রিহান যেদিন হঠাৎ ফোন দিয়ে বলল, আপু দুলাভাইকে দেখলাম সীমা আপুর সাথে রিক্সা করে কোথায় যেন যাচ্ছে। কিছুটা অবাক হওয়া সত্বেও নিজেকে সামলিয়ে রিহান কে ধমক দিয়ে বললাম কেন তোর দুলাভাই কি অন্য কোনো মেয়ের সাথে রিক্সা করে যেতে পারেনা? আর সীমার সাথেই তো দেখেছিস এটা আবার আমাকে ফোন করে জানানোর কি হলো!
– যাক বাবা দেখেছি বলেই তো বললাম। হুহ কারো ভালো করতে নেই!
– যা তোকে পাকনামি করতে হবেনা। রাখি হাতে অনেক কাজ আছে।
সেদিন ফোন টা রাখার পর থেকে মনের মধ্যে খুতখুত করছিল। সীমা কে নিয়ে রিক্সা করে রাতুল কই যাবে! কোনো বিপদ হলো না তো! যাই হোক রাত অব্ধি অপেক্ষা করলাম কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো রাতুল বাসায় ফিরে কিছুই বলল না। আমিও নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। সীমা আমার আর রাতুলের ক্লাসমেট ছিল। বান্ধবী হিসেবে খারাপ ছিল না। আমার আর রাতুলের আজ এই পরিপূর্ণতাই অনেকটা ক্রেডিট সীমার। আমাদের বিয়ে হয়েছে ৪বছর হলো। সীমা মাঝেমধ্যে আসে আমাদের বাসায়। গল্পেগল্পে কত সময় কাটিয়ে দেই আমরা। বিয়ের পর আমাদের সম্পর্ক টা আরো ভালো হয়েছে।
দুদিন পর, কিছু শপিং করব বলে বের হলাম, মার্কেটের পাশে একটা সুপার শপে ঢুকতেই চোখ আমার ছানাবড়া। রাতুল বাজার করছে। বেশ খানিক টা অবাক হলাম কারণ, সে সব দায়িত্ব পালন করলেও তাকে দিয়ে আজ পর্যন্ত আমি এ দায়িত্ব টা পালন করাতে পারিনি। রাতুল কে কখনো বাজারে পাঠালে লিস্টের অর্ধেক জিনিসই সে ছেড়ে আসবে। তাছাড়া বাজারের প্রতি তার দারুণ অনিহা। কিন্তু এ আমি কি দেখছি! মনে মনে খানিকটা খুশি হলাম যাক মহাশয় এত দিনেও হোক আমার কষ্ট টা বুঝলো। কিন্তু আমি তো ওকে কিছু বলিনি যে বাসায় কি আছে কি নেই। যাই হোক আর কিছু না ভেবে বের হয়ে বাসায় চলে এলাম। অপেক্ষা করছি রাতুলের। বাসায় ফিরেছি ২ঘন্টা হয়ে গেছে এতক্ষণে তো রাতুলের বাসায় চলে আসার কথা। ও আসছিল না বলে আমি নিজেই ফোন দিলাম।
– কোথায় তুমি?
– এই সময় কোথায় থাকার কথা! অদ্ভুত প্রশ্ন করো।
– যা জিজ্ঞেস করেছি সোজাসুজি উত্তর দিলেই তো হতো।
– দেখো নীরা অফিসের কাজে ব্যস্ত আমি। আর তুমি বলছ কোথায় আমি!
কৌতুহলের শীর্ষে আমি। রাতুল এভাবে কথা বলল কেন! আর মিথ্যেই বা বলল কেন! আচ্ছা ও কি আমাকে অবাক করে দেয়ার জন্য মিথ্যে বলল, হয়ত বাসায় আসছে। সারাদিন কেটে গেলো কিন্তু ওর দেখা নেই। প্রতিদিনের মতো একই সময়ে বাসায় ফিরল সে। আমার চোখ সবার আগের ওর শূন্য হাতের দিকে গেলো। এবার অবাক হওয়ার বদলে খানিক টা ধাক্কা খেলাম। রাতুল বাজার করল অথচ খালি হাতে বাসায় ফিরলো। আবার আমাকে মিথ্যেও বলল। ভিষণ কান্না পাচ্ছে। তবে নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক আচরণ করলাম। অপেক্ষা করছিলাম রাতুল নিজে থেকে কিছু বলে কিনা! না সে কিছুই বলল না। খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে গেলো। অনেক টা রাগ অভিমান সত্বেও রাতুলের কাছে যেতেই সে বলে উঠলো, নীরা আমি খুব টায়ার্ড, অফিসে কাজের চাপ প্রচুর। আমাকে একটু ঘুমাতে দাও।
সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। নানা কথা মাথায় ঘুরছে। উল্টাপাল্টা চিন্তা গুলো বড্ড ভাবাচ্ছে আমায়। আচ্ছা রাতুল কি আমায় ধোকা দিচ্ছে? আমার একটু একটু করে গড়ে তোলা সুখের সংসারে কি ভাঙন আসছে! হঠাৎ রিহানের সেদিনের কথা টা মাথায় এলো। আচ্ছা সীমা কি কিছু জানে! আমার কি সীমাকে কিছু জিজ্ঞেস করা উচিৎ! টানা দুদিন এসব ভেবেই কাটিয়ে দিলাম। আর ভাবছিলাম এই বুঝি রাতুল আমায় কিছু বলবে। কিন্তু না ও কিছুই বলছে না। দুদিন পর রাতুল অফিসে যাওয়ার পরপরেই আমিও বের হলাম। রাতুলের অফিস বাসা থেকে কাছেই। রিক্সায় যেতে ২০মিঃ এর মতো লাগে। কিন্তু রাতুল রিক্সায় না উঠে সিএনজি তে উঠল। রাতুল যাচ্ছে টা কই?
ওর পিছনে সিএনজি তে আমিও ওকে ফলো করতে লাগলাম। সিএনজি যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। অনেক টা দূরে একটা হাসপাতালের কাছে এসে থামলো। রাতুল হাতপাতালের ভিতরে ঢুকতেই আমি ও সিএনজি থেকে নামলাম। এখানে কে আছে! কার কি হয়েছে? রাতুল আমাকে কেন কিছু জানাচ্ছে না? রিসিপশনে গিয়ে রাতুলের নাম বলতেই যা জানালো তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। অনেক টা রাগ ক্ষোভ নিয়ে বের হয়ে আসলাম সেখান থেকে। শেষ পর্যন্ত রাতুল আমায় এভাবে ঠকালো। তাও আমারই বান্ধবী সাথে মিলে আমার পিঠ পিছে ওরা এসব নোংরামি করে বেরিয়েছে। ছিঃ! ভাবতেই ঘৃণা এসে যাচ্ছে আমার। কম ভালোবাসিনি আমি রাতুলকে। বাবা মা’র অমতে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম। কিছুই ছিল না ওর। দু’জনে মিলে সব টা গুছিয়েছি।
আচ্ছা রাতুল বাচ্চা পছন্দ করে সেটা আমি জানি। কোন মেয়ে চায় না মা হতে! আমিও চেয়েছিলাম। কিন্তু সে ভাগ্য আমার হয়ে উঠছিল না। নানা চিকিৎসার পরেও ডাক্তার বলতে পারছিল না সমস্যা টা কার। একটা সন্তানের জন্য দিনের পর দিন চোখের জল ফেলেছি আমি। রাতুল আমায় তাহলে এতদিন মিথ্যে স্বান্তনার দিয়ে গেছে। কি বোকা টাই ছিলাম আমি! রাতুল কে আমি নিজে বলেছিলাম আরেকটা বিয়ে করতে, কিন্তু ও তখন কিছুতেই রাজি হয়নি। বারবার বলেছে আমি ওর পাশে থাকলেই হবে ওর আর কিচ্ছু চাই না। সব মিথ্যে ছিল সব! আমাকে একবার বললেই হতো, এত লুকোচুরির কিছুই ছিল না।
যাক ওর ইচ্ছে টা তো সার্থক হলো আজ। হ্যাঁ রিসিপশনের ওই লোক আমাকে জানায় রাতুল এখানে কেন এসেছে! এখনে নাকি ওর স্ত্রী ডেলিভারির জন্য ভর্তি হয়েছে দুদিন আগে। তাও সে কে! আমার কাছের বান্ধবী সীমা। ছিঃ! কিভাবে পারলো ওরা এসব। ওই খান থেকে আর বাসায় যাইনি। সারাদিন রাস্তার পাশে বসে ছিলাম। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে কেউ নেই এই দুনিয়ায় আমার, সবাই নিজের টা ভাবে। আমি রাতুল কে মুক্তি দিয়ে দেবো আজই।
সীমার ডেলিভারি আজ নিশ্চয় রাতুল আজ বাসায় ফিরবেনা। আমি চলে যাবো অনেক অনেক দূরে। বাসায় গেলাম। হ্যাঁ রাতুল এখনো বাসায় ফিরেনি। দরজার তালা খুলতেই আমি চমকে যাই। বাসা টা কি সুন্দর করে সাজানো। ফ্লোরে ফুল দিয়ে সাজানো। আমি ভিতরে ঢুকতেই দেয়ালে চোখ গিয়ে আটকালো। “ওয়েল্কাম নিউ বোরন বেবি এন্ড হার মাম্মা” কি সুন্দর করে সব টা সাজানো। এ সব কিছু সীমা আর তার বেবির জন্য। হয়ত আজকে রাতুল আমার কাছে সব টা কনফেশ করতে আগ্রহী। কিন্তু সেই সুযোগ টা আমি আর ওকে দেবো না। ভালো থাকুক ওরা। ব্যাগ টা হাতে নিয়ে বের হতে নিতেই রাতুল এসে গেলো।
– কোথায় যাচ্ছো নীরা?
– জানিনা কোথায় যাচ্ছি। তবে তোমাদের স্বপ্ন পূরনের রাস্তা করে দিয়ে যাচ্ছি। যেতে দাও আমায়।
– আমার স্বপ্ন পূরন যে তোমাকে ঘিরেই। তুমি ছাড়া সব শূন্য।
– মিথ্যে, সব মিথ্যে!
– আমাদের নতুন বেবিকে কোলে নিবেনা?
-আমাদের? হা হা হা! বলো তোমার আর সীমার।
রাতুল এবার মুচকি হাসতে লাগলো। রাগে আমার গা জ্বলে যাচ্ছে। রাতুল কে সরিয়ে দিয়ে আমি যেতে নিতেই সে আমায় টেনে তার কাছে নিয়ে এলো। আমি ওর থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই পারছিনা।
– তুমি কিভাবে ভাবলে আমি তোমার ভালোবাসা অন্য কারো সাথে ভাগ করব?
– সেটাই তো করেছো। আমি সব জানি। এই বলেই এতক্ষণের আটকে রাখা কান্নার স্রোত বইতে লাগলো আমার চোখে।
– না তুমি ভুল জানো। সীমার কনসিভ করেছে তোমাকে জানাতে পারেনি লজ্জায়।
আর তুমি ভেবেছ ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক রয়েছে! না রাসেল সীমাকে ধোকা দিয়েছে। ওরা এক্টা ভুল করে ফেলছিল যার ফসল এই বাচ্চাটা। সীমা আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল কারন রাসেল ওকে মেনে নিচ্ছিল না। রাসেল আগে থেকেই বিবাহিত।
আমি চাইনি ওদের ভুলের জন্য কারোর প্রাণ যাক। তোমার আমার তো এক্টা বাচ্চার দরকার আমরা তো পারি সীমার বাচ্চাকে নিজেদের করে নিতে। আর সীমাকেও সব টা কাটিয়ে ওঠার এক্টা সুযোগ দিতে। সব কিছু শুনে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারছিলাম না। রাতুল কে জড়িয়ে ধরে কান্না করেই যাচ্ছি। সব ঝামেলা রাগারাগি মান অভিমান দূরে সরিয়ে আমরা গেলাম আমাদের নতুন বেবি কে নিয়ে আসতে। সীমা আমাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালো আর আমরাও পেয়ে গেলাম আমাদের সুখের সন্ধান। আমাদের বাবু সংসার টাই কেমন পরিপূর্ণ তা এনে দিয়েছে। সত্যি ভালো থাকার জন্য আর কি বা চাই!