উৎসর্গ
১৯২৩ সালের ৯ নভেম্বর সাড়ে বারটার সময় ফেল্ড হেরেনহালের সামনে গণ-আদালতে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত এবং মিউকিনের সামরিক বাহিনী কর্তৃক তৎকালীন জনগণের উদ্ধারকার্যে ব্রতী হওয়ার দোষে যারা নিহত হয়েছেন :
অ্যালফার্থ ফেলিক্স, ব্যবসায়ী, জন্ম ৫ জুলাই, ১৯০১ সালে।
বাউরিড্যাল অ্যানড্রেস, টুপী প্রস্তুতকারক, জন্ম ৪ মে, ১৮৮৯ সাল।
ক্যাসেলা থিয়োডর, ব্যাঙ্ক কর্মচারি, জন্ম ৮ আগস্ট, ১৯৯০ সাল।
অ্যারলিক উইলহেম, ব্যাঙ্ক কর্মচারি, জন্ম ১৯ আগস্ট, ১৮৯৪ সাল।
ফাউষ্ট মার্টিন, ব্যাঙ্ক কর্মচারি, জন্ম ২৭ জানুয়ারি, ১৯০১ সাল।
হেথেনবার্গার আন্তু, তালা প্রস্তুতকারক, জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯০২ সাল।
কর্ণে অস্কার, ব্যবসায়ী, জন ৪ জানুয়ারি, ১৮৭৫ সালে।
কুন কাইল, মুখ্য পরিচালক, জন্ম ২৬ জুলাই, ১৮৯৭ সাল।
লাফোর্স কার্ল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র, জন্ম ২৮ অক্টোবর, ১৯০৪ সাল।
নই বাউয়রে ফুর্ট, পরিচালক, জন্ম ১৬ আগস্ট, ১৯০৪ সাল।
ফোর্ডটেন থিয়োডর ভন্ ডার, উচ্চ প্রাদেশিক কোর্টের কাউন্সিলার, জন্ম ১৪ মে, ১৮৮৪ সাল।
রিকমাস জো, অবসরপ্রাপ্ত অশ্ববাহিনীর অধিনায়ক, জন্ম ৭ মে, ১৮৮৪ সাল।
সাউনার রিতার মাস্ক আরভিন ভন্, ডক্টর ইঞ্জিনিয়ার, জন্ম ৯ জানুয়ারি, ১৮৮৪ সাল।
স্ট্রানস্কি লরেন্স রিটার্ন ভন, ইঞ্জিনিয়ার, জন্ম ১৪ মার্চ, ১৮৯৯ সাল।
উলফ উইলহেলম্ ব্যবসায়ী, জন্ম ১৯ অক্টোবর, ১৮৯৮ সাল।
তথাকথিত জাতীয়তাবাদী অফিসারবৃন্দ এ মৃত নায়কদের এক জায়গায় কবর দেওয়ার সুযোগটুকু পর্যন্ত দিতে অস্বীকার করে। সে কারণে আমি আমার লেখা এ বইটির প্রথম অংশ তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলাম; যাতে সেসব শহীদ স্মৃতির চিরায়ত শক্তি আমাদের সংগ্রামী সৈনিকদের আলো দেখাতে পারে।
অ্যাডলফ হিটলার
দি ফোর্টেস্,
লেখ্ নদীর তীর, ল্যান্ডস্বার্গ
১৬ অক্টোবর, ১৯২৪ সাল।
০১. ধূসর অতীত
মা বাবার সঙ্গে
ইন নদীর তীরে ব্রুনাই গ্রামে জন্মেছিলাম বলে আজ নিজেকে ভাগ্যবান বলে মনে করি। ব্রুনাই ছোট গঞ্জশহর; সাদামাঠা হলেও জায়গা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক দুটো প্রদেশের মাঝে। এ দুই প্রদেশের একত্রীকরণের জন্য যে কোন উপায়েই আমাদের সারাটা জীবন উৎসর্গ করা উচিত।
জার্মান এবং অস্ট্রিয়াকে একই পতাকাতলে নিয়ে আসতে হবে। হ্যাঁ, তা ছলে-বলে অথবা যে কোন রকমের কৌশল প্রয়োগ করে। যদিও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিচার করলে অস্ট্রিয়াকে জার্মানির পতাকাতলে না আনাটাই উচিত। হয়তো বা চরম বোকামি। কারণ সেদিক থেকে উভয়েই চরম অসুবিধায় পড়বে। তবু একত্রিকরণ করা চাই, যে কোন মূল্যে; এবং উপায়ে। দুদেশের লোকের ধমনীতে যখন একই রক্ত প্রবাহিত, তখন তাদের সবাইকে এনে জার্মানির পতাকাতলে দাঁড় করাতে হবে। নিজেদের সন্তানেরা যদি একত্রে পাশাপাশি দাঁড়াতেই না পারে তবে বিদেশী রাষ্ট্র জয়ের চিন্তাটা নিছক বাতুলতা। যখন জার্মানরা নিজেদের রাষ্ট্রের ফসলে নিজেদের উদর পূর্তি করতে পারবে না, তখনই অন্য রাষ্ট্রের দিকে হাত বাড়ানো উচিত। অবশ্য লাঙলটাকে উল্টো করে তখন তরবারী হিসেবে তা ব্যবহার করতে হবে। যুদ্ধের সময় স্বজন হারানোর চোখের জলে উত্তরকালের জার্মানদের জন্য সৃষ্টি করবে দৈনন্দিন বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় রসদ রুটি।
সুতরাং নাউ ছোট্ট গঞ্জ শহর হলেও আমার কাছে তার গুরুত্ব অনেক বেশি। তাছাড়া ওই গঞ্জশহরটার ঐতিহাসিক একটা মূল্য আছে। যখন আমার পিতৃভূমি জার্মানি বিদেশীদের হাতে লাঞ্ছিত, চরম অবমাননায় নিমজ্জিত, তখন সেই দুর্যোগের দিনে জোহানস্ পাম, একজন বই বিক্রেতা দেশপ্রেমিককে এ ব্রুনাউয়ের মাটিতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তার দোষ? সে তার পিতৃভূমিকে ভালবেসেছিল। তবু মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত জোহানস্ পাম তার সঙ্গী সাথীদের নাম বলেনি। ফরাসীদের নিষ্ঠুর অত্যাচার সত্ত্বেও। এর ঠিক আগে এ একই কারণে ফরাসীরা হত্যা করেছে লিও শ্লাগেটারকে।
[১৯৭২ থেকে ১৮২৪ পর্যন্ত জার্মানি ফরাসীদের পদানত ছিল। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে হোয়েনলিভেনের যুদ্ধে অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করে ফরাসীরা ব্যাভেরিয়া প্রদেশের রাজধানী মিউনিক শহর অধিকার করে। ১৮০৫ সালে নেপোলিয়ান ব্যাভেরিয়ার নির্বাচিত প্রতিনিধিকে রাজা করে একটা সর্তে। প্রতিটি যুদ্ধে তিরিশ হাজার সৈন্য দিয়ে ফরাসীদের সাহায্য করতে হবে। ব্যাভেরিয়াকে এভাবে ফরাসীরা সম্পূর্ণ কজা করে ফেলে। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটা বিজ্ঞপ্তি জনসাধারণের মধ্যে প্রচার করা হয়। নাম— চরম অবমাননায় জার্মানি। যারা এ বিজ্ঞপ্তিটা প্রচার করতে সাহায্য করেছিল, নুরেমবার্গের পুস্তক বিক্রেতা জোহানস্ ফিলিপ তার মধ্যে অন্যতম। ব্যাভেরিয়ার পুলিশের এক গুপ্তচর ফরাসীদের খরবটা দেওয়ায় ফরাসীরা পামকে গ্রেপ্তার করে। বীভৎস অত্যাচার করেও জোহানসের কাছ থেকে বিজ্ঞপ্তিটার প্রকাশক এবং অন্যান্য ব্যক্তিদের নাম জানতে না পেরে, লোক দেখানো বিচারের পর নেপোলিয়নের আদেশে ব্রুনাউয়ের মাটিতে গুলি করে তাকে হত্যা করা হয় ২৬ আগস্ট ১৮০৩ সালে। সেই জায়গাতে স্থাপিত জোহানসের স্ট্যাচুটা হিটলারকে খুব ছেলেবেলা থেকেই আকর্ষণ করত।
লিও শ্যাগেটারের ব্যাপারটাও অনেকটা জোহানস্ পামের মত। শ্যাগেটার ধর্মতত্ত্বের ছাত্র হয়েও ১৯১৪ সালে যুদ্ধে যোগদান করে। গোলন্দাজ বাহিনীতে কাজ করে আয়রন ক্রুশ পেয়েছিল। ১৯২৩ সালে ফরাসীরা যখন রুড় অঞ্চল আক্রমণ করে, তাদের প্রতিহত করার জন্য শ্লাগেটার বদ্ধপরিকর হয়। কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে একটা রেল ব্রীজ উড়িয়ে দেয়; যাতে ফরাসীরা রুড় অঞ্চল থেকে নিজের দেশে কয়লা সহজে না নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু একজন জার্মান গুপ্তচর ফরাসীদের কানে পুরো ব্যাপারটা তুলে দেওয়ায় শ্যাগেটারকে ফরাসীরা গ্রেপ্তার করে। অনেক অত্যাচারেও শ্যাগেটার মুখ খোলে না। একটা সঙ্গীর নামও ওর মুখ থেকে বের করতে অক্ষম হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ফরাসীরা। শ্যাগেটার প্রথম থেকেই পুরো দোষটা নিজের ঘাড়ে নিয়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়। অবশ্য পরে ওর সঙ্গীসাথীরা ধরা পড়ে। বিচারে তাদের জেল হয়। ১৯২৩ সালের ২৬ মে শ্লাগেটারকে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে এনে দাঁড় করানো হয়। এ সময়ে সভারি জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েও ব্যাপারটাতে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করে।
শ্যাগেটার রুড় প্রতিরোধের প্রধানতম শহীদ আর ন্যাশানাল সোশ্যালিস্ট মুভমেন্টের অন্যতম নায়ক হিসেবে অল্পদিনের মধ্যেই খ্যাতিলাভ করে। অল্প বয়স থেকেই শ্যাগেটার এর সদস্য ছিল। তার সদস্য নম্বর ছিল ৬১।]
ইন্ নদীর তীরের এ ছোট্ট গঞ্জশহর শহীদদের স্মৃতিতে পবিত্র। গত শতাব্দীর শেষের দিকে, আমার বাবা-মা এখানেই বসবাস করতে আসেন। বাবা পুরো দস্তুর সরকারি কর্মচারী ছিলেন। এবং তার কর্তব্যকর্ম পালনে এতটুকুও শৈথিল্য ছিল না। মা প্রাণপণে আগলে রাখতেন সংসারটাকে। ছেলেমেয়েদের সব সময় স্নেহমমতায় ঘিরে রাখতেন। কিন্তু ব্রুনাইয়ের স্মৃতি আমার মনের আয়নায় তত উজ্জ্বল নয়। কারণ কয়েক বছর পরেই বাবাকে সেই ইন্ নদীর তীরের গঞ্জশহর ছাড়তে হয়। ই উপত্যকার আরো নিচের দিকের শহর পাসুতে নতুন কর্মভার নিয়ে বাবা চলে আসেন। পাসু পুরোপুরি জার্মানির মধ্যে।
তৎকালে অস্ট্রিয়ার সরকারি কর্মচারীদের চাকরিতে ঘনঘন বদলি করা হত। অর্থাৎ যাযাবরের মত আজ এখানে কাল সেখানে। কিছুদিন পরেই বাবাকে বদলী করা হয় পাস থেকে লিনৎসে। এখানেই বাবা সরকারি কর্ম থেকে অবসর নেন। পেনসনের কটা টাকার ওপর ভরসা করে জীবন পার করতে হবে। অর্থাৎ, বৃদ্ধ হলেও পরিশ্রমের হাত থেকে রেহাই নেই।
আমার বাবা ছিলেন খুবই গরীব ঘরের ছেলে। ঠাকুরদার সম্পত্তি বলতে একমাত্র ছোট্ট একটা কুঠির। দারিদ্রতাই বোধহয় বাবাকে জন্ম থেকে চঞ্চল করে তুলেছিল। মাত্র তের বছর বয়সে একটা থলে কাঁধে ঝুলিয়ে তাই বাবা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন ভিয়েনার উদ্দেশ্যে। তিনটে মাত্ৰগালডেন পকেটে সম্বল। সতেরো বছর বয়সে অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে বাবা কারিগর হন। কিন্তু ততদিনে জলমলে শহর ভিয়েনা বাবার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে। ছোটবেলায় যার একমাত্র স্বপ্ন ছিল গ্রামের গীর্জার ফাদার হওয়ার, সেই সব স্বপ্ন ততদিন মুছে গেছে। কারিগর হয়ে জীবনধারণের যে গ্লানি, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বাবা শুরু করেন অবিরাম পরিশ্রম। সরকারি চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা যে করেই হোক অর্জন করতে হবে। তেইশ বছর বয়সে বাবা সেই যোগ্যতা অর্জন করে নিজের গ্রামে ফিরে আসেন। দেহমনের সমস্ত শক্তি দিয়েও বাবা নিজের জীবনের প্রতিজ্ঞা এভাবে পূরণ করেছিলেন।
জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করলেও গ্রামে বাবা তখন তো সম্পূর্ণ অপরিচিত। অতটুকু বয়সে গ্রাম ত্যাগ করে চলে যাওয়াতে গ্রামের কেউই আর বাবাকে স্মরণে রাখেনি। নিজের গ্রামেই বাবা যেন প্রবাসী ছিলেন।
অবশেষে পঁয়ষট্টি বছর বয়সে বাবা চাকরি থেকে অবসর নেন। কিন্তু এখন কি করবেন? জীবনে একটা দিনও তার কুঁড়েমিতে কাটেনি। সত্যি বলতে কি আলস্য শব্দটাই বাবার অভিধানে ছিল না। সুতরাং অনেক চিন্তা ভাবনার পর আপার অস্ট্রিয়ার ছোট বাণিজ্য শহর লামবাখের শহরতলীতে বাবা পুরনো একটা ফার্ম কিনে চাষবাস শুরু করেন। অর্থাৎ এত বছর বিভিন্ন ঘাটে ঘুরে শেষমেষ পিতামহের পেশাকে বেছে নেন।
ঠিক এ সময়েই আমার জীবনের কিছুটা মোড় ঘোরে। লামবাখের উদার প্রান্তর, বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে হেঁটে স্কুলে যাওয়া। কয়েকটা বেপরোয়া ছেলের সঙ্গেও এ সময় বন্ধুত্ব হয়। অবশ্য সেই কারণে মা কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। ছুটি কাটানো সম্পর্কে আমি বরাবরই উদাসীন। অর্থাৎ সংসারের আরো দশটা ছেলের মত নিরুপদ্রবে ছুটি কাটানো আমার ধাতে ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে তাই নিয়ে জোর বিতর্ক লেগেই থাকত, যেটা ভবিষ্যতে আমার বক্তৃতা দেওয়ার অভ্যাসে পরিণত করে। লামবাখে থাকাকালীন আমার আরেকটা অভ্যাস গড়ে ওঠে। নিয়মিত সেখানকার গির্জায় গিয়ে ধর্মীয় সঙ্গীত অথবা আলোচনায় অংশ নিয়ে দেখেছিলাম কী করে মানুষের অনুভূতিশীল মনটাকে অনুভূতির চরমে নিয়ে যেতে হয়। অবশ্যই বাবার নিজের জীবনেও ছোটবেলায় আকাক্ষা ছিল নিজের গ্রামের চার্চের ফাদার হওয়ার। আমার জীবনে আমিও সেটাকেই জীবনের সবচেয়ে কাম্য বলে ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা কিছুতেই তাতে সায় দেননি। অর্থাৎ আমার ছেলেমানুষী কল্পনাকে বাবা কোনরকম আমল দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। আমার জীবনের সংঘাত বোধহয় এ অধ্যায়েই শুরু হয়।
বাবার বইপত্রগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে কয়েকটা বইয়ের বিজ্ঞাপন আমার নজরে আসে। সেই বইগুলো সবই মিলিটারী বিষয় সংক্রান্ত। বিশেষ করে একটা বই তো আমাকে ভীষণভাবে আক্রমণ করে। বইটি জনপ্রিয় ফ্রাংকো-জার্মান যুদ্ধের ইতিহাস ১৮৭০-৭১। দুটো পর্বে লেখা বইটি। চিত্রিত। যুদ্ধের তথ্যপঞ্জীতে ঠাসা। এ বইটি পড়তে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম। আর এ বইটি পড়েই কতগুলো প্রশ্ন আমার মনে জেগে ওঠে। মনের ভেতরে প্রচণ্ড আলোড়ন এনে দেয়। যুদ্ধ সংক্রান্ত যা কিছু পেতাম, সেই বয়স থেকেই তা গোগ্রাসে গিলতে শুরু করি। কিন্তু যুদ্ধ বিষয়ক এত বই পড়া সত্ত্বেও ফ্রাংকো–জার্মান বইটিই আমাকে বেশি ভাবিয়ে তোলে। তার মানে যে সব জার্মান সেই ১৮৭০-৭১ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল আর যারা অংশ নেয়নি, উভয়পক্ষই জার্মান হওয়া সত্ত্বেও কি তাদের মধ্যে কিছু ফারাক ছিল? আর যদি না থাকে তবে কেন তারা একই পতাকার নিচে এসে জমায়েত হল না। অস্ট্রিয়া-ই বা কেন সেই যুদ্ধে অংশ নিল না। আমার বাবাও সে যুদ্ধে যায়নি। তা হলে কি আমরা, আর অন্যান্য জার্মান যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল তারা এক নয়? এসব সূচীমুখ জিজ্ঞাসাগুলো আমার ছোট মস্তিষ্কটাকে চঞ্চল করে তুলল। অনেককে জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম যে সব জার্মান সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়নি, তারা বিসমার্কের সাম্রাজ্যের মধ্যে বাস করত না। অবশ্য তবু বিষয়টা ঠিক আমার স্পষ্ট হল না।
আমার ধাত দেখে বিশেষ করে মর্জি বুঝে বাবা ঠিক করলেন পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করে আমার জীবনে কিছু হবে না। আর সেই কারণেই হয়ত বা জিমনাসিয়াম স্কুলে আমার বুদ্ধিবৃত্তির সঠিক বিকাশ হচ্ছে না। বরং পেশাগত স্কুলই আমার পক্ষে সঠিক। বিশেষ করে ড্রইংয়ের প্রতি আমার ছোটবেলা থেকে ঝোক বাবাকে তার মনস্থির করতে সাহায্য করে। অস্ট্রিয়ান জিমনাসিয়াম স্কুলে ড্রইংটাকে বিশেষভাবে অবহেলা করা হয়। উপরন্তু নিজের জীবনের অভিজ্ঞতায় বাবা দেখেছিলেন পরবর্তী জীবনে এ পুঁথিগত বিদ্যা কোন কাজেই আসে না। সুতরাং তার কাছে স্বভাবতই এ বিদ্যার কোন দামও ছিল না। অবচেতন মনে বাবা হয়তো বা আমাকে সরকারি কর্মচারী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন বলা বোধহয় ভুল হবে, বাবা একরকম মনস্থির করেই ফেলেছিলেন যে আমাকে যে করে হোক সরকারি কর্মচারী করবেন। আসলে যে দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিয়ে তিনি নিজেকে সরকারি চাকরির যোগ্য করে তুলেছিলেন, সেটাই বাবাকে আরও বেশি প্রত্যয় এনে দিয়েছিল যে ছেলে নিশ্চয়ই তার পথে চলবে। বরং সরকারি চাকরিতে তার থেকেও একধাপ ওপরে উঠবে।
কিন্তু বাবা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে তার প্রস্তাব আমি অগ্রাহ্য করব। আসলে বাবা যেটাকে জীবনের সবকিছু প্রাপ্তি বলে ধরে নিয়েছিলেন, আমার কাছে সেটা কিছু নাও তো হতে পারে। বাবার চিন্তাধারা সহজ সরল এবং স্বচ্ছ। আসলে বেঁচে থাকার জন্য যে নিদারুণ সগ্রাম বাবাকে করতে হয়েছে, সেটাই তাকে ডিটেটর করে তুলেছিল। সুতরাং তার মতামতের কাছে জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এ বয়সের ছেলের মতামতের কতটুকুই বা মূল্য থাকতে পারে। বিশেষ করে আগামী ভবিষ্যতের পথ বেছে নেওয়ার ব্যাপারে।
কিন্তু তবু তিনি পারলেন না। আমারও তখন জেদ চেপে গেছে। এগারো বছর বয়সে জীবনে সেই প্রথম বাবার মতামতকে অগ্রাহ্য করলাম। ভয় অথবা স্নেহ কিছুই আমাকে আমার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারে না। বাবার তুলে ধরা রঙিন ছবি আকর্ষণ করা দূরে থাক, আমাকে আরও বেশি বিদ্রোহী করে তোলে। সারাজীবন টুলে বসে দরখাস্ত সাজিয়ে আলমারীতে তুলে রাখা আর যার দ্বারা হোক আমার দ্বারা কিছুতেই সম্ভব নয়।
সহজেই অনুমেয় চলতি পথে ভাল ছেলে বলতে যা বোঝায় আমি তা ছিলাম না। সুতরাং কী ধরনের চিন্তার মেঘ আমার মনের আকাশে আনাগোনা করতে পারে! স্কুলের দেওয়া পড়াশোনা অতি অল্প সময়ের মধ্যে শেষ করে আমার হাতে প্রচুর সময় থাকত। যেগুলো আমি চার দেওয়ালে বন্দী না থেকে উদার প্রান্তরের খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়িয়ে বেহিসেবী খরচা করতাম। আজ যখন রাজনৈতিক বিরুদ্ধবাদীর দল আমার ব্যক্তিগত জীবনে উকি-ঝুঁকি দিয়ে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে যে আমার ছেলেবেলা কত রকমের চালাকির মধ্যে দিয়ে কেটেছে, আমার তখন হাসি পায়। সত্যি বলতে কি আমার ছোটবেলার সুখস্মৃতি আজও আমাকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা দেয়। বর্তমানের জটিল জগত থেকে সেদিনের কথা ভেবে মুহূর্তের জন্য হলেও যেন মুক্তি পাই।
পেশাগত স্কুলে ভর্তি হয়েও আমার দিনগুলোর পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু আরেক ধরনের দ্বন্দ্ব এসে মনটাকে জুড়ে বসে।
যতদিন বাবা আমাকে সরকারি কর্মচারী করে গড়ে তুলতে চেয়েছেন, ততদিন পর্যন্ত মনের দিক থেকে দ্বন্দ্বটা সোজা ছিল। অন্তত আমার দিক থেকে সরকারি চাকরি করব না–এ প্রতিজ্ঞাটাই এদিক থেকে মনের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু যখন স্থির করলাম যে আমি কী করতে চাই, তখনই চরম মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগতে শুরু করি। বিশেষ করে বাবার কাছে তা উপস্থিত করতে। তখন আমার বয়স বারো। কি করে বলতে পারব না, তবে সেই বয়সেই মনস্থির করে ফেলেছি যে আমাকে শিল্পী হতেই হবে। হতে পারে ড্রইংয়ে আমার হাত পাকা ছিল বলেই ভেবেছিলাম শিল্পী হওয়াই আমার পক্ষে উপযুক্ত কাজ। কিন্তু বাবাকে বলি কি করে? যাহোক মনের দিক থেকে প্রস্তুত হয়ে নিয়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম সব। আমি শিল্পী হতে চাই।
—তুমি শিল্পী হতে চাও? মানে? বাবা বিস্ময়ে বিমূঢ়।
বাবার তখন পর্যন্ত দৃঢ় সন্দেহ যে সত্যি আমি প্রকৃতিস্থ কিনা। বাবা তখনো ভাবছেন— আমার কথা ঠিক বুঝতে পারেননি অথবা ভুল শুনছেন। কিন্তু আমি যখন পুরো ব্যাপারটা বিস্তারিত খুলে বললাম, বাবা প্রথমে গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর তার চরিত্র অনুসারে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করলেন। বাবার সোজাসুজি মতামত, এ হতে পারে না। হওয়া সম্ভব নয়।
—না, আমি বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না।
স্বাভাবিকভাবে পিতার চরিত্রের কিছুটা যেমন ছেলের চরিত্রেও বর্তায়, তাই তার চারিত্রিক দৃঢ়তা জন্ম থেকে আমিও কিছুটা পেয়েছিলাম। আমিও প্রত্যয়ের সঙ্গে বাবার কথার প্রতিবাদ করি, আমাকে যেমন করে থোক শিল্পী হতেই হবে।
সুতরাং পরিস্থিতিটা বেশ ঘোরালো এবং জটিল হয়ে ওঠে। বৃদ্ধ দ্রলোক আমার ওপরে প্রচণ্ড রেগে গেলেও আমি বাবাকে ভালবাসতাম। বাবা আমাকে শিল্পী হতে যত বাধা দিতে লাগলেন, আমিও মনস্থির করলাম যে এছাড়া অন্য কোনরকম পড়াশোনা করব না। শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা রীতিমত টানাপোড়ানের হয়ে ওঠে। আমি নীরবে আমার পথ বেছে নিয়ে ঠিক করি যে পেশাগত স্কুলের পড়াশোনায় একেবারে মন দেব না। তাহলেই বাবাকে বাধ্য হয়ে আমার মতে মত দিতে হবে।
অবশ্য জানি না অংক ঠিক ছিল কিনা। কিন্তু আমার স্কুলের অমনোযোগিতা দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আসলে স্কুলে যে বিষয়ে আমার আকর্ষণ ছিল, অথবা ভাবতাম ভবিষ্যতে শিল্পী হতে গেলে কাজে লাগবে সেটাতেই শুধু মন দিতাম। আর বাকিগুলো স্রেফ বাদ। সুতরাং স্কুলের ফলাফলও সেই ধরনের হল। একটা বিষয়ে হয়ত বা খুব ভাল নম্বর পেলাম, আরেকটাতে আবার সাধারণ মানের চেয়েও নিচে। বিশেষ করে ভুগোল আর ইতিহাসে আকর্ষণ আমার বরাবরের।
এত বছর পরেও পেছনে ফিরে তাকালে দুটো জিনিস বুঝতে পারি। প্রথমত সেই বয়সেই আমি প্রচণ্ড রকমের জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠি; দ্বিতীয়ত তখনই ইতিহাসের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে সক্ষম হই।
পুরনো অস্ট্রিয়ার অধিবাসীরা তখন মিশ্রিত জাত। বিশেষ করে ফ্রাংকো-জার্মান যুদ্ধের বিজয়ী জার্মানরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ না-কারী জার্মানদের হেয় নজরে দেখত। ভাবত যুদ্ধ করার উপযুক্ত ওরা নয়। আর সেই কারণেই সীমান্তের অপর পারের জার্মানদের সঙ্গে জার্মানির অব্যন্তরীণ জার্মানরা কোনরকম যোগাযোগ রাখত না।
জার্মান রাষ্ট্রের জার্মানরা একবার ভেবেও দেখেনি যে অস্ট্রিয়ার জার্মানরা যদি নিজেদের সত্যিকারের জার্মান বলে না ভাবত তবে কখনই বাহান্ন মিলিয়ান জার্মান ‘আমরা বলতে পারতাম না। ব্যাপারটা এতাই স্পষ্ট যে অনেক জার্মান নাগরিক জার্মান রাষ্ট্রের ভেতরে থেকেও অস্ট্রিয়াকে জার্মানির একটা অংশ বলে ভাবত। যাহোক, পূর্ব সীমান্ত অর্থাৎ জার্মান অস্ট্রিয়ার দশ মিলিয়ান অধিবাসী নিজেদের জার্মান বলেই মনে প্রাণে জানত। জার্মানির অভ্যন্তরের খুব অল্প জার্মানই জানত কত কষ্টে এ দশ মিলিয়ান জার্মান তাদের নিজস্ব জার্মান ভাষা, সংস্কৃতি, স্কুল ইত্যাদিকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
আজকে যখন জার্মান জাতির একটা বিরাট অংশ বিদেশী শাসকের পদানত হয়ে মাতৃভাষার অধিকারের জন্য মরণপণ যুদ্ধ করে চলেছে, শুধু তখনই জার্মানির ভেতরকার জার্মানরা উপলব্ধি করেছে যে সত্যিকারের সংস্কৃতির জন্য, নিজেদের ভাষা রক্ষার জন্য, অস্ট্রিয়ার জার্মানরা কতখানি বদ্ধপরিকর। আর বর্তমানে হয়ত তারা এ-ও বুঝতে পারছে বিদেশী পদানত হয়ে নিজেদের সংস্কৃতি এবং মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা কতখানি কষ্টকর।
সব জায়গায় এসব ব্যাপারে যা হয়ে থাকে অস্ট্রিয়াতে তার ব্যতিক্রম হবে কেন। এ মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে তিনটি দল, পুরোপুরি সক্রিয়, একদল যারা মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে, এগিয়ে নিয়ে যেতে, জীবনপণ করেছে; আরেকদল যারা সুবিধেবাদী; আর তৃতীয় দল হল বিশ্বাসঘাতক জুডাস। বিশেষ করে স্কুলগুলোকে কেন্দ্র করেই ব্যাপারটা চরমে ওঠে। আসলে আজকের চারাগাছগুলোই তো সব ভবিষ্যতের মহীরূহ। তাদের অপরিণত মস্তিষ্কে যেন তেন প্রকারে জিনিসটা গেঁথে দিতে হবে। তাহলেই কেল্লা ফতে। সুতরাং স্কুলে স্কুলে জার্মান শিশুদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেওয়া শুরু হয়ে যায়, জার্মান ছেলেরা ভুলে যেও না যে তোমাদের ধমনীতে জার্মান রক্ত প্রবাহিত। জার্মান মেয়েরা ভুলে যেন না যায় ভবিষ্যতে জার্মান সন্তান তোমরা গর্ভে ধারণ করবে, ইত্যাদি।
সমস্ত ব্যাপারটাতে আশ্চর্যজনক ফল পাওয়া যায়। জার্মান ছেলেরা অজার্মান গান গাইতে আপত্তি করে, নিষিদ্ধ জার্মান রাজের ছাপ মারা পোশাক পরতে শুরু করে দেয়। অজার্মান শিক্ষকদের কাছে পড়া পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায়। এমন কি জল-খাবারের পয়সা বাঁচিয়ে পর্যন্ত বড়দের হাতে তুলে দেয় যাতে এ সংগ্রামকে আরো বেশি জোরদার করা যায়, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। এর জন্য যে কোন রকম দৈহিক শাস্তি ওরা হাসিমুখেই বরণ করে নিত। এভাবে সেই যুদ্ধে অতি অল্প বয়সে আমি জড়িয়ে পড়লাম। সাউথ ফ্রন্টিয়ার লীগ অথবা স্কুল লীগের জামায়েতে আমরা গমের শিষ ছাপ মারা কালো-লাল সোনালী রঙের জামা পরে দলের প্রতি আমাদের বিশ্বস্ততা দেখাতাম। আমরা পরস্পরকে অভ্যর্থনা করতাম হাইল’ শব্দটা উচ্চারণ করে। অস্ট্রিয়ার জাতীয় সঙ্গীতের বদলে এসব জমায়েতে আমরা জার্মান জাতীয় সঙ্গীত, ডয়েচল্যান্ড ইবার আলেয় অর্থাৎ সবার ওপরে জার্মানি— গাইতাম। এ সবের জন্য কোনরকম শাস্তি বা জরিমানা আমরা গায়েই মাখতাম না। যে সময়ে একদল শিশু জাতীয়তাবাদী মন্ত্রে রীতিমত দীক্ষিত ও উৎসর্গীকৃত তখন অস্ট্রিয়ার লোকেরা নিজেদের ভাষা ছাড়া জাতীয়তাবোধ বলতে আর কিছুই বুঝত না।
এসব ঘটনাগুলো আমাকে অত্যন্ত দ্রুতবেগে জাতীয়তাবাদীর দিকে টেনে নিয়ে যায়। তখন আমার বয়স পনেরো বছর। কিন্তু এ ধরনের কাজে আমার সেই সময়েই রীতিমত উৎসাহ। জীবনের স্বাদ পেয়ে গেছি। যারা সেই সময়ের পৃথিবীর খবর জানে না অথবা হাববুর্গ শাসক সম্প্রদায় সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের পক্ষে ব্যাপারটা বোঝা সম্ভব নয়।
ইতিহাসের মধ্যে বিশ্ব ইতিহাসটাই বিশেষভাবে অস্ট্রিয়ার স্কুলে পড়ানো হত। অস্ট্রিয়ার নিজস্ব ইতিহাস খুবই সামান্য। সত্যি বলতে কি অস্ট্রিয়ার ভাগ্য জার্মানির উন্নতি বা অস্তিত্বের সঙ্গে একসুত্রে বাঁধা ছিল। সুতরাং অস্ট্রিয়ার নিজস্ব ইতিহাস বলতে প্রায় কিছুই ছিল না।
আগেকার সমাজের (যখন দ্বিতীয় ফ্রান্সিস পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের জার্মান অধীশ্বর রূপে নেপোলিয়ানের আদেশে নির্বাচিত হন, তখন তার মুকুট এবং রাজদণ্ড রাজার প্রতিভু স্বরূপ ভিয়েনায় রক্ষিত হয়। এ জিনিসগুলো জাতীয়তাবাদী জার্মানদের উদ্বুদ্ধ করতে ঠিক ম্যাজিকের মত কাজ করেছিল।
১৯১৮ সালে হাববুর্গ সাম্রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে অস্ট্রিয়ার জার্মানরা অনেক চেষ্টা করে ফাদারল্যান্ড অর্থাৎ পিতৃভূমি জার্মানির সঙ্গে মিলিত হওয়ার। সেই লক্ষ লক্ষ অস্ট্রিয়ার জার্মানদের নিজের পিতৃভূমিতে ফেরার জন্য যে আকুল ক্রন্দন উঠেছিল, একমাত্র ইতিহাসের বুকে কান পেতে শোনা ছাড়া তার আর কোন উপায় নেই। কেউ বুঝতেও পারবে না সেইসময় অস্ট্রিয়ার প্রতিটি জার্মান কী চরম হতাশার মধ্যে দিয়ে নিজেদের দিনগুলো পাড়ি দিয়েছে। সে গভীর ক্ষতের দাগ এখনো পর্যন্ত অস্ট্রিয়ার জার্মানদের মন থেকে মুছে যায়নি।
স্কুলে বিশ্ব ইতিহাস যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হত, তা মোটেই উপযুক্ত নয়। মুষ্টিমেয় শিক্ষকই উপলব্ধি করতে পারত, শুকনো কটা দিন, তারিখ আর পঞ্জীর মধ্যে আবদ্ধ যে ইতিহাস, সেটা জাতির ইতিহাস নয়। কবে কোথায় যুদ্ধ হয়েছে, কোন্ মার্শাল কত তারিখে মারা গেছে, অথবা কোন দিনে কার মাথার কোথার রাজমুকুট চড়েছে, এসব খবরাখবর একটা জাতির ইতিহাসে কতটুকু মূল্য?
ইতিহাসের অর্থ হল কোন বিশেষ ঘটনা কেন এবং কিভাবে একটা জাতির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ছিল সেইটাকে জানা। আর ইতিহাস পড়া উচিত— বিশেষ দরকারী জিনিসটাকে মনে রাখা, অদরকারী বিষয়টা ভুলে যাওয়া।
সম্ভবত এ সময়েই আমার ভবিষ্যৎ আমি স্থির করে ফেলি। তার জন্য যার কাছে আমি সম্পূর্ণ ঋণী তিনি হলেন আমার স্কুলের শিক্ষক, ডক্টর লিওপোন্ড পোয়েটি। লিৎজ স্কুলের। যে গুণগুলোর সমন্বয় ঘটলে সত্যিকারের ইতিহাসের শিক্ষক হওয়া যায়, তার মধ্যে সেইগুলোর যেন মণিকাঞ্চন যোগ ঘটেছিল। বয়সে বৃদ্ধ, দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এত দয়ালু হৃদয়ের মানুষ। চমৎকার বলার ক্ষমতা। কথার মধ্য দিয়ে যেন হাজার বছর পেছনে আমাদের নিয়ে যেতেন। নিজের ভেতরকার উৎসাহটাকে ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত করার অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। পড়াশোনার সময়ে বর্তমানকে ভুলিয়ে দিয়ে আমাদের নিয়ে যেতেন সুদূর এক ধূসর অতীতে। মন্ত্রের মত। সেই পুরনো দিনের ইতিহাসের ঘটনার মিছিল ওর বলার ভঙ্গিতে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতো। তারা যেন কথা বলত। আমাদের সঙ্গে নিয়েই তিনি সেই ইতিহাসের রাজ্যে বিচরণ করতেন। ইতিহাসের উপমাও ইতিহাস থেকেই দিতেন। বর্তমান কোন ঘটনার সঙ্গে নয়। আমরা এমন তন্ময় হয়ে যেতাম যে অনেকের পক্ষেই অশ্রু সংবরণ করা সম্ভব হত না। সত্যি বলতে কি ওঁর জন্যই বোধহয় ইতিহাস আমাকে এমন প্রচন্ডভাবে আকর্ষণ করেছিল। ইতিহাসই আমাকে সেই বয়সে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। কেন করবে না? সেই বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম হাবস্বুর্গের অতীত। নিজেদের স্বার্থের জন্য কিভাবে পুরো জার্মানিকে ব্যবহার করা হয়েছে। হাসবুর্গের শাসক সম্প্রদায় শুধু জার্মানদের দিয়ে নিজেদের স্বার্থই হাসিল করে নিয়েছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি।
হাবলুর্গের অতীতের ইতিহাস আর আজকের মধ্যে এতটুকুও ফারাক নেই। সেই একই ধারায় শোষণের পুনরাবৃত্তি ডক্টর লিওপোল্ড পোয়েটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। উত্তর ও দক্ষিণ থেকে বিদেশী রক্তের জীবগুলো, জার্মানদের নিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। এমন কি ভিয়েনা পর্যন্ত অজার্মান শহর হয়ে উঠেছে। শাসক সম্প্রদায়ের প্রতিটি সুযোগ চেকদের প্রতি। বিশেষ করে এগুলোই অস্ট্রিয়ার অভ্যন্তরে চরম জার্মান জাগরণ টেনে আনে। আর্চ ডিউক ফ্রানজ ফার্দিনান্দ নিজের তৈরি গুলিতে নিজে প্রাণ হারায়। কারণ অস্ট্রিয়াকে পুরোপুরি শ্লাভদের সাম্রাজ্য করে গড়ে তুলতে তার চেষ্টার অন্ত ছিল না।
অস্ট্রিয়ার জার্মানদের এর জন্য প্রচুর রক্ত এবং অর্থ ক্ষয় করতে হয়েছিল এবং তা তারা করেছিল হাসি মুখেই। কিন্তু যখন দেখত হাসবুর্গ হিপোক্র্যাসিতে জার্মানির জার্মানরা ধরে বসে আছে যে অস্ট্রিয়া জার্মানিরই একটা প্রদেশমাত্র, তখন অস্ট্রিয়ার জার্মানরা নিরাশ না হয়ে পারেনি। অবশ্য এ নিরাশা তাদের প্রতিজ্ঞা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়নি। বরং হাবলুর্গ নামক সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্রোহী করে তুলেছিল।
কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, তখনকার জার্মান সাম্রাজ্যের শাসকেরা যেন চোখ বন্ধ করে বসেছিল। পূত গন্ধময় মৃতের পাশে দাঁড়িয়ে সেটাকেই জীবন্তরূপে কল্পনা করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিল। আর দুয়ের এ বন্ধুত্বের মাঝে বিশ্বযুদ্ধের বীজাণু উপ্ত ছিল। যার পরিণতি সত্যিকারের বিশ্বযুদ্ধে।
এবার সমস্যাটার বিস্তারে আসা যাক। ছোটবেলা থেকে যে ধারণা আমার মনের ভেতরে বদ্ধমূল হয়েছিল, দিনে দিনে সেটা আরো দৃঢ়ভাবে গাঁথতে থাকে। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি কয়েকটা ধারণায় দৃঢ় হই। প্রথমত জার্মান সাম্রাজ্যের বুনিয়াদ শক্ত করতে হলে অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের ধ্বংস আবশ্যক। নইলে জার্মান সাম্রাজ্যের ভিত্ ভেঙে পড়বে। দ্বিতীয়ত জাতীয়তাবাদী মানে রাজবংশীয়দের প্রতি আনুগত্য নয়। শেষে হাসবুর্গ প্রাসাদ জার্মানির ভাগ্যকাশে শনিগ্রহ বিশেষ। ইতিহাস পড়েই এ ধারণাগুলো আমার গড়ে উঠেছিল। স্কুল জীবনে ইতিহাসের প্রতি আমার যে আকর্ষণ জন্মেছিল, সেটা কোনদিনই আমাকে ছাড়েনি। আর বিশ্ব ইতিহাস হল ঘটনাগুলোর তাৎপর্য বোঝার পক্ষে খনি বিশেষ। যার জন্য রাজনীতি আমাকে আর আলাদা করে পড়তে বা লিখতে হয়নি। বিশ্ব ইতিহাসই আমার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা এনে দিয়েছে। চলতি ভাষায় যাকে বলে অকাল পক্কো বিদ্রোহী। সাহিত্য এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে আমি ঠিক তাই ছিলাম। আপার অস্ট্রিয়ার শহরে ছোট একটা থিয়েটার হল ছিল। বারো বছর বয়সে প্রথম আমি থিয়েটার দেখতে যাই। সেটা ছিল উইলিয়াম টেল। জীবনে প্রথম দেখা থিয়েটার। কয়েক মাস পরেই দেখি আরেকটা অপেরা। লোহেনগ্রীন। জীবনে এদিকটাকে তখনো পর্যন্ত আস্বাদন করিনি। অপেরাটা দেখে এত আনন্দ পেয়েছিলাম যে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। পরবর্তী জীবনে যে শিল্পের বীজ আমার ভেতরে পরিণতি লাভ করেছিল, সেই বীজ সংগ্রহ করেছিলাম এ ছোট শহরের থিয়েটারের থেকে।
এগুলোই যেন আমাকে আমার ভবিতব্যের দিকে ঠেলে দেয় এবং বাবা তার ছেলের জন্য যে রঙিন ভবিষ্যত নিজের মনে এঁকে রেখে ছিলেন, তা থেকে আমাকে অনেক দূরে সরিয়ে দেয়। ক্রমে ক্রমে আমি যেন উপলব্ধি করতে পারি যে সঠিক পথেই আমি চলেছি। ততদিনে অর্কিটেকচার অর্থাৎ স্থাপত্য বিদ্যা বিষয়টাকে ভালবাসতে শুরু করেছি। শিল্পকর্মটা আরো বিস্তৃত পরিধি নিয়ে আমার কাছে ধরা দিয়েছে। সুতরাং অন্য কিছু হওয়ার বাসনা তখন আর আমার মনের মধ্যে নেই।
আমার যখন তেরো বছর বয়স, বাবা হঠাৎ মারা গেলেন। যদিও সেই বয়সে তার স্বাস্থ্য রীতিমত সুগঠিত, তবু রক্তের একটু উচ্চচাপ, তাতেই সব শেষ। আমরা পিতৃহারা হলেও আমার দিক থেকে একটা লাভ হল। বাবা আমাকে ছকে আঁকা ভবিষ্যতটাকে আর বেছে নিতে পীড়াপীড়ি করবেন না। তবু বাবার দৃঢ় ইচ্ছার একটা বীজ আমাদের অবচেতন মনে উপ্ত করে গিয়েছিলো।
মার মনে হল ছেলের ভবিষ্যত সম্পর্কে বাবার ইচ্ছেটাকে কার্যকরী করা তার কর্তব্য। আমার লেখাপড়ার প্রবাহটার গতিমুখ এমন দিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আমি সরকারি চাকরির উপযুক্ত হয়ে উঠি। কিন্তু ততদিনে আমি আরো বেশি দৃঢ় সংকল্প নিয়েছি যে কিছুতেই সরকারি কর্মচারী হব না। কিন্তু স্কুলের শিক্ষাদীক্ষা তো একই খাতে প্রবাহিত। ছাত্রদের সরকারি চাকরির উপযুক্ত করে গড়ে তোলা। কিন্তু অসুখ এসে যেন বাঁচিয়ে দিল। ডাক্তার আমার ফুসফুসের অবস্থা দেখে মাকে জানাল যে আমার ফুসফুসের যা অবস্থা তাতে ভবিষ্যতে চার দেওয়ালের বদ্ধ আবহাওয়ায় চাকরি করা উচিত নয়। বরং বছর খানেকের জন্য স্কুল থেকে ছুটি নেওয়া দরকার। নইলে শরীর সেরে ওঠার কোন সম্ভাবনা নেই। আঃ, আমি যেন বেঁচে গেলাম। এতদিন ধরে মনেপ্রাণে যা চাইছিলাম তা বাস্তবে মূর্ত হয়ে ধরা দিল। হ্যাঁ, অকল্পনীয়ভাবে। ডাক্তারের কথাবার্তা শুনে মা রাজী হল। আমি স্কুল ছেড়ে দিয়ে আকাদেমিতে ভর্তি হলাম।
কিন্তু সেই সুখের দিনগুলো যেন একটা স্বপ্ন। দেখা দিয়েই বুদ্বুদের মত মিলিয়ে গেল। বছর দুই বাদে মার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনের রঙিন স্বপ্ন সৌধগুলো তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়ল। দীর্ঘদিন মা ভুগছিলেন। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠতেন। তখনই বুঝেছিলাম মা আর বেশি দিন বাঁচবেন না। যদিও মার মৃত্যু খুব একটা অকস্মাৎ নয়, তবু জীবনে প্রচন্ড একটা ধাক্কা খেলাম। বাবাকে শ্রদ্ধা করতাম, কিন্তু মা’কে ভালবাসতাম।
দারিদ্রতা আর নিষ্ঠুর বাস্তব করালরূপ ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। সংসারে সঞ্চয় বলতে যা ছিল মার দীর্ঘ রোগভোগের সময়েই তা নিঃশেষ। অনাথ হিসেবে সরকারি তহবিল থেকে যা পেতাম তা আমার বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সুতরাং রুটির তাগাদা অনুভব করলাম।
একটা ছোট চামড়ার সুটকেশে জামাকাপড় আর মনের ভেতরে অদম্য ইচ্ছেটাকে পুরে নিয়ে আমি ভিয়েনার রাস্তা ধরি। অজানা ভবিষ্যত; যেমন আমার বাবা প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ভাগ্যকে ভবিষ্যতের হাতে ছেড়ে দিয়ে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। তবু মনে দৃঢ়তা ছিল। জীবনে কিছু করবই— কিন্তু সরকারি চাকুরে হব না।