বাসর ঘরে বসে যখন নিলু শুনলো সে আনিসের দ্বিতীয় বউ তখন শুধু ঘোমটা উঁচু করে ফুপু শাশুড়ীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে। হনুফা বেগম এক গাল পান মুখে দিয়ে চাবাতে চাবাতে বলতে লাগল,
___ ” বুঝচ্ছ নয়া বউ আনিসের আগের বউটা বড়ই খারাপ কিসিমের আছিল। মুখে মুখে তর্ক করত, শেষ পর্যন্ত গলায় দড়িই দিয়া বসল। ছেলেরা জিদ করলে হয় বাদশাহ আর মাইয়া মানুষ জিদ করলে হয় বেশ্যা।ওর আগের বউডাও এমনই আছিল”।
নিলু কিছু না বলে ঠোঁট কামড়িয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে লাগল। সৎ মায়ের সংসার থেকে এসে আরেক জনের দ্বিতীয় বউ হয়ে বসেছে সে। এর চেয়ে আর কিই বা থাকতে পারে একজন মানুষের জীবনের কষ্ট। ফিরে যাওয়ারও যে কোন উপায় নেই ওর কাছে। কই যাবে ও। সৎ মা কাঁধ থেকে নামিয়ে বেঁচেছে। নিলু বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। হনুফা বেগম আরো কিছু কথা বলেই বিদায় নিল। নিলুর শাশুড়ী প্যারালাইজড একদম বিছানা ধরা। এসব বিয়ের আগেই ওকে বলা হয়েছে। নিলু বেশ খানিকক্ষন অপেক্ষা করেও যখন দেখলো আনিস আসছে না তখন একটু উঠে দাঁড়ালো। ধীর পায়ে রুমের দক্ষিনের জানালা ধরে আকাশ দেখতে লাগল। নিলুর বয়স যখন তিন ওর মা দুম করেই মরে গেল।
নিলুর বাবা মাস ঘুরতেই নিলুর দোহাই দিয়ে আবার বিয়ে করে নিয়ে আসলেন। তখন থেকেই নিলু বুঝে গিয়েছিল পৃথিবীতে ভালবাসা নামক জিনিসটার যে বড়ই অভাব। সৎ মায়ের অবহেলা অত্যাচার এসবের মধ্যেই নিলুর বড় হয়ে ওঠা। আর এখন তাকে বিয়ে দিয়ে দিল এক বিপত্নীক লোকের সাথে। খুব টাকা পয়সার মালিক নাকি আনিস তাই প্রস্তাব আসার সাথে সাথেই নিলুর বাবা মা হ্যাঁ বলে দিয়েছিল। সারাজীবন গ্রামের টিনের ঘরে থাকা নিলু আজ শহরের উন্নত এক আলিশান ফ্লাটের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের হিসাব কষায় ব্যস্ত। নিলুর চোখে পানি আর ঠোঁটের কোণায় হাসি চলে এলো। এই বুঝি জীবন একটু পরেই নিলু টের পেল দরজা খুলে যাচ্ছে। আনিস ঘরে ঢুকেই নিলুকে জানলার পাশে দাঁড়ানো দেখে তেতে উঠলো। নিলু আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে আনিসকে সালাম করতে যাবে এমন সময় আনিস ওর থুতনী ধরে জোরে উঁচু করে ধরল। হিসহিসিয়ে বলল,
___ ” কি রে কোন নাগরকে ছেড়ে এসেছিস তুই?? এত রাতে তোর জানলার পাশে কি? ফষ্টিনষ্টি করার জায়গা পাশ না তাই না নিলু অবাক হয়ে আনিসের দিকে তাকিয়ে রইল। কি কি যে বলছে আনিস ও তাই বুঝতে পারতেছে না। আস্তে করে বলল,
___ ” আকাশটা দেখছিলাম একটু ”
___ ” ওরে আমার আকাশ দেখা রে, যদি আর কখনও দেখেছি তুই জানালার পাশে গেছিস তাহলে দেখিস কি করি তোকে”। এই বলেই আনিস ওয়াশরুমে ঢুকল ফ্রেশ হতে। নিলু যদন বরফ হয়ে গেছে। কান্নার বোধটুকুও যেন পাচ্ছে না ও। আনিস বের হয়েই আবার বলল,
___ ” যাও যেয়ে চেঞ্জ করে শুয়ে পড়ো। ”
নিলু যন্ত্রচালিত মানুষের মত সোজা যেয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। পানিটা ছেড়ে দিয়েই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো ও। উপরওয়ালা কি এতই পরীক্ষা নেবে ওর। পরের দিন থেকে শুরু হল নীলুর নতুন জীবন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাঁড় ভাঙ্গা খাঁটুনী। সারাদিন কাজের পরেও যেন শান্তি নেই ওর রাতে পান থেকে চুন খসলেই চলে অত্যাচার। প্রথম দিন যেদিন আনিস এক থাপ্পড় মেরেছিল ও কাঁত হয়ে পড়ে গিয়েছিল বিছানায়। এক হাতে মুখের বাঁ পাশে চেপে ধরে ভাবছিল ওর অন্যায় কোথায়৷ ওকে মারছেই বা কেন। এসব কিছু ভাবার আগেই আবারও আনিস টেনে ওকে তুলে আবারো সজোরে চড় মারলো। বেশকয়েক বার মারার পরে নিলুকে খাটের উপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে চলে আনিস। এর পর থেকে নিয়ম করেই চলত এই অত্যাচার। বেশ কিছুদিন পরে নিলু টের পেল ওর ভিতরে অন্য এক স্বত্তার। খুশিতে যেন ও পাগল হয়ে যায় যায়। আসলেই মাতৃত্বের অনুভব প্রতিটি মেয়ের জন্যই অতুলনীয়। সেদিন খুশিতে আনিসকে জড়িয়ে ধরে বলল,
___ ” আপনাকে একটা কথা বলার ছিল “।
আনিস বেশ অবাক হল নিলুর আচরনে। নিলুতো কখনও এমন করে না। চোখের ভ্রু কুঁচকে নিলুর দিকে তাকিয়ে বলল,
___ ” কি কথা শুনি?”
___ ” আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।” প্রথমে যেন আনিসের বিশ্বাসই হতে চাচ্ছিল না পরে আবার বলল,
___ ” কি বললে তুমি?”
___ ” আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।”
নিলুর কথা শুনে খুশিতে আনিস কোলে তুলে নিল ওকে। আনিসের বহু দিনের কাংখিত স্বপ্ন পুরন হতে যাচ্ছে। তারপরের দিন গুলো নিলুর কাছে যেন স্বপ্নের মত লাগতে লাগল৷ আনিস সারাদিন নিলুর পাশাপাশিই থাকে। ওর যত্ন আনিসের ব্যবহার সবই যেন পাল্টে গেল। রাজরানীর মত দিন কাটতে লাগল ওর। নিলুর মন বলতে লাগল এই বুঝি কষ্টের দিন শেষ হল ওর। কিন্তু বিধাতা যার কপালে নিজ হাতে কষ্ট লেখেছে তার কষ্ট কি এত অল্পতে শেষ হয়? নিলুর ফুটফুটে এক পরীর মত মেয়ে হল কিন্তু আনিস মেয়েকে দেখতে হসপিটালে পর্যন্ত এলো না। বাসায় এসে আনিসের মুখ দেখেই নিলু বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। আনিসের কোলে মেয়েকে দিতে গেলেই আনিস সরে যেয়ে বলল,
___ ” মুখ পুড়ি এখান থেকে সরে যা তোর মেয়েকে নিয়ে। আমি মেয়ে দিয়ে কি করব। আমার দরকার ছেলে…. না হলে আমার বংশ রক্ষা করবে কে?”
নিলু আঁচলে মুখ ঢেকে চোখের পানি ফেলতে লাগল। এর পর নিলুর জীবন আগের মতই চলে লাগল। পর পর তিন তিনটে মেয়ের মা হয়ে নিলুর উপরের অত্যাচারের মাত্রা যেনো আরো বেড়ে গেল। একদিন হঠাৎ করেই সিঁড়ি থেকে পড়ে আনিসের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে গেল। মাথায় প্রচন্ড আঘাতের কারনে বাক শক্তিও চলে গেল। সংসারের হাল তখন শক্ত করে ধরল নিলু। স্বামীর সেবা মেয়েদের সামলানো আর ব্যবসার দেখাশোনা করা। নিলু যেন রোবটের মত হয়ে গেল।
দিন কেটে যেতে লাগল দিনের মত৷ নিলুর জীবন থেকে চলে গেল আরো বাইশটা বসন্ত। সেদিনের কিশোরী নিলু আজকে আধাপাকা চুলের মালকিন। আজকে নিলুর বড় মেয়ের বিয়ে। তিন মেয়েকেই পড়ালেখা করিয়েই আত্মনির্ভর করেছে ও। মেয়েকে বিদায় দিয়ে সব কাজ কর্ম শেষ করে নিলু আনিসের রুমে এসে ঢুকলো। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আনিসের পাশে বসতেই আনিস চোখ খুলে তাকালো। নিলু আনিসের দুই চোখে আগুন দেখতে পেল। নিলু আনিসের হাত ধরে বলল,
___ ” আজকে আপনার বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে আসলাম। জানেন ছেলে মস্ত বড় অফিসার। মেয়েকে অনেক সুখে রাখবে। আপনি দোয়া করবেন।” আনিস চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। নিলু আনিসের মুখের সামনে মুখ এগিয়ে নিয়ে আসল। ফিসফিসিয়ে আনিসের কানে কানে বলল,
___ ” আপনার মত পিচাশ না কিন্তু আমার মেয়ের জামাই। আর যদি কখনও আপনার মত ব্যবহার করে আমার মেয়ের সাথে তাহলে আপনাকে যা করেছি তাই করব ওর সাথেও।” নিলুর চোখ ধক করে জ্বলে উঠলো। আনিসের চোখে ভয়ের দৃষ্টি দেখা দিল। কারন ওই দিন নিলুই আনিসকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল সিঁড়ি থেকে। নিলু মধ্য রাতে আকাশের দিকে চেয়ে রয়েছে চোখ ভর্তি পানি আর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি নিয়ে। পৃথিবীর সবার চোখেই শান্তির ঘুম আছে কিন্তু এমন হাজারো নিলুর চোখ ভর্তি পানিও যে আছে।