আজকে পনেরো তম বারের মত আমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে এলো। ছেলে বেসরকারি চাকরি করে, খুব বেশি বেতন না, কোনোভাবে খেয়ে পড়ে চলা যায় এমন। প্রচন্ড ভয়ে ভয়ে সামনে গেলাম। কয়েক জোড়া চোখ আমার দিকে সূক্ষ্মভাবে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টি আমার চেনা। এখানে তাচ্ছিল্য আছে, করুণা আছে, সহানুভূতি আছে। প্রথমেই ছেলের মা জিজ্ঞেস করলেন- “তোমার বয়স যেন কত?” একটু অবাক হয়ে গেলাম। আসরের মধ্যে এভাবে বয়স জিজ্ঞেস না করলে কি খুব ক্ষতি ছিলো? নাকি ইচ্ছা করেই এমন অপমান?
-“ছাব্বিশ। ”
-“দেখে তো আরো বেশি মনে হয়। মেয়েদের কুড়ি পেরোলো তো যৌবন অর্ধেক ফুরিয়ে গেলো। এখনো বিয়ে হয় নি যে! আগের প্রেম ঘটিত কোনো সমস্যা আছে?”
-” জ্বি না। আগে কোনো প্রেম ছিলো না।” ওপাশ থেকে পাত্র বলে উঠলো,
-“ওকে দেখেছো মা? অমন মোটা, কালো বেটে মেয়ের সঙ্গে কার প্রেম থাকবে শুনি? কি যে বলে ওঠো না তুমি মাঝেমাঝে।হাহাহা! ”
চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই ভিতরে চেপে নিলাম। আড় চোখে মা কে দেখলাম। মা দাঁড়িয়ে আছেন এককোণায়। আমার চেয়েও মাকে বেশি অসহায় লাগছে। তৃতীয়বার পাত্রপক্ষ আমাকে প্রত্যাখান করে দেবার পর থেকে বাবা আর উপস্থিত থাকেন না। আমার উপর বাবার কোথায় যেন একটা ক্ষোভ! আমি নীরু,ভালো নাম নীরুপমা রায়। এলাহাবাদের ছোট্ট একটা মফস্বলে থাকি। বাবা,মা, দাদা, আর আমি মিলে আমাদের পরিবার। ইংরেজিতে মাস্টার্স করছি এখানকারই একটা কলেজ থেকে।পাশাপাশি গান গাইতে পছন্দ করি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও আমার গানের গলা বেশ ভালো।
অন্যান্য গুনাবলী উপেক্ষা করে জন্মের পর থেকেই আমার উপর সবার একধরনের ঘৃণা, রাগ, ক্ষোভ। আমাদের প্রপিতামহদের বংশে এত নিখুঁত কালো মুখগড়নের আর কেউ নেই। ভূমিষ্ট হওয়ার পর আমাকে দেখে অনেকে মায়ের চরিত্র, আমার পিতৃপরিচয় নিয়ে কথা তুললেন। সে যাক গে, এতোশত লাঞ্জনার মধ্যেই নুয়ে থাকা চালকুমড়ার লতার মত আমি আমার গতিতে বেড়ে উঠলাম। আমার ভীষণ কষ্ট হয় যখন দেখি গায়ের রঙ দিয়ে মানুষ বিচার করা হচ্ছে।
নিজেকে যদি নিজে সৃষ্টি করার সুযোগ থাকতো তাহলে কি আমার চামড়া অন্ধকারের মতো হতো? আমি তখন নিজেকে বানাতাম সুচিত্রা সেন কিংবা সুপ্রিয়া দেবীর মত। বর্নে -গন্ধে সম্পূর্ণা হিসেবে নিজেকে স্থান দিতাম।
কিন্তু হায়! সে সুযোগ তো আমার হাতে ছিলো না। ক্ষমতা শুধুই ঈশ্বরের! কিছুক্ষন আগেই পাত্রপক্ষকে একটা ছোটো মিথ্যা বলেছি। বলেছি আমার প্রেম ছিলো না। কিন্তু এই ভ্রমরকৃষ্ণ চেহারা নিয়েও সুজয়দার সাথে আমার প্রেম ছিলো প্রায় একবছর।
সাঁঝবেলায় লোকচক্ষুর আড়ালে আমরা ঘাটপুকুরে বসে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা। আমার চুল নিয়ে খেলা ওর সবচেয়ে পছন্দ ছিলো। ঘন ভেজা চুলের ঘ্রাণ নিতো, বেনী করে দিতো, খোপায় ফুল গুঁজে দিতো। আর মাঝে মাঝে বলতো -“নীরু, একটা গান শোনাও তো।” প্রথমে একটু অনিচ্ছা দেখাতাম, এরপর সুজয়দার কাছে ঘেঁষে কানের কাছে আস্তে আস্তে গান শোনাতাম, পাছে কেউ শুনে ফেলে ?
আমার ছাব্বিশ বছরে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ সুজয়দা। মুখের ভাঁজে ভাঁজে যেন যৌবনের জ্যোতি ঠিকরে বেরোয়। শরীরের লোমকূপেও যেন তীব্র তারুন্যের ছাপ! খুব সম্ভবত এমন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের মোহেই আমি আটকে পড়েছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো। খুব যত্ন করে সুজয়দার একটা সাদাকালো ছবি এঁকেছিলাম। বিপত্তি হলো সেই ছবিটা নিয়েই। সুজয়দার মা টের পেয়ে ছুটে আসলেন আমাদের বাড়িতে।
প্রচন্ড অপমান করলেন আমাকে, সাথে মাকেও।
-” মেয়ে দেখেছি, তবে তোমার মতো লজ্জা ছাড়া মেয়ে দেখেনি। বলি, আয়নায় নিজেকে দেখেছো একবারো? অমন কদাকার হনুমানমুখী আমাদের বাড়িতে ঢুকবে না বলে দিচ্ছি৷ হতচ্ছাড়ির যোগ্যতা নেই, আবার বড় বড় স্বপ্ন দেখা। শুধরে যাও বলছি,নাহয় পাড়ার সবার সামনে এমন কালি মেখে দেবো না, বেঁচে থাকার সাধ মিটে যাবে।”
সত্যি কথা বলতে বেঁচে থাকার সাধ সেদিন ই মিটে গিয়েছিলো ৷ আমি হন্যে হয়ে জীবন থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছিলাম৷ বাকি সবাই তো দিব্যি সুখেই আছে। খাচ্ছে, দাচ্ছে, ফূর্তি করছে। তবে কেন আমার বেলায় এত বাঁধা? সুজয়দাও খুব সুখে আছে। ক’দিন আগেই সুজয়দার বিয়ে হলো, সে তো মেয়ে নয় ৷ শুনেছি সাক্ষাৎ ইন্দ্রসভার অপ্সরী উবর্শী! সে যাক গে, যে গিয়েছে তো গিয়েছেই। সুখে থাকুক এইটুকুই চাওয়া। তারও ক’দিন পর আবার শুভাশীষের সাথে বিয়ের কথা চলছিলো, পারবারিক ভাবেই। শুভাশীষ আমার দুরসম্পর্কের পিসতুতো ভাই। বিয়ের কথা প্রায় পাকা হওয়ার দু’দিন পরই আমার পিসি, মানে শুভ’র মা অনেক চিন্তিত মুখে এসে বললেন,
-“নীরু, তুই খুব ভালো মেয়ে, খুব সুন্দর গান ও গাস। কিন্তু শুভ’র বাবা বলেছেন লম্বা আর ফর্সা মেয়ে ছাড়া বিয়ে দেবেন না। নাতঠাকুর যদি কালো হয়, তাহলে তো মুখ দেখানো দায় হয়ে যাবে রে! তুই কষ্ট পাস না। দেখবি বেশ কেউ তোর জীবনে চলে এসেছে। ” আমি শুধু হেসে বললাম,
-“আচ্ছা পিসি, ও কিছু না। কষ্ট পাবো না আমি, তুমি চিন্তা করো না।”
কষ্টের একটা সীমা থাকে, সেই সীমা যে অনেক আগেই অতিক্রম করে এসেছি তা কি পিসি জানে? আমি ক্লান্ত, সর্বদিক থেকে ক্লান্ত। ভর্ৎসনা শুনতে শুনতে ক্লান্ত, অধিকার থাকা সত্ত্বেও না পেয়ে ক্লান্ত, ভালোবাসা না পেয়ে ক্লান্ত। জীবন থেকে মুক্তি লাভের সময় এসে পড়েছে। মা প্রতিদিন কান্নাকাটি করেন, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না, পাড়ার নানা লোকে নানান কথা বলে। বাবা বাসা থেকে বাইরে যেতে পারেন না। দাদা তো এসবের যন্ত্রণায় বাড়িতেই আসে না। আমি ঠিক করলাম সামনে আশ্বিনের শুক্লপক্ষ, আসছে কালীপূজোয় কিছু একটা করতেই হবে। সবাই তখন মন্ডপে ব্যস্ত থাকবে, এইতো সুযোগ! অপেক্ষার দিন চলে এলো। যখন পূর্ণিমার আলোতে ঢেউ খেলছে চারপাশ,কাউকে কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে গেলাম বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে।
আস্তে আস্তে ঘাটপাড়ের বিশাল কদম গাছের সামনে গেলাম। এইতো এ জায়গাটাতেই আমি আর সুজয়দা বসে গল্প করতাম। কত কথা ছিলো আমাদের! বিভিন্ন ছলেবলে সুজয়দা ছুঁয়ে দিতো আমাকে তা কি সে ভুলে গেছে? কি জানি, গেছে হয়তো। এসব ভাবতে ভাবতে আস্তে আস্তে গাছে কাপড় প্যাঁচালাম। চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। আরে হতভাগী! কালো হয়ে জন্মে আবার জীবনের জন্য এত মায়া?
শেষবারের মত পুকুরের কাছে গেলাম। পূর্নিমার আলোয় জলের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে চমকে উঠলাম। আরে! এ যেন কালো মাটিতে তৈরি দেবীর আদলে গড়া মানুষ। চোখ সরাতে পারছিলাম না, একটা বিস্ময় আর ঘোরের মধ্যে কাটছিলো সময়। মনে হচ্ছে কিছু একটা বলতে চাইছে আমাকে। ততক্ষণে কে যেন চলে আসলো ঘাটপাড়ে। আমি নিমিষেই সেখান থেকে কেটে পড়লাম, আর জীবন পেয়ে গেলো আরেকটা সুযোগ ৷ এর প্রায় এক মাস পরে, কলকাতার বিখ্যাত রাজেশবাবু তাঁর কি এক প্রজেক্টের জন্য গায়কী খুঁজছিলেন৷ যোগ্য গায়কীর অভাবে নাকি কাজ থেমে আছে। এ খবর শুনে আমাকে জোর করে পরীক্ষা দিতে পাঠালো ছোটোবেলার বন্ধু গোপাল।
প্রায় ১৫ ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমি কলকাতা পৌঁছলাম, তখন আমি বিধ্বস্ত, অবসন্ন। জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো কলকাতা এলাম, আর প্রথমবারের মতো কোথাও অডিশন দিবো৷ ভয়ে বুক কাঁপছিলো। সেবার ঈশ্বর হয়তো আমাকে সারাজীবন গঞ্জনা সহ্যের উপহার নিজ হাতে দিলেন। প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষকে পেছনে ফেলে রাজেশবাবু অজপাড়াগাঁয়ের এক নীরুপমা রায়কে বাছাই করলেন। কিভাবে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, স্টুডিওর ব্যস্ত শিডিউলে কন্ঠ দিয়ে গেলাম একের পর এক।
তারপরের গল্প সবারই জানা। রাতারাতি মানুষ চিনে গেলো। রাজেশবাবুর প্রজেক্টে কাজ করে অনেক প্রশংসা পেলাম, জাতীয় পুরষ্কার পেয়ে পত্রিকাতে স্থান পেলাম। ইদানীং আমার ইন্টারভিউ নিতে লোকজনের অনেক ভীড় হয়। সবকিছু ছিলো কল্পনার বাইরে। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না আমার জীবনে ভালো কিছু হতে পারে! একটু সময় নেওয়া আসলেই খুব দরকার ছিলো। ততদিনে আমার বাবা -মা, দাদা সবাই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। সুজয়দার সাথে নাকি সেই অপ্সরীর ডিভোর্স হয়ে গেছে বিয়ের ছ মাস পরেই। সুজয়দার মা এসেছিলেন, পুত্রবধূ করে নিতে চায় নতুন করে।
বেশিকিছু বলি নি। শুধু হেসে বলেছি – “যোগ্যতা আছে?” আমি ইদানীং বেশ ভালো আছি। মাঝেমাঝে মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। এত সুখ তো আমি স্বপ্নেও দেখিনি। বাবা মা, স্বামী, দাদা, বউদি সবাইকে নিয়ে খুব ভালো আছি। মাঝেমাঝে অবশ্য আফসোস হয় কৃষ্ণবর্ন নিয়ে, সৌন্দর্য নিয়ে। তখন আমার স্বামী রোহিত গুপ্ত কপালে চুমু দিয়ে হেসে বলেন-