দিপা ওর চলার গতিটা একটু একটু করে বাড়িয়ে দিচ্ছে পাছে ওরা যদি বুঝে ফেলে! আর ওর পিছু নেয়া ছেলে গুলোও সেটা আন্দাজ করতে পেরে ধীরে ধীরে আগাচ্ছে দিপার সান্নিধ্যে। প্রতিদিনই স্যারের বাসা থেকে বাড়ি ফিরতে সাঁঝ নেমে আসে, আবছা অন্ধকার মাড়িয়েই বাড়ি ফেরে দিপা। রাতে চশমার ভেতর থেকে পথ দেখতেও কষ্ট হয় দিপার। কিছুদিন ধরে দিপা লক্ষ্য করছে একটা ছেলে ওর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে!
বড় নীল ফ্রেমের চশমা পরা ছেলেটাও হয়তো চোখে একটু কম দেখে! দিপার আসলে চোখে সমস্যা না, ওর চশমা পরার কারণ হচ্ছে মাথা ব্যাথা। মাস দুই আগে মাথা ব্যাথার জন্য ডাক্তার দেখানোর পর এই চশমা পাওয়া হয় ওর।
কয়েকদিন ধরে ছেলেটা ওর সাথে আরও কয়েকটি ছেলে সঙ্গে নিয়ে দিপাকে অনুসরণ করে! আগে ছেলেটা যতই তাকিয়ে থাকুক দিপা ভয় পেতো না, ইদানীং ছেলেটাকে আরও কয়েকটি ছেলে সহ দিপার পিছু নিতে দেখে বেশ ভয় হয় দিপার! অজানা এক ভয় বাসায় ফিরেই যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো দিপা। এই শীতের হিম হিম ঠান্ডায়ও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। মা সোফায় বসে দিপার কার্যকলাপ লক্ষ্য করছেন, মেয়েটা এতো বিচলিত কেনো বুঝতে পারছেন তিনি।
“কিরে মা কি হয়েছে তোর?”
“কই কিছু হয়নি তো মা”
“তাইলে এতো কি ভাবছিস?”
“নাহ তো, কি ভাববো!”
“শীতের ভিতরেও তুই ঘামছিস কেনো তাইলে?
মায়ের কথা শুনে কপালে হাত দিতেই হাতটা ভিজে এলো দিপার। একবার হাতের দিকে তাকাচ্ছে আর একবার মায়ের দিকে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না,
“না মা, শীত তো তাই জলদি জলদি হেঁটে এসেছি যেনো শীত কম লাগে। এজন্য একটু ঘেমেছি হয়তো।
“আচ্ছা, ফ্রেশ হয়ে জামা পাল্টে নে নয়তো ঠান্ডা লেগে যাবে”
“হুম”
রাত দশটা পয়তাল্লিশ, ছেলেটার কথা একরকম ভুলে বসেছিল দিপা কিন্তু ফেবুতে গিয়ে নিউজফিডে ঢুকতেই চক্ষুচড়ক গাছ! নীল ফ্রেমের চশমা পরা ছেলেটা রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছে দিপাকে! ছেলেটার নাম দেখার আগে ছবির দিকে চোখ গেছে দিপার। অনেকগুলো মেসেজও এসেছে ওই আইডি থেকে, কিন্তু মেসেজ না দেখেই সাথে সাথে দিপা বেরিয়ে এসেছে ফেবু থেকে। “মাকে লুকিয়ে কি ঠিক করলাম!” আনমনে নিজেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিপা কিন্তু উত্তর আসে না। ছেলেটাকে দেখলে তো বেশ সিধে সাধা মনে হয় কিন্তু সাথে যাদের নিয়ে অনুসরণ করলো তাদের ঠিক সুবিধের মনে হচ্ছে নাহ! সকালে কলেজ যাওয়ার পথেও ছেলেটাকে দেখলো দিপা। ওদের বাসা থেকে কলেজ খুব একটা দূরে না কিন্তু তাও আজ বেশ দূরত্ব অনুভব হচ্ছে দিপার।
তবে ছেলেটাকে একা দেখে মনে একটু স্বস্তি এসেছে, চশমার ভিতর থেকে আড়চোখে তাকিচ্ছিল ছেলেটা বার বার রাস্তার এক পাশে দিপা আর অন্য পাশে ওই ছেলেটা। মাঝে দূরত্ব থাকলেও একরকম পাশাপাশি হাঁটছে দুজন। দিপা একটু আড়চোখে তাকালো যে আছে কিনা আর ওমনি দিপার পাণে চেয়ে ছেলেটা উষ্ঠা খেলো ইটের সাথে! ফিক করে হাসি বের হলো দিপার মুখ থেকে, তাতেই থেমে গেলো ছেলেটার পা। এক মনে দাঁড়িয়ে দিপার পাণেই চেয়েছিল ছেলেটা, ততক্ষণে দিপা চলে গিয়েছে তবুও দূর থেকে দিপার চলে যাওয়া পথ দেখছে ছেলেটা। কলেজ থেকে ফেরার পথেও ছেলেটাকে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দিপা কিন্তু এইবার ছেলেটা একা নয়, ওর সাথে কাল রাতের ছেলে গুলোও আছে। এভাবে প্রতিদিন যেতে আনুমানিক তিন মাস চলে গেলো, কিন্তু ছেলেটা একটাবার দিপার সামনে এসে কথা বলেনি।
দিপার চলার পথে ওই ছেলেটাকে দেখা এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যেখানেই যায় ছেলেটা ওর পিছেই থাকে, কখনো কখনো দেখা যেতো না হয়তো ওই সময় ছেলেটা খাওয়া দাওয়া করতো এমনটাই ভাবে দিপা। দিপার ভয়ও এখন কমে এসেছে, এখন আর ভয় হয় না ওর কারণ দূর থেকেই ছেলেটা ওর মনে বিশ্বাস জন্ম দিয়েছে। দিপার যেদিন জন্মদিন ছিল ওইদিন রাত বারোটায় ছেলেটা ফুল ছুড়ে মেরেছিল দিপার বারান্দায় আর সাথে একটা ছোট্ট চিরকুট। তাতে লেখা ছিল, “শুভ জন্মদিন, জন্মদিনে অনেক অনেক শুভেচ্ছা নিবেন। অনেক বিরক্ত করেছি আপনাকে কিন্তু আর নয়, চলে যাচ্ছি বহুদূরে অজানা প্রান্তরে। আর হয়তো ফেরা হবে না আপনার তীরে। ভাল থাকবেন, নিজের খেয়াল রাখবেন। ভাগ্য সহায় হলে আপনাকে আমার ঘরে নেয়ার ব্যবস্থা করে তবেই ফিরবো নয়তো না।
অপেক্ষা করতে বলবো না কিন্তু কেনো যেনো মনে হচ্ছে আপনি অপেক্ষা করবেন। যদি করেন তো করলেন আর না হয় থাক তা ভাবতে পারছি না তাই বলতেও পারছি না। আল্লাহ হাফিজ” চিরকুটটা পড়ার পরে দিপার ইচ্ছে হয়েছিল একবার বারান্দায় যাওয়ার, কিন্তু কি ভেবে যেনো যাওয়া হয়নি। ছেলেটার কথা সত্যি ছিল সেদিন কারণ তারপর থেকে আজ তিন বছর পার হয়ে গেলো কিন্তু ছেলেটাকে কখনোই আর দেখেনি দিপা। অনেক খুঁজেছে দিপা কিন্তু কোথাও দেখা মেলেনি, ফেবুতেও হাজার খুঁজেছে কিন্তু ছেলেটার সেই আইডি মুছে ফেলা হয়েছিল যার দরুন সেই মেসেজ গুলোও দিপা পায়নি। তবে প্রতিবছর দিপার জন্মদিনে একটা ফুলের তোড়া উপহার পায় দিপা। তাও ঠিক সেদিনের মতই যেভাবে ছুড়ে মারা হয়েছিল সেভাবেই।
দিপা ভাবে হয়তো আশেপাশেই কোথাও লুকিয়ে আছে ছেলেটা কিন্তু নাহ তা ভুল।
ওই তিন মাসে দিপা যে ছেলেটাকে ভালবেসে ফেলবে তাও ও বুঝতে পারেনি। আজ দিপার বাসায় পাত্রপক্ষ আসবে দিপাকে দেখতে কিন্তু দিপা নারাজ, তবে বাসায়ও সে বলতে পারছে না কারণ কোন ভরসায় সে বলবে! কিভাবে অপেক্ষা করবে যার কোনো হদিস নেই। পরিবারের মুখে তাকিয়ে নিজেকে জোর পূর্বক সে বসিয়েছে পাত্রপক্ষের সম্মুখে, কিন্তু পাত্রকে দেখেই দিপা হতবাক! পাত্রের চোখে নীল ফ্রেমের পুরনো চশমাটা আজও আছে….
(সমাপ্ত)