নীরাকে প্রথম দেখি মল চত্বরে! মেয়েটা দেখতে কেমন দেখার আগে আমার চোখআটকে যায় ওর চুলে। ভাবছেন জীবনানন্দের নায়িকার মতন ‘চুল তার কবেকার বিদিশার নেশা’ টাইপ চুলবলে? মোটেই না! রোদের আলোয় ওরব্লন্ড করা চুল স্বর্ণের মত জ্বলছিল। আমি ভাবছিলামএই ব্লন্ডে বাংলাদেশি স্কিন টোনের কাউকে কি মানাবে? মেয়েটা তো ভীষণ সাহসী! তখন ভাবতেও পারিনি মেয়েটার সাহস কোন একদিন আমার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে! যা বলছিলাম, পেছন থেকে মুগ্ধ হয়ে চুল দেখতে দেখতে ওর পেছনে হাঁটছিলাম আমি ভার্সিটির বাসে উঠব বলে। আজকাল যেদিকে তাকাই রিবন্ডিং করা স্ট্রেট চুল দেখে অভ্যাস। ওর ঢেউখেলানো সোনারং চুল ঠিক কতক্ষণ দেখেছি মনে নেই। বাসে উঠেই ও ডাবল ডেকারের নিচ তলায় মেয়েদের ভীড়ে হারিয়ে গেল। আমার উঠে যেতে হবে দোতলায়। কিন্তু মেয়েটাকে দেখতেও ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে। সাতপাঁচ ভেবে গেটে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি সেদিন প্রথমবারের মত। জুনিয়ররা মজা নিতে ছাড়ল না এই আমাকে গেটে দাঁড়াতে দেখে।
আমি হাসিমুখে সব হজম করছিলাম আর ভাবছিলাম কোন স্টপেজে নামবে মেয়েটা!একের পর এক স্টপেজে বাস থামে আর আমি অপেক্ষায় থাকিমেয়েটাকে দেখব বলে। নিজেকে ভীষণ বেহায়া লাগলেও সামলাতে পারছিলাম না। হাউজ বিল্ডিং এসে বাস বেশ ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় অযথা গেটে দাঁড়িয়ে থাকাটা খুব অস্বস্তিকর হয়ে গেলে উপরে উঠে এলাম আমি নিজেকে কটা গালি দিয়ে। একটা সিটে বসে জানালায় হেলান দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি পরের স্টপেজে নেমে হেঁটে চলে যাচ্ছে মেয়েটা। আবারো চিনলাম ওর চুল দেখেই। মুখটা আর দেখা হল না ভেবে মনে মনে ‘ধুর ছাই ইয়ন! এই ফাইনাল ইয়ারে এসে এসব ঢং করার মানে নেই ‘ বলতেই দেখি মুখ ফিরিয়েকোন বন্ধুকে বাই বলে হাত নাড়ছে স্বর্ণকেশী! আমি সত্যিকার অর্থেই জম্বি হয়ে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার হাসির দিকে। এতসহজ,সুন্দর মুখ আমি কোনদিন দেখিনি আগে!
হাসপাতাল খুব অদ্ভুত জায়গা! এক মুহূর্ত না ঘুমিয়ে প্রতি সেকেন্ডে কারো হাসি বা কান্নার সাক্ষী হয় বলেই কিনা কে জানে! যদিও এই হাসপাতালে বসেথাকলে হাসপাতাল কম, ফাইভ স্টার হোটেল বেশি মনে হয়। আমি বসে আছি আমার মেয়েকে বুকে চেপে। রাত কত হয়েছে বুঝতে পারছি না। ক্ষুধায় চোখে অন্ধকার দেখছি। ইরাবতী,মানে আমাদের মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে কাউচেই। আর আমি বসে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম নীরাকে প্রথম দেখার দিনটা। আর আজকে শেষ দেখব। আমাদের ১০ বছরের চেনাজানা, প্রেম, বিয়ে সব কিছু আজকের পর থেকে শুধু আমার গল্পে বেঁচে থাকবে।
আমি ইরাকে শুইয়ে দিয়ে করিডোরে বের হলাম। নীরার বাবাকে দেখলাম এক পাশে সব হারানো মানুষের মত দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখে পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি এই মানুষটার ছেলে হয়ে থেকেছি সব সময়। তার হাতটা মুঠোয় চেপে ধরলাম আমি। আমার শাশুড়িকে ইরার পাশে গিয়ে বসতে বলে বিল মিটিয়ে দিতে গেলাম। আজ থেকে নীরার জন্য আর কোন খরচ হবে না কারো। মেয়েটার কি ভীষণ আত্মসম্মানবোধ ছিল! নিজের পায়ে দাঁড়াবে, কারো কাছে কখনো হাত পাতবে না, কাউকে যেন তার জন্য ভাবতে না হয় সেই চেষ্টা করে যাওয়া মেয়েটার শেষ কটা দিন সবাই তাকে নিয়ে কতটা অস্থির হয়েছে দেখলে সে খুশি হত না মোটেই।
নীরার ক্যান্সার ধরা পরে আমাদের মেয়ের জন্মের ১ বছরের মাথায়। সি সেশনের ধকল সামলে ওঠার পর পর আবার একের পর এক সার্জারি আর কেমোতে অস্থির নীরা দাঁতে দাঁত চেপে বেঁচে ছিল আমাদের জন্য। চোখের সামনে কংকাল হয়ে যাওয়া, চুল, ভুরু পড়ে যাওয়া নীরাকে দেখে তবু রোজ মুগ্ধ হতাম আমি। ক্যান্সারের কেড়ে নেয়ার পর নীরা আর তার পাতলা চুলে রঙকরতে চায়নি। আমি ওর চুলের নিচের দিকে তবু খানিকটা রঙ করে দিয়েছিলাম। ওকে স্বর্ণকেশী ডাকি আর চুলে সোনার ছিটেফোঁটা না থাকলে মানায়?
এইসব অদ্ভুত কাজে রোমান্টিকতা খুঁজে পাওয়া নীরা কি যে খুশি হয়েছিল আমার এই কাজে! আমার হাত ধরে সেদিন বিকেলে মল চত্বর হাঁটার বায়না ধরেছিল। ঠিক ক্যাম্পাসের দিনগুলোর মত করে! ওকে প্রথম দেখার পর হারিয়ে ফেলি আমি। শুধু জানতাম ও কোথায় নামে বাস থেকে। ওই দিয়ে এই এত বড় ক্যাম্পাসে কাউকে খুঁজে পাওয়া যে কি মুশকিল! তবু রোজ ভার্সিটি বাসে উঠে খুঁজে বেরাতাম ওকে। নাম জানি না, ডিপার্টমেন্ট জানি না, নিজের মনে ওকে স্বর্ণকেশী বলে ডাকি আর খুঁজে বেড়াই। একদিন ভীষণ রোদে ঘেমে নেয়ে বাজে এক্সামের পর বাস ধরব বলে যেয়ে শুনি বাস চলে গেছে ১ মিনিট আগে। মহা বিরক্ত হয়ে পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখি স্বর্ণকেশী। আমারই মত বাস ধরতে এসেছিল। দৌড়ে আসায় হাফাচ্ছে। আমি সেদিন আমার জীবনজুড়ে পাওয়া লাজুক ছেলের খেতাবকে টিস্যু পেপারে মুড়িয়ে নীরার দিকে বাড়িয়ে দিলাম আর সে একটা থ্যাংকস বলে ওটা নিয়ে ঘাম মুছে ছুড়ে ফেলে হাসল।
এরপর কথা বলে জানা গেল এই মিষ্টি মেয়ে, যাকে আমি ফার্স্ট ইয়ারে বড়জোর সেকেন্ড ইয়ারে ধরে রেখেছি, মোটেই আমার জুনিয়র না, বরং ওর মাস্টার্সের শেষ সেমিস্টার চলছে। আমি কবে ধার ধেরেছি এসবের? নাহয় ও আমার আগে চাকরি পাবে, আমি বের হতে হতে ওর বিয়ের প্রেসার চরমে উঠবে, আমার যে ওর হাসি রোজ দেখতে পাওয়া চাই! নাহয় আমি করবই না মাস্টার্স। এই ফাইনালের পরই চাকরি খুঁজে নেব নীরার জন্য! আমার সব সস্তা রোমান্টিকতায় জল ঢেলে নীরাজানিয়েছিল ওর বিয়ে ঠিকঠাক। ৩ বছরের প্রেম করাক্যাম্পাসেরই প্রেমিকের সাথে। নিজেকে এত গাধা আর কোনদিন মনে হয়নি আমার।
পরের বাসে ওঠার আগে তবু কি ভেবে নীরাকে ফেসবুকে বন্ধু করে নিই আমি। মাঝে মাঝে কথা হয় আমাদের। ওর বই পড়ার স্বভাব, প্রিয় গানের লিস্ট আর প্রায় সব কিছুতে থাকা জ্ঞান আমাকে মুগ্ধ করতে থাকে আরো ভাঙবে বলে। আমিও নিজেকে ভাঙতে দিই। বন্ধুই তো আমরা। সে হওয়াই যায়। তবু যদি এ মেয়ের আশপাশে থাকা যায়। ততদিনে আমার মুগ্ধতা ওর চুল আর ভীষণরকম সুন্দর হাসি ছাড়িয়ে তার চেয়েও সুন্দর মানুষটাতে গিয়ে পৌঁছেছে। চোখের সামনে স্বর্ণকেশীর এনগেজমেন্টের ছবি ভাসে ওয়ালজুড়ে। আমিও বাকি সবার মত লাল টুকটুকে কংগ্রাচুলেশনস লিখে আসি সেখানে। ওর লাভ রিএক্ট আমাকে চুরমার করে দেয়। তবু কুল থাকি আমি। এ যুগের ছেলে আমি। চাইলেই এমন কত স্বর্ণকেশী পাওয়া যাবে। আর ও রঙ তো আসলও না। নিজেকে কত কি বোঝাই আমি। এর মাঝে একদিন নীরার একাউণ্ট খুঁজে পাইনা আর ফেসবুকে।
ওর নাম্বার ডায়াল করে বন্ধ পাই। দম আটকে আসে আমার। আরেকজনের হবু বউ সে, আমার সাথে ভদ্রতার খোলসে মোড়া কথাবার্তার বাইরে কাছে না আসা একটা মেয়ের জন্য বুকের ভেতরে ক্ষত হয়ে থাকে আমার! কাউন্টারের লোকটা আমার সাইন চাচ্ছে কি একটা কাগজে! আমি রোবটের মত সাইন করে, টাকা পে করে আমার কার্ড ফেরত নিয়ে পা বাড়াই। নীরাকে বাসায় নিয়ে যেতে আর কোন বাঁধা নেই। শুধু আজ থেকে নীরা থাকবে মাটির নিচের আলাদা বাসায়। আমার উপর রাগ করে মাঝে মাঝে বলত, ‘এমন করলে আমি কিন্তু হারিয়ে যাব ইয়ন!’ নীরাকে পেয়েও বারবার হারানোই হয়ত আমার নিয়তি।
নাহলে এতবার হারিয়ে যাকে নিজের করে পেয়েছিলাম সে কেমন করে আবার হারায় জীবন থেকে? ক্যান্সারটা আবার ফিরে না এলেও তো হত। আমাদের ইরাবতী, যার নাম নীরা রেখেছে পাঞ্জাবের কোন নদের নাম থেকে, যে কিনা দেখতে অবিকল তার মায়ের মত হয়েছে, সে কোনদিন জানতেও পারবে না তার মা থাকলে জীবনটা কেমন হত! আমার জীবনটাই বা কেমন হত? নীরাকে আগেও হারিয়েছি আমি। নীরাকে পাব না জেনেও ভালোবেসে ফেলেছিলাম বোকার মত। একটা কদিন পর বিয়ে হতে যাওয়া মেয়ের জন্য বুক ফাঁকা হয়ে থেকেছে আমার। তবু ওর জন্যে থাকা অনুভূতি বদলাতে পারিনি আমি। রোজ খুঁজতাম ফেসবুকে ও ফিরেছে কিনা! দিনের পর দিন অপেক্ষাই করেছি কেবল। নীরাকে পাইনি।
মাস ছয়েক পর আবার খুঁজে পেয়েছিলাম কার্জন হলের গেটের বাইরে। আবারো পেছন থেকে ওই চুল দেখেই হার্টবিট থেমে গিয়েছিল আমার! আমি ভেবেছিলাম ও আমি যে বাসে সেটায় উঠবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে ও হেঁটে যাচ্ছিল উল্টাদিকে। বাস ছেড়ে দিয়েছে। আমি দৌড়ে নেমে গেলাম সবাইকে ঠেলে। পাগলের মত নীরাকে ডাকতে ডাকতে ছুটছিলাম আমি। নীরা অবাক হয়ে পেছনে ফিরে আমাকে দেখে হাসল। সেই হাসি। আমি আবার ভেসে গেলাম ওর হাসিতে। কথা বলতে চাইলে বলল ওর বাবা গাড়িতে ওয়েট করছে। এতক্ষণে চোখে পড়ল সামনে পার্ক করা সাদা করলা এক্সিও থেকে একজন গম্ভীর মানুষ আমাদের দেখছে। বেহায়ার মত আমি জিজ্ঞেস করে বসলাম ওর বিয়েটা হয়ে গিয়েছে কিনা! এক পলকের জন্য বিষণ্ণ হয়েও আবার হাসল নীরা। বলল, নাহ। কারো মার খাওয়া পোষা প্রাণী হয়ে, জীবন কাটানোর যোগ্যতা নেই বলে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে!
ভীষণ স্বার্থপরের মত খুশি হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। সেটা চেপে শুধু বললাম, ফেসবুকে তো নেই, ফোনে কথা বলতে চাইলে সম্ভব? নীরা আমাকে জানালো সে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। কদিনের জন্য মায়া বাড়িয়ে লাভ নেই। আমি তবু মরিয়া হয়ে বললাম, ওইটুকু কষ্ট পেতে আমার আপত্তি নেই। নীরার বাবা তখন গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন। নীরা এক মুহূর্ত কি ভেবে বলল, আজ রাতে ফেসবুকে কথা হবে। কি কঠিন মেয়েরে বাবা! তাও নাম্বার দিল না। ফেসবুক তার ডিএক্টিভেট। কিসের কথা হবে? আমাকে অবাক করে দিয়ে কথা রাখল মেয়েটা। রাতে নক দিল আমাকে। মেসেঞ্জারে কথা হল সারা রাত। শুরুতে আমি কেন এত করে চাইছি ওর সাথে কথা বলতে, কোন লাভ হবে না, তার সবার উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে জানিয়ে নীরা আমাকে সাবধান করতে চাইল।
ও তো জানে না ওকে পাব না জেনেও ভালবাসতে থাকাকে আমি নিয়তি ধরে নিয়েছি। সেখানে ওর আশপাশে থাকতে পারাও শান্তির। নীরার এক্স তাকে বাজেভাবে এবিউজ করত শুনে মাথায় খুন চেপে যায় আমার! এমন একটা মেয়েকে কেউ কি করে কষ্ট দেয় বুঝতে না পেরে হু, হা করি আমি। নীরা ভাবে আমি বুঝি এসব শুনে কথা বলার আগ্রহ হারিয়েছি! কি করে বোঝাই ওকে সারা পৃথিবীর সব সুখ এনে দিয়ে ওর হাসিমুখ দেখতে কি অস্থির লাগছে আমার! সারারাত গল্পের শেষে ফেসবুক থেকে আবার হারিয়ে যাবে জানিয়ে কল কাটতে চাইলে আমি আবারো নাম্বার চাই। ওকে প্রথম কথা হবার দিন দেয়া টিস্যুর সাথে আমার লাজলজ্জাও চলে গিয়েছিল হয়তো! ভাগ্যিস গিয়েছিল!
নীরাকে শেষ দেখার সময়ও মুগ্ধতা কাটলোনা আমার। লোকে অনেককে দেবীমূর্তির মত সুন্দর বলে। নীরার সৌন্দর্য মোটেই অমন অলৌকিক না, অথচ অপার্থিব। ঠিক ওর নামের মতই। নীর থেকে নাম হওয়া আমার নীরার রূপ কখনও বয়ে চলা ঝর্নার মত, কখনও সাগর,কখনো আবার বরফকঠিন। সব রূপেই তাকে দেখে মুগ্ধ হই আমি। নীরাকে ভালোবাসা সহজ ছিল না কিন্তু প্রতিটা দিন ওকে ভালোবাসতে পেরে নিজেকে নিয়ে গর্ব হত আমার। একটা বাজে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে আমাকে ভালবাসতে শুরু করা মোটেই সহজ ছিল না নীরার জন্য। রোজ ওকে একটু করে পড়তাম আমি। শিখতাম ওর পাশে থাকার জন্য আরেকটু ভালো মানুষ হওয়া। একটা মেয়ে কিভাবে প্রতিটা পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করে হলেও মাথা উচু করে বাঁচার চেষ্টা করে যায় সেটা নীরাকে দেখে শিখেছি আমি।
ভালোবাসলে সেটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য নীরার যুদ্ধ দেখে আমি মনে মনে তার প্রাক্তনকে থ্যাংকস দিয়েছি। ওই পশুটা যদি মানুষ হত, নীরার আকাশসমান ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হত না। ফ্যামিলির সবাইকে মানিয়ে বিয়েটা করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাদের। এদেশে বয়সে মাত্র এক বছরের বড় একটা মেয়ে আর অল্প বেতনের মাত্র চাকরি পাওয়া জুনিয়র একটা ছেলে বিয়ে করতে গেলে যে কত ঝক্কি পোহাতে চায় দেখে আমি অবাক হয়েছি। কি শক্ত করে যে তখন আমার হাত ধরেছিল নীরা!ওর একটাই চাওয়া ছিল আমার কাছে। ওকে যেন কখনো ভালবাসার অভাবে পড়তে না হয়। আমি কথা রেখেছি। ওর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ডুবিয়ে রেখেছি ভালোবাসায়।
ইরার স্কুলের প্রথম দিন আজকে। মেয়েটাকে ঘুম থেকে তুলে নাস্তা খাইয়ে নিজ হাতে রেডি করলাম আমি। কাল রাত ২টা অব্দি ইউটিউব ভিডিও দেখেছি কিভাবে চুল বেণী করতে হয় শিখব বলে। ইরার সোনালি চুলে এখন সেটা প্রয়োগ করতে গিয়ে বুঝলাম নীরা কেন বেণী করতে চাইত না! কাজটা মোটেই সহজ না। তবু পেঁচিয়ে কোনমতে রাবার ব্যান্ড আটকে আমার মেয়ের স্কুল ড্রেস পরা মুখ দেখে আমার বুকে ধাক্কার মত লাগল। মেয়েটার চেহারায় নীরা এত তীব্রভাবে আছে! এইযে বেণীর ফাঁকে বেরিয়ে পড়া নিজের একটা চুল ধরে খিলখিলিয়ে হাসা ইরা, এ তো অবিকল নীরার হাসি! আমার ভুল দেখে ঠিক এভাবে হাসত নীরা। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে হাসিতে যোগ দিলাম। মেয়েকে আজ আমি কোনভাবে আমার চোখের জল দেখাব না।
আমার মেয়ে তার মায়ের মত শক্ত হবে। যদ্দিন আমার কাছে থাকবে, আমি তার চুলে সোনালি রঙ লাগিয়ে দিয়ে তার মায়ের কথা ভাবব। ঠিক তার মায়ের মত করেই তাকে ভালোবাসব। প্রথম কদিন মায়ের জন্য ছটফট করলেও এখন কাউকে কিছু বুঝতে দেয়না আমার মেয়েটা! আমার বুকে চেপে ধরা ইরা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেও বাবাকে তার কান্না দেখাবে না। আমার মনে হল আমি নীরাকে জড়িয়ে ধরে আছি। বিয়ের পর যখন প্রথম বাবার বাড়ি থেকে এলো, ঠিক এভাবে কাঁদছিল নীরা! আমি ওকে কতভাবে হাসানোর চেষ্টা করছিলাম। বলছিলাম, ‘এই যে স্বর্ণকেশী, খুব স্ট্রং ভাবতাম তো তোমাকে! এত কাঁদে স্ট্রং মেয়েরা?’ ভালোবাসার মানুষেরা আসলে কখনও হারিয়ে যায় না। কত রূপে, কত রঙে বারবার চারপাশে আনাগোনা করে!
আমি মেয়ের চোখ মুছিয়ে কপালে চুমু খেয়ে ভেজা চোখেই হাসি। আমি তো একজন সিঙ্গেল ফাদার। আমার চোখে তো এত পানি মানাচ্ছে না! কিন্তু নীরাবিহীন জীবনও তো এই পৃথিবীতে মানাচ্ছে না! আমরা বাবা-মেয়েতে নাহয় আজকে ভেজা চোখেই স্কুলে যাব। কারণ আমরা এই পৃথিবীর সবচেয়ে স্ট্রং একজনের কাছ থেকে শিখেছি যে কান্না কোন দুর্বলতা না! শুধু কান্নার পর চোখ মুছে উঠে দাঁড়াতে জানতে পারলেই জিতে যাওয়া যায়! আমাদের তো নীরার জন্য জিততে হবে।