আমি আমার ভাইয়ের বউকে সাধারণ আমার শ্বশুরবাড়িতে আসতে বলি না। কেন জানি পছন্দ না তার উপর আজ এই চেহারা নিয়ে হলুদ একটা শাড়ি পড়ে এসেছে। আমি দেখে ই অনেকটা বিরক্তি বোধ করলাম সাথে ভাইয়াও ছিল। কেমন করে যে ভাইয়া এই মেয়েকে বিয়ে করল ভেবে পাইনা।
আজ একটা পারিবারিক অনুষ্টান আমার শ্বশুরবাড়ি তে। সবাই এসেছে মেহমান নিকট আত্মীয় সহ সব। আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলে নিজের কাজে এদিক ওদিক ছুটছি। হঠাৎ এক আত্মীয় আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ঐ হলুদ রঙের শাড়ি পড়া কালো মেয়েটা কে? আমি কিছুটা ইতস্তত হয়ে জবাব দিলাম আমার ভাইয়ের স্ত্রী। উনি তখন ই জবাব দিলেন, তোমাদের পরিবারের সাথে মিল রেখে তো আনবে। তোমরা কই আর ও!
আমি কিছু না বলে চলে গেলাম। এজন্য আমারো পছন্দ না ভাইয়ার স্ত্রীকে। সবার খাওয়া দাওয়া কাজ শেষে ছবি তুলতে ব্যস্ত। আমিও নিজেকে আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে ছবি তুলার জন্য প্রস্তুত হলাম। সবার সাথে তোলা হল। সব ছবিগুলো যখন দেখছিলাম এক এক করে তখন আমার আর রাহাতের ছবি গুলো ই যেন সবচেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে ছিল। সবাই দেখে দেখে একদম প্রশংসায় পরিপূর্ণ। খুব ভালো ই লাগছিল এরকম যুগলবন্দি ছবি দেখে। ভাইয়া এসে ভাবীর সাথে উনার কয়েকটা ছবি তুলে দিতে বললেন। আমি তুলে দিলাম। ভাইয়া সব শেষে হাসি মুখে বিদায় নিলেন।
রাতে সব কাজ শেষ করে রাহাতে ল্যাপটপ অন দেখে আজকের তোলা সব ছবি গুলো দেখছিলাম। ও ফোন নিয়ে বাইরে গেছে কি একটু কাজে। ছবি গুলো দেখছিলাম আর আনমনে সুখের সাগরে ভাসছিলাম। আমাদের পছন্দের বিয়ে দুই পরিবারের সম্মতি নিয়ে ই বিয়ে করি। বিয়ের দিন সবাই বলছিল, একদম রাজযোটক যেন!
হঠাৎ কিছু একটার আওয়াজে খেয়াল হল দেখলাম একটা টেক্সট এসেছে। ডাটা কানেক্ট ছিল ওপেন করতে ই দেখি একটা মেয়ে ! ভাবলাম হয়ত পরিচিত কেউ দরকারে ই নক করেছে বেড়িয়ে আসব ঠিক তখনি কয়েকটা ছবি আসল, সাথে লেখা ছিল আজকের ছবিগুলো দেখেছ.! কত্ত কিউট। কিন্তু তোমার তো সময় ই নেই। আর কবে দেখা করবে?
আমি ছবি গুলো দেখে একদম অবাক হয়ে আছি। যেন বুকের ঠিক মাজখানটায় কেউ আঘাত করেছে আমাকে। কিছু বলার আগে ই চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরছিল। আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও পুরনো মেসেজ গুলো দেখলাম। অনেক গুলো ছবি সাথে প্রেমালাপে ভরপুর তাদের কনভারসেশন। আমার মাথা যেন ঘুরছিল। এতদিনের তার কাজের নামে ব্যস্ততা বাইরে থাকা আজ যেন সব স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম। আর নিজে ই নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম। আবার দেখালাম, আজ যে শাড়ি পরেছি সেই শাড়ির ছবি দেওয়া।
ছবি টা মেয়েটিকে পাঠিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে এটা তার জন্য। অথচ আমি পরসু রাতে রাহাতের লুকিয়ে আনা এই শাড়িটা কে আমার জন্য সারপ্রাইজ গিফ্ট হিসেবে মনে করে কি বোকামি টা ই না করেছি আজকে নিজ ইচ্ছায় বের করে পড়েছি শাড়িটা। শাড়িটা পড়ায় যেন নিজের উপর ই নিজের ঘৃণা হচ্ছে এখন। আর নিজের বিশ্বাস টুকু কাচের মত ভেঙ্গে যেতে দেখে নিজের অস্তিত্ব সংকটে পরে আছি আমি।
শাড়িটা পরায় রাহাতের চোখে যে বিস্ময় দেখেছিলাম সেটাকে ওর ভালো লাগা ভেবে ছিলাম অথচ সেটা ছিল তার নির্মম প্রশ্ন চিহ্ন ! কোথায় কমতি ছিল আমার বিশ্বাস ভরসা ভালোবাসা! কোথায়..? তবে কেন এমন হল। মনে হচ্ছিল এখন ই ঘর থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাই। এক মুহূর্তে যেন সবকিছু বিষিয়ে উঠেছিল।পরদিন সকালে আর তেমন কোনো কথা না বলে শরীরে অসুস্থতার বাহানা দিয়ে বাবার কাছে চলে আসলাম। আসার সময় শুধু বলে আসলাম মনে মনে, মুক্তি দিয়ে গেলাম সবকিছু থেকে যেখানে ভরসা বিশ্বাস নেই সেখানে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।
আজ পুরো একদিন পার করলাম বাড়িতে। ভাইয়ার বিয়ের প্রায় এক বছর পর এই ভাবে থাকতে আসা। অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে আজ সকাল থেকে যেন তাই দেখছি। ভাবী ছোঁয়ায় যেন পরিবারের নতুন প্রাণ পেয়েছে। সংসারটা গুছানো বাবা মায়ের এত এত যত্ন আর খেয়াল রাখা দিন শেষে ভাইয়ার প্রেয়সী রুপে ভাবী কে দেখে যেন নিজের নিষ্টুরতার জবাব পাচ্ছিলাম। ভাইয়া যখন রাত করে বাসায় ফিরত তখন কেন জানি নিজের মত এমন কিছু না হোক ভেবে ভাবীকে সাবধান করতাম।
কিন্তু ঠিক ই হাসিমুখে জবাব দিল, বিশ্বাস ভরসা আর সম্মান টা দু পক্ষের ব্যাপার। এক খুটি দিয়ে যেমন ঘর বানানো যায় না ঠিক তেমনি সংসারে একজনের বিশ্বাস ভরসা সম্মান, যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে সব হয় না। উভয়পক্ষের প্রয়োজন হয়। আমি কথাটা শুনে ই কেঁদে ফেললাম। সবকিছু খুলে বললাম ভাবীকে। আমিও তো বিশ্বাস করেছি তবে কেন সে এরকম করল ওকে দেখে তো এরকম একটুও মনে হয়নি। সবকিছু যদি চোখের দেখায় বুঝা যেত তাহলে মানুষ কখনো ভুল করত না।
এই বলে ভাবী আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি যেন অনেক দিন পর একটা আশ্রয় পেয়েছি। মানুষকে মানুষ রুপে ভালোবাসতে হয়। সিদ্ধান্ত নিলাম আর ফিরব না। রাহাত বেশ কয়েকবার খুঁজ নিয়েছে আমি না বলে দিয়েছি কারণ বিশ্বাসটা কাঁচের মত জোড়া লাগালেও ক্ষতটা কিন্তু থেকে ই যায়। বাবা মা অনেক বুঝাচ্ছেন কিন্তু কিছু তে ই যেন নিজের মনকে ফেরাতে ই পারছিনা। অবশেষে মা বললেন, নিজের আগত সন্তানের কথা ভাব। সে তো তোর একার নয়।
কথাটা শোনার পর যেন আমার হৃদপিন্ডটা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। যে সংসার আমার বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই সেখানে আমার সন্তান কোন ভরসায় কিসের হাত ধরে বেঁচে থাকবে। বুক ফেটে যেন কান্না আসছিল। নিজেকে যেন কেউ পিষে মেরে ফেলছে আমাকে। তখন ই চোখ মুছে ভাইয়া আর ভাবীকে ডেকে আনলাম। বললাম, তোমরা নিবে আমার এই সন্তানের দায়িত্বটা! আমি একজোড়া মানুষের কাছে আমার সন্তানকে রেখে যেতে চাই যেখানে সে একটা মানুষ রুপে গড়ে উঠবে এমন ভাবে যেন সে কখনো অন্য মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলা করতে না পারে। নিবে আমার সন্তানকে..? মানুষ করবে…
ভাইয়া আমার কথা শোনে পাগল বলল। জড়িয়ে ধরে এসব বলতে মানা করল। আমি যেন অনেক ভরসার একটা সাগরে পরে গেলাম। চোখ যেন বাঁধা মানছিল না অঝরে ঝরছিল। বিশ্বাসে ভাঙন ধরলে হয়ত মানুষকে এভাবে ই তিলে তিলে শেষ করে দেয়!
বাবা মা ভাবী সবাই আমাকে বুঝাল। এরকম কথা যেন না বলি। আমি চুপ হয়ে গেলাম শুধু বললাম, আমার সন্তানকে শুধু দেখে রাখলে ই চলবে। ভাইয়া রাগ করল। দিন যাচ্ছিল ঐ বাড়ির সাথে কোনো যোগযোগ নেই। যেখানে মনের সংযোগ না থাকে সেখানে কিসের সমাজ কিসের কি।
খুব ব্যথা অনুভব করলাম। ভাইয়া হাসপাতালে নিয়ে গেল। ভাবী, মা সাথে আমার। অনেক কিছুর পর আমার সন্তান আসল পৃথিবীতে। এই বিশ্বাস অবিশ্বাস মিশ্রিত মানব জগতে। আমি কিছুটা জোড় করে শক্ত হয়ে ভাইয়া ভাবীকে আমার সন্তানের দায়িত্ব দিলাম। আমার মেয়েটা হয়ত বুঝতে পেরেছিল তার মা আর থাকবে না প্রচন্ড বেগে কেঁদে চলছিল যত ই হোক নাড়ির টান বলে কথা আমার চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছিল। সেই আবছা দৃষ্টি তে কারো ছুটে আসা দেখতে পারছিলাম। কানে আসছিল ভাবী বলছিল রাহাত আসছে কি হবে এখন এসে ! যেখানে বিশ্বাস মরে যায় সেখানে শরীর টুকু আর কতদিন থাকে। মন তো মরে গিয়েছিল আজ শরীর থেকেও বিদায় নিলাম…..