রক্তের দাগ: ০৬. সেদিনটা ছিল রবিবার

রক্তের দাগ: ০৬. সেদিনটা ছিল রবিবার

০৫. মিনতি বলতে লাগল

মিনতি বলতে লাগল, রাত বোধ হয় বারোটা। হঠাৎ পর পর দুটো গুলির আওয়াজ–আর একটা আর্ত চিৎকার–

দুটো গুলির আওয়াজ শুনেছিলে? প্রশ্ন করলেন সোমনাথ ভাদুড়ী।

হ্যাঁ।

কিন্তু আদালতে বলেছ একটা গুলির আওয়াজই তুমি সে রাত্রে শুনেছিলে। আবার প্রশ্ন করলেন সোমনাথ ভাদুড়ী।

হ্যাঁ, তাই বলেছিলাম বটে।

কিরীটী এবার বললে, দুটো গুলির আওয়াজ শুনেছিলে তবে বলেছিলে কেন একটা গুলির আওয়াজ শুনেছো?

মনে ছিল না।

কিরীটী বললে, হুঁ। ঠিক আছে গুলির আওয়াজ শুনে তুমি কি করলে?

ভয়ে প্রথমে আমরা ঘর থেকে বের হইনি। এদিকে বাড়ির অনেকেই সে আওয়াজ শুনেছে তখন, কিন্তু তারাও কেউ ভয়ে ঘর থেকে বের হয়নি। মিনিট পাঁচেক পরে আমি আর আমার স্বামী দরজা খুলে বের হই। মৃণালের ঘরের দরজা বন্ধ। কোন সাড়া-শব্দ নেই। দরজায় ধাক্কা দিয়ে মৃণালকে ডাকি। কিন্তু মৃণালের কোন সাড়া-শব্দ পেলাম না। বাড়ির অনেকেই তখন এসে ঐ ঘরের দরজার সামনে ভিড় করেছে। হঠাৎ এই সময় আমার মনে পড়ল—আমার আর মৃণালের ঘরের মাঝখানে একটা দরজা আছে। আমার ঘরের ভিতর থেকেই আমি বন্ধ করে রাখতাম বরাবর। তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে সেই মধ্যবর্তী দরজাটা খুলে মৃণালের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি তপন ঘোষ রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেতে পড়ে। তার পাশে পড়ে বিজিতবাবু। তার হাতে ধরা একটা পিস্তল। আর—মৃণাল ঘরে নেই?

মৃণাল নেই?

না। বাথরুমের দরজাটা খোলা হাঁ হাঁ করছে। আমি তখন প্রথমে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বাথরুমের আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরে এলাম। আমার স্বামী দেখি দরজার গায়ে লাথি মারছে-বাড়িউলী মাসীর হুকুমে। দরজা ভেঙে আমি আর আমার স্বামীই প্রথমে ভিতরে ঢুকি—পর পর অন্য সকলে। পরে থানায় খবর দেওয়া হয়। পুলিস আসে।

বাথরুমের ওই দরজা দিয়ে এ বাড়ির বাইরে যাওয়া যায়? কিরীটীর প্রশ্ন।

হ্যাঁ, বাইরে একটা ঘোরানো লোহার সিঁড়ি আছে। সিঁড়িটা বরাবর একতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত গিয়েছে।

বলতে চাও তাহলে ওই সিঁড়িপথেই মৃণাল পালিয়েছে?

হ্যাঁ, তাছাড়া আর কি হবে। তবে পুলিসের খটকা থেকে গিয়েছে—মৃণাল কোন্ পথে পালাল-বাথরুমের দরজা যখন বন্ধ ছিল। আমিও পুলিসকে কথাটা বলিনি, আদালতেও প্রকাশ করিনি।

কেন করনি?

পুলিস হয়ত আমাকে সন্দেহ করত যে, আমিই তাকে সে-রাত্রে পালানোর সুযোেগ দিয়েছি।

এ কথাটা তোমার মনে হলো কেন মিনতি? কিরীটী প্রশ্ন করল।

তারা যে অনুসন্ধানের সময় আমার ও মৃণালের ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটা আবিষ্কার করেছিল এবং আমাকে নানাভাবে জেরা করেছি।

তা তোমাকে যে তারা শেষ পর্যন্ত সন্দেহ করেনি, তুমি বুঝলে কি করে?

আমি যে একসময় সে-রাত্রে গোলমাল শুনে এক ফাঁকে মৃণালের ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকেছিলাম, সে কথাটাও কাউকে আমি বলিনি। তারাও সেটা অনুমান করতে পারেনি। তাই আমার মনে হয়, আমাকে তারা মৃণালের সে-রাত্রে পালানোর ব্যাপারে কোনভাবে সন্দেহ করতে পারেনি।

কিরীটী মুখে কিছু না বললেও বুঝতে পারে মেয়েটি রীতিমত বুদ্ধিমতী।

মিনতি।

বলুন।

আমার কিন্তু মনে হয়, মৃণাল কোথায় আছে, অন্তত আর কেউ না জানলেও তুমি জানো।

কি বলছেন আপনি!

যা আমার মনে হচ্ছে তাই বললাম।

আপনি বিশ্বাস করুন, সত্যিই আমি জানি না।

দেখ মৃণালকে আমি খুঁজে বের করবই। সে অন্তত আমার চোখে ধুলো দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে না। আচ্ছা আজ আমরা উঠছি আবার কিন্তু আসবো।

নিশ্চয়ই আসবেন। মিনতি বললে, কিন্তু বিশ্বাস করুন বাবু, মৃণালের সন্ধান জানলে নিশ্চয়ই সে-কথা আমি আপনাদের জানাতাম।

কিরীটী মিনতিকে আর কিছু বললে না। উঠে দাঁড়াল এবং সোমনাথ ভাদুড়ীকে বললে, চলুন ভাদুড়ী মশাই, এবার যাওয়া যাক। ভাল কথা, একবার মৃণালের ঘরটা দেখে গেলে হতো।

সোমনাথ ভাদুড়ী উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, বেশ তো চলুন।

মিনতি বাড়িউলী মাসীর কাছ থেকে ঘরের চাবিটা নিয়ে এলো। দরজা খুলে ওরা দুজনে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।

রাত তখন প্রায় সোয়া নটা হয়ে গিয়েছে।

দুজনে ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় এসে কিরীটীর অপেক্ষমাণ গাড়িতে উঠে বসলো।

সর্দারজী, বাবুকে তার কোঠিতে নামিয়ে দাও আগে–কিরীটী বললে।

কিছুক্ষণ গাড়ি চলার পর সোমনাথ ভাদুড়ীই স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন, কি ভাবছেন রায় মশাই?

ভাবছি ওই মিনতি মেয়েটির কথা।

সত্যিই কি আপনার মনে হয়, মেয়েটি জানে মৃণাল কোথায়?

আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো জানে।

তবে সে কথা মিনতি প্রকাশ করল না কেন? এত কথা বললে, অথচ ওই কথাটা চেপে গেল কেন?

তার দুটি কারণ হতে পারে ভাদুড়ী মশাই।

কি কারণ?

প্রথমত, কথাটা প্রকাশ করলে সে মামলার মধ্যে জড়িয়ে পড়তো, যেটা হয়ত সে কোনক্রমেই চায়নি। দ্বিতীয়ত, হয়ত সে ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখেছিল সেই রাত্রে।

কি রকম?

গোলাগুলির আগে হয়ত একটা গোলমাল হয়েছিল। আর সে তখন ওই ঘরের। মধ্যবর্তী দরজা খুলে ব্যাপারটা সবার অলক্ষ্যে দেখেছিল। সে যে পিস্তলের গুলির শব্দেই প্রথমে আকৃষ্ট হয়েছিল কথাটা হয়ত সত্য নয় কিন্তু সে কথাটা প্রকাশ করেনি ওই একই কারণে—পুলিস তার পেটের গোপন কথা হয়ত টেনে বের করত জেরা করে। একটা কথা ভুলে যাবেন না ভাদুড়ী মশাই, ঘটনার সময় মিনতি আর তার স্বামী অবিনাশ ঠিক। পাশের ঘরেই ছিল। অকুস্থানের এক কথায় যাকে বলে সন্নিকটে।

তাহলে–

মিনতির উপর কড়া নজর রাখতে হবে। আপনি ভাববেন না, বাড়ি ফেরার পথেই লালবাজারের সি. আই. ডি. অফিসার প্রতুল সেনকে আমি মিনতির উপর কনস্ট্যান্ট একটা ওয়াচ রাখবার জন্য আজ থেকেই নির্দেশ দিয়ে যাবো।

সোমনাথ ভাদুড়ীকে তার গৃহে নামিয়ে দিয়ে কিরীটী সোজা সার্কাস এভিন্যুতে প্রতুল সেনের গৃহে গিয়ে উপস্থিত হলো।

প্রতুল সেন তখন ডিনারে বসেছিলেন।

সংবাদ পেয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে এলেন।

কি ব্যাপার মিঃ রায়! এত রাত্রে?

কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এত রাত কোথায়, মাত্র তো সোয়া দশটা।

আমি খেতে বসেছিলাম, আপনার নাম শুনে—

ছিঃ ছিঃ, যান আহার শেষ করে আসুন। আমি বসছি।

না না, আপনি বলুন কি দরকার?

বলবো বলেই তো এসেছি। আগে যান ডিনার শেষ করে আসুন, আমি বসছি।

সে হবেখন–আপনি বলুন।

না, এমন কিছু একটা জরুরী ব্যাপার নয়, আপনি যানফিনিশ ইওর ডিনার ফার্স্ট।

প্রতুল সেন চলে গেলেন এবং মিনিট কুড়ি বাদেই ফিরে এলেন একটা সিগারেট ধরিয়ে। একটা সোফায় বসতে বসতে বললেন, বলুন।

কিরীটী সংক্ষেপে ব্যাপারটা খুলে বলল। তারপর বললে, আমি যে জন্য এসেছি সেটা হচ্ছে ঐ মিনতির সবরকম গতিবিধির উপর আপনাকে নজর রাখার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এখুনি।

বেশ, করছি। প্রতুল সেন উঠে গিয়েই ফোনে যেন কাকে নির্দেশ দিয়ে এলেন।

মিঃ রায়, আপনার ধারণা তাহলে মিনতি জানে মৃণালের হোয়ার অ্যাবাউটস!

হ্যাঁ।

মিনতিকে তাহলে অ্যারেস্ট করলেই তো হয়?

না, এখন নয়।

কিন্তু তার স্বার্থ কি?

স্বার্থ একটা আছে বৈকি কিছু—

কি স্বার্থ থাকতে পারে?

ইফ আই অ্যাম নট রং—আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয়ে থাকে তো, কিরীটী বললে, ঐ বাড়িতে একটা চোরাকারবারের ঘাঁটি ছিল।

চোরাকারবারের ঘাঁটি!

হ্যাঁ। যার মধ্যে জড়িত ছিল তপন ঘোষ, বিজিত মিত্র ও সুদীপ রায় তো বটেই— ঐ মিনতি ও মৃণাল সম্ভবত ছিল।

সত্যি বলছেন?

বললাম তো আমার অনুমান। এবং তপন ঘোষের মৃত্যুর পশ্চাতেও ওই চোরাকারবার।

আর মিনতির স্বামী অবিনাশ সেন?

সেও থাকাটাই সম্ভব। আপনাকে আরো একটা কাজ করতে হবে মিঃ সেন।

কি?

ওই অবিনাশ সেনকে একবার লালবাজারে ডাকিয়ে আনাতে হবে কালই।

বেশ। কখন?

বেলা দশটা বা এগারোটা নাগাদ আমরা আপনার অফিসে তাকে জেরা করলে হয়ত কোন সূত্রের সন্ধান পেতে পারি।

আমার তো মনে হচ্ছে ওই মিনতি মেয়েটি—

তাকে তত জেরা করবোই—তার আগে তার জানা দরকার, তাকে ও তার স্বামীকে আমরা সন্দেহ করছি। আচ্ছা এখন তাহলে উঠি। কাল দশটা-এগারোটার মধ্যে আপনার অফিসে যাবো।

গৃহে ফিরে এলে কৃষ্ণা বললে, টিকিট পাওয়া গিয়েছে সামনের সোমবারে ড়ুন এক্সপ্রেসে।

আজ বৃহস্পতিবার হাতে তাহলে এখনো তিনটে দিন-রাত ও একটা বেলা আছে। ঠিক আছে, তার মধ্যে আশা করছি তপন ঘোষের হত্যার ব্যাপারে একটি হদিস হয়ত পেয়েও যেতে পারি।

তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি কোন একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের কাছাকাছি এসে গিয়েছে।

তোমাকে সেদিন বলছিলাম না কৃষ্ণা, কিরীটী একটা আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বললে, রক্তের দাগ একেবারে নিশ্চিহ্নভাবে মুছে ফেলা যায় না। যতই চেষ্টা করো মুছে। ফেলতে, একটা আবছা দাগ কোথায়ও-না-কোথায়ও থেকে যায়ই। আর সে-রক্তের দাগ যদি হত্যার হয় তো–

হত্যাকারী সনাক্ত হয়ে যায়! কৃষ্ণা মৃদু হেসে বললে।

তাই। কারণ কোন ক্রাইমই আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে একেবারে পারফেক্ট হয় না। হতে পারে না। ছোট একটা কিন্তু কোথাও-না-কোথাও থেকে যাবেই—সেই কিন্তু ধরে যদি এগুতে পারো—ঠিক সত্যে তুমি পৌঁছে যাবেই।

চল, রাত অনেক হয়েছে, এবারে খাবে চল।

হ্যাঁ, চল।

পরের দিন সকাল দশটা নাগাদ কিরীটী বেরুল।

লালবাজারে প্রতুল সেনের অফিস কামরায় প্রবেশ করে দেখলো প্রতুল সেন তারই অপেক্ষায় বসে আছে।

আসুন আসুন সত্যসন্ধানী।

কোন খবর আছে?

প্রতুল সেন বললেন, অবিনাশ সেনকে এখুনি আমার লোক নিয়ে আসবে।

প্রতুল সেনের কথা শেষ হলো না, সাব-ইন্সপেক্টার রঞ্জিত মল্লিক অবিনাশ সেনকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।

অবিনাশবাবু এসেছেন, স্যার।

বসুন অবিনাশবাবু। প্রতুল সেন বললেন।

অবিনাশ সেন বসলেন।

কিরীটী চেয়ে দেখে আগন্তুকের দিকে।

বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে বলেই মনে হয় ভদ্রলোকের। রোগা লম্বা চেহারা। গাল দুটো ভাঙা। মাথার চুলে কলপ দেওয়া! সযত্ন টেড়ি, মাঝখানে সিঁথি। চোখে সোনার চশমা। নিখুঁতভাবে দাড়ি কামানো। সরু গোঁফ ঠোটের উপর। পরনে দামী শান্তিপুরী ধুতি ও সাদা সিল্কের পাঞ্জাবি। সোনার বোতাম। দুহাতের আঙুলে গোটা দুই সোনার আংটি, তার মধ্যে একটা হীরা। হীরাটি বেশ বড় একটা বাদামের সাইজের, অনেক দাম যে হীরাটার বোঝা যায়।

লোকটি কেবল ধনীই নয়—বনেদী ধনী। শৌখিন প্রকৃতির।

কিন্তু সারা মুখে যেন একটা দীর্ঘ অত্যাচার ও অসংযমের ছাপ।

কি ব্যাপার স্যার—এত জরুরী তলব দিয়ে আমাকে এখানে ডেকে আনলেন কেন? অবিনাশ বললেন।

কোন রকমের ভনিতা না করেই প্রতুল সেন বললেন, আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে। তপন ঘোষ হত্যা-মামলার ব্যাপারটা!

সঙ্গে সঙ্গে অবিনাশ সেনের চোখের দৃষ্টি যেন সজাগ, তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।

মামলায় আপনি তো সাক্ষীও দিয়েছিলেন—

আজ্ঞে।

আপনি ওই বাড়িতে মিনতির ঘরে যেতেন? প্রশ্ন করল এবার কিরীটী।

অবিনাশ সেন চকিতে তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।

প্রতুল সেন বললেন, উনি যা জিজ্ঞাসা করছেন তার জবাব দিন।

কিন্তু স্যার—সে মামলা তো চুকেবুকে গিয়েছে।

না, যায়নি।

যায়নি! অবিনাশ সেনের কষ্ঠে বিস্ময়।

না, তপন ঘোষের হত্যাকারী এখনো সনাক্ত হয়নি। কিরীটী আবার বললে, কিন্তু আপনি আমার প্রশ্নের এখনো জবাব দেননি।

হ্যাঁ, তা মধ্যে মধ্যে যেতাম।

আপনার সঙ্গে তার পূর্ব-পরিচয় ছিল, তাই না?

পূর্ব-পরিচয় আর কি স্যার—একজন বারবনিতা—

কিন্তু তা তো নয়—

কি বলতে চান স্যার?

মিনতির সঙ্গে আপনার সত্যিকারের কি সম্পর্ক ছিল?

সম্পর্ক আবার কি থাকবে?

আপনি সত্য গোপন করছেন অবিনাশবাবু—

সত্য!

হ্যাঁ, তিনি ঐ লাইনে আসার আগে আপনার স্ত্রী বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন, দ্বিতীয় পক্ষের–

অবিনাশ সেনের চোয়ালটা ঝুলে পড়লো সহসা। দুচোখে বোবা দৃষ্টি।

কি, তাই না?

বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল কুলত্যাগিনী—

কথাটা আপনি আদালতে চেপে গেলেন কেন?

প্রয়োজন হয়নি-অবান্তর–

না, অনেক সত্য কথা বের হয়ে পড়ার ভয়ে কথাটা চেপে গিয়েছিলেন।

না, না—

তা সেই কুলত্যাগিনী স্ত্রীর কাছে আবার কেন আসতেন মধ্যে মধ্যে? নিশ্চয়ই ভালবাসার টানে নয়!

সত্যিই তাই স্যার। বিশ্বাস করুন ওকে আমি ভুলতে পারিনি।

তা মিনতি যে ওইখানে আছে খবর পেলেন কি করে?

হঠাৎ-ই—মানে অ্যাকসিডেন্টালি!

মানে ওই সব পাড়ায়—ওই ধরনের মেয়েদের কাছে যেতে যেতে!

অবিনাশ সেন চুপ করে থাকেন।

অবিনাশবাবু!

আজ্ঞে—

আমরা কিন্তু খবর পেয়েছি—

কি–কি খবর পেয়েছেন?

ওই বাড়িতে একটা চোরাই কারবারের আড্ডা ছিল।

চোরাই কারবার!

সেই কারবারের সঙ্গে আপনি ও মিনতি যুক্ত ছিলেন।

না, না–বিশ্বাস করুন, ওসব ব্যাপারের মধ্যে আমি নেই।

কিরীটী মৃদু হাসলো।

অবিনাশবাবু, আপনি জানেন মৃণাল কোথায়?

না, কেমন করে জানবো!

জানেন না?

না।

কিন্তু আমি যদি বলি আপনি জানেন!

মৃণাল পাশের ঘরে থাকত। মিনতির মুখেই আমি শুনেছিলাম, কিন্তু তার সঙ্গে কোন আলাপ-পরিচয় ছিল না, এমন কি আগে তার নামও জানতাম না।

তপন ঘোষের সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল না?

না।

বিজিতবাবুর সঙ্গে?

না।

সুদীপবাবুর সঙ্গে?

না।

তাহলে ওদের কাউকেই আপনি চিনতেন না বলতে চান অবিনাশবাবু? কথাটা বলে কিরীটী অবিনাশ সেনের মুখের দিকে তাকাল।

না। বিশ্বাস করুন, ওদের কাউকেই আমি চিনতাম না।

পন্টুকে আপনি চিনতেন?

পন্টু।

হ্যাঁ, সে তো মধ্যে মধ্যে আপনার দোকানে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করত। কথাটা কি অস্বীকার করতে পারেন?

ওই নামই জীবনে কখনো শুনিনি।

কিন্তু মিনতি বলেছে—

কি বলেছে মিনতি?

মধ্যে মধ্যে আপনি ঐ তপনবাবুর সঙ্গে বিশেষ করে দেখা করবার জন্য তার ঘরে রাত্রের দিকে যেতেন।

মিনতি বলেছে?

হ্যাঁ, আরো বলেছে তপন পাশের ঘর থেকে মিনতির ঘরে আসতো মাঝখানের দরজা-পথে—আবার কথাবার্তা হয়ে চলে যেতো ওই দরজা দিয়েই পাশের ঘরে।

মিনতি বলেছে ওই কথা আপনাকে! হারামজাদী! শেষেব শব্দটা কাপা আক্রোশভরা গলায় অবিনাশ সেন যেন অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলেন।

ঠিক আছে অবিনাশবাবু—আপনি যেতে পারেন।

ধন্যবাদ। অস্ফুট কণ্ঠে কথাটা বলে অবিনাশ সেন বের হয়ে গেলেন ঘর থেকে।

অবিনাশ ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর প্রতুল সেন কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

কিরীটী অন্যমনস্ক ভাবে পাইপটায় নতুন তামাক ভরছে তখন।

কি বুঝলেন মিঃ রায়। প্রতুল সেন প্রশ্ন করলেন।

গভীর জলের কাতলা। কিরীটী বললে।

সে তো বোঝাই গেল। নচেৎ সব স্রেফ অস্বীকার করে যেতে পারে!

তবে কাতলা টোপ গিলেছে।

টোপ!

হ্যাঁ, দেখলেন না—বঁড়শী টাকরায় গিয়ে বিঁধেছে।

মিনতি কি সত্যিই ওইসব কথা বলেছে মিঃ রায়?

না।

তবে যে বললেন—

টোপ ফেলেছিলাম একটা স্রেফ অনুমানের ওপরে নির্ভর করে দেখলেন তো, অনুমানটা মিথ্যে হয়নি। এবারে আপনাকে একটা কাজ করতে হবে মিঃ সেন।

কি বলুন?

মৃণালের ঘরটা এখনো খালি পড়ে আছে—সেই ঘরটার আমাদের প্রয়োজন।

সে আর এমন কঠিন কি!

এখুনি লোক পাঠান—আর একটা টেপ-রেকর্ডার।

পাবেন।

ওই বাড়ির খিড়কির দরজাটা

তাও খোলা থাকবে। তার আশেপাশে আমাদের একজন প্লেন ড্রেসে ওয়াচারও থাকবে। কিন্তু এত আয়োজন কিসের?

কিরীটী তখন তার প্ল্যানটা বুঝিয়ে দিল প্রতুল সেনকে। তারপর বললে, সন্ধ্যার পরই যেন সব প্রস্তুত থাকে।

কিন্তু আপনি কি মনে করেন মিঃ রায়–

কি?

টোপ গিলবে লোকটা!

গিলবে বলেই আমার ধারণা।

আজ না হয় কাল।

বেশ।

এবার আমি উঠবো।

তা কখন দেখা হচ্ছে?

ঠিক রাত সোয়া আটটায়।

অতঃপর কিরীটী বিদায় নিল।

আগের পর্ব :
০১. ফিরতে ফিরতে রোজই রাত হয়ে যায়
০২. সুদীপের ঘুম আসে না
০৩. গৃহে ফিরতেই কৃষ্ণা শুধাল
০৪. অমিয়বাবুর কাছ থেকে বিদায়
০৫. মিনতি বলতে লাগল

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত