সেদিন বাবাকে বলেছিলাম দায়িত্ব পালন করতে না পারলে জন্ম দিয়েছো কেনো? বাবা কিছুক্ষনের জন্য হয়ত তব্দা খেয়ে গিয়েছিলেন আমার কথায়। চুপ করে চলে গিয়েছিলেন পাশ কাটিয়ে। আমিও বোধহয় কিছুটা তৃপ্তি পেয়েছিলাম কথাটা বলতে পেরে। আসলেই তো,ছোটবেলা থেকে অন্যান্য দের তুলনায় আমার চাহিদা তুলনামূলক কম হওয়া স্বত্তেও বাবা কখনো তা পরিপূর্ণ করতে পারেন নি।প্রতি মাসে বেতন পেয়ে ৩০ টাকা দিতেন সেটাও আম্মুর কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে। আমার তাতে পোষাতো না। আমার এখনো মনে আছে,খুব ছোটবেলায় আশরাফুলের ক্রিকেট খেলা দেখে ক্রিকেটের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম,চেয়েছিলাম ক্রিকেটার হতে।
বাবার কাছে চেয়েছিলাম সামান্য একটা ব্যাটিং গ্লাভস। তিনি নিয়ে গেলেন মার্কেটে আমাকে। কিন্তু গ্লাভসের দাম ছিলো ৭৫০ টাকা। সামান্য বেতনভুক্ত আমার বাবার পক্ষে হয়ত সেটা ক্রয় করার সামর্থ্য ছিলো না। তাই তিনি রাত ২ টা পর্যন্ত জেগে কাপড় সেলাই করে বানিয়ে দিয়েছিলেন একটা হাতের গ্লাভস। যদিও সেটা হাতমোজার মতো হয়েছিলো,তবুও আমি স্বাচ্ছন্দ্যে সেটা নিয়ে খেলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু পাড়ার বন্ধুদের হাসি তামাশার পাত্র হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এসেই ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম বাবার দেওয়া সেই গ্লাভস টি। বাবা স্বচক্ষে দেখেছিলেন কিছু বলেননি। আরেকটু বড় যখন হলাম তখন বায়না ধরেছিলাম সাইকেলের। তিনি বলেছিলেন, “সময় হোক,পেয়ে যাবে।” সেই সময় বোধহয় আজো এলো না। আমার চাওয়া তেমনছিলো না।
আরেকটু বড় যখন হলাম,তখন আমি পরিপূর্ণ যুবক। গায়ের রক্ত গরম! কাউকে কেয়ার করার সময় নেই আমার। দেখলাম বন্ধুরা দামী ফোন ব্যাবহার করছে। বাবাকে বলা বৃথা জেনেও বলেছিলাম তাকে। তিনি বলেছিলেন, “আরো কিছুদিন অপেক্ষা করো,সময় হোক।” ব্যস আমার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। বলে ফেললাম সেই কথাটি!আর কত সময় লাগবে তার?আসলেই তো কেনো জন্ম দিয়েছিলেন? তিনি চলে গিয়েছিলেন অন্য রুমে। প্রায় ১ মাস আমার সাথে কথা বলেননি তিনি। সেটা কি তার রাগ ছিলো নাকি অন্য কিছু তা বোঝার মতো বয়স তখনো হয়নি। বললামই তো টগবগে যুবক ছিলাম। অন্যের বাবার সাথে নিজের বাবার তুলনা করতাম সব সময়। মা কে বলতাম,”অন্যের বাবা তাদের চাহিদা পুরন করতে পারলে তিনি পারবেন না কেনো?” মা আমাকে চুপ করিয়ে দিতেন।
বাবা সব সময় একটা কথা বলতেন, “ইট মারলে পাটকেল টি খেতে হয়” আমাকে ঈঙ্গিত করে বলতেন,”তুমি তোমার বাবা মায়ের সাথে যেমন আচরন করবে ঠিক তেমন টাই তুমি তোমার সন্তানের কাছ থেকে পাবে,এর বেশি আশা করিও না কিন্তু,মনঃক্ষুন্ন হবে” এসব কথা পাত্তা দিতাম না আমি। তার কিছুদিন পরে বাবা ইন্তেকাল করেন। দিন টি ছিলো সোমবার। আমি বন্ধু বান্ধব দের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম কক্সবাজার। মা ফোন দিয়ে বলেছিলেন বাবা হাসপাতালে। আমি পরের দিনই চলে আসার সিদ্ধান্ত নেই। জানি না কেনো,আমি খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। বাবার চেহারা ভাসছিলো আমার চোখে। রাত টুকু কেবল নিজেকে এই বলে স্বান্তনা দিয়েছিলাম যে সকাল হলেই বাবার দেখা পাবো।
কিন্তু নাহ,শেষ দেখা হলো না বাবার সাথে। তার আগেই তিনি বিদায় জানান এই নিষ্ঠুর জগত কে। মারা যাওয়ার আগে বারবার দেখতে চেয়েছিলেন আমাকে,মা ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন আর বলেছিলেন ও আসছে,শিঘ্রই এসে পড়বে। আমার মনে আছে সেদিন জীবনে প্রথম চিৎকার করে কেঁদেছিলাম আমি। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। অজস্রবার কপাল ঠুকেছিলাম দেওয়ালে,চিৎকার করে বলছিলাম কেও কি আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে? সকলেই বুঝাচ্ছিলো মৃত ব্যক্তির সামনে কাদঁতে হয়না! এতে নাকি মৃত ব্যক্তি কষ্ট পায়। কিন্তু আমি তাদের কিভাবে বুঝাবো, আমি যে বড্ড অপরাধী তার কাছে,বড্ড অপরাধী।সেই পাপের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে আমায় আজীবন।
ক্ষমা চাওয়া হলো না তার কাছে আমার। নিয়তি হয়ত এমনই। কিছু মানুষকে সুযোগ দেয় না প্রায়শ্চিত্ত করার। বিবেকের কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আজ মাথার উপর থেকে সেই বাবা নামক ছায়া টা নেই। আজ আমি নিজের সাথে বন্ধুদের তুলনা করি। মা কে বলি,”তারা কত ভাগ্যবান তাই না? অন্তত বাবাকে ভালোবাসি কথাটা তো বলতে পারবে।” মা চুপ করে থাকেন। চোখের কোণে বিন্দুজল জমা হয়ে উঠে তার। সেটা আমার চোখ এড়ায় না।