জীবনের সমাপ্তি

জীবনের সমাপ্তি

–ডাক্তার রিপোর্ট কখন আসবে ? বেশ উৎফুল্ল হয়ে ডাক্তার নীলাকে অর্নব জিজ্ঞেস করছে।

–আর একটু অপেক্ষা করুন।রিপোর্ট চলে আসবে।

ডাক্তার নীলা মৃদু হেসে হাতের কাজ করতে করতেই উত্তর দিলো আমাদেরকে। অর্নব আমার হাজব্যান্ড।বিয়ের প্রায় নয় বছর পর আমাদের প্রথম সন্তান হচ্ছে।কত ডাক্তার, ঔষধ কত কিছুই না করেছি আমরা।কেবল একটা বাচ্চার জন্য।অবশেষে আল্লাহ্ মুখ তুলে চেয়েছেন।ছয় মাসের বাচ্চা আমার গর্ভে।আজ আলট্রাসনোগ্রাফি করতে আসছি।একটু পরই রিপোর্ট হাতে আসবে।অর্নবের চেহারায় রাজ্যের আনন্দ আমি অবাক হয়ে দেখছি।অবশ্য রিপোর্টে ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এটা শোনার জন্য আমার মধ্যেও অধিক কৌতুহল কাজ করছে। এইতো সেদিনের ঘটনা অর্নব একই মাপের কতগুলো জামা হুট করে নিয়ে এসে বসলো।যতগুলো জামা নিয়ে আসছে ও, তাতে করে বেবিকে নিয়ম করে তিনবেলা ড্রেস চেইঞ্জ করে পরাতে হবে।নতুবা এই জামা শেষ করতে প্রায় এক বছর সময় লেগে যেতে পারে।এখন, এক বছরতো আর বাচ্চা একই মাপের থাকবেনা।ওকে সেটা বুঝানোর জন্যই বললাম,

–অর্নব, বাচ্চার জন্য আর কত একই মাপের ড্রেস কিনবা, বলো তো?তাছাড়া এত জামাকাপড় দিয়ে কি করবো? আমাদের বাচ্চাতো ক্রমশই বড় হয়ে যাবে তাইনা?

–বড় হলে আরও কিনবো।সমস্যা কি ? আমার সন্তানের জন্য আমি সব কিছুই করতে পারবো। বুঝলে মিসেস রহমান?

–তুমি পারও বটে।আচ্ছা শোনো আজ ফেরার পথে আমার জন্য কয়েকটা ঢিলেঢালা জামা নিও তো।অবশ্য মনে করে চেইনওয়ালা নিবা।

–আচ্ছা।আর কিছু লাগবে ? টাই বাঁধতে বাঁধতে সে আমায় প্রশ্ন করলো।

–না। সাবধানে এসো। সেদিন সন্ধ্যায় রাজ্যের খেলনাপাতি নিয়ে এসে উঠেছে সে।একটা একটা করে হাতে নিচ্ছে এবং প্র্যাকটিক্যালি আমাকে দেখাচ্ছে আর বলছে,

–দেখো অনু, আমাদের সন্তান এটা নিয়ে এভাবে খেলবে,ওটা নিয়ে ওভাবে খেলবে।

আমি ওর বাচ্চাদের মত আচরণ দেখে ভীষণ খিলখিল করে হেসেছি সেদিন। বাচ্চা কনসিভ করার পর প্রতি মাসেই চেকআপে যাই। আমাদের পারিবারিক ডাক্তার হলেন নীলা।তিনি প্রায়ই বলতেন, বাচ্চা কনসিভ করার পর একজন মায়ের ওজন যতটুকু প্রয়োজন আমার ওজন সেই পরিমাণের চেয়ে কম।আর নতুবা বাকি সব ঠিক আছে। প্রেগন্যান্সির পাঁচ মাস শেষ।এর মধ্যে একবার আলট্রাসনোগ্রাফি করেছিলাম।উনারা বলেছেন ক্লিয়ার হয়নি এখনো।তাছাড়া বাচ্চার ওজন কম। এখন ছয় মাস প্রায় শুরু। অর্নব প্রায় এসে বলতো,

–অনু,বাচ্চা হাত পা নাড়ায় ? তোমার কষ্ট হয় ? অনু তুমি ওর কথা শুনতে পাও ?

–অর্নব , ও এখনো পিচ্চি । কথা কিভাবে শুনবো বলো? তুমিও না !

পাগলটাকে মাঝে মাঝে ধমক দিয়ে বসতাম।এত জ্বালায় আমাকে, রোজ সে নিজেই এসে চেক করতো। বাচ্চার হাত পা খুঁজতো,আমার পেটের উপর হাত দিয়ে।সে রিয়েলাইজ করতে চাইতো।মাঝেমাঝে এক লাফে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলতো, এইতো বাচ্চার হাত, এইতো পা! আজ যখন অর্নব অফিসে যাচ্ছিলো তখন ওকে বললাম,

–অর্নব, আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে ?

–কেন ?

–আজ একবার ডাক্তার নীলার চেম্বারে যাবো।আলট্রাসনোগ্রাফি করবো।ছয়মাস তো শুরু হলো বলো।একটু তাড়াতাড়ি অফিস শেষ করো।

–আচ্ছা। এটা বলেই অর্নব অফিসে চলে যায়। অফিস শেষে এখন সে আমাকে নিয়ে ডাক্তার নীলার চেম্বারে এসে বসেছে।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর রিপোর্ট আসলো।বেশ কৌতুহল হয়ে আমরা দুজন দুজনকে দেখছি।

–ডাক্তার রিপোর্টে কি আসছে ? ছেলে নাকি মেয়ে ? অর্নব ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে প্রশ্ন করলো।

–আপনাদের মেয়ে হবে। ডাক্তার নীলা গম্ভীর চেহারায় উত্তর দিলেন।

–আলহামদুলিল্লাহ। বাচ্চা সুস্থ আছে তো ডাক্তার ? হাত পা নাড়ছে, তাইনা? অর্নব খুশিতে আত্মহারা। এই প্রথম অর্নবকে আমি এত খুশি হতে দেখলাম।আনন্দে তার চোখ বেয়ে অনবরত পানি ঝরে পড়ছে।আনন্দে মানুষ যে কাঁদে এই পাগল ছেলেটাকে দেখে আবারও রিয়েলাইজ করলাম।

–না, অর্নব সাহেব।আপনাদের বাচ্চার শরীরের নিচের অংশ ঠিক থাকলেও উপরের অংশ ঠিক নেই।আপনাদের বাচ্চার পেটের অংশ থেকে উপরের দিকের অংশ পুরো সমান।আই মিন, হাত,কান, নাক,মুখ,মাথা কিছুই নেই।সোজা কথায় উপরের অংশটা সমান এবং লম্বা।

–মানে ? কি বলছেন এসব ? আমি ডাক্তার নীলার দিকে তাকিয়ে কান্নাভেজা কণ্ঠে বললাম।

–জ্বি, মিসেস রহমান।

–না, আপনাদের রিপোর্টে হয়তো ভুল আসছে।

এটা বলে অর্নব আমাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বের হয়ে আসে। অর্নব আমাকে নিয়ে ঢাকা যায় এবং সেখানে নামকরা হসপিটালে আবার আল্ট্রাসনোগ্রাফি করায়।সেখানেও একই রিপোর্ট আসে।পরবর্তীতে আমরা দুজনেই ভেঙে পড়ি। কি করবো, মাথায় আসছিলো না। তখন একজন নামকরা গাইনী বিশেষজ্ঞ আমাদের বলেন,

–আপনারা যদি চান,তাহলে আমরা ফলস পেইন দিয়ে বাচ্চাটা ডেলিভারি করাতে পারি।

ডাক্তারের কথা শুনে অর্নব আমাকে বুঝাচ্ছে যে বাচ্চাটা ক্যারি করে আর কি হবে !তাছাড়া ওর হাত,নাক,মুখ কিছুই নেই।ও জন্মালেও খেতে পারবে না। আর খেতে না পেরে তখন তাকে কষ্ট পেয়েই হয়তো ও আমাকে নানাভাবে বুঝাচ্ছে আর কাঁদছে।আমিও অনবরত কাঁদছি।পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাচ্চা ডেলিভারি করা হবে।তাই ফলস পেইনের জন্য স্যালাইন দেওয়া হলো।যদিও পরবর্তীতে শুনেছি বাচ্চাটাকে পেটের ভেতর মেরে ফেলার জন্য ডাক্তাররা মেডিসিন ব্যবহার করেছেন।কিন্তু আমার বাচ্চাটা মারা যায় নি।জীবন নিয়ে সে পৃথিবীতে আসে। আমাকে আর বাচ্চাটা দেখায় নি ওরা।বাচ্চা নাকি হালকা পা নাড়ছিলো।রিপোর্টে যেরকম আসছে ঠিক সেরকমভাবে তার জন্ম হয়।

পরবর্তীতে ডাক্তারদের পরিচালনায় বাচ্চাটাকে একটা বক্সে আটকে রাখা হয়।যেখানে কোনোভাবেই অক্সিজেন পাওয়ার ব্যবস্থা নেই।আমার বাচ্চাটা ঐ বক্সেই প্রায় একদিন বেঁচেছিলো।ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলো আমার মাণিক। আমি কিছুই করতে পারিনি, কেবল চিৎকার করে কেঁদেছি। তারপর ধীরেধীরে তার শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়।সব শেষ হয়ে যায়।সে মারা যায়। এভাবে আমার মেয়েটার জীবন শেষ হয়ে যায়। আমাদের নিকট আমাদের মেয়েটা রইলো না।কেবল পড়ে রইলো অর্নবের কেনা সেই খেলনা,জামা,বাচ্চাদের পোস্টার। আরও কত কি ! যেদিকে তাকাই সেদিকে ঝুলছে এসব ! ঝুলে আছে একজন নারীর মা ডাকটা শোনার ইচ্ছা, একজন পিতার হাজার স্বপ্ন, আশা,ভরসা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত