অন্তরালে

অন্তরালে

জাহেদ পারভেজ আমার কলিগ এবং বন্ধু। বাড়ী নেত্রকোনা। ঠিক করেছি সামনের শীতেই বেড়াতে যাবো ওর বাড়ীতে। গত কয়েক বছরে ঢাকা শহরের সিসা ভর্তি হাওয়া ছাড়া শরীরে মুক্ত হাওয়া লাগেনি। এছাড়াও একটা কারণ হলো তামান্না মুস্তারি জয়ীতা। ডাক নাম জয়ী। একাশি বছর বয়স্কা কোন বুড়ির এতো আধুনিক নাম এর আগে কখনো শুনিনি। শুনেই বুড়িকে দেখার ইচ্ছে জেগেছিল। জয়ী বুড়ির অনেক গল্প আমি শুনেছি পারভেজের কাছে ।

জয়ী বুড়ি লতায় পাতায় কি করে যেন পারভেজের নানী হন। গ্রামে কারো মৃত্যু হলে জয়ী বুড়ি সেখানে গিয়ে হাজির হয়। জয়ী বুড়ি ছাড়া অনেক রকম সুরেলা শোকের গীত আর কেউ গাইতে পারে না। কোন বাড়িতে বাচ্চা হলেও জয়ী বুড়ি হাজির। বাচ্চার মাকে হেনোতেনো সব নিয়মকানুন বলে বলে মাথা খেয়ে আসে।

পারভেজ ঈদের ছুটি ছাড়াও আরো দুই তিন বার নেত্রকোনা যায়। কিন্তু যতদিন থাকে রাতে ঘুমুতে পারে না। পাশের ঘরেই সারা রাত রসিক বুড়ির হামান দিস্তায় পান ছেঁচে গীত গাওয়ার অভ্যাসের জ্বালায়। শেষমেষ শীতের এক রাতে কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছালাম। কথা ছিলো হাওর এক্সপ্রেসে করে স্টেশন থেকে রাত পৌনে বারোটায় আমরা রওনা দিবো। কিন্তু ট্রেন তিন ঘন্টা পরে ছেড়েছে। পরদিন দুপুরে নেত্রকোনা গিয়ে পৌঁছালাম। হালকা শীতল হাওয়া- মিষ্টি রোদ। মোহনগঞ্জ থেকে রিক্সায় করে গ্রামের রাস্তা ধরতেই সেই পরিচিত গ্রামের একটা গন্ধ।

সারা বাংলাদেশের সব গ্রামের শরীরের গন্ধ বুঝি একই রকম। খড়ের গন্ধ, গোবরের গন্ধ, মাটির গন্ধ, নদীর ধারে আলকাতরার কড়া গন্ধ। ভাল লাগছিলো Sসব। শহুরে রাস্তার একঘেয়ে হরণ নেই। মানুষ জনের ভিড় নেই। রাস্তার পাশেই শুকনো পাতা স্তুপ করে কেউ আগুন জ্বালিয়েছে। ধোঁয়ায় চোখ সামান্য জ্বালা করলেও ভাল লাগায় কোন চির ধরেনি। পাতা গুলো পটপট করে পুড়ছে। সাদা সাদা ধোঁয়া উপরে উঠে গাছের ফাঁকেফাঁকে মিশে যাচ্ছে। সূর্যের আলোয় ধোঁয়া গুলো আরো উজ্জ্বল লাগছে। ধোঁয়ার মাঝে গাছের ছায়ার ফাঁকে সূর্যের আলো কেমন এক রহস্যের চাদর বুনেছে যেন।

এ কারণেই গ্রাম আমার এতো ভাল লাগে। কোন ভন্ডামির বালাই নেই, কোন আরোপিত জৌলুস নেই। সবই কেমন খুবই সহজ আর শান্ত। মুহূর্তেই সব আপন আপন লাগে। অনেক অনেক বছর পরে গুন টানতে দেখলাম। নদীর পাড় ধরে শরীরের সব শক্তি দিয়ে একজন গুন টেনে চলেছে। রাস্তার ওপাশেই ডাক্কুয়াযির বিলে সরিষা ক্ষেত। দুই পাশে যতদূর চোখ যায় কেবল হলুদের মিছিল। চলেছি মেঠো পথ ধরে। দুপুরের রোদ গাছের মাথার উপরে গড়াতে গড়াতেই নওঁয়াগাও গ্রামে পারভেজদের বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালাম।

জীবনে এতো অপ্রস্তুত আর কখনো হইনি। বাড়ির সবাই এমন ভাবে দৌড়ে এসে ঘরে নিলো মনে হয় যেন বাড়ির জামাই এসেছে। ঢাকা থেকে মেহমান এসেছে বলে আশেপাশের কোন বাড়ির মহিলা মনে হয় বাকি ছিল না। মহিলারা শাড়ির আঁচল দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে এক নজরে তাকিয়েই আছে। কারো কারো কোলে বাচ্চাকাচ্চা। জানালা দিয়েও উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে অনেকে। আমি শুনেছি নতুন বউ বেড়াতে এলে সবাই এভাবে দেখতে আসে। কিন্তু তাই বলে আমার মতো… সে যাক। গ্রামের সরল মানুষ গুলোর এই দেখতে আসার ব্যাপারটা আমার আজীবন মনে থাকবে। ওরা কেউ কোন কথা বলছে না কেবল তাকিয়েই আছে। পারভেজ যে কোথায় গেলো বুঝতে পারছি না। নিজেকে ভিনগ্রহের বাসিন্দা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কিছুই মনে হচ্ছে না। পারভেজের মা ব্যাস্ত হয়ে আছেন অন্যদিকে। আমাকে ঘরে বসিয়ে একেকজন একেকদিকে ছুটেছে।

একটা পিচ্চি পুরো নাঙ্গাপুঙ্গা হয়ে মায়ের পা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বাচ্চাটাকে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, “ও বাবু তোমার নাম কি?” আশেপাশের সবাই এক সাথে হেসে উঠলো। দুইটা কিশোরী মেয়ে একজন আরেকজনকে চিমটি দিয়ে আমার কথার প্রতিধ্বনি তুললো, “ও বাবু তোমার নাম কি!” বাচ্চাটাকে কাছে ডাকলাম, “আসো বাবু কাছে আসো।” আমার কথা শেষ হতেই সবাই আবারো হাসি। কি জ্বালা যন্ত্রণায় পরলাম। কিছু বললেই দেখি হাসে। এমন সময় পারভেজের ছোটবোন শাবানা এসে সবাইকে সরিয়ে ভিড় কিছুটা হালকা করে আমার পাশে নাস্তার প্লেট রাখলো। মুড়ির মোয়া আর সরবত। লাল গ্লাসে সরবতের উপরে লেবুর কোয়া ভাসছে। এই লাল ধরণের কাঁচের গ্লাস এখন আর কোথাও দেখা যায় না। অনেক পুরানো গ্লাস।H

ভিড় থেকে এক মহিলা বলে উঠলো, “মেহমানরে ভাত না দিয়া নাস্তা দিতাছো ক্যান, নাস্তা খাইলে কি ভাত খাইতে পারবো আর, ঢাকা শহর কি কম দূর! ক্ষুধায় মেহমানের মুখ দিয়া কথাই তো বাইর হইতাছে না।” মহিলার কথা শেষ হতেই আবার সবার হাসি। শাবানা বলল, “এরা শহরের মানুষ। আগে একটু নাস্তা কইরা গোসল করবে। এরপরে খাইতে বসবে। তোমরা এবার যাও। মেহমানরে অনেক দেখছো।” আবারো হাসি সবার। কিন্তু কেউ এক চুল নড়ছে না। এতো মানুষের মাঝে কিছু মুখে দিতেও সংকোচ লাগছে।

আমি খুঁজে যাচ্ছিলাম জয়ী বুড়িকে। বুড়িকে দেখাই যাচ্ছে না। অনেকক্ষণ পরে ভিড় কমতেই পারভেজ এসে বসতেই বললাম, “কোথায় ছিলি এতক্ষণ? কি এক অস্বস্তিকর অবস্থায় ছিলাম। সব মানুষ হা করে দেখছিলো আমায়। কিছু জিজ্ঞাস করলেও কিছু বলে না। খালি হাসে। এরা এতো হাসে ক্যান রে।” “হা হা হা! সেটা বুঝে তোর কাজ নেই। চল উঠ এবার। গোসল করে নে।”

শার্ট প্যান্ট পাল্টে লুঙ্গি আর টিশার্ট পরে বের হলাম। পারভেজ শাবানাকে ডাক দিয়ে কল ঘরের দিকে নিয়ে যেতে বললো। কল ঘরে গিয়ে দেখি চারদিকে পাটখড়ি দিয়ে বেড়া দেওয়া। বড় একটা বালতি আর মগ। শাবানা কল চেপে বালতি ভরিয়ে দিচ্ছে। এই মেয়ের সামনেই কি গোসল করবো নাকি! কি এক মুশকিল। শাবানাকে অনেক জোর করেই কল ঘর থেকে বের করলাম। সে কিছুতেই যাবে না। বারবার বলছিলো, “আপনেরা শহরের মানুষ কল চাপার অভ্যাস নাই।” একটা মানুষ এভাবে কল চাপবে ভাবতেই তো ভাল লাগে না। বেচারি দেখলাম একটু মন খারাপ করেই চলে গেলো।

খেয়ে দেয়ে বিছানায় পিঠ লাগিয়েছি কি লাগাইনি এমন সময় এক বুড়ির ডাক শুনতে পেলাম। ডাক শুনেই আমি বুঝতে পারলাম এই সেই জয়ী বুড়ি। কার ছেলের পা মচকেছিলো তাই সেখানে গিয়েছিলো পা ঝেড়ে দিতে। এই সব করেই বুড়ির সময় কাটে। “কই আমার ঢাকার নাগর কই। হারামজাদার চেহারাটা একটু দেখি।” পারভেজ আমায় খোঁচা দিয়ে বলল, “নে উঠ তোর ডারলিং চলে আসছে।”

ঘর থেকে বের হতেই বুড়ির মুখোমুখি হলাম। যেমনটা ভেবেছিলাম তার থেকেও অনেক শক্তসামর্থ্য দেখলাম বুড়িকে। হাতে লাঠি আছে কিন্তু কুঁজো হয়ে যাননি। পুরো সাদা মাথায় কানের দুই পাAশে এখনো অনেক কালো আর ধূসর চুল। এক মুহূর্তে বুড়িকে বেশ সম্ভ্রান্ত মনে হলো। চামড়ায় পরোটার মতো ভাঁজ পড়েছে। দাঁত সামনে তিন চারটা আছে। তাও পানের রসে লাল হয়ে গেছে। কিন্তু চোখ ভরা দুষ্টুমি। এই বুড়ি যখন তরুণী ছিল আমাদের কত দাদা- নানাদের যে মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলো খুব সহজেই টের পাওয়া যায়।

“ও নাগর। এই বেডারে আমার সাথে নিকা দেওয়ার জন্য আনছো! ভাতার আমার পছন্দ হইছে। কাজী বোলাই আনো।” আমি হাসতে হাসতে বুড়িকে জড়িয়ে ধরলাম, “বিয়া কইরা তোমারে শহরে নিয়া যামু।” পাশ থেকে শাবানা আর ওর মা খিল খিল করে হেসে উঠলো। শাবানা বলল, “বুড়ির সোয়ামির অভাব নাই। ও বুড়ি এতো সোয়ামি দিয়া করবি কি?” জয়ী বুড়ি শাবানাকে লাঠি দিয়ে মারতে যেতেই শাবানা হাসতে হাসতে সরে গেলো।

“না বাপু আমি শহরে যামু না। পারভেজের মতো তুমিও এক মাগীর পিরিতিতে মইজা আমারে ছাইড়া দিবা। তোমাগো শহরের মাগী গুলার মতো আমি তো আর রঙ ঢঙ করতে পারি না।”

বুড়ির কথা শুনে আপনাতেই কাশি চলে এলো। পারভেজ আগেই বলে দিয়েছিলো বুড়ির মুখে কোন বাম্পার নেই। খুব গালাগালি করে কথা বলে। এই গালি গুলাই বুড়ির আদর। পারভেজের সাথে নাবিলা নামের এক মেয়ের সম্পর্ক আছে। বেশ চটপটে মেয়ে। পারভেজ বাড়ি এলে বুড়িকে কথা বলিয়ে দেয় নাবিলার সাথে। বুড়ি দুনিয়ার সব গালি দেয় নাবিলাকে। আর নাবিলা কুটকুট করে হেসেই মরে। বুড়ির সাথে বেশ ভাব। বুড়িও খুব ভালবেসে সতীন বলে ডাকে। জয়ী বুড়ির কথা শুনে পারভেজের মা বলল, “খালাম্মা কি কন এইগুলা? ঢাকা শহরের মেহমান। মুখে বেড়া দেন।”

“তুই চুপ থাক। আমার পিরিতি দেখলে তো তোগো গায়ে ফোস্কা পরে।” বিকালে হালকা ঘুম দিয়ে উঠে গ্রামটা দেখতে বের হলাম। এখানে এসে এখনো সিগারেট খেতে পারিনি। অনেকটা পথ আসার পরে সিগারেট ধরালাম। আমরা নদীর পাড়ে গিয়ে বসলাম। বেশ সুন্দর নদীর নামটা- কংশ নদী। এখান থেকে দেখা যায় মোহনগঞ্জ সরকারী পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। নদীর পানি নিচে নামতে শুরু করেছে। গ্রামের দিকে তাকালে সাদা ধোঁয়ার চাদর দেখা যায় বাড়ি গুলোর মাথায়। সবাই এখানে লাকড়ির চুলায় রান্না করে। ক্ষেতের উপরেও সাদা সাদা ধোঁয়ার রেখা।

কি শান্ত চারদিক। কোথাও কোন তাড়াহুড়ো নেই। কোন ব্যস্ততা নেই। সূর্যটাও খুব আস্তে আস্তে হেলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে। পাখিরা ঘরে ফিরছে। বাদুর গুলো ঘর ছেড়ে বের হচ্ছে। শীত এখনো জাঁকিয়ে পড়েনি, গায়ের শালটা খুলে হাতে নিয়ে কোমল শীতল বাতাসটা শরীরে ছোঁয়ালাম। ঠিক যেন বুকের গভীরেও শীতল হাওয়া পৌঁছে গেছে। মনে মনে ভাবি, আর যদি শহরে না ফিরি। এইখানেই কোন একটা জমিতে কৃষিকাজ করে ছোট একটা ঘর বাঁধি। একটা গ্রামীণ মেয়েকে বিয়ে করে সহজ শান্ত একটা জীবন কাটিয়ে দেই। কি এমন ক্ষতি হবে। বৃষ্টির সময় প্রাণ ভরে সোঁদা মাটির গন্ধ নিবো। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকবো। আমি খুব সহজ একটা জীবন চাই। খুব সহজ।

নদীর পানির আলাদা একটা গন্ধ আছে। লাকড়ির চুলার ধোঁয়া, নৌকার আলকাতরা, নদীর পানি, কুয়াশা; সব মিলেমিশে কেমন এক মোহিত করা গন্ধ। ফুসফুসে গভীর করে টেনে নিলে আর ছাড়তে ইচ্ছে করে না। মনে হয় বুকের মাঝেই রেখে দেই সব গন্ধ। গ্রামের আকাশে তারা খুব স্পষ্ট দেখা যায়। ছেলেবেলায় শোনা ঠিক সেই ধাঁধাঁর মতো- এক থাল সুপারি গুনতে যে না পারি।

সন্ধ্যার অনেক পরেও আমরা নদীর পাড়ে একটা গাছের গুড়ির উপরে বসেছিলাম। প্রায় এক প্যাকেট সিগারেট শ্রাদ্ধ করলাম। আস্তে আস্তে মাথার উপর দক্ষিণ দিকে উঁকি দিচ্ছে কালপুরুষ মণ্ডল। সেই কবে থেকে আকাশে ঝুলে আছে এক সৈনিক। কোটি কোটি বছর পার হয়ে গেছে। তবুও নক্ষত্রের বাগানে ঢাল তলোয়ার হাতে একই ভাবে আছে কালপুরুষ। কিসের অপেক্ষায় আছে কে জানে। কোন যুদ্ধের অপেক্ষায়! নাকি কালপুরুষ পাহারা দিচ্ছে কোন এক রাজকন্যাকে। রাজকন্যার চোখের ঘুমকে!

“নাবিলাকে বিয়ে করছিস কবে?” আমার এই প্রশ্নে হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলো পারভেজ। বলল, “বুঝতে পারছিনা। বাড়িতে সবাই রাজি। কিন্তু বাড়িতে এক কথা। বউকে নিয়ে গ্রামেই থাকতে হবে। নাবিলা কিছুতেই থাকতে পারবে না এখানে। আমি নিজেও তো থাকতে পারি না। শহর আমাকেও গিলে খেয়েছে।”

“তোর বাবা মাকেও শহরে নিয়ে গেলেই তো পারিস। আর শাবানাকেও ভালো একটা কলেজে ভর্তি করিয়ে দিবি।”

“উনারা গ্রাম ছাড়বেন না কখনো। জানিস, এক সময় আমিও কখনো ভাবতে পারতাম না গ্রাম ছেড়ে শহরে থাকবো। শহর আমায় কখনোই টানেনি। কিন্তু ভার্সিটিতে ভর্তির পরে কি করে যে আস্তে আস্তে আমার রক্তে শহরের মাদকতা ঢুকে গেছে বুঝতে পারিনি।”

“আমার কিন্তু গ্রাম বেশ ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই সারা জীবন।”

“দুই এক সপ্তাহ থাকার পরে তুইও পালাতে চাইবি। শাপলা যখন বলবে তোকে দেখা করার কথা ঠিকই দৌড়ে পালাবি।”

“কি যে বলিস!”

“আচ্ছা আমি এটা এখনো ঠিক বুঝি না, শাপলার সাথে তোর রিলেশনটা আসলে কি? না বন্ধু, না প্রেমিকা, না অন্য কিছু। কিছুই বুঝি না আমি।”

“আমি নিজেই তো বুঝি না। তুই কি বুঝবি।”

“তোদের মাঝে কি আসলেই এফেয়ার আছে নাকি স্রেফ বন্ধু তোরা?”

“কিছু প্রশ্ন নাহয় উত্তরহীন থাক। যেদিন উত্তর মিলবে তোকেই আগে জানাবো।”

“তোদের এইসব ব্যাপার সত্যি আমি বুঝি না। একজন আরেকজনকেK না দেখে দুই দিনের বেশি থাকতে পারিস না। অথচ কেউ নাকি কারো হাতও ধরিস নাই। আবার তুই তুই করে কথা বলিস। কিন্তু তোদের মাঝে কোন প্রেম আছে কিনা সেটা তোরাও জানিস না। মাথামুণ্ডু বুঝি না কিছু।” “তবে তুমি যাহা চাও, তাই যেন পাও আমি যত দুঃখ পাই গো…”

“এসব হেঁয়ালি ছাড়। সোজাসুজি বলতো সব।”

“গত এক সপ্তাহ কথা বন্ধ। হয়তো আর দেখাও হবে না কোনদিন।”

“মানে?”

“চল ঠাণ্ডা লাগছে। বাড়ি ফিরি এবার।”

মাথার উপরে কালপুরুষ; পায়ের নিচে ঘাসের উপরে কুয়াশা ভেজা শিশিরের মিছিল। বুকের ভিতরে একটা মুখ বারেবারে ডুব সাঁতার দিচ্ছে- শাপলা। সেই কাজল আঁকা চোখ। অভিমানী বুকে শাপলা কেবল আর্তনাদে ঘুরেফিরে।I এই গ্রামে এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। না আসাতে ভালোই হয়েছে। গ্রামকে তখন আর গ্রাম মনে হতো না। বাড়িতে না ঢুকে আমি কল ঘরের দিকে গেলাম। পারভেজকে ওর চাচা ডাক দিলো তাই কথা বলতে গেলো। কল ঘরে যেতেই দেখি শাবানা হাজির হারিকেন নিয়ে। এবার আর আমার জোর টিকলো না। শাবানা কল চেপে দিচ্ছে আমি হাত মুখ ধুয়ে নিচ্ছি। ধোয়া শেষ হতেই শাবানা গামছা এগিয়ে দিলো।

“তোমাদের গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। অনেক সুন্দর।”

“আপনে সিগারেট খান?”

“হুম। গন্ধ পাচ্ছো নাকি!”

“মাইয়্যা মাইনষ্যের নাক অনেক খারাপ।”

“বাহ!”

“গামছাটা দেন।”

“কেনো ধুয়ে দিবে নাকি গামছা? সিগারেটের গন্ধ হয়ে গেছে। হাহাহা!”

“আমার এই গামছা আমি কাউরে ধরতেও দেই না।”

বলেই খুব চঞ্চলL হয়ে আমার হাত থেকে প্রায় ছোবল দিয়ে গামছাটা নিয়ে পালালো। মনে মনে হাসি। ছোট একটা মানুষ। মনের ভিতরে কতকিছু না ঘুরে। সামনের বছরেই এসএসসি দিবে। গ্রামের মেয়েরা একটু তাড়াতাড়িই পেকে যায়। খাওয়ার সময় জয়ী বুড়ি বসলো আমার পাশে। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে বসেছি সবাই। গ্রামে এলে খাওয়াদাওয়ার এই আয়োজনটা আমার খুব ভাল লাগে। মাদুরে বসে খেতেই খুব তৃপ্তি পাই। জয়ী বুড়ি খেতে বসেনি। একটা পিড়িতে বসে সামনে মাটির মালশায় তুষের আগুন দিয়ে হাত গরম করে নিচ্ছেন। বৃদ্ধা মানুষ। শীতকালে ভীষণ কষ্ট পায়। শাবানা এটা ওটা পাতে তুলে দিচ্ছে। ওর কাঁধে এখনো গামছাটা আছে। হারিকেনের আলোয় শাবানার চোখে অন্য এক আভা। মেয়েটা একটা ভুল ভাবনায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এই বয়সেই মেয়েরা ভুল করে বেশি।

খাওয়ার পরে হাত ধুতে বাইরে গেলাম। উঠোনের এক পাশে দাঁড়িয়ে শাবানা জগ থেকে পানি ঢালছে আর আমি হাত ধুচ্ছি। হাত ধোয়া শেষ হতেই ওর গামছা এগিয়ে দিলো। হাত মুছে ফিরিয়ে দিলাম। কিছু না বলেই সবার সাথে গিয়ে বসলাম আবার।

গ্রামে রাত আটটা নয়টা বাজলেই ঘুমের পাড়া হয়ে যায়। সবার সাথে অনেক গল্প করে দশটার দিকে রুমে ফিরলাম। সারাদিন মোটামুটি ভালোই জার্নি গেছে। কিন্তু তবুও কেন যেন তেমন ক্লান্ত লাগছে না। ইচ্ছে করে সেলফোন ঢাকায় রেখে আসছি। বাসায় বলেছি এখানে কারেন্ট নাই। চার্জ দেওয়া ঝামেলা। খুব বেশি দরকার হলে পারভেজের নাম্বারে কল দিতে। আমার কাছে এই যন্ত্রটা খুবই অসহ্য লাগে। মনেহয় সব সময় একটা রিমোট কন্ট্রোল পকেটে নিয়ে ঘুরছি। শাপলা আমায় ভুলেও কল দিবে না আমি জানি। ও অন্য ধাঁচের মেয়ে।

পারভেজ হারিকেনের আলো একেবারে কমিয়ে দিয়ে লেপ গায়ের উপর টেনে নিয়ে ওপাশ ফিরেই পাঁচ মিনিটের মাথায় হ্যামিলনের বাঁশি বাজানো শুরু করে দিলো। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা সব বাচ্চাকাচ্চাদের সম্মোহিত করে নিয়ে গিয়েছিলো। আরR নাক দিয়ে যে বাঁশি বাজানো হয় তা দিয়ে পাশের মানুষের চোখের ঘুম নিয়ে যাওয়া হয়। সারারাত ঘুম চোখের পাতার উপরে টম এন্ড জেরির মতো ছোটাছুটি করে। ধরতে গেলেই হ্যামিলনের বাঁশির সুরে ঘুম পালায়। খুব দুঃখ হয় বেচারি নাবিলার জন্য। কত রাত যে নাবিলাকে বালিশ কানের উপরে চেপে ঘুমাতে হবে। আহারে বেচারি।

মাথাটা ভন ভন করছে নাক ডাকার শব্দে। সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে বাইরে গেলাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। উঠোনের এক পাশে খড়ের গাদা। সেটার পাশে গিয়ে সিগারেট ধরালাম। কনকনে বাতাস। কুয়াশা তেমন পরেনি আজ। আকাশ জুড়ে নক্ষত্র। আজ যেন নক্ষত্রের রাত।

হঠাৎ একটা শূন্যতা আমায় আচ্ছন্ন করে দিলো। মুহূর্তে নিজেকে অচেনা মনে হলো। আমি কে? আমি কোথা থেকে এলাম? কেন এলাম? আমি এখানে কেন? কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না। গতকাল ঠিক এই সময়েও তো ঢাকায় ছিলাম। রেলস্টেশন প্লাটফর্মে, ট্রেন ছিল তিন ঘন্টা লেট। কত কোলাহলের মাঝে ছিলাম। আর আজ! এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি আকাশ ভরা তারাদের নিচে নেত্রকোনার এক গ্রামের বাড়ির নির্জন উঠোনে। আমি নিজেকে আমার মাঝে খুঁজে পাচ্ছিনা। একটা ঘোরে মিলিয়ে যাচ্ছি। এমন সময় জয়ী বুড়ির হামান দিস্তায় পান ছেঁচার শব্দে বাস্তবে ফিরে এলাম। হাতের সিগারেট অর্ধেকে এসে নিভে গেছে কখন টের পাইনি। আরেকটা ধরাতেই দেখি পারভেজ টর্চ নিয়ে বের হয়েছে।

“কিরে এখানে কি করিস?”

“সিগারেট খেতে বের হলাম।”

“কেনো বুড়ির পান ছেঁচার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেছে?”

“আরে না। ঘুমাতে পারি নাই তোর নাকের বাঁশির শব্দে। বুড়িতো মাত্র পান ছেঁচা শুরু করেছে।”

“এই নাক ডাকা নিয়ে ভবিষ্যতে খারাপি আছে আমার কপালে।”

“চল নানীর কাছে গিয়ে বসি।”

“তুই যা। আমার মেজাজ বিগড়ে আছে বুড়ির পান ছেঁচানো শব্দে।”

কিছুক্ষণ পারভেজের সাথে কথা বলে; হাতের সিগারেটটা শেষ করে বুড়ির রুমের সামনে গিয়ে দরজায় টোকা দিলাম। বুড়ি পান ছেঁচা বন্ধ করে বলল, “কোন নাগর এতো রাইতে আমার ঘরে আসবার চায়? রাইতে কি পিরিতির জোয়ার উঠছেনি ? ”

দরজা ভেজানো ছিলো। ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। ভিতরে উঁকি দিয়ে বললাম, “নানী আসবো?” বুড়ি ফিচকে হাসি দিয়ে বলল, “আসো আসো আমার রসের সোয়ামি। রাইতেই খালি তোমাগো পিরিতির জ্বালা গতরে খাউজ দিয়া উঠে।” বুড়ির কথা শুনে হাসতে হাসতে পাশে গিয়ে বসলাম। বুড়ি খাটে ঘুমাতে পারে না। মেঝেতে অনেক ঠাণ্ডা তবুওO মেঝেতেই পাটি বিছিয়ে উপরে তোষক দিয়ে শোয়। বসতেই হা করতে বললো। আমি হা করতেই হামান দিস্তা থেকে পান মুখে পুড়ে দিলো।

“এতো রাইতে আমার ভাতার আমার লগে রসের আলাপ করতে আইছে। আগে মুখটা তো রসে ডুবাও।”

“নানী রাতে তোমার ঘুম আসেনা?”

“ঘুম কি জিনিস আমার চোখ তা ভুইলা যাইতাছে। স্বামীর সোহাগ ছাড়া কোন মাগী ঘুমাইতে পারে কও।”

“কি যে বলো না। তোমার মুখের কোন বেড়া নাই।”

“বেড়া তো সেই কবেই ভাঙছে ভাইডি। আসো আরো কাছে আইসা বও। পুরুষ মাইনষ্যের শইল হইলো আগুন। মেয়া মাইনষ্যের শইল হইলো মোম। মোম পুইড়া পুইড়াই নতুন মোম হয়। না হইলে কি দুনিয়ায় ছাওয়াল পাওয়াল হইতো। শইলে যৌবন না থাকলে মোম হইয়্যা যায় তুষের মতোন। পুরান কথা মনে কইরা তুষে আগুন লাগবো। আর পুইড়া ছাই হইবো। মোমের শইলের সুখ আর পাইবো না। আমিও অহন তুষের জঞ্জাল। এই জঞ্জালে বেড়া থাকবো কেমনে। শইল, মন, বেড়া সবই তো পুইড়া ছাই। সোনা পুড়লে হয় খাঁটি। মানুষ পুড়লে হয় মাটি।”

অবাক হলাম বুড়ির এমন গভীর দর্শনের কথায়। কি অসাধারণ করে কত সহজেই না মাত্র ক’টা কথায় কত কিছু বুঝিয়ে দিলো। বুড়ির গা ঘেঁষে বসলাম। কি মায়া। কি আদর বুড়ির চারপাশে। মনটাও কেমন যেন শান্ত হয়ে যাচ্ছে। একটু আগেও উঠোনে দাঁড়িয়ে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়েছিলো। “নানা মরছে কত বছর আগে?”

“বছরের হিসাব কে রাখবো ভাই? আমার কোলে তখন আমার চাইর নাম্বার মেয়া। দুধের বাইচ্চা। বাপটারেও দেখে নাই মেয়াটা। তোমার নানায় তখন লঞ্চের ডেরাইভার আছিলো। “আমারে যদি ছাড়বিরে পরাণ কেন তুই হইলি দেশান্তরি তোরে চোখের কাজলে রাখতাম তোরে বুকের খাঁচায় পুষতাম আয়রে পরাণ তোরে চুলের ফিতায় বান্ধি দেখরে পরাণ আমার বিছানা ঘুণপোকায় খায় কেন তুই হইলি দেশান্তরি কেন তুই আমার পরাণ হইলিরে পরাণ আমার বুকের ভিতরে তোর পরাণের লাশ আমার পরাণের কেন আজ ভিন দেশে বাস হারিকেনের আলোয় বুড়ির চোখের জল জ্বলজ্বল করে জ্বলতে জ্বলতে ঝরে পড়ছে গায়ে জড়ানো চাদরে। তবুও হামান দিস্তায় জোরে জোরে পান ছেঁচে যাচ্ছে আর গীত গেয়ে দম নিচ্ছে।

“তখন দেশ ভাগ হয়্যা যাইতেছিলো। তোমার নানাগো ছিল বিশাল কারবার। কলিকাতা শহরে কাপড়ের দোকান। সবাই চইল্যা গ্যালো। তোমার নানায়ও গেলো। যাইবার আগে আমারে কইলো, ‘আমি ফিরা আসুম। তুমি থাকবা আমার জন্যি!’

“হের বাপের সব কারবার ফালাইয়া এক কাপড়ে চইলা আইলো। বিয়া কইরা আমারে ঘরে তুললো। কি আছিলো আমাগো! কিচ্ছু ছিল না ভাইডি। ভাতের ফেন ফালাইতাম না। বড় ছাওয়ালডারে খাওয়াইতাম। অভাব ছিল। কিন্তু মানুষটা বুকের ভিতরে যখন টাইন্না নিয়া কইতো, ‘আমার বুকে তুমি আছে। দুনিয়ায় আমার আর কোন সম্পদ লাগবোনা।’ আমার সারা শইল কাঁপতো। মানুষটা কেমনে এই সম্পদ ছাইড়া চইল্যা গ্যালো। “দেখরে পরাণ আমার বিছানা ঘুণপোকায় খায় কেন তুই হইলি দেশান্তরি কেন তুই আমার পরাণ হইলিরে পরাণ বুড়ির হাতটা ধরি। বয়সের ভাড়ে নুয়ে পরা হাত। চামড়ায় ভাজ পড়েছে। আমার দুই হাতের মাঝে নিয়ে হাতটা গরম করার চেষ্টা করি।

“নানী, তোমারে অনেক ভালবাসতো নানা তাই না!”

“ভালবাসা! কোনদিন কেউ কাউরে কই নাই ভালবাসার কথা। তোমাগো যুগ আর আমাগো যুগ কতো ফারাক। পারভেজ নাবিলা মাগীরে দিনে চৌইদ্দবার কয় ভালবাসার কথা। ভালবাসার কথা কি মুখে কওন লাগে ভাইডি। হের ভালবাসার কিচ্চা শুনবা।”

“বলো নানী।” আমার মুখে আরো কিছু পান দিয়ে নিজের মুখেও পান পুড়ে নিলো।

“বিয়ার পরে প্রেত্যেক রাইতে ভাত খাওনের পরে আমার মুখের চাবানি পান খাইতো। আমার যে কি শরম করতো। পুরুষ মানুষ হইলো ছোঁচার জাত। একবার যা কইবো তাই আদায় কইরা ছাড়বো। না পাওন পর্যন্ত ছোঁচার মতো পিছে পইরা থাকবো। তোমরা কি পারবা তোমাগো বউয়ের মুখের চাবানি পান খাইতে, তোমাগো ঘেন্না লাগবো। আর মানুষটা কি সুখ কইরা খাইতো। আমি আঙুলে চুন লাগাই বইস্যা থাকতাম। আমার আঙুল চুইষা চুন খাইতো। এমন ছোঁচা পুরুষ আমি আর দেখি নাই।”

“তুমি খাইতা না নানার মুখের পান?”

“খাইতাম না আবার। হেয় যখন বেয়ান বেলায় কামে যাইতো। হের মুখের চাবানি পান দিয়া যাইতো আমার মুখে। আমি কত চাইতাম পান যেন শ্যাষ না হয়। কিন্তু রাখতে পারতাম না মুখে। পান শ্যাষ হইয়্যা যাইতো। “কি মধুর বিষে ডুবাইলা পরাণ দিন আমার যান না কতকাল তোমার হাতে সাজামু চুলের বেনি আসোরে পরাণ আমার দরজা খুইলা যায় তোমার আশায় দিন আমার যায় না কতকাল কি অসাধারণ একেকটা গীত। আর কি দরদ দিয়েই না গায় বুড়ি। বুকের কতোটা গভীর থেকে উঠে আসছে কথা গুলো আমি টের পাই। চোখে ভাসে শাপলার মুখ।

“নানার কথা মনে পরলেই কি গীত গাও নানী?”

“হ ভাই। গীত গাই আর পান ছেঁচি। তোমার নানার চেহারা মনে কইরাই জোরে জোরে ছেঁচি। আমারে একলা থুইয়্যা মানুষটা কেমনে চইল্যা গ্যালো। হেই জিদে আরো বেশি কইরা ছেঁচি। তোমার নানা আমার সামনে থাকলে অহন এমন কইরাই ছেঁচতাম।”

“হাহাহা! নানী! তোমার এই ছেঁচার ভয়েই নানা আগেভাগে ভাগছে।”

“হাইস্যা না রসের সোয়ামি। তোমার কথা ভাইব্বা ঢাকা শহরে কোন মাগী তোমারেও ছেঁচতাছে মনে মনে তার হিসাব কি রাখো!”

“না নানী। আমার অমন কেউ নাই।”

“যদি নাই থাকবো তাইলে আমার গীত শুইন্না তোমার চোখে ক্যান পানি টলমলায়! আমারে তুমি পিরিতি শিখাইও না নাগর। কেডা ঐ মাগীটা, যে তোমারে আমার কাছ থেইক্কা কাইড়া নিতে চায়?”

“কেউ না নানী। আমারে তোমার কাছ থেকে কেউ কাইড়া নিবে না।”

“ভাইডি একটা কথা কই। জ্ঞানের কথা না। আমি তোমাগো মতো শহরে থাকি না। বিদ্যা বুদ্ধি নাই আমার। একটা কথা মনে রাইখো, মেয়া মানুষ হইলো কাদা মাটির লাহান। যতো কষ্ট দিবা খালি শক্ত হইবো। শক্ত হইতে হইতে ভাইঙা যাইবো তাও মুখ ফুইটা কইবো না কিছু। বুঝবারও পারবা না ভিতরে ভিতরে তোমার আঘাতে কতটা ভাঙছে। আর যদি ভালবাসা দাও। আদর সোহাগ দাও। শক্ত মাটি ভিজা কাদা কাদা হইয়্যা যাইবো। হের পরে কাদা মাটি দিয়া যা খুশি বানাও। কিচ্ছু কইবো না। ভালবাসা দিয়া মেয়া মানুষরে দিয়া তুমি একটা খাল কাটাইতে পারবা। কিন্তু কষ্ট দিয়া এক টুকরা মাটিও কাটাইতে পারবা না। যতো জোর করবা ততো ভাইংগা টুকরা টুকরা হইবো। মেয়া মানুষ হইলো আদরের নৌকা। খুব যত্নে দরদ দিয়া নাও বাইতে হয় নাগর।”

“কিন্তু ও তো আমারে বুঝে না।”

“আরে বলদ! অয় কেন তোমারে বুঝবো, তোমারে বুঝতে হইবো। রাগ অভিমান গোসসা এইসব কি পুরুষ মাইনষ্যে করে। এইসব হইলে মেয়া মাইনষ্যের কাম। আগে ভালবাসার সেচ দিয়া মাটি নরম করো। হের পরে যেমনে মনচায় কাদা মাটি দিয়া হেই মাগীরে তোমার মতো যা খুশি করো।” বলেই আমার হাতে একটা চিমটি দিয়ে চোখে মুখে দুষ্টামির হাসি দিলো।

“নানী তোমার কোলে একটু মাথা রাখি!”

“আসো ভাইডি।”

আমার আপন নানী বেঁচে নেই। নানীর আদর কেমন সেটা হালকা কিছু মনে আছে। জয়ী বুড়ির কোলে মাথা রেখে যেনো সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছি। বুড়ি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বুড়ির হাতে পানের গন্ধ, জর্দার গন্ধ। কেমন একটা সম্মোহন করা নির্যাস বুড়ির চারপাশে। কখন আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা। বুড়ি গীত গাইছিলো। কেমন এক অদ্ভুত সুরে টেনে টেনে গীত গায় বুড়ি। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে শুনতেই ঘুমে তলিয়ে যাই। ঘুম ভাঙতেই দেখি বুড়ি আমার গায়ে লেপ দিয়ে দিয়েছে। আমার মাথায় তখনো হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

“যাও গো নাগর খাটে গিয়া ঘুমাও। সারা রাইত তো আমার কোলেই পার কইরা দিলা। তোমার মাগীটা জানতে পারলে তোমারে সারাজীবন গুতাইবো। কিন্তু অহন আমি কি করি!” “তোমার আবার কি হলো নানী?” “গ্রামের লোকেরা তো আমারে নিন্দা করবো। বেগানা পর পুরুষ মাইনষ্যের লগে রাইত কাটাইলাম। তুমি তো আমারে কলঙ্ক দিয়া দিলা রসের বান্ধব। আমি অবলা নারী কি করি অহন।”

“হাহাহা! নানী তোমার মুখে যদি বেড়া থাকতো তাইলে সব কথা তোমার পেটে কিলবিল করে মরতো।” বুড়ি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, “যেই মাগীর পিরিতি চোখে নিয়া ঘুইরা ঘুইরা মরতাছো ঐ মাগীর কাছে যাও। দুনিয়ায় সবই পাবা। কিন্তু একবার মনের মানুষ হারাই গেলে আর পাইবা না নাগর। আমার মতো সারা রাইত তার মুখ মনে কইরা পান ছেঁচা লাগবো। এখনN আর শইলে জোর পাই না। তোমার নানার মুখটাও ঝাপসা লাগে। ছেঁইচা আরাম পাই না।”

বিছানায় শুয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে জয়ী বুড়ির কথা গুলো আউড়ালাম। কি সাধারণ গ্রামের সরল মানুষ কিন্তু কি প্রখর দৃষ্টি। আমার চোখ ভেদ করে যেনো বুকের সব কথাই পড়ে ফেলছে। ঘুম ভাঙলো বেশ দেরি করে। সকাল সাড়ে দশটায়। পাশে দেখি পারভেজ নাই। বাহিরে সবাই কাজ করছে। এখান থেকেই শোনা যাচ্ছে সবার কথা। লাকড়ি চুলার ধোয়ার গন্ধ আসছে নাকে। একটা মুরগি ঢুকে গেছে ঘরে। মুরগির পিছনে পিছনে এলো শাবানা।

“মুখ ধুইয়া আসেন নাস্তা দেই। ভাইজান মোহনগঞ্জ গেছে। দুপুরের আগেই চইলা আসবে।”

“অনেক দেরি হয়ে গেলো উঠতে। তোমার স্কুল নাই?”

“শাপলা কে?”

মোটামুটি ভিতরে একটা ভালোই ঝাঁকি খেলাম। পারভেজ বলার কথা না। আর শাবানার আচরণও একটু গোলমেলে লাগছে। মাত্র একদিন হয় আমায় দেখেছে। কিন্তু এমন ভাবে কথা বলছে যেন কতদিনের পরিচয়। গলার স্বরে কেমন কৈফিয়ত নেওয়ার সুর।

“আছে একজন! কেনো?”

“ভাইজান বাইর হওয়ার পরে আপনারে ডাকতে আসছিলাম। তখন আপনে ঘুমের মইধ্যে এই নাম ধইরা ডাকতেছিলেন।”

“ওহ।”

“ঐ মেয়ে কি অনেক সুন্দরী? শহরের মেয়ে, অনেক রঙঢঙ করবার পারে। আমাগো মতো গ্রামের ভূত না তাই না?”

বলেই গটগট করে চলে গেলো। উঠানে কে যেন ঝাড়ু দিচ্ছে। রাতের সেই নির্জনতা নেই। কিন্তু কেমন একটা মাটির মায়া আছে চারদিকে। শাপলা কি থাকতে পারবে এমন একটা গ্রামে! আমায় যে শহর আর টানছে না এই মাটির মায়া ছেড়ে। মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বাইরের উঠোনে হাঁটছিলাম। টিনের চালে বালিশ-লেপ রোদে দিয়েছে। শহরে এই মুহূর্তে কত কি ঘটে যাচ্ছে কত দ্রুত। কিন্তু এই গ্রাম সেসবের কোন খবর রাখে না। সে চলে ধীরে, নীরবে। এমন সহজ একটা জীবন খুব করে চাইছি আমি। দুপুরে পারভেজ এসেই বলল, “রেডি হয়ে নে। তোকে ঢাকায় রওনা দিতে হবে।”

“মানে কোন সমস্যা হয়েছে। কোন খারাপ খবর আছে?”

“না তুই যাবি ব্যাস।”

“আমাদের বাসা থেকে কোন কল আসছিলো। কারো কিছু হয় নাই তো?”

“ধুর গাধা। সেসব কিছুই নাই। ঘটনা হলো শাপলা।”

“মানে কি হয়েছে শাপলার?”

“এতো প্রশ্ন না করে চটপট রেডি হয়ে নে। ভাত খেয়েই রওনা দিতে হবে। আমি বাসের টিকেট কেটে এনেছি।” আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উধাও হয়ে গেলো পারভেজ। মনের ভিতরে কু ডাক দিচ্ছে। কিছু হয় নাই তো শাপলার? এলোমেলো লাগছে সব। কি এমন হতে পারে যার জন্য আমায় এখনই ঢাকায় যেতে হবে।Y ব্যাগ গুছাতে গুছাতেই শাবানা এলো ঘরে। কিছু না বলে খাটের মশারি স্টেন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। একটা নখ দিয়ে খুব মনযোগ দিয়ে স্টেনের ক্ষয়ে যাওয়া কাঠ খুঁটছে।

“পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় চলে এসো। তোমাকে চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে যাবো।”

“আর দুইটা দিন থাকা যাইতো না?”

“আবার কখনো ছুটি পেলে আসবো।”

“এইটা রাখেন। ব্যাগে ঢুকান।”

শাবানার সেই গামছা। যা কাউকে ও ধরতে দেয় না। এই পাগলামীর কোন মানে হয়। তবুও হাত বাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগে ঢুকালাম। নাহলে অযথাই মন খারাপ করবে। এই বয়সের মেয়েরা খুবই স্পর্শকাতর হয়। ওর মনে কি চলছে বুঝতে পারি আমি। কিন্তু সেটা প্রশ্রয় দেওয়ার কোন মানে হয় না। “আপনি ঢাকায় গিয়া শাপলারে বিয়া করবেন তাই না?”

মশারির স্টেনে একটা ঝাঁকি দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো শাবানা। ওকে খাওয়ার সময় দেখলাম না। ইচ্ছে করে জিজ্ঞাসও করি নাই শাবানা কোথায়। হয়তো আড়াল থেকে জানার চেষ্টা করছে ওকে খুজছি কিনা। কিন্ত বুকের ভিতরে তোলপাড়। শাপলার জন্য চিন্তা হচ্ছে। পারভেজ স্টুপিডটা কিছু বলছেও না। এদিকে সাতসকালেই জয়ী বুড়ি গেছে পাশের গ্রামে। জয়ী বুড়ির কাছ থেকে বিদায় নেয়াও হলো না। আসার সময় শাবানাকেও দেখলাম না কোথাও। মোহনগঞ্জ এসে পারভেজ আমায় টিকেট দিয়ে বলল, “এবার মনেহয় তুই ফেঁসে গেছিস।”

“মানে!”

“ঢাকায় পৌঁছে ফোন দিস।”

জানি পারভেজের পেট থেকে কিছুই বের করতে পারবো না। শুধু একটা ব্যাপারে একটু স্বস্তি পাচ্ছি। খুব সিরিয়াস কিছু হলে পারভেজ এভাবে চুপ করে থাকতো না। আমার বাস ছেড়ে দিয়েছে। এতো কম সময়ে এতো আপন করে নেওয়া মানুষ গুলোকে ছেড়ে এভাবে চলে আসতেও ভীষণ খারাপ লাগছে। শাবানা মেয়েটা বেশ ভালো, বড় হলে নিজেই সব বুঝতে পারবে।

জয়ী বুড়ির কথা মনে পড়তেই বুকের ভিতরে দুমড়ে উঠলো। আবার এলে জয়ী বুড়িকে দেখতে পাবো তো! জয়ী বুড়ি আমার বুকের ভেতর থেকে অভিমানটা সরিয়ে দিয়েছে। কত সহজে বুঝিয়ে দিল সম্পর্ক ব্যাপারটা কেমন। বুড়ির কাছে এসে যেন নিজেকে চিনলাম। শাপলাকে নতুন করে গড়লাম। বুঝতে পারি নাই এতোদিন শাপলা আমার কাছে কি! কিন্তু কাল রাতের পর থেকে শাপলা ছাড়া মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার কোন অবস্থান নেই। আমি যদি একটা বৃত্ত হই তবে কেন্দ্রবিন্দু হলো শাপলা।

বাসের হালকা তালে চোখ ঢুলুঢুলু করছে। আবার কবে ফেরা হবে এই গ্রামে… আর কি কখনো বসা হবে কংশ নদীরে পাড়ে। ক্রমশ মাইলের হিসাব দীর্ঘ করছে। নেত্রকোনার এই একটা রাতের কথা আমি কখনোই ভুলবোনা। কি এক শান্তিতে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে। চোখের কোণে ভাসছে শাপলার মুখ। বুকের মধ্যে বেজে উঠোলো জয়ী বুড়ির গীত। “কি মধুর বিষে ডুবাইলা পরাণ দিন আমার যান না কতকাল তোমার হাতে সাজামু চুলের বেনি আসোরে পরাণ আমার দরজা খুইলা যায় তোমার আশায় দিন আমার যায় না কতকাল”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত