সাইকোসিস

সাইকোসিস

টিকটিকিটা এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অরুন সেটা হাতে নিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেললো।পুষ্পা শুধু অবাক হয়ে তার স্বামীর এই কান্ডকারখানা দেখলো।সর্বোনাশ!তার কপালে কি পোকামাকড় খেকো বর ছিলো!এই কি কান্ড করে ফেললো সে!বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় বরের এইরকম স্বভাব চোখে ধরা পরলে কোন বউয়ের কাছেই বা তার স্বামীকে অস্বাভাবিক মনে হবে না।পুষ্পা আঁতকে উঠে চেঁচিয়ে বললো-

-এই এই..কি করলে তুমি এইটা? অরুন স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো-
-কি করেছি?
-তুমি টিকটিকিটাকে আস্ত খেয়ে ফেললে?কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ কি এসব খায়?
-কেন খায় না!বিশ্বের এমনও অনেক মানুষ আছে যারা পৃথিবীর সকল প্রকার পোকামাকড়,মলমূত্র,মাটি এসব খেয়েই জীবন ধারন করে।

-চুপ করো তো।আমার এখনো অবাক লাগছে তুমি এইটা কিভাবে গিলে ফেললে।ইয়াক। অরুন হাসলো।কেমন যেন একটা রাক্ষুসে হাসি।পুষ্পার ভয় ভয় লাগছে। অরুনের আরও কিছু দিক পুষ্পার চোখে পরলো।অরুন রাতে চোখ খুলে ঘুমায়।চোখ বন্ধ করে নাকি সে ঘুমাতে পারে না।এইরকম আজব মানুষ পুষ্পা জীবনেও দেখে নি।পুষ্পা প্রথমবার যখন দেখলো সে তখন খুব অবাক হয়ে হয়েছিলো।একবার অরুনকে রাতে চোখ খুলে শুয়ে থাকতে দেখে পুষ্পা জিজ্ঞেস করলো-

-কি হলো?তাকিয়ে আছো কেন?ঘুমাচ্ছা না যে? অরুনের কোনো সাড়াশব্দ নেই।পুষ্পা আবারও বললো-
-কানে তুলা দিয়ে শুয়েছো নাকি?শুনছো না?কথা বলছো না কেন?কোথায় তাকিয়ে আছো? অরুন কোনো কথা বললো।পুষ্পা যখন অরুনকে ধাক্কা দিয়ে বললো-

-আরে কি হলো?কথা বলো? অরুন তখন চোখ বড় বড় করে বললো-
-ডাকছো কেন?
-তুমি তাকিয়ে থেকেও কথা বলছো না কেন?
-আমি ঘুমাচ্ছিলাম।সজাগ কেন করলে?
-তাকিয়ে থেকে বলো ঘুমাচ্ছিলে!
-আমি তাকিয়ে থেকেই ঘুমাই।চোখ বন্ধ করে আমি ঘুমাতে পারি না।
-মানে?এইরকম তো কখনো শুনি নি।
-আমি এইরকমই।আমার অভ্যাস।
-এ কেমন অস্বাভাবিকতা!আচ্ছা,বলো তো তুমি কি অসুস্থ?
-এই নিয়ে পরে কথা বলবো।এখন ঘুমাতে দেও।
-চলো কাল ডাক্তারের কাছে যাই।

অরুন কিছু না বলেই আগের মতো করে তাকিয়ে বিছানায় পরে রইলো। মানুষটা এমন কেন!পুষ্পার ভেতরে একটা ভয় ঢুকে গেছে।যার সাথে সে সারাজীবন কাটাবে সেই মানুষটা কিনা অস্বাভাবিক!পুষ্পা ঠিক করলো সে তার স্বামীকে একজন ভালো সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাবে।একজন ঠিক করতে ব্যর্থ হলে সে আরেকজনকে দেখাবে কিন্তু অরুনকে সে ঠিক করেই ছাড়বে। পুষ্পা মনস্থির করলো অরুনকে সে ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে চায় বিষয়টা সে অরুনকে বলবে।পুষ্পা বললো-

-আচ্ছা,বলো তো অরুন..আমার মধ্যে কি তুমি কোনো পরিবর্তন দেখো?
-কেমন পরিবর্তন?
-বিয়ের প্রথম দিন আমি যেমন ছিলাম এখনো কি ঠিক তেমনি আছি নাকি বদলে গেছি?
-বুঝতে পারছি না।
-আমি খুব ভয় পাচ্ছি।সারাক্ষণ সারাবেলা এই ভয়েই কাটাচ্ছি।
-কেন ভয় পাচ্ছ?
-তোমাকে দেখে।চলো আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
-আমি তো সুস্থ।ডাক্তারের কাছে কেন যাবো!আর তুমি কেন ভয় পাচ্ছ শুধু শুধু!
-তুমি পোকামাকড় যা পাও তাই খেয়ে ফেলো।রাতে চোখ খুলে ঘুমাও আবার বিড় বিড় করে কি যেন বলো।আমার ভয় লাগে তোমাকে।

-আমার এসব দেখে তোমার অভ্যাস নেই।তাই হয়তো ভয় হয় তোমার।কিন্তু আমি এইরকমই।কতো চেষ্টা করেছি নিজেকে ঠিক করতে কিন্তু পারি নি।আমি যখন ছোট ছিলাম তখন থেকে বাবা আমার এইরকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেছিলেন।ঝাড় ফুক,ডাক্তার কবিরাজ কিছু বাদ রাখেন নি।অনেকের ধারণা আমার উপর জ্বীনের ভর আছে।

-তোমার কি হয়েছিলো?
-আমি জানি না আমার কি হয়েছিলো।জানো!আমার বাবা ভাবতেন আমার মায়ের আত্মা আমার মাঝে ঢুকে গেছে।বাবা মারা যাওয়ার আগে আমার মাঝে মায়ের আত্মা আছে ভেবে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন।

-ক্ষমা চেয়েছিলেন কেন?
-হয়তো তিনি তার পাপের জন্যই ক্ষমা চেয়েছিলেন।আমি যখন ছোট ছিলাম,মাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝি নি।তখন সেই মাকে বাবা আমার চোখের সামনে দেয়ালের সাথে তার মাথা ঠুকিয়ে মেরে ফেলেন।
-কি বলছো?
-হ্যা।বাবা প্রতি রাতে অফিস থেকে ফিরলেই মাকে মারধর করতেন।তাদের মাঝে ঝগড়া হতো।

বাবাকে  ভালোবাসতাম কিন্তু মাকে যখন তিনি মারধর করতেন তখন নিজেকে খুব একা মনে হতো।আমি ভয় পেতাম।সেদিনও তিনি মাকে প্রচুর মারলেন।দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকতে ঠুকতে আমার মায়ের মাথা ফেটে গিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত পরার সাথে সাথে মা মারা গেলেন।বাবা সেই লাশটাকে গোপন করে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখলেন দীর্ঘদিন।আর আমাকে বললেন আমার মা লুকোচুরি খেলছে।আমি কাউকে কিছু বলি নি।তখন আমার মুখে কোনো শব্দ বেরুতো না।কথা বলা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।

আমার মায়ের সেই লাশ সাতদিন পর্যন্ত খাটের নিচে থাকলো।পচে গিয়ে দুর্গন্ধ বের হয়ে পোকামাকড় এসে ভীড় জমাতো খাটের নিচটায়।আর আমি কি করতাম জানো!ওই পোকামাকড়দের বসে বসে চিবিয়ে খেতাম।আমার মায়ের দেহ ওরা খেয়ে ফেলবে সেটা আমি মেনে নিতে পারতাম না।এক রাতে এই লাশটা খাটের নিচ থেকে বের করে বাবা একদিন নদীতে ফেলে দিয়ে আসলেন।এরপর থেকে খাটের নিচে সেই অন্ধকারের ভেতর মাকে খুঁজে না পেলে আমার ভয় হতো।আমি চোখ বন্ধ করলেও একই অন্ধকার দেখতে পাই।তাই চোখ বন্ধ করে আমি ঘুমুতে পারি না।কেমন একটা ভয় ভয় লাগে। পুষ্পা এক ধ্যানে কথাগুলো শুনছিলো।অরুন বললো-

-কি হলো পুষ্পা?
-আমি ভয় পাচ্ছি। অরুন পুষ্পাকে জড়িয়ে ধরে বললো-
-একদিন আমি ঠিক হয়ে যাবো পুষ্পা।ভয় পেয়ো না।

একটি তেলাপোকাকে হঠাৎ রুমে উড়তে দেখা গেলো।অরুনের ইচ্ছে হলো সেটা ধরে গিলে খেয়ে ফেলতে।কিন্তু সে নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করলো।তাকে ঠিক হতেই হবে।পুষ্পার জন্য হলেও হতে হবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত