টুনু মামার জোড়াজুড়িতে অবশেষে আসতেই হলো মেয়ে দেখতে। এসেছি আধঘণ্টা আগে। আমাকে বসিয়ে রেখে মামা উধাও হয়েছেন সেই কখন। তারপর আর আসার নামগন্ধ নেই। সস্তাদরের হোটেল, ভিতরদিকে ধোঁয়া। তাই বাইরে গাছের নিচে পাতা বেঞ্চে বসে আছি। সামনে বছর তেইশের একজন তরুণী বসে আছে। এতক্ষণ মেয়েটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলাম। নিজেকে উপস্থাপন করতে কোনো কমতি রাখেনি। একগাদা মেকাপের ভীরে আসল চেহারা বুঝা যাচ্ছে না। দেশে আজকাল প্রচুর নকল বেড়ে গিয়েছে। সবকিছুতেই দু’নাম্বারি। মেয়েটির ঘর্মাক্ত মুখে মাছি বসছে। বারবার হাত দিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে । মাছের হিসেবে যেসব মাছে মাছি বসে সেসব মাছ টাটকা। আর যেসব মাছে মাছি বসে না তাতে ফরমালিন দেওয়া। কিন্তু যা দিনকাল পড়েছে! আজকাল তো ফরমালিনেই ভ্যাজাল। সরষের মাঝে ভূত আরকি। মেয়েটিকে বলবো নাকি, ‘‘নীলু তোমার উচিত ছিল ফরমালিন মেখে আসা। তাহলে আর মাছি বিরক্ত করতো না।’’
না এভাবে বলা ঠিক হবে না। ভড়কে যাবে। আমার কাজেকর্মে এমনিতেই ভড়কে আছে মেয়েটি। একজন মানুষকে সামনে বসিয়ে রেখে ঘুরে ঘুরে, আঢ়চোখে দেখলে তাতে সবারই ভড়কানোর কথা। নীলু নামের মেয়েটিও ভড়কেছে। হালকা টেনশনও কাজ করছে মনে হয় তার মনে। সেটা বিয়ের চিন্তায় না অন্য কারণে তা জানি না। বাড়িতে হয়তো বলে দিয়েছে, এবার আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে বিয়েটা হলেই বাঁচি। মেয়েটিও মনে প্রাণে খুব করে চাইছে, যেন বিয়েটা এবার হয়ে যাক। অত্যন্ত পছন্দ করে যেন তাকে। বাসায় গেলে সবার বিমোর্ষিত মুখ দেখতে না হয়। পিতার ক্লান্তি ভরা মুখ কত আর সহ্য হয়। মেয়েটি হয়তো এই চিন্তায় ঘামছে। আদৌ কী বিয়ে নামক এই বিশেষ জিনিস তার নসিবে জুটবে!
কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না মেয়েটিকে পছন্দ করা ঠিক হবে কিনা। সচরাচর নীলু নামের মেয়েগুলো শ্যামলা টাইপের হয়। উজ্জ্বল শ্যাম। এরা কোনো অবস্থাতেই যায় না। না সাজলে ভালো দেখায়, না কোথাও বেড়াতে গেলে সুস্থিরবোধ করে। তাই এসব মেয়েরা সাধারণত চার দেয়ালেই বেশি সময় অতিবাহিত করে। তবে এদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, যেমন আছে তাতেই ভালো দেখায়। অনেকটা নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ন্যায়। কারও সাথেও নেই পাঁচেও নেই। বন্যরা বনে, শিশুরা মাতৃক্রোড়েই সুন্দর। টিস্যু এগিয়ে দিলাম। নীলু টিস্যু নিয়ে মুখ মুছে নিলো। মেকাপ উঠে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। তাই আরও একটা টিস্যু দিলাম। লজ্জিত মুখে ভালোভাবে মুছে নিলো মুখের চারিপাশ। যাক এবার অত্যন্ত আসল চেহারা প্রকাশ পেলো। গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম,
‘‘আচ্ছা নীলু এভাবে কে সাজতে বলেছে, তোমার মা?’’
‘‘না, আমার মা নেই।’’
‘‘তাহলে তোমার বোন?’’
‘‘আমার কেউ নেই। যে আশ্রমে থাকি সেখানকার বড় আপা সাজিয়ে দিয়েছেন।’’
‘‘অ নীলু চিন্তিত স্বরে বললো,‘‘তাহলে কী আপনি আমাকে বিয়ে করবেন না?’’মেয়েটির মুখে এমন সরলোক্তি শুনে হাসি পেলো আমার। বললাম,
‘‘এমন কেন মনে হলো তোমার?’’
‘‘আমাদের ওখানকার মেয়েদের বিয়ে হতে অনেক সমস্যা হয় কিনা। যাদের কেউ নেই সেই মেয়েকে কেউ বিয়ে করতে চায় না।’’
নীলুর কথায় লজিক আছে। চালাকচতুর মেয়ে। টুনু মামারও মনে একই চিন্তা। আমারও কেউ নেই, যাকে বিয়ে করবো তারও কেউ নেই। দু’জন দু’জনকে ভালো বুঝবো। অবশ্য আমাদের সমাজে বংশপরিচয় অনেককিছু বহন করে। বেশ্যা আমরাই বানাই, টানাহেঁচড়া আমরাই করি। অশ্রাব্য ভাষায়, কষে দু’একটা গালি দেওয়ার সময় আমরাই দেই। পতিতা থেকে আমরাই বা কম কিসে? আমরা হচ্ছি গিয়ে ভদ্র বেশ্যা। নীলুর কথার প্রত্ত্যুত্তরে হেসে জবাব দেই,
‘‘তাহলে তো আমারও বিয়ে হবে না।’’
‘‘কেন!’’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নীলু।
‘‘কারণ আমারও তো কেউ নেই। বাবা মারা গেলেন মাধ্যমিকের -এর সময়। মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবো। উচ্চ মাধ্যমিকে থাকতে মাও বিদেয় নিলেন। আমার ডাক্তার হওয়া শিকেয় উঠলো। জীবনের তাগিদে অনেক ছোটাছুটির পর জুটলো একটা চাকরি।’’
‘‘ও আচ্ছা।’’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে নীলু। নারীমন। নিজে শত দুঃখের মাঝে থাকলেও অন্যের দুঃখে ব্যথিত হওয়া যার নিত্যকর্ম।
‘‘আচ্ছা এসব বাদ দাও। কী কী করতে পারো। মানে রান্নাবান্না, ঘর-গৃহস্থালীর কাজ?’’
‘‘হ্যাঁ পারি তো। রান্নাবান্না, সেলাই, হাতের কাজ সব।’’
‘‘সুইয়ে সুতা ভরতে পারো তো নাকি?
আমার আবার শার্টের বোতাম ছেড়ে বেশি। সুইয়ে সুতা ঢুকেছে মনে করে যেই না সুতায় টান দিতে গিয়েছি,ওমনি সুই পড়ে যে কোথায় যায় খুঁজেই আর পাই না।’’ নীলু ফিক করে হেসে দিলো। ঝকঝকে সাদা দাঁত। যেন পালিশ করা। দাঁতের মাজনের ভালো বিজ্ঞাপন হবে একে দিয়ে। দাঁত বের করে হাসি দিবে, হাতে থাকবে দাঁতের মাজন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে চেহারা কালো। এযাবতকালে কালো মেয়ে দিয়ে কোনো বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে নাই। বর্ণবাদের আন্দোলন যতই করা হোক না কেন। বিজ্ঞাপনে লাক্স আর কেয়া সুন্দরীরাই থাকে। নীলু হাসতে হাসতে বললো, ‘‘আপনি অনেক মজার কথা বলেন।’’না, মেয়েটার হাসি আসলেই অনেক সুন্দর;কোমল।
-‘আচ্ছা নীলু ধরো তোমার বিয়ে হলো, স্বামীর কাছে কী চাইবে?’
নীলু লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। যখন মাথা উঁচু করলো দেখলাম এক উজ্জ্বল আভা খেলা করছে মুখে। ধীর নিচু কণ্ঠে বললো,
‘‘একটা বাচ্চা।’’
‘‘বাচ্চা কেন!’’
‘‘জানি না’’, বলে লজ্জায় আবার মুখ লুকালো।
আমি বুঝতে পারছি, বংশপরিচয়হীনা একটা মেয়ে অন্য একজনের পরিচয় দেওয়ার কী অদম্য আগ্রহ। যার প্রিয়জন হারায় শুধুমাত্র সেই বুঝে হারানোর বেদনা।ঘড়ির দিকে তাকালাম। প্রায় অনেক সময় হয়ে এলো। টুনু মামা মনে হয় আর আসবেন না।নীলুকে বললাম,
‘‘তাহলে এবার যাওয়া যাক, কী বলো?’’
‘‘হ্যাঁ।’’
‘‘নীলু, মেকাপে তোমায় ভালো দেখায় না।’’
‘‘আমি জানি। আমারও এসব ভালো লাগে না। কেমন ভারি ভারি লাগে।’’ বুঝলাম মেয়েটি আসলেই আলাদা। একেবারেই ভিন্ন। নরম সুরে জিজ্ঞেস করি,
‘‘তোমার কী মন খারাপ, নীলু?’’
‘‘মন খারাপ হবে কেন!’’ বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে সে।
‘‘এইযে তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি।’’
‘‘এতে মন খারাপের কী আছে! এর আগেও কয়েকবার এমন হয়েছে। হয়তো আরও হবে। তাই আর মন খারাপ করি না। যার ভাগ্যে যা আছে, তাই হবে।’’
‘‘এবার যাই তাহলে।’’
‘‘আচ্ছা।’’
নীলু পা বাড়ালো যাওয়ার জন্যে। চারদিকের শব্দের কারণে একটু জোড়েই বললাম, ‘‘নীলু, আমার একটা ছোট্ট নীলু দরকার। দিতে পারবে?’’ ঘুরে দাঁড়ায় নীলু। চোখে অশ্রু টলমল করছে। যেন টলটলে কালো জলে ভরপুর এক দীঘি। যার গভীর কালো জল ভেদ করে আলো প্রবেশ করছে। আশার আলো,বাঁচার আলো;পরিচয়ের আলো।