এই মুহূর্তে দুইটা চিঠি আমার হাতে। একটায় লেখা, ‘অনু, মোনালিসাকে লোকে সুন্দর কেন বলে আমি জানিনা। আমার তেমন লাগেনি কখনো। তবে মোনালিসার হাসি সুন্দর। এইদিক দিয়ে তোমার সাথে মোনালিসার পার্থক্য একটা। তোমার ভ্রুঁ আছে। তোমায় প্রচণ্ড ভালো লেগেছে আমার। আমি স্পর্শ। পাথুরিয়ায় থাকি। এটা আমার নাম্বার।’ বাকি চিঠিটাও একদম একিই। শুধু ওখানে অনুর জায়গায় লিলি লেখা। আমি চিঠি দুটো পকেটে পুরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোরা যে একে অপরের বোন, ছেলেটা জানে?’ অনু আর লিলি মাথা দুলালো। লম্বা বেণী দুটো দুলে উঠলো ওদের। জানেনা।
‘ছেলেটাকে দেখিয়ে দিস তো। এখন ভেতরে যা। বাইরে ঘুরাঘুরি করিস না বেশি।’ অনু আর লিলি হনহন করে হেঁটে ভেতরে ঢুকে গেলো। অনু একটু পরই ফিরে এলো, হাত ধরে টেনে আম গাছতলায় নিয়ে হাত উঁচু করে বললো, ‘ভাইয়া, ওই যে কালো চশমা পরা ছেলেটা.. হাতে নীল ব্রেসলেট।’ স্পর্শকে আমি প্রথমবার দেখি তখন। লম্বা, চিকন স্বাস্থ্য। লম্বাটে মুখ, নাকের নিচে হালকা গোঁফের রেখা। বেশ স্টাইল করে চুল কাটা। হাতে নীল রঙা ব্রেসলেট, অন্য হাতে ঘড়ি। বয়স অনুমান করলাম, আঠারো। এই বয়সী ছেলের শার্টের বোতাম দুটো খোলা থাকে। স্পর্শের তিনটা বোতাম খোলা। আমার চেয়ে পাঁচ বৎসরের ছোট। কৈশোর পার হওয়ার পর কিছু ছেলে বখে যায়। এদের দুনিয়া হয়ে আসে একটানা সিগারেট কিংবা নারী। অথবা উভয়ই। এই ছেলে ভয়ানক টাউট।
আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে কয়েকজন ছিলো, যাদের কথাবার্তা শুরু হতো ‘দোস্ত একটা মেয়ে পটাইছি’ দিয়ে। শেষ হতো, ‘দোস্ত, মেয়েটাকে জাস্ট ছেড়ে দিছি!’ ছাড়ার আগে কেউ কেউ ‘খাওয়া’ শব্দটা কুৎসিত উপমায় ব্যবহার করতো। এদেরকে আমরা টাউট ডাকতাম। খাঁটি বাংলায় ছ্যাঁচড়া। স্পর্শকে আমার প্রথম দেখায়ই মনে হলো, এই ছেলে শুদ্ধ ছ্যাঁচড়া। কোনো ভেজাল নেই। অনু এবং লিলি সম্পর্কে আমার মামাতো বোন। বিয়ে বাড়ির এই বিশাল আয়োজনটা ওদের বড় বোন অনিমাকে ঘিরে। অনিমারা তিন বোন। ভাই নেই বলেই ভাইয়ের ছোটখাটো দায়িত্ব আমার কাঁধে।
ছেলেটা বরপক্ষের কোনো আত্মীয় হবে। বরের সাথে আসার পর পরই অনু আর লিলি দুইজনকেই বেশ কিছুক্ষণ চোখে চোখে রেখেছে সে। সুযোগ পেয়ে আলাদা ভাবে দুইজনের হাতেই চিঠি গুজে দিয়েছে। যদিও আমার ধারণা, ইতিমধ্যে আরো কিছু মেয়ের হাতেও সে একিই চিঠি গুজে দিয়েছে। শুধু নামের জায়গাটা বদল করে। ‘তোমার নাম স্পর্শ?’ স্পর্শ এদিক ফিরে তাকায়। ডানহাতের তর্জনি আর মধ্যাঙ্গুলির মাঝখানে সিগারেট আটকানো। আমায় দেখে ডানহাত সামান্য পেছনে নেয়। নিতান্তই লোকদেখানো ভদ্রতা বলে মনে হলো আমার। এইসব ছেলে মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়তে পারে। ‘জি। আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না ভাইয়া?’ ‘আমি অনু আর লিলির ভাই।’ ‘অনু আর লিলি কে?’ আমি একটু থামলাম। মুখের উপর প্রশ্ন করছে ছেলেটা। তাও উদ্ভট প্রশ্ন! চূড়ান্ত বেয়াদব। আমার ইচ্ছে করলো কানের নিচে জোরদার একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিই। অতিকষ্টে নিজেকে কন্ট্রোল করে বলি, ‘যাদের হাতে চিঠি গুজে দিয়েছ তুমি।’
ছেলেটা একটু ভাবলো। তারপর বললো, ‘ও’ আমি বিস্মিত হলাম। ভাইয়া ফোন দিলো ওই মুহূর্তে, জরুরি দরকার। ছেলেটাকে রেখে আসতে হলো। মাথার মধ্যে ছেলেটির ‘ও’ জবাবটা সুঁচের মতোন গাঁথলো যেন বেশ কয়েকবার। যখন ফিরে আসলাম, ছেলেটি নেই। একটু এদিক ওদিক ঘুরতেই দেখি বন্ধুদের সাথে হাঁটছে। মাঝেমধ্যে ইতিউতি করে তাকাচ্ছে এখানে সেখানে। কিছু একটা বলে খিক খিক করে হাসছে। বিশ্রি হাসি। নিশ্চয় কোনো অশ্লীল জোকস! এইসব ছেলেদের চেনা আছে আমার। রাগে গা শিরশির করলো অনেকক্ষণ। ভাইয়াকে বিষয়টা বলতেই তিনি ধমকালেন, ‘বিয়ে বাড়িতে অমন হয়, ছেলে মেয়ে কথা বলে। তুই গণ্ডগোল করিসনা। বরপক্ষ। ইজ্জতের ব্যাপার।’ আমি গণ্ডগোল করলাম না।
স্পর্শকে আমি দ্বিতীয়বার দেখি বিয়ের পরদিন। এই অনুষ্ঠানটা বরের বাড়িতে হয়। আমরা বলি, বৌভাত। কনেপক্ষ থেকে কিছু আত্মীয় যায়, প্রচুর আপ্যায়ন আর খাওয়া দাওয়া হয়। আমি খেতে বসে বরের ছোটভাইকে স্পর্শ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। ছোটভাই আঁতকে উঠে, ‘বেয়াদবী করছে কোনো? নিজেদের মানুষ। দূর সম্পর্কের ভাই। বিশ্বাস করেন, লজ্জায় বাঁচিনা। পুরাই ছ্যাঁচড়া, যেখানেই যায়, মেয়ে সম্পর্কিত একটা ঘটনা ঘটিয়ে আসে। আর কত মেয়ের সাথে যে সম্পর্ক আছে বাপরে। একটা ছেড়ে আরেকটা। মাসে মাসে মেয়ে পাল্টায়। খাস প্লেবয়। কেমনে পটায়, ক্যান যে ছাড়ে সে-ই জানে। সেইটা তার ব্যাপার। আমাদের খারাপ লাগে যখন পরিচিত কেউ এসে বলে- তোর ভাইটা এইরকম একটা কাজ করেছে!’ ছোটভাইয়ের মুখ এতটুকুন হয়ে আসে লজ্জায়। আমি আর অনু লিলির কথা বলিনা। কি দরকার!
তবে স্পর্শের সাথে আমার কথা হয়। সিগারেট খেতে আসছি পুকুরঘাটের একটা কোনায়। এইদিকে পাড়ে প্রচুর নারিকেল গাছ। এখনো লুকিয়ে সিগারেট খেতে হয়। নিয়মিত খাইনা। তবে বিয়ে শাদির অনুষ্ঠানে পেটপুরে খাওয়ার পর সিগারেট একটা না হলে যেন কোনো কিছু অপূর্ণ থেকে যায়। সিগারেট ধরিয়ে আমি নারিকেল গাছের আড়ালে দাঁড়াই। স্পর্শকে দেখি, সামনেই আরেকটি গাছে এক পা ভাঁজ করে গাছে ঠেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে একা। আমায় দেখে বিব্রত হলোনা, লজ্জা পেলোনা। পাওয়ার কথাও না। এইসব ছেলেরা সহজে বিব্রত হয়না।
আমি ভেবেছি আমায় দেখে হয়তো আড়ালে যাবে আরেকটু, কিংবা চলে যাবে। স্পর্শ এগিয়ে আসে আমার দিকে। হাতে সিগারেট নিয়ে আমি নিজেই বিব্রত হই। বয়সে ছোট কারোর সামনে সিগারেট খেতে পারিনা। কেমন যেন মনে হয়, ওরা হয়তো মনে মনে ভাববে এটা করে আমি নিজেকে জোর করে ‘সিনিয়র’ প্রমাণ করার চেষ্টা করছি! এই ভাবনাটা আমায় বিব্রত করে। স্পর্শ এগিয়ে এসে সহজ গলায় বলে, ‘অনু আর লিলির কথা মনে পড়েছে। ওদের তো ভাই নেই।’ আমি ভ্রুঁ বাঁকা করে বললাম, ‘ওরা যে একে অপরের বোন, জানতে এটা?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘তারপরও চিঠি দিচ্ছো, তাও দু’জনকেই!’ স্পর্শ ফিক করে হাসলো। কি বিচ্ছিরি লাগলো হাসিটা। সিগারেটে টান দিয়ে ধুমসে ধোঁয়া উড়িয়ে বললো, ‘একটা প্রেমের গল্প শুনবেন?’
যে মানুষটিকে আমরা অপছন্দ করি, তার মুখনিঃসৃত দমফাটানো হাসির জোকসগুলোতেও তেমন একটা হাসি পায়না। পাঞ্চলাইনকে মনে হয় চিপে রস বের করা আখের টুকরো। খসখসে স্বাদ। নাহলে আমি এতক্ষণে হো হো করে হেসে উঠতাম। বিয়ে বাড়িতে আসা প্রতিটা মেয়ের হাতে চিঠি গুজে দেয়া ছেলেটা আমায় একটা প্রেমের গল্প শুনাবে! অতীব হাস্যকর কথা! আমি স্পর্শের দিকে তাকিয়ে সিগারেট ফেলে দিলাম। এটা একটা সুক্ষ্ম তিরস্কার। স্পর্শও সিগারেট ফেলতে বাধ্য হবে। স্পর্শের কোনো ভাবান্তর হলোনা। এইসব ছেলেরা অতি সহজে গায়ে তিরস্কার মাখেনা। সে নারিকেল গাছে ঠেস দিয়ে বললো, ‘দেড় বৎসর আগের কথা। আমার বন্ধুর ভাইয়ের বিয়ে।’ আমি জানি, এই ছেলের সব গল্প শুরু হবে কোনো না কোনো বিয়ে বাড়ি থেকে। শেষ হবে কোনো একটা ফ্ল্যাটে, বিশেষ কোনো রাতে।
‘বিয়ে হলো চট্টগ্রাম শহরের কোনো একটা কমিউনিটি সেন্টারে। পাশের কমিউনিটি সেন্টারে চলছিলো পুজোর হৈ হুল্লোড়। পরদিন দুর্গা বিসর্জন৷ আজ নবমী। আমরা প্রায় জনা দশেক বন্ধু গ্রাম থেকে গিয়েছি বিয়েতে। পুজোর মানুষজন আর সাথে অপরিচিত মানুষজন ঢুকে পড়বে বলে বিয়েতে আসা লোকদের পাস দেয়া হলো একটা করে। পাস দেখালেই ভেতরে ঢুকতে দেবে। আমাদের পাসের দরকার হলো না। গেইটে বন্ধু এসে বললো, ‘ওরা আমার বন্ধু- পাস লাগবেনা!’ আমরা ভেতরে ঢুকলাম। আমি বললাম, ‘জেলখানা মনে হচ্ছে রে, আর বাইরে বের হতে পারবোনা?’ বন্ধু বললো, ‘কেন পারবিনা, যখন ইচ্ছা বাইর হবি, ঢুকবি। গেইটে ঝামেলা করলে আমায় ফোন দিবি। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।’ স্পর্শ আনমনে বলে যাচ্ছে। আমি শুনছি কি শুনছিনা নিয়েও তেমন আগ্রহ নেই। গল্প বলার এমন অদ্ভুত ধরণ প্রথম দেখলাম।
‘আমরা কনে দেখতে গেলাম। কনেকে একটা রুমে রাখা হয়েছে। দরজায় ফিতে বাঁধা। ফিতে কাটতে টাকা দিতে হবে। চট্টগ্রামের বিয়েতে পায়ে হাঁটার প্রতি মোড়ে মোড়ে ফিতে বাঁধা হয়। ফিতে কাটার গেইমস। একটা লেভেল পার হয়ে পরের লেভেল। দরজায় কিছু কিশোরী। খিলখিল করে হেসে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনারা কোন পক্ষ?’ আমি বুদ্ধি খাটিয়ে বললাম, ‘কনেপক্ষ!’ দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো, ‘তাহলে তো কনেকে দেখা যাবেনা, ছবিও তোলা যাবেনা। দুলাভাইয়ের নিষেধ আছে। কনেপক্ষের কোনো ছেলে তার বৌয়ের ছবি তুলতে পারবেনা।’ সেই এক আহামরী ব্যাপার! তার বৌ! ছবি তুললে অন্য কারোর হয়ে যাবে! নিজের বুদ্ধিতে নিজেই আটকালাম। অতি চালাকের গলায় দড়ি হয়। আমাদের হলো অতি চালাকের দরজায় ফিতে। উলটো বলতেও পারছিলাম না এবার, আমরা আসলে বরপক্ষ। তখন এই মিথ্যের দরুণ ফিতে কাটার দাম বাড়বে।’ স্পর্শ আমার দিকে তাকালো। জিজ্ঞেস করলো, ‘এইগুলি কেন বলছি আপনাকে বলুন তো..’ আমি তাকিয়ে রইলাম, জবাব দিলাম না। স্পর্শ কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো, ‘আমি আসলে তুলির বিষয়টা সাজিয়ে নিচ্ছি মনে মনে। কখনো কাউকে বলা হয়না এই গল্পটা। তাই অগোছালো।
তারপর শুনুন, আমাদের কনে দেখা হলো না। তবে আমি দেখে ফেললাম একজনকে। বেণী করা চুল। চোখ দুটোয় গাঢ় কাজল দেয়া। গোল মুখ। হাতে নীল ব্রেসলেট। শাড়ি পরা একটা মেয়ে। শাড়ি না পরলে কিশোরী বলা যেত। আমি হা করে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটি অন্য আরেকটি মেয়ের সাথে দ্বিতীয় তলায় উঠার সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে। গল্প উপন্যাসে নায়িকাদের আহামরি সুন্দরী দেখানো হয়। আমার দৃষ্টি ছাড়া আপনার দৃষ্টিতে মেয়েটা একদম কমন, আর দশটা মেয়ের মতোই গায়ের রঙ, চেহারা, শাড়ি পরা কিংবা ভ্রুঁ কুঁচকানো। অথচ এইগুলিই আমার কাছে অসাধারণ লাগতে শুরু করে। শাড়ি পরে সাধারণত কেউ চুলে বেণী করলে মানায়না, তুলিকে মানিয়ে গেলো। আমি চারোপাশে তাকাই, অনেক মেয়ে এসেছে। অন্যসময় হলে ওদের প্রত্যেকের উপর আমি আলাদা করে প্রেমে পড়তাম। ফ্লার্ট করতাম। অথচ ওইদিন আমি ঘোরে ছিলাম। কি একটা ঘোর। ভীষণ মায়া মায়া ঘোর। আমি কখনো এর আগে এই ঘোরে থাকিনি। এই ঘোরের নাম আমি জানিনা!’
স্পর্শ থামে। আগের সিগারেট পুরো শেষ। ফিল্টারে আগুন আসতেই ঠোঁটে শক লাগলো। দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো ফিল্টার, আরেকটা সিগারেট বের করলো অভ্যস্ত হাতে। চেইন স্মোকার। ধরিয়ে ঠোঁটের ফাঁকে রেখে বললো,
‘তুলি একটু পরই বুঝতে পারলো, আমি দেখছি তাকে। ফলো করছি। আমার দিকে বেশ কয়েকবার চোখাচোখি হলো। প্রত্যেকবার তুলি হাসলো। প্রশ্রয়ের হাসি। একটা নিঁখুত সুখে তৃপ্ত হয়ে আসলাম আমি। প্রানপনে সুযোগ চাইছিলাম, একটু কথা বলার। সুযোগ পাচ্ছিলাম না সঙ্গে থাকা মেয়েটির জন্য। সঙ্গে থাকা মেয়েটির একটু বিবরণ দিই। গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। কালো মেয়েদের মুখে মায়া থাকে। এই মেয়ের মুখটায় একফোঁটা মায়া নেই। আপনার এটা মনে হতে পারে, কথা বলার সুযোগ দিচ্ছিলোনা বলে আমি একটা সুপ্ত রাগ থেকেই মেয়েটিকে অপছন্দ করছিলাম। এটা সত্য না। মেয়েটি আসলেই অসুন্দর।’
আমি খুক খুক করে কেশে গলা পরিষ্কার করলাম। স্পর্শ একটানা কয়েকবার সিগেরেটের ফিল্টার ঠোঁটে চেপে টিপে টুপে সমস্ত ধোঁয়া গলায় টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়লো, বললো, ‘আমি পেছন পেছন ঘুরছি। এরমধ্যে আমার একটা বন্ধু, নিচে একটা মেয়েকে পছন্দ করে ফেললো। এই বন্ধুটা ‘দিল চাহতা হ্যায়’র সাইফ আলি খান ভাবসম্পন্ন। ভালোবাসতে বড্ড ভালোবাসে। আশ্চর্য হলেও সত্যি, সে দেড় দুই মাসে একবার করে প্রেমে পড়ে ভিন্ন ভিন্ন মেয়ের৷ প্রত্যেকবারই কঠিন প্রেম; রিয়েল লাভ। তো, যে মেয়েটিকে পছন্দ করলো, সেই মেয়েটি তাকে মোটেও পছন্দ করলো না। বরং বললো, ‘কাছে ঘেঁষবেন না আমার, আমার জুতো অনেক শক্ত।
এই চমৎকার গভীর মন্তব্য কিংবা হুমকি গর্দভ বন্ধু না বুঝলেও আমি শুনে ফেললাম। এবং প্রতিটা বন্ধুর কানে কানে গিয়ে বলে আসলাম, ‘বন্ধু প্রেমে পড়েছে তবে মেয়েটি বলেছে, তার জুতো অনেক শক্ত। শুধু তোকে বললাম, আর কাউকে বলিস না যেন।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো বন্ধুমহল শক্ত জুতোর বিষয়টি জেনে গেলো এবং বন্ধুকে নাজেহাল করে ছাড়লো। বন্ধুর নাম হয়ে গেলো, শক্ত জুতো। কি ভয়ংকর! বন্ধু চোখ সরু করে আমায় খুঁজছিলো। আমায় শাস্তি দেবে। উপযুক্ত শাস্তি।’ স্পর্শ থামলো। সিগেরেট শেষ। ফিল্টার ছুঁড়ে ফেলে জিজ্ঞেস করলো, ‘প্রেডিক্ট করতে পারছেন গোপন কথা কানাকানির কি শাস্তি হতে পারে?’ আমি চুপ করে রইলাম। স্পর্শ মৃদু হেসে বললো, ‘ঠিক ধরেছেন। প্রেমে পড়ার আগে সিগারেটখোর বন্ধুকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়া যায়- সিগারেটের প্যাকেট লুকিয়ে ফেলে। আপাতত আমি আটকে যাবো। সিগারেট না পেলে বাইরে যেতে হবে, পাস নেই আমাদের।
গেইটে আটকাবো। আমার গর্দভ বন্ধু সিগারেটের অপেক্ষা করলো। তখনো বন্ধুর জানা হয়নি, আমি পৃথিবীর সর্বোত্তম নেশায় আসক্ত হয়ে গিয়েছি। তুলি। আমার একটুকরো পৃথিবী। প্রথম দেখায় মানুষ ধপাস করে প্রেমে পড়ে, আমি কখনোই বিশ্বাস করিনি এই আজগুবি তথ্য। আমি ধপাস করেই পড়লাম। একটু বেশিই ধপাস করে। তুলির সাথে আমার কথা হলো। কমিউনিটি সেন্টারের রুম সাইডে, অলি গলিতে। টুক টাক। নাম জানা হলো। পড়াশুনো জানা হলো। আমি এক দুনির্বার তৃষ্ণায় ঢোক গিলি, আরো কত কি জানার বাকি। কুচকুচে কালো মেয়েটি বড্ড জ্বালাতন করে। কথা বলার সময় হুট করে এসে তুলিকে নিয়ে যায়। আর একটা মোটাসোটা বড় ভাই পাশ দিয়ে হেঁটে যায় বারবার। তখন তুলি মুখে তালা মেরে বসে থাকে। কয়েকবার অমন করার পর আমি কথা বলার একটা বুদ্ধি বের করলাম।’
স্পর্শের ফোন বাজছে। গল্প বলার মাঝখানে ফোন বাজলে একটা সমস্যা। সুতো কেটে যায়। গল্পের স্রোত হোঁচট খায়। এই সুতো জোড়া দেয়া সহজ নয়। ভালো বক্তারা পারে। স্পর্শও পেরেছে। ফোন দিয়েছে কোনো একটা গার্লফ্রেন্ড। সম্ভবত জিজ্ঞেস করছিলো কোথায় আছে সে এখন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কড়কড়ে মিথ্যে বললো সে, ‘আমি রিফাতের বাসায়, পড়ছি। গ্রুপ স্টাডি। আর শুনো, ভীষণ মিস করছি তোমায়!’ ফোন রেখে সুতো জোড়া দিলো, ‘আমার একটা বন্ধুর সাথে পরামর্শ করলাম। ওর কাজ হলো, কালো মেয়েটিকে ব্যস্ত রাখা। বন্ধু পিছু নিলো ওদের। তুলি হাঁটছিলো আনমনে, সঙ্গের মেয়েটির দারোগা দৃষ্টি। বন্ধুকে খপ করে ধরে ফেললো। ফলো করছেন কেন? বন্ধু ট্রাই করলো, আপনাকে ভালো লেগেছে আমার খুব। কোথায় থাকেন। হেন তেন। বন্ধু ব্যস্ত রাখলো মেয়েটিকে। আমি একটা সুযোগ পেলাম।
রুমের একদিকে ছোট্ট গলির এক কোনায় টেনে নিয়ে গেলাম তুলিকে। বললাম, অল্প কিছুক্ষণ সময় আছে। কথা বলেন। তুলি বললো। আমি হা করে তাকিয়ে শুনলাম। একটা মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলবে কেন? তুলি সম্পর্কে জানলাম আমি। ওর বাড়ি কক্সবাজার। কনে তুলির দূর সম্পর্কের কাজিন হয়। সঙ্গে ভাইয়াও এসেছে বিয়েতে। এতক্ষণে মোটাসোটা বড় ভাইটার আশেপাশে ঘুরঘুরের কারণ জানলাম। তুলির ভাই হয়। বাপরে! বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছি। আমার সম্পর্কে জানতে চায় তুলি। আমি বলি। আমার পরিবার। আমার এলোমেলো কিছু শখ। আমার তুলির নাম্বার দরকার ছিলো। জিজ্ঞেস করি, তুলি কিছু বলার আগেই পেছনে ‘শক্ত জুতো’ বন্ধু এসে পিঠ চাপড়ে দেয়। তারপর দাঁত বের করে উচ্চস্বরে বলে, দোস্ত কই রে তুই, এতক্ষণ ধরে খুঁজছি। তোর জেসমিন ফোন দিয়ে দিয়ে বিরক্ত করে ফেলছে। একটু সময় দে এবার ওরে।’
স্পর্শ খুক খুক করে কেশে উঠে নতুন সিগারেট ধরায়। যেন আনাড়ি কোনো ঠোঁট। আমি ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে। স্পর্শ বলে, ‘তুলি চট করে ড্যাবড্যাবে চোখে তাকায় আমার দিকে। আকস্মিক শক পেলে মানুষ ভাষা হারায়। আমিও হারালাম। তুলির বিশ্বাস হয়না। একটু আগেই আমি তাকে জানিয়েছি আমার তেমন কেউ-ই নেই। তুলি বিমর্ষ চোখে তাকিয়ে সরে যায় সামনে থেকে। শক্ত জুতো বন্ধু ততক্ষণে কমিউনিটি সেন্টার থেকে উধাও। ওর টিকিটাও খুঁজে পাইনা আমি। বিপদের উপর বিপদ। কালো মেয়েটি এসে শেষ মুহূর্তে দেখে ফেলেছে আমাকে আর তুলিকে। তুলিকে বকা দিয়েছে খুব। এবং সম্ভবত তুলির ভাইকেও কিছু একটা বলেছে। কারণ এর কিছুক্ষন পর আমি দোতলা থেকে জানালায় দেখতে পাই, একটা বাইকে টেনে হিঁচড়ে কাউকে বসানো হচ্ছে।
তুলি। ওর মুখে রক্ত এসে গিয়েছে, লালচে রঙা মুখ। তীব্র লজ্জায় কুঁকড়ে আছে। এতগুলি মানুষের সামনে থেকে টেনে হিঁচড়ে ও কে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এখান থেকে, কাছেই কাজিনদের বাসা। বাসায় রেখে আসা হবে। তুলির শাড়ির আঁচল নিচে ঝুলছে। প্রথমে ভাইটা বসলো, স্টার্ট করলো বাইক। কালো মেয়েটি মাঝখানে বসলো। পেছনে বসলো তুলি। ভাইটার চোখমুখ রাগে লাল। বসামাত্রই এত স্পিডে টেনে নিলো বাইক, আমি আঁতকে উঠলাম.. তুলি পড়ে যেতে যেতে সামলালো নিজেকে। হুট করেই মনে হলো, নবমীর ওই রাতে হৈ হুল্লোড়ে ভরপুর ওই চট্টগ্রাম কমিউনিটি সেন্টারের দোতলায় আমি ভয়ংকর একা একটি মানুষ। শুধুমাত্র আমার কেউ নেই কোথাও। কেউ না।’
স্পর্শের চোখে মুখে গল্প ফুটে উঠছে। এই প্রথম বেজায় বিষন্ন লাগছে ও কে। ছেলেটির প্রতি কি আমি কোনোরকম মায়া অনুভব করছি? অসম্ভব। স্পর্শ বললো, ‘ভেবেছিলাম, আর দেখবোনা তুলিকে ওই রাতে আর। একঘন্টা পর-ই এসে হাজির সে। ঘাড়ে লালচে দাগ। চোখে বিষাদ। বাসায় খুব রাগ ঝাড়া হয়েছে ওর উপর। মারধোর করেছে কিনা কে জানে। তুলিও কম জিদ্দি না। ও আসবেই আসবে। ঠিক-ই এসেছে ভাইয়ের চোখ রাঙানি পায়ে পিষে। তুলি আর আমার দিকে তাকায় না। আমার বুক ফেটে যাচ্ছে তখন। কি অদ্ভুত এইসব অনুভূতি দেখুন। একটা মানুষ ভুল বুঝে থাকছে, আমি মুখ ফুটে না বলতে পারছি- না পারছি বুঝাতে।
এমন কষ্টও হয় বুঝি! শক্ত জুতো বন্ধুর আগমন হয়েছে। আমার পেছন পেছন ঘুরছে। ওর হাব্লা মুখটায় অপরাধবোধ টাঙানো। আমার হাব্লা বন্ধু বুঝতে পারেনি, ঘটনাটা এতদূর। ও ভেবেছে, জাস্ট কোনো মেয়ের সাথে ফ্লার্ট করছি আমি। তবে এখন অপরাধবোধ কমাতে যেকোনো কিছু করতে রাজি। আমি তুলির পেছন পেছন ঘুরি। আমায় দেখে মুখ ঘুরিয়ে রাখে সে। কালো মেয়েটাও ভীষণ সঙ্গে লেগে থাকছে এখন আগের থেকেও বেশি। বন্ধু মেয়েটিকে ডাকছে, কালী। হিন্দুরা ভক্তি নিয়ে ডাকে কালী, বন্ধু পুরো উল্টো। সে ডাকছে তীব্র ঘৃণা থেকে। তীব্র ঘৃণায় মানুষ বর্ণবাদী হয়ে ওঠে। আমার কেন যেন মনে হলো, তুলির ঘাড়ের লালচে দাগটা যেন কালী-ই সেঁটে দিয়েছে। কি কানপড়া দিয়েছে ভাইয়ের কানে মেয়েটি কে জানে। এত রাগে মানুষ?
তুলির সাথে কথা বলা দরকার। আমি সিঁড়ি পার হই, উপরে গলির কোনা পেরুতেই তুলির হাত চেপে ধরি। কালী তখন ব্যস্ত আমার বন্ধুর সাথে। বন্ধু সেভেন আপ খাবে। কালীকে বলেছে, বোতল আনতে, তারপর গ্লাস। এরপর লবণ। লেবুর কথাও বলবে একটু পর। কালী মুখ ভার করে তীব্র অনিচ্ছায় বাধ্য হয়ে করছে। বরপক্ষ। ইজ্জতের ব্যাপার। তুলির নরম হাতের কব্জি চেপে ধরি আমি। ব্রেসলেট খুলে হাতে চলে আসে। তুলি মুখ ফিরিয়ে বলে, আপনার সাথে আমি আর কথা বলবোনা। আমি তুলিকে চেপে ধরি দেয়ালে, চোখের দিকে চোখ রাখি। তুলি প্রথমে তাকায় না। একটু পর এদিক ওদিক চেয়ে তাকায়। আমি বলি, আমি একফোঁটা মিথ্যে বলছিনা তুলি। বন্ধুটা নিচে আছে, চাইলে ও সত্যিটা বলবে। কিন্তু আমি চাচ্ছি আপনি আমায় বিশ্বাস করুন।
তুলি তাকিয়ে রইলো। তারপর ঠাণ্ডা স্বরে বললো, ছাড়ুন। আমি ছেড়ে দিলাম। চোখ ফেটে জল বের হয়ে আসতে চাইলো। এমন করে বুক কাঁপেনি কোনোদিন। তুলি হেঁটে চলে যায়। একবারও তাকায়না পেছন ফিরে। আমার হাতে একটা ব্রেসলেট। নীল রঙা। তুলির ছোঁয়া লেগে আছে এতে। আমি ওতে চুমু খাই। কালী এসে দেখে আমার হাতে ব্রেসলেট। কয়েকবার সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচে নেমে যায়। আমি ভেবেছি তুলি আমায় আর বিশ্বাস করছে না। মেয়েদের মন বুঝতে পুরুষ বরাবরই অপটু। আমিও কম নই। রাত যখন আরেকটু বাড়লো, তুলি আসে আমার কাছে। দোতলায়। গলির কোনায়। কঠিন স্বরে বলে, ‘ব্রেসলেট দিন আমি হাত বাড়িয়ে দিই। বলি, ‘আমি তোমার পিছু নেবোনা। ভয় পেওনা। যাও।’
তুলি ব্রেসলেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি অতটাও গাধা নই। এই দাঁড়িয়ে থাকার অর্থ আমি জানি। ঠিক কতটা মায়া নিয়ে একটা মানুষ ছেড়ে না যাওয়ার তীব্র ইচ্ছে বুকে নিয়ে চলে যাওয়ার রাস্তায় পিঠ দেখিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে আমার জানা নেই। তীব্র আনন্দের অনুভূতি আমার জানা হলো ওই রাতে। একসাথে একগাদা অনুভূতির সাক্ষাৎ আমি পাইনি। কাঁপা স্বরে বলি, ‘আমি কি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি? আমার কেমন যেন লাগছে।’ তুলি হাসলো, তারপর মাথা দুলিয়ে বললো, ‘নাহ। ভাইয়া খুব রেগেছে। কাজিন দেখলে খবর আছে। এমনিতেও ভাইয়াকে কি কি যেন বলেছে।’
আমি আকুল স্বরে বলি, ‘ফোন নাম্বারটা ‘বৌভাত অনুষ্ঠানে আসতেছি কাল। ওখানেই বাকি সব কথা হবে। আমায় যেতে হবে এখন। ভাইয়া দেখবে। যাই?’ আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। তুলি পা টিপে টিপে যায় সামনে। তিনবার পেছন ফিরে তাকায়। তুলির সাথে সেইরাতে আর কথা হয়নি আমার। ভাইটা ঘুরঘুর করছিলো। আর কালী! স্টেজে নাচছিলো কিছু মেয়ে, তুলি ঠিক ওপাশে সামনেই আমার। স্টেজে টেনে উঠিয়েছিলো ও কে ওর কাজিনগুলি। স্টেজে যতক্ষণ ছিলো, সব ভুলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। কালী আড়চোখে দু’জনকে দেখে। ওর কুঁচকানো ভ্রুঁ’টাই বলে দেয়- তুলির এইভাবে চেয়ে থাকাটা ওর কাছে দৃষ্টিকটু লাগছে। আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। তুলির ঘাড়ে লালচে দাগ। আমার চোখ ভরে আসে জলে। তুলি ঘাড়ে আঁচল ঝুলিয়ে লাল রঙা কষ্ট ঢেকে চোখের ইশারায় আমায় চুপ করতে বলে। আমি তাকিয়েই থাকি। পাথুরিয়ায় ফিরি আমি ঘোরলাগানো চোখ নিয়ে। কবে রাত পোহাবে। কবে দৌঁড় দেব। ভোরের দিকে ঘুমোই। সকাল সকাল আবার ধড়পড়িয়ে ঘুম থেকে উঠি।
বাড়ি থেকে একগাদা প্রস্তুতি নিয়ে বন্ধুর বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠানে হাজির হই। এটা আমার গ্রাম। এখানে সময়, জায়গা, সুযোগ সব আমার। তুলির সাথে ঝামেলাহীন কথা বলা যাবে অনেকক্ষণ। ফোন নাম্বার আদান প্রদান বাকি এখনো। রাতে অনেক কষ্টে জীবনের প্রথম প্রেমপত্র টাইপের কিছু একটা লিখেছি। ছোট্ট কয়েক লাইনের। নিচে আমার নাম্বার। তুলির হাতে দেব। কনেপক্ষ থেকে একগাদা লোক আসে। খাওয়া দাওয়া হয়। ওরা চলে যাওয়ার সময় হয়। আমি অপেক্ষা করি। আমি অপেক্ষা করি একটা অদ্ভুত প্রাসঙ্গিক দিনে। ওই দিনটা.. প্রতিমা বিসর্জনের দিন।’
স্পর্শ হুট করেই থেমে যায়। একদম চুপ। আমি তাকিয়ে থাকি। সে বলে, ‘গল্প শেষ।’
তুলি? তুলির সাথে দেখা হয়নি আর?’ পুরো গল্পে এটাই আমার প্রথম প্রশ্ন। আমি অবাক হই। স্পর্শ সিগারেটে ধুমসে টান দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে উদাস স্বরে বলে, ‘নাহ। ওই রাতে আমরা আসার পর বাসায় গিয়ে কালী আরো প্যাঁচ লাগিয়েছিলো। ভাইকে কি কি জানি বলেছে। বৌভাত অনুষ্ঠানে ভাই এসেছে। তুলিকে আনেনি। বন্ধুরা রাগে ফেটে পড়ে, কালীকে যা তা বলে। বলে তখন লাভ নেই। তুলিকে কক্সবাজার পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’ আমি আকুল হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘পরে আর কোনো ভাবে দেখা হয়নি? বন্ধুর ভাইয়ের বিয়ে, বন্ধুকে দিয়ে তো ঠিকানা নাম্বার বের করা যায় ‘চেষ্টা করেছি। বন্ধু অনেক কষ্টে খবর নিয়ে শুধু এই তথ্য জানাতে পেরেছিলো, কক্সবাজার থেকে ওর কোথাও যাওয়া সারাজীবনের জন্য বন্ধ। প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে পা ফেললে গলা কেটে নেবে। আর কোনো ছেলে পেলে বাড়ির আশেপাশে দেখলে প্রথমে ও কে মারবে, তারপর ছেলেকে।’
‘ফেসবুক? এখন তো সবাই সবাইকে পায় এখানে।’ ‘নেই।’ আমি মানতে পারছিনা। এমন কেন হয়! আরেকবার কনফার্ম করি, ‘গল্প সত্যি শেষ?’ ‘হু’ স্পর্শ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে ফিল্টার। আমি সিগারেট ধরাই একটা। অভ্যস্ত হাতে। অনেকক্ষণ চুপ দু’জন। হুট করে বলি, ‘এসব কেন করো?’ স্পর্শ জবাব দেয়না। আমি একটু থেমে বলি, ‘তারচেয়ে, বরং প্রেমে পড়ো অন্য কারোর। আবার।’ স্পর্শ ঢোক গিলে। গলায় কান পাতলেই মৃদু শব্দ শুনা যাবে। আমি দুই কদম দূরে বসেই শুনলাম। ভেজা স্বরে বললো, ‘হাজারবার প্রেমে পড়ে মানুষ। প্রেমে মরে একবার-ই। নিঃসঙ্গতা ভয়ংকর। একা থাকলেই একদলা জোঁক এসে ঘিরে ধরে আমায়। একরাত্তিরের স্মৃতি! চুষে খায়।’ আমি চুপ করে বসে থাকি। অনেকক্ষণ কাটে আবার। নিশ্চুপ। নির্জনতা ভেঙে বলি,
‘আমি কখনো কারোর কোনো প্রেমের গল্প লিখিনি। আই মিন, বাস্তব। এই প্রথম তোমার গল্পটা লিখবো।’
‘কেন?’
‘জানিনা।’
স্পর্শ মাথা নিচু করে বসে থাকে। আশেপাশে বিয়ে বাড়ির হৈ হুল্লোড়। একটা শুদ্ধ ছ্যাঁচড়া যুবক। তারপরেও আমি গভীর মায়া নিয়ে তাকালাম ওদিকে। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ লিখেছিলেন, “আন্দামান সাগরের এক একলা দ্বীপে এক সাধু যখন একটা পাখির কিচির মিচিরে অতিষ্ঠ হয়ে ভাবছিলো কিভাবে আরো একা হওয়া যায় তখন জাকার্তার জনাকীর্ণ সড়কে হাজার হাজার মানুষের ভিড় ঠেলে একটা লোক একা একা হেঁটে যাচ্ছিলো!” স্পর্শকে আধেক সিগারেট বাড়িয়ে দিই আমি। হাত টেনে সিগারেট ঠোঁটে গুজে আনমনে ধোঁয়া উড়ায় সে। মাথা নিচু করে নরম স্বরে বলি, ‘আমি ভেবেছি, তোমাদের কোনো গল্প নেই।’ স্পর্শ ফিক করে হাসে। আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করি, হাসিটা একটুও বিচ্ছিরি লাগছেনা এখন আমার।