বাসের ঝাঁকিতে রুপার ওড়না বুক থেকে কিছুটা সরে গেলো। সাথে ওর ঘুমটাও ভেঙ্গে গেলো। চোখ মেলতেই দেখলো বাসের কন্ট্রেকটার লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে তাকে দেখছে। চোখে চোখ পড়তে সে বিশ্রি ভঙ্গিতে হাসলো। রুপা ওড়না দিয়ে তার পুরো শরীর ভালো করে জড়িয়ে নিলো। মনে অজানা ভয় কাজ করছে। ঢাকা থেকে গাজীপুর গামী একটি বাসে উঠেছে সে। গার্মেন্টস ছুটি দিতে আজ অন্যদিনের তুলনায় বেশি দেরী করে ফেলেছে। অন্যসময় সন্ধ্যার আজান দেওয়ার সাথে সাথে ছুটি দিয়ে দেয়।
আজ আজানের ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ছুটি দিয়েছে। এত রাত করে গাজীপুর রওনা হওয়ার একটাই কারন, আগামীকাল তার বড় বোনের বিয়ে। গতকাল নিউ মার্কেট থেকে একটি টকটকে লাল বেনারসি কিনেছে রুপা। নিজ রোজগারে কেনা বেনারসি পড়ে বউ সাজবে তার বড় বোন। মেয়েটার চোখের সামনে সেই দৃশ্য ভেসে উঠছে বারবার। ঠোঁটের কোণে ভেজা হাসির চিহ্ন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আগামীকাল তার বোনকে কতটা সুন্দর লাগবে সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে রুপা। তাদের অভাবী সংসার হলেও বোনের জন্য আগত সম্বন্ধ মন্দ ছিলো না। হবু স্বামী বেশ ভালো বেতনের চাকরিই করে। কন্ট্রেকটরের ভরাট গলায় চেতনা ফিরে পেলো রুপা।
” আপা, আপনার পেছনে যাইয়া বসতে হইবে।”
” ক্যান? পেছোনে যাইয়া বসুম ক্যান সামনে সিট থাকতে?”
” আসলে এই সীট আগের থিকাই বুক কইরা থুইছে একজন। হেরে উঠাইতে হইবে।”
” সে আগে আসুক। তারপর উইঠা যামু নে।”
” না আপা, অহনই উঠা লাগবো।”
কন্ট্রেকটার ব্যাপক পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলো। উপায় না দেখে রুপা আর কথা বাড়ালো না। একদম বাসের শেষ সীটগুলোর একটিতে গিয়ে বসলো। সেখানে আরো দুইজন মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছে। গাড়ি চলতে লাগলো আপন বেগে।
কিছুক্ষণ পর দ্বিতীয় কন্ট্রেকটর পুরো বাসের যাত্রীদেএ একটি করে পানির বোতল দিয়ে যেতে লাগলো। রুপা লক্ষ করলো তার পানির বোতলের মুখা আগের থেকেই খোলা। ” ভাইজান, আমার বোতলের মুখ তো খোলা! পাল্টায়ে দেন।” ” আফা, আর তো পানির বোতল এক্ট্রা নাই। এইডাই খাইতে হবে। কোনো সমস্যা নাই পানি ভালো। আগের একজন যাত্রী খাওয়ার জন্য মুখা খুলছিলো কিন্তু হেতি খায় নাই।” রুপা এবারো কিছু বললো না। বোতলটা নিজের কাছে রেখে দিলো।
রাত তখন ৯ টার বেশি। গাজীপুর পৌঁঁছাতে আর মাত্র পঁনেরো থেকে বিশ মিনিট বাকি। রুপার প্রচন্ড তেষ্টা পেয়েছে। বোতলটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো সে। তারপর থেকেই মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। কারণটা বুঝতে পারলো না সে। এর মধ্যে দ্বিতীয় কন্ট্রেকটার একবার এসে ঘুরে দেখে গেলো। রুপার অবস্থা দেখে মুচকি হাসলো সে তারপর ফিরে গিয়ে প্রথম কন্ট্রেকটার এবং ড্রাইভারকে ফিসফিস করে কিছু একটা বললো। তাদের তিনজনের চোখ মুখেই রহস্যময় হাসি। রুপা বাসের বন্ধ জানালায় হেলান দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় হারিয়ে গেলো।
রাতের দ্বিপ্রহর শুরু হয়েছে তখন। জঙ্গলে কুকুর কান্না করছে। রুপাও কাঁদছে। তবে তার কান্নায় তেমন শব্দ নেই! কাপড় দিয়ে শক্ত করে মুখ বাঁধা তার। মুখ থুবরে ফেলে রাখা হয়েছে তাকে। হাত দুটো পেছোনে গামছা দিয়ে বেঁধে রাখা। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে গোঙ্গানির মতো আওয়াজ বের হচ্ছে। গায়ে এক টুকরো কাপড় নেই। গত দুই ঘন্টা ধরে পালাক্রমে ধর্ষণের শিকার হয়ে আসছে সে। আরো এক ঘন্টা রুপার ওপর নির্যাতন চালানোর পর ড্রাইভার হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, “কাম শেষ। এখন এইডারে শেষ করতে হইবো। ছাইড়া দিলে পরে যদি কেইস কাসারিতে ফাঁসি?” প্রথম কন্ট্রেকটার বললো, ” এক্কের কথা কইছেন ভাই। এসব মাইয়া মানুষ বিশ্বাস নাই।” একথা বলে প্রথম কন্ট্রেকটার দ্বিতীয় কন্ট্রেকটারের দিকে তাঁকিয়ে ইশারা করলো।
দ্বিতীয় কন্ট্রেকটার এক গাল হেসে পকেট থেকে ছুঁড়ি বের করলো। রুপার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে। সে চিৎকার করে মনে মনে বলছে “ব্যাগে আমার বোনের শাড়ি! আমার বোনডার বিয়া আগামীকাল। আমার দেওয়া শাড়ি পইড়া সে বিয়ের পিড়িতে বসবে। আমারে মাইরেন না! আমি কেওরে কিচ্ছু কমু না। আমারে যাইতে দেন!” মানুষ আরেকজনের মনের কথা শুনতে পায় না। সেই ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা কাউকে দেন নি। যদি দিতেন তাহলে হয়তো পরের দিন বিয়ে বাড়িতে লাল বেনারসির পরিবর্তে রক্তাক্ত এবং ছিন্নবিচ্ছিন্ন এক ধর্ষিতার লাশ যেতো না!