতির আওতার বাইরে নিজেকে রেখে আলোর গতিপথে এগিয়ে চলেছে।

অবশ্য অতীতের সেই দিনগুলোয় রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর চিন্তার পেছনেই আমি বেশি সময় খরচ করতাম; কিন্তু তবু আমি রাজনীতিতে প্রকাশ্যভাবে অংশ নেওয়ার থেকে অতি সতর্কভাবে বিরত থাকতাম। যে সমস্যাগুলো অবিরত আমাকে দংশনে ক্ষত বিক্ষত করত, সেগুলো নিয়ে সীমাবদ্ধ অতি স্বল্পসংখ্যক লোকের কাছে মুখ খুলতাম, আলোচনা করতাম, সীমাবদ্ধ এ গম্ভীর আলোচনা চালানোর সুফল অনেক। নিজে কথা বলার চেয়ে আমাকে ঘিরে থাকা স্বল্পসংখ্যক লোকগুলোর চিন্তাধারা এবং মতামত বুঝতে অনেক বেশি সচেষ্ট থাকতাম। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের চিন্তাধারা এবং মতামত সে করলে ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত; তবু এ পথেই আমি মানুষ সম্পর্কে আমার জ্ঞান বাড়িয়েছি। ভিয়েনায় এ ব্যাপারে যত সুযোগ আমি পেয়েছি জার্মানদের সম্পর্কে জ্ঞান বাড়ানোর, অন্য কোথাও সে সুযোগ পাওয়া সম্ভব নয়।

জার্মানির চেয়ে প্রাচীন ভাণুবিয়ান সাম্রাজ্যের রাজনীতিতে অনেক বেশি বৈচিত্র পরিধি বিস্তৃত ছিল। অবশ্য প্রুশিয়ার কিছুটা অংশ, হামবুর্গ এবং নর্থ-সীর প্রত্যন্ত প্রদেশের কয়েকটা জেলা ছাড়া। যখন আমি অস্ট্রিয়ার কথা বলি, তখন অবশ্য হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের কথাই বোঝাই। কারণ সেই সুবিস্তীর্ণ জার্মান অধ্যুষিত হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের রাজনৈতিক জীবনের মধ্যকার সাংস্কৃতিক জীবনটা ছিল নিছকই কৃত্রিম। যত দিন যেতে থাকে তত যেন অস্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের ভিত্তিভূমি হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের বীজাণু ভর্তি ইটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

বংশগত রাজকীয় সম্প্রদায় হল সে সাম্রাজ্যের হৃদয়স্বরূপ। আর সে হৃদয়ই দেশের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রক্ত সঞ্চালনের দ্বারা নাড়ীর গতি ঠিক রাখে। এ সাম্রাজ্যের-হৃদয়ের মস্তিষ্ক এবং ইচ্ছাশক্তি হল ভিয়েনা। তখনকার দিনের ভিয়েনার চালচলন দেখে মনে হত যেন মুকুটহীন রাণী, যার আঙুল সঙ্কেতে বিভিন্ন জাতিরা মুহূর্তে একটা পিণ্ডে পরিণত হয়ে হাবুসবুর্গ রাজদণ্ডের নিচে মাথা পেতে দিত। রাজধানী শহরের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে রাজ্যগুলোর বার্ধক্যজনিত অবক্ষয়তা নজর এড়িয়ে যেত।

যদিও ভেতরে ভেতরে তখন সে সাম্রাজ্য ক্ষয়িত। কারণ আর কিছুই নয়, বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। কিন্তু বাইরের জগৎ থেকে বিশেষ করে জার্মানির নজরে তা পড়ত না। কারণ তাদের দৃষ্টি তখন সেই সুন্দর শহরের দিকেই একমাত্র নিবন্ধ। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন দৃষ্টির প্রধান কারণ হল শহর ভিয়েনা— তখন তা গৌরবের উত্তুঙ্গ শীর্ষে। সুযোগ্য মেয়রের সুন্দর প্রশাসনে সেই প্রাচীন শহর যেন যৌবনের নতুন সাজে সুসজ্জিত।

সর্বশেষে যে মহান জার্মান সাধারণ জনতার মধ্য থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিল এবং পুরো পূর্বদিকটা কজা করতে পেরেছিল, সত্যিকারের নেতা যদিও তাকে বলা যায় না, তবু এ ডক্টর লুইগের মেয়র হিসেবে এ সাম্রাজ্যের রাজধানীটিতে এতটুকু প্রাণ সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিল যে অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উভয় দিক থেকে সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের হৃদয়টাই নতুন উদ্দীপনায় জেগে উঠেছিল। সেই কারণে তৎকালীন রাজনীতিজ্ঞদের থেকে নেতা হিসেবে তার স্থান অনেক উঁচুতে।

এটাও সত্যি যে এ ধরনের পাঁচ মিশেলী জাতির সমন্বয়ে গঠিত অস্ট্রিয়া শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক অক্ষমতার জন্যেই ভেঙে পড়ে। অসম্ভব পরিস্থিতির পরিণতিই হল এ ভঙ্গুর অবস্থা। পঞ্চাশ লক্ষ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গঠিত কতগুলো প্রদেশকে, যারা প্রতিনিয়ত সংঘর্ষে লিপ্ত দশলক্ষ লোকের একটা দেশ হয়ে তাদেরকে শাসন করা অসম্ভব। যদি শেষপর্যন্ত বিশেষ সংগঠিত কোন পরিকল্পনা হাতে থাকে।

অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী জার্মানদের চিন্তাধারা সব সময়েই উঁচু ছিল। বিরাট একটা সাম্রাজ্যে বসবাস করে এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে সদা সর্বদাই সচেতন থাকত। অস্ট্রিয়ার এতগুলো প্রদেশের মধ্যে একমাত্র ওরাই একফালি জমি পেরিয়ে সীমান্তের ওপারের দেশটায় দৃষ্টি মেলে দিত। সত্যি বলতে কি, নিয়তি তাদের নিজেদের পিতৃভূমির থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিলেও, তাদের ওপর সম্পর্কিত কর্তব্য তারা ভোলেনি। এ কর্তব্য বা দায়িত্ব হল স্বদেশপ্রেম, যা তাদের পূর্বপুরুষেরাও মনেপ্রাণে পোষণ করে এসেছে। তবে এটাও স্মরণীয় যে অস্ট্রিয়ার জার্মানরা মনেপ্রাণে সেই পথের প্রয়াসী হতে পারেনি। কারণ হৃদয় এবং মস্তিষ্ক তাদের মাতৃভূমির আত্মীয়স্বজনের থেকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয়নি। সে কারণে সমস্ত শক্তি তাদের পক্ষে বিনিয়োগ করা সম্ভব ছিল না।

অস্ট্রিয়ার জার্মানদের মানসিক উদারতাও ছিল অন্যান্যদের চেয়ে বেশি। তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ সেই মিশ্রিত সাম্রাজ্যের প্রায় প্রতিটি শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত। অধিকাংশ বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের দ্বারাই পরিচালিত। শিল্প বিশেষজ্ঞ এবং উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বেশিরভাগ তাদের মধ্যে থেকেই এসেছে। এমন কি বৈদেশিক বাণিজ্যও তাদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত; বিশেষ করে ইহুদীদের এ জগতে ঠাঁই ছিল না বললেই হয়। শুধু তাই নয়, অস্ট্রিয়ার বসবাসকারি জার্মানরাই বিভিন্ন প্রদেশগুলোকে একসূত্রে গ্রথিত করে রেখেছিল। তাদের সামরিক কলাকৌশলের খ্যাতি দেশের সীমান্ত পেরিয়ে বহুদূরে গিয়েছিল। যদিও সে বাহিনীর অধিকাংশ সৈনিক জার্মান, তবু তাদের রাখা হয়েছিল হেরজে-গাভিনা এবং ভিয়েনা অথবা গেলিসিয়া প্রভৃতি জায়গায়। হাবুসবুর্গ সামরিক বাহিনীর অফিসার এবং বেসামরিক অফিসারবৃন্দ প্রায় সবাই ছিল জার্মান। বিজ্ঞান এবং শিল্পকলাও ছিল তাদেরই হাতে। তথাকথিত আধুনিক শিল্পকলার নামে আবর্জনা বিশেষ; যা এমন কি নিগ্রোদের পক্ষেও সৃষ্টি করা সহজ। বাকি উঁচু দরের শিল্পকর্ম বলতে যা বোঝায় সবাই প্রায় জার্মান গোষ্ঠী থেকেই সৃষ্টি হত। সঙ্গীত, স্থাপত্য, ভাস্কর্য বা অঙ্কন শিল্প প্রভৃতি যেসব শিল্পকর্ম দ্বারা শহর ভিয়েনা সমৃদ্ধ, তার অধিকাংশের সৃষ্টিকর্তা ছিল অস্ট্রিয়ার বসবাসকরি জার্মানরা। এবং এ ভান্ডার নিঃশেষিত হবার কোন লক্ষণও দেখা যাচ্ছিল না। সর্বপরি, এ জার্মানরাই বৈদেশিক নীতির নির্ধারক ছিল, যদিও খুবই স্বল্প পরিমাণে হাঙ্গেরীয়ানরাও এ বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে সহায়তা করত।

কিন্তু সমস্ত প্রদেশগুলোকে এক সূতোতে বেঁধে রাখার জন্য প্রাথমিক উপকরণ যা দরকার তারই অভাব ছিল অত্যন্ত বেশি।

এ বিভিন্ন প্রদেশের জাতিকে এক জায়গায় ধরে রাখার মাত্র একটাই পথ। অস্ট্রিয়ার প্রদেশগুলোকে অন্তশক্তি দিয়ে শাসনের মাধ্যমে শক্তিশালী এক কেন্দ্রের নিচে নিয়ে আসা। অন্য আর কোন পথই ছিল না যার দ্বারা এর অস্তিত্ব রক্ষা করা যায়।

মাঝে মধ্যেই ওপর মহলে এ সত্য আবিস্কার হত। কিন্তু তা কিছুক্ষণের বা কয়েকদিনের জন্য। এক সময় সবাই তা ভুলে যেত বা ইচ্ছে করে ভুলে থাকত। এ দিনের আলোর মত স্পষ্ট সত্যটাকে। কারণ এটাকে স্বীকার করে নেওয়ার মত কষ্টটাকে দৃঢ়ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে বাঁধার চিন্তাধারা কখনই কার্যকর করা হত না। এ চিন্তাধারাটাকে কার্যে পরিণত করার মত শক্তিশালী কোন কেন্দ্রও ছিল না। এখানে মনে রাখা সবিশেষ প্রয়োজন যে তকালীন অস্ট্রিয়ার অবস্থা বিসমার্ক শাসিত জার্মানির মত ছিল না। জার্মানির সমস্যা তখন একটাই; তা হল রাজনৈতিক। কারণ বিসমার্কের সময় জার্মানির সাংস্কৃতিক পটভূমিতে কোন মিশেল ছিল না। সাম্রাজ্যের প্রতিটি সদস্য একই জাতির বা গোষ্ঠীর; শুধু স্বল্প সংখ্যক কয়েকটা টুকরো ছাড়া।

অস্ট্রিয়ার গৃহ ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। হাঙ্গেরী ব্যতীত রাজনৈতিক কোন ধারা ছিল না, এবং এটা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছিল। যদি থেকেও থাকে, তবে তা ইতিমধ্যে হয় ধুয়ে মুছে লুপ্ত হয়েছে, নয় যুগের অন্ধকারে তলিয়ে গিয়ে তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সর্বপরি এ যুগটা হল জাতীয়তাবাদী উত্থানের প্রাক্-মুহূর্ত। আর সে কারণে হাবুসবুর্গ রাজদণ্ডের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেশগুলোও তার স্বাদ ইতিমধ্যে পেয়ে গেছে। এ নতুন উদ্ভুত জাতীয়তাবাদী মতাদর্শকে দমন করে রাখাও অসম্ভব। তার কারণ হল সীমান্ত ঘেঁষা সাম্রাজ্যগুলো এ নতুন জন্ম দেওয়া প্রদেশগুলো হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশগুলোর আত্মীয় হওয়াতে এর ছোঁয়া লেগে সাম্রাজ্য রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। অস্ট্রিয়ার বসবাসকারী জার্মানদের থেকে ওদের হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের ওপর প্রভাব ছিল অনেক বেশি।

এমন কি ভিয়েনা পর্যন্ত এ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খুব বেশি দিন নেতৃত্ব দিতে পারে নি। তখন বুদাপেস্তও ধীরে ধীরে ইউরোপের একটা প্রধান নগর হিসেবে সবেমাত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন কেন্দ্রীয় শক্তিগুলোকে একসঙ্গে বেঁধে না রেখে, কোন একটা বিশেষ শক্তিকে আরও বেশি শক্তিশালী করা। কিছুদিনের মধ্যে প্রাণও বুদাপেস্তের মত একই লাইনে গিয়ে ভেড়ে। পেছনে পেছনে আসে লেমবার্গ, লাইখ আর অন্যান্যরা। এসব প্রাদেশিক শহরগুলো ধীরে ধীরে রাজধানীতে রূপান্তর হওয়ায় এদের এক পৃথক সাংস্কৃতিক জীবনও গড়ে ওঠে। এবং সাধারণ জনতার মাধ্যমে। ওরা নিজেদের সাংস্কৃতিক দৃঢ় ভিত স্থাপন করে। এক সময় সাধারণ জনতার স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থটাই উঁচু হয়ে ওঠে, যখন সমস্ত পর্যায়টা এক ছন্দে ওঠে, তখনই অস্ট্রিয়ার ভাগ্য ওদের কাছে বন্ধক পড়ে।

বিশেষ করে দ্বিতীয় যোসেপের মৃত্যুর পর সমস্ত ব্যাপারটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ স্বাভাবিক দ্রুতগতি নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর, কয়েকটা বিষয়ের জন্য স্বয়ং রাজা দায়ী। বাকিগুলো অবশ্য বৈদেশিক নীতির গর্ভে উদ্ভূত।

অস্ট্রিয়ার প্রদেশগুলোকে বিশেষ কোন একটা কেন্দ্রীয় শক্তি ছাড়া একসূতোয় বাধা। একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। অন্য কিছু করার আগে সমস্ত প্রদেশগুলোয় একমাত্র একটা ভাষার প্রচলন করার দরকার। যার মাধ্যমে সরকারি কাজকর্ম চালানো সম্ভব হবে। এ একটা সুতো দিয়েই একমাত্র রাজকীয় টুকরোগুলোকে একসঙ্গে জোরে বাঁধা যায়। সুতরাং পুরো শাসন ব্যবস্থাটাই এমন এক যন্ত্রের মাধ্যমে বাঁধতে হবে, যা ছাড়া রাজনৈতিক একতা সম্ভব নয়। এভাবেই প্রতিটি বিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একই মন্ত্র জপ করে মনের এমন এক স্তরে গেঁথে দিতে হবে যে নিজেরা নিজেদের একই দেশের নাগরিক বলে মনে করে। এটা অবশ্য দশ-বিশ বছরের মত অল্প সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়। এ প্রচেষ্টা শতাব্দী ধরে চালানোর প্রয়োজন, বিভিন্ন উপনিবেশ স্থাপন করার সময় যেমন মানসিক ধৈর্যের প্রয়োজন সাময়িক উৎসাহের চেয়ে অনেক বেশি।

সুতরাং এটা বলা নিষ্প্রয়োজন যে এ পরিবেশে দেশের শাসনব্যবস্থা একত্র আদর্শে দৃঢ় হাতে পরিচালিত হওয়া উচিত।

অন্য প্রদেশের চেয়ে পুরনো অস্ট্রিয়ার অস্তিত্ব রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল শক্ত এবং সুপরিচালিত সরকারের। হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের পরিচালনার ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে অভাব ছিল মানুষ যে বাঁধনে পরস্পরকে বাধে, সে বন্ধনের। এবং কোন জাতির যদি ভিত মানবজাতির বন্ধনের ওপর গড়ে ওঠে তবে সরকার পরিচালন ব্যবস্থায় অনভিজ্ঞ হলেও সহসা তা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা নেই। যখন কোন প্রদেশ বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, তখন তাদের স্বাভাবিক জড়তা পরস্পরকে কুশাসন এবং অপরিণত শাসনব্যবস্থা; সত্ত্বেও বিস্ময়করভাবে দীর্ঘদিন ধরে রাখে।

অনেক সময় মনে হয় যে এ রাজনৈতিক দেহ থেকে জীবনের আদর্শগুলোই হয়ত বা মরে গেছে। কিন্তু যথা সময়ে দেখা যায় সে মৃতদেহগুলো আবার হঠাৎ জেগে উঠে ২ কলরব করতে শুরু করেছে, এবং এ রকম অবিনশ্বর শক্তি দেখে পৃথিবী বিস্ময় মানে।

কিন্তু যে দেশের লোকসংখ্যা মিশ্রিত নয়, সে দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। কারণ শাসন ব্যবস্থা সেখানে একার হাতে থাকলেও রক্ত তো এক নয়। যদি এমন সরকার বহাল থাকে যা ঘুমিয়ে থাকা একটা জাতিকে জাগানোর পক্ষে দুর্বল, তবে তা তাদের পক্ষে কখনই সম্ভব নয় যতক্ষণ না পর্যন্ত দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি দ্বারা কেন্দ্রীয় কোন সরকার পরিচালিত হয়। এ ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিবর্গের মধ্যে বিপদের সম্ভাবনা কম থাকে যদি শতাব্দী ধরে একই শিক্ষা, এক ট্রাডিসন এবং একই ধরনের স্বার্থ থাকে। সরকার যত নবীন হয়, কেন্দ্রের ওপর তার নির্ভরশীলতাও তত বাড়ে। যদি তাদের ভিত্ কোন সক্ষম নেতার ব্যক্তিত্বের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তবে সে নেতা বা ব্যক্তিত্বের অপসারণের সংগে সংগে সে অট্টালিকা ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা। কারণ ব্যক্তিত্ব বিরাট হলেও সে তো একক। কিন্তু শতাব্দী ধরে সহশিক্ষা থাকলেও আমি যে সব ব্যক্তিত্বের কথা বলছি তাদের এড়িয়ে যাওয়া সবসময় সম্ভব নয়। অনেক সময় তারা হয়ত বা সুপ্ত অবস্থায় থাকে, কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতা দেখলেই হঠাৎ তারা জেগে ওঠে। এবং সে সময় একক ব্যক্তিত্বের স্বার্থের স্রোতে শতাব্দী ধরে চলে আসা শিক্ষা বা ট্রাডিসন ভেসে যেতে বাধ্য।

এ সব সত্যগুলোর অবলুপ্তিই হল হাবুসবুর্গ শাসকদের অপরাধ বিশেষ।

একমাত্র একজন হাবুসবুর্গ শাসকের চোখের সামনে ভবিতব্যের আলোটা দপ্ করে জ্বলে ওঠে, যাতে হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত উজ্জ্বল হয়। কিন্তু সে হঠাৎ আলোর ঝলকানিও চিরতরে নিভে যায়।

যোসেপ দ্বিতীয়: জার্মান জাতির রোমান সম্রাট যখন অত্যন্ত উদ্বিগ্নতার সঙ্গে ব্যাপারটা লক্ষ্য করছিল, তখন অবশ্য পুরো ব্যাপারটাই সীমান্তের ওপরে দাঁড়িয়ে। ক্ষয়িষ্ণু, মিশ্রিত দেশবাসীর দ্বারা সৃষ্ট বিরাট বিরাট ঘূর্ণাবর্তগুলি যেন হাঁ করে পুরো সাম্রাজ্যটাকেই গিলতে আসছে। যদি শেষ মুহূর্তে তার পূর্বপুরুষদের অবহেলার প্রতিকার এ মুহূর্তেই কিছু করা যায়। অতি মানবীয় মানসিক শক্তিতে দ্বিতীয় যোসেপ তার পূর্বপুরুষদের অবহেলা এবং বোকামির মোকাবিলা করে, মাত্র এক যুগের মধ্যে সে প্রাণপণে চেষ্টা করে শতাব্দী ধরে ফুটো হওয়া নৌকাটাকে সারাতে। যদি তার ভবিতব্য তাকে আর মাত্র চল্লিশটা বছর পরিশ্রম করার সুযোগ দিত, এবং পরবর্তী দুটো বংশধর তার ইঙ্গিত কাজ চালিয়ে যেতে পারত, তবে হয়ত বা আশ্চর্যজনক কিছু ঘটে যাওয়া বিচিত্র ছিল না। কিন্তু মাত্র দশ বছরের শাসনকার্যের পর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে, তার প্রগতিমূলক কার্যাবলী ও দৃষ্টিভঙ্গিও কবরের অন্ধকার গহ্বরে চিরতরে প্রোথিত হয়ে যায়; যারা আর কোনদিন প্রাণের ইসারা নিয়ে জেগে ওঠেনি। সেগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত তার পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে না ছিল ইচ্ছাশক্তি, না কর্মক্ষমতা।

সমগ্র ইউরোপে নব বিপ্লবের সঙ্গে ধীরে ধীরে তা অস্ট্রিয়াতেও ছড়িয়ে যায়। কিন্তু সেই আগুনের শিখা ভালভাবে প্রজ্জ্বলিত হওয়ার আগেই তা জ্যোতিহীন হয়ে পড়ে। কারণ আর কিছুই নয়, এ আগুনের উৎপত্তি হয়েছিল মিশ্রজাতিদের মধ্য থেকে। সুতরাং জোর থাকবে কোথায়। ১৮৪৮ সালের ইউরোপের বিপ্লবের সময় যখন সমগ্র ইউরোপ শ্রেণী সংগ্রামে রত, তখন অস্ট্রিয়ায় এর রূপ ছিল পরস্পরের জাতি বিদ্বেষে। অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী জার্মানদের ব্যাপার হল তারা বিপ্লবের মূল উৎপত্তির কারণটাকেই হয়ত বা ভুল বুঝেছিল; অথবা প্রথমদিকে ব্যাপারটাকে ঠিক মত বুঝে উঠতে না পারায় শেষমেষ তাদের ভাগ্যের দরজাটাই বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে একরকম নিজেদের অজ্ঞাতসারে তারা। পশ্চিমের গণতন্ত্রে জাগরণ নিয়ে আসে এবং কালে যা তাদের নিজেদের অস্তিত্বটাকেই বিপন্ন করে তোলে।

এ তথাকথিত ব্যাপারটা দুঃখজনক হলেও অভিজ্ঞতা যে বাড়ায় তাতে সন্দেহ নেই। সহস্র ধারায় প্রবাহিত হয় এ অমোঘ ইতিহাসের আদেশ। এ বিশাল জনতার অন্ধত্ব সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়ে অস্ট্রিয়ার ধ্বংস ডেকে আনে।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজনও যেমন নেই, অবকাশও কম। কারণ তা এ বইয়ের বিষয় বস্তুর বাইরে। আমি শুধু সে বিষয়গুলোর ওপরেই আলোকপাত করতে চাই, যেগুলো একটা জাতি এবং প্রদেশগুলোকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। উপরন্তু এসব ঘটনাগুলো আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতেও অনেক সাহায্য করেছে।

এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যা সবচেয়ে বেশি ধ্বংস ডেকে এনেছে তা হল দুর্বল এবং সঙ্কীর্ণময় ব্যক্তিবর্গ, যারা নিয়মিত ভিড় করেছে পার্লামেন্টে বা ইপিরিয়াল কোর্ট-এ, অস্ট্রিয়ায় যে নামে পার্লামেন্টকে অভিহিত করা হয়।

এ ধরনের সম্মিলিত সভা ঠিক ইংল্যাণ্ডের অনুকরণে গঠিত হয়েছিল; ইংল্যান্ড হল গণতন্ত্রের স্বর্গভূমি।

প্রায় সময় সংঘটাই বলতে গেলে অস্ট্রিয়াতে পাচার করে দেওয়া হয়েছিল। সামান্য কিছু রদবদল করে।

ব্রিটেনের বদলী ভিয়েনাতে দু’কামরা বিশিষ্ট গণতন্ত্রের প্রচলন করা হয়। সহকারী সদস্যদের জন্য একটা কামরা আর লর্ডদের জন্য আরেকটা। বাড়িগুলোই অন্যরকম ঢঙে তৈরি করা হয়েছিল। ব্যারি যখন তার রাজপ্রাসাদ তৈরি করে, যাকে আমরা হাউস অফ পার্লামেন্ট বলে থাকি, টেমস নদীর ধারে, সে বাড়িটার স্থাপত্যের উৎসমুখ ছিল বৃটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের মধ্য থেকেই সে প্রচুর উপকরণ এবং মালমশলা সংগ্রহ করে যা দিয়ে ব্যারী বারশ’ কুলাচ্ছি, থাম প্রভৃতির অলংকরণ করে সেই রূপকথার মত সুন্দর প্রাসাদ ও অট্টালিকা তৈরি করে। সে অট্টালিকার গাম্ভীর্য এবং অলংকরণ, রঙ সবকিছুই জাতির জন্য একটা বিশিষ্ট মর্যাদার স্থান অধিকার করে। যেটা মন্দিরের মত পবিত্রও বটে।

এখানেই ভিয়েনা প্রথম অসুবিধার সম্মুখীন হয়। যখন হানসন, ওলন্দাজ স্থাপত্যবিদ সেই মর্মর প্রস্তরে তৈরি প্রাসাদটার ঢালু ছাদ দিয়ে ঘেরা দেওয়ালের তিন কোণা উপরিভাগ প্রায় শেষ করে এনেছে, ঠিক তখনই প্রয়োজন হয়ে পড়ে প্রাসাদটি অলংকরণের। কারণ এমন একদিন আসবে যখন সেইসব প্রতিনিধি নিয়মিত বসবে যারা সমস্ত দেশে জনপ্রিয়। সুতরাং অলংকরণের প্রয়োজনে তাকে বাধ্য হয়েই পুরনো দিনের মহৎ শিল্পের দিকে মুখ ঘুরাতে হয়। পশ্চিমী গণতন্ত্রের এ নাটকীয় মন্দিরকে সাজানো হয় বিভিন্ন মূর্তি দিয়ে। গ্রীক ও রোমান রাষ্ট্রনেতা ও দার্শনিকদের প্রতিচ্ছবি সে প্রাসাদে স্থাপন করে। যেন ভাগ্যের পরিহাসের মত, একদল উত্তেজক ঘোড়া পরস্পরকে টানছে ঢালু ছাদ দিয়ে ঘেরা চারিদিকের প্রাসাদটার দেওয়ালের দিকে। অবশ্য বাড়িটার ভেতরে যা চলছিল, এর থেকে ভাল প্রতীক অন্তত এ প্রাসাদে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না।

বাড়িটা অলংকরণের ব্যাপারে জাতীয়তাবাদীকে পুরোপুরি বর্জন করা হয়, ধরে নেওয়া হয়েছিল যে জাতীয়তাবাদী দোষের এবং তা জনসাধারণকে উত্তেজনার খোরাক। জোগাবে। এ একই ব্যাপার জার্মানিতে ঘটেছিল। রাইখষ্টা বাড়িটা যখন ভালেট তৈরি করে, তখন এটা জার্মান জাতির জন্য মোটেই তৈরি করা হয়নি; যতক্ষণ পর্যন্ত না বিশ্বযুদ্ধের কামান গর্জে ওঠে। তখন শুধু পাথরে খোদাই করা এক উৎসৰ্গনামা জনসাধারণের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল।

আমার তখন কুড়ি বছর বয়সও হয়নি, যখন প্রথম সেই ফ্রাজেড্রিঙের প্রাসাদে সদস্যদের বক্তৃতা শোনার জন্য প্রবেশ করি। প্রথম অভিজ্ঞতাই প্রচণ্ড ঘৃণার উদ্রেক করে। সংসদকে আমি বরাবরই ঘৃণা করে এসেছি। তবে প্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়, ঠিক তার উল্টো কারণে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আস্বাদনের জন্য এর থেকে ভাল রাজনৈতিক পদ্ধতি আমি কল্পনাতেও আনতে পারি না। কিন্তু যে আলোর আশায় আমার হাবুসবুর্গ সংসদের পরিচয়, সে একনায়কতন্ত্রের কথা চিন্তা করার জন্য নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হয়েছে।

অবশ্য আমার এ চিন্তাধারার পেছনে ব্রিটিশ সংসদের দান অনেকখানি। বয়সে কম ছিলাম বলে পত্র পত্রিকার মাধ্যমে সংসদের অতিরঞ্জিত করা ব্যাপার পড়ে আমার সংসদ রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ আরও বেড়ে যায় এবং এ আকর্ষণ আমি সে মুহূর্তে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারিনি। যেরকম অভিজাত্যের সঙ্গে ব্রিটিশ হাউস অ কমনস্ তাদের কর্তব্য সম্পাদন করত, তাতে আমার শ্রদ্ধা আর বেশি বেড়ে গিয়েছিল। এর জন্য অবশ্য অস্ট্রিয়ার সংবাদপত্রকে ধন্যবাদ, যারা গালভরা বিশ্লেষণ দিয়ে ঘটনাগুলোকে উপস্থাপিত করত। আমি নিজেকেই বারবার জিজ্ঞাসা করতাম, জনসাধারণের নিজস্ব দরকার ছাড়া অন্য কোন আর উন্নত ধরনের সরকার গঠন করা সম্ভব কিনা।

কিন্তু এ চিন্তাগুলোই আমাকে আরও বেশি অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্টের বিরুদ্ধবাদী করে তোলে। যতদিন পর্যন্ত গোপন ভোটে নির্বাচনপ্রথা শুরু করা না হয়েছিল, ততদিন পর্যন্ত জার্মান প্রতিনিধিরাই সংখ্যায় বেশি ছিল। যদিও এ সংখ্যাধিক্য নামে মাত্র। এ পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা আরও বেশি ঘোলাটে হয়ে ওঠে। কারণ জার্মানদের মধ্যে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ওপর কখনই বিশ্বাস করা যায় না। বিশেষ করে জাতীয় বিপর্যয়ের সময়। জার্মানদের পক্ষে ব্যাপারটা আরও বেশি বিপদজ্জনক হয়ে উঠে, কারণ যে কোন বিষয়বস্তু আলোচনার সময়েই তারা জার্মানদের বিরোধিতা করতে শুরু করে। এর কারণ আর কিছুই নয়, তাদের ভয় অন্যান্য জাতীয়তাবাদী দলে তাদের যেসব অনুগত কর্মী আছে তারা যাতে দল ছেড়ে চলে না যায়। ভোট প্রথা চালু হওয়ার আগেই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দলকে তখন আর কোনক্রমেই জার্মান জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে গণ্য করা চলে না। ভোটপ্রথা চালু করার সঙ্গে সঙ্গে জার্মান সংখ্যাধিক্যের পরিসমাপ্তি হয়। এভাবেই অস্ট্রিয়াতে জার্মানদের প্রভাব নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

আমার জাতীয়তাবাদী মন এবং চরিত্র এ সদস্য ব্যবস্থাকে মেনে নিতে কখনই সায় দেয়নি, যাতে জার্মান জাতীয়তাবাদী দলকে সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব করতে দেওয়া হয়নি। কারণ যারা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের এক অংশের দ্বারা প্রতারিত হয়েছে, এরকম এবং আরও অনেক দোষ ত্রুটি, সেগুলোর জন্য পার্লামেন্টকে দোষারোপ করা ঠিক নয়। এরজন্য সম্পূর্ণ দায়ী অস্ট্রিয়া সরকার। এখন পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করি যে যদিও জার্মান সংখ্যাধিক্য সংসদে পাওয়া যায়নি, তবু তার জন্য পার্লামেন্টারি প্রথাকে কোন রকমেই দোষারোপ করা চলে না। এরজন্য সম্পূর্ণ দায়ী তৎকালীন অস্ট্রিয়ার সরকার।

আমি যখন সে পবিত্র অথচ কলহমুখর সভায় প্রবেশ করি, তখন আমার ধ্যান ধারণা ছিল এরকম। আমার কাছে তার পবিত্র কারণ সেই গৌরবময় প্রাসাদের আনন্দব্যঞ্জক রূপ। জার্মানির মাটিতে একটা গ্রীক অত্যাশ্চর্যের নিদর্শন।

কিন্তু মাত্র কিছুদিনের মধ্যেই সে বিকট দৃশ্য আমার চোখের ওপর ঘটতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠি। কয়েক শ’সদস্য যারা একটা বিরাট অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্য উপস্থিত এবং প্রত্যেকেই বক্তব্য রাখার জন্য উদগ্রীব।

আমার সে একদিনের অভিজ্ঞতা পরবর্তী অনেক সপ্তাহের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করেছিল।

সে বিতর্কে বুদ্ধিমত্তার কোন ছাপই ছিল না। বরং তা অনেক নিচু গ্রামে বাধা। কখনও আমার মনেই হয়নি যে বিতর্করত সদস্যদের মাথায় কিছু আছে। বেশ কিছু সদস্য যারা সেখানে উপস্থিত, জার্মান ভাষাতেই তারা কথা বলেনি, শুধু সমানে নিজেদের প্রদেশের উপভাষা চালিয়ে গেছে। এভাবেই এতদিন যা সংবাদপত্রে পড়ে এসেছি মাত্র, তা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করি। একদল অবাধ্য দাঙ্গাবাজ মানুষ বিশ্রী আকার ইঙ্গিত সহকারে হৈ হল্লা করে চলেছে, পরস্পরের প্রতি, আর করুণা পাওয়ার যোগ্য একজন বৃদ্ধ ক্রমাগত ঘন্টা বাজিয়ে সে হিংস্র সভার মর্যাদা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে; তার আবেদন, নিবেদন, উপদেশ বা পরামর্শ অথবা সতর্কতায় কেউ কান দিচ্ছে না।

ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি না হেসে পারিনি। কয়েক সপ্তাহ পরে আবার আমি যাই। এবারের সভার চিত্র সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। এত আলাদা যে বোঝাই কষ্টকর এ সভাতেই আমি কয়েক সপ্তাহ আগে এসেছিলাম। পুরো সভাকক্ষই বলতে গেলে শূন্য। সংসদ সদস্যবৃন্দ নিচের আরেকটা ঘরে টানা ঘুম দিচ্ছে। মাত্র কয়েকজন সদস্য সভাকক্ষে পরস্পরের মুখোমুখি বসে আলস্য বিজড়িত হাই তুলছে। একজন সভাপতি চেয়ারে বসে। তার এদিক ওদিক তাকানোর ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায় যে তার চেয়ারে বসে থাকতে একঘেঁয়ে লাগছে।

তখন পুরো ব্যাপারটা নিয়েই আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করি। এবং সময় পেলেই আমি সংসদে যাওয়া শুরু করি নিঃশব্দে কিন্তু গভীর অভিনিবেশ সহকারে দর্শকদের লক্ষ্য করি। বিতর্ক শুনি এবং সেই মিশেলী রাজ্যগুলো থেকে আসা বিচিত্র সদস্যদের বুদ্ধির পরিমাপ করার চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে আমার মনোজগতে একটা সুসংবদ্ধ চিন্তাধারা রূপ নেয়, যা যা দেখতাম তাকে অবলম্বন করে।

একটা বছর চুপচাপ পর্যবেক্ষণই আমার পুরনো ধ্যান-ধারণা ভেঙে সংসদের চরিত্র বোঝার পক্ষে যথেষ্ট। অস্ট্রিয়ার সংসদ সদস্যদের বিপথগামী সদস্যরা শুধু বিরোধিতা নয়, সমস্ত প্রথাটাকেই মেনে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এতদিন পর্যন্ত ভেবে এসেছি যে অস্ট্রিয়ার সংসদের এ দুর্ভাগ্যজনক রক্তাল্পতার জন্য দায়ী জার্মান সদস্যদের লঘিষ্ঠতা। কিন্তু এখন বুঝতে পারি সংসদ গঠিতই হয়েছে ভুল উপাদানে।

তাদের জন্য অনেকগুলো সমস্যা এসে আমার মনের পর্দায় ভিড় করে। আমি ভোটদান পর্বটাকে নিয়ে অনেক চিন্তা করি আর সংসদ সদস্যদের বুদ্ধিমত্তা এবং নৈতিক দিকটার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও ভাবি।

সুতরাং এ পৃথিবীতে শুধু সংসদ চরিত্র নয়, যাদের দ্বারা এটা গঠিত তাদেরও অনুধাবন করতে পারি। এভাবে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে আমার সময়কার তথাকথিত পূজনীয় চরিত্র সম্পর্কে আমার মনের আয়নায় স্পষ্ট একটা ছবি ফুটে ওঠে, সে হল সংসদ সভাপতি। তার ছবিটা মনের এত গভীরে দাগ কেটে বসে যায় যে আজ পর্যন্ত তা ভুলিনি বা ভোলার প্রয়োজন হয়নি।

আরও একবার বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া এ সোজাসুজি শিক্ষা আমাকে ফাদে ফেলতে পারেনি, দিনের পর দিন লোককে প্রলুব্ধ করে এসেছে। যদিও পুরো ব্যাপারটাই হল মানব জাতির অবক্ষয়ের চিহ্নস্বরূপ।

গণতন্ত্র, যা আজকের পশ্চিম ইউরোপে মেনে চলা হয়, তা হল মার্কসীয় মতবাদের পথিকৃৎ। সত্যি বলতে কি মার্কসীয় মতবাদের জন্মই হয়েছিল গণতন্ত্রের গর্ভে। গণতন্ত্র হল মার্কসীয় বীজাণু জন্মনোর পক্ষে এক অতি উর্বর ক্ষেত্রবিশেষ, যাতে এ বীজাণু অতি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে পারে। আর এ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রচলন হল অকালে গর্ভপাতের মত ঘটনা বিশেষ। যার শিক্ষা প্রচলিত হওয়ার আগেই সৃষ্টির আগুন নির্বাপিত।

আমি ভাগ্যের কাছে সত্যিই ঋণী যে ভিয়েনাতে থাকাকালীন ব্যাপারটা আমার নজরে এসেছিল। ঘটনাক্রমে যদি আমি জার্মানিতে থাকতাম, তবে হয়ত বা ব্যাপারটার ভাসা ভাসা একটা সমাধান খুঁজে পেতাম। আর যদি আমি বার্লিনে বাস করতাম তাহলে আমি প্রথমেই উপলব্ধি করতে পারতাম এ সংসদ কতখানি অযৌক্তিক, আমি হয়ত বা সহজেই অন্য প্রান্তে বিশ্বাস করতাম। যেরকম অনেকে কোন কারণ ছাড়াই বিশ্বাস করে যে জনসাধারণের রক্ষা পাওয়া সম্ভব যদি সাম্রাজ্যের ভিত দৃঢ় করা যায়, এবং সাম্রাজ্যের ভিত শক্ত করার একমাত্র পথ তথাকথিত রাজকীয় আদর্শগুলোকে সমর্থন করা। যারা এ পথে ভাবত, তাদের যেমন দূরদৃষ্টির অভাব ছিল, তেমনি জনসাধারণের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কেও তারা অবহিত ছিল না।

অস্ট্রিয়াতে সহজে কাউকে প্রতারিত করা সম্ভব নয়। সেখানে একটা ভুলের মধ্য থেকে আরেকটা ভুলে পদক্ষেপ করা অসম্ভব। যদি সংসদ অর্থহীন হয়ে থাকে, তবে হাবুসবুর্গ নিকৃষ্টতম। অথবা বলা যায় সামান্যতমও ভাল ছিল না। কিন্তু সংসদীয় পদ্ধতিকে বাতিল করে দিয়ে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তক্ষুণ্ণি প্রশ্ন উঠতে পারে— তবে? তবে কি করা? ভিয়েনার সংসদকে বর্জন এবং ধ্বংস করে দিলে তো সমস্ত শক্তি গিয়ে জড় হবে হাবুসবুর্গের হাতে। আমার কাছে এ চিন্তাটা কল্পনায় আনাও সম্ভব ছিল না।

বিশেষ করে এ সমস্যাটা অস্ট্রিয়ার বেলায় এতই তীক্ষ্ম যে বাধ্য হয়েই সে অল্প বয়সে ব্যাপারটা নিয়ে অনেক বেশি মাথা ঘামাতে হয়, সমস্যাটা এত গভীর না হলে এটা আমি অন্তত সে বয়সে কখনই করতাম না।

পরিস্থিতি বিবেচনার পর যেটা প্রথমেই আমার নজরে পড়ে, সেটা হল সংসদ সদস্যদের ভেতর স্পষ্টত এককভাবে দায়িত্ব এড়িয়ে চলা।

সংসদের এক একটা আইন বা বিল পাশের প্রতিক্রিয়া দেশের চরম দুর্দশা ডেকে এনেছে। কিন্তু তার জন্য কাউকে দায়ী করা যায়নি। কোন একক ব্যক্তিকে কারণ দর্শাবার জন্য প্রশ্ন করাও সম্ভব নয়। কেউ হয়ত বলবে না যে সংসদ তার কর্তব্য সম্পাদন করেছে, যখন এসব আইন বা বিলের আনীত কোন দুর্যোগ উপস্থিত হওয়ার পর সভার কার্যকাল শেষ হয়ে যায়। অথবা সংসদ যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাময়িক মিলনে গঠিত হয় বা ভেঙে যায়, তখনই কি সেই সংসদ তার ওপর সযত্নে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে? দায়িত্বের আদর্শ মানে কি একক ব্যক্তির ওপর অর্পিত দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া।

সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত নেতাদের, যারা জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত সদস্য বিশেষ কোন কার্যকলাপের জন্য তাদের কাছে কি হিসেব চাওয়া সম্ভব? নাকি, কোন নেতার পক্ষে এসব তথাকথিত নির্বোধ রাজনৈতিক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কোন গঠনমূলক পরিকল্পনা পাওয়া যায়। তার পক্ষে এ ব্যবসায়ীদের তোষামোদ এবং অনুনয় বিনয় করেই সম্মতি আদায় করতে হয়।

এটাই কি একজন রাজনৈতিক নেতার পক্ষে অপরিহার্য গুণ যে, কোন একটা ভবিষ্যতের বীজকে বর্তমানের মাটিতে রোপণ করতে হলে তাকে সানুনয় বিনয় দ্বারা নিজের দৃষ্টিভঙ্গির সমানুপাতে সবাইকে নিয়ে আসতে হবে?

একজন রাষ্ট্রনেতা কি অযোগ্য বলে প্রমাণিত হবে যদি সে তার মতাদর্শ বেশির ভাগ ভোটে পাশ করতে না পারে?

অবশ্য বলা বাহুল্য সে সংসদ সদস্যদের বেশির ভাগ হয়ত বা জাল ভোটের দ্বারা নির্বাচিত।

এ সংসদ সভা কি কোনদিন কোন মুল্যবান রাজনৈতিক মতবাদ চালিয়ে তার মুল্য নিরূপণ করে তবে তা গ্রহণ করেছে?

বাস্তব পৃথিবীতে প্রতিভাবান ব্যক্তির প্রতিভা কি অলস এবং জড় জনতার দ্বারা সদাসর্বদা প্রতিহত হয়নি। তাহলে সে রাষ্ট্রনেতার কি করা কর্তব্য, যদি সে সেই দলে ভারী সংসদ সদস্যদের মতামত আদায় করতে না পারে? তবে কি তার কিছুর বিনিময়ে তা কেনা উচিত? অথবা যদি সে নেতা খোশামুদি করে একগুঁয়ে সদস্যদের সন্তুষ্ট করতে না পারে, তবে সে কি সেপথ ছেড়ে দেবে, যা সে জাতির প্রতি প্রয়োজনীয় এবং সঠিক বলে মনে করেছিল। এ অবস্থায় তার কি রাজনৈতিক জীবন থেকে অবসর নেওয়া উচিত? নাকি ক্ষমতায় থাকবে?

এরকম পরিস্থিতিতে সত্যিকারের চরিত্রবান একজন রাষ্ট্রনেতা কি তার নিজের মুখোমুখি হবে না? একদিকে তার নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাধারা, অপরদিকে নৈতিক ন্যায়, নিষ্ঠা আরও স্পষ্টভাষায় বলতে গেলে নৈতিক সাধুতা।

তা হলে ঠিক কোথায় আমরা জনসাধারণের প্রতি কর্তব্য এবং নিজের সম্মানবোধের সীমারেখা টানব?

সত্যিকারের একজন নেতা নিশ্চয়ই তাকে ঠিকাদারের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে আসার কথা চিন্তা করবে না। এবং অপরদিকে, প্রতিটি রাজনৈতিক ঠিকাদার কি ভাববে না যে সেও রাজনীতির এ খেলায় মাতে? কারণ ব্যক্তিগত কাউকে তো হিসেবের জন্য বলা যাবে না; তার দায় তো অগুস্তি জনসাধারণের।

সুতরাং নিশ্চিন্তরূপেই বলা যায় যে সংখ্যাধিক্য নির্বাচিত সংসদীয় এ গণতান্ত্রিক সরকার কি একজন রাষ্ট্রনেতার আদর্শকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে না?

সত্যিই কি কেউ বিশ্বাস করে যে মানুষের প্রগতি শুধুমাত্র একদল মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত? কোন একক ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা এবং সদিচ্ছা দ্বারা তা সম্ভব নয়? অথবা, এটাই ধরে নেওয়া যায় যে ভবিষ্যৎ মানবিক সভ্যতা এ পরিস্থিতিতেই শুধু বেঁচে থাকবে?

তবে কি আজকের মত সেদিন একক ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা এতটা নির্ভরশীল ছিল না?

সংসদীয় গণতন্ত্রে বিধান সম্বন্ধীয় ক্ষমতায় একক ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তা খারিজ হয়ে যেত একদল বেনামী মাথার কাছে। কিন্তু এভাবে প্রকৃতির মূল আইন অর্থাৎ আভিজাত্যেই সংঘাত লাগত। যদিও এ অবক্ষয়ের যুগে আমাদের বোঝা উচিত এ আভিজাতপূর্ণ চিন্তাধারা শুধু সমাজের ওপরের স্তরের হাজার দশেক লোকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই।

যারা ইহুদী প্রেসের সঙ্গে পরিচিত, তাদের পক্ষে এ সংসদীয় ক্ষয়িত শক্তি সম্পর্কে কোনরকম আঁচ করা সম্ভব নয়। যদি না তারা নিজেরা নিজেদের ভেতরে স্বতন্ত্র চিন্তাধারা গড়ে তুলতে পারে, বা সংবাদগুলো যাচাই করার ক্ষমতা রাখে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোই রাজনীতিতে অতি সাধারণ লোকেদের ভিড় বাড়ানোর জন্য দায়ী। এসব বাস্তবের সম্মুখীন হয়ে একজন পুরুষ যার ভেতরে সত্যিকারের রাষ্ট্রনেতা হবার যোগ্যতা আছে, সে চেষ্টা করবে রাজনীতির প্রাঙ্গণ এড়িয়ে যেতে। কারণ এ পরিবেশে যার গঠনমূলক কাজ করার ক্ষমতা আছে, তা তাকে করতে দেবে না। বরং যার পক্ষে অধিকাংশের ভিড়ে ভিড়ে যাওয়া সম্ভব, রাজনীতি তাকেই আকর্ষণ করবে। সুতরাং এ পরিবেশ সংকীর্ণমনাদের জন্য এবং তাদেরই টানবে।

মানসিক দিক থেকে সংকীর্ণমনা এবং জ্ঞানের দিক থেকে অপ্রতুল এসব রাজনীতির দিনমজুরদের রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের ভান্ডার সীমাবদ্ধ, যার জন্য সে স্বভাবতই জনতার মনের ভিড়ে নিজের মতাদর্শ মিলিয়ে যেতে দেবে যাতে তার প্রতিভা বা বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ কেউ করতে না পারে; বরং এ ধরনের কৌশলপূর্ণ বিচক্ষণতা একজন অভিজ্ঞ সরকারি কেরাণীর পক্ষে ভাল, কিন্তু একজন রাজনীতিজ্ঞের জীবনে নয়। বাস্তবিকপক্ষে তার ধ্যান ধারণা এ সংকীর্ণ কৌশল রাজনৈতিক প্রতিভার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। এ ধরনের সাধারণ লোকে তার কাজ সম্পর্কে কোনরকম দায়িত্ব গ্রহণের উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্ত। কারণ প্রথম থেকেই তার রাষ্ট্রনৈতিক খেলার ফলাফল যাই হোক না, পরমায়ু তো তারার আলোর মত বাঁধাধরা। একদিন তারই মত বুদ্ধিসম্পন্নকে তার জায়গাটা ছেড়ে দিতে হবে। আমাদের এ ক্ষয়িত যুগে এ কারণেই সম্ভবত উচ্চ ধীশক্তিসম্পন্ন রাজনীতিজ্ঞের অভাব ঘটেছে। এবং যত বেশি একক ব্যক্তিত্ব সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে, তত বেশি এ ক্ষমতা কমে আসবে। সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিভাসম্পন্ন কেউ এ ধরনের হাঁসের ঝাঁকের ভিড়ে উচ্চ কণ্ঠস্বরে দি দিগন্ত নিনাদিত করবে না।

আর এ ধরনের সভাপতিদের একমাত্র সান্ত্বনা যে যেসব সদস্যদের তাকে পরিচালিত করতে হয়, তাদের বুদ্ধিমত্তাও তার চেয়ে বেশি নয়। সুতরাং সবাই একই ধরনের বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন হওয়ায় বিতর্ককালে ভাবে যে এমন একদিন আসবে যখন অপরকে ডিঙিয়ে তার পক্ষে ওপরে ওঠা সম্ভব। আজকে যদি পিটার কর্তা হতে পারে, তবে আগামীকাল পাউলারই বা তা হতে বাধাটা কোথায়? বুদ্ধির ব্যারোমিটারের পারা যখন উভয়েরই একসুরে বাঁধা।

এ নয়া গণতন্ত্রের একটা অদ্ভুত দিক আছে, যেটা প্রচণ্ড রকমের অপকার ছড়ায় সমাজে। সেটা হল আমাদের বিরাট একদল তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা উৎপাদন। যখনই কোন জরুরী বিষয়ের অবতারণা করা হয়, তারা তক্ষুণ্ণি সংখ্যাধিক্যের পেছনে মুখ লুকায়।

এসব রাজনৈতিক কৌশলগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে কিভাবে মিষ্টি কথায় সংখ্যাধিক্য সদস্যদের ভুলিয়ে ভালিয়ে সে যা করতে চায় তার মতামত আদায় করে নিচ্ছে। আর এসবই হল মূল কারণ যার জন্য সাহসী এবং চরিত্রবান কোন রাজনৈতিক নেতার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ঘৃণ্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিচুস্তরের লোকদের ঠিক এ জিনিসটাই প্রচন্ড আকর্ষণ করে, যারা নিজেদের কাজকর্মের দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক, কিন্তু সব সময়ই নিজেদের কৃতকর্মের জন্য একটা আবরণ খুঁজে বেড়ায়। তাদের বদমাস এবং অসৎ লোকদের দলে দেখা উচিত। যদি কোন জাতীয় নেতা রাজনীতির নিচুস্তরের থেকে আসে, তবে তার মধ্যেও এসব দুষ্ট কৌশল প্রবেশ করবে। কারও পক্ষেই তখন সাহসের সঙ্গে কোন নির্দিষ্ট পথ নেওয়া সম্ভব নয়। তারা তখন গালাগাল এবং অখ্যাতির কাছে নতি স্বীকার করে নিয়ে সাহসের সঙ্গে কোন মত প্রকাশ করবে না। এভাবে একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যে তার ভবিষ্যৎ এবং বর্তমানকে বাঁধা রেখে রাজনীতির নির্দিষ্ট পথে নিজের মতামত ব্যক্ত করতে প্রয়াসী।

একটা সত্য সবসময় মনে রাখা উচিত যে সংখ্যাধিক্য কখন একক ব্যক্তিত্বের পরিপূরক হতে পারে না। সংখ্যাধিক্য শুধু অজ্ঞতাই প্রকাশ করে না, কাপুরুষও হয় বটে। যেহেতু একশো বোকা একজন জ্ঞানীর সমতুল্য নয়, সেই রকম একজন কষ্টসহিষ্ণু এবং নৈতিক চরিত্রবান রাজনীতিজ্ঞের পক্ষে রাজনীতির ক্ষেত্রে যা করা সম্ভব, একশোটা কাপুরুষের পক্ষে তা সম্ভব নয়।

কর্তব্যের বোঝা একজন নেতৃত্বের ওপর যত কম চাপবে, ততবেশি উটকো সাধারণ নেতার দল তাদের দুর্নীতির বোঝা কমাতে জাতির কাছে ভিড় জমাবে। তারা উচ্চাকাঙ্ক্ষার এত বেশি উঁচু শিখরে অবস্থান করে যে তাদের পক্ষে তাদের জন্য নির্দিষ্ট এবং যথাযথ সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে তাদের সামনের অপেক্ষাকৃত লোকগুলোকে বিষন্ন মুখে গোনে এবং মনে মনে নির্দিষ্ট প্রহরের আঁক কষে কখন তাদের পালা আসবে। তারা প্রতিটি ঘটে চলা ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করে

যা তাদের প্রতিনিয়ত আশা নিরাশায় দোল দেয় এবং প্রত্যেকটি অপবাদকে উপভোগ করে, যা লাইনে দাঁড়ানো অন্য প্রার্থীদের লাইন থেকে সরিয়ে দিয়ে তাকে ইঙ্গিত বস্তুর প্রতি এগিয়ে দেবে। যদি কেউ ভাগ্যক্রমে দীর্ঘদিন তার চেয়ার দখল করে বসে থাকে, তবে তারা এটাকে তাদের প্রতি পরস্পরের বোঝাপড়ার বিশ্বাসঘাতকতা বলে ধরে নেয়। তারা এত হিংস্র হয়ে ওঠে যে যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকটা আরামপ্রদ জনসাধারণের দেওয়া গদি না ছাড়ে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা কিছুতেই শান্ত হয় না। অবশ্য এ ধরনের ঘটনার পর তার আবার সেই গদীতে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব কমই থাকে। সাধারণত তাড়িয়ে দেওয়া এ লোকগুলো আবার গিয়ে লাইনে ভিড় করে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত লাইনের দাঁড়ানো অন্যান্য উচ্চাকাক্ষীর দল এদের তাড়িয়ে দেয়।

সরকারি পরিচলন ব্যবস্থায় এ ধরনের হঠাৎ পরিবর্তনের ফলে অনেক সময়েই গণজীবনে বিপর্যয় নেমে আসে; বিশেষত দেশ যখন কোন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। শুধু অজ্ঞ এবং অযোগ্য ব্যক্তিরাই এ সংসদীয় গণতন্ত্রের বলি হয় না। সত্যিকারের যোগ্য নেতৃত্বও অনেক সময় এ পরিস্থিতির শিকার হয়ে পড়ে, যদি না ভাগ্য তাকে যোগ্য হওয়াতে নেতার পদে ঠেলে দেয়। আর যখনই তার যোগ্যতার আভাস ফুটে ওঠে, তখন অযোগ্যরা দল বেঁধে তার বিরুদ্ধাচারণ করতে নামে। বিশেষ করে যদি সে নেতা তাদের দল থেকে না আসে এবং তথাকথিত ঝলমলে এ দুর্বল চিত্ত লোকদের সঙ্গে তার মেলামেশার অভ্যাস না থাকে। তারা স্বভাবত তাদের নিজেদের যুথের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে এবং কেউ যদি তাদের সমকক্ষ হয়, তৎক্ষণাৎ তারা দল বেঁধে তার বিরুদ্ধচারণ করে। তাদের সহজাত প্রকৃতি অন্যদিকে ভোতা হলেও এ বিষয়ে অত্যন্ত প্রখর।

এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হল সরকারি পরিচালন ব্যবস্থায় বুদ্ধিমানের দল ক্রমাগত আর বেশি করে ঢোকে। যদি কেউ এ শ্রেণীর নেতা না হয়, তবে তার পক্ষে ভবিষ্যদ্বাণী করা অতি সহজ যে এ পরিস্থিতিতে একটা জাতি এবং দেশের কতটা ক্ষতি হতে পারে।

পুরনো অস্ট্রিয়ার সংসদীয় গণতন্ত্র মূল আদর্শের দিক থেকে হুবহু একই রকম ছিল, যার বর্ণনা আমি ওপরে দিয়েছি।

যদিও অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হত সম্রাটের দ্বারা, তবু এ নিযুক্ততা সত্যিকারের সংসদীয় কার্যকলাপে কোন ঢেউ তুলতে পারত না। ফেরিওয়ালা মনোবৃত্তি আর দর কষাকষি এ সব মন্ত্রীত্ব পদ নিয়ে এত বেশি চলত যে পশ্চিমী গণতন্ত্রের সত্যিকারের রূপ এর মাধ্যমেই ফুটে উঠত। আদর্শ অনুযায়ী ফলাফলও প্রকাশিত হত; দুজনের ভেতর বদলির সময় কমতে কমতে এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়ায় যে তাকে পরস্পরের প্রতি মৃগয়া ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। প্রতিটি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নেতার গুণাবলী কমতে বাধ্য; শেষপর্যন্ত সে ছোট্ট ধরনের রাজনৈতিক ফেরিওয়ালায় পরিণত হয়। এসব লোকের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের পরিমাপ হল— কত নিপুণতার সঙ্গে মিশ্রিত রাজনৈতিক দলগুলোকে সে টুকরো টুকরো করতে পারে। অন্য কথায় বলা যায়, এদের কৌশল হল ননাংরা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন; আর সেটাই হল এ ধরনের সদস্যদের সত্যিকারের যোগ্যতর কাজ।

এ ব্যাপারে ভিয়েনাকে একটা শিক্ষায়তন বলে অভিহিত করা চলে, যার যোগ্য উদাহরণ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া মুস্কিল।

আর একটা ব্যাপার, যেটা আমার সব সময় নজরে আসত সেটা হল তার চারিত্রিক বিরোধিতা; জ্ঞান এবং প্রতিভার দিক থেকে শুধু যে একের সঙ্গে অপরের কোন মিলই নেই শুধু তা নয়, প্রকৃতিগত ভাবেও এরা পরস্পর বিরোধী। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এসব বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত সদস্যদের সংকীর্ণতার চিন্তা থেকে কেউ মুক্ত হতে পারত না। তারা একরকম বাধ্য হয়ে ভাবত কিভাবে এ তথাকথিত মহান চরিত্রগুলো প্রথম গণমানসে উদিত হল।

এটা সত্যি একটা গবেষণার বিষয় যে এসব ভণ্ড ব্যক্তিরা তাদের প্রতিভাকে কিভাবে দেশের কাজে লাগাত। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, ওদের কার্যপ্রণালীর বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া অত্যন্ত জরুরী।

সংসদীয় গণতন্ত্রের জীবনটা যত বেশি স্পষ্ট করে ধরা দেয়, মানুষের আশাও তত বেশি নিভে আসে। বিশেষ করে যখন কেউ এর সত্যিকারের চেহারা এবং যাদের নিয়ে এটা গঠিত তা বিশেষভাবে অনুধাবন করে। অবাক হতে হয় এ সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শগত কাৰ্যসূচীর দিকটার দিকে নজর দিলে। সত্যি বলতে কি, এর বৈষয়িক দিকটাকে ভালভাবে বোঝা উচিত, কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের ধর্মপিতার দল প্রতি কথায় এর বৈষয়িক দিকটাকেই জনসাধারণের চোখে তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকে। তাদের কথায় তো মনে হয় পুরো ব্যাপারটাই পরিষ্কার পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ন্যায় বিচারের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কেউ যদি এসব ভদ্রলোকদের এবং তাদের অতি অধ্যাবসায়ে তৈরি আইন-কানুন সতর্কভাবে পরীক্ষা করে দেখে, তবে তার ফলাফল দেখে অবাক হয়ে যাবে।

সংসদীয় গণতন্ত্রের আদর্শের মত এত অন্তঃসারশূন্য আর কোন আদর্শকে সম্ভবত খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি অবশ্য এর বৈষয়িক দিকটা বিচার করা যায়।

আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথম ধাপে কিভাবে নির্বাচন পর্ব সমাধা করা হয়, সেটা বিচার করবে। তার সঙ্গে সঙ্গে এটাও দেখা উচিত যে তারা কিভাবে অফিসে আসে এবং নতুন নামে অর্থাৎ সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেদের চেয়ারে স্থাপন করে। এটা সত্য যে মাত্র অল্পসংখ্যক জনসাধারণের ইচ্ছা বা প্রয়োজনই মাত্র এ তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে প্রতিফলিত। প্রত্যেকে, যাদের কিছুটা রাজনৈতিক চেতনা আছে এবং জনসাধারণের রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার দিকটা বোঝে, তারা সবাই জানে যে সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক বিচারবুদ্ধি অত্যন্ত কম, তাই তাদের পক্ষে এমন কাউকে নির্বাচন করাও সম্ভব নয় যে তাদের চিন্তাধারাকে রূপ দিতে সক্ষম।

আমরা যতই বলি না কেন ‘গণ মতামত’ কিন্তু বাস্তবে অতি অল্প সংখ্যক লোকের চিন্তাধারা এবং অভিজ্ঞতা প্রসূত হল এ মতামত। এর বেশির ভাগ ফলাফলই আসে জনসাধারণের কাছে ফুলিয়ে ফঁাপিয়ে নিপুণভাবে পরিবেশিত হয়ে।

ধর্মের জগতে সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস আসে শিক্ষার দিক থেকে। কিন্তু ধর্মের বার্ধক্যহেতু তা অলসভাবে মাটির ওপর ঘুমিয়ে থাকে। আর সেই কারণেই জনসাধারণের রাজনৈতিক মতামত গড়ে ওঠে মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতিতে সুড়সুড়ি ও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগে অবিশ্বাস্য ধৈর্য প্রয়াসের ফলে।

রাজনৈতিক শিক্ষার সবচেয়ে ফলপ্রদ দিক হল সংবাদপত্রের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সংবাদ পরিবেশনার দিকটা। সংবাদপত্রই হল রাজনৈতিক আলোকসম্পাতের প্রধানতম হাতিয়ার। এটা প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য এক রকমের স্কুলও বলা চলে। এ শিক্ষা কর্মকাণ্ডটি সরকারের হাতে থাকে না। এটা থাকে তাদের হাতে চরিত্রের দিক থেকে যারা অতি নিম্নস্তরের। যৌবনকালে ভিয়েনায় থাকাকালীন এসব মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছিল, যাদের হাতে এ লোকশিক্ষার যন্ত্র, তাদের মাধ্যমে এর আদর্শও জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত হতো। প্রথমে তো আমি বিস্ময়ে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কত ক্ষুদ্র সময়ে এ ভয়ঙ্কর শক্তিধরটি জনসাধারণের মধ্যে কোন বিশেষ একটা বিশ্বাস উৎপাদন করতে সক্ষম। এবং তা, এ পথে চলতে গিয়ে প্রায়ই জনসাধারণের ইচ্ছা ও মতবাদকে উপস্থাপনা করে। একটা হাস্যাস্পদ তুচ্ছ ঘটনাকে জাতীয় পর্যায়ে তুলে আনতে সংবাদপত্রের মাত্র কয়েকদিন সময়ের প্রয়োজন হয়। যে মাধ্যমে জাতির পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কোন একটা সমস্যাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা, অপহরণ বা অন্য কোন উপায়ে জনসাধারণের কাছ থেকে সম্পূর্ণরূপে লুকিয়ে রাখে।

সংবাদপত্রের আর একটা ভাণুমতীর খেলা হল কোথা থেকে একটা নাম খুঁজে পেতে বার করে এনে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলা। আগে হয়ত কেউ সে নাম শোনেনি। তারা নামগুলোকে এমনভাবে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপিত করে যেন সেই নামগুলোর সঙ্গে জনসাধারণের অনেক আশা জড়িয়ে আছে। তারা নামটাকে জনপ্রিয়তার এতটা উঁচু ধাপে টেনে তোলে যা সত্যিকারের কোন ক্ষমতাসম্পন্ন নেতার পক্ষে সারাজীবনেও সেই জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব নয়। এ সমস্ত করা হয়, যদিও এ সব নামগুলো হয়ত বা মাসখানেক আগেও অশ্রুত ছিল এবং কেউ উচ্চারণ পর্যন্ত করত কিনা সন্দেহ, সংবাদপত্র এগুলোকে খ্যাতির পাহাড়ের চূড়ায় টেনে তোলার আগে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন এবং ক্লান্ত রাজনৈতিক জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠিত লোকদের নাম এ সংবাদপত্রগুলো জনসাধারণের স্মৃতিশক্তি থেকে ধীরে ধীরে আবছা করে এনে শেষে একসময় ভুলিয়ে দেয়, যেন তারা মৃত। যদিও তখন তারা অনেক স্বাস্থ্যবান এবং পরিপুর্ণ উৎসাহে টগবগ করে ফুটছে। অথবা, অনেক সময় এসব লোকদের প্রতি এমন সব ননাংরা গালাগাল বর্ষণ করা হয় যে জনসাধারণের মনে করে এরা অত্যন্ত নিচ। সংবাদপত্রের অনিষ্ট করার ক্ষমতা যে কত দূর; সঠিকভাবে বুঝতে হলে বিশেষ করে কুখ্যাত ইহুদী সংবাদপত্রগুলোকে অনুধাবন করা উচিৎ। সে কুখ্যাত ইহুদী সংবাদ পত্রগুলোর সংবাদ পরিবেশনা করার পদ্ধতি দ্বারা তারা সম্মানিত এবং সুন্দর লোকগুলোর নাম প্রথমে জনসাধারণের স্মৃতিতে মলিন করে আনে। তারপর তার প্রতি এমন খিস্তি খেউরের কাদা ছেড়ে চারদিক থেকে যে পুরো ব্যাপারটাই যাদুর মত কাজ করে।

এ তথাকথিত ডাকাতের দল তাদের শয়তানের চক্র সফল করার জন্য কিছু করতেই দ্বিধা করে না।

তারা এমন কি পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলিয়ে এমন কয়েকটা নোংরা ব্যাপার নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করে যাতে প্রতিপক্ষের সম্মান সম্পূর্ণভাবে ধূলোয় লুটিয়ে পড়ে। কিন্তু এসব না নামান যায়, তখন এরা তাকে লক্ষ্য করে কুৎসিত গালাগাল দেয় এ বিশ্বাসে যে তার কিছু অংশ প্রতিপক্ষের গায়ে লেগে থেকে জনসাধারণের কাছে তাকে হেয় করে তুলবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একে প্রতিরোধ করার কোন অস্ত্র প্রতিপক্ষের হাতে আর থাকে না। কারণ এরা একসঙ্গে এতগুলো কৌশল অবলম্বন করে যে তা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে। কিন্তু বাইরে থেকে এতটুকু বোঝার উপায় নেই যে বিশেষ কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলো করা হচ্ছে। জনসাধারণও তা বুঝতে পারে না। যেসব শয়তানের দল তার সমকালীন কাউকে এরকম অপমানকরভাবে নিচে নামায় এবং নিজেরা নায়ক সেজে যশের মুকুট মাথায় পরে, সেইসব দুবৃত্তদের সাংবাদিকতার কর্তব্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে দেখা যাবে তৈলযুক্ত কথায় নির্বাচিত সেকেল বোকা বোকা শব্দ দ্বারা তারা নিজেদের জয়টাক পিটাচ্ছে। যখন এ খুঁটে খাওয়া মাছগুলো এক জায়গায় মাছের ঝাঁকে জড় হয় এবং সেই সভায় তারা এঁটেল মাটির মত সেঁটে বসে তাদের নিজেদের সম্মানের কথা বলে চলে যাকে তারা বলে সংবাদপত্রসেবীদের সম্মানে সম্মানিত ব্যক্তি। তখন আবার তারা পরস্পরকে উচ্চতর জীব ভেবে নিয়ে মাথা বঁকিয়ে সম্মানও জানায়।

এ জঘন্য প্রকৃতির জীবেরাই তথাকথিত জনসাধারণের মতামত নিজেদের কল্পনায় তৈরি করে।

পদ্ধতিটার পুরোপুরি হিসেব এবং তার ভ্রমাত্মক ধ্যান-ধারণার শূন্যগর্ভ সম্পর্কে বলতে গেলে বেশ কয়েক অধ্যায়েও কুলাবে না। সুতরাং এ ব্যাপারে বিস্তারে না গিয়ে এর কাজ চলাকালীন ফলাফল বিচার করব এবং আমি মনে করি নির্দোষ এবং সরল বিশ্বাসী লোকেদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দেওয়ার পক্ষে এটাই যথেষ্ট। ফলে তারা এ প্রতিষ্ঠানের বৈষয়িক দিকটার অসারত্ব সম্পর্কে সহজেই বুঝতে পারে।

এ গণমানসের নৈতিক অবনতি কতখানি ক্ষতিকারক, যা বোঝার সবচেয়ে সহজ এবং সর্বোত্তম উপায় হল এ সংসদীয় গণতন্ত্রের সঙ্গে যদি জার্মান গণতন্ত্রের কেউ তুলনা করে।

এ সংসদীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিকটা হল একদল লোক, ধরা যাক বর্তমানে শ’ পাচেক তার মধ্যে স্ত্রীলোকও আছে, সংসদে নির্বাচিত হয়ে আসে। তারপর যে কোন বিষয়ে অর্থাৎ সব বিষয়েই তাদের ওপর শেষ বিচারের পূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয়। প্রকৃতপক্ষে তারাই কিন্তু সবকিছুর পরিচালক, যদিও তারা নামে একটা মন্ত্রীসভা গঠন করে এবং বাইরে থেকে মনে হয় এ মন্ত্রীসভাই বুঝি সবকিছু চালনা করছে। কিন্তু সত্যিকারের খতিয়ে দেখতে গেলে মন্ত্রীসভার আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই। আসলে সংসদ সদস্যদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সরকারের কিছু করার ক্ষমতাই নেই। এমন কি কোন একটা বিষয়ের হিসেব নিকেশও পাওয়া এদের কাছ থেকে অসম্ভব। কারণ করণীয় কিছু করার দায়িত্ব তো তথাকথিত মন্ত্রীসভার নয়; সংসদের অধিকাংশ সভ্যের ভোটে তা ঠিক করা হয়েছিল। সংসদের গরিষ্ঠ সদস্যদের চিন্তাধারার বাহন হল মন্ত্রীসভা। এর রাজনৈতিক সফলতা নির্ভর করে কতটা পরিমাণে এরা গরিষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে নিজের মত মিলিয়ে নিয়ে মানিয়ে থাকতে পারে। অথবা পড়িয়ে উড়িয়ে তাদের নিজেদের মতামত গ্রহণ করতে বাধ্য করে। কিন্তু এর অর্থ হল সত্যিকারের শাসকের আসন থেকে নিচে নেমে ভিক্ষাজীবিদের ন্যায় গরিষ্ঠ সংসদ সদস্যদের কাছে ভিক্ষাবৃত্তি করে মত আদায় করা। সত্যি বলতে কি মন্ত্রীসভার প্রধান কাজই হয়ে দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত শাসকদলের গরিষ্ঠ সদস্যদের নিজেদের পক্ষে দলে টানা। আর টানতে না পারলে নতুন গরিষ্ঠতা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া। যদি দু’য়ের মধ্যে একটাতেও এরা সাফল্য লাভ করতে পারে, তবেই সরকারে এরা টিকে থাকে। আর গরিষ্ঠ সদস্যদের মতামত নিজেদের স্বপক্ষে জড় করতে না পারলে স্বভাবত মন্ত্রীসভাও ভেঙে যায়।

কিন্তু এ দুই প্রচেষ্টার একটাও যদি সাফল্য লাভ করতে পারে, তবে আর কিছুদিনের জন্য মন্ত্রীত্ব চালিয়ে যেতে পারে। এখন প্রশ্ন হল, এ ধরনের রাজনীতি সঠিক না বে ঠিক? অবশ্য এর কোন অর্থ নেই। দুটোর মধ্যে যেটাই হোক না কেন?

এভাবেই বাস্তবে সবার দায়িত্ব ধুয়ে মুছে যায়। তবে এর ফলাফল একটা রাজ্যকে কোথায় টেনে নামাতে পারে সেটা বোঝার জন্য নিম্নবর্ণিত সহজ ঘটনাপঞ্জী পড়লেই বোঝা সম্ভব।

এ পাঁচশ সদস্য, যারা জনসাধারণের ভোটে সংসদে নির্বাচিত, তারা আসে জীবনের অসমতল ক্ষেত্র থেকে। সুতরাং তাদের মধ্যে পারস্পরিক রাজনৈতিক ক্ষমতাতেও যে মিল থাকবে না তাতে আর আশ্চর্য কি। যার ফলে সেগুলোকে বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগের সময় প্রচণ্ড অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় এবং সমস্ত ভবিষ্যতের ছবিটাই বিবর্ণ হয়ে আসে। এটা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে যদি কেউ চিন্তা করে এ নির্বাচিত পাঁচশ প্রতিনিধি হল উৎসাহ এবং বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ তাহলে সেটা মস্ত ভুল। এমন নির্বোধ সম্ভবত একজনকেও পাওয়া যাবে না যে নাকি ভাবে যে এ তথাকথিত ভোটের কাগজগুলো থেকে হঠাৎ শয়ে শয়ে রাষ্ট্রনেতা বেরিয়ে আসবে; যারা আর যাই হোক সাধারণের চেয়ে একবিন্দুও বুদ্ধি বেশি রাখে না। প্রতিভাবানরা যেসব ধ্যান ধারণা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এক কথায় তা নাকচ করে দেওয়া সম্ভব নয়। বরং সত্যিকারের একজন রাষ্ট্রনেতার অভ্যুদয় একটা জাতির পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ এসব রাষ্ট্রনেতারা ঝাঁকে ঝকে আসে না। দ্বিতীয়ত, জনসাধারণের প্রতি একটা স্বাভাবিক অনীহা ভাব থাকে। ভোটের দ্বারা নির্বাচিত সত্যিকারের একজন রাষ্ট্রনেতার সন্ধান পাওয়ার চেয়ে সম্ভবত একটা ছুঁচের সুতো গলার ফাঁক দিয়ে পুরো একটা উট গলে যাওয়াও সহজ।

ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে জনসাধারণের যা অতীতে উপকার করেছে, তা সম্ভব হয়েছে একক কোন ব্যক্তির উৎসাহ এবং কর্মশক্তির তৎপরতায়।

কিন্তু গণতন্ত্রের দোহাই পড়ে এখানে পাঁচশ অতি সাধারণ বুদ্ধিজীবি মানুষ জাতির পক্ষে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা সমস্যা নিয়ে বিচার করে তার রায় দেয়। তারা যে সরকার তৈরি করে প্রতিটি ক্ষেত্রে সেই মন্ত্রীসভাকে সেই রঙচঙে সংসদের অনুমোদন নিতে হয়, অর্থাৎ যে পথ তারা বাছে, সেটা হল পাঁচশ লোকের মিলিত পথ।

যাহোক, এসব সদস্যদের বুদ্ধিমত্তার দিকটার দিকে যদি আলোকপাত করা যায় তবে দেখা যাবে কি ধরনের কাজকর্ম এসব পদের জন্য অপেক্ষা করছে। যদি আমরা এসব সমস্যার সত্যিকারের রূপটা চিন্তা করি, তবে দেখতে পাব, কত রকমারি এবং বিভিন্ন রকম। সদস্যগুলোর ধরন। তখনই বুঝতে কষ্ট হয় না যে তথাকথিত মন্ত্রীসভা এসব নানামুখী সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কতখানি অজ্ঞ। একে তো তাদের মধ্যে বুদ্ধিমত্তার অভাব, তদুপরি অভিজ্ঞতা বলতেও কিছু নেই, সুতরাং সমস্যাগুলোর সমাধান কি করে করবে? একটা অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য যখন সংসদে উপস্থিত করা হয়, তখন দেখা যাবে যে এক দশমাংশ সদস্যেরও প্রাথমিক অর্থনৈতিক জ্ঞানটুকুও নেই। এর অর্থ যাদের ওপর কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের সেই বিষয়ে সামান্য জ্ঞানটুকুরও অভাব; সুতরাং সেই বিশেষ বিষয়টার সমাধানে তাদের কাছ থেকে কি আশা করা যেতে পারে।

অন্য সমস্যাগুলোর ব্যাপারেও এ একই সমস্যা। সদাসর্বদা একদল অজ্ঞ এবং অযোগ্য লোক সমস্যার সমাধানে ব্রতী। সমস্যাগুলো যদিও জীবনের বিভিন্ন কোণ থেকে উদ্ভূত, কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্যবৃন্দ তো একই মান মর্যাদায় তৈরি। ন্যায় বিচার তখনই সম্ভব যদি এসব সদস্যবৃন্দের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য যে জ্ঞান দরকার তা থাকত। এটা অকল্পনীয় যে যারা যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ তারাই আবার বৈদেশিক নীতি নির্ধারণেও দক্ষ; অবশ্য যদি না এরা প্রতিভাসম্পন্ন হয়। কিন্তু পুরো একটি শতাব্দিতে একজনের বেশি প্রতিভা খুব কমই জন্মগ্রহণ করে। তাই এসব ক্ষেত্রে সত্যিকারের প্রতিভাসমৃদ্ধ মানুষের দেখা খুব কমই পাওয়া যায়। বেশির ভাগই সেসব ললিতকলার অনুরাগীবৃন্দ যাদের মন অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং একগুয়ে। এরা জঘন্য বেশ্যাবৃত্তিতে পারদর্শী। আর এ কারণেই এসব তথাকথিত সম্মানিত দ্রলোক মহোদয়গণ কোন বিষয়ের ওপর আলোচনা চলাকালে এবং বিচারের সময় এত চপলতা দেখিয়ে থাকে; যেসব বিষয়বস্তু বিচারের সময় বুদ্ধিমান লোকদেরও অতি সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। একটা দেশের ভবিষ্যৎ অস্তিত্বের জন্য যে ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশের প্রয়োজন, তা ত এসব সংসদে নেই-ই বরং যে আবহাওয়ায় এসব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়, তা তাসের আড্ডায় ঠিক মানানসই। জনসাধারণের ভাগ্য ঠিক করার চেয়ে তাসের আড্ডায় এসব দ্রমহোদয়দের উপযুক্ত স্থান।

অবশ্য এটা বলা ঠিক হবে না যে এর মধ্যে কোন সদস্যেরই সামান্যতম কর্তব্যজ্ঞানটুকুও নেই। তা অবশ্য প্রশ্নাতীত।

কিন্তু বিশেষ করে এ পদ্ধতিতে যা কিনা একজন ব্যক্তিকে যে বিষয়ে সে দক্ষ নয়, তার ওপর জোর করে তার বিচার আদায় করে নেয়, এর অর্থ হল নৈতিক দিক থেকে তাকে টেনে নিচে নামানো। কেউ-ই সাহস করে বলবে না যে, ভদ্রমহোদয়গণ, আমরা যে বিষয়ে আলোচনা করছি সে বিষয়ের কিছুই আমাদের জানা নেই। আমি বা আমাদের এ বিষয়টার ওপর কিছুমাত্র যোগ্যতা নেই। অবশ্য এ ধরনের স্বীকারোক্তিতেও খুব বেশি একটা যায় আসে না, কারণ এ ধরনের সোজাসুজি সরলতা বুঝবেই বা কে? যে লোকটি এরকম স্বীকারোক্তি করবে, তাকে সম্ভবত সম্মানিত গাধা হিসেবে ধরে নিয়ে এ রকম মজাদার খেলা নষ্ট করতে দেওয়া হবে না। যাদের মনুষ্যচরিত সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধ্যান ধারণা আছে, তারা ভালভাবেই জানে যে সহকর্মীদের গণ্ডীর মধ্যে কেউ বোকা সাজতে চায় না। এবং এক্ষেত্রে বিশেষ সাধুতাকে বোকামী বলে গণ্য করা হয়।

এভাবে একজন সোজা কথার লোক যখন সংসদে সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়, শেষমেষ হয়ত বা পরিবেশের চাপে পড়ে বিনা আপত্তিতে তাকেও ব্যাপারগুলো মেনে নিতে হচ্ছে, জনসাধারণ তার ওপর যে বিশ্বাস করে সংসদে তাকে পাঠিয়েছিল তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাই বলা চলে। তখন ব্যাপারটা হল কোন একজন একক ব্যক্তিত্ব যদি কোন বিশেষ আলোচনায় অংশগ্রহণ না করে, তাতে কিন্তু পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র কোন পরিবর্তন হয় না। কিন্তু তার সম্মানটাই মাঝের থেকে ধুলিসাৎ হয়ে যায়। শেষে হয়ত বা সে সদস্য নিজেকে বোঝাতে সমর্থ হয় যে আর যাহোক দলের মধ্যে সে নিকৃষ্ট নয় এবং এসব বিতর্কে অংশগ্রহণ না করে সবচেয়ে খারাপ কিছু ঘটার হাত থেকে রেহাই পায়।

এর বিরুদ্ধেও যুক্তি স্থাপন করা যায়। বলা যেতে পারে যদিও একক কোন ব্যক্তি বিশেষ কোন প্রশ্নের বিতর্কে নিজেকে জড়ানোর মত জ্ঞান নেই, তবু তার ধ্যান-ধারণা তার দলের উপদেশের ওপর নির্ভরশীল, এবং বলা হয়ে থাকে যে তার দল বিশেষজ্ঞদের একটা দল গড়ে, যাদের বিষয়টির ওপর যথেষ্ট জ্ঞান আছে, পুরো ব্যাপারটাই তাদের সামনে রাখা হয়।

হঠাৎ এক নজরে মনে হবে যুক্তিটা যথেষ্ট জোরাল। তবু আরেকটা প্রশ্ন থেকে যায়, যদি বিশেষ কোন সমস্যা সমাধানের জন্য মাত্র কয়েকজনের জ্ঞান থাকে, তবে আর পাঁচশ লোককে নির্বাচন করা কেন?

আসলে আমাদের আধুনিক গণতান্ত্রিক সংসদীয় পদ্ধতির লক্ষ্যই হল বুদ্ধিমান এবং জ্ঞান বিশিষ্ট সদস্যদের একত্রিত না করা। না; একেবারেই নয়। বরং পদ্ধতিটার উদ্দেশ্যই হল একদল অবিবেচক, যাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণভাবেই অন্যের ওপরে নির্ভরশীল, যাতে সহজেই তাদের পরিচালন করা যায়। কারণ প্রতিটি একক ব্যক্তিত্ব সংকীর্ণমনা। এ একটা উপায়েই দলীয় আদর্শ আজকের দিনের দুষ্ট স্বরূপ যা প্রকটিত তাকেই কাজে লাগানো যায়। এ পদ্ধতিতেই একমাত্র সম্ভব অদৃশ্য হাতে সবকিছুকে পরিচালনা করা, যাতে নিজেকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা যায়; আর এ কারণেই তাকে তার কাজের আর হিসেব নিকেশের জন্য তলব করা সম্ভব নয়। এ অবস্থাতে যদি কেউ জাতির পক্ষে বিপর্যয়সূচক কোন পথ ঠিক করে; তবু তার জন্য তাকে দায়ী করা উচিত হবে না। যদিও সবাই জানে তার একক শয়তানি প্রতিভা এর জন্য দায়ী। কারণ পুরো দায়িত্বটা তো গিয়ে পড়ে দলের ঘাড়ে।

বাস্তবে কিন্তু পুরো ব্যাপারটাতেই কার কোন দায়িত্ব থাকে না। কারণ দায়িত্ব যে একক ব্যক্তিত্বের ওপর বর্তানো সম্ভব— সংসদীয় সদস্যবৃন্দের শূন্যগর্ভ চিল্কারে তার প্রতিফলন কি করে হবে?

সংসদ নামক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পেঁচা ধরনের লোকদেরই আকৃষ্ট করে থাকে, যারা দিনের আলো সহ্য করতে অপারগ। সাহসী এবং সোজা কোন ব্যক্তি, যে তার নিজের কাজের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত,–কখনই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হবে না।

এ কারণেই এ তথাকথিত ছাপমারা গণতন্ত্র সে জাতির হাতের যন্ত্রে পরিণত, এরা তাদের নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য দিনের আলোর দিকে পেছন ফিরিয়ে থাকে। যা এরা বরাবর করে এসেছে এবং আজও করছে। একমাত্র ইহুদীরাই এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রশংসা করে, কারণ এ প্রতিষ্ঠান ওদের মতই দুনীস্তি এবং প্রতারণায় পরিপূর্ণ।

এ ধরনের গণতন্ত্রের ঠিক উল্টোপিঠ হল জার্মান গণতন্ত্র, যাকে সত্যিকারের গণতন্ত্র বলে আখ্যা দেওয়া যায়। কারণ এখানে নেতা নির্বাচন অবাধে হয়ে থাকে এবং তারা তাদের কাজের ত্রুটির জন্য সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে সদাসর্বদা প্রস্তুত থাকে। সমস্যাগুলোকে গরিষ্ঠতার ভোটে দেখা হয় না। একক ব্যক্তির দায়িত্ব সেখানে সমাধানের পথ খোঁজে। এবং তার জন্য সে পৃথিবীতে তার যা কিছু আছে সবকিছু বন্ধক দিতে তৈরি এমন কি নিজের প্রাণ পর্যন্ত।

এমন মানুষ পাওয়া সম্ভব কিনা যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গ করবে; এখানে হয়ত বা আপত্তি উঠবে। আপত্তি উঠলে তার উত্তর হল; ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমাদের জার্মান গণতন্ত্রের অন্তনিহিত শক্তিই তাকে পদলোভী হয়ে উঠতে দেবে না। যে হয়ত বা বুদ্ধির দিক থেকে নিকৃষ্টতম এবং নৈতিক দিক থেকে অসাধু চালাকির পথ বেয়েই এমন এক জায়গায় উঠেছে যেখান থেকে সে তার সহ নাগরিকদের ওপর শাসনকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। জার্মান গণতন্ত্রের এ সুদূরপ্রসারী দায়িত্বের ভয়টাই তাকে অজ্ঞতা এবং শঠতা থেকে দূরে রাখবে।

যদি এর মধ্যে কেউ বুকে হেঁটে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে তার লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে চলে, তবে তাকে চিনে ফেলা কষ্টকর হয় না; এবং কর্কশ কণ্ঠে সে শুনতে পারে; দূরে হঠো বদমাস। এ মাটিতে তোমার পাপ রাখার জায়গা নেই, কারণ এ হাঁটা তাকে সোজা সর্পদেবতার মন্দিরের দ্বারে নিয়ে যাবে, এবং সেখানে নিকৃষ্ট প্রকৃতির কোন লোকের প্রবেশ নিষেধ; একমাত্র মহান চরিত্রের লোকই সেখানে যেতে পারে।

ভিয়েনায় সংসদ সভা দু’বছর পর্যবেক্ষণের পর আমার এ ধারণাই হয়েছিল। এরপর অবশ্য আমি সেখানে আর যাইনি।

এ সংসদীয় গণতন্ত্রই হল অন্যতম কারণ যার জন্য হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব শেষের দিকে ক্রমান্বয়ে বারবার ঢলে পড়েছিল। যত বেশি জার্মান প্রভাব ফেঁচে বাদ দেওয়া হচ্ছিল,—ঠিক তত বেশি বিভিন্ন জাতির মধ্যকার ঝগড়াটা প্রকট হয়ে উঠেছিল। রাজকীয় সংসদ পদ্ধতির জন্য সর্বদা জার্মানরা মার খেয়েছে। যার অর্থ হয়েছে সম্রাট সামগ্রিকভাবে নিজের ক্ষতিই ডেকে এনেছে। শতাব্দীর শেষের দিকে সবচেয়ে সোজা এবং নির্বোধ লোকটাও দ্বৈত রাজতন্ত্রের সংযোগশীল শক্তির দ্বন্দ্ব দেখতে পেত, যেটাকে আর কোনরকমই ঢেকে রাখা সম্ভব ছিল না, এবং যা বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করার অভিপ্রায়ে নিয়ত টানাটানি করে চলত।

উপরন্তু, প্রদেশগুলো সেদিন স্বনির্ভরতার জন্য যে পথ বেছে নিয়েছিল তা অত্যন্ত সংকীর্ণমনা এবং পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত অসম্মানজনক। শুধু হাঙ্গেরী নয়, সমস্ত প্রদেশগুলোই যারা এ রাজতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারা এ রাজতন্ত্রের দুর্বলতা বুঝতে পারেনি, আর এ দুর্বলতা যে তাদের পক্ষে কত ক্ষতিকর তা আর কে বোঝাবে। বরং বার্ধক্যজনিত কারণে এ ক্ষয়ে যাওয়াকে অভ্যর্থনাও করেছিল। তারা অপেক্ষা করছিল সুস্থ হওয়ার জন্য নয়; বরং সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ার দিনটা গুণছিল।

জার্মানসহ নির্যাতিতদের গণতান্ত্রিক সংসদকে ভেঙে ফেলার জন্য সবরকম দাবিই ক্রমেই বেড়ে উঠতে থাকে। সমস্ত দেশ জুড়ে এক জাতের সঙ্গে অপর জাতের সংঘর্ষ চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু মোটামুটি এ সংঘর্ষগুলো প্রায় সবটাই একমুখী; অর্থাৎ জার্মানদের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে যখন থেকে সিংহাসনের দাবি বর্তায় আর্চ হিউক ফ্রানজ ফারনান্দের ওপর, চেকেরা সেই সুবিধা নিয়ে শাসনব্যবস্থার উঁচু স্তর থেকে নিচু স্তর পর্যন্ত নিজেদের প্রভাব এবং প্রতিপত্তি বিস্তার করে ফেলে। দ্বৈত রাজকীয়তন্ত্রের উত্তরাধিকারী সমস্ত কিছু সুযোগ সুবিধা নিয়ে জার্মানদের প্রভাব প্রতিপত্তি খর্ব করতে মাঠে নেমে পড়ে, সোজাসুজি না হলেও সে এ পদ্ধতির রক্ষাকর্তা হিসেবে কাজ চালিয়ে যায়। শাসনব্যবস্থার অফিসারদের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে জার্মান জেলাগুলোকে; ধীরে ধীরে চূড়ান্তভাবে মিশ্রভাষার বিপজ্জনক সীমার মধ্যে টেনে আনা হয়। এমন কি অস্ট্রিয়ার নিচের দিকের প্রদেশগুলোতেও একই ব্যবস্থা বলবৎ করা হয়; আর ভিয়েনাকে তো চেকেরা তাদের সবচেয়ে বড় শহর হিসেবে দেখত।

এ নতুন হাবুসবুর্গ রাজপ্রাসাদের লোকেরা নিজেদের মধ্যেই কথাবার্তা চালানোর জন্য চেক ভাষাটাকেই বেশি পছন্দ করত। আর্চ ডিউকের স্ত্রী চেকদেশের রাজকন্যা এবং রাজকুমারের সঙ্গে এ বিয়ে ঠিক সমানে সমানে হয়নি। রাজকুমার সম্বন্ধে বলা যায় তার চেয়ে সব বিষয়ে নিচু এ রাজকন্যাকে বিয়ে করেছিল। রাজকন্যা যে পরিবার এবং পরিবেশ থেকে এসেছিল, সেখানে জার্মানদের বিরুদ্ধাচারণ ছিল বংশপরম্পরায়, রক্তে রক্তে, শিরা উপশিরায়। আর্চ ডিউকের মনের ইচ্ছে ছিল মধ্য ইউরোপে শ্লাভ সাম্রাজ্য বিস্তার করা, যেটা পরিপূর্ণ ক্যাথলিক ধারায় হবে। অর্থাৎ গোঁড়া রাশিয়াকে বাধা দেবার প্রাচীর হিসেবে যাতে এ ক্যাথলিক ধর্ম কাজ করে।

হাবুসবুর্গের ইতিহাসে বারবার এ জিনিসের পুনরাবৃত্তি হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ধর্মকে কাজে লাগানো হয়েছে; আর এ ব্যাপারে নিছক শোষণ পদ্ধতিকে কার্যকরী করার জন্য অবশ্যই সেখানে জার্মান স্বার্থ আছে। এর ফলাফল অনেক জায়গাতেই শোকাবহ হয়ে ওঠে।

তবে হাবুসবুর্গ প্রাসাদ বা ক্যাথলিক চার্চ যা আশা করেছিল তা কিন্তু পায়নি। হাবুসবার্গ তার সিংহাসন হারায়, আর চার্চের প্রভাব পুরো দেশটা থেকেই মুছে যায়। ধর্মীয় উদ্দেশ্য রাজনীতিতে ঢালার জন্য আরেকটা উত্তেজনার উদ্ভব হয়।

জার্মান মতবাদকে রাজকুমার রাজতন্ত্রের থেকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে জার্মান আন্দোলন সমস্ত অস্ট্রিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। গত শতাব্দীর আশি সালের দিকে ম্যানচেষ্টার লিবারালিজম যার চিন্তাধারার মূল ভিত্ ছিল ইহুদীরা, এ দ্বৈত রাজতন্ত্রে তার সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে, এর প্রতিক্রিয়াটা ঠিক সামাজিক দিক থেকে আসেনি, এসেছিল জাতীয়তাবাদী থেকে। যেটা পুরনো অস্ট্রিয়ায় সদা সর্বদা হয়ে এসেছে। কিন্তু জার্মানদের নিজেদের অধ্যাবসায় উৎসাহের সঙ্গে প্রাণপণে চেষ্টা করেছে নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখার। তখন অবশ্য অর্থনৈতিক চাপ মাত্র মাথা চাড়া দিতে শুরু করেছে; কিন্তু তা তো দ্বিতীয় স্তরের সমস্যা। সাধারণ রাজনৈতিক এ বিশৃঙ্খলার থেকে দুটো দলের অভ্যুত্থান হয়। একটা পুরোপুরি জাতীয়তাবাদী, আর অপরটা চরিত্রগত দিক থেকে সামাজিক কিন্তু উভয় দলই ভবিষ্যতের পক্ষে উৎসাহদায়ক এবং উদ্দেশ্যমূলক।

১৮৬৬ সালের যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার নির্যাতনের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হাউস অফ হাবুসবুর্গ তখন বদ্ধপরিকর। শুধুমাত্র সম্রাট ম্যাস্কিমিলিয়ান অফ মেকিকোর করুণ পরিণতিই ফ্রান্সের সঙ্গে খুব নিকট সম্পর্ক স্থাপন করতে দেয় না। ম্যাস্কিমিলিয়ানের সর্বনাশা অভিযানই তৃতীয় নেপোলিয়ানকে ডেকে আনে এবং সত্যি বলতে কি ফরাসী লোকটা তাকে যেভাবে টলটলায়মান অবস্থায় একা ফেলে রেখে সরে পড়ে, তাতে সবারই ঘৃণা মিশ্রিত ক্রোধ জেগে ওঠে। তবুও হাবুসবুর্গ সুযোগের অপেক্ষায় প্রতীক্ষা করেছিল। যদি ১৮৭০-৭১ সালের সাফল্য না আসত, হয়ত বা ভিয়েনায় সাদাওয়া যুদ্ধের প্রতিহিংসার দরুন রক্তগঙ্গা বয়ে যেত।

এ দু’বছরের অর্থাৎ ১৮৭০-৭১ সালের বীরত্বময় সংঘর্ষ আরো একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপারের সৃষ্টি করে; যার জন্য হাবুসবুর্গ বাধ্য হয় তার হৃদয় পরিবর্তনের। অবশ্য সে পরিবর্তন হৃদয়ের অন্তঃস্থলের প্রেরণায় নয়, পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে পড়ে। পূর্বের জার্মানরা গৌরবময় জয়ের পথ দিয়ে জার্মান সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে এবং তাদের পূর্বপুরুষদের স্বপ্নের মহৎ পুনরুত্থান প্রত্যক্ষ করে।

এর জন্য অবশ্য এ ব্যাপারে আমাদের কোন ভুল বোঝাবুঝি থাকা উচিত নয়, সত্যিকারের অস্ট্রিয়ার জার্মানরা উপলব্ধি করে যে এ সময় থেকে রাজ্যাভিষেক প্রয়োজন হলেও করুণ পরিণতির জন্য দায়ী, যদিও এটা সাম্রাজ্য পুনস্থাপনের জন্য একটা কর্তব্যও বটে। কিন্তু তা পক্ষাঘাতগ্রস্ত পুরনো কুটুম্বিতার মত শেষমেষ বোঝা হয়ে রুগ্ন ক্ষয়ে যাওয়া রুগীর মত অবস্থায় এসে না দাঁড়ায়। সর্বোপরি, জার্মান-অস্ট্রিয়ান উভয়েই উপলব্ধি করে যে হাবুসবুর্গ প্রাসাদের ঐতিহাসিক দিন শেষ হয়ে এসেছে এবং নতুন সাম্রাজ্যে যে নয়া সম্রাটকে অভিষেক করা হবে, তাকে নায়কোচিত ছাঁচে গড়া হবে, যাতে রাইনের মুকুট পরার যোগ্যতা তার থাকে। এ অভিপ্রায় এবং স্থিরতাই সেই হাবুসবুর্গ প্রাসাদের একটা শাখা বেছে নিতে সাহায্য করে, যে শাখায় ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট অতীত দিনে সমগ্র জাতিকে গৌরবের শিখায় তুলে ধরে জাতির মুখ গৌরববাজ্জ্বল করেছিল।

১৮৭০-৭১ সালের যুদ্ধের পর হাবুসবুর্গ প্রাসাদ স্থির মাথায় সমস্ত জার্মানদের নির্মূল করার কাজে নেমে পড়ে, যাদের সম্পর্কে ওদের ধারণা ধীরে ধীরে হলেও একেবারে বিনাশ করা চাই। আমি ইচ্ছে করে নির্মূল’ শব্দটা ব্যবহার করেছি; কারণ এ শব্দটা দিয়েই একমাত্র বোঝানো সম্ভব শ্লাভদের পদ্ধতির ফলাফল কি হতে পারে। যাদের ওপর নির্মূলের বিজ্ঞপ্তি ঝুলছে, তারাই বিদ্রোহের অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে তোলে। এবং সেই আগুনের শিখা এতই লেলিহান যে আধুনিক জার্মান ইতিহাস তা কোনদিন প্রত্যক্ষ করেনি।

এ প্রথম জাতীয়তাবাদী এবং দেশপ্রেমিকরা একত্রে বিদ্রোহীতে পরিণত হয়। জাতি বা দেশের বিরুদ্ধে এ বিদ্রোহ নয়। এ বিদ্রোহ হল সরকারের বিরুদ্ধে, যে সরকার তাদের মতে সুনিশ্চিতভাবে জাতিকে ধ্বংসের পথে নিয়ে চলেছে, আধুনিক ইতিহাসে এ প্রথম যখন বংশ পরম্পরায় রাজবংশীয় দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী দলের পিতৃভূমির প্রতি ভালবাসা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে খোলাখুলি সংঘর্ষ লাগে।

অস্ট্রিয়াতে সর্বব্যাপী জার্মান আন্দোলন, যা গত শতাব্দীর শেষের দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল যে একটা দেশ তার শাসকবর্গের কাছে পরিষ্কার এবং সুষ্টভাবে দাবি জানাতে পারে, তার শাসনকার্য দেশের স্বার্থে পরিচালিত হবে, অথবা কমপক্ষে তা জাতির ক্ষয় ডেকে আনবে না।

শাসকবর্গের শাসন কখনও নিজে থেকে সরে যাবে না। তা হলে তো যে কোন রকম অত্যাচার লঙ্খনীয় এবং পবিত্র বলে বিবেচিত হত।

শাসক যদি তার শক্তি জাতির ধ্বংসের কাছে নিয়োজিত করে, তবে বিদ্রোহ শুধু সঠিক পন্থাই নয়, প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্যও বটে।

এখন প্রশ্ন হল কখন এবং কী ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে, তা শুধু নীরস প্রবন্ধ লিখে সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন শক্তির। হ্যাঁ, শুধুমাত্র শক্তিই এ সমস্যার সমাধান করতে পারে।

প্রত্যেকটি শাসকবর্গ, যদিও এরা নিকৃষ্টতম এবং হাজার বার জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তবু তারা দাবি করবে যে তারা জাতিকে টেনে ওপরে তুলেছে। এর প্রতিপক্ষরা, যারা জাতীয়তাবাদী সংরক্ষণের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে তাদেরও উচিত একই হাতিয়ার ব্যবহার করা, যা শাসকবর্গ ব্যবহার করে চলেছে। একমাত্র এ পথেই এ ধরনের অপশাসন রোখা যায় এবং নিজেদের মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে পারা সম্ভব। সুতরাং এ সংঘর্ষ আইনগতভাবেই চলবে যতক্ষণ পর্যন্ত শাসক সেই পথে চলবে; কিন্তু বিদ্রোহীর দল বে-আইনী কার্যকলাপও শুরু করতে পারে যদি অত্যাচারী শাসকবর্গ সে পথে চলে।

বিশেষ করে বলতে গেলে, আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে মানবজাতির অস্তিত্বরক্ষা শুধু শাসনকার্যের মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে না; অধিকন্তু জাতিকে সংরক্ষিত রাখাই তার প্রধানতম কর্তব্য।

যদি জাতিই বিপন্ন হয়ে পড়ে অথবা নিমূল হওয়ার পথে পা বাড়ায়, তবে আইন টাইন দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রশ্ন। শাসকবর্গ অবশ্য এক্ষেত্রে শুধু আইন অনুযায়ী ব্যবস্থাই নেবে। কিন্তু অত্যাচারিতভাবে নিজেদের রক্ষা করার প্রবৃত্তি সহজাত, সুতরাং যে কোন উপায়ে তা করা উচিত।

একমাত্র এ পথই স্বীকৃত, এ সংগ্রামের নজীর ইতিহাস খুঁজলে ভুরি ভুরি পাওয়া যাবে। নিজেদের অত্যাচারিত শাসকের হাত থেকে বা বিদেশী বন্ধন খুলতে এর কোন বিকল্প নেই।

মানুষের অধিকার শাসকের অধিকারের থেকে অনেক ওপরে। কিন্তু কেউ যদি মনুষ্যত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে পরাজয় স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়, তার অর্থ বিশেষ লক্ষ্যে পৌঁছবার পক্ষে তার প্রয়াস যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

অস্ট্রিয়া হল একটা পরিষ্কার এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কত সহজে একটা বিক্ষুব্ধতা পোশাকের নিচে আইনের নামে তার মাথা লুকাতে পারে।

হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্যের আইনগত শক্তির দিকটার ভিতই ছিল সংসদের জার্মান বিরোধিতা। কারণ সংসদে তখন অজার্মানদের গরিষ্ঠতা, এবং রাজবংশীয়রা যারা বরাবর জার্মানদের বিরোধীতা করে এসেছে। দেশের শাসন ব্যবস্থাটাই এ দুটো বিষয়ের মধ্যে সংঘবদ্ধ। জার্মানদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য এ দুই নিরর্থক বিষয়ের উৎখাতের চেষ্টা করাটাও ছিল নিষ্ফলা। যারা উপদেশ দিত এ আইনানুগ পথে যেতে এবং শাসনব্যবস্থার অনুগত হওয়ার জন্য, তাদের পক্ষে কোন রকম বিরোধিতা করাই সম্ভব নয়। কারণ আইন অনুযায়ী বিরোধিতা করার কোন পথই খোলা নেই। এ আইন বিশেষজ্ঞ সংসদ সদস্যদের উপদেশ মেনে চলার অর্থই হচ্ছে রাজতন্ত্রের মধ্যে জার্মানদের অনিবার্য ধ্বংস; এবং এ ধ্বংস আসতেও বেশি সময় লাগে না। সত্যি বলতে কি সাম্রাজ্য নিজে থেকে ভেঙে পড়ার জন্যই জার্মানরা রক্ষা পায়।

চশমাধারী তাত্ত্বিকরা তাদের নিজেদের মতবাদের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে, কিন্তু লোকের জন্য নয়। কারণ মানুষই আইন তৈরি করেছে এবং ক্রমে ক্রমে সে ভাবতে শেখে যে আইনের জন্যেই সে বেঁচে আছে।

জার্মানদের সর্বব্যাপী আন্দোলন এসব নিরর্থক ধারণাগুলো মুছে দিতে সাহায্য করেছিল, যদিও মতবাদধারী তাত্ত্বিক এবং অন্যান্য ভক্তিতে গদগদ পুজারীরা যে এতে চমকে উঠেছিল তাতে সন্দেহ নেই।

যখন হাবুসবুর্গ তাদের হাতের সমস্ত কলাকৌশল নিয়ে জার্মানদের কাছাকাছি আসতে চেষ্টা করে, তখন এ জার্মানরা নিষ্ঠুর হাতে সেই উজ্জ্বল রাজবংশীদের প্রচণ্ড আঘাত করে। এ দলই প্রথম শাসকবর্গের দুর্নীতির মুখোশ খুলে দেয় এবং হাজার হাজার মানুষের জ্ঞানচক্ষু উন্মিলিত হয়। এভাবে প্যান্ জার্মান মুভমেন্ট বা সর্বব্যাপী জার্মান আন্দোলন দেশকে রাজবংশীয়দের শোচনীয় আলিঙ্গন থেকে রক্ষা করে।

পার্টি তার প্রথম আর্বিভাবেই বিরাট এক অনুগামীদের আস্থা লাভ করে। কিন্তু প্রথমদিকের সাফল্য বেশি দিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। আমি যখন ভিয়েনাতে আসি তখন প্যান্ জার্মান পার্টিতে গ্রহণ লাগা শুরু হয়ে গেছে। খ্রিষ্টান সোশ্যালিস্ট পার্টি ইতিমধ্যে শাসন ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। প্যান জার্মান পাটি তখন কৃচ্ছতার গভীরে প্রায় পুরোপুরি নিমগ্ন।

একদিকে প্যান্ জার্মান আন্দোলনের উত্থান এবং পতন, অপরদিকে খৃষ্টান সোশ্যালিস্ট পার্টির চমৎকার অগ্রগতি আমার অনুধাবন করার জন্য বিস্ময়কর বিষয়বস্তু; আর সেই কারণেই আমার ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের পক্ষে এদের দান অপরিসীম।

আমি যখন ভিয়েনাতে আসি, আমার সহানুভূতি ছিল সম্পূর্ণরূপে প্যান্ জার্মান আন্দোলনের দিকে।

বিশেষ করে তাদের জয়ধ্বনি। জয় হোক হোয়েন জোলারেন, আমাকে বিস্ময়ে অভিভূত করে ফেলত; তাদের মনের জোর দেখে আমার বুক ভরে উঠত। তারা নিজেদের অখণ্ড জার্মানির অংশ বলে ভাবত, যেখান থেকে তারা সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন। তারা সুযোগ পেলেই জনসাধারণকে বুঝিয়ে বলত যা আমার শুধু আত্মবিশ্বাসই বাড়িয়ে দেয়নি, উৎসাহও বর্ধিত করেছে। জার্মান সম্পর্কিত সমস্ত আদর্শকে প্রকাশ্যে ঘোষণা করা এবং কোন বিষয়ে আপোষ নয়; আমার মনে হয় এ পথেই শুধু দেশকে বাঁচানো যায়। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না যে এত বড় একটা আন্দোলন কি করে তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়ল; এবং এটা কিছুতেই বোধগম্য নয় যে এত অল্প সময়ের মধ্যে খ্রিস্টান সোশ্যালিস্ট পাটি কি করে এতখানি অগ্রগতি করল। তারা ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তার উতৃঙ্গ শৃঙ্গে চড়ে বসেছে।

যখন এ দুই আন্দোলনকে আমি তুলনামূলক বিচার করতে বসি, তখন ভাগ্য আমাকে সহায় দেয়, এ হতবুদ্ধির সমস্যাটা বোঝায়। ভাগ্যের এ সহায়তা আমাকে যেন আমার পরিবেশে আরো বেশি সংকুচিত করে দেয়।

আমি এখানে দুটো মানুষ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করা, যাদের এ আন্দোলনের স্রষ্টা এবং নেতা বলে মান্য করা উচিত। একজন হল জর্জ ভন্ শ্ৰোয়েনার, আর অপরজন হল ডক্টর কার্ল লুইগার।

ব্যক্তিত্বের দিক থেকে দুজনেই সাধারণের চেয়ে ওপরে এবং তথাকথিত সংসদ সদস্যদের থেকেই উঁচু ছিল। তারা তাদের জীবনযাত্রা নির্বাহ করত নিষ্কলঙ্ক, নির্দোষ এবং চরম সাধুতার মধ্যে, চারিদিক যখন দুর্নীতির বিষবাষ্পে আচ্ছাদিত। ব্যক্তিগতভাবে প্রথমে আমি প্যান্-জার্মান প্রতিনিধি শ্রোয়েনারকে পছন্দ করতাম, কিন্তু ধীরে ধীরে খ্রিষ্টান সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতাকে একইভাবে পছন্দ করে ফেললাম।

উভয়ের যোগ্যতা বিবেচনায় আমার মনে হয় গোড়ার সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে শ্ৰোয়েনারের চিন্তাধারা উঁচু ধরনের এবং বলিষ্ঠ; সে তার দূরদৃষ্টিতে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের পতন যে কারোর চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে দেখতে পেয়েছিল। যদি হাবুসবুর্গ সাম্রাজ্য সম্পর্কে তার কথাগুলোয় জার্মানরা সময় মত মনোযোগ দিত, তবে সর্বনাশা যুদ্ধে সারা ইউরোপের বিরুদ্ধে হয়ত বা জার্মানিকে জড়িয়ে পড়তে হত না।

কিন্তু যদিও শ্রোয়েনার সমস্যার গভীরে ঢোকার ক্ষমতা রাখত, তবে মানুষ চেনার ব্যাপারে তার প্রায়ই ভুল হত।

এবং এখানেই ডক্টর লুইগারের বিশেষ প্রতিভা ছিল। মানুষের চরিত্র বোর ব্যাপারে তার ছিল ইশ্বরদত্ত ক্ষমতা। সে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে মানুষের মূল্যায়ন করত এবং সেই মূল্যায়ন করতে গিয়ে তার প্রাপ্যের চেয়ে বেশি কখনই দিত না। সব পরিকল্পনাই মানুষের বাস্তব দিকটার দিকে নজর রেখে হত, কিন্তু এ বিষয়ের প্রভেদটা শ্ৰোয়েনার ঠিক বুঝত না। প্যান্ জার্মান আন্দোলনের ধ্যান-ধারণাগুলো ঠিকই ছিল, সেগুলো জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে সার্থক করে তুলতে যে দূরদৃষ্টি এবং মনের দৃঢ়তা দরকার তা তার ছিল না। এবং এসব পরিকল্পনা যাতে সহজেই জনসাধারণ দিতে পারে, সেভাবে তৈরি করার ক্ষমতাও তার ছিল না। কারণ জনসাধারণ সম্পর্কে বোধশক্তি ছিল খুবই সীমাবদ্ধ এবং কোনদিনই তার আর বাড়েনি। সুতরাং শ্রোয়েনারের জ্ঞানবুদ্ধি ছিল পয়গম্বরের মত, যা তার পক্ষে কোনদিনই বাস্তবে রূপায়িত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

মানব চরিত্র সম্পর্কে তার বোধশক্তির অভাব, জনসাধারণের শক্তি সম্পর্কেও তাকে ভুল ধারণা দিয়েছিল। শুধু কয়েকটা আন্দোলনের ব্যাপারেই নয় পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোর সহজাত ক্ষমতা সম্পর্কেও।

বাস্তবিকপক্ষে শ্ৰোয়েনার বুঝতে পেরেছিল যে সব সমস্যার তাকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সেগুলো সব মানবিক। কিন্তু তার পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না যে একমাত্র জনসাধারণই সেই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারে, কারণ সেগুলো ছিল ধর্মঘেষা।

দুর্ভাগ্যবশত তথাকথিত বুর্জুয়াদের সংগ্রাম শক্তি সম্পর্কেও তার ধারণা ঠিক ছিল। এ দুর্বলতা মূলত তাদের নিজেদের ব্যবসার স্বার্থরক্ষার কারণে এবং তারা যে বিষয়ে এককভাবে কোনমতেই কোনরকম দায়িত্ব বা ঝুঁকি নিতে রাজী ছিল না। এটাই তাদের যে কোন সংগ্রামে অংশ নিতে বাধা দিয়েছে। বিশেষভাবে বলতে গেলে সর্বাত্মক আন্দোলন কখনই সার্থকতা লাভ করতে পারে না, যদি না বিশাল জনসাধারণ তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে তাতে অংশগ্রহণ না করে।

জনসাধারণের এ নিচেকার স্তর সম্পর্কে ভুল ধারণা সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কেও সঠিক ধারণা থেকে তাকে বঞ্চিত রাখে।

এসব ব্যাপারে ডক্টর লুইগার ঠিক শোয়েনারের বিপরীতপন্থী ছিল। মানব চরিত্র সম্পর্কে তার সাধারণ জ্ঞান বিভিন্ন সামাজিক শক্তিগুলো সম্বন্ধে তার ধারণাকে সঠিকভাবে উপস্থাপিত করে এবং বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে অবহেলার মনোভাব নেওয়ার হাত থেকে তাকে রক্ষা করে; এবং সম্ভবত তার এ গুণটাকেই সে ব্যবহার করে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির কাজে লাগায়।

আমাদের সেই ঘটনাবহুল কালে, সে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল যে সমাজের ওপরের স্তরের সংগ্রাম করার ক্ষমতা বলতে কিছু নেই, এবং নতুন নতুন বড় সংগ্রাম করতেও তারা অসমর্থ, যতক্ষণ না পর্যন্ত বোঝে যে এ আন্দোলনে জয় তাদের সুনিশ্চিত। সুতরাং সমাজের এ বিশেষ স্তরটাকে জয় করার জন্য সে প্রাণমন ঢেলে দেয় এবং তাদের পঙ্গু করার চেয়ে সযত্নে সাময়িক উদ্দীপনা তাদের মধ্যে লালন পালন করে; কারণ এদের অস্তিত্বই তখন বিপন্ন। দীর্ঘস্থায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থন পাওয়ার জন্য সত্বর যত রকমের উপায় বেছে নেওয়া সম্ভব; তার সবগুলোকেই সে গ্রহণ করেছিল; যাতে তার এ আন্দোলনের জন্য সেইসব প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলোর থেকে যতটা সম্ভব শক্তি আরোহণ করা যায়।

এ কারণে সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে, যাদের প্রায় নির্মূল করার জন্য সরকার উঠে পড়ে লেগেছিল, দলের ভিত্ হিসেবে তাদের নির্বাচন করে। এভাবে সে যে অনুগামীরা দল তৈরি করে, যারা নিজেদের উৎসর্গ করতেই যে সব সময় প্রস্তুত ছিল শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে সংগ্রাম করার মত যথেষ্ট মানসিক শক্তিও বর্তমান। ক্যাথলিক চার্চের প্রতি তার ধ্যান ধারণা যুবক পাদ্রীদেরও দলে টানে এবং প্রাচীন পুরুতের দল একরকম বাধ্য হয়েই রক্ষণক্ষেত্র থেকে রণে ভঙ্গ দেয়; যুবকরা এ আশাতেই নতুন দলে যোগ দিয়েছিল যে ধীরে ধীরে নতুন পার্টি তাদের ওপরে উঠতে সাহায্য করবে।

একমাত্র তার চরিত্রের এদিকটাকে বিচার করার অর্থই হল তার প্রতি অত্যন্ত অবিচার করা। কারণ তার যুদ্ধ কৌশল ছিল অনন্য। সংস্কারক হিসেবে তার প্রতিভাকেও কোনমতেই ছোট করে দেখা চলে না। কিন্তু এসব ক্ষমতা অর্থাৎ অস্তিত্ববোধ এবং যোগ্যতা ছিল সীমাবদ্ধ।

এ বিখ্যাত ব্যক্তিটির লক্ষ্য ছিল কিন্তু সত্যিকারের বাস্তব সম্মত। তার ইচ্ছে ছিল ভিয়েনা জয়ের, যা হল রাজতন্ত্রের হৃদয়স্বরূপ। এ ভিয়েনা থেকেই অসুস্থতা এবং বার্ধক্যহেতু জরাজীর্ণ সাম্রাজ্যের শেষ নাড়ীর স্পন্দন শোনা যেত। যদি কোনভাবে হৃদয়টাকে সুস্থ করে তোলা যায়, তবে শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোও সজীব হতে বাধ্য।

ধারণাটা আদর্শগতভাবে ঠিকই ছিল; কিন্তু যে সময়ের মধ্যে এ আদর্শকে রূপায়িত করতে হবে তা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। এবং এটাই হল তার দুর্বল স্থান।

শহর ভিয়েনার মেয়র হিসেবে তার কার্যাবলী অসাধারণ; কিন্তু তাতেও রাজতন্ত্র রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় ছিল না। কারণ পুরো ব্যাপারটাই তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

তার প্রতিদ্বন্দ্বী শ্ৰোয়েনার কিন্তু ব্যাপারগুলোকে স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছিল। ডক্টর লুইগার যে বিষয়গুলোর বাস্তব প্রয়োগ করেছিল, তা কার্যকরী হয়নি। শ্রোয়েনার শেষ ধাপ বলে যা ভেবেছিল, সেখানে পৌঁছতে পারেনি। কিন্তু তার আশঙ্কাগুলো আশ্চর্যজনকভাবে সত্যে পরিণত হয়েছিল। এভাবে উভয়েই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। লুইগার অস্ট্রিয়া রক্ষা করতে পারেনি, আর শ্রোয়েনারের পক্ষে অস্ট্রিয়ার জার্মানদের পতন রোধ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি।

এ দুই দলের পতনের কারণ আমাদের যুগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা বিশেষ।

আমার বন্ধুদের পক্ষে ব্যাপারটা যে বিশেষভাবে উপকারি হয়েছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ অনেক বিষয়েই সেদিনের সেই পরিবেশ ও আমাদের সময়ের মিল ছিল। সুতরাং এ শিক্ষা থেকে শেখা উচিত ছিল যে ভুলগুলো আন্দোলনটাকে খতম করে দিয়ে পুরো জমিটাকে বন্ধ্যা করে দিয়েছিল, তা থেকে রেহাই পাওয়ার।

আমার মতে অস্ট্রিয়াতে প্যান-জার্মান আন্দোলনের ধ্বংসের জন্য মূলত তিনটে কারণ দায়ী।

প্রথম কারণ হল, তৎকালীন নেতাদের সামাজিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন ধারণা ছিল না। বিশেষ করে নতুন আন্দোলন যেটা চরিত্রগতভাবে বিদ্রোহাত্মক।

শ্ৰোয়েনার এবং তার অনুগামীদের দল তাদের মনোযোগ পুরোপুরি বুর্জোয়া শ্রেণীর ওপর দিয়েছিল; সুতরাং তাদের সেই আন্দোলন নিরীহ এবং মধ্যমগোছের আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। ভাল সময়ে অর্থাৎ সুশাসনের সময় সমাজের বিশেষ স্তরের এ মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধীয় ধ্যান ধারণা দেশের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান। কিন্তু খারাপ শাসকের সময়ে এ বিশেষ গুণটাই ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অধ্যাবসায় পূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্যা-জার্মান আন্দোলনকারীদের উচিত ছিল জনসাধারণকে জয় করার। এ ব্যর্থতার জন্য আন্দোলনটির প্রাথমিক কোন আবেগের ঢেউ-ই ছিল না, এবং এ কারণেই আন্দোলনটাতে এত অল্প সময়ে ভাটা পড়ে যায়।

অসংখ্য আধুনিক বুর্জয়া যারা এ আন্দোলনে শামিল হয়েছিল, এর অন্তনির্হিত আবর্তন স্থির করে এবং এ উপায়ে আগে থেকেই জনসাধারণের সমর্থন আশা করে। এ পরিবেশে এ ধরনের একটা আন্দোলন বিতর্ক সমালোচনার পরিধি ছাড়িয়ে ওপরে উঠতে পারে না। ধর্মোন্মাদনা এবং আত্মোৎসর্গের প্রেরণা এ আন্দোলনে আর ছিল না। তার পরিবর্তে জায়গা নিয়েছিল দেশের বর্তমান সরকারের সবকিছুকে মেনে নেওয়া এবং কঠিন সমস্যাগুলোকে ঠেলে এককোণে সরিয়ে দিয়ে এক অপমানজনক শক্তির মধ্য দিয়ে সব কিছুর সমাপ্তি ঘোষণা করা।

প্যান-জার্মান আন্দোলনের জন্য দায়ী হল এর নেতারা, যাদের উচিত ছিল সাফল্যের কারণে অনুগামীর দল বিশাল জনসাধারণের মধ্যে থেকে খুঁজে বের করে নেওয়া।

এভাবে পুরো আন্দোলনটাই গিয়ে পড়ে বুর্জুয়া, সমাজের তথাকথিত ব্যক্তিবর্গ এবং আধুনিক পন্থীদের হাতে। এ অসফলতার দরুন দ্বিতীয়বার ধস্ নামে।

প্যান-জার্মান আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রিয়ার জার্মানদের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়। অস্ট্রিয়ার জার্মানদের নির্মূল করার জন্য পার্লামেন্টকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। শেষ সময়ে এ অস্ট্রিয়ার জার্মানদের রক্ষা করার একমাত্র পথ ছিল এ সংসদ গণতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া। কিন্তু তার আশা খুবই কম বা ছিল না বললেই চলে।

সুতরাং প্যান্-জার্মান আন্দোলনের মূল প্রশ্ন হল এখন কি করা? সংসদীয় গণতন্ত্রের ভেতরে থেকে তাকে সাবোতাজ করা, নাকি বাইরে থেকে প্রচণ্ড আক্রমণ করে প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দেওয়া।

প্যান-জার্মানরা পার্লামেন্টে ঢুকে পরাজিত হয়েই ফিরে আসে। কিন্তু নিজেদের পার্লামেন্টে ঢুকতে পারার জন্য কৃতজ্ঞ বোধ করে।

বাইরে থেকে এ ধরনের সংগ্রাম চালানোর জন্য প্রয়োজন হল অদম্য ও অজেয় সাহসের এবং আত্মোৎসর্গের প্রেরণাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা। এ সব ক্ষেত্রে যাড়কে শিঙ ধরে জোর করে বলপূর্বক অধিকৃত করতে হয়। ক্রুদ্ধশক্তি হয়ত বা আক্রমণকারীকে বারবার মাটিতে আছড়ে ফেলবে, তবু বলিষ্ঠ মনের জোরে তাকে উঠে দাঁড়াতে হবে, যদিও হয়ত বা তার ইতিমধ্যে কিছু হাড় ভেঙে গেছে, এবং এ ধরনের দীর্ঘ যুদ্ধের পরই একমাত্র বিজয়ী হওয়া সম্ভব। নতুন যোদ্ধারা এ আত্মোৎসর্গের প্রেরণাতেই এসে জোটে। এ অদম্য উৎসাহ শেষমেষ তাদের মাথায় বিজয়ীর মুকুট পরিয়ে দেয়।

এ ধরনের ফলাফলের জন্য অবশ্য জনসাধারণের মধ্যে মহৎ সন্তানের প্রয়োজন। তাদেরই একমাত্র প্রয়োজনীয় মানসিক ধৈর্য এবং অধ্যবসায় থাকে যার দ্বারা কোন রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের সমাপ্তি করা সম্ভব। কিন্তু প্যান জার্মান আন্দোলনে এ ধরনের কোন যোদ্ধা ছিল না; সুতরাং সমাধানের জন্য সংসদে ঢোকা ছাড়া গত্যন্তর কোথায়!

এটা মনে করলে ভুল হবে যে নৈতিক দিক থেকে অন্তর্জগতে দ্বিধাদ্বন্দ্বের পর এ পথ স্থির করা হয়েছিল বা এটা সুচিন্তিত কোন চিন্তাধারার ফসল। না, এ সমস্যা সমাধানের জন্য অন্য কোনরকম চিন্তাই করা হয়নি। তারা মিথ্যা ধারণা আর ভুল চিন্তাধারার বশবর্তী হয়েই আর চিন্তা করেনি যে এ প্রতিষ্ঠানে মাথা গলাবার কি ফলাফল হতে পারে, যদিও বরাবর আদর্শগতভাবে এ প্রতিষ্ঠানে ঢোকার বিরোধিতা নিজেরাই করে এসেছে। আশা করেছিল এ পথেই তারা জনসাধারণের নিকট পৌঁছতে পারবে। কারণ তাদের কথা যারা শুনবে তারাই তো সম্ভাব্য জাতির প্রতিনিধি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় শয়তানির একেবারে গোড়ায় ঘা দিতে পারবে, বাইরে থেকে যেটা কোনমতেই সম্ভব নয়। তাদের বিশ্বাস ছিল সংসদের মুক্তির মধ্যে তারা যদি নিজেদের রক্ষা করতে পারে, তবে একক ব্যক্তিত্বের ভূমিকাটা হবে কোন নাটকের মত, যা দিনে দিনে দৃঢ় এবং বর্ধিত হবে।

কিন্তু বাস্তবে পুরো ব্যাপারটাই বিপরীতভাবে দেখা দেয়। বিচারালয়, যার সামনে প্যান-জার্মান আন্দোলনের প্রতিনিধিবর্গ তাদের বক্তব্য উপস্থিত করে, তা মোটেই বিশাল হয়ে ওঠে না। বরং ক্ষুদ্রই হয়েছিল। উপস্থিত তারাই থাকত যারা ওদের বক্তব্য শুনতে রাজী; অন্যেরা পরেরদিন সংবাদপত্রে তা পড়ে নিত।

সংসদ কিন্তু প্রধান বিচারালয় নয়, সবচেয়ে বড় বিচারখানা হল জনসাধারণের সামনে খোলা আকাশের নিচে সভা করা। কারণ এখানেই হাজার হাজার লোকের জমায়েত, এবং তারা শুনতে আসে বক্তা কি বলছে; কিন্তু সংসদে শ্রোতা বলতে তো মাত্র কয়েকশ লোক। এবং বেশিরভাগই সেখানে উপস্থিত থাকে তাদের ধার্য দৈনিক ভাতা পাওয়ার ধান্ধায়, জ্ঞানের আলোকবর্তিকার শিখা বাড়াবার জন্যে নয়; এরাই তথাকথিত জনসাধারণের প্রতিনিধি।

তবে এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে জমায়েতে জনসাধারণ কিছু শিখতে আসে না, কারণ শেখার জন্য যতটুকু বুদ্ধিমত্তা এবং ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন, তা তাদের কারোরই প্রায় থাকে না।

এ সংসদের একজন প্রতিনিধিও সত্যের কাছে শ্রদ্ধাবনত হয়ে নিজেকে কাজের জন্য উৎসর্গ করে না। এ ভদ্রসম্প্রদায়ের একজনও এ কাজ করবে না, যদি না ভাবে আগামীবারে নির্বাচনে সে আবার একই জায়গা থেকে সংসদের সদস্যপদ নির্বাচিত হওয়ার আশা রাখে। সুতরাং এসব সদস্যরা তখনই নতুন পার্টির খোঁজে বের হয় যাদের ভোটে জেতার সম্ভাবনা আছে, যখন দেখে তার পুরনো দলের খারাপ সময় চলছে। অবশ্য এ দল পরিবর্তনের আগে যুক্তির বন্যায় নিজেদের নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করে এবং যখনই দেখা যায় বর্তমান পার্টি নির্বাচনে পরাজয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে, তখন দলে দলে নেতাদের দল ভেঙে নতুন দলে যেতে দেখা যায়। সংসদীয় ইঁদুরের দলে তখন জাহাজ ছাড়ার হিড়িক পড়ে।

কোন একক ব্যক্তিত্বের বিষয়বস্তুর ওপর দখলের জন্য এগুলো হয় না। এ দল ভাঙাভাঙির খেলা হয় কোন এক অতীন্দ্রিয় বিষয়ে অন্তদৃষ্টির জন্য। সংসদ মাছির দল ঠিক মুহূর্তে অন্য পার্টির বিছানায় পোকার মত লাফিয়ে পড়ে। আর এসব বিচারালয়ের সামনে বক্তৃতা করা হল বিশেষ কোন জন্তুদের দিকে মুক্তা নিক্ষেপ করা। বাস্তবিকপক্ষে এত কষ্টের কোন প্রতিদান পাওয়া যায় না। কারণ ফল তো সর্বদাই নেতিবাচক।

এবং এটাই সব সময় হয়ে এসেছে। প্যান-জার্মান সদস্যরা হয়ত বা কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে গেছে, কিন্তু তাদের কথা শুনছেটা কে!

সংবাদপত্রগুলো হয় গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না, না হয় কেটে হেঁটে সেই বক্তৃতাগুলো এমনভাবে প্রকাশ করে যে তার মধ্যেকার সার বস্তুই ধ্বংস হয়ে যায়, অথবা সেগুলোকে এমনভাবে মোচড় দেওয়া হয় যে তার অর্থ একেবারে অন্যরকম হয়ে দাঁড়ায়। যা পড়ে সাধারণ দর্শক নতুন আন্দোলন সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে বসে থাকে। একক সদস্যরা কি বলছে সেটা অপ্রয়োজনীয়। দরকার হল সেই বক্তৃতা সাধারণ মানুষ কিভাবে পড়ছে এবং নিচ্ছে।

সুতরাং প্রকাশিত সংবাদপত্রে বক্তৃতাগুলো আর কিছুই নয়, প্রদত্ত বক্তৃতার কাট-ছাঁট করা অংশবিশেষ; যা পাঠকগণকে অসংলগ্ন স্বচ্ছতার ধারণা দেয়। কিন্তু এটা করা বিশেষ একটা উদ্দেশ্য নিয়ে। সুতরাং দর্শক বলতে সত্যি বোঝায় মাত্র পাঁচশ লোক; এবং তাই যথেষ্ট। নিকৃষ্টতম হল নিচের বিষয়বস্তুটা

প্যান্-জার্মান আন্দোলনটা হয়ত বা সফল হত যদি তার নেতারা উপলব্ধি করতে পারত যে আন্দোলনটা যতটা নতুন পার্টির জন্য তার চেয়ে বেশি সর্বমানবাত্মক চরিত্রের। এ একটাই উপলব্ধি এত বড় একটা সগ্রাম চালানোর জন্য যে অন্তনিহিত শক্তির দরকার, তা জাগাবার জন্য যথেষ্ট। অবশ্য এ ধরনের সগ্রাম চালানোর জন্য প্রয়োজন নেতাদের অসীম বুদ্ধিমত্তা এবং অদম্য সাহস। যদি এ সর্বাত্মক আন্দোলন যারা চালনা করবে তারা তাদের সবকিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত না থাকে, তাহলে শীঘ্রই দেখতে পাবে এমন অনুরাগী আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, যারা এ সংগ্রামের সাফল্যের জন্য নিজেদের জীবন শুদ্ধ তুচ্ছ বলে মনে করে। যে তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করে,–সে সমাজকে সেবা করবে কি করে?

সাফল্যের পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য প্রত্যেকের উচিত এটাকে এমনভাবে পরিচালনা করা যাতে ভাবী বংশধরেরা এটাকে সম্মান এবং গৌরবের চোখে দেখে; তবে এ আন্দোলনের বেশি সংখ্যায় সভ্যদের কোনরকম প্রতিদান আশা করা অন্যায়। যদি এ ধরনের আন্দোলনে বেশি সংখ্যায় সভ্যদের ঊচুপদ এবং চেয়ার পাওয়ার সুযোগ থাকে তবে প্রচুর পরিমাণে অযোগ্য সভ্যরা সেই দলে ভিড় করবে। এবং দিনে দিনে মুনাফাখোরদের দলই পার্টির ভেতরে বেশি গুরুত্ব পাবে। সত্যিকারের যোদ্ধার দল যারা প্রথম দিকে আক্রমণের প্রচণ্ড ধাক্কা সামলাবে তাদেরই হয়ত বা মুনাফাখোরের দল। পরিত্যক্ত পাথরকুচির মত বাতিল করে দেবে। সুতরাং আন্দোলনের মৃত্যু তো সেখানেই ঘটে যাবে।

একবার যখন প্যান-জার্মান আন্দোলনকারীরা ঠিক করে যে সংসদের সঙ্গে হাত মিলাবে, তখন নেতা এবং যোদ্ধারা আর জনপ্রিয় আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী থাকে না, সংসদে সদস্যে পরিণত হয় তারা। এভাবে আন্দোলন সাধারণ একটা রাজনৈতিক দলে পরিণত হয় এবং তার যুদ্ধপ্রিয় চরিত্র হারিয়ে ফেলে; কোনক্রমেই আর শহীদ হতে চায় না।

সগ্রামের পরিবর্তে প্যান-জার্মান আন্দোলনের নেতারা বক্তৃতা আর দর কষাকষিতে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। নতুন সংসদ সদস্যরা এ ভেবে খুশি হয় যে সর্বাত্মক আন্দোলন চালানোর জন্য বাগ্মিতা অনেক ভাল অস্ত্র; এতে নিজেদের জীবনের ঝুঁকি কম, যা তাকে পদে পদে সশস্ত্র আন্দোলনের সময় মুখোমুখি হতে হয় এবং তাতে যে কোন সময়ে তার জীবন হারাতে হতে পারে। এ সগ্রামের ফলাফল কি হবে তা যেমন বলা যায় না তেমনি ব্যক্তিগত লাভও এতে নেই।

তারা যখন সংসদের সভ্যপদ অলংকৃত করে, তখন তাদের অনুগামীর দল কোন এক অত্যাশ্চর্য কিছু ঘটবে ভেবে আশা নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করে। স্বভাবতই কোন অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে না, ঘটতেও পারে না। কিন্তু আন্দোলনের অনুগামীর দল শীঘ্রই অধৈর্য হয়ে পড়ে; কারণ তারা সংবাদপত্রে যা পড়ে; তার সঙ্গে নির্বাচনের কোন প্রতিশ্রুতির মিলই ভোটদাতারা খুঁজে পায় না। তার কারণ অবশ্য বেশি খোজার দরকার। নেই। এর প্রধানতম কারণ হল সাংবাদিকরা প্যান-জার্মান আন্দোলনের নেতারা বাস্তবে কি করছে না করছে তার সত্যিকারের বিবরণ কখনই প্রকাশ করে না।

নতুন সংসদ সদস্যদের দল সংসদের ভেতরে বিদ্রোহী মনোভাবের খুব অল্প ছাপই। রাখে।

প্রকাশ্য জনসভা করাও দিনের পর দিন কমে আসে; যদিও এটাই হল জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার এবং তাদের কাছে পৌঁছবার একমাত্র পথ। কারণ এখানে জনসাধারণের ওপর সোজাসুজি প্রভাব ফেলা যায় ও বিরাট জনসমর্থনও পাওয়া যায়।

বিরাট বীয়ার হলের টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে হাজার হাজার শ্রোতার সামনে যে বক্তারা তাদের বক্তৃতা রাখত তারা যখন সেই টেবিল খালি করে সংসদের উচ্চ বক্তৃতামঞ্চে সামান্য কয়েকজন নির্বাচিত সদস্যদের সামনে তাদের বক্তৃতা রাখে, তখন তাদের বক্তৃতা আর জনসাধারণের কাছে উপস্থিত হয় না, হয়ে দাঁড়ায় নির্বাচিত কয়েকজন সদস্যর উদ্দেশ্যে। এবং প্যান-জার্মান আন্দোলন তার নিজস্ব চরিত্র হারিয়ে ফেলে নিছক একটা ক্লাবে পরিণত হয় যেখানে কঠিন সমস্যাগুলোরও কেতাবী ঢঙে আলোচনা চলে।

সংবাদপত্রের মাধ্যমে দলের যে ভুল ধারণা গড়ে ওঠে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের দ্বারা সেটাকে পরিশুদ্ধ করার চেষ্টাও করা হয়নি। যেটা একমাত্র প্রকাশ্য জনসভার মাধ্যমেই সম্ভব, যেখানে একক কোন ব্যক্তিত্ব তার কাজের হিসেব নিকেশ দাখিল করার সুযোগ পায়। এর চরম পরিণতি হল প্যান-জার্মান শব্দটাই বিশাল জনসাধারণের কানে বিষবৎ শোনায়।

আজকের কলমের যোদ্ধাগণ এবং সাহিত্যের চালিয়াতের দলের বোঝা উচিত যে পৃথিবীর ইতিমধ্যে পরিবর্তন সংগঠিত হয়েছে, সেটা রাজহাঁসের পাখার কলমে হয়নি। না; কলমের প্রধান কাজ হল এ পরিবর্তনের তাত্ত্বিক দিকটার ব্যাখ্যা করা। বক্তৃতাই একমাত্র যাদুশক্তি যা ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে যাদুদণ্ডের মত কাজ করে।

বিরাট জনসাধারণকে একমাত্র বক্তৃতা দ্বারাই শাসন করা যায়, অন্য কোন শক্তি দিয়ে নয়। সমস্ত জনপ্রিয় আন্দোলনই হল মহান আন্দোলন। মানুষের ইচ্ছা এবং অনুভূতির এগুলো হঠাৎ আগ্নেগিরির উদ্গীরণ নিষ্ঠুর ধ্বংসের কাজে অথবা জাতিগড়ার কাজে নিয়োজিত হয়। কোন ক্ষেত্রেই মহান কোন আন্দোলন ড্রইংরুমের নায়কদের চিনি মিশ্রিত কবিতা এবং রঙিন কল্পনার দ্বারা সংগঠিত হওয়া সম্ভব নয়।

একটা জাতির ধ্বংস একমাত্র প্রবল ইচ্ছাশক্তির দ্বারাই এড়ানো সম্ভব। কিন্তু যাদের মধ্যে প্রবল ইচ্ছাশক্তি বর্তমান, তারাই অপরের মধ্যে সেই ইচ্ছাশক্তির ঢেউ জাগাতে পারে। একমাত্র নেতাদের মধ্যেকার ইচ্ছাশক্তির বন্যা হাতুড়ির আঘাতের মত জনসাধারণের হৃদয়ের দুয়ার খুলতে সমর্থ।

যে এ অনুভূতির প্লাবন তাকে বক্তৃতার মাধ্যমে রূপ দিতে সক্ষম নয়, তার পক্ষে দূরদর্শী এবং তার ইচ্ছার আগামীদিনের দূত হওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং একজন তাত্ত্বিক লেখক তার কালি দোয়াত নিয়ে প্রশ্নোত্তরেই ব্যস্ত থাকবে। কারণ তার যোগ্যতা এবং জ্ঞান দুইই বর্তমান, কিন্তু সে জননেতা বা নেতা নির্বাচিত হওয়ার জন্য জন্মায়নি।

প্রতিটি আন্দোলন, যার শেষ পর্যায়ে কেন মহান রূপে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা সে ধরনের আন্দোলনে সব সময় নজর রাখতে হবে যেন সেটা জনসাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে। প্রত্যেকটা সমস্যাকে এ দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করার প্রয়োজন, এবং সেই সমস্যা সমাধানের জন্য যে পথ বাছা হবে সেখানে আদর্শের সঙ্গে যেন ছন্দও বজায় থাকে।

এ আন্দোলনে এমন সব কিছুকে পরিত্যাগ করা দরকার—যা নাকি সেই আন্দোলনকে জনতার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। এটা সহজ সরল সত্য যে কোন মহৎ আন্দোলনই জনসাধারণের শক্তিছাড়া সফল হতে পারে না। তা যত সম্ভ্রম বা উন্নতমানেরই আপাতদৃষ্টিতে দেখাক না কেন। একমাত্র নগ্ন, বাস্তব উদ্দেশ্য সাফল্যের দরজায় পৌঁছে দিতে পারে। কঠিন এবং বাস্তব রাস্তা ধরে হাঁটার অনিচ্ছাই হল আমাদের নিজস্ব লক্ষ্যে না পৌঁছানো এবং এ অনিচ্ছা ইচ্ছাকৃতই হোল্ক আর অনিচ্ছাতেই হোক।

যে মুহূর্তে প্যান্-জার্মান আন্দোলনের নেতারা সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে পড়ে, সেই মুহূর্ত থেকেই তারা জনসাধারণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন; এবং মুহূর্ত কয়েকের সস্তা সাফল্যের জন্য তারা তাদের ভবিষ্যৎকে উৎসর্গ করে বসে থাকে। তারা সংগ্রামের জন্য সহজ পথটা বেছে নেয় এবং তা নিতে গিয়ে বিজয়ীর পক্ষে অযোগ্য বলে নিজেদের প্রমাণ করে।

ভিয়েনা থাকাকালীন আমি গভীরভাবে এ দুটো প্রশ্ন অনুসরণ করেছি। এবং উপলব্ধি করেছি যে প্যান-জার্মান আন্দোলন ধসে পড়ার পেছনের কারণগুলো হল, এ প্রশ্নগুলোই পুরোপুরি বিশ্লেষণ না করা। আমার ধারণা সেই সময়ে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল অস্ট্রিয়ার জার্মানদের দ্বারা।

এ দুই বিরাট ভুলই হল প্যান-জার্মান আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পারস্পরিক প্রধান কারণ। অন্তর্নিহিত শক্তি যা মহান আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রেরণা দেয়, তা আসে জনসাধারণের কাছ থেকে। কিন্তু সেই জনসাধারণের প্রেরণা থেকেই আন্দোলন বঞ্চিত হয়েছিল। এর ফলাফল হল সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানের কোন চেষ্টা করা হয়নি এবং এ আন্দোলনের মাধ্যমেও সমাজের নিচু এবং দুর্বল শ্রেণীর মন কাড়ার চেষ্টা করেনি। আরেক ফলাফল হল সংসদীয় গণতন্ত্র স্বীকার করে নেওয়া—যার প্রতিক্রিয়া হয় আগেরই মত।

যদি জনসাধারণ আন্দোলনের সময়ে যে শক্তির পরিচয় দিয়েছে তার সঠিক মূল্যায়ন করা হত, সামাজিক সমস্যাগুলোর প্রতি নজর দেওয়া হত এবং প্রচার সম্পর্কে অন্য পদ্ধতি নেওয়া হত, তবে আন্দোলনের ভারকেন্দ্র সংসদে না গিয়ে রাস্তায় এবং কলকারখানায় ছড়িয়ে পড়ত।

তৃতীয় ভুলটা হল জনসাধারণের মূল্যায়নের শিকড়টাকে খুঁজে বার করার কোন চেষ্টাই হয়নি। কোন অসাধারণ প্রতিভাবান লোক দিয়ে বিশেষ একটা নির্দিষ্ট দিকে জনসাধারণের গতিটাকে ঠিক করে দিতে হয়। জনসাধারণ যখন একবার সেই গতিতে চলে তখন যন্ত্র নিয়ামক ভারী চক্রের মত আপন ভরবেগেই সে চলতে থাকে, বাইরের আর কোন শক্তিরই তাকে চালাতে প্রয়োজন হয় না।

প্যান-জার্মান নেতাদের ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে সংগ্রামের নীতিটার মধ্যেই ভুল ছিল, কারণ ক্যাথলিক চার্চ মানুষের আধ্যাত্মিকতার দিকটাতে তেমন গুরুত্ব আরোপ করেনি।

নতুন দল যে রোমের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রচারে নেমে পড়েছিল তার কারণগুলো নিচে বলা হলঃ।

হাউস অফ হাবুসবুর্গ যখন অস্ট্রিয়াকে একটা শ্লাহু প্রদেশে পরিণত করতে চাইল, তখন তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য যে কোন রকম পথ বেছে নিতে কসুর করেনি।

এমন কি এ নতুন প্রদেশ গড়তে গিয়ে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শুদ্ধ প্রতারিত করতে তাদের বিবেকে এতটুকু বাঁধেনি। অনেকগুলো পদ্ধতির একটা হল চেক্ ধর্মযাজকদের পল্লীগুলো এবং তাদের যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অস্ট্রিয়াকে শ্লাভ নেতৃত্ব দেওয়ার পথ করে দেওয়া। পদ্ধতিটা ছিল এরূপ :

জার্মান জেলাগুলোতে চেক ধর্মযাজকদের পল্লী জোর করে বসিয়ে দেওয়া হয়। তারপর ধীরে ধীরে সেই ধর্ম যাজকদের চার্চের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দিয়ে তাদের এগিয়ে দেয়, এভাবে জেলাগুলোকে জার্মান ছাড়া করার কাজে শ্লাভ যাজকপল্লী এবং যাজকেরা তৎপর হয়ে ওঠে।

দুর্ভাগ্যবশত অস্ট্রিয়ার জার্মান পাদ্রীরা এ পদ্ধতির বিরোধিতা করতে গিয়ে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। শুধু জার্মানদের তরফ থেকে একই পদ্ধতি প্রয়োগ করতে তারা অপারগ হয়নি, চেকদের বাধা দানেও তারা ছিল অক্ষম। সুতরাং ধীরে ধীরে হলেও প্রত্যয়ের সঙ্গেই তাদের পেছন দিকে ঠেলে দেওয়া হয়; একদিকে যেমন রাজনীতির জন্যে ধর্মের বিকৃতি, অপরদিকে তেমনি সফল বিরোধীতা। ছোটখাট সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রে এটাই ছিল পদ্ধতি, বড় বড় সমস্যাগুলোর ক্ষেত্রেও এ একই পদ্ধতি কাজ করছিল।

হাবুসবুর্গ যে জার্মান বিরোধিতা করে চলছিল যাজকদের সাহায্যে, সেই বিরোধিতাকে অধিকতর বলিষ্ঠ কোন বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। সুতরাং জার্মান প্রতিপত্তি ধর্মীয় দিক থেকে ধীরে ধীরে কমে আসে। সাধারণের ধারণা যে ক্যাথলিক চার্চ বিপুলভাবে জার্মান জনসাধারণকে অবহেলা করে চলেছে।

ওপর থেকে মনে হচ্ছিল যে ক্যাথলিক চার্চ জার্মানদের একেবারেই দেখছে না, বিরুদ্ধ পক্ষও এ মতবাদের প্রচারে সমর্থন করে এসেছে। এ শয়তানির শিকড় হল শ্ৰোয়েনারের মতে, ক্যাথলিক চার্চের নেতৃত্ব জার্মানিতে ছিল না, এবং একটা কারণই যথেষ্ট যে আমাদের লোকেরা চার্চের শত্রুভাবাপন্ন হয়ে ওঠে।

তথাকথিত সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলো পাদ প্রদীপের আড়ালে চলে গিয়েছিল। শুধু সাংস্কৃতিক সমস্যা কেন, সব সমস্যাগুলোরই এক গতি হয়েছিল। ক্যাথলিক চার্চের প্রতি প্যান্-জার্মান আন্দোলনের মৌলিক অধিকার ঠেলে পেছনে ফেলে দিয়েছে।

জর্জ শ্ৰোয়েনার যে কাজ ধরত তা অর্ধেক করে থেমে পড়ার মানুষ ছিল না। সে চার্চের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে নামে, কারণ তার ধারণা ছিল যে একমাত্র এ পথেই জার্মানদের রক্ষা করা সম্ভব। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে রোম থেকে সরে আসার আন্দোলন জোরদার করা হয়েছিল; কিন্তু এ পদ্ধতিতে বিরুদ্ধপক্ষের দুর্গ ধুলিসাৎ করা শুধু কষ্টকর নয়, অসম্ভবও বটে। শ্ৰোয়েনার বিশ্বাস করত যে যদি এ আন্দোলনকে সার্থকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তবে এ যে জার্মানিতে দুটো বিরাট ধর্মীয় সম্প্রদায় দু’টুকরো হয়ে গেছে, তাকে রোধ করে যে বিশাল অন্তনিহিত শক্তির উৎপত্তি হবে, তার দ্বারা জার্মান সাম্রাজ্য এবং জাতিকে যে অতিশয় সমৃদ্ধ করা যাবে; শুধু তাই নয়, একেবারে বিজয়ের তোরণদ্বারে নিয়ে গিয়ে হাজির করা সম্ভব।

কিন্তু এ ব্যাপারটার শুরু এবং শেষ, দু’দিকই ভুলে ভর্তি ছিল।

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, জার্মানদের সম্পর্কে যে কোন বিষয়ে জার্মান পাদ্রীদের প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যদের থেকে অনেক কম ছিল; বিশেষ করে চেদের সঙ্গে বুঝবার ক্ষমতা তো ওদের ছিল না বললেই চলে। একমাত্র কোন অজ্ঞ ব্যক্তিরই বোধ হয় অজ্ঞাত ছিল যে জার্মানির স্বার্থরক্ষার জন্য জার্মান পাদ্রীরা কোনরকম চেষ্টাই করেনি।

কিন্তু এ সঙ্গে যারা একেবারে অন্ধ নয়, তারা স্বীকার করবে যে আমাদের চারিত্রিক দোষেই আমরা প্রায় ধ্বংস হতে চলেছি। এ চরিত্রের জন্য আমরা আমাদের জাতিকে শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করছি, জাতিকে শ্রদ্ধা দেখানো যেন এমন একটা জিনিস যেটা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। চেক পত্নীরা অবশ্য নিজেদের লোক সম্পর্কে অন্তমুখী আর নিজেদের জাত সম্পর্কে বহির্মুখী। দুঃখের বিষয় আমাদের ক্ষেত্রে খুব কম করে হাজারটা বিষয়ে এ একই জিনিস দেখা যাবে।

এটা কোন রকমেই ক্যাথলিক ধর্মের উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নয়; এ জিনিসের উৎপত্তি আমাদের ভেতরেই যা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের সারবস্তুকে কুরে কুরে খেয়ে ফেলেছে; বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে, যাদের নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমাদের সরকারি অফিসাররা জাতির পুনরুত্থানের যে চেষ্টা করেছিল তার সঙ্গে যদি তুলনা করা হয়, অন্য জাতের সরকারি অফিসাররা এসব ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই দেখাত না। অথবা, আরো স্পষ্ট ভাষায় বলা যেতে পারে, অন্য কোন জাতির ক্ষেত্রে জাতীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য সামরিক অফিসারবৃন্দ একইরকমভাবে পাশে এসে দাঁড়াত না। বরং ‘প্রদেশের শাসক’ বলে তার দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়া, যা আমাদের দেশে গত পাঁচবছর হয়েছে এবং এ ধরনের পুরস্কারের যোগ্য কোন যোগ্যতাই তারা দেখাত না। অথবা আমরা যদি আরেকটা উদাহরণ ধরি, ইহুদী সমস্যা সম্পর্কে দুই দৃষ্টিহীন ধর্মীয় সম্প্রদায় যে ধরনের মতবাদ পোষণ কত তা কি আজকের জাতির পক্ষে অত্যাবশ্যক, নাকি ধর্মের স্বার্থে? ইহুদী পুরোহিতদের যে কোন ব্যাপার যদি বিবেচনা করা যায়, এমনকি ইহুদী জাত সম্পর্কে সাধারণ একটা ব্যাপার—তাহলে তাদের মনোভাব এবং আমাদের গরিষ্ঠ জার্মান পাদ্রীদের মতবাদে কত ফারাক; তা ক্যাথলিক বা প্রটেস্টান্ট যাই হোক না কেন।

সমস্ত বিমূর্ত ব্যাপারেই আমরা এ একই ধরনের মতবাদে বিশ্বাসী।

‘দেশের শাসকবৃন্দ’ ‘গণতন্ত্র’, বিশ্বজনীন শান্তিবাদ, আন্তর্জাতিক একতা ইত্যাদি ধারণাগুলো যেন দৃঢ়, প্রামাণিক হয়ে দাঁড়ায় আমাদের কাছে, এবং জাতির জন্য সত্যিকারের যা প্রয়োজনীয় সেগুলোও যেন একান্তভাবেই এ আলোতে বিচার করা হয়ে থাকে।

এ যে জাতির প্রয়োজনীয় সবকিছুকে আগের ধারণা নিয়ে দেখার মজ্জাগত অভ্যাস আমাদের দাঁড়িয়ে যায়, যাতে সবকিছুকে আমরা বাঁকাভাবে দেখতে শুরু করি, সোজাসুজি কিছুই যেন আর নজরে আসে না। যেটা নিজেদের মতবাদেরই পরিপন্থী। শেষে পুরো ব্যাপারটাই নিজেদের কাছে ফিরে আসে। জাতির কোনরকম উন্নতির চেষ্টা করলেই অপকারি দলটা তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কারণ এ ধরনের যে কোন প্রচেষ্টাকেই শাসনের অন্তরায় বলে ধরে নেওয়া হয়। শাসনের অন্তরায় বলে যারা ভাবে, তাদের চোখে শাসন মানে সেবা নয়, তারা হল প্রামাণিক কর্মকাণ্ডতে বিশ্বাসী, এবং সে তার নিজের দুর্দশার জন্য ক্ষমার যোগ্য। যদি কেউ একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টামাত্রও করে, তবে তারা সঙ্গে সঙ্গে হৈ চৈ আরম্ভ করে দেয়। যদি সে ব্যক্তি ফ্রেডারিক দ্য গ্রেটও হয়। এমনকি সংসদে যারা সংসদীয় গণতন্ত্র করেছে, তারা যদি সংখ্যায় লঘিষ্ট এবং অক্ষমও হয়, অথবা বুদ্ধিমত্তার একেবারে নিচের স্তরে থাকে, তবু হৈ চৈ করতে কসুর করে না। কারণ এসব নিয়মবাদীদের কাছে গণতন্ত্রের আদর্শ জাতির আদর্শের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। তার আদর্শ অনুসারে এসব দ্র সম্প্রদায়রা অত্যন্ত নিপীড়িত হয়ে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেও এ তথাকথিত শাসনের সমর্থন করে চলবে, অপরদিকে উপকারি সরকার হলেও তাকে অগ্রাহ্য করবে, কারণ সেটা যে তার ধারণার ‘গণতন্ত্র’ নয়।

একই উপায়ে জার্মান শান্তিবাদীর দল নিপ থাকছে যখন জাতি যন্ত্রণায় এবং উৎপীড়নে গভীর আর্তনাদ করছে। আর যখন পুরো দেশ প্রতিবাদের জন্য উন্মুখ। কিন্তু এ প্রতিবাদের অর্থ হল সামরিক শক্তি প্রয়োগ, যা হল শান্তিবাদীদের আদর্শের বিরুদ্ধে।

আন্তর্জাতিক জার্মান সোশ্যালিস্টদের পৃথিবীর অন্য সব দেশের সহকর্মীরা একতার নামে প্রতারণা এবং লুণ্ঠন করতে পারে; কিন্তু তারা সবসময়ই তাদের ভ্রাতৃবৎ দেখে এসেছে, এবং কখনই তাদের ফিরতি প্রতারণা বা লুণ্ঠন করতে চায়নি। এমনকি নিজেদের আত্মরক্ষা পর্যন্ত করেনি। কিন্তু কেন? কারণ সে হল–জার্মান।

এ ধরনের সত্যকে হয়ত বা মেনে নেওয়া ঠিক নয়; কিন্তু কিছু যদি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে তবে তা আমাদের প্রথমে রোগটা সঠিকভাবে নির্ণয় করা উচিত।

যে ব্যাপারটা আমি এইমাত্র ব্যক্ত করলাম, সেটা প্রমাণ করে যে জার্মান পাদ্রীদের একাংশ কত দুর্বলভাবে জার্মানদের স্বার্থ দেখত।

আমাদের জাতীয় চরিত্রে এ দৃঢ়তা এবং স্থিরতার অভাবের কারণ হল আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি। আমাদের যুবকদের জার্মান জাতিকে উপযুক্ত করার চেয়ে এ শিক্ষার উদ্দেশ্য যেন ওদের আদর্শের কাছে অসহায় করে তোলে। আদর্শ যেন একটা প্রতিমূর্তি।

যে শিক্ষা পদ্ধতি তাদের কতগুলো ধারণার ভক্ত করে তোলে, যেমন গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক সোশ্যালিজম, শান্তিবাদী ইত্যাদি ধ্যান-ধারণাগুলো বাইরে থেকে তাদের এমনভাবে গড়ে যে জীবনের মূল উদ্দেশ্য যেন এ ধারণাগুলোকেই রূপ দেওয়া। কিন্তু অপরদিকে নিজের জাত জার্মানদের সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই একটা অনীহার ভাব গড়ে ওঠে। শান্তিবাদী যারা জার্মান তারা দেহমন ছোটবেলা থেকেই গোঁড়া আদর্শের কাছে বিকিয়ে দিয়ে বসে থাকে; যখনই বিপদজনক কোন অবস্থার মুখোমুখি জাতি এসে দাঁড়ায়, তখন এরা বিচার করতে বসে কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয়। এমনকি এ বিপদ যদি মারাত্মক এবং প্রায় ধ্বংসের কাছেও জাতিকে নিয়ে যায়, তবু সে নিজের লোকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সংগ্রামে নামবে না; এমনকি নিজেদের আত্মরক্ষার প্রশ্নেও নয়।

বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের ওপর কি ধরনের প্রতিক্রিয়া ঘটে তার আরেকটা উদাহরণ দেওয়া যায়। যখন বংশ পরম্পরায় জার্মান আদর্শ হয়, প্রটেস্টান্ট ধর্মমতের লোকেরা তাদের আদর্শকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থের বেলায় এরাই সবচেয়ে আগে সরে দাঁড়ায়। কারণ এটা ধর্মের আদর্শ বা বংশ পরম্পরায় কোন ব্যাপার নয়, কোন একটা কারণ দেখিয়ে তা বাতিল করে দেবে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে প্রটেস্টান্টরা নৈতিক সাধুতা বা জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতির ভাষা বা আধ্যাত্মিক ব্যাপারে নিজেদের রক্ষা করার জন্য মনপ্রাণ সঁপে দেবে; কারণ এগুলোই যে ওদের ধর্মীয় আদর্শ যার জন্য তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু এ প্রটেস্টান্টরাই জাতি যখন শত্রুর আক্রমণের মুখোমুখি, তা থেকে উদ্ধারের প্রতিটি প্রচেষ্টাকে তারা প্রাণপণে বাধা দেবে। কারণ ইহুদীদের প্রতি এদের ধারণা দৃঢ় এবং গোড়াভাবে স্থির। যদিও এটাই হল প্রথম সমস্যা যার সমাধানের প্রয়োজন, এবং জার্মান জাতির এ চরম অধঃপতনের থেকে পুনরুত্থানের পথে টেনে ওঠানো এ সমস্যার সমাধান ছাড়া অসম্ভব।

ভিয়েনার প্রবাসী দিনগুলোয় আমার প্রচুর অবসর এবং সুযোগ ছিল কোনরকম সংস্কার ছাড়াই সমস্যাটাকে বিশ্লেষণ করার এবং প্রত্যহ যে হাজার হাজার লোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হত, তার থেকে আমার সমাধান যে নির্ভুল এ বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলাম।

এ আলোতেই যেখানে অনেক জাতির লোক এক বিন্দুতে এসে মিলেছে, তাদের কাছে এটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট যে জার্মান শক্তিবাদীর দল তাদের জাতির স্বার্থের ওপরই দেখেছে। উপরন্তু আমি দেখেছি জার্মান সোশ্যালিস্টরা একমাত্র আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং জাতির স্বার্থের ব্যাপারে কোন রকম দাবি দাওয়াই তাদের নেই; একমাত্র অন্য দেশের সহকর্মীদের কাছে বিলাপ করা ছাড়া। কেউ কিন্তু চেক্ বা পোলিশদের চরিত্রে এ কলঙ্ক আরোপ করতে পারবে না। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, চরিত্রের এ কলঙ্কময় দিকটার জন্য দায়ী সেই দিনের মতবাদ। পুরোপুরি দায়িত্ব হল শিক্ষা ব্যবস্থার; যেটা আমাদের জাতীয় আদর্শকে কখনই গড়তে দেয়নি।

সুতরাং প্যান-জার্মান আন্দোলনের নেতাদের ক্যাথলিক ধর্মমতের বিরোধিতা আমার মতে পুরোপুরি অসমর্থনীয়।

একমাত্র এ শয়তানির সমাধানের উপায় হল, জার্মান যুবকদের ছোটবেলা থেকে মনটাকে বিষিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে কি করে স্বার্থরক্ষা করতে হয়, সেই বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া। যখন তারা অত্যন্ত ছোট, তখন থেকেই প্রত্যেকটা বস্তুকে ওপর থেকে দেখার প্রবণতা তাদের ভেতরে প্রবেশ করে, যেটা ভবিষ্যতে আমাদের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে ফেলে। এর ফলে আয়ারল্যান্ড, পোল্যান্ড কিংবা ফ্রান্সের মত ক্যাথলিকরা প্রথমে এবং সর্বাগ্রে হবে জার্মান। কিন্তু এ যে আগে থেকে শিক্ষা তা সরকারের একটা মৌলিক পরিবর্তন আনতে সমর্থ হবে।

আমার এ মতবাদের সবচেয়ে জোরাল সমর্থন হল, ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে যখন শেষবারের মত ইতিহাসের বিচারশালায় আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য গিয়ে দাঁড়াতে হয়েছিল, সে ছিল জীবন মরণের সংগ্রাম।

যতদিন পর্যন্ত ওপরের নেতৃত্বের অভাব ছিল না, জনসাধারণ তাদের কর্তব্য যতটা সম্ভব বেশি পরিমাণেই পালন করেছে। তা সে প্রটেস্টান্ট ধর্মযাজক বা ক্যাথলিক পাদ্রী, যে-ই হোক না কেন, চেষ্টা করেছে আপ্রাণ তা তুলে ধরতে শুধু বাইরের জীবনেই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও। বিশেষ করে উৎসাহের প্রথম জোয়ারের সময়। উভয় ধর্মই পবিত্র জার্মান সাম্রাজ্যকে ভাগাভাগি করা হয়নি, যা রক্ষা এবং ভবিষ্যত সমৃদ্ধির জন্য তারা ঈশ্বরের কাছে সতত প্রার্থনা করেছে।

অস্ট্রিয়ার প্যান-জার্মান আন্দোলনের নেতাদের নিজেদেরই একটা প্রশ্ন করা উচিত, যতদিন পর্যন্ত তাদের বিশ্বাস ক্যাথলিক ধর্মে আছে, ততদিন পর্যন্ত অস্ট্রিয়াতে এ জার্মানিদের থাকতে দেওয়া উচিত কিনা? যদি এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হয়, তবে রাজনৈতিক দল হিসেবে এর ধর্মীয় দলাদলিতে জড়িয়ে পড়াটা উচিত হয়নি। কিন্তু উত্তরটা যদি নেতিবাচক হয়, তবে এদের ধর্মীয় সংস্কারে নামা উচিত ছিল; রাজনৈতিক আন্দোলনে নয়।

যারা বিশ্বাস করে যে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে ধর্মীয় সংস্কার সম্ভব, তাদের শুধু ধর্ম নয়, কোন মতবাদে বিশ্বাস এবং বাস্তবে চার্চের কি প্রতিক্রিয়া—এসব সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই।

কোন মানুষের পক্ষে দু’জন প্রভুকে সেবা করা সম্ভব নয় এবং ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি যে ধর্মের ভিত্তিভূমি উপড়ে ফেরার চেয়ে কোন দেশের সরকার উপড়ে ফেলা

অনেক সহজ। সত্যি বলতে কি, একটা দলের পক্ষে এটা বিশেষ কিছু কাজ নয়।

এর বিরুদ্ধে কোন যুক্তিই খাটে না। বরং বলা যায় আক্রমণটা করা হয়েছিল আত্মরক্ষার খাতিরে, কোন বহিরাক্রমণ রুখবার জন্য নয়।

সন্দেহ নেই যে সব সময়েই কিছুসংখ্যক নীতিজ্ঞান শূন্য দুরাত্মা থাকে, যারা রাজনীতির পটভূমি হিসেবে ব্যবহারের জন্য ধর্মকে টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে আসে। প্রায় সব সময়েই এদের মনে ধর্ম এবং রাজনীতি নিয়ে ব্যবসা করার ধান্দা থাকে। কিন্তু এরজন্য চার্চকে দোষারোপ করা অন্যায়; কারণ সর্বদাই এ সংসারে কিছু দূরাত্মা থাকে, তারা যারই সংস্পর্শে আসে তাকেই প্রতারণা করে। তার জন্য ধর্ম বা কোন ধার্মিক সম্প্রদায়কে দোষী বা দায়ী করা যায় না।

এ সংসদীয় কুঁড়ে এবং প্রবঞ্চকদের কাছে কোন একটা বলির ছাগল খোজার চেয়ে সুস্বাদু বস্তু আর কিছু নেই; অবশ্যই ঘটনা ঘটে যাবার পর। যে মুহূর্তে ধর্ম বা ধর্মীয় কোন সম্প্রদায়কে এর জন্য আক্রমণ করা হয়, সেই মুহূর্তে সে এবং তার ভ্রষ্ট দল হৈহুল্লা চিৎকার জুড়ে দিয়ে সারা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বোঝাতে চেষ্টা করে সে এবং তার সৃষ্ট গোলমালই একমাত্র চার্চ এবং ধর্মকে রক্ষা করেছে। জনসাধারণ স্বভাবতই বোকা এবং স্মৃতিশক্তি না থাকায় মনে করতে পারে না যে এ গোলমালের পেছনে চাবিকাঠি কে নাড়ছে এবং কার জন্য এ হাঙ্গামা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গোলমালটা কে শুরু করেছিল ভুলে যাওয়াতে এ প্রবঞ্চকগুলো সহজে রেহাই পেয়ে যায়।

ধূর্তেরা সব সময়ই জানে তার কুকাজের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। সুতরাং যখন সে দেখে সৎ অথচ কৌশলহীন প্রতিপক্ষ হেরে গেছে, তখন সে জামার অস্তিন গুটিয়ে নিয়ে আরো বেশি হাসতে শুরু করে এবং তার প্রতিপক্ষ একসময় জনসাধারণের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে জনজীবনের কোন ব্যাপারে অংশগ্রহণের থেকে অবসর নেয়।

কোন একক ব্যক্তির কুকার্যের জন্য চার্চ বা ধর্মকে দায়ী করা আরেকটা দৃষ্টিকোণ থেকেও অন্যায়। কেউ যদি দলের বিশালত্ব তুলনা করে, যেটা সাদা চোখে সবাই দেখতে সক্ষম, তাহলে মানব চরিত্রের সাধারণ দুর্বলতাগুলো মেনে নিয়েও আমাদের স্বীকার করা উচিত যে খারাপের চেয়ে ভালর দিকের পাল্লাই এখানে বেশি ভারী। পাদ্রীদের মধ্যেও কয়েকজন থাকতে পারে যারা তাদের পবিত্র আহ্বান রাজনৈতিক উচ্চাশা পূরণের কাজে লাগায়। দুর্ভাগ্যবশত কিছু ধর্মযাজক ভুলে যায় এ রাজনৈতিক দাঙ্গায় তাদের আরো বেশি বিশ্বস্ত যোদ্ধা হওয়া উচিত। মিথ্যা এবং দুষ্কর্মেরতদের সাহায্যকারী হিসেবে কোন কাজ করা তাদের পক্ষে অন্যায়। তবে প্রতিটি অন্যায়কারীর তুলনায় আরো হাজার ধর্মযাজক আছে, যারা এ পংকিল সমুদ্রের মধ্যে ছোট ছোট দ্বীপের মত মাথা উঁচু করে নিজেদের ধর্মীয় কাজ অতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে চলেছে।

আমার পক্ষে চার্চকে দোষী করা সম্ভব নয়, তার স্বপক্ষে যথেষ্ট কারণও নেই। যদি কিছু ভ্রষ্ট ব্যক্তি পাদ্রীর পোশাক পরে নৈতিক আইন কানুনের বিরুদ্ধে কোনকিছু করে, তবু মুহূর্তের জন্যও আমি চার্চকে দোষারোপ করব না। চার্চের অগুন্তি সভ্যদের মধ্যে কয়েকজন হয়ত বা তাদের স্বদেশবাসীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। কারণ এ যুগে তো সেটা খুব সাধারণ ব্যাপার। বিশেষ করে আমাদের যুগে ভোলা উচিত নয় যে গ্রীক বিশ্বাসঘাতক ফিলটেসের* সময়েও হাজার লোক বর্তমান ছিল যাদের হৃদয়ে তাদের স্বদেশবাসীর দুঃখে সবসময়ে রক্তক্ষরণ হত। তাই আমাদের দুর্ভাগ্যের কালো ছায়া সরে গিয়ে যখন সুখের সূর্য মুখ বাড়াবে, তখন এরাই জাতির মুকুট হিসেবে বিবেচিত হবে।

এখানে যদি এ প্রশ্ন কেউ তোলে যে আমরা দৈনন্দিন ছোট ছোট সমস্যাগুলোর আলোচনা করছি না, কিন্তু ধর্মের ব্যাখ্যা করে চলেছি, তবে তার একমাত্র উত্তর হল:

তুমি কি মনে কর সময় তোমাকে পৃথিবীতে সত্য স্থাপনের জন্য আহ্বান করেছে? তাই যদি হয়, তবে তাই কর। কিন্তু সে কাজ প্রত্যক্ষভাবে করার মত সাহস তোমার থাকা চাই এবং কোন রাজনৈতিক দলকে মুখবন্ধ হিসেবে ব্যবহার করা উচিত নয়। কারণ এ উপায়ে তুমি তোমার বৃত্তিকেই ত্যাগ করবে। বর্তমানে যার অস্তিত্ব আছে তাকে আরো ভাল কিছু করা উচিত যা ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে।

যদি তোমার সে রকম সাহস না থাকে বা এর পরিবর্তে সঠিক জিনিসটা কি হবে জানা না থাকে, তবে সেটাকে আগের মতই থাকতে দাও। নাড়াচাড়া করাটা ঠিক হবে না। কিন্তু যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, রাজনৈতিক দলের স্বার্থে ঘোরাপথে নিজের উদ্দেশ্য সাধন করতে যেও না, যদি তোমার মুখোশ খুলে সংগ্রাম করার মত সৎসাহস না থাকে।

রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্মের ব্যাপারে অযথা হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকারই নেই, যদি না তার সঙ্গে জাতির স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত থাকে। কারণ তা সমগ্র জাতিকে সংস্কৃতি, নৈতিকতা প্রভৃতি সবদিক থেকে টেনে নিচে নামিয়ে নিয়ে যাবে।

যদি কোন উচ্চ পদস্থ যাজক ধর্মীয় উৎসব বা কুশিক্ষা ব্যবহার করে যা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী তবু তার প্রতিপক্ষের সেই রাস্তাতে যাওয়া উচিত নয় বা একই অস্ত্রে যুদ্ধ করাটাও ঠিক হবে না।

কোন রাজনৈতিক নেতার কাছে যদি ধর্মীয় অনুশাসন এবং তার প্রচার পবিত্র এবং অলঙ্খনীয় বলে বিবেচিত হয়, তবে তাকে কোনরকমেই রাজনৈতিক নেতা বলা চলে না। সে হল ধর্ম সংস্কারক। যদি অবশ্য তার ধর্ম সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় গুণগুলো থাকে।

.

প্যান-জার্মান আন্দোলন এবং তাদের রোমের সঙ্গে বিরোধ নিয়ে আমি স্থির নিশ্চিত যে, বিশেষ করে শেষের দিকে প্যান-জার্মান আন্দোলনকারীরা সামাজিক সমস্যাগুলো থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার ফলে জনসাধারণের সমর্থনও হারিয়ে ফেলে, যারা হল এ ধরনের সংগ্রামের অতি নির্ভরযোগ্য যোদ্ধা। সংসদে প্রবেশ করে প্যান-জার্মান আন্দোলনকারীরা নিজেদের ভেতরের শক্তিটাকে হারায়, যার উৎসস্থল হল জনসাধারণ এবং সংসদের পরাজয়ের বোঝাটাকেও তাদের ঘাড়ে এসে পড়ে। চার্চের সঙ্গে তাদের রেষারেষির দরুন, নিচু এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসংখ্য জনসাধারণের আস্থা তারা হারিয়ে ফেলে; ওপরের স্তরেরও অনেকে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে যাদের অনেককেই জাতির মূল্যবান সম্পদ হিসেবে গণ্য করা চলে। সুতরাং অস্ট্রিয়ার সংস্কৃতি আন্দোলনের হিসেবের খাতায় লাভের পরিবর্তে ঢ্যাড়াই পড়ে।

যদিও তারা দশ লাখ লোককে চার্চের আওতা থেকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিল, তবু তাতে পরবর্তীদের কোন ক্ষতি হয়নি। কারণ চার্চের পক্ষে হারানো মেষগুলোর জন্য চোখের পানি ফেলার কোন মানে হয় না। এরা হৃদয় দিয়ে চার্চকে কোনদিন ভালবাসেনি। এ নতুন সংস্কারের সঙ্গে মহাসংস্কারের পার্থক্য এ যে মহাসংস্কার কালের একটা বিখ্যাত ঘটনা, যখন চার্চ ধর্মের জন্য তার কয়েকজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারায়। কিন্তু এ নতুন সংস্কারে তারাই একমাত্র চার্চ ছেড়ে বেরিয়ে আসে যাদের সঙ্গে চার্চের যোগাযোগ আগেও নিবিড় ছিল না। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটাকে শুধু হাস্যাস্পদ ঘটনাই বলা চলে না, শোচনীয়ও বটে। আরো একবার জার্মান জাতির পক্ষে প্রতিশ্রুতিময় একটা রাজনৈতিক আন্দোলন যা ব্যর্থ হয়। কারণ এটাকে রূঢ় বাস্তবের প্রতি অবিচলিত অনুরাগ রেখে পরিচালিত হয়নি। তাই এমন একটা জায়গায় আন্দোলনের স্রোত গিয়ে পড়ে যেখানে আপনা থেকেই তা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়তে বাধ্য।

যদি বিশাল জনসাধারণের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারত তবে প্যান-জার্মান আন্দোলন নিশ্চয়ই এ ভুল করত না। নেতাদের যদি এটা জানা থাকত তবে একমাত্র মনস্তাত্ত্বিক

কারণেই জনসাধারণের সামনে একটার বেশি দুটো প্রতিদ্বন্দ্বী খাড়া হতে দিত না, কারণ এটা তাদের সগ্রাম করার শক্তিটাকেই টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। তাদের উচিত ছিল পূর্ণশক্তি নিয়ে একক প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে দাঁড়ানো। একটা রাজনৈতিক দলের নীতির পক্ষে এটা বিপজ্জনক, যা কিনা এমন একজন মানুষের দ্বারা পরিচালিত যে তার আঙুল প্রতিটি মটর দানার ওপর রাখতে চায়, কিন্তু সহজ একটা ব্যঞ্জন রান্না করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়।

বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের বিপক্ষে কথা বলা যেতে পারে এমন অনেক কিছুই আছে, তবু রাজনৈতিক নেতাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ইতিহাসের শিক্ষা কোন নির্ভেজাল রাজনৈতিক দল এ পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে ধর্মের সংস্কার করতে সক্ষম হয়নি। কেউ ইতিহাস পড়ে না শিক্ষাকে অবিশ্বাস করতে বা ভুলে যাওয়ার জন্য, যখন সত্যিকারের সময় উপস্থিত হয় তা বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য। এ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম হয়েছিল এ ধারণা করাটা ভুল হবে, যেখানে ইতিহাসের অনন্তকালের সত্যটা ঠিক খাটে না। কেউ ইতিহাসের শিক্ষা নেয় বর্তমানে সেটা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে, যে সেটা করে না, তার কোন যোগ্যতাই নেই। বাস্তবে তার জ্ঞান তাহলে ব্যাপারটায় ভাসা ভাসা অথবা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা হয়ে থাকে, সে একটি দাম্ভিক কিন্তু সহজে প্রতারিত হয় এমন নির্বোধ ব্যক্তি যার সৎ উদ্দেশ্য তার বাস্তব ব্যাপারে অক্ষমতার পরিপূরক নয়।

নেতৃত্বের কৌশল, যা নাকি বিরাট বিরাট নেতারা যুগে যুগে করে এসেছে, তা হল সমস্ত জনসাধারণের মনোযোগ একত্রিত করেছে মাত্র একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে এবং সতর্কতা নিয়েছে যাতে কোন রকমেই সেই মনোযোগী জনসাধারণ ভেঙে টুকরো টুকরো

হয়। যত বেশি জনসাধারণের যুদ্ধরত শক্তি একটা দৃশ্যের ওপর পড়বে, তত বেশি নবাগত সেই আন্দোলনে যোগ দেবে তার চৌম্বক শক্তিতে আকৃষ্ট হয়ে যার দ্বারা সেই আন্দোলনের তীব্রতা অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে। প্রতিভাধর নেতাদের এমন ক্ষমতা থাকা উচিত যাতে নাকি তারা অনেক বিরুদ্ধ মতাবলম্বীদেরও একই ধরনের বিরোধিতা বলে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরতে পারে; দুর্বল এবং টলমলে চরিত্রের নেতাদের নিজেদের কাজ সম্পর্কে সন্ধিগ্ধ মনোভাব নিজেদের ভেতরে গড়ে উঠবে, যদি তাদের অনেকগুলো বিভিন্ন ধরনের শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়।

যে মুহূর্তে অস্থির জনসাধারণ দেখতে পাবে তাদের প্রতিপক্ষ রকমারী দলের সংমিশ্রণে তৈরি, তখনই তারা মনে করবে যে এটা কি রকম হল? আমরা এবং আমাদের আন্দোলনই একমাত্র সঠিক। আর প্রতিপক্ষের মত এবং আদর্শ ভুল।

এ ধরনের অনুভূতি প্রথমেই তাদের সংগ্রাম করার শক্তিটাকে পঙ্গু করে দেবে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের শত্রুতা একই কেন্দ্র থেকে ছিটকে বেরিয়েছে। তাদের এক জায়গায় আটকে একটা প্রতিপক্ষের সৃষ্টি করতে হবে, যাতে সংগ্রামরত জনসাধারণ তাদের সামনে একজন প্রতিপক্ষকেই দেখতে পায়; যার বিরুদ্ধে তাদের লড়তে হবে। এ ধরনের একতা তাদের নিজেদের বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করবে এবং প্রতিপক্ষের প্রতি বিরোধিতার অনুভূতিটা চরমে নিয়ে যাবে।

প্যান্-জার্মান আন্দোলনের ব্যর্থতার জন্য দায়ী হল এর নেতারা, যারা এ সত্যের রহস্যটা অনুধাবন করতে পারেনি। তারা তাদের লক্ষ্যটাকে স্পষ্ট দেখেছিল এবং ভেবেছিল তাদের নীতিটাই সঠিক; কিন্তু এ ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা ভুল রাস্তায় গিয়ে পড়েছিল। এদের কার্যকলাপের সঙ্গে তুলনা করা চলে সেই আলপস পর্বতে আরোহণকারী, যে চূড়ার দিকেই দৃষ্টি নিবন্ধ রেখে পথ এগোচ্ছিল, যার দৃঢ়তা এবং শক্তি ছিল শ্রেষ্ঠত্বের তুঙ্গে, কিন্তু পায়ের নিচেকার রাস্তাটাকেই সে দেখেনি। তার দৃষ্টি উদ্দেশ্যের প্রতি এতই নিবদ্ধ ছিল যে সে আরোহণের পথটা নিয়ে চিন্তা করেনি বা তাকিয়েও দেখেনি; তাই শেষে তাকে বাধ্য হয়ে পরাজয় বরণ করে নিতে হয়েছে।

প্যান্-জার্মান পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য যে রাস্তা বেছে নিয়েছিল তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদের নির্বাচিত রাস্তা শঠতার। কিন্তু এদের উদ্দেশ্যে পৌঁছবার জন্যে ধ্যান-ধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল না। যেসব কারণে প্যান-জার্মান আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছিল, সেই সব নীতি সম্পর্কে খ্রিস্টান সোশ্যালিস্ট পার্টি ছিল সঠিক এবং নিয়মতান্ত্রিক।

তারা জনসাধারণের গুরুত্ব ঠিকভাবে উপলব্ধি করেছিল এবং প্রথম থেকেই আন্দোলনের সামাজিক চরিত্রটার দিকে নজর দেওয়ায় বিপুল জনতার জনপ্রিয়তা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং শ্রমশিল্পীদের প্রতি আবেদন রাখায় তাদের সমর্থন পেয়েছিল–যারা বিশ্বাসী, ধৈর্যশীল এবং আত্মোৎসর্গকারী। খ্রিস্টান সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতারা প্রথম থেকেই অতি সতর্কভাবে ক্যাথলিক ধর্ম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হৃদ্য সম্পর্ক বজায় রাখায় এ বিশাল প্রতিষ্ঠানের পুরো সমর্থন পেয়েছিল। এ আন্দোলনের নেতারা বিরাটভাবে প্রচার ব্যবস্থায় বিশ্বাস করত এবং এরা প্রকৃতই ধার্মিক ছিল। যে কারণে বিশাল জনতার মধ্যে আধ্যাত্মিক একটা সহজাত প্রেরণা জাগাতে পেরে এরা তাদের সমর্থন লাভ করে।

এ পার্টির নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে না পারার প্রধান দুটো কারণ ছিল, যে কারণদ্বয়ের জন্যে তাদের পক্ষে অস্ট্রিয়াকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

খ্রিস্টান সোশ্যালিস্টদের ইহুদী বিদ্বেষের পটভূমি ধর্মীয় ভিত্তিতে ছিল, জাতি বিদ্বেষের আদর্শের ওপর নয়; এ ভুল থেকেই দ্বিতীয় ভুলের জন্ম হয়েছিল।

খ্রিস্টান সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের ধারণা ছিল যদি অস্ট্রিয়াকে রক্ষা করতে হয় তবে তাদের ধ্যান-ধারণা জাতিগত হওয়া উচিত হবে না। কারণ তাদের মনে হয়েছিল এ ধরনের নীতি নিলে অস্ট্রিয়া টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। পার্টির সর্বোচ্চ নেতার ধারণা ছিল যে ভিয়েনা টুকরো টুকরো হয়ে যেতে পারে এমন কোন ব্যাপার বা চিন্তাধারা সযত্নে পরিহার করা উচিত। এবং যে সব চিন্তাধারা রকমারী জাতিকে এক সুতোয় বাধতে পারবে, একমাত্র তাকেই উৎসাহ দেওয়া উচিত।

সে সময় ভিয়েনায় পরদেশীদের মধুচক্র ছিল, বিশেষ করে চেদের। এদের জার্মান বিরোধী নয় এমন কোন দলে তালিকাভুক্ত করতে সবিশেষ ধৈর্য্যের প্রয়োজন ছিল। অস্ট্রিয়াকে বাঁচাতে হলে ওদের অপরিহার্যতাকে স্বীকার করে নিতেই হয়। সুতরাং ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের সমর্থন পাওয়ার সবরকম চেষ্টাই করা হয়েছিল, যাদের বেশির ভাগই ছিল চে। যারা ম্যানচেষ্টার স্কুলের উদার আদর্শের তথাকথিত যোদ্ধা, তাদের বিশ্বাস এ ধরনের মতবাদের সাহায্যে তারা ইহুদীদের বিরোধিতা করতে সক্ষম হবে। কারণ ধর্মীয় অনুসন্ধানের জালে জড়িয়ে পড়ে অন্য ধর্মের লোকেরা একত্রিত হবে, যা পুরনো অস্ট্রিয়ার লোকসংখ্যার সমসংখ্যক।

এটা পরিষ্কার যে এ ধরনের ইহুদী বিদ্বেষ ইহুদীদের খুব একটা ভাবিয়ে তুলতে পারেনি। কারণ এটা পরিষ্কার ধর্মীয় ভিত্তিভূমিতে স্থাপিত। খুব বেশি খারাপ হলে তো দরকার মাত্র কয়েক ফোঁটা পবিত্র পানির, যা ছিটিয়ে দিলেই সমস্যা শেষ। তার পরেই নিশ্চিন্ত মনে যেমন ব্যবসাও করা যাবে আর তেমনি ইহুদী জাতীয়তা বজায় রাখা যাবে।

এসব ভাসা ভাসা কারণে সম্পূর্ণ সমস্যাটাকে সমাধান করার ব্যাপারে যুক্তিসংগতভাবে অসম্ভব ছিল। তার ফলে বহুলোকই ইহুদী বিদ্বেষী ব্যাপারটা পুরোপুরি অনুধাবন করতে না পেরে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণই করে না। আদর্শের চৌম্বক শক্তি এভাবে নিতান্ত একটা সংকীর্ণমনা দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। কারণ নেতারা অনুভূতির আরো উচ্চস্তরে আরোহণে অসমর্থ হয়ে পড়ে এবং তার ভিত্তিভূমি সঠিক যুক্তিসঙ্গতভাবে স্থির করা হয় না। আদর্শগতভাবে বুদ্ধিমানেরা তাই এ নীতিকে সমর্থনও করে না। সমস্ত আন্দোলনটাকেই যেন মনে হচ্ছিল ইহুদীদের ধর্মান্তরকরণের একটা নতুন প্রচেষ্টা। অপরদিকে মনে হচ্ছিল এটাকে দলবদ্ধভাবে এ ধরনের আন্দোলনের আরো একটা প্রচেষ্টা। এভাবে সমগ্র সংগ্রামটাই তার আধ্যাত্মিক এবং ভক্তিসম উৎপাদক চরিত্রটা হারিয়ে বসে থাকে। সত্যি কথা বলতে কি, কিছু মানুষের চোখে, যাদের কোন রকমেই অপদার্থ বলা যায় না, পুরো আন্দোলনটাকেই আদর্শভ্রষ্ট এবং তিরস্কারের যোগ্য বলে মনে হয়। সুতরাং সমস্ত মানব জাতির পক্ষে ভীষণ প্রয়োজনীয় কোন সমস্যা বর্তমান, যার ওপরে ইহুদী ছাড়া পৃথিবীর অন্য সব জাতির অস্তিত্ব নির্ভর করছে—এ বিশ্বাস মানুষের মধ্যে জাগাতে ব্যর্থ হয়।

গয়ংগচ্ছভাবে নিয়ে পুরো সমস্যাটাকে সমাধানের প্রচেষ্টা খ্রিস্টান সোশ্যালিস্টদের বিদ্বেষী নীতিকে ভোঁতা করে দেয়।

এ আন্দোলনের বাইরের রূপটাই ছিল একমাত্র ইহুদী বিদ্বেষী। এবং এর ফলাফল অনেক দূর পর্যন্ত গড়ায়, তার চেয়ে সম্ভবত ইহুদী বিদ্বেষী ভাব আন্দোলনে না থাকলেই ভাল ছিল। কারণ এ ভুল ধারণা মানুষের মধ্যেও একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি করেছিল যে শত্রুকে কান ধরে টানা হয়েছে; কিন্তু সত্যিকারের অবস্থা দেখতে গেলে দেখা যাবে, শত্রুকে কান ধরে টানার পরিবর্তে জনসাধারণকেই নাকে খত দিতে হয়েছে।

ইহুদীরা এ ইহুদী বিদ্বেষী পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয় এবং দেখে যে এ ইহুদী বিদ্বেষী পরিবেশই তাদের পক্ষে লাভজনক। এ পরিবেশের অবলুপ্তি তাদের ক্ষতি ডেকে আনবে।

পুরো আন্দোলনটাই দেশের কাছে, যা অসদৃশ্য জাতির সমন্বয়ে গঠিত আরও বেশি আত্মোৎসর্গ কামনা করে, বিশেষ করে জার্মানদের অছিরূপে বেশি প্রয়োজন ছিল।

এমনকি ভিয়েনাতেও কেউ জাতীয়তাবাদী হতে সাহস করত না পায়ের তলায় মাটি সরে যাবার ভয়ে। হাবুসবুর্গ সরকারের ধারণা ছিল জাতীয়তাবাদী প্রশ্নটা চুপচাপ এড়িয়ে যেতে পারলেই বোধহয় হাবুবুর্গ সরকার রক্ষা পেয়ে যাবে। কিন্তু এ নীতি সরকারের ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে এবং একই নীতি খ্রিস্টান সোশ্যালিজমের মৃত্যুও ঘনিয়ে আনে। এভাবে আন্দোলনটা যার থেকে একটা রাজনৈতিক দল তার প্রয়োজনীয় এগিয়ে যাবার শক্তি আহরণ করবে, সেই একমাত্র উৎসটাকেই হারিয়ে ফেলে।

এ বছরগুলোতে আমি উভয় আন্দোলনকেই সতর্কভাবে অনুধাবন করি। কেমন করে তারা উন্নতির ধাপে ধাপে এগোচ্ছিল। একটা আন্দোলনের সঙ্গে আমার হৃদয়ের যোগ ছিল, আর আরেকটার সঙ্গে এ বিস্মৃত মানুষটার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিল, যাকে আমার তখন মনে হয়েছিল অস্ট্রিয়ায় বসবাসকারী জার্মানদের শ্রেষ্ঠ প্রতীক।

যখন মৃত বুর্গার মাষ্টার বা মেয়রের শবযাত্রার মিছিলটা সিটি হল থেকে রি স্ট্রাসের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, হাজার হাজার লোকের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমিও দেখেছিলাম সে পবিত্র নীরব শবযাত্রার মিছিলকে চলে যেতে। পুরো ব্যাপারটা যেন আমার মনটাকে সজোরে নাড়া দিয়ে যায় এবং আমার সহজাত প্রবৃত্তি যেন বলে দেয়, এ মানুষটার সমস্ত কাজই পণ্ডশ্রম হয়েছে। কারণ একটা অনমনীয় দানব ভাগ্য এ সরকারকে টেনে নিয়ে চলেছে পতনের দিকে। যদি ডক্টর লুইগের জার্মানিতে বসবাস করত, তবে আমাদের জনসাধারণের মধ্যে নেতৃত্বের পদ তাঁকে দেওয়া হত; এটা তারই দুর্ভাগ্য যে এমন একটা দেশে তাকে কাটাতে হয়েছে যেখানে তার করার কিছুই ছিল না।

তার মৃত্যুর পরেই বালাকান দেশসমূহে আগুন জ্বলে উঠেছিল। এবং মাসের পর মাস তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেদিক থেকে তার ভাগ্য খারাপ বলতেই হবে, কারণ যার জন্য সারাজীবন সে সংগ্রাম করে গেছে তা শেষ পর্যন্ত সে দেখতে পায়নি।

আমি বিশ্লেষণ করতে সচেষ্ট হই কি কারণে একটা আন্দোলন এরকমভাবে ব্যর্থ হয়ে গিয়ে ধ্বংসের পথে এগিয়ে গেল। এসব অনুসন্ধানের ফলাফলে আমার দৃঢ় ধারণা হয় যে পুরনো অস্ট্রিয়াকে একত্রি করতে না পারার দরুন উভয় দলই বিরাট ভুল করেছিল।

প্যান-জার্মান দল তাদের আন্দোলনের লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য জাতিগত আদর্শ ঠিকই বেছে নিয়েছিল, সেটা হল জার্মান জাতির পুনরুত্থান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যে রাস্তাটা ওরা লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে নির্বাচিত করেছিল সেটা সঠিক হয়নি। এটা হল জাতীয়তাবাদী, কিন্তু ওরা সামাজিক সমস্যাগুলোর দিকে খুব অল্পই নজর দিয়েছিল, এবং সেই কারণেই জনতার সমর্থনও পায়নি। কিন্তু সত্যটাকে বিচার করতে গিয়ে ওরা ভুল করেছিল, যার জন্য ভুল পদ্ধতিতে ওদের একটা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে।

খ্রিস্টান সোশ্যালিস্ট আন্দোলন অনেকগুলোর মধ্যে জার্মানদের পুনরুত্থানের ভুল ধারণা ছিল, কিন্তু ওদের বুদ্ধিমত্তা এবং দলীয় আদর্শের লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্য নির্বাচিত পথটা বাছা ভাগ্যক্রমে সঠিক হয়েছিল। খ্রিস্টান সোশ্যালিস্টরা সামাজিক সমস্যাগুলোর চরিত্র ঠিকমত অনুধাবন করতে পেরেছিল; কিন্তু ইহুদীদের সঙ্গে সগ্রামের পথটা তাদের ভুল ছিল এবং তারা জাতীয়তাবাদীকে রাজনৈতিক শক্তির উৎস হিসেবে মূল্য দিতে সম্পূর্ণ ভুল করেছিল।

যদি খ্রিস্টান সোশ্যালিস্ট দল তাদের ধূর্ত বিচার বুদ্ধির সঙ্গে যা তারা জনপ্রিয় জনতা সম্পর্কে নিয়েছিল, জাতিগত সমস্যা সম্পর্কেও সেই বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করত—যেটা প্যান্-জার্মান আন্দোলনকারীরা ঠিক মত ধরতে পেরেছিল,-এবং এ পার্টি যদি সত্যিকারের জাতীয়তাবাদী হত; অথবা যদি প্যান-জার্মান আন্দোলনের নেতারা অপরদিকে ইহুদীদের এবং জাতীয়তাবাদী সম্পর্কে সঠিক ধারণার সঙ্গে খ্রিস্টান সোশ্যালিস্ট দলের মত বাস্তববাদী হত— বিশেষ করে সামাজিক দিক থেকে, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি আন্দোলন এমন রূপ নিত যা জার্মানদের গন্তব্যটাকে সফলভাবে ঘুরিয়ে দিত।

তৎকালীন দলগুলোর কারোর মধ্যে আমার মতবাদের মিল দেখতে পাইনি, আর সে কারণে তার দলভুক্ত সদস্য হবার জন্য আমার নামও লেখাইনি, এবং আমার সাহায্যের হাতও তাদের দিকে বাড়াইনি। এমনকি এসব দলগুলো তাদের সব শক্তি হারিয়ে ফেলে তখন শ্রান্ত, ক্লান্ত। তাই তাদের পক্ষে সত্যিকারের শক্তভাবে ধরে জার্মান জাতির পুনরুত্থান করাটাও সম্ভব ছিল না।

আমার অন্তরের বিতৃষ্ণা হাবুসবুর্গ শাসকদের প্রতি দিনে দিনে আরো বেশি বাড়তে থাকে।

যতই আমি এদের বৈদেশিক নীতি নিয়ে পর্যালোচনা করি, তত বেশি আমার ধারণা জন্মায় যে এ অপশাসক নিশ্চিতভাবে জার্মানদের দুর্ভাগ্যকে ডেকে আনবে। আমি দিনের পর দিন আরো বেশি উপলব্ধি করি যে জার্মান জাতির ভাগ্যের গন্তব্যস্থল কিছুতেই এদের দ্বারা নির্দিষ্ট হতে পারে না। তা একমাত্র সম্ভব কোন জার্মান সাম্রাজ্যে। এটা শুধু রাজনীতির ব্যাপারেই নয়, সংস্কৃতির ক্ষেত্রও এটা সত্যি।

এ সমস্ত ব্যাপারগুলোই সংস্কৃতি এবং শিল্পের ক্ষেত্রে আঘাত করেছে, যেখানে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যে বার্ধক্য হেতু জীর্ণ বলিরেখা ফুটে উঠেছে। অথবা কমপক্ষে, যে কোন বিপদের মুখোমুখি নিয়ে গিয়ে জার্মান জাতিকে দাঁড় করাবে, অন্তত এসব ব্যাপারে। এ সত্যটা আরো বিশেষভাবে প্রকটিত স্থাপত্য বিদ্যার ব্যাপারে। আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যা অস্ট্রিয়াতে কোন ফলাফলই দেখাতে পারেনি। কারণ রিঙ ট্রাসের বাড়িগুলো, এমনকি সমগ্র ভিয়েনার স্থাপত্যকলা জার্মান স্থাপত্যকলার তুলনায় প্রগতির দিক থেকে নেহাত ই তুচ্ছ এবং ক্রমে ক্রমে আমি এক দ্বৈত সমস্যার সম্মুখীন হই, কারণগুলো এবং বাস্তবতা আমাকে বাধ্য করে অস্ট্রিয়ার অমসৃণ শিক্ষানবীশ করতে, যদিও আমি আজ স্বীকার করি এ শিক্ষানবীশের ফলাফল শেষ পর্যন্ত ভালই হয়েছিল আমার পক্ষে। কিন্তু আমার হৃদয় পড়েছিল অন্য কোথাও।

একটা আত্মতুষ্টির মনোভাব আমার মনের ভেতরে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, এবং যত বেশি এ সরকারের অন্তঃসারশূন্যতা অনুভব করি তত বেশি আমাকে হতাশায় আচ্ছন্ন করে ফেলে। আমার দৃঢ় ধারণা হয় যে এ সরকার যে কোন মুহূর্তে ভেঙে পড়তে বাধ্য। এর হাত থেকে কিছুতেই অব্যাহতি নেই। তার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয় এ সরকার জার্মানদের জন্য সবরকম দুর্ভাগ্যকে ডেকে আনবে।

আমার দৃঢ় ধারণা হয় এ হাবুসবুর্গ সরকার প্রতিটি জার্মানের মহানুভবতাকে বাধা দিয়ে তার গতিরোধ করবে, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি অজার্মানদের অসৎ কার্যকলাপকে সাহায্য করে যাবে। অসদৃশ্য বিভিন্ন জাতির সমষ্টি এ রাজধানীতে যেন একটা জড়বৎ পিণ্ডের মত হয়ে আছে। বিশেষ করে চিত্র-বিচিত্র চেক, স্প্যানিশ হাঙ্গেরিয়ান, রুমানিয়ান, সার্বস এবং ক্রট প্রভৃতিরা। সর্বদা এ সমাজের তলাকার বীজাণু ওখানে সব জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ইহুদীরা আমার কাছে অত্যন্ত অপ্রীতিকর। এ বিশাল শহরটা যেন সংকর জাতীয় নীতিভ্রষ্ট অবতারদের নন্দন কানন।

জার্মান ভাষা যা আমি ছোটবেলা থেকে বলে এসেছি, তা ছিল লোয়ার ব্যাভিরিয়ার ভাষা। আমি বিশেষ ভঙ্গিতে বলার ভাষাটা কখনই ভুলতে পারিনি; আর সেই কারণেই ভিয়েনার উপভাষাও কখনো শিখিনি। যতদিন আমি সেই শহরে ছিলাম, বিদেশী পাঁচ মিশেলী পতঙ্গদের পালের প্রতি তত ঘৃণা আমার ভেতরে জেগে ওঠে। সেটা সুপ্রাচীন জার্মান সংস্কৃতির ওপরে বেতের মত নিরন্তর আঘাত করে চলে। আমার দৃঢ় ধারণা এ সরকার দীর্ঘদিন কিছুতেই স্থায়িত্ব পেতে পারে না।

অস্ট্রিয়ার তখনকার অবস্থা ছিল এক কারুকার্যময় সিমেন্টের মত, যেটা শুকিয়ে গিয়ে বহু পুরাতন এবং ভংগুর অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত এ ধরনের আর্ট ছোঁয়া না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা ঠিকই থাকে। কিন্তু যে মুহূর্তে বাইরের কোন আঘাত এর ওপরে এসে পড়ে সেই মুহূর্তে এটা ভেঙে হাজার হাজার টুকরো হয়ে যায়, সুতরাং এখন সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা হল, কখন এ আঘাত এসে পড়বে।

আমার হৃদয় সব সময়ই স্বপ্ন দেখত জার্মান সাম্রাজ্যের। অস্ট্রিয়ার রাজতন্ত্রের সঙ্গে কখনো সঙ্গ দেয়নি। সুতরাং অস্ট্রিয়ার শাসকবর্গের অবলুপ্তি দেখে আমার মনে হয়েছিল জার্মান জাতির স্বাধীতার প্রথম ধাপ উপস্থিত।

এসব কারণগুলোই ও দেশটা ছেড়ে যাবার জন্য আমার হৃদয়ের ইচ্ছেটাকে আরো বলবতী করে তোলে; যেটা আমার যৌবনের প্রারম্ভেই কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল।

আশা করেছিলাম স্থপতি হিসেবে নিশ্চয় একদিন আমি সফল হব এবং আমার দেশের সেবায় তা বড়ভাবে বা ছোটভাবে (যা ভাগ্যের ইচ্ছা) ঢেলে দেব।

সেদেশে যারা কাজ করছিল তাদের মধ্যে আমার দীর্ঘদিন বসবাস করার কারণ হল আন্দোলনটা সেখান থেকেই শুরু হবে, যা আমার হৃদয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতীক্ষা করে এসেছে, বিশেষ করে যে দেশের চৌহদ্দির ভেতরে আমাদের পিতৃভূমিতে আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম সে হল জার্মান সাম্রাজ্য।

অনেকেরই হয়ত জানা নেই যে এ ধরনের ইচ্ছা কত বলবতী হতে পারে, কিন্তু আমার আবেদন দু’দল লোকের প্রতি। প্রথম দল হল এতক্ষণ পর্যন্ত আমি যা বলেছি সেই সুখগুলো যারা স্বীকার করতে নারাজ। দ্বিতীয় দল হল, যারা একবার এ সুখের স্পর্শ পেয়েছে, কিন্তু ভাগ্য নির্মম হয়ে তা কেড়ে নিয়েছে। আমি তাদের উদ্দেশ্যেই বলছি যারা তাদের মাতৃভূমিকে হারিয়েছে এবং এখনো যারা উত্তরাধিকার সূত্রে পৈতৃক সম্পত্তিটুকু বজায় রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। তাদের মাতৃভাষা, যার ওপরে অকথ্য নির্যাতন চলছে,—তাদের জন্মভূমির প্রতি ভালবাসা এবং বিশ্বস্ত কারণে। তারা বুকের ভেতরে প্রবল ইচ্ছা নিয়ে অপেক্ষা করছে, কখন পিতৃভূমির উষ্ণ ক্রোড়ে ফিরে যেতে পারবে। তাদের উদ্দেশ্যে আমার এ বক্তব্য, এবং আমি জানি তারা আমার বক্তব্যকে সম্যভাবে অনুধাবন করতে পারবে।

যে তার পিতৃভূমি থেকে বিতাড়িত—সে-ই উপলব্ধি করতে পারবে কী গভীর সেই স্বদেশের প্রতি আকুলতা যা তাকে নির্বাসিত ভাবতে বাধ্য করেছে। এটা হল একটা চিরস্থায়ী মনস্তাপ যার কোন প্রকার সান্ত্বনা নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না পিতৃঘরের দরজা খোলা যায়। একমাত্র তখনই শিরা উপশিরায় প্রবাহিত চঞ্চল রক্ত শান্তি পেতে পারে তাদের নিজভূমিতে আশ্রয় পেয়ে।

ভিয়েনা আমার পক্ষে কঠিন বিদ্যালয় ছিল; কিন্তু এটাই আমাকে জীবনে সুগভীর শিক্ষাও দিয়েছিল। আমাকে তখন বড়জোর বালক বলা চলে যখন আমি সে শহরে আসি, এবং যখন আমি সে শহর ছাড়ি তখন আমি মনের দুঃখে ভারাক্রান্ত বিষন্ন যুবক। ভিয়েনাতেই আমার আন্তর্জাতিকতাবাদের দীক্ষা এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিশ্লেষণের শুরুও হয় এ শহরেই। সেই দিনকার সেই আন্তর্জাতিকতাবাদ চিন্তাধারা, রাজনৈতিক মতবাদ আমাকে আর কখনই ছেড়ে যায়নি। যদিও তারা ভবিষ্যতে ভিন্নমুখী হয়ে বিভিন্ন পথে ছুটেছে। বর্তমানে আমি আমার সেই ফেলে আসা শিক্ষানবীশ দিনগুলোর সঠিক মূল্যায়ণ করতে পারি।

এ কারণেই আমি সেদিনগুলোর বর্ণনা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দিয়েছি। এ ভিয়েনাই আমাকে রূঢ় বাস্তব শিক্ষা ও সত্যের সন্ধান দেয়, যা ভবিষ্যতে আমার রাজনৈতিক আদর্শের পটভূমি হিসেবে কাজ করে পরবর্তী পাঁচ বছর ধরে জনতার সমর্থন লাভ করে। আমার ইহুদী, সামাজিক গণতন্ত্র বিশেষ করে মার্কসবাদ সম্পর্কে কোন ধ্যান ধারণাই ছিল না। এবং সেদিন তাই অত পরিশ্রম এবং পড়াশোনায় ভাগ্যের লাঞ্ছনায় তৈরি করেছিলাম নিজেকে।

পিতৃভূমির দুর্ভাগ্যের জন্য যে হাজার হাজার লোক মনে মনে নিজেদের তোলপাড় করে চলেছে, তাদের পক্ষেও একজন যে প্রবল বাঁচার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজের ভাগ্যকে তৈরি করেছে, তার মত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা সম্ভব নয়।

——–
*হেরোডটি তার লেখায় গ্রীক বিশ্বাসঘাতক এ্যফিলটেসের বর্ণনা করেছেন। থার্মোপাইলের যুদ্ধে প্রায় পরাজিত পারস্যরাজ জেরেসের কাছে গিয়ে ফিলটেস্ প্রস্তাব করে যে তাকে যদি মূল্য দেওয়া হয়, তবে সে গ্রীক দেশে ঢোকার গুপ্তপথ দেখিয়ে দেবে। প্রাপ্তিযোগের পর পাহাড়ের গিরিপথ দিয়ে একদল পারস্যদেশীয় সৈন্যকে জেনারেল হাইডেরলেসের অধীনে পথ দেখিয়ে দেয়। কিন্তু গ্রীক সৈন্যরা, স্পার্টার রাজা লিওনিডাসের নেতৃত্বে দু’মুখী পারস্য অভিযানের মোকাবিলা সেই সংকীর্ণ গিরিপথে করে। সেই সংগ্রামে লিওনিডাসের। মৃত্যু হয়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত