দীর্ঘ ৩ বছরের রিলেশনের পর আজকে অরুনাকে আমি বিয়ের জন্য রিজেক্ট করে এসেছি তার জন্য দায়ী শুধুমাত্র অরুনার গায়ের রং,অরুনার গায়ের রং কালো,দেখতে কেমন যেনো,আজকাল এমন গায়ের রং এর মেয়ে বিয়ে করে কি করবো, কিভাবে তাকে নিয়ে কোথাও যাবো, আর বন্ধুদের সামনে যেতে তো আমার লজ্জাই লাগবে, সবার বউ কতটা সুন্দরী, সেখানে আর যাই হোক, এমন কালো মেয়ে বিয়ে করতে পারবো না। তার উপর পরিবার থেকে মানা এই মেয়েকে বিয়ে করা যাবেনা,একদম না। আমার সুন্দরী একটা মেয়ে লাগবে, যার দিকে অনন্ত কাল ধরে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করবে,যাকে পাশে নিয়ে চলতে আমার বেশ আনন্দ হবে।
হ্যাঁ, ঠিক তেমনি একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়, খুব সুন্দরী একটা মেয়ের সাথে,যেমন ভাবনা ছিলো তেমনি কাজ, বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া,নিজের বউ সবচেয়ে সুন্দরী বলে অহংকার করা । আত্মীয় স্বজন সবাই দেখেই বললো, ওয়াও কত কিউট একটা মেয়ে, কেউ কেউ তো বলেই ফেললো, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে,এসব শুনতে আমারও বেশ আনন্দ লাগলো। এভাবেই আমাদের দিন যেতে লাগলো,কিন্তু হুট করে এক ঘনমেঘ বর্ষা রাতে আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেনো ফাঁফা ফাঁকা লাগতে লাগলো, আমার কেনো জানি নিজেকে খুব একা লাগতে লাগলো।
তখন আমি বুঝতে পারলাম, আমি আসলে এমন একটা মেয়ে চাইছি যে আমাকে ঘনমেঘ বর্ষা রাতে গান শুনাবে, যে আমাকে দিন শেষে বুকে জড়িয়ে নিবে, যে পাশে থাকলে আমার মনেহবে আমার সবকিছু আছে, আমি পরিপূর্ণ, যার জন্য দিনশেষে বাসায় ফেরা বকুলফুলটা আমার হাতে থাকবে, কোনো এক এলোমেলো রাতে আমি তাকে বউ সাজিয়ে দিবো, যে আমার জন্য রোজ কাজল আঁকবে চোখে।
কিন্তু এসবের কিছুই আমি পাইনি মেয়েটার কাছ থেকে, সে তার মতোই ব্যস্ত থাকে, দিনশেষে আমি তার কাছে যেতে পারিনি,মনের এলোমেলো সব কথা তাকে বলতে পারিনি,আমার মন খারাপের সময়টাতেও তাকে পাশে পাইনি,আমার অহেতুক সব গল্প কিংবা কবিতায় কোথাও সে ছিলো না। দিনশেষে আমি কখনো আমার অনুভূতিগুলোর কথা বলতে গেলে সে কেমন যেনো বিরক্ত হয়, কেমন যেনো একটা বিষন্নতা চলে আসলো আমাদের মাঝে। তার কাছে আমি মানসিক শান্তিটা পাইনি,অথচ আমি একটা মানুষের খুব প্রয়োজন, যে হবে আমার মানসিক শান্তি, যে হবে আমার নিজের মানুষ।
তখন খুব মনে পড়লো অরুনার কথা, রোজ রোজ লুকোচুরি করে আমার জন্য কত কিছু যে রান্না করে আনতো মেয়েটা, আমার শাড়ি পছন্দ বলে একটু সুযোগ পেলেই শাড়ি পড়ে আসতো আমার সামনে, চোখে কাজল দিতে তার কখনো ভুল হতোনা, এমন অনেক রাত আছে সে ফোনের ওপাশে থেকে গান শুনাতো, আমি এপাশ থেকে ঘুমিয়ে পড়তাম। অথচ দিনশেষে তার সাথে থাকতে আমার কেমন যেনো অস্বস্তি লাগতো, লজ্জা লজ্জা লাগতো শুধু মাত্র ওর গায়ের রং এর জন্য । কিন্তু আজ মনে হচ্ছে আমার শুধু ওকেই প্রয়োজন ছিলো, শুধু অরুনাকেই।
এসব ভাবতে ভাবতে নিজের উপর খুব রাগ হলো, মন খারাপ হলো অনেক, আচ্ছা যে মেয়েটাকে আমি বিয়ে করেছি ও এমন না কেনো? তাহলে পৃথিবীর সব সুন্দরী মেয়ে কি এমন? কই না তো, আমার মা অনেক বেশি সুন্দরী আমার বউ থেকে, আর আমার বাবাতো আমার মাকে নিয়ে অনেক খুশী, আমার মায়ের পৃথিবীজুড়ে আমার বাবা আর আমরা। এখনো সেই দোয়াত কলমে লেখা চিঠিগুলো মা মাঝেমধ্যে বের করে পড়ে। তাহলে কি আমরা আরো ভালো খুঁজতে গিয়ে ভালোটাকে হারিয়ে ফেলি? এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। এই মন খারাপের সময় বছরের পর বছর চলতেই থাকে। এর মাঝে আমার একটা মেয়ে হয়,ওর নাম রাখলাম নীতু, পৃথিবীর সব মন খারাপ আমি ভুলে গিয়ে ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, আমার পৃথিবী বলতে এখন শুধু ও।
বেশ কয়েক বছর পর হুট করে একদিন মেয়েটা কলেজ থেকে এসে মন খারাপ করে বসে আছে,আমার একমাত্র মেয়ে,ওর মন খারাপ আমি কখনো দেখতে পারিনা,ওর মন খারাপ দেখলে পুরো পৃথিবী আমার কাছে বিষন্ন লাগে। মেয়েটার মন খারাপ দেখে আমি ওর পাশে গিয়ে বসে জানতে চাই, ” মা,কি হলো তোর?” মেয়েটা কান্না করে উঠে বললো ”বাবা আমি দেখতে কি খুব খারাপ?,আমার গায়ের রং কি অনেক ময়লা?” কথাগুলো বলতে মেয়েটার কতটা কষ্ট হলো আমি বাবা হয়ে বুঝতে পারলাম। মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, না মা তুই দেখতে ঠিক এক রাজ কন্যার মতো, আর রাজকন্যাদের গায়ের রং কখনো ময়লা হয়না। নিজের কান্না লুকিয়ে রাখার জন্য মেয়ের পাশ থেকে উঠে চলে যাই।
সেদিন অফিস থেকে এসে দেখি বন্ধু আর বন্ধুর বউ বসার ঘরে বসে আছে,অনেকদিন পর ওদেরকে দেখে অনেক খুশী হই, কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে জানতে পারলাম তারা আমার মেয়েকে দেখতে আসলো, বন্ধুর বউ এর ভাইয়ের জন্য, তারা আমার নীতু মাকে দেখে সন্ধ্যা নাগাত বাসায় গেলো। কিন্তু রাত ১১ টার দিকে বন্ধু কল করে বললো, “দোস্ত,ও আরেকটু ফর্সা মেয়ে চাচ্ছে। ” কথাটা শুনে অনেক খারাপ লাগলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,আচ্ছা। সে রাতে আর আমার ঘুম হলোনা।
যাইহোক,মন খারাপগুলো জমিয়ে আছে,মেয়ের কলেজ বন্ধ আর আমার অফিস থেকেও ৩ দিনের ছুটি পাই, আমার সমুদ্র সেই ছোট থেকেই অনেক পছন্দ, কেনো জানি আমার মেয়েরও সমুদ্র খুব পছন্দ, ছুটি পেলেই বলে বাবা সমুদ্র দেখতে যাবো। সুযোগটা পেয়ে মেয়েকে নিয়ে চলে যাই সমুদ্র দেখতে,সারাদিন ঘুরাঘুরির পর সূর্যাস্তের সময় আমরা সমুদ্রের পাড়ে বসে ছিলাম, তখন কেনো জানি মেয়ে কান্না করে উঠলো,মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, তার একটা পছন্দ ছিলো, ছেলেটাও তাকে খুব পছন্দ করতো, কিন্তু কিছুদিন আগে ছেলেটা দেশের বাহিরে স্কলারশিপ পেয়ে চলা যায়, যাওয়ার আগে পরিবার তার বিয়ে দিবে বলে, নীতু তা শুনে খুব খুশি হলেও পরে জানতে পারে নীতুকে তার পরিবারের পছন্দ না। কথাটা শুনে সমুদ্রপাড়ে বসে কান্না শুরু করলাম, হয়তো সবটুকু অপরাদ এই আমার, নীতুর কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলাম, মা, আমাকে ক্ষমা করে দে, একজীবনে এতবড় ভুল আমি করেছি, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
বেশ কিছুক্ষন আমরা বাবা মেয়ে বসে ছিলাম সমুদ্রপাড়ে, একজন অপরাধী বাবা হয়ে যখন সবটুকু মন খারাপ নিয়ে হোটেলে ফিরি তখন অরুনার সাথে দেখা,অরুনা আজও আমাকে দেখে কেমন যেনো লজ্জা পেয়ে উঠলো,একটু পর কাছে এসে জানতে চাইলো, ও কি আপনার মেয়ে? আমি মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ, ও আমার মেয়ে। ও আমার মেয়ের কাছে গিয়ে বলে উঠলো, “ও মা, কত কিউট একটা মেয়ে,কবে যে আপনার মেয়ে হলো, আর কবেই বা এতো বড় হয়ে গেলো। ”
তখন অরুনা আমাকে বললো,আচ্ছা,আমি একটা কথা বললে আপনি কি খুব মন খারাপ করবেন? আমি অরুনার দিকে তাকিয়ে আগের মতোই বললাম না,বলো। তখন অরুনা বললো, ”এই লক্ষী মেয়েটাকে আমি আমার ঘরের মেয়ে করে নিতে চাই, যদি আপনার কোনো আপত্তি না থাকে।” আমার চোখ ভর্তি জল চলে আসলো,আমি সেখান থেকে চলে আসি, অরুনা নীতুকে নিয়ে অরুনার রুমে যায়, সেখানে অরুনা নীতুকে সাজিয়ে দেয়, দুজনের পরনে একই শাড়ি, দুইজন সমুদ্র পাড়ে হাঁটছে।