অসময়ে গর্ভধারণ

অসময়ে গর্ভধারণ

আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল সতের বছর বয়সে। তার দু বছর পর আমি জন্মাই। এখন আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে। বছর দুয়েক আগে আমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর প্রথমদিকে শ্বাশুড়ির সাথে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। উনি কেমন মানুষ আমি বুঝতে পারতাম না। খুব ছোট ছোট ভুলের জন্য অনেক চেঁচামেচি করতেন। আবার বড় বড় ভুল গুলো ক্ষমা করে দিতেন। কাজের মধ্যে কোন খুঁত পেলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতেন। আবার নিখুঁতভাবে কাজ করলে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতেন। বুঝতাম না আমি ওনাকে। আসলে কেমন মানুষ উনি?

যেহেতু বাবার বাড়িতে খুব বেশি কাজ করিনি তাই ওসবে অভ্যস্ত ছিলাম না। ধীরে ধীরে যখন কাজ শিখে গেলাম, বিশেষ করে রান্নাটা আয়ত্ত করে নিলাম শ্বাশুড়ির মন জয় করে ফেললাম। উনি খুব ভোজন প্রিয় মানুষ। ওনাকে যত সুস্বাদু রান্না করে খাওয়াব উনি ততই আয়ত্তে থাকবেন। ব্যাপারটা আমি বুঝে গেলাম। তাই চেষ্টা করতাম ওনাকে মজার সব খাবার রান্না করে খাওয়াতে। এভাবে আমার প্রতি ওনার বিরক্তি ভাবটা কমে গেল। কিন্তু ঝামেলাটা শুরু হল কিছুদিন আগে যখন উনি জানতে পারলেন আমার মা এই বয়সে আবার মা হতে চলেছেন।

– কে কোথায় আছো গো। আমার সর্বনাশ হয়ে গেল গো। এই মুখ আমি কাকে দেখাব গো। এই বুড়ো বয়সে আমার বেয়ান পোয়াতি হইছে কেমনে সহ্য করি বলো। সমাজে তো আমাদের একটা সম্মান আছে নাকি। এই কথা দশজন জানলে আমাদের মান সম্মান সব শেষ হয়ে যাবে গো।

যদিও ব্যাপারটি ঘরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, দশজন জানতে পারত না, কিন্তু আমার শ্বাশুড়ির চেঁচামেচিতে প্রতিবেশিসহ শশুরবাড়ির আত্মীয়রা সবাই জেনে গেলেন যে আমার মা পোয়াতি। শ্বাশুড়ির বিলাপে পাড়ার লোকজন জড়ো হল। মূল কাহিনী শোনার পর সবাই আমাকে অনেক ব্যঙ্গ করতে লাগল। এমনকি মহিলারা আমার মাকে উদ্দেশ্য করেও অনেক কটূ কথা বলল। আমাকে সব চুপচাপ হজম করতে হল। কারণ আমি যে বউ। যদিও এ ব্যাপারে আমার কোন দোষ ছিল না কিন্তু আমাদের সমাজে বউ হলে দোষ না করেও দোষ মাথায় নিতে হবে। তবেই সে ভাল বউ হতে পারবে। কিন্তু কতক্ষণ? এত কথা কিভাবে হজম করা যায়? আমিও তো একজন মানুষ। আমার সহ্য শক্তি অসীম না। একটা সময় আমারও কষ্ট হয় আমিও ভেঙে পড়ি। সবার কটূ কথা সহ্য করতে না পেরে গেলাম বাপের বাড়ি। বাবার সামনে কিছু বললাম না। মাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে তাই বললাম।

– লজ্জা করে না তোমাদের? এই বয়সেও? যেখানে তোমার মেয়ে কিছুদিন পর পোয়াতি হবে সেখানে তুমি হয়ে বসে আছো? তুমি জানো লোকে কতকিছু বলছে? তোমাকে তো এসব শুনতে হচ্ছে না। শুনতে হচ্ছে আমাকে। মুখ দেখাতে পারছি না ও বাড়ির কারও সামনে। সবাই যা নয় তাই বলে অপমান করছে।

হ্যাঁ মায়েরও লজ্জা লাগছিল। মাকে যে কোন কথা শুনতে হচ্ছিল না তা নয়। যেমন আমাকে ও বাড়িতে সবাই কথা শোনাচ্ছে তেমনি এখানেও মাকে অনেক কথা শুনতে হচ্ছে। দেখলাম মায়ের চোখ গড়িয়ে দু ফোটা জল পড়ল। কিন্তু সেটা দেখার সময় আমার নেই। আমি মাকে বকেই যাচ্ছি। বকা দিয়ে মন শান্ত হয়ে গেলে নিজের বাড়ি মানে শশুড়বাড়ি গেলাম। কিন্তু মনটা খচখচ করছিল। মাকে এতটা না বললেও পারতাম। আবার ভাবলাম ধ্যাত। বলেছি বেশ করেছি। খেয়াল থাকে না? আমার বিয়ে হয়ে গেছে এখন তো তাদের এসব ভেবে চিন্তে চলা উচিত। আমার চিন্তিত মুখ দেখে আমার স্বামী জিজ্ঞেস করল,

– কি হয়েছে? ও বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই গোমড়া হয়ে বসে আছো। মায়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে?
– ঝগড়া আমিই করেছি
– কেন করেছ?
– কেন করব না বল। ওনাদের জন্য আমাকে কত কথা শুনতে হচ্ছে
– তুমি ওসবে কান দিচ্ছ কেন? জানোই তো আমাে মা কেমন। ওনার কথা এ কান দিয়ে শুনে ও কান দিয়ে বের করে দিবে

– ওনার একার কথা এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু আর পাঁচজন? সবাইকে এড়াব কিভাবে? তাছাড়া ওনারা তো ঠিকই বলছেন। এই বয়সে এসব মানায়?

– কেন মানাবে না বলো তো
– আরে!! ওনারা বুড়ো হয়ে গেছেন। এখন বাচ্চা কাচ্চা নেওয়ার বয়স আছে ওনাদের?
– আচ্ছা বলো তো, ওনাদের বিয়ে হয়েছো কতদিন?
– পঁচিশ বছরেে মত
– আমাদের কতদিন হল?
– দু বছরের মত
– তাহলে তুমি এবার ভেবে বলো। পঁচিশ বছর যারা একসাথে আছে তাদের মধ্যে ভালবাসা বেশি নাকি আমাদের মধ্যে বেশি?

– এটা কেমন প্রশ্ন? দু পক্ষের ভালবাসাই অনেক। তবে হ্যাঁ এটা ঠিক যে ওনারা এত বছর একসাথে আছেন। আমাদের চেয়ে ভালবাসা একটু বেশিই হবে
– একটু না। অনেক বেশি। আমরা মাত্র দুবছর একসাথে থেকে যদি একে অপরকে এত ভালবাসতে পারি, স্বামী স্ত্রীর সব ভালবাসা পরিপূর্ণ ভাবে আদান প্রদান করতে পারি, তাহলে ওনারা কেন পারবেন না?
– সে না হয় পারে। তাই বলে এখন বাচ্চা নিতে হবে?
– আম্মার যে বয়স এই বয়সে সন্তান ধারণ ক্ষমতা সব মহিলার থাকে না।

এটা তো সৌভাগ্য যে উনি সেটা করতে পেরেছেন। তাছাড়া সমাজকে সবাই ভয় পায়। কেউ জেনে বুঝে এমন কাজ করতে চায় না যার জন্য সমাজের সবাই তাদের দিকে আঙ্গুল তুলবে। কিন্তু যেটা হয়েই গেছে এটা নিয়ে এত রাগ করার কি আছে? ওনাদের সম্পর্কটা পুরোপুরি হালাল। তাই ওনাদের সন্তান ধারণে গোনাহ বা লজ্জার কোন কারণ নেই। এটা আল্লাহর নেয়ামত। আল্লাহ খুশি হয়ে ওনাদের দিযেছেন। মনে রাখবে ওনার ইচ্ছা ছাড়া পৃথিবীতে কোন কাজ হয় না

– কিন্তু সবার মুখ তো ধরে রাখা যায় না
– সবার কাজই হচ্ছে নিজের কাজ বাদ দিয়ে অন্যের কাজে নাক গলানো। এসব চিন্তা বাদ দিয়ে মাকে সাহস দাও।
ওর কথাগুলো তো বুঝলাম কিন্তু তবুও মনের মধ্যো কেমন লাগছে। তবে মাকে আর এসব নিয়ে কিছু বললাম না।

আজ মায়ের ডেলিভারি। বাবা, আমি, নেহাল মানে আমার স্বামী, আমরা সবাই হাসপাতালে এসেছি। সবাই অপেক্ষা করছি। একটা ভয় কাজ করছে। মায়ের বা বাচ্চার যদি কিছু হয়? নিজের চেয়ে বাবার জন্য চিন্তা হচ্ছে বেশি। মায়ের কিছু হলে ওনাকে সামলানো যাবে না। বড্ড ভালবাসেন মাকে।

নার্স একটা ফুটফুটে মেয়ে এনে আমার কোলে দিল। আমি অবাক হয়ে দেখছি। বলল মা ভাল আছে। এত ছোট বাবু? আমি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম। অন্য কারো সন্তানকে এভাবে জন্মের পরপরই দেখার সৌভাগ্য হয় নি। তাই বুঝতাম না বাচ্চারা কত ছোট হয়ে জন্মায়। এত ছোট বাচ্চা কিভাবে কোলে নিব বুঝতে পারছি না। একটা চেয়ারে বসে ওকে ভালভাবে জড়িয়ে ধরলাম। নার্স বলল ওর গায়ে যেন বাতাস লাগতে না দিই। মাত্রই উষ্ণ জায়গা থেকে বেরিয়েছে।

ও এখন বাতাস বা ঠান্ডা সহ্য করতে পারবে না। সেভাবেই ওকে তোয়ালে দিয়ে ভালভাবে জড়িয়ে রাখলাম। ওকে দেখেই মনটা আনন্দে ভরে গেছে। আমার ছোট বোন এটা? ভাবতেই কত মজা লাগছে। মায়ের জন্য খারাপ লাগছে। সেদিন যদি জানতাম মা আমাকে এত সুন্দর একটা উপহার দিবে মাকে কখনই বকতাম না। সরি মা। তোমার সন্তান তুমি যখন ইচ্ছা গর্ভে ধারণ করতে পারো। এটা নিয়ে বলার অধিকার কারো নেই। এমনকি আমারও নেই।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত