জামা

জামা

“বউ তোর জামাডা তো ছিঁড়া গেছে”। খেতে বসে রমিজ মিয়া লক্ষ্য করলো জুলেখার জামার কাধের অংশে অনেকখানি ছিড়ে গেছে। জুলেখা ওড়না টেনে ছেড়া অংশ ঢাকতে ঢাকতে লাজুক হাসি দিয়ে বললো ” এই সামান্য একটু ছিড়া গেছে।তেমন কিছু না,একটু সুই সুতা দিয়া সেলাই দিলেই হবো।আপনে ভাত খান তো।ডাটা দিয়া কাঠালের বিচির চচ্চড়ি টা খাইয়া বলেন কেমন হইছে”। রমিজ মিয়া ভাত মুখে নিলো।ডাটা দিয়ে কাঠালের বিচির তরকারির স্বাদ সে বুঝতে পারছে না।তার মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেছে।দুই বছর আগে জুলেখাকে বউ করে ঘরে তুলেছিলো। সেই বিয়ের সময়ই কয়টা জামা কিনে দিয়েছিলো। তার পর আর কিছু দিতে পারেনি।

রমিজ মিয়া রিকশা চালায়। যা৷ রোজগার করে,অর্ধেক মালিককে দিতে হয়।আর বাকী যা পায় তা দিয়ে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা আর খেয়ে পড়ে কোন রকম বেচে আছে।ঢাকা শহরে এসেছিলো কিছু পুজি করতে।কিন্তু জিনিসপত্র, ঘর ভাড়া এত বেশী যে, যা আয় হয় তার মধ্যে জমানোর জন্য অবশিষ্ট কিছু থাকে না।নতুন কাপড় কিনার মত বিলাসিতা করার সুযোগ তার হয় না। কিন্তু জুলেখার ছেড়া জামা দেখে তার খুব মন খারাপ হয়ে গেছে।মেয়েটা কোনো দিন তার কাছে মুখ ফুটে কিছু আবদার করে নি। জুলেখা কয়েকবার চেয়েছে মানুষের বাসায় কাজ করবে।এতে সংসারের আয় বাড়বে।কিন্তু রমিজ মিয়া বউকে অন্য বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে দিতে রাজি হন নি।রিকশাচালক হয়েছে তো কি হয়েছে?নিজের বউ অন্য বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করবে,ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারে নি।

“কি ভাবেন এত?ভাত তরকারি তো ঠান্ডা হইয়া গেলো।পরে স্বাদ পাবেন না”। জুলেখার ডাকে রমিজ মিয়া ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো।মুখে আরেক লোকমা ভাত পুরে দিলেন। ” খুব মজা করে রানছিস বউ,পেট ভইরা ভাত খাইলাম”। রমিজ মিয়া রান্নার প্রশংসা করলেন। প্রশংসা শুনে জুলেখার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। তার রান্নার প্রশংসা পেলে সে খুব খুশী হয়।

রাতে শুয়ে শুয়ে রমিজ মিয়া ভাবতে লাগলো,জুলেখা কে কালই সে জামা কিনে দিবে।এজন্য মালিকের কাছ থেকে হয়তো কিছু ধার করা লাগবে।সমস্যা নেই,পরের মাসে শোধ করে দিতে পারবে।কিন্তু বউয়ের ছেড়া জামা সে দেখতে পারবে না।রমিজ মিয়া সারাদিন রিকশা চালিয়ে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরলো।তাকে আসতে দেখে জুলেখা এগিয়ে এলো।হাত মুখ ধোয়ার জন্য পানি দিলো। মুখে পানি দিতে দিতে রমিজ মিয়া বললো,”বউ রেডি হইয়া নে।তরে নিয়া এক জায়গায় যামু”। জুলেখা অবাক হয়।”কই যাইবেন”? “গেলেই দেখবি।তাড়াতাড়ি কর।রাত হইয়া গেলো তো”। জুলেখা রেডি হয়ে নিলো।তার বিয়ের শাড়ীটা পড়েছে আজ।ভালো কাপড় বলতে এই বিয়ের শাড়ীটাই।কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে সে এই শাড়ীটি ই পড়ে।

জুলেখা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো রমিজ মিয়া তাকে নিয়ে একটা মার্কেটে ঢুকেছে।সে তার জিবনে মার্কেটে খুব কম ই এসেছে।ঢাকা শহরের মার্কেটে তো এই প্রথম এলো।নিউমার্কেটের ভেতর এত এত জিনিসের বাহার দেখে সে অবাক হয়ে জিনিসপত্র দেখতে৷ লাগলো।তার কি যে আনন্দ হচ্ছে! তার ইচ্ছে হচ্ছিলো সব কিছু কিনে ফেলতে। রমিজ মিয়া তাকে নিয়ে একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকলো।দোকানদার একের পর এক লোনের থ্রিপিচ বের করে দেখাচ্ছে।

” দেখ বউ,তোর কোনটা পছন্দ হয়”।

“আমার পছন্দ”? জুলেখা বিস্মিত কন্ঠে বললো।

” হ্যা,তোর জন্যই তো কিনতে আইছি”।

জুলেখার চোখে পানি চলে এলো।এত আনন্দ সে তার জীবনে কোন দিন পায় নি।চোখ মুছে নিয়ে সে জামা পছন্দ করতে লাগলো।এই প্রথম সে নিজে পছন্দ করে কিছু কিনছে।লাল আর গোলাপি রঙের দুইটা জামা সে পছন্দ করলো।রমিজ মিয়া বারোশো টাকা বিল দিয়ে জামার প্যাকেট নিয়ে উঠে দাড়ালো। জুলেখার সোনালী রঙের একটা জামায় চোখ আটকে গেলো।ইশ কি সুন্দর জামাটা!এত সুন্দর জামা হয়!এত সুন্দর জামা মানুষ পড়ে? রমিজ মিয়া লক্ষ্য করলো জুলেখা একটা জামার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।রমিজ মিয়ার দেখলো জামাটা।তার নিজের ও খুব পছন্দ হলো।জুলেখা কে খুব মানাবে জামাটায়।তার ও নিশ্চয়ই খুব পছন্দ হয়েছে।দোকানদারকে দাম জিজ্ঞেস করলো।দাম শুনে মুখ শুকিয়ে গেলো তার।আড়াই হাজার টাকা।এত টাকা দিয়ে জামা কিনার সাধ্য তার নেই।

তার মুখ দেখে জুলেখা বুঝতে পারলো তার মনের অবস্থা।তাড়াতাড়ি বলে উঠলো “এটা একটা জামা হইলো নাকি।রংটা দেখছেন কেমন মাদা মাদা,বুড়া মানুষদের রঙ।এটা পাচশ টাকায় দিলেও নিতাম না”।মুখ ঝামটা দিয়ে বললো জুলেখা। স্বামীর মন খারাপ সে দেখতে পারছে না।তার জামার প্রয়োজন নেই।তার স্বামীর মনটা ভালো থাকুক তাই সে চায়। রমিজ মিয়া মনে মনে ঠিক করলো, এইবার ইদে অবশ্যই জুলেখাকে সে এরকম একটা জামা কিনে দিবে।ধার করে হলেও কিনে দিবে।

” একটা কথা কই”?

” কও বউ”।

“মায়ের জন্যে একটা শাড়ি কিনা নিয়া যাই।মায়ের শাড়ীটাও তো পুরান হইয়া গেছে”। রমিজ মিয়ার চোখে পানি চলে এলো।এত ভালো একটা মেয়েকে সে বউ হিসেবে কিভাবে পেলো সে বুঝে উঠতে পারলো না। মায়ের জন্য শাড়ি কিনে তারা বাড়িতে ফিরে এলো।শাড়ি পেয়ে মা এত খুশী হলো বলার মত না। জুলেখার আজ এত আনন্দ হচ্ছে।আল্লাহ তাকে এত সুখি বানিয়েছে।বার বার আল্লাহর শোকর আদায় করতে লাগলো।

এটা কি কিনেছ তুমি”?তিশা রাগ করে জামাটা ছুড়ে ফেলে দিলো।রায়হান অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। জামাটা সে নিউমার্কেট থেকে কিনেছে।হ্যা এটা সেই জামা যেটার দিকে জুলেখা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো।যেটা কিনার স্বপ্ন দেখেছিলো।কিন্তু তার জন্য সেটা ছিলো সাধ্যের বাইরে। রায়হান অফিস থেকে ফিরার সময় শখ করে তিশার জন্য জামাটা কিনে আনে তিশাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে।কিন্তু তিশার আচরনে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেছে। “কত দাম নিয়েছে এটার”? তিশা জানতে চাইলো।

” আড়াই হাজার”।

“তুমি ভাবলে কি করে এরকম চিপ একটা জামা আমি পড়বো”?

” চিপ বলছ কেন তিশা।জামাটাতো খুব সুন্দর ”

“আড়াই হাজার টাকায় কিনা ফুটপাতের জামা তোমার কাছে সুন্দর লাগলেও, আমার কাছে চিপ লাগে।ছাড়ো ওসব,বসুন্ধরায় একটা জামা পছন্দ হয়েছে।নয় হাজার টাকা লাগবে।টাকা দাও”।

” নয় হাজার”?রায়হানের চোয়াল ঝুলে পড়লো।

“হ্যা নয় হাজার।জাহিদ ভাই তিথি ভাবীকে পচিঁশ হাজার টাকা দিয়ে শাড়ী কিনে দিয়েছে।আর তুমি মাত্র নয় হাজার টাকার জামা আমায় কিনে দিতে পারবে না”?

” জাহিদ ভাইয়ের ইনকাম আর আমার ইনকাম সমান না তিশা।এত টাকা দিয়ে জামা কিনে দেয়ার সামর্থ আমার নেই। আমি বেতন পাই চল্লিশ হাজার।এর মধ্যে বাসা ভাড়া,বাজার খরচ বাবা মা কে গ্রামে পাঠাতে হয় সব মিলিয়ে মাসের শেষে তো তেমন কিছুই বাকী থাকে না। তুমি তো জানোই”। “আমি অত কিছু জানি না।কিনা দিবা ব্যাস,শেষ কথা।আর তোমার এই চিপ জামাটা বস্তিতে কাউকে দান করে দিয়ে এসো।এটা ওখানেই মানাবে”। বলে জামাটা আবার ও ছুড়ে মারলো তিশা।জামাটার দিকে তাকালেই তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।

কি আশ্চর্য এই দুনিয়া।একজনের স্বপ্ন আরেক জন ছুড়ে ফেলে দেয়। মানুষ যা পায় তার কদর করে না।সাধ্যের ভেতরের জিনিসগুলো কে সব সময় সস্তা মনে হয়।মানুষ চায় অসাধ্য সাধন করতে।যেটা আমাদের নাগালের বাইরে,আমরা সেটা পাবার ই স্বপ্ন দেখি। উপরের লেভেলের মানুষ গুলোর দিকে তাকালে মনে হয় আমি কত দুঃখ কস্টে আছি। তবে বেশি দূর না,নিজের বাসার কাজের বুয়া কিংবা রিকশাওয়ালা মামাটার দিকে তাকিয়ে দেখি।নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখি মনে হয়।সুখি হতে বেশী কিছু লাগে না।নিজের যা আছে তাই নিয়েও সুখে থাকা যায়।শুধু নিজের চাহিদাটাকে লাগাম পড়াতে হয়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত