নিজের সন্তান ভেবে মেয়েটি শিশুটিকে স্তন পান করাত । কিন্তু এই খবরটি তার গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রী কেউ জানতো না । মাত্র তিন মাস আগে নিজের সদ্যজাত সন্তান হারিয়ে এই শিশুটিকেই সে যেন নিজের সন্তান ভেবে নিয়েছে । স্বামী, স্ত্রী যখন অফিসে চলে যেত সমস্ত ভালোবাসা উপচে পরত শিশুটির উপর । সমস্ত ধ্যান জ্ঞান যেন শিশুকে ঘিরে । মাঝে মাঝে সে ভুলে যেত শিশুটি তার কেউ নয়, সে এ বাড়ির কাজের মেয়ে মাত্র । শিশুটি যখন রাত্রে কান্না করতো, যখন তার মা বাবা কান্না থামাতে পারত না তখন ডাক পরতো আছিয়ার । সে কুলে নেওয়ার সাথে সাথে কান্না থেমে যেত । এ যেন যাদুর হাতের পরশ । ছোট্ট শিশুটিও জানে সে কার কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পায় । এখানে ধর্ম, গোত্র, বর্ণ ভালোবাসার মাপ কাঠি হয়ে দাঁড়ায় না ।
মাত্র চার মাস বয়স থেকেই শিশুটির ঘর আলাদা । একটি দোলনাতে তার অবস্থান আর কাজের মেয়ে আছিয়ার অবস্থান সেই ঘরের মেজেতে । যেদিন শিশুটি কে তার মা বাবা পৃথক করে দিল সেদিন আছিয়ার খুব আনন্দ হয়েছিল। দিনের বেলায় শিশুটি সে কাছে পায় কিন্তু রাতে তার বুকটা খা খা করে । কখন বাবুটা কাঁদবে কখন তাকে ডাকবে এই ভেবে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমাত না সে । এখন যদিও বাবুটার মা দোলনা দিয়েছে কিন্তু দোলনাতে সে ঘুমায় না ঘুমায় আছিয়ার বুকে ।
শিশুটি আস্তে আস্তে বড় হয় এবং ভালোবাসার প্রতিদান হিসেবে আছিয়াকেই মা ডাকতে শুরু করে কিন্তু কোন মাই তার নিজ সন্তান কাজের মেয়েকে মা ডাকুক এটা চাইবে না । যখন আছিয়া দেখলো এই জিনিসটা নিয়ে মেম সাহেব বড়ই বিচলিত তখন আছিয়া নিজ খেকেই তাকে খালা মনি ডাকতে শেখাল আর শেখাল আমি তোমার মা নই মা তোমার ঐ সুন্দর মহিলা । কিন্তু শিশুটি মা এবং খালা মনির শব্দের অর্থ না বুঝলেও এটা ভালো ভাবেই বুঝেছিল খালা মনি নামের মানুষটার কাছ থেকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পায় ।
আছিয়ার মাঝে গ্রাম্য ভাব থাকলেও, সামান্য পড়া লেখা জানায় তার কথাবার্তায় গ্রাম্য ভাব ছিল না । যার কারনে শিশুটির উপর এর কোন প্রভাব পরেনি । তার ভাইয়েরা তাকে অনেক বার বলেছে আছিয়া তুই চলে আয় আর কত দিন তুই আর অন্যের বাড়ি পরে থাকবি । তোর বয়স তো আর ফুরিয়ে যায়নি তোকে আবার অন্য জায়গায় বিয়ে দিব । কিন্তু আছিয়া একটি মাত্র শিশুর জন্য নিজের সুখটুকু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে । একটি বারের জন্যও তার মনে হয়নি শিশুটি তার সন্তান নয় । শিশুটির মা বাবা কেউ না জানলেও সেতো জানে তার বুকের স্তন পান করিয়ে সে শিশুটি কে বড় করেছে । আরেক জন সাক্ষী হয়তো আছে কিন্তু তাকে অনুনয় বিনয় করে কাউকে বলতে বারণ করেছে ।
আজ শিশুটির সপ্তম জন্ম বার্ষিকী । সমস্ত আয়োজন শেষে শিশুটি যখন কেক কেটে নিজের মাকে খাইয়ে দিচ্ছিল এমন সময় সে দেখলো দরজার আড়াল থেকে খালা মনি তার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে । প্রথম কেক টুকু মাকে খাওয়ানোর পরেই আরেক টুকরা কেক নিয়ে দৌড়ে গেল খালা মনির দিকে । সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলো কাজের মেয়ের মুখে কেক তুলে দিচ্ছে বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর সন্তান । এই জিনিসটা কারো কাছেই ভালো লাগলো না বিশেষ করে ভালো লাগলো না শিশুটির মায়ের ।
এই সমাজে যখন ভালোবাসা সম্পর্কের বাইরে চলে যায় সেই ভালোবাসা গুলো কেউ মেনে নিতে পারে না । তেমনি মেনে নিতে পারেনি শিশুটির মা । এর শাস্তি স্বরূপ, সমস্ত ভালোবাসা, মায়া মমতা কে তুচ্ছ জ্ঞান করে আছিয়াকে বিদায় দেওয়া হলো । আছিয়া যেতে চায়নি আছিয়া গেটের বাইরে সারাদিন বসেছিল । আঝোর ধারায় কেঁদেছিল । কিন্তু কেউ কান্নার মর্মার্থ বুঝেনি । শুধু বুঝেছিল শিশুটি । সে তার খালা মনির কাছে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি কারন সে ছিল চার দেয়ালে বন্দি । সেদিন শিশুটির কান্নার দামও কেউ দেয়নি ।
আজ অনেক বছর হয়ে গেছে । ছোট্ট শিশুটি এখন দেশের নামকরা ডাক্তার কিছুদিন আগে তার মা স্ট্রোক করে মারা গেছেন । সে ডাক্তার হয়েও বাঁচাতে পারেনি তার মাকে । মায়ের প্রতি তার ভালোবাসা থাকলেও অন্য একটি কালো মুখ তার বারবার মনে পড়ে ইদানিং। স্বপ্নেরও সেই কালো মুখটা এসে ধরা দেয় । সে মেয়েটি তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিত, গোসল করাতো, থুতনিতে ধরে মাথা আচঁড়িয়ে দিত । স্কুলে আনা নেওয়া করতো । চুমোতে চুমোতে ভরিয়ে দিত তার ছোট্ট গাল । সেই মধুর স্মৃতি গুলো আজও তার পিছু ছাড়েনি ।
বুড়ো দারোয়ান চাচার কাছে আজ সকালে সেই আছিয়া খালা মনির কথা জিজ্ঞেস করতেই বেড়িয়ে আসলো আরো অনেক অজানা তথ্য । জন্ম দিয়ে তার মা কর্ম উদ্ধার করেছে । কিন্তু তিলে তিলে তাকে বড় করে তুলেছিল আছিয়া নামের সেই মেয়েটি । শুধু বড় করাই নয় । তার রক্তে মাংসে মিশে আছে সেই মেয়েটির স্তনের তরল । দারোয়ান চাচার কাছে আরো জেনেছে তার খালা মনির এক লোকের সাথে দ্বিতীয় বিয়ে হয়েছিলো । সেই স্বামীটাও মরে গেছে । তাদের ঘরে কোন সন্তানাদী হয়নি । সে এখন মোটেও ভালো নেই । অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে কোন এক নির্জন কুটিরে। একটি ছেলে আছিয়ার শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে । ছেলেটি কে সে চিনতে পারছে না । কিন্তু ছেলেকে কেমন যেন খুব আপন মনে হচ্ছে । ছেলেটি তার দিকে কেমন যেন বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে । ছেলেটি হঠাৎ করে বলে উঠলো ।
— খালা মনি কেমন আছ ?
আছিয়া চমকে উঠে। ছেলেটি কে এখন আর চিনতে অসুবিধা হয়না । কারন পুরো পৃথিবীতে একটি মাত্র মানুষ আছে তাকে যে খালা-মনি বলে ডাকে । আছিয়া কোন কথা বলছে না । ইশারায় ছেলেটি কে কাছে ডেকে নেয় । খুব তৃষ্ণায় জড়িয়ে ধরে ছেলেটি কে । অনেক দিনের দুঃখ কষ্ট গুলো অঝোর ধারায় ঝরে পরে আছিয়ার চোখ বেয়ে । এ কান্না প্রাপ্তির এ কান্না আনন্দের । এ কান্না ভালোবাসার । এখানে কোন সম্পর্কের বাঁধা নেই, নেই কোন রক্তের ভিন্নতা । আছে মানবতা, আছে ভালোবাসার প্রতিদান ।