অমিত মাথা নিচুকরে ধীরগতিতে ফুটপাত ধরে হাটছে।আজ মাসের ১৬ তারিখ,মানিব্যাগটা এখনি টাকা শূন্যতায় ভুগছে,শুধু কাগজপত্রে ফুলে আছে ব্যাগখানা। মেসের ইমতিয়াজ ভাই বলে দিয়েছে মেসের বকেয়া যেনো শোধ করে দেয়।বন্ধু তমাল,আর চা দোকানদার রাশেদ ভাইয়ের ধার গুলো পরিশোধ করতে হবে।মার কাছেও টাকা চাওয়া যাচ্ছে না,কারন এই মাসের টাকা ১ তারিখ দিয়ে দিছেন।স্বার্থপরের মতন অভাবের সংসারে বারবার হানা দেওয়াটা একদমি ঠিক হবে না।মার কষ্টটাও বুঝতে হবে। টাকার এই ক্রাইসিস টা হতো না,হয়েছে কারন নীরার বার্থডে ছিলো এই মাসের ৯ তারিখ।বার্থডে সেলিব্রেশন,গিফট কেনা, ঘুরতে নিয়ে যাওয়া এইসবের জন্যই টাকা ফুড়িয়ে যায়।নীরা গান খুব পছন্দ করে তাই তাকে একটা দামি হেডফোন কিনে দিতে ইচ্ছে হলো অমিতের।
ভার্সিটিতে সাবাই অমিত কে কবি বলে জানতো,যদিও সে লিখালিখি করে তবে কবিতা তার ঠিক তেমন ভাবে লিখা হয়ে উঠেনি।লিখালিখির সুবাধেই নীরার সাথে পরিচয়, একদিন রাত দুটায় নীরা নক দিয়ে বসলো।সেদিন রাতে অনেক কথা হয় তাদের। অমিত দেখলো মেয়েটার রুচি অনেকটাই মিলে যাচ্ছে।যেমন সে সাহিত্য পছন্দ করে,প্রচুর বই পড়ে,ছবি আঁকে। আর সবচেয়ে বড় কথা সেও অমিতের মতোই অর্ণবের ফ্যান। তারপর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই কথা হতে লাগলো।রাতের পর রাত নির্ঘুমভাবে কাটতে লাগলো।অমিত একসময় ভাবে যে তাদের এই ভালো-লাগাটা ভালোবাসায় রূপ দিবে।তাই একদিন তার মধ্যে থাকা সাহিত্যিক সব প্রতিভা ঢেলে দিয়ে একটা প্রেমপত্র লিখে ফেললো।যখন নীরা রাজি হয়ে যায়,তখন অমিত ভাবলো সাহিত্য চর্চাটার সার্থক ব্যবহারটি বুঝি আজ হলো।
এইসকল কথা ভাবতে ভাবতে কাঠফাটা রোদে অমিত হাটছে।সূর্যের প্রচন্ড তাপে তার শার্ট ভিজে চুপসে শরীররে সাথে লেগে গেছে।গরমটা তার ভালোই লাগছে।এক রকম ঘুর অনুভব হচ্ছে।ঘুরের মধ্যে নীরার কথা ভাবতে ভালোই লাগছে তার। যেতে হবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। নীরা সেখানে অপেক্ষা করছে।বিশেষ একটা কথা আছে নাকি।
গিয়েই দেখি নীরা সেই বার্থডেতে দেওয়া হেডফোনটা দিয়ে আনমনে গান শুনছে।
-নীরা,কেমন আছো?
-ভালো, তুমি?
-আমিও ভালো আছি।কিযে গরম পরছে আজকে।
-হ্যা,রিকসায় করে আসলেতো পারতে,ঘামে ভিজে ভূত হয়ে আছো
-হাটতে ভালো লাগছিলো,নিজেকে হিমু,হিমু লাগছিলো।যখনি পকেটে রিকশা ভাড়া থাকে না তখনি আমি নিজেকে হিমু মনে করি আর হাটা শুরু করি।
-তাহলে জুতা খুলে হাটবে
-আচ্ছা, এরপর থেকে জুতা খুলেই হাটবো।তোমার কি যে ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিলো,সেটা বলো?
-এখন বলবো না,তোমাকে দেখলেই কথাটা আর বলতে ইচ্ছে করে না এখন।
-আমার মুখের আবার কি এমন বিশেষত্ব আছে,জানি না বাপু। নীরার সাথে সেদিন অনেকক্ষণ ধরে কথা হয়।হঠাৎ নীরা বললো,
-অমিত,আমি আর তোমাকে ঠকাতে পারছি না।নিজের উপর প্রচুর ঘেন্না হয়।তোমার মত মানুষকে আর ঠকানো যাচ্ছে না।আমি আসলে অমিত এই কথা শুনে হকচকিয়ে গেলো।নীরা কথার আগামাথা কিছুই তার মাথায় ডুকছে না।সে শুধু তাকিয়েই আছে।তারপর আবার নীরা বলতে শুরু করলো।
-আমি আসলে সিএসসি ডিপার্টমেন্টর সজয় কে ভালোবাসি।আমাদের কলেজে থেকে রিলেশন ছিলো।তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগতো।তোমার লেখার হাত ভালো, তুমি মানুষটাও খুব ভালো অমিত।তোমার মতো মানুষকে সত্যি ভালো না বেসে থাকা যায় না।কিন্তু আমার জীবন জড়িয়ে আছে সজয়ের সাথে।তাই এই সত্যিটা তোমাকে বলতেই হলো।আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। নীরা অনায়াসে কথা গুলো বলে গেলো।অমিত তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো শুনছে।একসময় নীরা চলে যায়।অমিত বসে থাকে।তার মুখ রক্তিম হয়ে উঠে,চোখ লাল হয়ে যায়।বেশ অনেকক্ষণ সে স্থির মূর্তির মতো বসে থাকে,চোখ বেয়ে কয়েক ফুটা পানি পরে তার পায়ে।
মাঝে বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো।অমিতকে আর ক্যাম্পাসে আসতে দেখা যাচ্ছে না।নীরা বিষয়টা খেয়াল করলো কিন্তু মাথায় নিলো না।বরং বলে গেলো ছেলেটা ছ্যাঁকা খেয়ে বেকা হয়ে কয়েকটা কাব্য রচনা করবে।মন না ভাঙ্গলে কবি হওয়া যায় না।এখন দেখবি সে আরও বড় মাপের কবি হয়ে গেছে।হি হি হি কিন্তু কয়েক মাস হয়ে গেলো অমিতের কোন খুঁজ নেই।নীরাও কেন যেনো অমিতের কথা ভুলতে পারছে না।মনে ভেতর কেমন যেন অমিত রয়েই গেছে।তার সেই উদাসিনী চাহুনি,তার কথা বলার ভঙ্গি সব বারবার মনে পরতে লাগলো।যখনই তার কথা মনে হয় সে অমিতের দেওয়া গিফট হেডফোন দিয়ে গান শুনে।
একদিন তমালকে ক্যাম্পাসে দেখতে পেয়ে নীরা অমিতের খবর জিগ্যেস করাতেই তমাল কিছুক্ষণ নীরা দিকে তাকিয়ে চলে যায়।তমালে সে চাহুনিতে ছিলো ঘৃণা।পরে নীরা জানতে পারে অমিত এই জগৎসংসার ছেড়ে চলে গেছে।সেদিন এই কথা শুনে নীরা হাঁটু গেড়ে বসে পরল।বাড়িতে এসেই সে তার রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো।একসময় সে বালিশে কামড়ে ধরে কাদতে লাগলো।সে এক বিশাল অপরাধবোধে অস্থির হয়ে উঠলো।কান্না করতে করতে সে একপর্যায়ে ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙ্গলো দুপুর রাত্রে,নীরা লক্ষ করলো তার পুরো ঘর জুড়ে অমিতে নিজস্ব সেই পারফিউমের গন্ধটা ছড়িয়ে আছে।যেনো অমিত রুমের কোন একটা পাশে দাড়িয়ে দেখছে নীরাকে।
নীরা কিছুটা বিবৃতবোধ করে,ফ্রেশ হতে বাথরুমে গেলো।সে অনেকক্ষণ সাওয়ার ছেড়ে চুপচাপ বসে রইলো।তার চোখ লাল রক্তবর্ণ হয়ে গেছে,তাও সে ভিজছে।ঘন্টাদুয়েক পর সে রুমে আসে।তার প্রচন্ড জ্বর অনুভব হতে লাগলো।
অমিতের দেওয়া সেই হেডফোনটা নিয়ে সে কানে দিলো।ফোনটা হাতে নিয়ে অর্ণবের “তুই বললে” গানটা প্লে করলো সে।এটা অমিতে প্রিয় গান গুলোর মধ্যে একটা।গানটা শুনতে শুনতে সে অমিতের সাথে কাটানো সময়গুলো মনে করতে লাগলো।সাথে একটা ঘুর অনুভব করতে লাগলো।হঠাৎ মনে হলে গানের বদলে এখন অমিত কথা বলছে।যেন অমিত বলছে,
-নীরা,আমার ভালোবাসটা মিথ্যা ছিলো না।যেদিন থেকে তোমাকে ভালোবেসেছি, সেদিন থেকে মনে মধ্য একটা গাছ রোপণ করেছিলাম।তুমি ছিলে সেই গাছটার সূর্যকিরণ।কিন্তু তোমার ঐ কথা গুলো গাছটাকে ধুমরে-মুছরে মেরে ফেলে।সেদিন থেকে নিঃশ্বাস নিতেও আমার খুব কষ্ট হতো।তোমাকে কখনো ঘৃণার চোখে দেখিনি।বাকিটা জীবনেও দেখতে পারবো না, তাই আমার গল্পটার ইতিটানতে হলো।এখন শুধু তোমার অপেক্ষায় আছি।
নীরা কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন ঘুরে তলিয়ে গেলো।সে বুঝতে পারছে হেডফোনের তারটি কেমন তার গলায় পেঁচিয়ে ধরছে।কিন্ত সে মূর্তিমানবীর মতো স্তব্ধ হয়ে বসে আছে।নড়াচড়া করতে পারছে না।একটি সময় সে নিথর হয়ে খাটের উপর শুয়ে পরলো। সকালে বেলায় নীরার রুমে অনেক মানুষ জড়ো হয়।ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে জানাযায়,অতিরিক্ত মানসিক চাপ ও স্ট্রেসের কারনে স্ট্রোকের মাধ্যমে তার আকস্মিক মৃত্যু হয়।