রাতপরী ও অপূর্ণতা

রাতপরী ও অপূর্ণতা

চাকরি! সেতো আজকাল সোনার হরিণ। হেন জায়গা নেই সিভি জমা দেইনি। অনেক ইন্টার্ভিউ দিয়েছি। কোথাও থেকে ডাক আসেনি। কারো দয়া হয়নি। একদিন সব ঠিক হয়ে গেল রিটেনে পাশ করলাম। ভাইবায় কোথাও আঁটকায়নি। একজন বড় কর্তা বললেন। ‘ আপনি আমার পিএ’র সাথে কথা বলুন। আমরা আপনাকে সিলেক্ট করেছি।’ আমি পি এর কাছে গেলাম। উনি চশমার ফাঁক দিয়ে আমায় খানিকক্ষণ দেখলেন। তারপর বললেন ‘পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে পরশু এখানে আসবেন। আমি হাতে হাতে জয়েনিং লেটার দিয়ে দেবো।’

আমি হাসলাম। আমি মনে হয় একমাত্র মানুষ যে জীবনে একলাখ টাকা একসাথে দেখিনি। সে দেবে পাঁচ লাখ টাকা ! ভুল বললাম, না দেখেছি একবার। এক ব্যাংকে শুটকো মতো একটা লোক কী একটা মেশিনে টাকা দিচ্ছিলো। আর টাকা গুলো ডালের ফোঁড়নের মতো শব্দ করে গোনা হয়ে যাচ্ছিলো। বাবার তার পেনশনের টাকা দিয়ে বাড়ি করেছেন। আমার পড়া শেষ করিয়েছেন। বোনেদের বিয়ের দেনা মিটিয়ে দাদাভাই কে চাকরি নিয়ে দিয়েছেন। আর কতো ! সেদিন আমি বাড়িতেই ছিলাম। কেন জানি দুঃসংবাদ গুলো দুপুরের ঘুম ভাঙার পড়েই পাওয়া যায়। আব্বা আমায় ডাকছিলেন।

– ছোটন শুনলি ! রাস্তার শেষ মাথায় যে বাড়িটা

সেই বাড়ির মেয়ে, তিথি না কি যেনো নাম। ট্রাক চাপা পড়ে মরে গেছে। আহা মা’টা বড্ড কাঁদছে।’ আমি কিছু বলিনা। চুপচাপ শুণ্যের দিকে চেয়ে থাকি। মা আর তিথি মিলে আমার হাসি আর কথাগুলো আঁচলে বেঁধে নিয়ে গেছে। কোথায়! কোন সুদূর দেশে! কে জানে ! আমি একটা বেঞ্চ খুঁজে নিয়ে বসে পড়ি। একজন মেয়ে এগিয়ে আসে, সেই বুঝি রুমানা ! কি মায়াবী মুখ। কোলে একটা ছোট বাচ্চা।

— ভাইজান। আমার বাচ্চাটার খুব জ্বর। বাড়িতে দেহার কেউ নাই। আপনে একটু দেখবেন। আইজ রাইতে ইনকাম না হইলে বাচ্চাটার ওষুদ কিনতে পারুম না। আমি মাথা নাড়ি। ছোট্ট তুলতুলে একটা বাচ্চা। আমি বাচ্চাটার গায়ে হাত রাখি।

তিথির খুব বাচ্চার শখ ছিল বাচ্চার। হাত নেড়ে নেড়ে ও নিজের ভবিষ্যৎ বাচ্চার গল্প করতো। হাতের তালুতে গাল রেখে কথা বলতো তিথি। আমার কাছে অদ্ভুত লাগতো। পানি খাচ্ছে আর গুটগুট করে কথা বলছে। পানি খাওয়াটা ছিলো ওর বিশ্রাম। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম । আজ রাতটা এতো দীর্ঘ কেন? সময় যাচ্ছেই না। শিশুটি অল্প কাঁপছে, জ্বরে হয়তো বা ঘুম ঘোরে। একসময় হাত ইশারায় রুমানা’কে ডেকে বলি বাচ্চাটা নিয়ে যেতে। পকেটে যা ছিল দিয়ে, বলে দেই ওষুধ কিনে দিতে। মেয়েটির চোখের জলে আমি বড় আপাকে দেখতে পাই। বিদেশে কোন সুদূরে আমার মমতাময়ী বড় আপা কেমন আছে কে জানে ! যাবার সময় মেয়েটি আমার গায়ে হাত রেখে বলে।

– ও ভাইজান আপনিও বাড়িত যান। আপনার মনে হয় শরীর খারাপ। আমি লাল চোখে তাকিয়ে থাকি । আশেপাশে মনে হয় কেউ আবীর খেলেছে। সব কিছু লাল মনে হয়। খুব ভোরে কে যেনো গায়ে ধাক্কা দেয়।

— এইযে শুনছেন। আপনিতো মনে হচ্ছে খুব অসুস্থ। বাসায় যান প্লিজ।

– বাসায় !

— হ্যা বাসায়। হাঁটতে পারবেন। নিন আমার হাত ধরুন।

– তুমি কে তিথি !

– না আমি তিথি না। আমার নাম মৌমিতা।

– ও মৌমিতা। আমি সাবধানে চোখ খুলি।

গালে পাউডার ঠোঁটে লিপস্টিক ছাড়া সাধারণ একটি মেয়ে, এমন জায়গায় এটা বিরল। মনে হয় শখ করে শাড়ি পরেছে। পড়ার ভঙ্গিটা কেমন এলোমেলো।

– শুনুন আমি চা আনছি। আপনি চা খান। আর বাসায় যান। আমি লাল চোখে তাকিয়ে থাকি, ‘কে কথা বলে কে!’

আমি রিক্সা ডেকে এনেছি। ঠিকানা বলতে,পারবেন ! আমি রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে দিচ্ছি। আমার হাতে
একটা প্লাস্টিকের কাপ ধরিয়ে দিয়ে মেয়েটি বলে। খালি পেটে চা। আমার পেট গুলিয়ে ওঠে। আমি কোনমতে টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াই। রিক্সাওয়ালা প্রায় টেনে আমায় রিক্সায় তোলে। বাসায় এসে দেখি আব্বা ভীত মুখে আমার পথ চেয়ে বসে আছেন।

— ছোটন এলি। কাল বাড়ি ফিরিসনি কেন! বৌমা আর বাবাই কক্সবাজার গেছে। কাজের লোকটাও নেই। আমি অবাক হয়ে বলি।

— তার মানে আপনি কিছু খাননি । তাইনা !

আব্বা বিড়বিড় করে কিছু একটা বলেন । হয়তো মৃতা স্ত্রীর কথা মনে করে খানিকটা কাঁদেন। আমি অবাক হয়ে যাই, মানুষের নিষ্ঠুরতা দেখে। আস্তে আস্তে রান্নাঘরে ঢুকি। কোনমতে বাবাকে একটু চাল ডাল ফুঁটিয়ে দিতে হবে। আহা বয়স্ক মানুষটা রান্নার অভাবে না খেয়ে আছে।

টলে পড়ে যেতে যেতে আমি দেয়ালের তাক’টা ধরে ফেলি। চাল কই! কিছু আলু বেগুন ! একটু সামান্য সব্জীও না হলে আব্বা খাবেন কী ! ওরাতো বরাবরই ফ্রিজ লক করে বাইরে যায়। আমি হন্যে হয়ে সব খুঁজতে থাকি। পাগলের মতো এ কৌটা সে কৌটা। হঠাৎ মাথাটা ঘুড়ে ওঠে। পৃথিবী আবার আবির রাঙা হয়ে যায়। আমি ধুপ করে নিচে পড়ে যাই। আমি স্বপ্নের অতলে তলিয়ে যাই। স্বপ্নগুলো সব বারে বারে ঘুরে ফিরে চোখের সামনে আসে। আসে তিথি। আসে আম্মা। আম্মা সেই মশলার গন্ধ মাখা হাত দিয়ে আমার কপালে হাত বুলিয়ে দেন। আর গল্প করেন।

– ও ছোটন সিলেটে নাকি কমলা বাগান আছে। সত্যি নাকি। আমায় নিয়ে যাবি একবার ! মা ছেলে মিলে খুব ঘুরবো।

– তারচেয়ে চলুন সীতাকুণ্ড যাই। চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে দূরের সমুদ্র দেখা যায়। যাবেন আম্মা!

আম্মা হাসেন । আম্মা যেন এক ছোট্ট মেয়ে। আমার মতো বুড়ো ছেলের কথায় খুব মজা পেয়েছেন। আমার ঘুম ভাঙে বা জ্ঞান ফেরে ঝকঝকে এক সকালে। পুরো ঘর জুড়ে একটা মিষ্টি গন্ধ। এমন একটি অদ্ভুত সুন্দর সকালে একা থাকতে ইচ্ছে করেনা। আমার চোখ মেলা দেখে বাবা হাসেন। মানুষের হাসির চেয়ে সুন্দর আর পবিত্র কী হতে পারে আমার জানা নেই। বাবার হাসির সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে রোদ ঝলমল করে উঠলো।

বাবা আমাকে বললেন। দুদিন কী ভোগাটাই না ভুগলি ছোটন। নে এখন উঠে মুখ হাত ধুয়ে কিছু খা। আর এই নে তোর দুটো চিঠি আছে। ঘড় বাড়ি এতো পরিস্কার, বিছানায় ধবধবে ধোয়া চাদর। আমি বলি ‘বাবা এসব কী ! মনে হচ্ছে মায়ের সংসারে ফিরে গেছি আমরা ! ‘ বাবা হেসে বলেন – ‘ মা “ই তো । তবে তোর না আমার। তোর বন্ধু শাওনের বোন মৌমিতা এসেছিলো।’ ওই তো ঘর পরিস্কার করে , খাবার রান্না করে দিয়ে গেছে। ডাক্তার ডাকা ওষুধ কেনা সব একা হাতে সামলেছে। আমি কী আর এতো পারি! আমি অবাক হয়ে দেখি বাবার চোখের কোণায় ছোট ছোট আনন্দ ঝিকমিক করছে।

‘ শাওন তোর খুব ভাল বন্ধু বুঝি ! কী ভালো মেয়েরে ছোটন । আহা মেয়েটির ভাল হোক। ‘ আমি কিছু না বলে খাম খুলি। চিঠিটা পড়তে গিয়ে আমার হাঁত কাঁপতে থাকে। সিলেট বাংলাদেশ ফিনলে কোম্পানি আমাকে এক্সুইটিভ অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। আমি যেনো অতিসত্বর তাদের সিলেট অফিসে জয়েন করি। বেতন, ভাতা , ফ্রি ফার্নিসড কোয়ার্টার , নিচে সব বর্ণনা দেয়া আছে। আমি আর একটি চিঠি খুলি। গোটা গোটা হাতে লেখা কোমল একটা চিঠি।

” প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি বিনা অনুমতিতে আপনার বাসায় এসেছিলাম বলে। কিন্তু এছাড়া আর উপায় ছিল না। দূর থেকে দেখলাম, আপনি রিক্সা থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন। তাই আপনার পিছুপিছু আসি । আপনি বাসায় এসেই জ্ঞান হারান। বাবা খুব কাঁদছিলেন। পাপ হাতে আপনার মতো পবিত্র মানুষ’কে ছুঁয়েছি। এর জন্য ক্ষমা চাইছিনা। যত খুশি অভিশাপ দেবেন। তবে একটা অনুরোধ। বাবাকে বলেছি আপনি আমার ভাই শাওনের বন্ধু। আপনার খোঁজ নিতে আমায় পাঠিয়েছে শাওন ভাইয়া।

আমার সত্যি পরিচয়টা বাবাকে বলে দিয়ে তাকে আর কষ্ট দেবেন না। আসলে ঘর আশ্রয় কেমন জিনিস তা ভুলে গিয়েছিলাম। বাবা যখন আমায় মা বলে ডাকলেন। তার মেয়ে হবার লোভ সামলাতে পারিনি। জানি ক্ষমা পাবো না, তবু বলছি ‘ক্ষমা করবেন।’পার্কের যেখানে প্রতিরাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষণিক আনন্দলোভী মানুষদের’কে খুঁজে বেড়াতাম। আজ সেখান থেকে চলে গেলাম।

যদি আবার আপনাকে দেখি। আবার লোভের সাপের ছোবল খেয়ে আপনার সামনে দাঁড়াই। আপনার সাথে আমার সামান্য পরিচয়। সেই অল্প কিছু মুহূর্ত আপনার মনে কোন অবস্থাতেই যেন ছাপ না ফেলে, সেই প্রার্থনা করি। সেই পাপ আরো বড় পাপ হবে। বিধাতাও হয়তো আমার এই ভুল ক্ষমা করবেন না। ভাল থাকবেন। ইতি মৌমিতা। রাত বাড়ে আবার সেই বিশাল অজগরের মতো ঠাণ্ডা বিষণ্ণ রাত । আমি দুটো চিঠিই ছিঁড়ে ফেলে আবার রাস্তায় নামি। আমার আর এসবের কোন প্রয়োজন নেই। আমি আবার তারা নেভা রাত গুলোতে হাঁটি আর হাঁটি। আমার আর একবার শুধু একবার মৌমিতা নামের অসহায় রাত পরীটিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে ।

পৃথিবীতে কোথাও আমার জন্য একটুকরো ভালোবাসা লুকানো আছে। ইচ্ছে করে তার কাছে যাই স্বপ্নের উড়ান দুঃখগুলো তারাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে প্রিয় মানুষের হাত ধরে হারানো কবিতাগুলো আবার ফিরিয়ে আনি। তার পরিচয় কী আমার জানবার কিছু নেই। এই হতভাগ্য আমি’র কাছে তার একটাই পরিচয়। ‘সে আমায় ভালোবাসে। ‘ আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন কতদিন আমিও তোমাকে খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু– একই আলো পৃথিবীর পারে আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়, প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয় ।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত