অতীতের স্মৃতি

অতীতের স্মৃতি

হাতে একটা লাল ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেজান। আজ তার বউয়ের জন্মদিন। বউ হলেও মিলির সাথে দেখা করার অধিকার, অনুমতি কোনোটাই নাই। ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে পড়া ছেলে হলে এমনই হয় বোধহয়। ক্লাস টেন এ থাকতে মিলিকে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করে৷ কৈশোরের প্রেম ভালোবাসা বিয়ে পর্যন্ত খুব কমই গড়ায়। কিন্তু কৈশোরেই বিয়েটা নিতান্তই আবেগের বশে, অনেকের ধারণা। ধারণাটা পুরোপুরি ভুলও না। বিয়ের কথা জানাজানি হয়ে গেলে সেজার আর মিলির পরিবার তাদের বিয়ে মেনে নেয় লোকলজ্জার ভয়ে।

ছেলে মানুষ বলে সেজানের পরবর্তীতে কোনো সমস্যা না হলেও মেয়ে হিসেবে মিলির জন্য মোটেও সুবিধার হবে না। এই ভেবেই মিলির বাবাই মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সাথে শর্ত জুড়ানো থাকে। ইন্টারের গণ্ডি পার করার আগে তাদের দেখা হবে না৷ যে যার বাসায় থাকবে। সাথে ভালোবাসার পরীক্ষাটাও দেয়া হবে। সেই থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা। পরিবারের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এক নজর একে অন্যকে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা চলে দুজনের। তবে দেখা হলে শুধু দুজোড়া চোখই কথা বলে । ভালোবাসার প্রকৃত প্রকাশ হয় চোখ দিয়ে। প্রায় ১৫ মিনিট পরে মিলি বাসা থেকে বের হলো। বাসার বাইরে একটা কোণায় দাঁড়িয়ে আছে সেজান। মিলি সামনে আসতেই একটা প্রশান্তির হাসি দিলো।

– শুভ জন্মদিন।
– হাসো কেন?
– ভালো লাগে যে।
– কি?
-তোমাকে.।
– এখন নেকামি রাখো৷ কি এনেছো তাই বলো।
– একটা কাজল, দুই প্যাকেট বাদাম, আর এক ডজন কালো চুড়ি। এর বেশি টাকা জমাতে পারি নাই। বাবা বুঝে গেছে যে আমি টাকা জমাই। তাই এখন আরো কম টাকা দেয়।
– তাহলে এত কিছু আনার কি দরকার ছিলো?
– আনব না!! তুমি তো আমার বউ।
– ইশ্। বউ!!! থাকি তো বাপের বাড়ি।
– আর ১ টা বছর। ভালো কোথাও ভর্তি হয়ে তোমাকেও নিয়ে যাবো।

পিছন থেকে মিলির নাম ধরে কেউ দৌড়াতে দৌড়াতে আসলো। “আপু মা ডাকে তোমাকে। তারাতারি। ” শশী, মিলির ছোট বোন। সেজানের সাথে দেখা করার ক্ষেত্রে শশীর অবদান অনস্বীকার্য। সেজানের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে মিলি দৌড় দিলো বাসার ভিতর৷

-শশী দাঁড়াও। ডাক দিলো সেজান।
– জ্বি দুলাভাই।
– এইটা তোমার জন্য৷

পকেট থেকে একটা চকলেট বের করে দিলো শশীকে৷ চকলেট পেয়ে শশী আরো দ্বিগুণ বেগে দৌড়। ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষার প্রথম দিন। পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে দেখা। কিন্তু পরিবারের লোকজন থাকায় কথা হয় না৷ রাতে সেজান শশীকে একটা চিঠি দিয়ে যায় মিলির জন্য। “আজ আমার দেয়া কাজল পরেছিলে, না? অনেক মানিয়েছে৷ এরপর যতবার আমার সামনে আসবা কাজল দিয়ে আসবা। কাজলে তোমার চোখ আরো সুন্দর লাগে।” দিনের সাথে সপ্তাহ, সাথে মাস শেষ হয়। দেখতে দেখতে পরীক্ষাও শেষ। সেজান ঢাকা চলে যায় ভর্তিরপ্রস্তুতির জন্য। যাওয়ার আগে মিলির সাথে দেখা করতে আসে। এবার লুকিয়ে না৷ পরিবারের অনুমতি নিয়ে। মিলির সামনে সেজান দাঁড়িয়ে থাকে, কিন্তু মিলি কথা বলে না। মাথা নিচু করে কিছু একটা করছে। কিছুক্ষণ পরপর একটা নির্দিষ্ট তালে তালে কাঁপছে পুরো শরীর। সেজান বুঝলো মিলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। থুতনিতে হাত দিয়ে মুখটা উঁচু করে ধরলো। চোখের পানিতে চোখের কাজল লেপটে গেছে। মিলিকে আরো সুন্দর লাগছে।

-কাঁদার দরকার নাই৷ তিনটা মাসই তো বাকি। এরপর একসাথেই থাকবো।
-তুমি আরকেটা বিয়ে করবে না তো?.
-হা হা হা। একজনকে কাজল কিনে দিতেই অবস্থা খারাপ আমার!! আরেকজনকে কিভাবে দিবো?
– সব সময় মজা ভালো লাগে না।
– আচ্ছা, আর করবো না। এরপর একদম বরযাত্রী নিয়ে আসবো। তুমি শুধু দোয়া করো আর অপেক্ষা করো।
– হুম।
– কি হুম? অপেক্ষা করবে তো?
-করবো তো।
– কত দিন?
-বাকি জীবন।
– তোমাকে লেপটানো কাজলে বেশি সুন্দর লাগে কিন্তু।

মিলি আর কিছু বলে না৷ সেজান চলে যায়। মাস দেড়েক পরে একদিন সন্ধ্যায় খবর আসে, সেজান এক্সিডেন্ট করেছে। বাসায় আসার সময় বাস খাদে পরে যায়। কয়েকজন বাদে সবাই ঘটনাস্থলেই মারা যায়৷ সেজানকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো। বাঁচানো সম্ভব হয় নি। সেজানের লাশ যখন আনা হয় মিলি চোখে কাজল দিয়ে যায়। আজও চোখের কাজল লেপটানো৷ পার্থক্য শুধু যার জন্য কাজল সে দেখতে পাবে না। অনেক্ষণ বসে ছিলো সেজানের পাশে। এতদিন তো কেউ সাথে থাকতে দেয় নি। আজ কেউ মানা করে নি। মেয়ের মুখ দেখে মিলির মা বারবার অঙ্গান হয়ে যাচ্ছে। শশীটাও মিলির পাশে বসে মিলির দিয়ে তাকিয়ে আছে। আজ মিলিকে কেউ বাঁধা দিচ্ছে না। বাঁধা দিলো নিয়তি৷ স্বপ্ন পূরণের দাঁড়প্রান্তে এসে সব শেষ। কবর দেয়া হয়ে গেলে মিলিরা চলে আসে। আসার সময় সেজানের মায়ের থেকে সেজানের একটা ছবি নিয়ে আসে। ছবিটা দেখে মিলির ঠোঁটে এক অদ্ভুত প্রশান্তির হাসি ফুটলো। মনে হলো নতুন করে কিছু শুরু করতে যাচ্ছে।

৭ বছর পর। সেজানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মিলি। হাতে একটা তোয়ালে। “দেখেছো? আজ আমাদের বিয়ের ১০ বছর পূর্ণ হলো। তুমি তো আগের মতই আছো। আমি একটু মোটা হয়ে গেছি। আজ আমাকে আমার ছাত্রীরা একটা কাজল দিয়েছে ঠিক যেমনটা তুমি দিয়েছিলে। ” তোয়ালে দিয়ে ছবিটা মুছতে মুছতে নিজের অজান্তেই কেঁদে দিলো। মিলি তার কথা রেখেছে। সেজানের জন্য তার অপেক্ষা এখনও অটুট। ৭ টা বছর এভাবেই সংসার করেছে মিলি সেজানের সাথে। প্রতিদিন গোসলের আগে চোখে কাজল দেয়। এরপর লেপটানো কাজল চোখে সেজানের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ আর বিয়ে না করার কারন জিজ্ঞেস করলে মিলির উত্তর একটাই, “লেপটানো কাজল চোখের সৌন্দর্য তো সবাই বোঝে না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত