প্রায়শ্চিত্ত

প্রায়শ্চিত্ত

এই মুহুর্তে আমি দাঁড়িয়ে আছি ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানার সামনে। আমার সাদা শার্টের উপর রক্তের ছিটা দাগ লেগে আছে।যখন থানার ভিতরে ওসি সাহেবের রুমে ঢুকতে যাবো তখন কনস্টেবল আমার পথ আটকে দাড়ালো। আমি শার্টের কলারটা দাঁড় করিয়ে কান চুলকাতে চুলকাতে কনস্টেবলকে বললাম,

— আমি সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতি প্রিন্সিপালের ডান হাত।

কনস্টেবল আমার কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে গেলো। আমার জানা মতে যেসব ছেলেরা রাতে প্রস্রাব করতে যাওয়ার সময় মাকে বাথরুমের পাশে দাড় করিয়ে রাখে তারাই পরবর্তীতে পুলিশের চাকরি করে। কনস্টেবল আমার সামনে থেকে হাতটা সরিয়ে বললো,

– যান ভাই, স্যার ভিতরেই আছে আমি ওসি সাহেবের রুমের ভিতরে যখনি ঢুকতে যাবো তখন দেখি ওসি সাহেব তড়িঘড়ি করছেন রুম থেকে বের হবার জন্য। আমি আমার পকেট থেকে রক্তমাখা চুরিটা বের করে টেবিলের উপর রেখে চেয়ারে বসতে বসতে বললাম,

–স্যার, আপনি আমায় ১০ মিনিট সময় দেন। আমি আপনাকে একটা কাহিনী বলছি তারপর আপনি আপনার মত ব্যবস্থা নিয়েন। ওসি সাহেব এক নজরে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে দেখে বললেন,

– কি বলতে চান তাড়াতাড়ি বলেন। আমি বলা শুরু করলাম,

— আমার বিয়ের ৫ দিন পর জানতে পারি আমার স্ত্রী শ্রাবণীর ২টা কিডনি নষ্ট হওয়ার পথে। কথাটা যখন আমার পরিবার জানলো তখন তারা বললো, আমি যেন মেয়েটাকে ডিভোর্স দিয়ে দেই আর জালিয়াতির মামলা করি। কিন্তু আমার মনে অন্য রকম লাগছিলো। হাজার হোক শ্রাবণী তখন আমার বিয়ে করা বউ। আমি তাকে ইসলামের সকল নিয়ম কানুন মেনেই ওকে বিয়ে করেছিলাম তাই ওর প্রতি কেন জানি একটা দ্বায়িত্ব বোধ কাজ করছিলো। আমি আমার শ্বশুর বাড়ি গেলাম। শ্বশুরকে বললাম, বাবা, আপনি এমন একটা কাজ কিভাবে করলেন? আপনার মেয়ে যে অনেকদিন ধরে অসুস্থ সেটা বিয়ের আগে আমায় বললেন না কেন? উনি আমার দিকে কিছুটা রাগী চোখে তাকিয়ে বললো, আমি বলতে যাবো কেন? তুমি আমার মেয়েকে ভালো করে দেখে শুনে বিয়ে করো নি কেন? উনি আমার শ্বশুর হলেও উনার এমন থার্ডক্লাস কথা শুনার পর রাগে আমি উনার পাঞ্জাবির কলার ধরে বলেছিলাম,

আপনার মেয়ে কি কোরবানির গরু যে ভালো করে দেখে পরীক্ষা করে নিয়ে যাবো? আমি শ্রাবণীকে একজন কিডনির ভালো ডাক্তার দেখাই। উনি দেখে বললেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশের বাহিরে নিয়ে যেতে। আর কিডনিটা যেন কিছুদিন ভালো থাকে সে জন্য কিছু দামী ঔষধ লিখে দেয়। আমি প্রাইভেট কম্পানিতে ছোট একটা জব করি। আর বেতন মাত্র ২০ হাজার টাকা। এই টাকা আমার স্ত্রীর ঔষধ কিনার পিছনেই চলে যেত৷ ওকে বিদেশ কিভাবে নিয়ে চিকিৎসা করাবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। শেষ মেষ আমার স্ত্রী আমার হাতে হাতটা রেখে বলেছিলো,

-তুমি আমার জন্য যথেষ্ট করেছো। আর করতে হবে না। আমি মরে গেলে মরে যাবো তুমি শুধু শুধু আমার পিছনে আর টাকা খরচ করো না। শ্রাবণী এই কথা গুলো বলছিলো ঠিক আছে কিন্তু আমি ওর চোখে মুখে বাঁচার জন্য আকুতি দেখছিলাম।ওর চোখের মাঝে দেখতে পারছিলাম ওর এই দুনিয়াতে বেঁচে থাকার আর্তনাদ…

নিজের বাবা বড় ভাই বোন সবাইকে বললাম, আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য আমায় সাহায্য করতে কিন্তু ওরা কেউ করে নি। ওদের একটা কথায় আমাদেরকে ঠকানো হয়ছে। আমি যেন মেয়েকে ডিভোর্স দিয়ে নতুন আরেকটা বিয়ে করি। ওরা বিয়ের সব খরচ দিবে কিন্তু চিকিৎসার জন্য এক টাকাও দিবে না। যে শ্বশুরের কলার ধরেছিলাম সেই শ্বশুরের পা পর্যন্ত ধরে বললাম, আমায় একটু সাহায্য করেন। আমি আপনার মেয়ে আমার স্ত্রীকে বাঁচাতে চাই। কিন্তু উনি আমাকে বলেছিলেন, আমার মেয়েকে আমি বিয়ে দিয়ে দিছি এখন আমার কোন দায়ভার নেই। সব দায়ভার তোমার। তুমি যেভাবে খুশি সেভাবে চিকিৎসা করাও আমি একটা টাকাও দিতে পারবো না…

কিন্তু আমি থেমে যাবার পাত্র ছিলাম না। আমার মাথায় তখন একটা চিন্তায় ঘুরছিলো কিভাবে আমি আমার স্ত্রীকে বাঁচাবো। আমি আমার অফিস থেকে লোন নিলাম। এলাকার কয়েকজনের থেকে সুদে টাকা ধার নিলাম। শ্রাবণীকে নিয়ে গেলাম দেশের বাহিরে ভেলুর CBMC হসপিটালে। হসপিটালে ওর রক্তের সাথে মিলে শুধু একটা কিডনি পাওয়া যায়। আমার শরীরে দুইটা কিডনি থাকা অর্থহীন মনে হচ্ছিলো। যে আমার অর্ধাঙ্গিনী তাকে তো আমি আমার একটা কিনডি দিতেই পারি৷ আমি আমার একটা কিনডি দিয়ে দেই। শ্রাবণী আস্তে আস্তে পুরো সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু দেশে আসার পর আমার পাওনাদারদের চাপ বাড়তে থাকে৷ কিভাবে সুদের এতগুলো টাকা অফিসের লোন পরিশোধ করবো সেটার চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম।

পাওনাদারদের থেকে কিছু দিন সময় চেয়ে শ্রাবণীকে নিয়ে আমি ময়মনসিংহ এসে পরি। আমি চাকরির পাশাপাশি টিউশনি শুরু করলাম যেন টিউশনির টাকা দিয়ে সংসারটা চলে আর বেতনের পুরো টাকাটা দিয়ে ঋণশোধ করতে পারি। এর মাঝে শ্রাবণীর মাঝে পরিবর্তন। আমি সারাদিন পরিশ্রম করে আসার পর মাঝে মাঝে দেখতাম ও বাসায় নেই। ইদানিং সারাক্ষণ সেজেগুজে থাকে। কয়েকদিন আগে দেখতে পাই বাড়িওয়ালার ছেলের সাথে বাইকে করে কোথায় যাচ্ছে। আর আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে দেখি আমার স্ত্রী আর বাড়িওয়ালার ছেলের নগ্ন একজোড়া শরীর। বাড়িওয়ালার ছেলে দৌড়ে পালিয়ে যাবার পর ও আমায় কিছু একটা বুঝাতে চেয়েছিলো কিন্তু আমি তার সুযোগ দেই নি। তার আগেই বেঈমানের গলার উপর এই চুরিটা চালিয়ে দেই ওসি সাহেব আমার কথা গুলো মন দিয়ে শুনার পর বললেন,

– আপনি যা বলেছেন সত্যি বলেছেন। কারণ মিথ্যা কথা কেউ এইভাবে বলতে পারে না। আপনি বাসায় যান বাসায় গিয়ে বাসায় সমস্ত কিছু এলোমেলো করে রাখেন। টাকা পয়সা জুয়েলারি সব কিছু এক জায়গায় সরিয়ে রাখেন।তারপর আমায় খবর দেন। আমি গিয়ে এটা ডাকাতি আর খুনের মামলা সাজাবো আমি বাসায় আসলাম আলমারি থেকে যখন কাপড়গুলো এলোমেলো করছিলাম তখন দেখি কাপড়ের ভাজে অনেকগুলো টাকা আর একটা ডায়েরি। আমি ডায়েরিটা খুলে পড়তে লাগলাম,

– আজ নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবতী মেয়ে মনে হচ্ছে কারণ আমি পিয়াসের মতন একজন স্বামী পেয়েছি। কিন্তু আমার জন্য পিয়াসের এই কষ্টটা আমার সহ্য হচ্ছে না। আর আমি তার স্ত্রী হয়ে কিছুই করতে পারছি না। আমি আমার কষ্টের কথাগুলো বাড়িওয়ালার ছেলের কাছে বলেছিলাম। সে আমাকে বললো তার সাথে কয়েকদিন ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত কাটালে সে আমার ঋণগুলো শোধ করে দিবে। আমার কিছু উপায় ছিলো না তাই এই নোংরা প্রস্তাবটা মেনে নেই। নিজেকে আজকাল খুব অপবিত্র মনে হয়। কিন্তু যখন পিয়াসের ঘুমন্ত মুখটা দেখি তখন সবকিছু ভুলে যায়। আমি জানি না পিয়াসকে কখনো সত্যিটা বলতে পারবো কি না তবে কোন না কোনদিন আমি ওকে সব কিছু বলার চেষ্টা করবো।আমি ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেললাম। আমি আর পড়তে পারছি না। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট তম মানুষ মনে হচ্ছিলো। তাকিয়ে দেখি শ্রাবণীর রক্তহীন নিথর দেহটা পড়ে আছে। আমি কতক্ষণ চিৎকার করে কান্না করলাম জানি না…

ওসি আরিফুল জামান বাসায় এসে অবাক। অনেকগুলো সাংবাদিক কিছুক্ষণ আগে পুলিশ স্টেশনে আসা লোকটাকে ঘিরে বসে আছে। আর লোকটা তাদের বলছে, সে তার স্ত্রীকে নিজ হাতে খুন করেছে । তার স্ত্রী তার পরকীয়া সম্পর্কে বাধা দিয়েছিলো দেখে সে তার স্ত্রীকে মেরে ফেলেছে। চাকরির ১৫ বছর বয়সে এই প্রথম আরিফুল জামান সত্যি মিথ্যার মাঝখানে পরে আছে। আরিফুল জামান যখন পিয়াসের কানের কাছে এসে বললো,

– আপনি এইসব কি বলছেন? পিয়াস তখন চোখের কোণ থেকে জলটা মুছে বললো,
— স্যার প্রায়শ্চিত্ত করছি…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত