নতুন অধ্যায়ের সূচনা

নতুন অধ্যায়ের সূচনা

-কি ব্যাপার?রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন কেন?আপনার সাইকেল কোথায়?

ভার্সিটিতে যেতে হবে। তাই আমাদের বিল্ডিং এর পাশের রাস্তায় দাড়িয়ে আছি একটা রিক্সার জন্য।।লেইট হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু কোন রিক্সা পাচ্ছি না।এই রাস্তায় অবশ্য রিক্সা খুব একটা পাওয়াও যায় না।তাই আমি প্রতিদিন সাইকেল নিয়েই ভার্সিটিতে যাওয়া-আসা করি।কিন্তু আজ সকালে আমাদের বিল্ডিং এর গ্যারেজে সাইকেল আনতে গিয়ে দেখি সাইকেলের সামনের চাকা পানচার হয়ে গেছে।

কিন্তু কালকেও সাইকেলের চাকা ঠিক দেখেছিলাম।যাক কি আর করার!ভার্সিটির টাইমও হয়ে গেছে।তাড়াতাড়ি ভার্সিটিতে যেতে হবে।এখন সাইকেল সাড়ারও সময় নেই।তাই রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।কিন্তু এই রিকশাই পাচ্ছি না আমি।এমন সময় পেছন থেকে কে যেন উপরের কথাটা বলে উঠলো! পেছনে তাকিয়ে দেখি মিলি।মিলিকে দেখেই আমার হার্টবিট বেড়ে গেলো।হার্টবিট বেড়ে যাওয়ার দুইটা কারণ আছে।প্রথমত:মিলিকে আমি অসম্ভব পছন্দ করি।দ্বিতীয়ত:আমি ওকে সপ্তাহখানেক আগে প্রপোজ করেছি।আর ও সেটা বেশ ভদ্রভাবেই প্রত্যাখান করে দিয়েছে।এই কয়দিন লজ্জায় ওর সামনাসামনি হইনি।কিন্তু আজকে সামনাসামনি পরেই গেলাম।মিলি আবার বললো,

-কি ভাবছেন এতো?কথা বলছেন না কেন? আমি একটু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলাম।তারপর বললাম,
-হ্যাঁ।আসলে সাইকেলে একটু সমস্যা হয়েছে তো।কিন্তু রিক্সা তো পাচ্ছি না। মিলি বললো,

-আচ্ছা সমস্যা নাই।আমিও ক্যাম্পাসে যাচ্ছি।আমার জন্য একটা রিক্সা সারামাসের মনে ভাড়া করা আছে।আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন। ওর সাথে যদিও যেতে চাইছিলাম না।কারণ ও যদি আবার সেইদিনকার কথা তোলে তাহলে আমার লজ্জার সীমা থাকবেনা।কিন্তু ওর সাথে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায়ও ছিলো না।কারণ আজকে ক্লাসটেস্ট আছে।তাই মিস করা যাবেনা।একটু পরেই ওর রিক্সা চলে এলো।আমিও রিক্সায় উঠে জুবুথুবু ভাবে বসে রইলাম।

মিলির সাথে আমার প্রথম পরিচয়টা বেশ মজার ছিলো।ও আমাদের ভার্সিটিতেই পড়ে।আমার থেকে বছর দুয়েকের জুনিয়র।তো একদিন ভার্সিটির একটা প্রোগ্রাম ছিলো।প্রোগ্রাম শেষ করে আমি সাইকেল নিয়ে বাসায় আসছিলাম।এই এলাকায় তখন নতুন এসেছিলাম।তাই কাউকেই ঠিক মতো চিনতাম না।একটু রাতও হয়ে গিয়েছিলো।তাই একটু ভয় ভয়ও করছিলো।ভার্সিটি থেকে একটু দূরে আসতেই দেখলাম রিকশায় করে একটা মেয়ে আমার সামনে দিয়ে যাচ্ছে।তো আমিও আর কিছু না ভেবে রিকশাটার পিছে পিছে যাচ্ছিলাম।মানে মেয়েটার পিছে পিছে যাচ্ছিলাম না।রিকশাটা যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে আমাদের বাসাটাও সেইদিকে।তাই রিকশাটার পাশে পাশে যাচ্ছিলাম।আমি রিকশার পাশে পাশে যাওয়ার সময় মেয়েটার দিকে মাঝে মাঝেই তাকাচ্ছিলাম।মেয়েটাও বেশ সুন্দরী।সেও দেখলাম একটু পরেপরেই আমার দিকে তাকাচ্ছে।একদম আমাদের বিল্ডিং এর সামনেই রিক্সাটা থামলো।তার মানে কি?মেয়েটাও কি এই বিল্ডিং এ থাকে?আমি আর অতোসতো না ভেবে আমাদের বাসার গেটের দিকে যেতে লাগলাম।এমন সময় দেখি মেয়েটা আমায় ডাকছে।আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বললো,

-এই ছেলে সমস্যা কি?সেই ভার্সিটি এলাকা থেকে দেখছি আমার পিছু পিছু আসছেন। আমি একটু অবাক হলাম।বললাম,

-আরে আমি আপনার পেছনে আসবো কেন?আমি তো রিকশার পিছু পিছু আসছিলাম।তাও আমি তো পিছু পিছু আসি নাই।পাশে পাশে আসছিলাম।

-রিকশার ভেতরে আমি বসাছিলাম।তাই টেকনিক্যালি আপনি আমার পেছন পেছন বা পাশে পাশে আসছিলেন।বলুন উদ্দেশ্য কি?

-কোন উদ্দেশ্য নাই। আমার উত্তর শুনে মেয়েটা মনে হয় রেগে গেলো।বলল,

-আপনার মতো ছেলেদের আমি খুব ভালো করে চিনি মেয়েদের পেছন পেছন ঘোরা ছাড়া তো আপনাদের কোন কাজ নাই। আমি মেয়েটার কথা শুনে যারপরনাই অবাক হলাম।একটু ভয়ও পেলাম।এলাকায় নতুন এসেছি।যদি কোন সমস্যা হয়।তাই আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,

-আপু আমি এই বিল্ডিং এ নতুন ভাড়ায় এসেছি।বিশ্বাস করেন আমি আপনার পিছু নিচ্ছিলাম না।
-তাহলে আপনি ভার্সিটি এলাকায় কি করছিলেন?
-আমি ওখানে পড়াশোনা করি।ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট,৩য় বর্ষ।বিশ্বাস না হলে খোঁজ করে দেখতে পারেন। মেয়েটার মুখে এবার একটু লজ্জার ছাপ দেখতে পেলাম।
-আরে এমন জড়োসড়ো হয়ে রিকশায় বসে আছেন কেন?স্বাভাবিক ভাবে বসুন। আমি বললাম,
-কই স্বাভাবিক ভাবেই তো বসেছি। মিলি বললো,

-হ্যাঁ।তা তো দেখাই যাচ্ছে।বসেন।স্ব াভাবিকভাবে বসেন। আমি একটু স্বাভাবিক ভাবে বসার চেষ্টা করলাম। পরেরদিন অবশ্য ছোটবোনের কাছে থেকে জানতে পেরেছিলাম যে মেয়েটা বাড়িওয়ালার মেয়ে।আর ওর নাম মিলি।ওর সাথে হয়তো কোনদিন আর কথাই হতো না যদিনা ও নিজে থেকে আমার সাথে কথা বলতে আসতো।একদিন বিকেলে ছাদে উঠেছিলাম।দেখি মিলিও আছে।আমি ওকে দেখে ছাদ থেকে নেমে আসবো।এমন সময় ও আমাকে ডাক দিলো,

-এই দাড়ান। আমি ওর ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম।ও আমার সামনে এসে দাঁড়ালো।তারপর বলল,

-আই এম স্যরি।আসলে আমি আপনাকে এর আগে কোনদিন এই এলাকায় দেখি নাইতো।তাই ভাবছিলাম আপনি মনে হয় আমার পিছু নিয়েছেন।তাই রেগে গিয়ে কয়েকটা কথা বলেছিলাম।আমি জানি আপনি আমার ওপর রাগ করেছেন।রাগ করাটা স্বাভাবিক।কিন্তু আমাকে কি ক্ষমা করে দেওয়া যায় না?

মেয়েটা একবারে এতোগুলা কথা বলে তারপর থামলো।ওর ওপর একটু রাগ ছিলো।কিন্তু এইভাবে ক্ষমা চাওয়ার পরে আমার ওর ওপর আর কোন রাগ রইলো না।এরপর থেকে আমাদের আসলেই ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।ঘুরতাম-ফিরতাম,ক্যাম্পাসে একসাথে যেতাম,আড্ডা দিতাম।মানে এককথায় বেশ ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম।কিন্তু হুমায়ূন স্যারের একটা বাণী আছে না,”একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না।”আমার ক্ষেত্রে ঠিক একই জিনিস ঘটলো।আমি মিলির প্রেমে পরে গেলাম।আর ওকে এটা জানালামও।কিন্তু ও শুধু আমাকে বন্ধুই ভেবেছে এর বেশি কিছু নয়।এটা আমাকে ও বেশ ভদ্র ভাবেই বুঝিয়ে দিলো।কেন যে ওকে প্রপোজ করতে গেলাম।আগে তো ওর সাথে কথা বলতে পারতাম,ঘুরতে পারতাম।কিন্তু এখন যে ওর সামনে দাঁড়ানোর মুখই আমার নাই।তাই এই সাতদিন আমি ওর থেকে পালিয়েছিলাম।ভার্সিটিতে গেলেও ওর থেকে পালিয়ে থাকতাম।আর বাসাতেও আসতাম অনেক রাত করে।কিন্তু আজ এই সাইকেল নষ্ট হয়ে ওর কাছে ধরা খেয়ে গেলাম।

-কি ব্যাপার রিকশাতেই বসে থাকবেন।ভার্সিটিতে যেতে হবে না।এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ভার্সিটিতে চলে এসেছিলাম তা টেরই পাই নাই।আমি নেমে রিকশা ভাড়া দিয়ে ওর সাথে সাথে হাঁটতে লাগলাম।আমাদের ভার্সিটিটা একটু ভেতরের দিকে।মুল রাস্তা থেকে মিনিট পাঁচেক হাটলে তবে আমাদের ভার্সিটি পাওয়া যাবে।আমি চুপচাপই হাঁটছিলাম।এমন সময় মিলি আমাকে জিজ্ঞাস করলো,

-এই সাতদিন আপনি কোথায় ছিলেন?

আমি এই প্রশ্নের কি জবাব দেবো।ও এই প্রশ্নের উত্তর বেশ ভালো করেই জানে।তারপরেও এই প্রশ্ন করছে!ও আবার জিজ্ঞাসা করলো,

-কি ব্যাপার জবাব দিচ্ছেন না কেন? আমি বললাম,
-আমার মনে হয় তুমি প্রশ্নের উত্তরটা খুব ভালো করেই জানো। মিলি বললো,
-নিচের দিকে তাকিয়ে কি কথা বলছেন?আমার চোঁখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন।
-আমি পারবোনা।
-পারবেননা মানে?আপনাকে তাকাতেই হবে।

আমি ওর ঝাড়ি শুনে একদম সরাসরি ওর চোঁখের দিকে তাকালাম।কি গভীর চোঁখ!কি মায়াময় চোঁখ!ওর দৃষ্টি একদম আমার বুকে এসে আঘাত করলো।আমি চোঁখ ফিরিয়ে নিলাম।ও বললো,

-কি ব্যাপার চোঁখ ফিরিয়ে নিলেন কেন? আমি বললাম,
-আমি ওই মায়াময় চোঁখের দিকে তাকালে আরো বেশি করে তোমার প্রেমে পরে যাবো।আর আরো বেশি কষ্ট পাবো।তাই প্লিজ তুমি আমাকে আর এই অনুরোধ করো না। এরপর আর কেউ কোন কথা বলতে পারলাম না।যে যার ডিপার্টমেন্টের দিকে হাঁটা দিলাম। কিন্তু ক্লাসের ভেতরে এসেও শান্তি পাচ্ছিলাম না।বারবার শুধু মিলির কথা মনে হচ্ছিলো।তাই কোনমতে ক্লাসটেস্ট দিয়েই ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলাম।ভার্সিটির মাঠ দিয়ে হেঁটে গেটের বাইরে যাচ্ছিলাম।এমন সময় ফোন বেজে উঠলো।বেশবিরক্ত বোধ করলাম এখন ফোন আসায়।তাই নাম না দেখেই ফোনটা রিসিভ করেই জিজ্ঞাসা করলাম,

-কে?
-বাব্বাহ নাম্বারটাও ডিলিট করে দিয়েছেন।আমি কান থেকে ফোন নামিয়ে দেখি মিলির নাম্বার।
-আরে না।রোদের কারণে তোমার নাম্বারটা ঠিক ভাবে দেখতে পারি নাই।
-কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আমি বললাম,
-ক্যাম্পাসের বাইরে যাচ্ছি।তুমি কোথা থেকে দেখলে?
এমন সময় কাধে কে যেন হাত রাখলো।পেছনে তাকিয়ে দেখি মিলি।ওর কানে তখনো ফোন ধরা।ও বললো,
-চলেন আমিও বাইরে যাবো।আজ সারাদিন আপনার সাথে ঘুরবো।

ওর প্রস্তাব টা বেশ ভালো লাগলো।অনেকদিন ওর সাথে রিকশায় করে ঘুরাঘুরি নাই।তাই মনটা একটু বিক্ষিপ্ত হয়েছিলো।কিন্তু ওর ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব শুনে মন বেশ ভালো হয়ে গেলো।আমি তাড়াতাড়ি করে রাস্তার উপর এসে একটা রিকশা ঠিক করলাম।তারপর শুরু হলো আমার অনেক প্রতীক্ষিত রিকশাভ্রমণ।রিকশা কিছু দূরে যাওয়ার পরে মিলি আমাকে বললো,

-আজকে পূর্নিমার রাত।রাত ১১:০০ টার দিকে ছাদে আসবেন।দুইজনে মিলে জোছনা বিলাস করবো।
এবার আমার বেশ অভিমান হলো।প্রপোজও গ্রহণ করবেনা।আবার জোছনা বিলাসের জন্য আমাকে ডাকবে।তাতো হবেনা।আমি বললাম,

-আমি আসবোনা।জোছনা বিলাস তো সবথেকে প্রিয় মানুষকে নিয়ে করে।তুমিও তাকে নিয়ে করো। মিলি এবার আমার হাত ধরে একদম আমার চোঁখে চোঁখ রেখে বললো,

-আমি আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষকেই ইনভাইট করছি আজকে রাতে আমার সাথে জোছনা বিলাস করার জন্য।আর সে আমার সাথে দেখা করছিলোনা বলে আমিই তার সাইকেলের চাকা পানচার করেছিলাম। আমি মিলির কথা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।মিলি একদম গভীর চোঁখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ওর এই গভীর চোঁখ দুটিই বলে দিচ্ছে অনেক কিছু।হয়তো আজকের এই পূর্নিমা রাতেই আমাদের দুইজনের জীবনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত