১৪. রাত্রি যখন গভীর হয়
প্রতি রাতের মত আজও রাত্রির অন্ধকার ধূসর কুয়াশার ঘোমটা টেনে পায়ে পায়ে শ্রান্ত ক্লান্ত ধরণীর বুকে নেমে এল। পাখির দল কুলায় গেল ফিরে। সারাদিন খনিতে খেটে ক্লান্ত সাঁওতাল কুলিকামিনরা যে যার ধাওড়ায় ফিরে এসেছে। সুব্রত চুপটি করে বারান্দায় একটা বেতের ডেকচেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে দূরের দিকে তাকিয়ে ছিল।
কাল হয়ত কিরীটীর চিঠি পাওয়া যাবে। কিন্তু আজকের রাতটা?
এ কি নির্বিঘ্নে কাটবে?
রাতের অন্ধকারে কি আজ আর বিভীষিকাময় মৃত্যুর কঠিন হিমপরশ কোনো হতভাগ্যের ওপরে নেমে আসবে না?
দূর থেকে সাঁওতালী বাঁশি ও মাদলের সুর ভেসে আসে।
জীবনের কোনো মূল্যই ওদের কাছে নেই। প্রকৃতির স্নেহের দুলাল ওরা। মাটির ঘরে অযত্নে বর্ধিত মাটি-মাখা সহজ ও সরল শিশুর দল। প্রাণপ্রাচুর্যে জীবনের পাত্র ওদের কানায় কানায় পূর্ণ।
শঙ্কর এখনও খাদ থেকে ফেরেনি।
ঝুমন গরম চা, কেক ও ফল প্লেট সাজিয়ে দিয়ে গেল।
সুব্রত একটুকরো কেক মুখে পুরে চায়ের কাপটা তুলে নিল। বাইরে আজ ঠাণ্ডাটা যেন একটু চেপেই এসেছে।
মাঝে মাঝে খোলা প্রান্তর থেকে আসন্ন রাতের স্তব্ধতা যেন বহন করে আনে হিমেল হাওয়ার ঝাপটা।
একসময় চায়ের পাত্র নিঃশেষ করে সুব্রত পাশের টিপয়ে সেটা নামিয়ে রেখে দিল। কত রকম চিন্তা একটার পর একটা মাথার মধ্যে এল মাকড়সার জালের মত।
এবং সেই জালের সূক্ষ্ম তন্তুগুলি বেয়ে বেয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারটি দাগের মত কী যেন ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।
কী ওগুলো?
ভূতের মত একাকী চুপ করে এই বারান্দায় ঠাণ্ডায় বসে বসে কি ভাবছেন?
চোখ তুলে তাকায় সুব্রত।
কে? শঙ্করবাবু? সুব্রত ধীরকণ্ঠে বলে।
কী এত ভাবছেন বলুন তো? এখানে এসে আপনার এত কাছে দাঁড়িয়ে আছি, তবুও টের পাননি?
হাসতে হাসতে শঙ্কর জিজ্ঞাসা করে।
এবেলা খাদের অবস্থা কেমন? Peacefully work চলছে তো?
কতকটা, যদি কিছু দুর্ঘটনা না আচমকা এসে পড়ে।
হঠাৎ এ কথা কেন শঙ্করবাবু?
বলা তো যায় না। শঙ্কর মৃদুকণ্ঠে বলে, বিমলবাবুর ভাষায় বলতে গেলে এই ভৌতিক ফিল্ড-এ যখন-তখনই যে কোনো ভয়ঙ্কর ব্যাপারই তো ঘটা সম্ভব সুব্রতবাবু! তাছাড়া নতুন ম্যানেজারবাবু এখনও ভূতের হাতে আক্রান্ত হননি যখন!
সুব্রত কোনো কথা বলে না।
তারপর আপনার কাজ কতদূর এগুলো সুব্রতবাবু? How far you have proceeded?
অনেকটা।
বলেন কী? শঙ্করের কণ্ঠস্বর উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ। কিন্তু এখনও আমাদের দারোগাবাবু এসে পৌঁছলেন না!
দারোগাবাবু এখন আসবার কথা আছে নাকি?
শঙ্কর উৎকণ্ঠিতভাবে প্রশ্ন করে।
তাঁকে সন্ধ্যার পরই যে বাসটা থামে, তাতে দুজন কনেস্টবল নিয়ে আসতে বলে দিয়েছিলাম।
কনেস্টবল নিয়ে আসতে বলেছিলেন! কেন? হঠাৎ কনেস্টবল নিয়ে আসবেন কেন? কাউকে গ্রেপ্তার করবেন নাকি?
শঙ্কর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে সুব্রতর দিকে তাকাল। কিন্তু চারদিককার অন্ধকারে কিছু দেখা গেল। আবার শঙ্কর প্রশ্ন করে, আমি যে অন্ধকারেই থাকছি সুব্রতবাবু। Please খুলে বলুন। কাকে গ্রেপ্তার করবেন?
খুনীকে। এ রহস্যের হোতাকে।
পেরেছেন বুঝতে তাহলে সত্যিই? পেরেছেন জানতে হত্যাকারী কে?
একরাশ উৎকণ্ঠা শঙ্করের গলার স্বরে ফুটে রেরুল।
হ্যাঁ। সুব্রত জবাব দেয়।
কে সুব্রতবাবু?
আপনিই বলুন কে? সুব্রত স্মিতভাবে শঙ্করের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
আগে বলুন, এই খনির area-র মধ্যে সেই লোকটি আছে কিনা? তারপর বলছি।
শঙ্কর সুব্রতর মুখের দিকে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
যদি বলি আছে! সুব্রত মৃদুস্বরে জবাব দেয়।
তাহলে বলব, আমিও একজনকে সন্দেহ করেছি সুব্রতবাবু।
কে? বিমলবাবু—এই খনির সরকার?
হ্যাঁ। কিন্তু আশ্চর্য, how could you guess! আপনারা দেখছি সর্বজ্ঞ। Am I right সুব্রতবাবু?
অধীরভাবে শঙ্কর সুব্রতকে প্রশ্ন করে।
You are right শঙ্করবাবু। ধীরভাবে সুব্রত জবাব দেয়।
আজ তাহলে বিমলবাবুকে গ্রেপ্তার করছেন বলুন? শঙ্কর আবার জিজ্ঞাসা করে।
এমন সময় দারোগাবাবু দুজন কনেস্টবল সমভিব্যাহারে এসে হাজির হলেন। বাংলোর বারান্দায় উঠতে উঠতে দারোগাবাবু বললেন, আমরা এসে গেছি সুব্রতবাবু।
Many thanks, আসুন আসুন। Everything O. K.! একটু চাপা গলায় বলে ওঠে।
Yes, everything 0. K.দারোগাবাবু জবাব দিলেন।
আপনারা তাহলে একটু অপেক্ষা করুন। আমরা চট্ করে খাওয়াদাওয়া সেরে ready হয়ে নিচ্ছি। উঠুন শঙ্করবাবু, রাত হয়ে গেছে, চলুন খেতে যাওয়া যাক।
চলুন।
সুব্রত ও শঙ্কর দুজনে উঠে পড়ল।
.
রাত্রি গভীর হয়েছে।
সুব্রত, শঙ্কর, দারোগাবাবু তিনজনে নিঃশব্দে কালো কয়লার গুঁড়ো কাঁকরঢালা অপ্রশস্ত রাস্তাটা, যেটা বরাবর অফিসারদের কোয়ার্টারের দিকে চলে গেছে সেই রাস্তা ধরে প্রেতের মত এগিয়ে চলে। সকলেরই পায়ে রবার সু। কাঁকর কয়লা বিছানো রাস্তা দিয়ে চললেও কোনো শব্দ পাওয়া যায় না।
সকলে এসে বরাবর বিমলবাবুর কোয়াটারের সামনে দাঁড়াল।
এর মধ্যেই চারিদিকে কুয়াশা জমেছে।
আশেপাশের সব কিছু আবছা অস্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিমলবাবুর কোয়াটারটা কুয়াশার ওড়না জড়িয়ে যেন আবছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আগে সুব্রত ও তার পিছনে দারোগাবাবু ও শঙ্কর পা টিপে টিপে বিড়ালের মত সন্তর্পণে বারান্দা অতিক্রম করে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
ওকি! সুব্রত সবিস্ময়ে দেখল, দরজার দুপাশের দুটো ভেজানো কবাটের ফাঁক দিয়ে ঈষৎ স্রিয়মাণ একটা আলোকরশ্মি যেন অতি সন্তর্পণে বাইরে উঁকি দিচ্ছে ভয়ে ভয়ে।
সুব্রত একবার চেষ্টা করলে দরজার ফাঁক দিয়ে কিছু দেখা যায় কিনা দেখবার। কিন্তু কিছুই দেখা যায় না।
আঙুলের চাপ দিতেই ভেজানো দরজা আরও ফাঁক হয়ে গেল। ঘরের এক কোণে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে।
প্রচুর ধূম উদগিরণ করে হ্যারিকেনের চিমনিটা কালো হয়ে ওঠায় আলো অত্যন্ত মলিন বলে মনে হয়।
প্রথমটায় সেই মলিন আলোয় সুব্রত কিছুই দেখতে পেল না, কিন্তু পরক্ষণেই ভাল করে দৃষ্টিপাত করতেই সুব্রত ভয়ঙ্কর রকম চমকে উঠল।
ওকি! সেই শালবনে দেখা পাগলটা না?
কে একজন উপুড় হয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। পাগলটা সেই ভূপতিত দেহের উপরে ঝুঁকে অত্যন্ত নীচু হয়ে কি যেন করছে।
ডান হাতের পিস্তলটা বাগিয়ে, বাঁ হাতে টচটা ধরে বোম টেপার সঙ্গে সঙ্গেই সুব্রত আচমকা দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল।
টর্চের তীব্র আলোর ঝাপটা মুখের ওপরে পড়তেই পাগলটা চমকে লাফিয়ে উঠল। কিন্তু ওকি! পাগলটার হাতে একটা উদ্যত পিস্তল!
সুব্রত থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
কে তুই? বল শীগগির, কে তুই?
সহসা একটা উচ্চরোলের হাসির প্রচণ্ড উচ্ছাসে সমগ্র ঘরখানি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল।
পাগলটা হাসছে।
সকলেই স্তম্ভিত, বাক্যহারা।
হঠাৎ পাগলটা হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক গলায় ডাকল, সুব্রত!
সুব্রত চমকে উঠল।
কে?
ভয় নেই, আমি কিরীটী।
অ্যাঁ! কিরীটী, তুই! একি বিস্ময়!
সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করও বলে উঠল, কিরীটী তুই!
হ্যাঁ। কেন, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি শ্রীহীন কিরীটী রায়!
কিন্তু ব্যাপার কী? মাটিতে পড়ে লোকটা কে?
সুব্রত কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
বিমলবাবুর মৃতদেহ।
কার? কার মৃতদেহ? অস্ফুট কণ্ঠে সুব্রত চিৎকার করে উঠল।
কলিয়ারীর সরকার বিমলবাবু। যাকে গ্রেপ্তার করবার জন্য তোমাদের আজকের রাত্রের এই দুঃসাহসিক অভিযান বন্ধু! চল বন্ধু, এবারে বাসায় চল। দারোগাবাবু, আপনার সঙ্গে যে কনেস্টবল দুটি এনেছেন, তাদের এই মৃতদেহের জিম্মায় আজকের রাতের মত রেখে চলুন শঙ্করের বাংলোয় ফেরা যাক। চল সুব্রত, হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কী? গাম ইলাস্টিক দিয়ে একমুখ দাড়ি করে চুলকে চুলকে প্রাণ আমার ওষ্ঠাগত হবার যোগাড় হল!
কিন্তু—সুব্রত আমতা আমতা করে বললে।
এর মধ্যে আবার কিন্তু কী হে ছোরা! চল, চল্। রাত কত হল তার খবর রেখেছিস? বাড়িতে চল, ধীরেসুস্থে বলব।
তাহলে বিমলবাবু…
সুব্রতর কথা শেষ হল না, কিরীটী বলে উঠল, আজ্ঞে না। You are mistaken, বিমলবাবু খুনী নন।
তবে?
তবে আবার কী? অন্য লোক খুনী।
কে খুনী?
কাল সকালে বলব। এখন চল বাংলোয় ফেরা যাক।
কিন্তু আমার যে কেমন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে কিরীটী! সুব্রত বললে।
অর্থাৎ তুমি একটি হস্তীমূখ। শোন, কানে কানে একটা কথা বলি।
সুব্রতর কানের কাছে মুখ নিয়ে চাপা স্বরে কিরীটী কি যেন ফিসফিস করে বলতেই সুব্রত লাফিয়ে উঠল, অ্যাঁ, বলিস কি আশ্চর্য, আশ্চর্য!
কিন্তু তার একটি ডান ও একটি বাঁ হাত ছিল যন্ত্রস্বরূপ। কিরীটী বললে, এই হতভাগ্য বিমলবাবু হচ্ছে বাঁ হাত।
সে রাত্রে বাংলোয় ফিরে গরম জল করিয়ে কিরীটী ছদ্মবেশ ছেড়ে স্থির হতে হতে প্রায় রাত্রি আড়াইটে বেজে গেল।
আগের পর্ব :
০১. নতুন ম্যানেজার
০২. ভয়ঙ্কর চারটি কালো ছিদ্র
০৩. মানুষ না ভূত
০৪. আঁধারে বাঘের ডাক
০৫. আবার ভয়ঙ্কর চারিটি ছিদ্র
০৬. খাদে রহস্যময় মৃত্যু
০৭. নেকড়ার পুঁটলি
০৮. পুঁটলি-রহস্য
০৯. আঁধার রাতের পাগল
১০. অদৃশ্য আততায়ী
১১. ময়না তদন্তের রিপোর্ট
১২. আরও বিস্ময়
১৩. মৃতদেহ
পরের পর্ব :
১৫. রহস্যের মীমাংসা