বিয়ের জন্যে পাত্রী খুঁজতে গেলে আমার দাবি ছিল একটাই, মেয়ের কাচ্চি বিরিয়ানি রাঁধতে জানতে হবে।যেমন তেমন রান্না নয়। খাসির লেগ পিস মুখে দেওয়া মাত্র মাখনের মত গলে যাবে। পোলাওয়ের সাথে আলুর টুকরো মেখে মুখে দেওয়া মাত্র আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে যাবে। আহা! সারা বাড়ি অমৃতের গন্ধ ভেসে যাচ্ছে। স্বয়ং দৌপদ্রী যেন আমার হেঁসেলে রান্না বসিয়েছেন। দুঃখজনক ব্যাপার হল, গত দুই বছর ধরে ঘুরেও আমি একটা কন্যার সন্ধান পেলাম না যে ভালো রাঁধতে জানে। মেয়ে চোখ-নাক-কান সবই ঠিকঠাক। চার চারটে ডিগ্রী নিয়ে বসে আছে। জিজ্ঞেস করি,
-রান্না জানেন?
-জ্বী।
-কি কি পারেন?
২৩ বছরের মেয়ে ন্যাকা সুরে উত্তর দেয়,
-ডিম ভাজা আর ডিম সিদ্ধ। পিছন থেকে মেয়ের মা গদগদ হয়ে জবাব দেয়,
-আসলে গায়ের রঙ কালো হয়ে যাবে তাই কোনোদিন রান্নাঘরে ঢুকতে দেই নাই তবে বিয়ের পর সব শিখে নিবে।
ভদ্রমহিলাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে ইচ্ছা করছিল, আমার মা গত ৩০ বছর ধরে একান্নবর্তী পরিবারের রান্না করছেন গায়ের রঙ এখনও টকটকে ফর্সা। সে যাই হোক পাত্রী দেখতে গিয়ে নানানরকম অভিজ্ঞতা হল অধিকাংশ মেয়ের দৌঁড় ডিমের তরকারি পর্যন্ত। হায়রে! মেসে ছয় বছর পাড় করলাম ডিমের সাথে পেঁয়াজি কাঁচামরিচ ঘণ্ট করে। বিয়ের পর যদি ব্যাচেলর লাইফ পালন করতে হয় তবে বিয়ে করে লাভ কি!
বন্ধুরা বুদ্ধি দেয়, দেখ ভাই বিয়ের পর সব মেয়েরাই মাছের ঝোল, মসুর ডাল রান্না শিখে নেয়। তোর অযথা ফ্যাকড়া ধরে লাভ নাই। তিন মাস খালাম্মার কাছে ট্রেনিং নিবে সব শিখে যাবে। তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, আমার আম্মা চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা থেকে শুরু করে খাসির রেজালা সবকিছু দারুণ রাঁধেন৷ কিন্তু এখনও কাচ্চি রাঁধতে পারেন না। কাচ্চি রান্না একটা শিল্প যা সবাইকে দিয়ে হয় না। আরেকদল বন্ধু আছে যারা আমার পেটে খোঁচা মেরে বলে,
-শালা, তোর ভুড়ি দেখলে মনে হয় সাত মাসের পোয়াতি। আবার কাচ্চি কাচ্চি করস।
-দুঃখিত। তোমরা যারা গাজর,টমেটো খেয়ে ডায়েট করো আমি সেই দলের নই। সাত বছর ধরে পরিবারের কাছ থেকে দূরে থেকে আলু সেদ্ধ আর ডিম ভাজা খেয়ে বেঁচে আছি, ২০ বছর পড়াশোনা করে সরকারি চাকুরি জুটিয়েছি কি না খেয়ে বেঁচে থাকার জন্যে? সরি ভাই। আমার দ্বারা এতবড় ত্যাগ সম্ভব না।সারা সপ্তাহ অফিস করবার পর উইকেন্ড কব্জি ডুবিয়ে ভালো-মন্দ খাব, দুপুরে ভাতঘুম,বিকেলে বউকে নিয়ে ঘোরাঘুরি এইতো জীবন।
রেস্টুরেন্টে বসে পিৎজা,বার্গার, ফ্রাইড রাইস খেয়ে আমার পোষায় না।মায়ের হাতে বেগুন ভাজা, কড়কড়ে ভাজা কৈমাছ আর এক চা চামচ ঘি হলে আর কিছু চাই না। শৈশবে বাবা-মায়ের ম্যারিজ ডে,ভাই-বোনের জন্মদিন যেকোন পারিবারিক অনুষ্ঠানে মা বিরিয়ানি রাঁধতেন।। স্কুল থেকে ফিরলে সুগন্ধি চাউলের মৌ মৌ গন্ধে মন ভরে উঠত। বুঝতাম সুসংবাদ আছে তাই মা বিরিয়ানি রাঁধছেন। সেই থেকে বিরিয়ানি আমার প্রিয় খাবার। ভার্সিটি কোচিং করতে ঢাকা এলাম। আমার শহুরে জীবন শুরু কিন্তু বিরিয়ানির প্রতি ফ্যান্টাসি কমল না। দুদিন উপোস করে মিলের টাকা বাঁচিয়ে শুক্রবারে ঢু মারি। হাজীর বিরিয়ানি, নান্নার বিরিয়ানি, হানিফের বিরিয়ানি তামাম দুনিয়ার মোগলাই খাবারের স্বাদ নেওয়া হয়ে গেছে। জব হবার পরও কোথাও ভালো কাচ্চির রিভিউ পেলে ভুড়িটাকে অগ্রাহ্য করে ছুটে যাই। দুই গ্লাস ফ্রেশ বোরহানি আর পেল্লাই সাইজের এক প্লেট সুস্বাদু কাচ্চি আমার আর কিছু চাই না। যা বলছিলাম ওজন, ভুড়ি এইসব ছোটখাটো ব্যাপার আমলে নেই না। সমস্যা হচ্ছে ইদানীং গ্যাস্ট্রিকের ব্যথায় সারারাত চি চি করি। বেআক্কেল ডাক্তার বলে দিয়েছেন,
-তৈলাক্ত খাবার একেবারে বন্ধ নয়ত মেডিসিন কাজ করবে না। ভেবেছি বউকে বলব কাচ্চিতে তেল না ঢেলে ঘি ঢালতে। কিন্তু কপালে বউ জুটছে না। লোকের কত চাহিদা থাকে শরৎচন্দ্রের নায়িকার মত কন্যার দীঘল কালো চুল, ডাগর চোখ থাকতে হবে। কেউ বা আবার শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে একগাদা পণ দাবি করে।আমার কাছে আল্লাহপাকের সৃষ্টি সব মানুষই সুন্দর। নিজের না আছে গুণ না রুপ, গায়ের গন্ধে ভূত পালায়। সরস্বতীর মত সর্বগুণসম্পন্না স্ত্রীর আশা করব কোন ছলে! খালি কাচ্চি রান্নায় পারদর্শী হলেই চলবে।
আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব আরো কিছু পাত্রীর সন্ধান নিয়ে আসে। অধিকাংশজন আমার অদ্ভুত ইচ্ছার কথা শুনে আগেই রিজেক্ট করে দেন৷ আমিও পাত্রী দেখতে গিয়ে হতাশ হই। কয়েকজন বলল, তারা ইউটিউব দেখে চিকেন ফ্রাই, পাস্তা, ইতালিয়ান রান্না করতে পারে৷ কাচ্চি খাবার জন্যে তো পুরান ঢাকা আছে কষ্ট করে রান্না শেখা কি দরকার! আরেকজনের সবকিছুই বেশ পছন্দ হল। স্কুল পড়ান, কাচ্চিও রাঁধতে জানেন। তিনি বললেন, সারা সপ্তাহ বাচ্চা ঠেঙিয়ে ছুটির দিনে বিরিয়ানির ঝামেলা করতে পারবেন না। ভাত-মাছ হলে ঠিক আছে। অকাট্য যুক্তি তার সোজাসাপ্টা কথাও বেশ ভালো লাগল। কিন্তু ওই যে, আমার কাচ্চি চাই তাই বিয়ের ফুল ফুটল না। আরো একবার পাড় হল। মা আমার বিয়ের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। আমিও পাত্রী দেখার ঝামেলাতে যাই না। সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন কোনো মেয়ের সাথে পরিচয় হলে টুপ করে প্রশ্ন করি,
-রান্না জানেন?
-রান্না! আম্মু বলে আমি একগ্লাস পানি ঢেলেও খেতে পারি না।
এইধরনের ন্যাকা মেয়েদের সযত্নে এড়িয়ে যাই। পণ করেছি হোটেলের কাচ্চি খেয়ে আলসার হয়ে মরব তবু রাঁধুনি বউ ছাড়া বিয়ে করব না। এরমাঝে একদিন ছোট মামার কল। উনি নাকি ভাগ্নের জন্যে পছন্দমত মেয়ে যোগাড় করে ফেলেছেন৷ দেখতে সুন্দরী আর কাচ্চি ফাচ্চি রান্না এরকাছে দুই মিনিটের মামলা। মামার পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়ে কুমিল্লা গেলাম। মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম,
-নাম কি?
-মেহনাজ।
-বাহ! চমৎকার নাম!
-আপনার হবি কি?
-জ্বী!মেয়ে মুচকি হেসে জবাব দেয়,
-রান্না করা।
খুশিতে আত্মহারা হয়ে ইচ্ছা করছিল তখনি কাজী ডেকে বিয়ে সেরে ফেলি। নাহ! মুরব্বিদের কথা মতন আমার আরো এক মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল। এরমাঝে তিনদিন ওর সাথে কুমিল্লা গিয়ে দেখা করে এসেছিলাম।কালো বোরকা আপাদমস্তক ঢাকা কিন্তু হাতের নীল রঙের টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি কাচ্চির গন্ধ জানিয়ে দিত এই মেয়েটা শুধুই আমার।
বিরিয়ানি যে কত প্রকার হয় তা জেনেছি মেহনাজের সাথে বিয়ে হবার পর। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি, লখনৌ বিরিয়ানি, সিন্ধি বিরিয়ানি আরো কত বাহারি নাম। এক এক সময় এক এক রেসিপি ট্রাই করে।ধোঁয়া উঠা বিরিয়ানিতে আমি তো দূরে থাক একটা মাছিও বসতে দেয়। প্রথমে ইউটিউবে ওর রান্নার ভিডিও শেয়ার করে।সেখানে ভিউয়ার সংখ্যা দশ হাজার ছুঁই ছুঁই হলে ও ফ্রীজ থেকে বের করে ফেসবুকে বিরিয়ানির ছবি পোস্ট করে। সেখানে লাইক,কমেন্টের ঝড় শেষ হলে আবার ফ্রীজে তুলে রাখে।তারপর ইনস্টাগ্রাম, টাইমলাইন, মাইডে পর্ব হলে শেষ লক্ষী বউর মত প্রশ্ন করে,
-ওগো শুনছ? কাচ্চি খাবে? গরম করে দেই?