২.০৫ কে কাঁদে নিশিরাতে
ক্রমশ সন্ধ্যার অন্ধকার যেন কালো একটা ওড়না টেনে দেয় পৃথিবীর বুকে।
সুব্রত চুপচাপ একাকী তার ঘরের সামনে খোলা ছাদটার ওপরে একটা ক্যাম্বিসের ইজিচেয়ারে গা ঢেলে নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল।
অন্ধকারে ছাদের ওপরে নুয়ে পড়া বটবৃক্ষের পাতাগুলো ছোট ছোট হাতের মত যেন দুলে দুলে কি এক অজ্ঞাত ইশারা করছে।
আর কিছুক্ষণ পরে ক্রমে রাত্রি যখন গভীর হবে, এ বাড়ির আশেপাশে সব বিদেহী প্রেতাত্মারা ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে। তাদের দেখা যাবে না, অথচ তাদের পায়ের শব্দ শোনা যাবে। তাদের নিঃশ্বাসে বইবে মৃত্যুর হাওয়া।
জুতোর শব্দ শোনা গেল বারান্দায়, সুব্রত সজাগ হয়ে উঠে বসে। শিবনারায়ণ চৌধুরী আসছেন নিশ্চয়ই। পরক্ষণেই চৌধুরী এসে ছাদে প্রবেশ করলেন, কল্যাণবাবু আছেন নাকি?
হ্যাঁ, আসুন চৌধুরী মশাই। কখন ফিরলেন কারখানা থেকে?
এই তো কিছুক্ষণ হল ফিরে স্নানাদি করলাম। তারপর সারাটা দিন একা একা কাটাতে হল, খুব কষ্ট হয়েছে নিশ্চয়ই!
না, কষ্ট আর তেমন কি, নির্জনতা আমার ভালোই লাগে। আপনার ওদিককার কাজ কতদূর হল?
সবই প্রায় হয়ে গেছে, এখন চালানটা তৈরী করে গাড়িতে চাপিয়ে স্টেশনের দিকে রওনা করে দিতে পারলেই, ব্যস। আজ সারাটা রাত্রি ধরে গাড়িতে বোঝাই হবে, ভোরবেলা আমি গিয়ে রওনা করে দিয়ে আসব মাত্র।
***
রাত্রে আহারাদির পর সুব্রত এসে শয্যায় শুলো বটে, কিন্তু চোখের পাতায় ঘুম যেন কিছুতেই আসতে চায় না। আর কেন যেন ঘরে ঘরে কেবলই ছাদের দিকে খোলা জানলাটার উপরে গিয়ে চোখের দৃষ্টি পড়ে। অন্ধকার বাতাসে ছাদের উপরে নুয়ে পড়া বটবৃক্ষের পাতার কাঁপুনির শব্দ যেন একটানা শোনা যায়। কেমন যেন একটু তন্দ্ৰামত এসেছিল, সহসা এমন সময় আবার গতরাত্রের সেই করুণ কান্নার শব্দ রাতের স্তব্ধতাকে মর্মরিত করে তোলে। সুব্রত ধড়ফড় করে শয্যার ওপরে উঠে বসে। কাঁদছে! কে যেন কাঁদছে গুমরে গুমরে! গতরাত্রের মতই সুব্রত ঘরের দরজা খুলে বাইরে অন্ধকার বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।
এখন আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে সেই কান্নার শব্দ। সুব্রত বারান্দা অতিক্রম করে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। কান্নার শব্দ যেন সুব্রতকে সম্মোহিত করে সামনের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে কি এক অজ্ঞাত আকর্ষণে।
সিঁড়িটা অন্ধকার। সুব্রত অবার নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে টটা নিয়ে আসে। সিঁড়ির স্তুপীকৃত অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে যেন পাতালপুরীর মৃতুগুহা হতে কোনো এক অশরীরী কান্নার শব্দ ওপরদিকে ঠেলে উঠে আসছে। সুব্রত টর্চের বোম টিপল, মুহূর্তে স্তুপীকৃত অন্ধকার সরে গিয়ে সমগ্র সিঁড়িপথটি আলোকিত হয়ে ওঠে। সিঁড়ি বেয়ে সুব্রত নীচে চলে আসে। কান্নার শব্দটা এখনও কানে এসে বাজছে।
প্রথমে সুব্রত সদর মহলটা দেখলে। না, কিছু নেই সন্দেহজনক। অতঃপর অন্দরমহলে গিয়ে সুব্রত প্রবেশ করে। এবারে কান্নার শব্দটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে কানে আসছে। চলতে চলতে সুব্রত দ্বিপ্রহরে যে ঘরটার তালা ভেঙেছিল, সেটার বন্ধ দরজাটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। তালাটায় হাত দিতেই তালাটা খুলে গেল,বুঝলে এখনও তালা ভাঙার ব্যাপারটা কেউ টের পায়নি এ বাড়িতে। মনে হচ্ছিল কান্নার শব্দটা যেন সেই ঘর থেকেই আসছিল। নিঃশব্দে সুব্রত অন্ধকার ঘরটার মধ্যে পদার্পণ করলে। হ্যাঁ, আরও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে এবারে কান্নার শব্দটা। মনে হয় কে বুঝি ঐ ঘরেরই ধূলিমলিন মেঝের ওপরে লুটিয়ে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে।
চাপা গলায় সুব্রত প্রশ্ন করলে, কে কাঁদছ?
মুহূর্তে কান্নার শব্দ থেমে গেল। সুব্রত কিছুক্ষণ রুদ্ধনিশ্বাসে অন্ধকার ঘরটার মধ্যে কান পেতে দাঁড়িয়ে রইল। না,আর কোনো শব্দ নেই। যে-ই কাঁদুক, এখন আর কাঁদছে না।
সুব্রত আবার চাপা গলায় প্রশ্ন করে, কে? কে কাঁদছিলে? কথা বলছ না কেন? জবাব দাও।
সহসা এমন সময় গতরাত্রের মত কার পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। অস্থির পদে কে যেন আশেপাশেই কোথায় পায়চারি করছে আর করছে।
সুব্রত এবারে টর্চের বোম টিপে টচটা জ্বালল। কেউ কোথাও নেই, খাঁ খাঁ করছে শূন্য ঘরটা। অন্ধকারে এতক্ষণ যারা ঘরের মধ্যে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, তারা সব যেন হঠাৎ আলো দেখে পালিয়ে গেছে। বাড়িটা কি ভৌতিক বাড়ি! এ কি সব আশ্চর্য ব্যাপার! খখস শব্দ তুলে পায়ের কাছ দিয়ে একটা বড় ইঁদুর চলে গেল ঘরের কোণে। সব্রত তার উপরে আলো ফেললে। হঠাৎ আলোয় ইঁদুরটা যেন একটু হকিয়ে গিয়েছিল। পরক্ষণেই একলাফে কপাট-খোলা দেওয়ালে-আলমারিটার মধ্যে লাফিয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আশ্চর্য, ইঁদুরটা কোথায় গেল? সুব্রত আলমারিটার সামনে আরও এগিয়ে গেল। না, ইঁদুরটা নেই তো! অতবড় ইঁদুরটা! আলো ফেলে খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুব্রত আলমারিটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। আলমারিটায় সর্বসমেত তিনটি তাক। সর্বনিম্নের তাকে লাফিয়ে উঠেই ইঁদুরটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। হঠাৎ ওর নজরে পড়ল, সর্বনিম্ন তাকের ডানদিককার দেওয়ালে একটা বড় ফোকর। এতক্ষণে সুব্রত বুঝলে ঐ ফোকরের মধ্য দিয়েই ইদুরটা অদৃশ্য হয়েছে। এমন সময় আবার সেই কান্নার শব্দ এবং যেন বেশ স্পষ্ট হয়ে কানে আসে এবারে।
নিজের অজ্ঞাতেই সুব্রত এবারে ফোকরটার দিকে ঝুঁকে পড়ে। হ্যাঁ, ঠিক। এতক্ষণে চকিতে ওর মনে একটা সম্ভাবনা যেন হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে যায়। অশরীরী কান্না নয়, কোনো জীবন্ত হতভাগ্যেরই বুকভাঙ্গা কান্না। সুব্রত ফোকরটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে থাকে, চারপাশে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে। নিশ্চয়ই এই ঘরের নীচে কোনো চোরাকুঠুরি আছে, এবং সেই চোরাকুঠুরির অন্ধকার অতল গহ্বর থেকেই আসছে সেই কান্নার শব্দ কিন্তু সেই চোরাকুঠুরিতে প্রবেশের পথ কোথায়? কোথায় সেই অদৃশ্য সংকেত? সুব্রত আলমারিটা আবার ভাল করে পরীক্ষা করতে শুরু করে উৎকণ্ঠিত ভাবে চারপাশে টিপে টিপে হাত বুলিয়ে, টোকা মেরে, ধাক্কা দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকে। কিন্তু কোনো অদৃশ্য সংকেতই তার চোখে পড়ে না। আলমারির কপাটের গায়ে সেখানেও কিছু নেই। আলমারির কপাট দুটো খোলে আর বন্ধ করে। দুতিনবার খুলে আর বন্ধ করতে করতে চতুর্থবার একটু জোরে কপাট দুটো বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরসর করে একটা ভারী শব্দ ওর কানে আসে। পরক্ষণেই তার চোখের সামনে যে বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটে যায়, তাতে ও ভূত দেখার মতই চমকে দুপা নিজের অজ্ঞাতেই পিছিয়ে যায়। আলমারির মধ্যস্থিত পশ্চাতের দেওয়াল ও সেলগুলো আর দেখা যাচ্ছে না। তার জায়গায় একটা কালো গহুর হাঁ করে মুখব্যাদান করে যেন ওকে গ্রাস করতে চাইছে।
প্রথম পর্ব:
আগের পর্ব :
১.০১ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
১.০২ পুরাতনী
১.০৩ রায়পুর হত্যা-মামলা
১.০৪ প্লেগ ব্যাসিলাই
১.০৫ মাকড়সার জাল
১.০৬ জাস্টিস মৈত্র
১.০৭ জবানবন্দি জের
১.০৮ আরও সূত্র
১.০৯ হারাধন ও জগন্নাথ
১.১০ অদৃশ্য ছায়া
১.১১ মৃত্যবাণ
১.১২ নিশানাথ
১.১৩ তারিণী, মহেশ ও সুবোধ
১.১৪ আরও সাংঘাতিক
১.১৫ আবার আততায়ীর আবির্ভাব
১.১৬ দুঃখের হোমানল
১.১৭ মামলার আরও কথা
দ্বিতীয় পর্ব :
২.০১ সূত্র সন্ধান
২.০২ নৃসিংহগ্রাম
২.০৩ শিবনারায়ণ
২.০৪ পুরাতন প্রাসাদ
পরের পর্ব :
২.০৬ আবার বিষের তীর
২.০৭ রাণীমা
২.০৮ জবানবন্দির জের
২.০৯ পাতালঘরের বন্দী
২.১০ ঘটনার সংঘাত
২.১১ পাতালঘরে
২.১২ কিরীটীর বিশ্লেষণ
২.১৩ রাণীমার স্বীকৃতি
২.১৪ কিরীটীর চিঠি
২.১৫ কিরীটীর ডাইরী
২.১৬ বিশ্লেষণ
২.১৭ মীমাংসা
২.১৮ পূর্ব ঘটনার অনুস্মৃতি
২.১৯ শেষ কথা











