নতুন বিয়ের পর নববধূর ঘনঘন বাপের বাড়িতে যাওয়া-আসা করাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ এসময় পরিবারের প্রতি অন্যরকম টান কাজ করে, যা বিয়ের আগে অনুভূত হয় না। আর যদি শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সাথে না থাকেন, তাহলে তো কথাই নেই। বরের অনুপস্থিতিতে একাকীত্বটা আরো ভাল করে জেঁকে ধরে তখন। শ্বশুর-শ্বাশুড়ি সাথে থাকলে বাবা-মায়ের শূন্যতাটা কোনো না কোনোভাবে ঠিকই পূরণ হয়ে যায়। মোট কথা, যৌথ পরিবার হলে সময়গুলো ভাল কাটে। এদিক দিয়ে আমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়। আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তাদের নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে এই কংক্রিটের শহরে এসে দমবন্ধ করা পরিবেশে দিনযাপন করতে কিছুতেই রাজি নন। ননদ দুটোর বিয়ে হয়ে গেছে আর ভাসুরেরও আলাদা সংসার। এখানে আমার সংসার বলতে আমি আর আমার বরমশাই।
বাবা গতকাল ফোন করে আমাদের দু’দিনের জন্য যেতে বলেছেন। অন্যান্যদের কাছে শুনি, তাদের বরদের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা বললে নানাধরনের টালবাহানা শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আমার বরের বেলায় সবই উল্টো। আমি একবার বলতেই তিনি নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেছেন। কিন্তু সেদিন থানায় রাত কাটানোর পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমি আমার বরমশাইয়ের সাথে ঢাকার বাইরে তো দূরের কথা, ঢাকার ভেতরেও কোথাও যাবো না। আর যদি দুজনের একসাথে কোথাও যাওয়ারও থাকে, তাহলে যাত্রাপথে অবশ্যই আলাদা যাবো।
যাই হোক, সিদ্ধান্তনুযায়ী আমরা দু’জন আলাদা রিক্সায় রওনা হলাম আমার বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে। অবশ্য যদি দু’তিনবার বরমশাই এক রিক্সায় দু’জন পাশাপাশি বসে যাওয়ার অনুরোধ করতেন, তবে ঠিকই পাথর গলে যেত। আমি আশাও করেছিলাম তাই। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বিনাবাক্যে তিনি আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন। প্রথমে সন্দেহ করেছিলাম, বরমশাই বোধহয় যাত্রা বিরতিতে কোনো পরনারীর সংগে সময় কাটাবেন। পরক্ষণেই আবার ভাবলাম, যে মানুষ নিজের নববিবাহিতা স্ত্রীকে বশে আনতে পারে না, সেই মানুষের সম্পর্কে এসব উদ্ভট ধারণা করা নিতান্তই বোকামি ছাড়া আর কিছু না। আপনারা হয়তো বলবেন, নিজের বউয়ের চেয়ে পরনারীকে বশে আনা সহজ। কিন্তু ভাই/বোন, সেজন্যও কিছু ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে, যার ছিটেফোঁটাও নেই তার মধ্যে।
বাপের বাড়িতে সময়মতো পৌঁছে সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় শেষ করে ফ্রেশ হয়ে এসেও যখন দেখলাম, বরমশাইয়ের এখনো কোনো পাত্তা নেই তখন খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেলাম। কোনো বিপদাপদ হল না তো আবার! দুজন তো একইসাথে রওনা দিলাম। আমাদের বাসা থেকে আমার বাপের বাড়ির দূরত্ব বেশি না, রাস্তাও একটাই। দেরী হলেও ১০/১৫ মিনিটের বেশি দেরী হওয়ার কথা না। এদিকে বাবা-মা কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন, “কেন বরমশাইকে সাথে করে নিয়ে এলাম না” এ নিয়ে। তাদেরকে তো আর বলতে পারি না সেই কালরাত্রির কথা। সেদিন সেই মামার নাম্বার পর্যন্ত মুখস্থ ছিল না বরমশাইয়ের। ভাগ্যিস, ওসিকে মামার নাম বলতেই চিনে ফেলেছিলেন। তারপর আমাদের সাথে কথা বলিয়ে দিয়েছেন। কল করবো না করবো না করেও শেষমেশ আর সইতে না পেরে কল করেই ফেললাম বরমশাইকে। তিনবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলেন তিনি।
– হ্যাঁ হ্যালো, কোথায় তুমি? প্রতিউত্তরে আমি উত্তেজিত ভঙ্গীতে পালটা প্রশ্ন করলাম।
– আমি কোথায় মানে? আপনি কোথায়?
– আমি তো আমার শ্বশুরবাড়ির ড্রয়িংরুমে বসে আছি।
বেডরুমের পর্দাটা খানিকটা সরিয়ে ড্রয়িংরুমে উঁকি দিয়ে তার কথার সত্যতা যাচাই করে নিলাম। তারপর রেগেমেগে জিজ্ঞেস করলাম,
– ফাজলামো হচ্ছে আমার সাথে? ভালোয় ভালোয় বলুন, কোথায় আছেন আপনি।
– আরে রেগে যাচ্ছো কেন? সত্যিই আমি চলে এসেছি। তুমি এখনো আসছো না কেন? আমি তো এর মধ্যে নানী-
শ্বাশুড়ির হাতে চমৎকার একগ্লাস শরবতও খেয়ে ফেলেছি। চিন্তা করো না, তোমার জন্যও রাখা হয়েছে নিশ্চয়ই। কি নানী, রেখেছেন না? বরমশাইয়ের কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে না, তিনি মজা করছেন। তার উপর আবার আমাকে লাইনে রেখে পাশে থাকা কাউকে জিজ্ঞেসও করছেন আমার জন্য শরবত রেখেছে কিনা। কাহিনী গণ্ডগোল আন্দাজ করতে পেরে আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,
– আপনার পাশে যিনি আছেন, তাকে দিন তো ফোনটা।
বরমশাই আমার কথামতো তার পাশে থাকা বৃদ্ধাকে ফোন ধরিয়ে দিলেন। বৃদ্ধার “হ্যালো” শুনে মনে হচ্ছে, তিনি এ শহরের মানুষ না। হয়তো এখানে আত্নীয়ের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। আমি কিছু বলার আগেই বৃদ্ধা নরম সুরে আমাকে বুঝাতে লাগলেন,
– এমন মানসিক রোগীরে কেউ একলা ছাড়ে, বইন? বেশভূষা ভাল দেইখা আমরা তো তাও ভেতরে ঢুকতে দিছি,শরবত বানাইয়া দিছি। অন্যকেউ হইলে তো দৌঁড়ানি দিয়া রাস্তায় নামাইয়া দিতো। বৃদ্ধার কথা শুনে পাশ থেকে বরমশাই চেঁচাতে শুরু করলেন,
– এই, আপনি কাকে মানসিক রোগী বলছেন? আমি সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মানুষ। দিন, আমাকে দিন ফোনটা। বৃদ্ধার কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নিয়ে বরমশাই বললেন,
– এই প্রিয়তি, তাড়াতাড়ি আসো তো তুমি। আচ্ছা, বাবা-মাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন বলো তো? দীর্ঘশ্বাস নিলাম আমি।
– আপনি কোথায় আছেন বলুন তো?
– আবারো একই প্রশ্ন করছো!
– ঠিকানাটা বলুন প্লিজ।
– তুমিও দেখছি আমার মত ভুলোমনা হয়ে গেছো। আচ্ছা বলছি।
সরকারবাড়ির গলিতে ঢুকতেই একটা মসজিদ আছে না? ওই মসজিদ পেরিয়ে সামনে যেতেই দুটো বিল্ডিং এর পরে যে সাদা আর ঘিয়ে রঙের বাড়িটা আছে? আমি ওই বিল্ডিং এর চারতলার ফ্ল্যাটে আছি। ঘটনা বুঝতে পেরে অনেক কষ্টে মেজাজ ঠাণ্ডা রেখে বললাম আমি,
– আপনি ভুল ঠিকানায় গিয়ে বসে আছেন। আমাদের বিল্ডিং এর রঙ শুধু সাদা। আপনি পরের বিল্ডিং এ চলে গিয়েছেন। এখন আপনিই বলুন, আমি আপনাকে নিতে আসবো নাকি এইটুকু রাস্তা আপনি একা আসতে গিয়ে আবার গুলিয়ে ফেলবেন?
ফোনের লাইন কেটে গেল সাথে সাথে। বাসায় এসে বরমশাই আমাদের বাড়িওয়ালার জাতগোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগলেন, এই বাড়ির রংও সাদা করার জন্য। পাশাপাশি দুটো বিল্ডিং এর রঙ কাছাকাছি দেখতে হলে, এরকম ভুল হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। তাছাড়া এই বাসায় তিনি মাত্র একবার এসেছেন, তাও কিছুক্ষণের জন্যে। সুতরাং এতে তার কোনো দোষ নেই। আর ওই ভুল বাসায় যারা উপস্থিত সদস্য ছিলেন, তারা ছিলেন মেহমান, গ্রাম থেকে বেড়াতে এসেছেন। বাসার আসল মালিক আর মালিকের বউ ছিলেন বাইরে। তাই বরমশাই ভেবেছিলেন, আমাদের বাসায় হয়তো গ্রাম থেকে মেহমান এসেছেন আর বাবা-মা বাইরে গেছেন। আমি তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম,
– আসার সময় যে দই মিষ্টিগুলো কিনেছিলেন, সেগুলো কোথায়?
– ওগুলো তো ওই ভুল ঠিকানায় দিয়ে এসেছি। এতক্ষণে হয়তো বাচ্চাকাচ্চাগুলো খাওয়াও শুরু করে দিয়েছে। আমি আর কিছু বললাম না। বলা ভাল, বলার মত কোনো ভাষা খুঁজে পেলাম না। রাত দুটোর সময় বরমশাই আমাকে কাঁচা ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললেন,
– জানো প্রিয়তি, ওই বাসার নানীর হাতের শরবতটা না বেশ সুস্বাদু ছিল। যতোই তিনি আমাকে মানসিক রোগী বলুক, শরবতের প্রশংসা করতেই হবে। তুমি একবার সময় করে গিয়ে উনার কাছ থেকে রেসিপিটা জেনে এসো তো।