বেকার দর্শক

বেকার দর্শক

পাঁচশত টাকার একটি নোট আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে মা বললেন, “যা! এক কেজি পেঁয়াজ, এক কেজি রসুন আর বাকি টাকার আদা নিয়ে আয়।”

মায়ের কাছ হতে টাকাটা নিয়ে বাসা হতে বের হলাম। বাসা হতে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে চৌরাস্তার মোড়টাতে আসলাম। দেখি রাস্তায় বিশাল জ্যাম লেগেছে। আমার জ্যাম দেখতে বেশ ভালো লাগে। ভাবলাম কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে জ্যাম দেখা যাক। পকেটে রাখা পাঁচশ টাকাটার দিকে আবার তাকালাম। পেঁয়াজ এবং রসুন কেনার পর বাকি টাকা দিয়ে মা আদা আনতে বলেছেন। আর এই বাকি টাকাটাই আমার অর্থ উপার্জনের উৎস। বাকি টাকা হতে কিছু টাকা সরিয়ে তারপর আদা কিনতে হবে।

তবে একবার এইভাবে অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে আচ্ছামতো ধোলাইও খেয়েছিলাম। তখন ক্লাস নাইনে পড়তাম। একদিন মা দেড়শত টাকা আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ” যা তেল নিয়ে আয় এক লিটার। বাকি টাকা দিয়ে মরিচ আনবি। ” আমি জানতাম তেলের লিটার একশত টাকা। আর ত্রিশ টাকার মরিচ কিনবো ভেবে বাকি বিশ টাকা দিয়ে আইসক্রিম কিনে খেয়েছিলাম। কিন্তু তেল কিনতে গিয়ে দেখি তেলের দাম একশ ত্রিশ টাকা।

এদিকে পেটের ভেতরের আইসক্রিমও আর ফেরত দেওয়া সম্ভব না। বাসায় গিয়ে মাকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মিথ্যা বলতে গিয়ে ধরা খেয়ে যাই। মা সেদিন কাপড় ধোয়ার মতো করে ধুয়েছিলেন আমাকে। এসব ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম আমার সামনে একটি রিকশা এসে দাঁড়িয়েছে। রিকশায় সুন্দরী এক আপু বসেছেন। তিনি পায়ের উপর পা তুলে সেই পা আবার রিকশাচালকের আসনেও তুলে রেখেছেন।

ব্যাপারখানা বেশ অদ্ভুত ঠেকলো আমার কাছে। এই রিক্সাওয়ালা কি সিটে বসেন না? নাকি আপুটাই উনাকে বলেছেন, “আপনি সিটে বসবেন না। দরকার হলে আপনাকে দশ টাকা বাড়িয়ে দিব। এইভাবে পা তোলা ছাড়া আমি বসতে পারি না।” রিক্সাওয়ালাও সিটে না বসেসে প্যাডেলে ভার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কি হবে তা দেখতে বেশ ইচ্ছে করছে আমার। সারাদিনে আর কোনো কাজ নেই তাই দাঁড়িয়ে রইলাম।

মেয়েটা মোবাইল বের করে সেলফি তুললো কয়েকটা। এরপর এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। পা এখনও সিটের উপর তুলে রেখেছে। এরপর হঠাৎ আমার দিকে তাকালো। হয়ত বুঝতে পেরেছে আমি তার দিকে মনযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। আমি অন্যদিকে তাকানোর ভান করলাম। এদিকে শেষটুকু দেখার জন্য নেশায় পেয়ে বসেছে আমাকে। পকেট থেকে পাঁচশ টাকার নোটটা বের করে খানিকক্ষণ এদিকওদিক করে আবার ঢুকিয়ে রাখলাম। জ্যাম এখনও রয়েছে। মেয়েটার দিকে আবার তাকালাম। এবার বেশ বিরক্ত মনে হলো তাকে। এমন সময় গাড়ি সামনের দিকে আগাতে লাগলো। রিক্সাওয়ালা সামনের দিকে প্যাডেলে ভার দিয়েই সিটে বসে পড়লেন।

আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখলাম মেয়েটা, “ওমাআআআআআরে ” বলে বিরাট এক চিৎকার দিয়ে রিকশা হতে রাস্তায় পড়ে গেল। আমি তাড়াতাড়ি সেখানে দৌড়ে গেলাম। আমি পৌঁছানোর আগেই জনতার ভীড় জমে গেল সেখানে। চৌরাস্তার মোড়েই একটা ছোট্ট হাসপাতাল আছে। কয়েকজন ধরাধরি করে মেয়েটাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমিও পিছুপিছু সেখানে গেলাম। রিক্সাওয়ালাটা ভয়ে ভয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

হাসপাতালে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মেয়েটার জ্ঞান ফিরল। ডাক্তার কিছুক্ষণ দেখেশুনে বলল মেয়েটার পায়ের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছে। মেয়েটা সবার মুখের দিকে আস্তে আস্তে তাকালো। আমার মুখের উপর তার দৃষ্টি স্থির হলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। হয়ত কিছু বুঝতে চাইছে। এরপর রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল, “আপনি যেখান হতে আমাকে তুলেছেন সেখানে নামিয়ে দিয়ে আসুন।” এরপর হঠাৎ রেগে গিয়ে প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে মেয়েটা বলল, “আপনি সিটে দেখে শুনে বসতে পারেন না! চোখ কি হাতে নিয়ে রাখেন!” মেয়েটা খুব রেগে গিয়েছে বোঝা যাচ্ছে। চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছে।

রিক্সাওয়ালা অনেকক্ষণ ধরেই আমতা আমতা করল। এরপর তোতলাতে তোতলাতে আস্তে করে বলল, “ছরি আফা! সিডের ঘষায় ঘষায় পাছাডা শক্ত অইয়া গ্যাছে!” আমি দেখলাম মেয়েটার চোখ আবার ছোট হয়ে আসছে। হয়ত আবার জ্ঞান হারাবে। এদিকে শেষে কি হয়ে তা দেখার জন্য আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত