পূর্ণিমারচাঁদ

পূর্ণিমারচাঁদ

—বাপ-মা মরা ছেলেকে এভাবে মেরো না শাহানা।
—তুমি চুপ থাকো!আজই আপদ বিদায় করো,আমি আর তোমার ভাতিজাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারবো না।এটাই আমার শেষ কথা।
—এতটুকু ছেলে কি কাজই বা করবে।সব কাজ কি ও পারে বলো।তাছাড়া তুমিও তো কম কাজ করাও না আবিরকে দিয়ে।

—অতশত বুঝি না আমি।আজ হয়তো ও বিদায় হবে, নতুবা আমি।
—কাকিমা আপনার কোথাও যেতে হবে না।আমিই চলে যাবো এ বাড়ি ছেড়ে।আজ যদি বাবা-মা বেঁচে থাকতেন তবে এভাবে বলতে পারতেন না।
—শাহানা তুমি কেন এমন করো ওর সাথে? ও তোমার সন্তানের মত নয় কি??
-তোমার যেহেতু এতই দরদ তবে থাকো তোমার ভাতিজাকে নিয়ে।
—কাকিমা আপনার দুটি পায়ে ধরি আপনি যাবেন না।যেতে হলে আমি যাবো, আপনি কেন? কাগজটা দিন, আজ আপনাদের নামে জমি-জমা যা আছে সব লিখে দিবো।

—বাবা আবির এ তুই কি বলছিস? তুই কই যাবি তোর বাবার বাড়ি ছেড়ে?
—কাকু আমি যদি এ বাড়িতে থাকি তাহলে প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হবে।তাতে আমার কোন রাগ বা আক্ষেপ নেই।কিন্তু আপনি কেন আমার জন্য কথা শুনবেন বলুন? তাছাড়া আমি যে কোন এক ব্যবস্থা করে নিবো চিন্তা করবেন না। কই আমার সোনা ভাই দুটি কই, আমার কাছে একটু আয়রে সোনা।শেষ বারের মত তোদের একটু বুকে জড়িয়ে নেই।

—দাদু ভাই! তুমি আমাদের ছেড়ে যেও না দাদু ভাই।
—আরে দূর বোকাদের মত কাঁদছিস কেন তোরা? আমি তোদের সাথে দেখা করতে আসবো সময় পেলে।আর হ্যাঁরে ভাই তোরা মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবি।অনেক বড় অফিসার হবি তোরা ।কাকা-কাকির প্রতি খেয়াল রাখিস।আমি এবার আসি কেমন।আয় তো তোদের কাপালে একটা চুমা খাই।

—শেষ পর্যন্ত তুমি আবিরকে বাড়ি ছাড়া করেই ছাড়লে শাহানা?তোমার সাথে কথা বলতে আমার ঘৃণা হয় ঘৃণা।
—এতই যখন ঘৃণা হয় তাহলে তুমিও চলে যাও,থাকতে হবে না আমার সাথে হুহহহহ!!
—কাকিমা আপনি কাকার সাথে এভাবে কথা বলবেন না।আর হ্যাঁ এই বাড়ি থেকে আমি এক কাপড়ে বেরিয়ে গেলাম।আজ থেক এই সব কিছু আপনাদের।নিবার মত কিছুই নেই তাই মা-বাবার ছবিটা সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম।ভালো থাকবেন আপনারা আমি চললাম।

এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লো আবির।সে নিজেও জানে না তার গন্তব্য কোথায়।যাবার মত কোন জায়গাও নেই আবিরের।আবিরের বাবা -মা বৈদ্যুতিক শকে মারা যান।তারপর থেকে বহু অত্যাচারের স্বীকার হন বড় কাকি শাহানার কাছে।শাহানা দুচোখে সহ্য করতে পারে না আবিরকে।শেষমেশ ছাড়তে হলো আবিরের বাবার রেখে যাওয়া বাড়িটা। আবির হাটতে হাটতে গঞ্জে পৌছে যায়।প্রচুর ক্ষুধার্ত হয়ে বসে আছে ছাত্রী ছাউনিতে। ছুটছে শহরের পানে,টাকা পয়সাও নেই আবিরের কাছে।ক্ষুধা চেপে বসে আছে আবির।পরপর ৪ টা শহরগামী গাড়িতে সিট মিললো না টাকার জন্য।আকাশটাও যে সন্ধ্যার বার্তা দিয়ে দিছে।বাবা-মায়ের ছবিটা বের করে দেখতে থাকে আবির।কথা বলতে থাকে ছবির সাথে…

—জানো মা,জানো বাবা, আজ না আমাকে বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে।তোমার খোকা যে সকাল থেকে না খেয়ে আছে।আর যে সইতে পারছি না আমি।তোমরা বেঁচে থাকলে আজ আমি এভাবে ক্ষুধার্ত হয়ে থাকতাম না।
কথা গুলো বলতে বলতে টপ টপ করে আবিরের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে।নিজেকে এই পৃথীবির সব থেকে অসহায় মনে হচ্ছে আবিরের। রাত তখন ১২ টা ছুই ছুই।লাঠি হাতে এক বৃদ্ধার আগমন হয়। বয়স সম্ভবত ৭০ থেকে ৭৫ হবে।ছেড়া একটা পাঞ্জাবী ছিলো পরনে।সাদা রং এর পাঞ্জাবীটা হলুদ বর্ণের হয়ে গিয়েছে।বৃদ্ধা লোকটা আবিরের দিকেই এগিয়ে গেল। লোকটি বললেন,

—তুমি কে বাবা? এত রাতে এই যাত্রী ছাউনিতে কেন? তোমার বাড়ি কোথায়??
—আমার নাম আবির।পাশের গ্রাম রসুলপুর আমার বাড়ি।বাবা-মা বেঁচে নেই।কাকা কাকির কাছে থাকতাম।আজ বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে।থাকার বা যাবার মত কোন জায়গা আমার নেই তাই এখানে বসে আছি।

—মুখটা কেমন শুকিয়ে এসেছে তোমার।সারাদিনে মনে হয় পেটে কিছুই যায় নি?
-হুমমম!প্রচুর ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু খাবো কি? নিজের কাছে যে একটা পয়সাও নেই।
—নাও আমার খাবারটা তুমি খাও আজ।
—আপনি খাবেন না?
—আজ না খেলেও চলবে আমার।আজ তেমন ক্ষুধা নেই।তুমি খেতে থাকো আমি পানি নিয়ে আসি।

আবির খেতে শুরু করে।প্রচুর ক্ষুধার্ত ছিলো আবির।কিন্তু আবির পুরো খাবারটা খেলো না,অর্ধেকটা বৃদ্ধা লোকটার জন্য রেখে দিলেন।বৃদ্ধা লোকটা পানি নিয়ে আসলেন এবং আবিরকে পানি দিলেন। আবির বাকি অর্ধেক খাবারটা বৃদ্ধা লোকটার দিকে এগিয়ে দিলেন।বৃদ্ধা লোকটি খেতে চাইলেন না।বৃদ্ধা লোকটিও ক্ষুধার্ত ছিলো। সারাদিন এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে নিজের জন্য খাবারের জোগান করেন বৃদ্ধা লোকটি।প্রতি রাতে পাশের মাদ্রাসা থেকে বৃদ্ধা লোকটাকে একটা করে খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়। বৃদ্ধা লোকটি খাবার খাওয়া শেষ করে আবিরকে বললেন,

—এখন থাকবে কোথায় তুমি?তোমার কাছে তো টাকা-পয়সাও নেই যে শহরে যাবে? করবেটা কি তবে? আবির দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললো,

—আজকের রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেই।সকালে না হয় শহরের পানে ছুটবো।আল্লাহ সহায় হলে ঠিকি একটা উপায় খুজে পাবো ইনশাআল্লাহ।

—বাবা আবির আমার যে তেমন কোন সমর্থ নেই।মানুষের কাছে হাত পেতে দু-টাকা উপার্জন করি।আর রাতের খারারটা মিলে এই মাদ্রাসা থেকেই। এভাবেই আমার জীবন চলছে।তুমি যদি চাও আমার কাছে থাকতে পারো বাবা।থাকার মত দোচালা একটা ঘর আছে।আমি ওখানে বেশি একটা থাকি না। আবির বৃদ্ধা লোকটার কথায় রাজি হয়ে যায়।দুজনে হাটতে থাকে। আবির কিছুটা প্রশান্তির হাসি হাসে।কিছু দূর যাবার পর নির্জন একটা জায়গাতে দেখতে পায় ঘরটি।বৃদ্ধা লোকটা হাতের ইশারায় নিশ্চিত করেন ওটাই উনার থাকার ঘর। ঘরটা অন্ধকার থাকায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। বৃদ্ধা লোকটি হাতড়ে হাতড়ে কুপিটা খুজে বের করে।কুপিতে আগুন দিতেই অন্ধকার কিছুটা মিলিয়ে যায়।আবির কুপি হাতে নিয়ে পুরো ঘরটা দেখে নেয়।ঘরের পূর্ব পাশে মাটিতে খড় দিয়ে থাকার জায়গা করা রয়েছে। আবিরে উদ্দেশ্যে বৃদ্ধা লোকটি বললেন,

—বাবা আবির এখানে থাকতে তোমার সমস্যা হবে না তো? বৃদ্ধা লোকের এমন প্রশ্ন শুনে আবির চোখের পানি ছেড়ে দেয়।জড়িয়ে নেয় বৃদ্ধা লোককে।আবির বললো,

—না কাকা, আমার কোন সমস্যা হবে না।আমি আজ থেকে এই ঘরটায় থাকবো।তবে কাকা একটা প্রশ্ন ছিলো আমার।যদি অনুমতি দেন তবে আমি প্রশ্নটা করবো।

—হ্যাঁ বাবা বলো।কি জানতে চাও তুমি।
—আপনি কি একাই থাকেন?? আপনার ছেলে-মেয়ে নেই?

বৃদ্ধা লোকটা আবিরের এমন প্রশ্নে চুপ হয়ে গেলেন।কুপির আলোতে দেখলো বৃদ্ধা লোকটা চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদছেন।বৃদ্ধা লোকটার পাশে গিয়ে বসলো আবির। আবির হাতটা বাড়িয়ে বৃদ্ধা লোকটার চোখটা মুছিয়ে দিলেন।বৃদ্ধা লোকটা বললেন,

—আমার অতীতের কোন কথাই মনে নেই।আমার এতটুকুই মনে আছে আমার একটা ছেলে ছিলো।সেদিন রাতে সব এলোমেলো হয়ে গেলো।আমার কোন কিছুই মনে নেই।কোন কিছুই মনে নেই।

—কাকা আপনি কাঁদবেন না।আমি তো আছি।আজ থেকে আমি আপনার ছেলে। বৃদ্ধা লোকটা আবিরকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। আবির নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বললো,

—কাকা আজ থেকে আপনি আর মানুষের কাছে সাহায্যের হাত পাতবেন না।আমি যা পারি জোগাড় করবো।আল্লাহ আমাকে অক্ষম করে পাঠান নি।কাজ করার মত সক্ষমতা আমাকে দিয়েছেন।দুজনে খুব ভালো ভাবে জীবন-যাপন করতে পারবো। আবিরের বয়স তখন ১৫ অথবা ১৬ হবে।এই বয়সে স্কুল মাদ্রাসায় পড়ার কথা আবিরের।কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস।দু বেলা পেট ভরে খাবার খেতে পারে না।ওদিকে বৃদ্ধা লোকটার শরীরও খুব একটা ভালো না।সেদিন চেয়ারম্যান সাহেবর বাড়িতে পাথর ভাঙ্গা শেষ করে ওষুধ হাতে বাড়ি ফিরছে আবির।ঘরে ঢুকতেই বৃদ্ধা লোকটি মৃদু সরে ডাক দেয় আবিরকে,

—বাবা আবির তুই এসেছিস।আমার পাশে একটু আয় তো বাবা।

বৃদ্ধা লোকটার ডাকটা আজ আবিরের কলিজায় গিয়ে লাগে।দৌড়ে গিয়ে লোকটা পাশে বসে।বৃদ্ধা লোকটা আবিরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে এবং বলতেছে,

—বাবা আবির আমার অতীতের কোন কথাই মনে পড়লো না।তোকে কিছু বলেও যেতে পারলাম না।বাবারে তুই এতদিন আমার পাশে ছিলি।আমার মনে ছেলের জায়গাটা তোকে দিয়ে পূরণ করেছি।আমি মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচবো না বাবা।তোর পাশে তো কেউ থাকলো না রে বাবা।তুই ভেঙে পড়বি না।ঐ উপর ওয়ালা সব সময় তোর পাশে থাকবে।তাকে ভুলে যাস না বাবা।আল্লাহকে স্বরণ রাখিস বাবা।

আবির চোখের পানি ছেড়ে দেয়।বুকটা শুকিয়ে আসে আবিরের।বৃদ্ধা লোকটা হটাৎ করেই নিরব হয়ে যায়।আবির চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে।লোকজন জড় হয়ে যায় মুহূর্তেই। আজ আবার একা হয়ে গেলো আবির। আজ এক সপ্তাহ হলো বৃদ্ধা লোকটা মারা গেছেন।এই এক সপ্তাহ আবির কাজে যায় নি। চেয়ারম্যান সাহেব আবিরকে খুব ভালোবাসে।এক সপ্তাহ আবিরের দেখা না পেয়ে আবিরের খোজে লোক পাঠান।আবিরও চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি উদ্দেশ্যে রওনা হয়।পথেই কুদ্দুস ভাই, চেয়ারম্যান চাচার সাথেই থাকে তার সাথে দেখা।কুদ্দুস ভাই আবিরের উদ্দেশ্যে বললেন,

—আবির চেয়ারম্যান চাচা তোমার খোজে আমাকে পাঠিয়েছে।তুমি এতদিন কাজে যাওনি কেন?? কাজে যাওনি সেটা বিষয় না। তুমি তো জানোই চেয়ারম্যান চাচা তোমাকে খুব আদর করে।অন্তত তার সাথে দেখা করতে তো যেতে পারতে? আবির, কুদ্দুস ভাইয়ের কথায় কোন প্রত্যুত্তর করলো না।আবির সামনের দিকে হাটতে থাকে।কুদ্দুস ভাই কিছুটা ভাবুক মনেই আছে।যে আবির কথা না বলে থাকতে পারে না আজ কেন এমন নিরব। নানান প্রশ্ন কুদ্দুস ভাই এর মনে ঘূরপাক খাচ্ছে।আবির চেয়ারম্যান সাহেবের সামনে পৌছে গেল।চেয়ারম্যান সাহেব আবিরকে জিঙ্গেস করলো,

—আবির তুই এতদিন কই ছিলি রে?? তোর মুখটা কেমন জানি শুকিয়ে গেছে? কি হয়েছে বলতো আমায়।
আবির বললো,

—চাচা আমার এই জগতে আপন বলতে কেউ নাই চাচা।বাবা-মা মারা যাবার পর বড় কাকি বাড়ি থেকে বের করে দেয়।তারপর আশ্রয় পাই এক বৃদ্ধ কাকার কাছে।আজ এক সপ্তাহ হলো তিনিও চলে গেছেন।আমি যে আবার একা হয়ে গেলাম চাচা। চেয়ারম্যান তার আসন ছেড়ে উঠে এসে আবিরকে নিজের বুকে জড়ি নেয়।আবির এমন ভাবে কথা গুলো বলেছে চেয়ারম্যান সাহেবের চোখে পানি এসে গিয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব আবিরকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

—আরে বোকা আমি তো আছি তোর পাশে।আজ থেকে আমার কাছেই থাকবি।কাঁদিস না আবির।আমি আছি তোর পাশে।তোর যা প্রয়োজন হবে আমায় বলবি কেমন।

—চাচা আমি ফ্রি ফ্রি আপনার থেকে কিছু নিবো না।আমি তো অক্ষম নই।আপনার এখানে কাজ করবো,বিনিময়ে যা প্রয়োজন হবে তাই নিবো। চেয়ারম্যান সাহেব এজন্যই হয়তো আবিরকে খুব বেশি ভালোবাসে।আজ অব্দি কোন কিছুই কাজের বিনিময় ছাড়া নেয় নি আবির।

আজ বারটি বছর অতিবাহিত করেছে চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ীতে।চেয়ারম্যান সাহেবের সস্তির দীর্ঘশ্বাস এখন আবিরই।প্রয়োজনের বাহিরে কোন কিছুই খরচ করে না আবির।কখনো হিসাব মিলাতে ভাবতে হয় নি পাঁচ মিনিট।আবিরের এই সততা চেয়ারম্যান সাহেবের মনে একটা ভালোবাসার স্থান করে নেয়।চেয়ারম্যান সাহেবের ডান-বাম দুটোই আবির।দশ গ্রামের সালিশ বিচার করতে আবিরকে নিয়ে যায়।

লোক সমাজে বেশ কথা বলতে পারে আবির।ন্যায়ের পক্ষে সব সময় কথা বলে আবির।অন্যায়ে মাথা নত করে না।চেয়ারম্যান সাহেবের আদর্শে দীক্ষিত আবির।চেয়ারম্যান সাহেব গ্রামের সকলের কাছে ভালোবাসার মানুষ,বিশ্বাসের প্রতিক।আজ অব্দি চেয়ারম্যান সাহেবের বিপরীতে কেউ বিরোধিতা করেন নি।বেশ জনপ্রিয়তা তার গ্রামে। পাশের বাড়ির সুমনাকে আবির পছন্দ করে।সুমনা ওর নানির কাছে বড় হয়েছে।সুমনার নানি আবিরকে খুব আদর করে।সেদিন সালিশ থেকে ফিরছে আবির।গ্রামে মেলা বইছে।সুমনা রসমালাই খেতে খুব পছন্দ করে।সুমনার জন্য ৫০০ গ্রাম রসমালাই কিনে আবির, সুমনার বাড়ি সামনে গিয়ে ডাকতে থাকে,

—নানি! ও নানি! বাড়িতে আছো?
—আয় ভাই ভিতরে আয়।সারাদিনে এখন নানির কথা মনে পড়লো?
—আর বইলো না নানি, পাশের গ্রামের এক সালিশে গেছিলাম।সেখান থেকে ফিরতে এত বেলা হলো। সুমনা কোথা থেকে যেন ছুটে আসে।হয়তো আবিরের গলার আওয়াজ শুনে।

—আচ্ছা নানি খিদা লাগছে কিছু খাইতে দিবা?
—ভাত দিবো ভাত খাবি ভাই?
—না নানি, ভাত খামু না। চাইরটা মুড়ি দাও বইসা বইসা চাবাইতে থাকি।
—সুমনা যা তো আবিরকে মুড়ি আর আখের গুড় এনে দে।

উঠানে সুমনা ওড়না শুকাতে দিয়েছিলো।আবির ওড়নাটা নিজের গলায় পেচিয় নেয়।সুমনা ঘরের ভিতরে যাবার সময় ওড়নটা আবিরের গলা থেকে নিয়ে যায়।ওড়নার এক প্রান্তে মুড়ি ও আখের গুড় বেঁধে আবিরের হাতে দেয়। আবির মৃদু হাসি হাসে এবং বলে,

—সুমনা ফেরার পথে মেলা থেকে তোমার জন্য রসমালাই নিয়ে এসেছি।অনেক দিন ধরে খেতে চেয়েছিলে আনতে পারি নি। নানিরেও দিও একা খেও না যেন।

—নানিরে দিতে পারুম না।আমার জন্যি আনছো আমি একাই খামু।নানির জন্যি দরদ থাকলে আবার লইয়া আসো তুমি। সুমনার এমন ছেলে মানুষি আবিরের খুব ভালো লাগে।সুমনার গায়ের রং তেমন উজ্জল নয়।তবে গঠনটা বেশ সুন্দর।শ্যাম বর্ণের,আলাদা একটা সৌন্দর্য রয়েছে সুমনার মাঝে। সুমনা রসমালাই খেতে খেতো বললো,

—আবির ভাই তুমি আমার জন্যি নূপুর,কাচের চুড়ি আনতে পারো না?তোমারে কতবার কইছি মনে থাকে না তোমার?আইজ যদি তুমি না আনছো তোমার লগে কথা কমু না। আবির সুমনার কথা আপন মনে শুনলো। আবির বললো,

—আজ তোমারে কাচের চুড়ি আর নূপুর এনে দিবো।তুমি মন খারাপ করো না। আমি এখন যাই ঐ দিকে কাম আছে অনেক।সন্ধায় আবার আমুনি যইগা নানি।

আবির রোজ আসার সময় সুমনার শুকাতে দেওয়া ওড়নাটা নিয়ে আসে।আবির ক্লান্ত হলে ওড়না দিয়েই মুছে নেয়।পরের দিন ওটা রেখে আরেকটা নিয়ে আসে।দুজন দুজনকে পছন্দ করে,ভালোবাসে, তবে একে-অপরের কেউ কাউকে বলতে সাহস পায় না।দুজনের প্রতি দুজনের মায়া-মহব্বত কম নয়। আবির চেয়ারম্যান চাচার কাছে গিয়ে বসে।অন্যদিন হলে আবির কথা না বলে থাকতে পারতো না।চেয়ারম্যান সাহেব পেপার পড়ছিলেন।পেপার থেকে মুখটা সরিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,

—আবির কিছু বলবি নাকি? মুখ টা এমন গোমড়া করেছিস কেন?? আবির একটু নড়ে-চড়ে বসলেন।আমতা আমতা করে বললো,
—চাচা সুমনাকে আমি বিয়ে করতে চাই।অরে আমার ভাল্লাগে খুব। চেয়ারম্যান সাহেব হাসি মুখে বললেন,

—সেদিন সুমনার নানি এসেছিলো।তোর ব্যপারে কইলো।সুমনার নানি ও চায় তুই সুমনারে বিয়া কর।তবে তোরে সাহস করে বলতে পারি নি। তুই তো রাগি মানুষ কি থেকে কি বলিস সে জন্য।তবে তোর যে সুমনাকে ভালো লাগে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম।

—হ চাচা সুমনারে ছাড়া কাউরে বিয়া করুম না।সুমনারে দেখলে পরানডা জুড়ায় যায়।কষ্ট গুলো উইড়া যায়।অর ভিতর মায়া আছে চাচা।আপনি সুমনার লগে আমার বিয়াডা পড়ায় দ্যান।
—আচ্ছা ঠিক আছে।ওদের সাথে কালই কথা বলবো।ওদের ও তো সুযোগ সুবিধা দেখতে হবে।
—আইচ্ছা চাচা অনেক সাহস নিয়ে আইজ আপনার কাছে আইছি।অনেক বার ভাবছি বলবো, তবে বলবো বলবো করে বলা হয় নি।

পাশ থেকে চেয়ারম্যান সাহেবের ছোট ছেলেটা হুট করে হেসে ওঠে।আবির লজ্জা পেয়ে চোখটা নামিয়ে নেয়।অনুমতি নিয়ে বেরিয়ে আসে। লাল বেনারসি পরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে সুমনা।আজ যে ওদের স্বপ্নের বাসর রাত।রাত তখন ১১ টা ছুই ছুই।আবির এখনো আসে নি।সুমনা আবিরের জন্য উৎসুক মনে বসে আছে।আবিরের কোন খবর নেই।আবিরের জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে আছে সুমনা।একা ঘরে কিছুটা ভয়ও করছে সুমনার। হাটাৎই আবির ঘরে ঢুকে। আবিরকে দেখতে পেয়ে অভিমানের সুরে সুমনা বললো,

—আমাকে ঘরে একা রেখে কোথায় ছিলেন আপনি? জানেন না আমার একা থাকতে ভয় করে।আপনার সাথে কথা বলবো না আমি।আপনি খুব পঁচা।
—আমি কি সত্যিই খুব পঁচা??
—পঁচা নয়তো কি।নতুন বউকে কেউ এত সময় ধরে অপেক্ষা করায় শুনি।তাছাড়া আমার চিন্তা হয় না বুঝি।
—কিসের চিন্তা আমাকে নিয়ে শুনি?
—আপনার শুনতে হবে না। বলেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় সুমনা।
—আমার বউটার জন্য রসমালাই আনতে গিয়েছিলাম।সে যে খুব পছন্দ করে রসমালাই খেতে। তাই তো একটু দেরি হলো। সুমনা একটু বিস্মিত হয়ে বললো,

—সত্যি আপনি আমার জন্য রসমালাই এনেছেন?

আবির মনে মনে ভাবে, রাগলে তো সুমনাকে বেশ ভালোই লাগে।আর একটু রাগাই সমস্যা কি।পরে না হয় রাগ বেশি হলে ভাঙিয়ে নিবো।আবির মৃদু হাসি দিয়ে বলে,

—আমি কি একবারও বলেছি তোমার জন্য এনেছি?

মুহূর্তেই সুমনার মুখটা গোমড়া হয়ে যায়।সুমনা ভেবেছিলো আবির তার কথাই বলবে।আবির দেখলো সুমনার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আবির বললো,

—এই তুমি কাঁদছো কেন? সুমনা কাঁদো গলায় বললো,
—আপনি কোন মেয়ের জন্য রসমালাই এনেছেন।অন্যের জন্য যেহেতু আনবেন তবে আমাকে বিয়ে করলেন কেন? আমি কাল সকালেই নানির কাছে চলে যাবো।

—কাল যাবে কেন?? এখনই যাও।
—হুমম তাই করবো এখনই চলে যাবো নানির কাছে।

সুমনা দরজা খুলে বাহিরে অন্ধকার দেখে দাড়িয়ে যায়।আবির খুব উপভোগ করছে সময়টা।আবির আবারও মৃদু হাসি হাসলো এবং বললো,

—থামলে কেন যাও?
—বাহিরে তো অন্ধকার আমার ভয় করে।আপনি একটু এগিয়ে দিবেন।
—তোমাকে আমি কেন এগিয়ে দিবো বলো।আমার ঘুম পাচ্ছে, এখন ঘুমাবো আমি।
—আপনার যেতে হবে না, বলেই বাহিরে বসে পড়ে সুমনা।সুমনা আবিরের উদ্দেশ্যে বললো, আমি সারারাত বাহিরেই থাকবো।সকাল হলে চলে যাবো নানির কাছে।সুমনার কান্না জড়িত কথাটা শুনে আবির বাহিরে চলে এলো।আবির বললো,

—আমার নতুন বউটা কি কান্না করছে? বোকাদের মত কান্না করছো কেন তুমি।আর আমি অন্য মেয়ের জন্য কেনইবা রসমালাই আনতে যাবো।আমি তো আমার নানির নাতনির জন্য এনেছি।আবিরে কথা শুনে ফিক করে হেসে দিয়ে সুমনা বললো,

—আপনি সত্যি খুব পঁচা।
—আবার আপনি? বুঝছি সেই মেয়েকে এবার দিয়েই আসতে হবে রসমালাই গুলো। আর নূপুর,কাচের চুড়ি গুলোও দিয়ে আসবো।
—এই না! না! আমি তুমি করেই বলছি।
—আর কখনো যদি আপনি করে বলেছো তবে সেই মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসবো।

সুমনা বাধ্য মেয়ের মত মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আবির নূপুর গুলো সুমনার পায়ে পরিয়ে দেয়।সুমনা অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে আবিরের দিকে। চুড়ি গুলো এগিয়ে দেয় সুমনার দিকে এবং বলতে থাকে, আর যদি কখনো আপনি করে বলেছো তখন যেমন করে পরিয়ে দিয়েছি তেমন করে আবার খুলে নিবো মাথায় রেখো কেমন। সুমনা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।সুমনা আবিরের বাহু জড়িয়ে নেয়। দুজনের ভালোবাসার প্রাপ্তিটা আজ পেয়েই গেলো।

সুমনা গভীর ঘুমে আচ্ছন।চাঁদের আলো আচড়ে পরেছে সুমনার মুখটাতে। দেখতে খুব মহনীয় লাগছে।চাঁদের আলো আরো সুন্দর করে তুলেছে সুমনাকে।বেশ মায়াবী দেখাচ্ছে সুমনাকে।আবির ভাবতে থাকে, এই মেয়েটার মাঝে এত মায়া কেন? আমি যে চোখ ফেরাতেই পারি না ওর থেকে। মানুষ ঘুমিয়ে থাকলে এতটা নিষ্পাপ ও মায়াবী দেখায় আগে জানা ছিলো না।আল্লাহ এই মেয়েটাকে শুধু আমার জন্যই পাঠিয়েছে।আমার ঘরে পূর্ণিমার চাঁদ হয়ে পাঠিয়েছে।ঐ আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে মানুষ যেমন রাত পার করে দিতে পারে আমিও ঠিক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রাতের পর রাত পার করতে পারবো।

আজকের রাতটা না হয় আমি আমার ঘরে উদিত পূর্ণিমার চাঁদটা দেখেই পার করি।আবির বিড়বিড় করে বললো, সূর্য্যের রশ্মি রক্তিম হয়ে মিলিয়ে যাবে আধারে, অন্ধকারে মিলাবে দিনের আলো। খোলা জানালায় উকি দিয়ে দেখবে বিদঘুটে অন্ধকার। কোথাও আলোর ছিটেফোঁটা নেই,নেই আলোক রশ্মি। কালো মেঘের অবরণে লুকিয়ে আছে অভিমানি চাঁদ, তোমরা বলবে,আজ কালো রাত নতুবা অন্ধকার। আমি তোমাদের বিপরীতে বলবো, আজ! আজ কালো রাত নয়, আজ! পূর্ণিমা রাত। ঐ যে! আমার ঘরে উদিত রয়েছে “পূর্ণিমার চাঁদ”। আজ! আজ কালো রাত নয়, আজ! পূর্ণিমা রাত।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত