মুখোশ

মুখোশ

চিঠি পাওয়ার পর এখন আমি কি করবো ? একটু আগেই তো ডিভোর্স লেটার পোস্ট করে আসলাম। ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত আমরা পারিবারিক ভাবেই নিয়েছি। নীলার মা বাবাও মেনে নিয়েছেন। এমন কি তারা তাদের অপরাধও স্বীকার করে নিয়েছেন। সুতরাং আমাকে দেনমোহরের টাকাও পরিশোধ করতে হলো না।

নীলার বাবার অপরাধ হলো, অসুস্থ একজন মেয়ের অসুস্থতা গোপন করে বিয়ে দেয়া। ‌অত্যন্ত লোভী একজন মানুষ। আমার বাবার সম্পদ আর আমার ভালো বেতনের ব্যাংকের চাকরী দেখে তিনি লোভ সামলাতে পারলেন না। মা বাবাকে তার অতি সুন্দরী মেয়ে নীলাকে দেখিয়ে বিয়েতে রাজি করিয়ে নিলেন। নীলা ভয়ঙ্কর অসুস্থ একটি মেয়ে। আমাদের বিয়ে হয় আষাঢ়ের ভরা বর্ষায়। বিয়ের দিন হাল্কা বৃষ্টি ছিলো। যেদিন আমাদের বাসর, সেই রাতে শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি । আর তখনই নীলার ভয়ঙ্কর সমস্যা শুরু হয়।

বাসর ঘরে প্রবেশ করে নীলার পাশে বসে সবে মাত্র ঘোমটা সরিয়ে ভালো করে তাকিয়েছি। কি অপরূপ , কি সুন্দর, দয়াময়ের সৃষ্টি । মনে হলো জীবনেও এমন সুন্দরী মেয়ে আর দেখিনাই । তখনই শুরু হলো বৃষ্টি। নীলা কাপড় চোপড় আর গয়না পাতি সব ফেলে সোজা আমার গলা জড়িয়ে ধরল। আমি তখনও কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। ভাবলাম হয়তো ভালোবাসার অতি প্রকাশ। কিন্তু সময় যেতে থাকলো আর আমি ভয় পেতে থাকলাম। নীলা গলা ছাড়ছেনা। বৃষ্টি বেড়ে চলছে, সাথে সাথে নীলার অস্বাভাবিকতাও বেড়ে চলল।

একসময় কাঁপতে কাঁপতে সে আমার শরীরে নিস্তেজ হয় পড়ে গেলো। শশুড় শাশুড়ীকে রাতেই ঘটনার বিস্তারিত জানানো হলো। তারা তেমন গুরুত্ব দিলেন না । বললেন কিছুক্ষনের মাঝেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আর কাল সকালেই শশুর আব্বা তাবিজ নিয়ে আসবেন , তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকবেনা। অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়েদের প্রতি নাকি খারাপ জ্বীনদের কুনজর থাকে। আজ প্রায় ছয় মাস। তাবিজ-তুমার আর হুজুর বৈদ্য কিছুই কাজে আসেনি। নীলার অসুস্থতা বেড়েই চলেছে। আকাশে ঘন কালো মেঘের আনা গোনা দেখলেই কেঁপে কেঁপে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। অবশেষে আমার মা বাবা সিদ্ধান্তে আসলেন এমন মেয়েকে আর রাখবেন না। তালাকের ব্যবস্থা করে আমাকে আবারও বিয়ে করাবেন। নীলার পাঠানো পত্র ,মাত্রই পেয়েছি । স্বল্প শিক্ষিত দরিদ্র গ্রাম্য কিশোরীর ভুলে ভরা পত্র খানা কিছুটা এডিট করে এখানে তুলে ধরলাম।

সালাম নিবেন। আমি অসুস্থ একজন মানুষ। আপনার মত উপযুক্ত শিক্ষিত এক জন মানুষের বউ হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। আমার বাবা আসলেও প্রতারক আর লোভী। আপনার সাথে জেনে বুঝে প্রতারনা করেছেন। বিয়ের আগে মাকে বলেছিলাম আপনাকে সব খুলে বলতে। মায়ের কথা বাবা শুনলেন না । তিনি বললেন, “নীলার মা শুনো ,পাত্র পক্ষ ধনী মানুষ , বউ পছন্দ হলে আমার মেয়েকে তারা টাকা ব্যায় করে চিকিৎসা করিয়ে নিবে। আমি দরিদ্র ,সারা জীবন তো ঝাড় ফুঁক ছাড়া কিছু করাতে পারলাম না। তাদের অনেক টাকা । তারা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে। মা বলেছিলেন, “যদি হিতে বিপরিত হয় ? তাহলে কিন্তু আপনাকে সবাই প্রতারক বলবে। বাবা বলেছিলেন, মেয়ের ভালোর জন্য আমি প্রতারক হতেও রাজি আছি। এই কদিন আপনার পাশে থেকে বুঝতে পেরেছি আপনি অত্যন্ত ভালো আর নরম মনের একজন মানুষ। দোয়া করি, যিনি আপনার ঘরে আসবেন তিনি যেনো অনেক সুন্দর আর ভালো মনের হোন।

একটি গল্প বলছি শুনুন, সাড়ে তিন বছর বয়সের একটি শিশু। ঘুম থেকে জেগে দেখতে পেলো কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা আর মুখোশ পড়া কিছু মানুষ। সবার হাতে রুপার মত চকচকা ধারালো অস্ত্র। নিচু স্বরে কিন্তু চিবিয়ে চিবিয়ে ধমকের সুরে কথা বলছে। মা শিশুকে বুকে জড়িয়ে নিল। বাবাকে সে দেখতে পেল চৌকির নিচে দরজার পাশে মাটির মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। গামছা দিয়ে বাবার মুখ বাঁধা। কথা বলতে পারছেন না। একজন নিষ্ঠুর লোক ছোরা দিয়ে খুঁচিয়ে যাচ্ছে। বরাবর বলছে খতি ( হাটুরে ব্যাবসায়িদের টাকা রাখার থলে)কই? বাবা ইশারায় বলছেন, জানেন না। তারা মানতে নারাজ ।

লোকটা বাবাকে খুঁচিয়ে যাচ্ছে, আর বাবার রক্তে ঘর ভেষে যাচ্ছে। অপর দুইজন লোক শিশুটিকে মার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে দূরে নিক্ষেপ করে মায়ের কাপড় নিয়ে টানা টানি করতে থাকে। হেঁচড়া টানে এক সময় মায়ের গা থেকে কাপড় সরে যায়। অবুঝ শিশু গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চাইলে এক জন মেরে ফেলার হুমকি দিতে থাকে। তবুও শিশুটি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকল। কিন্তু তার চিৎকার চার দেয়ালের বাহিরে যাচ্ছিল না। কারণ সেই রাতে প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। টিনের চালে বৃষ্টির বড় বড় ফোটায় বাহিরে কিছুই শোনা চাচ্ছিলো না। বলতে পারবেন শিশুটি কে ? আপনি তো মেধাবী মানুষ । বলুন , সেই শিশুটি কে ?

বিশ্বাস করুন, আমার মাঝে জ্বীনে ধরা বলতে কিছু ঘটেনি। সেই দিনের সেই ভয়ঙ্কর স্মৃতি আমাকে এমন করে। আকাশে ঘন মেঘ দেখলেই সেই রাতের সব কিছু ঝলমল করে আমার স্মৃতি পটে ভেসে উঠে। আর তখন আমার মাঝে কি জানি কি হয় তা বলতে পারবো না। আমি অসুস্থ হয়ে যাই। ভলো থাকবেন আর ক্ষমা করবেন । ইতি নীলা।

পত্র পাঠের পর দুইটি বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে, এক , মানুষ কত নির্মম হতে পারে । একজন অবুঝ শিশুর সামনে এমন নির্মম কাজ কিভাবে করতে পারল ? একবারের জন্যও কি নিজেদের সন্তান,ছোট ভাই বোন আর মায়ের কথা মনে পড়লো না? দুই, নীলা এই কদিনে কেমনে বুঝতে সক্ষম হলো যে আমি নম্র আর ভদ্র ? অথচ একটু আগেই তো ডিভোর্সের মত কঠিন কাজটা অবলীলায় সেরে আসলাম ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত