— “স্বপ্ন কি? মেডিকেল নাকি বুয়েট?”
— “জ্বী আংকেল ভার্সিটি।”
— “বলো কি? ঢাকা ভার্সিটি?”
— “জ্বী না আংকেল। নির্দিষ্ট কোনো নেই। একটা পাবলিক ভার্সিটি হলেই হলো।”
আংকেল আমার কথা শুনে প্রথমে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন। তারপর উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলেন। একবার হাসছেন। একবার থামছেন। হাসি থামিয়ে হয়তো আমায় কিছু বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু পারছেন না। আমি বললাম,
— “আংকেল আগে হেসে নিন। হাসি মনকে ফ্রেশ করে। সবসময়ই বুঝি হাসেন?” আংকেল আমার কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলো না। উনি হাসি থামানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। বাঁ হাতের সিগারেটটায় মৃদু ধোঁয়া উড়ছে। একটা লম্বা টান দিলেন। বাতাসে ধোঁয়া ছাড়লেন। আমায় খুব শান্ত স্বরে বললেন,
— “আমার মেয়ে মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হতে চায়। তুমি তাকে কি বলেছিলে? মনে আছে?”
— “জ্বী আংকেল। স্বপ্ন বড় করতে বলেছিলাম।”
— “এটাকে সঠিক “বলা” বলে না। এটাকে উপদেশ দেওয়া বলে। তুমি আমার মেয়েকে উপদেশ দিয়েছিলে।”
— “উপদেশ দেওয়া তো ভালো। আমি সবসময় ভালোকে গ্রহণ করি। খারাপকে বর্জন করি।”
— “তো তোমার স্বপ্নও তো দেখছি কম বড় না?
তোমার বাবার তো অনেক গল্প ! ছেলে হ্যান হবে ত্যান হবে ! ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ ছেলের স্বপ্ন যে একটা পাবলিক ভার্সিটিতে পড়া তা কি তোমার বাবা জানে? আজকাল তো পাবলিক ভার্সিটিতে পড়া মানেই বেকার হয়ে ঘরে বসে থেকে মোবাইল টেপা।”
— “আংকেল…”
— “জ্বী।”
— “আমি কিছু কথা বলবো।”
— “বলো।”
— “কিন্তু আমার প্রত্যেকটা কথাই নিজের অজান্তেই বেয়াদবি হয়ে যায়। তাই কোনো কথায় বেয়াদবি হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।”
— “বাহ! কত সুন্দর মিষ্টি কথা! এই কথা কিভাবে বেয়াদবি হয়? পাথর সোনা হইছে এটা বিশ্বাস করবো কিন্তু তুমি বেয়াদবি করতে পারো এটা বিশ্বাস করবো না।”
— “আংকেল চা খাবো। অর্ডার দিন।”
আংকেল চায়ের দোকানদারকে দুইটা চা দিতে বললো। রঙ চা। ওনার সিগারেটটা ছোট হয়ে আসছে। তাই সিগারেটটায় একটা শেষ লম্বা টান দিলো। সিগারেটটা নিচে ফেললো। কালো বুট দিয়ে ঘষে সিগারেটের আগুন নিভালো। উনি হয়তো ম্যাচিং জিনিস পড়তে পছন্দ করেন। আজ কালো কোর্ট, কালো শার্ট, কালো প্যান্ট, কালো জুতা পড়েছেন। চেয়ারায় বয়সের ছাপ অতটা স্পষ্ট না। গোঁফ গুলো যতটা সম্ভব বড় রাখা যায়, রেখেছে। মাথার সামনে কয়েকটা চুল নেই। কিন্তু এখনো টাক মাথা বলা যায় না। ওনার মেয়ের সাথে আমার কয়েকবছরের সম্পর্ক। কিন্তু উনি আমায় দেখতে পারেন না। আমাদের সম্পর্ক মেনে নিতে পারেন না। কারণ অনেক। সবথেকে বড় কারণ আমি বেয়াদব। অনেক চেষ্টা করেছেন ওনার মেয়েকে আমার থেকে আলাদা করতে। কিন্তু পারেন নি। আমি বাজারে যাচ্ছি। শীতের দুপুর। তাই গোসলের পর গায়ে কালো চাদর জড়িয়ে বাজারে যেয়ে রোদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষের ভীর দেখতে ভালোই লাগে। হঠাৎ পথিমধ্যে ওনার সাথে দেখা। দোকানদার দুইটা চা আনলো। আংকেল একটা চা নিলো। চা নেয়ার সাথে সাথেই চায়ে চুমুক দিলেন। তারপর বললেন,
— “বলো তুমি কি বলবে?”
— “আংকেল আপনি চা বেশি খান নাকি সিগারেট?”
— “দুটোই।”
— “এসব এতো বেশি খাওয়া ঠিক না। আংকেল…”
— “জ্বী।”
— “যার স্বপ্ন নিয়ে কেউ হাসাহাসি করে না।
বুঝতে হবে তার স্বপ্ন খুব ছোট। ধরেন কেউ আপনার মেয়েকে আদুরে স্টাইলে প্রশ্ন করলো, মা তুমি বড় হয়ে কি হবে? আপনার মেয়ে তখন গর্বের সাথে উত্তর দিচ্ছে, ডাক্তার হবো। তখন সেই মানুষটি কি বলবে? জানেন? বলবে, বাহ! কি সুন্দর! কি সুন্দর! ডাক্তার হওয়া তো খুব ভালো। আবার ধরেন আপনার ছেলেকে কেউ প্রশ্ন করছে, বাবা তুমি বড় হয়ে কি হবে? আপনার ছেলে বললো, ইঞ্জিনিয়ার হবো। তখন সেই ব্যক্তি খুশি হয়ে বলবে, বাহ! ইঞ্জিনিয়ার তো দেশের সম্পদ। হ্যাঁ বাবা। তুমি ইঞ্জিনিয়ার হও। দোয়া করি। কিন্তু আপনার মেয়ে যদি বলতো, আমি একজন গায়িকা হবো। ন্যান্সির মতো বড় গায়িকা। আপনার ছেলে যদি বলতো, আমি এমপি হবো। মন্ত্রী হবো। নেতা হবো। তখন সেই মানুষটি কি করতো জানেন? হা হা করে হেসে উঠতো। তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে বলতো, হ্যাঁ মা। তুমি ন্যান্সি হও, মমতাজ হও, রুনা লায়লা হও। হ্যাঁ বাবা। তুমি এমপি কেন? তুমি মন্ত্রী হও। শুধু মন্ত্রী না। প্রধানমন্ত্রী হও।
এসব বলে ওখান থেকে চলে যেতো। তারপর আড়ালে যেয়ে অন্যের কাছে যেয়ে হাসতে হাসতে ঠিকই বলতো, ওরে বাবা! রফিকুলের বেটা নাকি প্রধানমন্ত্রী হবে! ওরে বাবা, রেজার বেটি নাকি গায়িকা হবে! ওরে বাবা, তাইজুলের বেটা নাকি সাহিত্যিক হবে! ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আংকেল, এসব কথায় এসব তাচ্ছিল্যে কষ্ট পাওয়া যাবে না। বরং খুশি হতে হবে। কেননা তাদের হাসাহাসিতেই আমার স্বার্থকতা। তিনি হাসলেই বুঝে নিতে হবে, আমার স্বপ্ন ঠিক আছে। আমার স্বপ্ন বড়।” আমি এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বললাম। কথা বলার সময় হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলা আমার অভ্যাস। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। আংকেল আমার কথা শুনে কয়েকবার মাথা ঝাকালেন। তারপর দিয়াশলাই বের করে আরেকটা সিগারেট ধরালেন। একটা টান দিলেন। শব্দ করে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর আমায় বললেন,
— “চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। চা খাও।”
— “আর আংকেল মানুষের জীবনের স্বপ্ন মেডিকেল, বুয়েট, ভার্সিটি না।
স্বপ্ন হলো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অন্যান্য পেশা। ভার্সিটির কথা শুনে আপনি হেসে উঠলেন। কিন্তু ভার্সিটিতে পড়ার পর কি হতে চাই সেটা শুনতে চাইলেন না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার অনেক উঁচু একটা পেশা। আমি অসম্মান করছি না। কিন্তু ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া মানে জীবনের স্বপ্ন ওই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার পর্যন্তই। কিন্তু আমি ধরেন ভার্সিটিতে পড়লাম। একটা কলেজের শিক্ষক হলাম। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের চেয়ে ছোট পেশা। আরে তাতে কি হয়েছে? স্বপ্ন তো তখন কেবল শুরু। তখন প্রতিভা গুলো ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব। যার মাঝে যে প্রতিভা আছে সে যদি সেই প্রতিভা শুধুমাত্র জাগ্রত করতে পারে তখন তার কাছে দশটা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কিছুই না। প্রতিভা দিয়ে জীবনে স্বার্থকতা আনা যায়। পড়ালেখা করে নয়। এটা মনে রাখবেন। উঠি এখন। বেয়াদবি হয়ে গেছে। তা জানি। কিন্তু ক্ষমা চাইবো না। যেটা আরেকটি বেয়াদবি। তবুও চাইবো না। আসসালামু আলাইকুম।”
— “তোমার সব কথা বুঝলাম। এবং এটাও বুঝলাম তুমি পৃথিবী খ্যাত লেকচারার…”
— “বুঝেছি আংকেল আপনি এখন কি বলবেন। আসি আমি। আর আমি রঙ চা খাই না। দুধ চা খাই। চিনি বেশি।”
আমি চলে আসলাম। আজকের রোদটা নামে মাত্র রোদ। রোদের কোনো তীব্রতা নেই। বেশ ঠাণ্ডাই লাগছে। চা খেতে ইচ্ছে করছে। এতক্ষণ চা সামনে নিয়ে বসে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো তেঁতুল সামনে নিয়ে বসে ছিলাম।