ঘন্টা পাঁচেক আগেই বাড়ির কর্তা মারা গেছেন। বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৮ বছর। ম্যাসিভ হার্ট এটাক। ঘুমের মধ্যেই মৃত্যু। শান্তির মৃত্য যাকে বলে। একটা বড় ব্যবসা ছিল কর্তার। কাড়ি কাড়ি স্বয়সম্পত্তি করে গেছেন। কিছুক্ষণ আগেই মৃত বাড়িটাতে খুব জমিয়ে কান্নার উৎসব হচ্ছিল। ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যেত খুব কঠিন হৃদয়ের হিংসুক প্রতিবেশীটাও ভদ্রলোকের হঠাত মৃত্যুতে হুঁ হুঁ করে কেঁদেছেন।
একজন মানুষকে মরা মানুষের নিথর দেহের সামনে কাঁদতে হয়, এটা নিয়ম। অন্তত বিশ সেকেন্ডের জন্যে হলেও চোখের পানি দেখাতে হয়। তা না হলে মানুষ পরে এ নিয়ে খুব সমালোচনা করে। মৃত ভদ্রলোকের চার ছেলে এবং তিন মেয়ে। বাবার হঠাত মৃত্যুতে এতক্ষণ বিলাপ আর মুর্ছা খেয়ে কাঁদছিল ওরা। মেয়েগুলো বারবার মুর্ছা যাচ্ছিল আর কাঁদছিল। খুব বিলাপ ধরে ধরে কাদছিল। বিলাপগুলো অনেকটা এমন–
বড় মেয়ে- “ও বাবা,বাবাগো তুমি কেমনে আমায় একা করে চলে গেলাগো?আমার তো আর কেউ রইল না গো!ও খোদা তুমি আমারেও টাইনা নাওগো” ছোট মেয়ে- “আমায় এখন কে আদর করবে গো, আমার কথায় কথায় শখ কে পূরণ করবে গো!ও বাবা গো….ও বাবা..মেঝ মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ঘন্টা দেড়েক।
বাবা মারা গেলে ছেলেদের শব্দ করে কাঁদার নিয়ম নেই।এই সময়টাই তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল কত দ্রুত সম্ভব বাবাকে কবরবাসী করে দেয়া যায়। কোন পাওনাদার কিংবা দেনাদার থাকলে জানাযায় উপস্থিত মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করা যে আপনারা কেউ টাকা পাবেন কিনা।তাছাড়া ছেলেদের শব্দ করে কান্না করাটা বড্ড বেমানান।কিছুদিন পরে প্রতিবেশীরা এটা নিয়ে খুব হাসিঠাট্টা করে।কিন্তু তবুও চার ছেলে প্রথমে খুব কান্নাকাটি করেছিল।
লোকটাক কবরে শুইয়ে আসা হয়েছে বেশ খানিকটা সময় হয়ে গেছে। এখন আর বাড়ি জুড়ে কোন কান্নার উৎসব নেই আর। নিস্তব্ধ নীরবতা। সবাই মেনে নিয়েছে “বাবা মরণশীল”।সবার মধ্যে আস্তে আস্তে বাস্তবতার নিয়মগুলো ফুটে উঠছে। মূলত বাস্তবতা যখন ক্লান্ত হয় তখন কিছুক্ষণের জন্যে আবেগ মানুষের অনুভূতির কাজটা কিছুক্ষণের জন্যে করে দেয়। বাস্তবতার সাথে আবেগের কোন সম্পর্ক নেই।
মৃত ভদ্রলোকের দুই ছেলে ঢাকা থেকে এসেছে। দুজনেজ অনেক বড় অফিসে চাকরী করে। আর বাকী দুই ছেলের একজন পড়াশোনা করে আর একজন ক্ষেত-খামার দেখাশোনা করে। তিন মেয়ের দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে আর একজন এখনো পড়াশোনা করছে।
সেদিনের সন্ধ্যার ঘটনা। বাড়ির উঠোনে চারদিন্না/ কুলখানির আয়োজনের মিটিং বসেছে। মৃত ভদ্রলোকের সব ছেলেমেয়ে গোল হয়ে বসেছে। সবার মনোযোগী দৃষ্টি। এখন আর কেউ কাঁদছে না। এমনকি মেঝ মেয়েটাও না।সবাই স্বাভাবিক। মিটিং এ দুজন মুরুব্বি আছেন। একজন তাদের মা। বেচারি এখনো স্বামীর শোকে একেবারে পাথরের মত হয়ে আছেন। অপলক তাকিয়ে থাকেন একদিকে। বাকী আরেকজন তাদের বড় চাচা। মিটিং শুরু হল। কথাও শুরু হল। বাবার কুলখানির জন্যে কোন ছেলে কে কত টাকা করে দিবে তা আলোচনা চলছে। মোট কতজন গ্রামবাসীকে দাওয়াত দেয়া হবে তা নিয়ে কথা হচ্ছে। এখন সবাই ভীষণ বাস্তববাদী৷ এ সময়টাতে কাঁদা যায়না। কাঁদলে আবেগ থাকে। আর আবেগ হুশ কেড়ে নেয়। হুশ গেলে স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়। তাই সবাই যথেষ্ট সচেতন।কে কত টাকা দেবে এমন টা নির্ধারণ করা হচ্ছে। মৃত ভদ্রলোকের সব ছেলেমেয়ের চোখে মুখে কাঁচুমাচু ভাব।
ঠিক সে সময় মেঝ ছেলেটা একটা বড় মাপের দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। দীর্ঘশ্বাস টেনে মুরুব্বি জেঠার দিকে তাকিয়ে বলে বসল –“জেঠা, আল্লাহ আমার আব্বারে বেহেশত নসীব করুন। আমি আব্বার খাওয়ার জন্যে ত্রিশ হাজার টাকা দিব। কিন্তু আমার একখান কথা আছে। সকলের দৃষ্টি এসে আছড়ে পড়ল তার দিকে। জেঠা জানতে চাইলো কি কথা বাপজান? কিছুটা ইতস্তত ভাব আনার ভঙ্গি করে বলল ” আব্বার চারদিনের অনুষ্ঠান টা শেষ হতেই ঢাকা ফিরতে হবে।আমার ছুটি নেই। তাই বলছিলাম কি যদি জেঠা পালটা প্রশ্ন করল – ” যদি কি বাপজান?”
মেঝো ছেলেটা কাচুমাচু করে জবাব দিল ” জেঠা আমি বলছিলাম কি যদি আমাদের সম্পত্তি গুলান যদি ভাগ বাটোয়ারা আজকেই কইরা ফেলা যায় তাইলে ভালা হয় খুব। আব্বারতো ইচ্ছা ই ছিল সব ছেলেমেয়েদের সামনে রেখেই কিন্তু কথাটা শেষ না করেজ চোখ কচলাতে থাকে মেঝো ছেলেটা। এমন ভাব যেন এখন ই কান্নার স্রোতে ভেসে যাবে সে। সুনসান নীরবতা। তবে খুব বেশিক্ষণ না। নীরবতা খুব দ্রুতই ভেঙে সেঝো ছেলেটা গলা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে বলে উঠল – ” জেঠা আমি মেঝোর সাথে একদম একমত।ও ঠিক বলেছে। আমাকেও তো ঢাকা ফিরতে হবে এত সময় কোথায় বলুন। বাবাকে তো আর ফিরে পাব না।তাই কাজে কর্মেতো যোগ দিতে হবে। তাই আমিও বলছিলাম আজ ই সব সম্পত্তি ভাগ করে ফেলুন।
আবার সুনসান নীরবতা। বড় ছেলের বউটা তার স্বামীকে কানে কানে ফিসফিস করে বলে উঠল- “কি গো তুমি চুপ কইরা আছ কেন হাদারামের মতন, কথা কও। তুমিও তোমার জেঠারে কও যে তোমার ভাইগো লগে তুমি একমত আছো। একমাত্র বউ এর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে বড় ছেলেও গলা বাড়িয়ে বলল- হ জেঠাসাব মেঝো সেঝো খাটি কথাউ কইসে ।আমিও হেগো লগে একমত। আবার সুনসান নীরবতা। মৃত ভদ্রলোকের স্ত্রী অপলকহীন তাকিয়ে আছে এখনো বাড়ির শেওলা জমে থাকা উঠোনের দিকে। তিনি নির্বাক। একদম নির্বাক।
ছেলেমেয়েদের জেঠা নীরবতা ভাঙলেন। তিনি গলাটা বেশ খানিকটা শান্ত গলা করে বললে ” বাপজানেরা, আগে তোমাগো বাপের চারদিন্নাখান সুন্দরমতন শেষ হইয়া যাউক। তোমাগো বাপ তো খুব সম্মানী মানুষ আছলো। হের আত্মার বেহেশতবাসী হওনের লাইগা এখন তোমাগো মেলা কাজকাম। ” কথাটা শেষ হতেই আবার নীরবতা। সবার চেহারা এমন যে কেউ জেঠার কথাগা বুঝতে ই পারেনি। মেঝো ছেলেটা আবার নীরবতা ভাঙল। সে তার নির্বাক মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল – “মা যাও তো,জলদি যাইয়া দলিলপত্রগুলান লইয় আসো। আমি উকিল কাকারে কল দিয়া দিসি। উনি এক্ষুণি আইয়া পড়বো। ” তাদের মা এখনো নির্বাক। সেঝো ছেলেটা মায়ের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে জোরে ডেকে উঠল ” যাওনা মা, মেঝো কি বলেছে শুনোনি। ”
অমন ডাকে আচমকা সম্ভিত ফিরে ফেলেন যেন নির্বাক মানুষটা। শাড়ির আচল গুঁজে এই প্রথম তাদের মা শব্দ হু হু করে কেঁদে ফেলল। মহিলা ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। হয়ত এমন মুহূর্তটার জন্যে একদম তৈরি ছিল না। তিনি কাঁদদতে কাঁদতে মুখে আচল গুজে উঠে গেলেন চেয়ার ছেড়ে। মেঝো মেয়ের স্বামী মেঝো মেয়েকে কানের কাছে ফিসফিস করে বলল- “শোন অধিকার কিন্তু ছাড়বে না।মুখ চালাবে। তা না হলে ঠকবে কিন্তু।”
এই একটু আগেই তো ছেলেমেয়েগুলো কেদে পুরো দুনিয়া কাপিয়ে দিচ্ছিল। আর তারাই এখন নিজেদের স্বার্থের কাছে এত মাতোয়ারা হয়ে উঠল। এইটাই কি নিয়ম! দলিল পত্র এসে পৌছে গেছে টেবিলে। সুনসান নীরবতা। ছেলেমেয়েরা সবার চৌকস দৃষ্টি। তাদের শরীরের কোথাও এখন কান্নারা নেই। শরীরের প্রতি পরতে পরতে এখন শুদ্ধ অংকে ঘুরঘুর করছে। নটিক্যাল,বিঘা,কানি,আইল,বাংলো,কড়ই গাছ,নারকেল গাছ,সোনালী ব্যাংক,রুপালী ব্যাংক ইত্যাদি বিষয় মুহুর্তের মধ্যে কষে ফেলছে। বাবার কোথায় কি আছে না আছে সব নিয়ে ভীষণ ভাবনা চিন্তা হচ্ছে।সবার একটাই চিন্তা একটু ভুল হলেও চলবে না।
মেঝো ছেলেটা আগ বাড়িয়ে দলিলপত্রগুলো ধরতে যাবে। ঠিক একই মুহুর্তে হুমড়ি খেয়ে বাকী ছেলেমেয়েগুলোও হামলে পড়ল কাগজগুলোর উপর। ফাইলটা হাতে নিয়ে খুলতে গিয়েই দেখতে পেল একটা লাল রঙের বড় খাম। খামটা হাতে নিয়ে তাড়াহুড়া করে খুলে দেখল একটা চিঠি। চিঠিটা ছেলের হাত থেকে এক ঝাপটায় নিয়ে নিল মৃত ভদ্রলোকের স্ত্রী। চিঠিটা নিয়ে সেটা বাড়িয়ে দিল সন্তানদের জেঠার দিকে। মৃত ভদ্রলোকের ভাই চিঠিঠা হাতে পেয়ে তাতে একবার হাত বুলিয়ে পুরো চিঠিখানা মেলে ধরলেন। এরপর জোরে জোরে পড়া আরম্ভ করলেন।
প্রিয় সন্তানেরা,
আমি মারাগেছি। এতক্ষণে নিশ্চয় আমাকে কবরে শুইয়ে এসেছ। এতক্ষণে তোমরা সবাই নিশ্চয় আমার সব সম্পত্তি নিয়েও চিন্তিত হয়ে পড়েছ। হওয়াটাই স্বাভাবিক। এটাই ই তো নিয়ম। আমার বাবার মৃত্যুর ঠিক এক দিনের মাথায় আমার ভাইরা মিকে সব সম্পত্তি ভাগ করে ফেলেছিল। তাই আমি তো জানি এ পৃথিবীর নিয়ম গুলো বড়ই বেদনাদায়ক। তোমাদেরকে একটা কথা বলি শোন, আমি খুব কষ্ট করে এতসব টাকা সম্পত্তি এসব কামিয়েছি।
তোমাদের আরো একটা কথা জানিয়ে রাখি, এই এতসব সম্পত্তি করার পেছনে যে মানুষটা সবসময় আমাকে সাহস আর অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সেই মহিয়সী ব্যাক্তিটি হল তোমাদের মা মানে আমার সহধর্মিনী। আমি তাকে খুব ভালবাসি। যেহেতু তোমরা তার গর্ভর ফুল। তাই তোমাদের ও ভালোবাসি। তবে কোনভাবেই তাকে ভালোবাসার চাইতে বেশি নয়। তাই অবশ্যই আগে আমার কাছে তার নিরাপত্তা তারপর তোমাদেরটা। জানো সন্তানেরা, পৃথিবীটা খুব কঠিন জায়গা। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার বাবার মৃত্যুর পরে আমার মা কে কোন ছেলে ভাগে নেবে এটা ঠিক করতে আমার বড় ভাইদের ঘাম ছুটে গেছিল। শেষ মেশ আমি ক্লাস সিক্সে থাকা বয়সেই আমার বৃদ্ধা মায়ের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। সব সন্তানকে তো আল্লাহ আর কুলাংগার করে পাঠান না। তাইনা? তাই তোমাদের কিভাবে বিশ্বাস করি বল।
নিজের ভালোবাসার প্রিয় মানুষটাকে তো আর পরম অনিশ্চয়তায় ছেড়ে যেতে পারি না। তাই আমি খুব ভেবেচিন্তেই একটা দারুণ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি অনেক আগেই। আর তা হল আমার যাবতীয় সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আমার বউ মানে তোমাদের মা কে উইল করে দিয়ে রেখেছি। পদ্ধতিটা একটু কঠিন। কিন্তু টাকার কাছে এই পৃথিবীতে সব ই সম্বব। তাই অবাক হওয়ার কিছুই নেই। তোমাদের মা আমাকে প্রতীজ্ঞা করেছে – “তিনি মরার আগে কোনভাবেই সম্পত্তি তোমাদের ভাগ করে দেবে না”। তবে তোমরা কোন বিপদে পড়লে তোমাদের মা কে বললেই তিনি তোমাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করবেন। তোমরা মায়ের যত্ন নিও।আর দলিলগুলো মাকে আবার দিয়ে দিও। সেগুলো আকড়েই তো তিনি বাকী জীবন গুলো বাঁচবে। খুব মনে পড়বে তোমাদের কথা।
ইতি
তোমাদের বাবা
চিঠিটা পড়া শেষ হওয়ামাত্রই মৃতভদ্রলোকের স্ত্রী ঝটপট দলিলগুলো এক ঝটকায় দু হাতে তুলে নিয়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতন কেঁদে উঠল। সে কান্নার কি যে ভূবন ভোলানো আর্তনাদী আওয়াজ। উফ!