শুকনো পাতা

শুকনো পাতা

বাবার তখন কোমড়ে ব্যাথা। কাজ করতে গিয়ে নাকি হালকা ব্যথা পেয়েছে। মিথ্যে গুলো কত সহজেই বলে দেয়। অদ্ভুত লাগে ভীষণ! কাজ করেনা কিছুদিন হলো, কাজ করতে গেলেই নাকি ব্যাথা বেশি হয়। তাই কিছুদিন রেস্ট নিচ্ছে। মাসের শেষ হয়ে ৭ তারিখ, তখনো স্কুলের গতমাসের বেতন দেওয়া হয়নি। বাবার কাছে টাকা চাব সেই সাহসও হয়নি। রোজ স্যারদের কটু কথাও ভালো লাগেনা। সবার যেখানে ১ তারিখেই টাকা পেইড সেখানে আমি এখনও দেইনি। সেদিনতো কবির স্যার বলেই দিলো…

–কিরে তুই এখনও বেতন দিলিনা যে। মাত্রতো ৬০০ টাকা।
-স্যার আব্বা অসুস্থ, ক’দিন পর দিব।
–৩ দিন থেকেই তো বলছিস ক’দিন পরে দিবি। নাকি টাকা নিয়া নেশা করছস?

স্যারের কথার জবাব দেওয়ার সাহস হয়নি। সবাই যেখানে হাসাহাসি করছিলো সেখানে আমি মাথা নিচু করেছিলাম, অপমানে হয়তো লজ্জায়। তবে মনে হয়েছিলো কেউ একজন আমায় দেখছে তার মায়াময় ঐ চোখ দিয়ে। তার বুকে কিঞ্চিত ধুকপুক শব্দ করছে, সেটা কেন হয় তা আমি জানিনা। শুধু জানি সে আমার কষ্ট গুলোর ভাগ চায়, চায় একটু আড়ালের বেড়াজালটা ভেদ করতে। আমার সাহসে কুলোয়না, মাথা উঠাইনা, নিচু করেই রাখি। দীর্ঘ ১ ঘণ্টা পথ হেঁটে বাড়ির সামনে মাস্টারের বড় ইউকেলেপ্টাস বাগানের ভিতর দিয়ে বাড়িতে যাই। এখানে দিয়ে আসলে সময় কিছুটা কম লাগে। অভিমান করে আম্মাকে বলি….

–মা কালকে বেতন দেওয়া লাগব।
-জানোসইতো তোর বাপে অসুস্থ, কোমড়ে ব্যাথা।
–আমি এতকিছু জানিনা, কবির স্যার সরম দেয় খালি।
-দিকগা সরম, স্যাররে কইস কয়দিন পর নিতে।
–পারুমনা, আর সবাই বেতন দিয়া দিছে।
-সবার বাপেরতো টাকা আছে তোর বাপের কি এত টাকা আছে?!
–মাত্র ৬০০ টাকাইতো।
-মাটি খুইদা দেখতো একটা পয়সা বাড়ায় নাকি।

আমি কথা বাড়াইনা। হারিকেন জ্বালিয়ে পড়তে বসি৷ জাহিদ স্যারের পড়াগুলো সারারাত ধরে মুখস্থ করি। নইলে যে দাঁড় করায় রাখে, আবার মারেও। সকালে মা হাতে ৫০০ টাকা দেয়। আমি অবাক হই বেশ, ১০০ কম কেন? এটা ভেবে। মাকে বললাম….

–আর একশ কো?
-তর বাপে ঔষধ আনব।
–না ঐ একশও দেও।
-তর বাপের ঔষধ লাগব, ঐ ৫০০ শই দেগা স্যাররে বলিস কম নিতে।

আমি জেদ করি, আমার ৬০০ ঐ লাগবে। বাসায় আব্বার আগমন ঘটে৷ সব বলার পর ১০০ দিয়ে দেয়৷ আমি দেরি করিনা, এমনিতেই স্কুলের বেলা হয়ে গেছে৷ স্যার টাকা নেয়, পুরাতন নোটতো উল্টিয়ে দেখে। বলে…’এরপর তাড়াতাড়ি দিবি, দেরি করিসনা।’

মার ডিম বেচা অল্পকিছু টাকা দিয়ে আব্বা দোকান থেকে ব্যাথার ট্যাবলেট এনে খায়। কিছুদিন পর ব্যাথা কিছুটা কমে। আব্বা আবার কাজে যায়। স্কুল থেকে বলা হলো পিকনিকে যাবে। আমি স্যারদের না করে দেই। মন খারাপ হয় ভীষণ। মাকে বলব সাহস হয়না। আব্বার চোখের দিকে তাকানোর ইচ্ছে করেনা। ঐ চোখের ভাষা সবাই পড়তে পারবেনা। পিকনিকের দিন আঁচ করতে পারি সবাই গেলেও কেউ একজন যায়নি পিকনিকে। নিজ থেকেই আসে কাছে, বলে….

–সবাই গেলো তুমি গেলাও না কেন?
-এমনি যাইনি। তুমি কেন গেলা না?
–বাসে গেলে বমি হয় তাই।

তার এক নিঃশ্বাসের বলা কথাগুলো বলে দেয় সে মিথ্যে বলছে। আমি বুঝিনা আমার সাথে তার সখ্যতা করেই বা কি। আহামরি দেখতে না হলেও তার মুখটা মায়াবী। সেও আমার মতন ব্যাকবেঞ্চার। তবে তাকে স্যার কখনো কিছু বলেনা। বেতন দেয় ঠিকমতো, আর পড়াও দেয় কোন ভাবে।

পরীক্ষা চলে আসে। বিদায় অনুষ্ঠানে সবাই শাড়ী পাঞ্জাবী পরে৷ আমি আমার হাফ হাতা শার্ট আর গ্যাবাটিং প্যান্টটা পরে আসি। কেন জানি বেমানান লাগে নিজেকে। তবে কোনা ভাঙা আয়না দিয়ে দেখছিলাম আমায়তো ভালোই দেখা যায়। একটু হেসেছিলাম। সেও শাড়ি পরে এসেছিলো। স্যারের বক্তৃতার মাঝে আড়চোখে দেখেছিলাম তাকে। কপালে একটা টিপ পরেছিলো, একটু বাকা হয়েছিলো৷ সেদিন তার ঠোঁটে প্রথম লিপস্টিকের হালকা ছাপ দেখেছিলাম। বক্তৃতা শেষে স্যাররা তবারক দেয় আমাদের। তার কাছাকাছি হই একটু। অবাক হই বেশ! এমা তার চোখের নিচে তিল আছে, অথচ আমি দেখিনি এর আগে। সে বলল….

–তোমার পাঞ্জাবী নাই, সবাই পাঞ্জাবি পইরা আইছে।
-নাইতো, তোমারে সুন্দর দেহা যায়।
–এহ, আমিতো কালা।
-কালাই ভালা।
–বাসায় যাবা কহন?
-এইতো এহনি।
–আইচ্ছা যাও, পরীক্ষার দিন দেহা অইব।

আমি চলে আসি। তবে বুঝেছিলাম সে আমায় পাঞ্জাবীতে দেখতে চাইছিলো। পরীক্ষা শুরু হয়। আমি হেঁটে হেঁটে পরীক্ষা দিতে যাই। আমার সিট পরে একটা মেয়ের সাথে। হল থেকে বের হইনি সেদিন। পরীক্ষা শেষে দেখি মাঠের মাঝখানে সে। আমাকে হাত ইশারা করে। মুচকি হেসে বলে….

–তোমারেতো দেখলামই না। পরীক্ষা কেমন দিলা?
-ভালোই তুমি?
–দিলাম কোনরহম। তোমার পাশে মেয়ে বসছে নাকি ছেলে?
-মেয়ে, তোমার?
–আমারও মেয়ে। অনেক ভালো ছাত্রী তয় দেহায়না।
-নিজেই লেইখো।
–আচ্ছা যাইগা, বায়।

চলে যায় পরীক্ষা। শেষ পরীক্ষার দিন তার চোখের দিকে তাকাতে পারছিলামনা। কেমন জেন লাগছিলো। অনুভূতিটা ভয়ংকর। মনে হয়েছিলো কেউ বুকে চাকু ঢুকিয়েছে আর সেটা কলিজায় গিয়ে লেগেছে। আমিই প্রথম বলি….

–পরীক্ষা কেমন হইলো?
-ভালোনা বেশি, তোমার?
–আমারও, পরীক্ষাতো শেষ কি করবা?
-কি আর করুম বাসায় বইসা থাকমু রেজাল্ট দিলে কলেজে ভর্তি হমু।

খুব বেশি কথা বলিনি আর। তবে বুঝতে পেরেছিলাম আমার কিছু একটা হয়েছে। তবে তার চোখ বলছিলো, রুবেল তুমি বলদ একটা। দু’দিন পর আব্বা বলে বাসায় বইসা থাক কি করবি, তর লিটন কাকার দোকানে গিয়ে কাজ করবি।’

এভাবেই চলে আমিও কাজে যাই। দু’মাস পর রেজাল্ট দেয়। কোনরকমে পাস করি। ৩.৫৮ রেজাল্ট। আব্বা আম্মা খুশি কারণ পাশ করেছি। তার রেজাল্ট শুনতে পারিনি। কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা আব্বাকে বলার সাহস হয়নি। আব্বার চোখই বলছিলো সে আর পারবেনা। আমারও আর হলোনা। ইতি হলো কলেজ লাইফ। জীবন পরিচালনার জন্য ফার্ণিচারের কাজটাই বেছে নিলাম। কেমন করে যেন ম্যাচিউরড হতে থাকলাম।

তারপর বহুদিন গেলো। আমি এখন ১২ হাজার টাকা বেতন পাই। আব্বা কাজ করেনা, কোমড়ে সমস্যা। নিজেই সংসার চালাই। বৃষ্টি আসলো একদিন। সেবার কাজের চাপ বেশি। বোরকা পরে একটা মহিলা আসলো৷ ছোট বাচ্চাও আছে সাথে। লিটন কাকা দোকানে নাই আমিই বসতে বললাম। পাশের দোকান থেকে চা অর্ডার করলাম কাস্টমার বলে কথা। সে মুখোস খুলল, কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়েছিলাম। সেই কালো মেয়েটা, যার চোখের নিচে কালো তিল আছে। বলল….

–আলনা বানাইতে কত টাকা লাগবে?

আমি বিষম খেয়ে জবাব দিলাম, ২৩০০ টাকা। সে কিছু বললনা। লিটন কাকা আসলো আলনার অর্ডার করলো। জরুরি কল আসলে লিটন কাকা চলে যায়। সেও উঠে দাঁড়ায়, আমি বলি….

–তুমি কত পাইছিলা পরীক্ষায়?
-গনিতে ফেল করছিলাম। আব্বা বিয়া দিয়া দিছে।
–আইচ্ছা, আর তোমার আলনা পরশুদিন দিমুনি।
-আইচ্ছা। তুমি ভালো আছাও রুবেল?

আমার বুকে ধুকপুক শব্দ হয়। অদ্ভুত রকমের। তবে, সেটা সুখের নয়। আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি, মুচকি হেসে কাজে মনোযোগ দিয়ে বলি ‘এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত