মন পবন: ২১-২৬. আপনি জানেন না

মন পবন: ২১-২৬. আপনি জানেন না

২১-২৬. আপনি জানেন না

আপনি জানেন না যে তা আমি জানি, কিরীটী বলে, কিন্তু আর্থার হ্যামিলটন জানে।

আর্থার। না না—সে অত্যন্ত নিরীহ গোবেচারি লোক। তাকে আপনারা জানেন না, কিন্তু আমি জানি। সে এসবের মধ্যে সত্যিই নেই, বিশ্বাস করুন।

আপনার সঙ্গে তো তার গত দেড় বছর ধরে কোন সম্পর্ক নেই। আপনাদের স্বামীস্ত্রীর মধ্যে তো সেপারেশন হয়ে গিয়েছে!

হয়েছে, তবু তাকে আমি জানি। সে এসবের কিছু জানে না। He is so innocent! এত নিরীহ-বলতে বলতে সীতা মৈত্রের দু চোখের কোল ছলছল করে ওঠে।

পটপট করে তার দু চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।

কিন্তু সীতা দেবী, পিয়ারীলাল সে কথা বিশ্বাস করে না। কিরীটী এবারে বলল।

পিয়ারীলাল! চমকে তাকায় সীতা মৈত্র কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ, পরশু রাত্রে সে কথা কি সে আপনাকে এসে বলে যায়নি?

ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে সীতার সমস্ত মুখখানা যেন একেবারে মড়ার মতই ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

আর্থার হ্যামিলটনকে সে শেষ করে দিতে চায় সেই কথাই কি গতরাত্রে পিয়ারীলাল এসে আপনাকে জানিয়ে যায়নি?

সীতা একেবারে বোবা হয়ে যায় যেন।

কয়েক মুহূর্ত তার মুখ দিয়ে কোন শব্দই বের হয় না।

কি, চুপ করে রইলেন কেন? কোথায় গাড়িতে করে যাবার কথা আছে আজ রাত্রে আপনাদের? বলুন, এখনও আর্থারকে যদি বাঁচাতে চান তো বলুন।

সীতা নির্বাক পাথর।

আর্থারকে তো আজও আপনি ভালবাসেন। কেন তবে চুপ করে থেকে তার সর্বনাশ ডেকে আনবেন মিস্ মৈত্র?

জানি না, আমি কিছু জানি না।

দু হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল সীতা মৈত্র।

কোন ভয় নেই আপনার সীতা দেবী, নির্ভয়ে আপনি বলুন, আমি কথা দিচ্ছি আপনার নিরাপত্তার জন্য দায়ী আমি থাকব। বলুন, চুপ করে থাকবেন না!

কোথায় তাকে নিয়ে যাবে আমি জানি না, তবে—

তবে?

আজ অফিসে পিয়ারীলালকে বলতে শুনেছিলাম, আমাদের উর্বশী সিগারেটের ভ্যানটা নাকি বারুইপুরে যাবে।

বারুইপুরে?

হ্যাঁ, সিগারেটের কারখানাটা শুনেছিলাম একসময় বারুইপুরে না কি কোথায়।

হুঁ। তাহলে আমার অনুমান মিথ্যে নয়!

কিরীটী যেন অতঃপর চিন্তিতভাবে কিছুক্ষণ ঘরের মধ্যে পায়চারি করল।

তারপর একসময় পায়চারি থামিয়ে বললে, ঠিক আছে, আপনি আপনার ঘরে যান।

এখন তো আমি ঘরে যাব না—

তবে?

চায়না টাউন হোটেলে একবার যেতে হবে।

কেন, সেখানে কি?

সেখানেই আর্থার থাকে—সেখান থেকে তাকে নাকি ওরা গাড়িতে তুলে নেবে সেই। রকম কথা হয়েছে।

আপনার সঙ্গে কি সেই রকম কথা ছিল?

না। আমার এখানেই থাকবার কথা। কিন্তু—

ঠিক আছে, আপনি যান চায়না হোটেলে, আপনার কোন ভয় নেই।

যাবো?

হ্যাঁ, যান।

সীতা মৈত্র ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

.

২২.

সেই রাত্রেই।

ভবানীপুর থানায় আমি, কিরীটী ও নির্মলশিববাবু অপেক্ষা করছিলাম এমন সময় ফোনে সংবাদ এল, সীতা মৈত্র তখনও নাকি চায়না টাউনে যায়নি।

একটু অবাকই হলাম আমরা সংবাদটা পেয়ে।

রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আমাদের ফ্ল্যাট থেকে সীতা মৈত্র বের হয়ে গিয়েছে।

এখন রাত সাড়ে এগারোটা এখনও চায়না টাউনে সে পৌঁছায়নি মানে কি?

সংবাদটা পেয়ে কিরীটী যেন একটু চিন্তিতই হয়ে ওঠে।

বলে, তবে কি সে সেখানে আদৌ পৌঁছাতেই পারল না?

কিরীটী মুহূর্তকাল যেন কি চিন্তা করে।

তারপর মৃদুকণ্ঠে ডাকে। সুব্রত।

কি?

ব্যাপারটা ভাল মনে হচ্ছে না। এদিকে হরিপদও তো এখনও পর্যন্ত কোন ফোন। করল না। উর্বশী সিগারেটের ভ্যানের সংবাদটা তার দেওয়ার কথা ছিল–

কিরীটীর কথা শেষ হল না।

ফোন বেজে উঠল।

নির্মলশিবই ফোন ধরেছিল।

কি আশ্চর্য! কে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি ও. সি. কথা বলছি। সন্ধ্যার সময় যে সেই ভ্যান গ্যারাজ থেকে বের হয়ে গেছে আর ফেরেনি!

ফোন রেখে দিয়ে নির্মলশিব কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, কি আশ্চর্য। শুনলেন তো মিঃ রায়, ভ্যান এখনও ফেরেনি!

হুঁ শুনলাম, আর দেরি নয়—চলুন—

সকলে আমরা এসে জীপে উঠে বসলাম।

কিরীটী নিজেই ড্রাইভারকে সরিয়ে দিয়ে স্টীয়ারিং ধরল।

রাত পৌনে বারোটা প্রায়।

কলকাতা শহর প্রায় নিশুতি হয়ে এসেছে।

নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দেখা গেল এক ভদ্রলোক বিরাটাকার দুই অ্যালসেসিয়ান কুকুর নিয়ে তার গাড়ির মধ্যে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।

কিরীটী শুধালে, হরগোবিন্দ, এসেছ কতক্ষণ?

তা বোধ হয় ঘণ্টাখানেক হবে।

ঠিক আছে, আমাদের গাড়ির পিছনে পিছনে তুমি তোমার গাড়িটা নিয়ে এস।

.

আগে আমাদের জীপ, পিছনে হরগোবিন্দর গাড়ি।

বারুইপুরে এসে আমরা পৌঁছলাম রাত একটা নাগাদ।

পথের ধারে এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করানো হল।

নির্মলশিববাবু প্রশ্ন করে, এবারে?

কিরীটী এবার তার পকেট থেকে একটা ব্যবহৃত, ঘামের গন্ধওলা পুরানো গেঞ্জি কাগজের মোড়ক থেকে বের করে হরগোবিন্দকে বললে, তোমার জ্যাকি আর জুনোকে নিয়ে এস তো গাড়ি থেকে নামিয়ে!

হরগেবিন্দ নিয়ে এল গলায় চেন বাঁধা কুকুর দুটো গাড়ি থেকে নামিয়ে।

সেই গেঞ্জিটা কুকুর দুটোকে শুঁকতে দেওয়া হল কিছুক্ষণ।

কুকুর-দুটো আকাশের দিকে অন্ধকারে মুখ তুলে বার-দুই ঘেউ ঘেউ শব্দ করে এগুতে শুরু করল। আগে আগে কুকুর দুটো, আমরা তাদের পিছু পিছু চলতে লাগলাম। কখনও রাস্তা, কখনও মাঠ, কখনও পুকুরের ধার দিয়ে কুকুর দুটো যেতে লাগল।

প্রায় আধঘণ্টা পরে নির্জন একটা পড়ো বাড়ির কাছাকাছি আসতে আমাদের নজরে পড়ল, অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে উর্বশী সিগারেটের সেই কালো রঙের চচকে ভ্যানটা।

সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী হরগোবিন্দকে চাপাকণ্ঠে যেন একেবারে ফি ফি শব্দে নির্দেশ করে, থামো।

হরগোবিন্দ কিরীটীর নির্দেশমত কুকুর-দুটোর গলায় বাঁধা চেনে টান দিতেই শিক্ষিত। কুকুর দুটো থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

এক পাও তারা আর নড়ল না।

পূর্ববৎ চাপাকণ্ঠে কিরীটী ডাকে, সুব্রত।

কি?

দেখেছিস?

হুঁ।

নির্মলশিববাবু?

বলুন!

পিস্তল আছে তো সঙ্গে?

হ্যাঁ।

লোডেড?

হ্যাঁ।

O. K.

বাড়িটার মধ্যে আমাদের প্রবেশ করতে বিশেষ কোন বেগ পেতে হল না।

পরে জেনেছিলাম, সেটা এককালে নাকি নীলকুঠী ছিল।

বিরাট বিরাট ঘর, বিরাট আঙিনা—কিন্তু সব যেন অন্ধকারে খাঁ-খাঁ করছে।

পাখি কি তবে পালাল? নিজেকেই নিজে যেন মনেমনে প্রশ্নটা করি।

এমন সময় হঠাৎ নজরে পড়ল অন্ধকারে একটা ক্ষীণ আলোর আভাস। আলোর আভাসটা আসছিল সামনে একটা ঘরের ঈষৎ উন্মুক্ত দ্বারপথে।

সর্বাগ্রে ছিল কিরীটী। তার পশ্চাতে আমি ও আমার পাশে নির্মলশিববাবু।

কিরীটী দরজার কাছ-বরাবর গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ে।

এবং পূর্ববৎ ফিফিস করে আমাকে বলে, শুনছিস্?

হুঁ।

অত্যন্ত ক্ষীণ একটা গ্লোনিংয়ের শব্দ যেন কানে আসছিল সামনের ঘরের ভিতর থেকে।

নির্মলশিববাবু, গেট রেডি।

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী যেন একপ্রকার ছুটে গিয়েই দড়াম করে ঘরের দরজাটা খুলে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়ল।

আমিও সঙ্গে সঙ্গে ছুটে যাই।

ঘরে ঢুকে দেখি ঘরের দেওয়ালে একটা দেওয়ালগিরি টিমটিম করে জ্বলছে।

আর একটা শয্যার ওপরে অসহায়ের মত চিৎ হয়ে পড়ে আছে কে একজন।

আচমকা এসময় দরজার ওপাশ থেকে একটা ছায়ামূর্তি যেন ঝাঁপিয়ে এসে কিরীটীর উপর পড়ল।

কিরীটীও সঙ্গে সঙ্গে তাকে দুহাতে জাপটে ধরে এবং চোখের পলকে তাকে যুযুৎসুর এক মোক্ষম পাঁচে কায়দা করে ধরাশায়ী করে ফেলে।

আমি ততক্ষণে ছুটে শয্যার উপর সয়িত মানুষটার দিকে এগিয়ে গিয়েছি এবং তার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠি।

একি! এ যে সীতা।

কিরীটী ঐসময় আমাকে ডেকে বলে, সুব্রত, শয়তানটাকে কায়দা করেছি, তুই আগে দেখ সীতা দেবীকে।

সীতাকে তখন আর দেখব কি!

প্রাণ আছে কিনা সন্দেহ।

নিশ্চল রক্তাক্ত দেহটা শয্যার উপর পড়ে রয়েছে।

সমস্ত পরিধেয় বস্ত্র রক্তে, একেবারে লাল।

ডানদিককার বুকেই রক্তাক্ত ক্ষতস্থানটা নজরে পড়ল। শয্যার একপাশেই নজরে পড়ল পড়ে আছে রক্তমাখা একখানা ছোরা।

বুঝলাম ঐ ছোরাটাই সীতার বুকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

ঘটনার আকস্মিকতায় নির্মলশিববাবু প্রথমটায় বোধ হয় একটু হতভম্বই হয়ে গিয়েছিল। কারণ সে তখনও এক পাশে বোকার মত দাঁড়িয়েছিল।

আমি ঝুঁকে পড়লাম নিঃসাড় সীতার মুখের কাছে, প্রাণ আছে কিনা দেখবার জন্য।

কিরীটী ইতিমধ্যে তার আক্রমণকারীকে যুযুৎসুর প্যাচে ধরাশায়ী করে বুকের উপর চেপে বসেছিল।

নির্মলশিববাবুকে লক্ষ্য করে সে এবারে বলে, নির্মলশিবাবু, আমার পকেটে সিল্ককর্ড আছে একটা বের করুন তো, এটাকে বেঁধে ফেলা যাক।

নির্মলশিব তাড়াতাড়ি এবার এগিয়ে গেল কিরীটীর কাছে। এবং তার পকেট থেকে সিল্ককর্ডটা টেনে বের করল। এবং ক্ষিপ্রহস্তে কিছুটা কিরীটীর সাহায্যেই শেষ পর্যন্ত নির্মলশিব আততায়ীকে বেঁধে ফেললে।

এতক্ষণ আততায়ীকে কিরীটী মাটিতে উবুড় করে রেখেছিল। পিছন দিক থেকে তাকে শক্ত করে সিল্ককর্ডের সাহায্যে বাঁধবার পর চিৎ করেই আমার লোকটার মুখের প্রতি প্রথম নজর পড়ল।

আমি চমকে উঠি নোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে।

শেষ পর্যন্ত আততায়ী আর্থার হ্যামিলটন। সত্যিই বিস্ময়ের যেন আমার অবধি থাকে না!

সীতার আততায়ী আর্থার হ্যামিলটন।

.

ইতিমধ্যে আততায়ী হ্যামিলটনকে বন্দী করে কিরীটী আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এবং কোন কথা না বলে প্রথমেই সীতার নাকের কাছে মুখ নিয়ে পরীক্ষা করল, তারপর তার হাতটা তুলে নিয়ে নাড়ির গতি পরীক্ষা করল। এখনও প্রাণ আছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে মনে হচ্ছে বাঁচবে না। তার পরেই পার্শ্বে দণ্ডায়মান নির্মলশিবের দিকে তাকিয়ে বললে, নির্মলশিববাবু, একে এখুনি হাসপাতালে রিমুভ করা দরকার।

আমার জীপে করেই তাহলে নিয়ে যাই?

হ্যাঁ, সেই ব্যবস্থাই ভাল হবে। চলুন—আর দেরি নয়।

বলতে বলতে কিরীটী নিজেই নিচু হয়ে রক্তাক্ত সংজ্ঞাহীন সীতার দেহটা দুহাতে বুকের উপরে তুলে নিল।

নির্মলশিব বন্দী আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়ে অগ্রসর হল।

আর্থার হ্যামিলটন যেন একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বিনা প্রতিবাদে সে চলতে লাগল।

.

শেষ পর্যন্ত কিন্তু জীপে তোলা গেল না সীতার দেহটা।

কাজেই হরগোবিন্দের গাড়িতেই দেহটা ভোলা হল।

সেই গাড়িতেই আমি ও কিরীটী উঠলাম।

কিরীটীর নির্দেশে বন্দী আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়ে জীপে উঠে বসল নির্মলশিববাবু।

স্থির হল হাসপাতালে সীতাকে পৌঁছে দিয়ে আমরা থানায় যাব।

.

২৩.

পরদিন বেলা সাতটা নাগাদ কিছুক্ষণের জন্য সীতার জ্ঞান হল।

কিরীটী ও আমি এবং নির্মলশিববাবু তিনজনেই সীতার বেডের সামনে ছিলাম। কিন্তু বিশেষ কিছুই বলবার ক্ষমতা তখন আর ছিল না সীতার।

নিদারুণভাবেই সে আহত হয়েছিল, মারাত্মক ছুরির আঘাতে। তার উপরে অতিরিক্ত, রক্তস্রাব।

সীতাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই কিরীটী তার মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে।

কিছু বলবেন সীতা দেবী?

ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে সীতা কিরীটীর মুখের দিকে।

কোন কথাই যেন বলতে পারে না।

ঠোঁট দুটো থর থর করে কাঁপতে থাকে কেবল।

বলুন কিছু যদি বলতে চান? কিরীটী আবার বলে।

আর্থার—

হ্যাঁ বলুন, আর্থার কি?

তাকে-তাকে! বোধ হয় শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলাম না মিঃ রায়।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, হি ইজ সেভড।

বেঁচেছে? সে-সে-

হ্যাঁ, সেই অক্ষতই আছে।

অক্ষত আছে? হি ইজ সেভড়? থ্যাঙ্ক গড।

শেষের কথাগুলো যেন ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে গেল।

দুচোখের কোল বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।

আমারও চোখে জল এসে যায়।

ঐদিনই।

থানায় বসে কিরীটী বলছিল, বেচারী সীতার ঐ করুণ পরিণতির ব্যাপারে কোন দিনই বোধ হয় নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারব না!

নির্মলশিববাবু প্রশ্ন করে, কেন ও কথা বলছেন মিঃ রায়?

কারণ সীতার ঐ পরিণতির জন্য আমিই বোধ হয় দায়ী।

আপনি?

নিশ্চয়ই সীতার ব্যাপারে অতবড় মারাত্মক ভুলটা যদি না করতাম।

ভুল?

ভুল বৈকি। সীতাকে যদি আমি কাল রাত্রে একাকী না ছেড়ে দিতাম তবে তো তাকে ঐ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হত না। হ্যামিলটনকে বাঁচাতে পারবে ভেবেই সীতাকে আমি যেতে দিয়েছিলাম এবং সেটা যে আমার কত বড় ভুল–

কিন্তু একটা কথা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি নি মিঃ রায়!

কি?

শেষ পর্যন্ত স্কাউন্ট্রেলটাকে বাঁচানোর জন্য আপনারই মাথাব্যথা হয়েছিল কেন?

ঐখানেই তো আপনি ভুল করছেন নির্মলশিববাবু!

ভুল করেছি মানে?

নিশ্চয়ই, কারণ সত্যি সত্যিই লোকটা স্কাউন্ট্রেল নয়। বরং বলতে পারেন হতভাগ্য!

হতভাগ্য?

হ্যাঁ। অমন স্ত্রী আর তার ভালবাসা পেয়েও নচেৎ লোকটার আজ এই পরিণতি হয়? তাকে দুর্ভাগা ছাড়া আর কি বলব বলুন?

লোকটার প্রতি দেখছি এখনও আপনার মমতার অন্ত নেই। একটা ডায়বলিক্যাল মার্ডারার!

মার্ডারার?

নিশ্চয়ই। খুনী—

কে খুনী? হ্যামিলটন? কিন্তু সে তো খুনী নয়।

খুনী নয় মানে?

অতি প্রাঞ্জল, সে হত্যা করেনি সীতাকে।

কথাটায় এবারে আমিও চমকে উঠি।

কি বলছিস কিরীটী?

কিরীটী শান্ত মৃদুকণ্ঠে বলে, ঠিকই বলছি—সে খুন করে নি।

কিন্তু–

লোকটা হ্যামিলটনের মত দেখতে তাই তো? বলতে বলতে মৃদু হাসে কিরীটী।

অতঃপর প্রশ্নটা না করে পারি না।

শুধাই, কে—কে তবে ঠিক হ্যামিলটনের মতই অবিকল দেখতে লোকটা?

হ্যামিলটনের ছদ্মবেশে আসল খুনী।

ছদ্মবেশে!

হ্যাঁ, হাজতঘরে গেলেই তোমাদের ভুল আমি ভেঙে দিতে পারব।

কিরীটীর কথায় সঙ্গে সঙ্গে নির্মলশিব উঠে দাঁড়ায় এবং বলে চলুন, এক্ষুনি চলুন। আমার সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মিঃ রায়!

বেশ, চলুন।

সকলে আমরা হাজতঘরের দিকে অগ্রসর হলাম।

থানার লকআপেই লোকটা তখনও ছিল এবং লকআপে থাকলেও কিরীটীর পূর্ব নির্দেশমত তার হাতে হাতকড়া দেওয়া ছিল।

আমরা সকলে এসে থানার সেই লকআপের মধ্যে তালা খুলে ঢুকলাম। দিনের বেলাতেও ঘরটার মধ্যে আলো না জ্বাললে ভাল করে সবকিছু দৃষ্টিতে আসে না।

আমাদের পদশব্দে সে ফিরে তাকাল।

লোকটার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই কেন যেন বুকটার মধ্যে শিরশির করে ওঠে। রুদ্ধ আক্রোশে পিঞ্জরাবদ্ধ বাঘের মতই যেন চোখ দুটো তার জ্বলছিল তখন।

কিন্তু কিরীটী একটু আগে কি বলল? এ তো আর্থার হ্যামিলটনই।

কিরীটী।

আমার ডাকে কিরীটী মৃদু হেসে বললে, এখনও মনে হচ্ছে আর্থার হ্যামিলটনই, তাই না।

আমি এবং নির্মলশিব দুজনাই কিরীটীর মুখের দিকে তাকাই, কিন্তু ভাল করে ওর চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবি সে নয়। তোদের কেন, সকলেরই ঐ ভুল হওয়াটা একান্তই স্বাভাবিক। তবে হ্যামিলটনের অপূর্ব ছদ্মবেশ নেওয়া সত্ত্বেও আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েই গতকাল বুঝতে পেরেছিলাম-চিনতে পেরেছিলাম ও আসলে কে? ওর ঐ দুটো চোখই আমাকে ওর সত্যকারের পরিচয় দিয়েছিল—ওর ছদ্মবেশ নেওয়া সত্ত্বেও। হ্যাঁ, তোমাদের সকলকে ফাকি দিতে পারলেও ও আমাকে ফাকি দিতে পারে নি Now you see–

বলতে বলতে এগিয়ে গিয়ে লোকটার দাড়ি ধরে একটা হেঁচকা টান দিতেই স্পিরিটগামের সাহায্যে লাগানো ফলস্ মেকআপের দাড়ি গোঁফ কিরীটীর হাতের মুঠোর মধ্যে চলে এল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি চমকে উঠলাম এতক্ষণে লোকটাকে চিনতে পেরে। আর্থার হ্যামিলটন নয়। কাঞ্জিলাল।

অস্ফুট কণ্ঠ দিয়ে আমাদের বের হয়ে এল। একি! কাঞ্জিলাল।

হ্যাঁ, কাঞ্জিলাল। চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল।

.

২৪.

আশ্চর্য।

চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল!

কিরীটী মৃদু হেসে অদূরে দণ্ডয়মান চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, হ্যাঁ, আপাতত তাই মনে হলেও ঐ নামটিও কিন্তু ওর আসল আদি ও অকৃত্রিম নাম বা পরিচয় নয়। ছদ্মবেশের মত ওটিও আর একটি ছদ্মনাম!

ছদ্মনাম?

হ্যাঁ। মহৎ ব্যক্তি ও গুণীজন কিনা—তাই ভদ্রলোক অনেক নামেই পরিচিত।

আরও নাম ওর আছে? শুধাল এবারে নির্মলশিববাবুই।

আছে। আমি অবিশ্যি আর দুটি নাম জানি।

আরও দুটি নাম ওর জানেন?

জানি। বোম্বাই শহরে বৎসর-চারেক পূর্বে উনি বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন, মিঃ রাখন নামে। এবং তার পূর্বে বছর সাতেক আগে ছিলেন মাদ্রাজে-সেখানে নাম নিয়েছিলেন মিঃ অবিনাশলিঙ্গম।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তিন-চারটি ভাষা ওঁর আয়ত্তে।

তবে ওর আসল নামটা কি? নির্মলশিব প্রশ্ন করে।

আসল নামটি যে কি একমাত্র বলতে পারেন উনিই! বলেই চিরঞ্জীববের দিকে তাকিয়ে কিরীটী প্রশ্ন করল, বলুন না মিঃ কাঞ্জিলাল, আপনার আসল, আদি ও অকৃত্রিম নামটা কি?

বলাই বাহুল্য কাঞ্জিলাল নিরুত্তর রইল।

কেবল কুদ্ধ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিঃশব্দে আমাদের দিকে।

কিরীটী মৃদু হেসে বলে, বোবার শত্রু নেই নির্মলশিববাবু। এতএব উনি বোবা, মৌনী। যাকগে—এখানে আর নয়, চলুন বাইরে যাওয়া যাক।

.

আমরা পুনরায় নির্মলশিবের অফিসঘরে ফিরে এলাম।

একটা চেয়ারে বসে একটা চুরুটে অগ্নিসংযোগে মনোনিবেশ করে কিরীটী।

আমিই এবারে শুধোই, ওকে তাহলে তুই পূর্ব হতেই সন্দেহ করেছিলি?

হ্যাঁ, চায়না টাউন হোটেলে ওকে যেদিন প্রথম দেখি, বলা বাহুল্য আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠেছিলাম, কারণ ওর ঐ দুটি চোখ মনের পাতায় আমার অনেকদিন থেকেই গাঁথা ছিল।

ওকে তুই পূর্বে দেখেছিলি?

চাক্ষুষ নয়-ফটোতে।

ফটোতে।

হ্যাঁ, ক্রিমিনাল রেকর্ড সেকশনের দপ্তরে ওদের মত বহু চিহ্নিত গুণীজনদের যেসব নানাবিধ পরিচিতি সংরক্ষিত থাকে সেই রকমই একটা ফটোর অ্যালবামে ওর চেহারার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। ফটোতে সেই সময় ওরই চোখ দুটি সেদিনই আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল। এবং সেইদিনই ডি.সি.-কে আমি বলেছিলাম, চোখের ঐ দৃষ্টি একজন সাধারণ কালপ্রিটের নয়, রক্তের মধ্যে যাদের ক্রাইমের বিষাক্ত বীজ থাকে ও চোখের দৃষ্টি তাদেরই।

আমরা যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত কিরীটীর বিশ্লেষণ শুনতে থাকি।

কিরীটী বলতে থাকে, সেই সময় ডি. সি.-র কাছে লোকটার কিছু পরিচয় আমি পাই। কারণ লোকটা সম্পর্কে জানতে আমার সত্যিই আগ্রহ হয়েছিল। কিন্তু ডি. সি. আমাকে বিশেষ কোন ইনফরমেশন লোকটার সম্পর্কে দিতে পারলেন না, বোম্বাই এবং মাদ্রাজের ব্যাপারটুকুই কেবল আমাকে সে সময় তিনি বললেন। মামলাটা ছিল সোনার চোরাই কারবার ও নোটজালের ব্যাপার। কিন্তু সে সময় লোকটিকে ধরেও স্থানীয় পুলিসের কর্তারা জোরালো প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ওকে।

তারপর? রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নির্মলশিববাবু।

তারপর বেশ কিছুদিন লোকটার আর কোন পাত্তাই পাওয়া যায় না এবং শ্রীমান যে ইতিমধ্যে কলকাতা শহরে এসে চিরঞ্জীব কাঞ্জিলাল নাম নিয়ে তার কর্মের জাল বিছিয়েছে পুলিসের কর্তৃপক্ষ এতদিন স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

তারপর?

তারপর সেদিন যখন ওকে আমি হ্যামিলটনকে অনুসরণ করতে করতে গিয়ে চায়না টাউন হোটেলে প্রথম দেখলাম, আমি আর কালবিলম্ব করিনি। সঙ্গে সঙ্গে পুলিসের দৃষ্টি ওর ওপরে আমি আকর্ষণ করাই এবং অনুসন্ধানের ফলে বিচিত্র এক ইতিহাস আমরা জানতে পারি।

ইতিহাস?

হ্যাঁ, সেই ইতিহাসই এবার বলব। প্রথমে মাদ্রাজ এবং পরে বোম্বাই থেকে পুলিসের তাড়ায় কারবার গুটিয়ে সম্ভবত চিরঞ্জীব—ঐ নামেই বলব, কলকাতায় চলে আসে সোজা। কলকাতায় এসে তার পরিচয় হয় ঘটোৎকচ—অর্থাৎ আমাদের পিয়ারীলালের সঙ্গে। পিয়ারীলাল লোকটা দুর্ধর্ষ ও শয়তান কিন্তু চিরঞ্জীবের মত তার কূটবুদ্ধি ছিল না। পিয়ারীলাল তখন চায়না টাউন হোটেলটি একজনের কাছ থেকে ষড়যন্ত্র করে বাগিয়ে নিয়ে সবে হোটেলটির মালিক হয়েছে। পিয়ারীলালের সঙ্গে দোস্ত পাতিয়ে চিরঞ্জীব ঐ চায়না টাউন হোটেলই আস্তানা নিল। তারপর পিয়ারীলালের মাথায় হাত বুলাতে কাঞ্জিলালের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। অতি সহজেই সে হোটেলটি গ্রাস করে নিল। এবং তার একটা পাকাপাকি নিশ্চিন্ত আস্তানাও হল। আস্তানা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিরঞ্জীব আবার পুরাতন কারবার অর্থাৎ নোটজাল ও সোনার চোরাকারবারে মন দিল। একে একে সোনার লোভে লোভে চিরঞ্জীবের দলে লোক এসে জুটতে লাগল।

কিন্তু আর্থার হ্যামিলটন ও তার স্ত্রী সীতা!

সেই কথাই এবারে বলব। ঘটোৎকচের পিয়ারীলালও আসল নাম নয়।

তবে?

ওর আসল নাম হচ্ছে ফ্রান্সিস মূর। নেটিভ ক্রিশ্চান। ফ্রান্সিস আর আর্থার ছিল দীর্ঘদিনের বন্ধু।

বন্ধু!

হ্যাঁ। কিন্তু বন্ধুত্বটা যে কিভাবে এত গাঢ় হয়েছিল সেটাই বিচিত্র। কারণ আর্থার তার বন্ধুর মত শয়তান ছিল না। তবে মনের মধ্যে লোভ ছিল অর্থের এবং আমার মনে হয় ঐ লোভই হয়েছিল তাদের পরস্পরের বন্ধুত্বের বাঁধন। যাই হোক যা বলছিলাম তাই বলি। চিরঞ্জীব কলকাতায় স্থিতি হবার পর তার ওভারসিজ লিঙ্ক কোম্পানি গড়ে তুলল। এবং বরাবর যেমন সে করে এসেছে এবারেও তেমনি ওভারসিজ লিঙ্কই নয়–সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে এবং তার আসল কারবারকে পুলিসের শ্যেনদৃষ্টি থেকে বাঁচাবার জন্য আরও কয়েকটি উপঘাঁটি গড়ে তুলল। অবশ্যই প্রত্যেকটি উপঘাঁটিই কাছাকাছি গড়ে তুলল, কেবল বিশেষ দুটি ঘাঁটি ছাড়া—প্রথম তার নিজের বাসস্থানটি ও দ্বিতীয় নোটজালের কারখানাটি দূরে দূরে রইল।

হস্তধৃত সিগারটা ইতিমধ্যে কথা বলতে বলতে নিভে গিয়েছিল।

সেটায় পুনরায় অগ্নিসংযোগ করে গোটা দুই টান দিয়ে কিরীটী তার অর্ধসমাপ্ত কাহিনীর পুনরাবৃত্তিতে ফিরে এল।

কিরীটী বলতে লাগল, চায়না টাউন হোটেল ও বারুইপুরের ঘাঁটি বাদে অন্যান্য ঘাঁটি হল তার, ওভারসিজ লিঙ্ক, পান্থ পিয়াবাস রেস্তোরাঁ ও লাটুবাবুর গ্যারাজ এবং নিজেকে ও সেই সঙ্গে নোট জালের কারখানাটি আড়াল করে রাখবার জন্য আমদানি হল উর্বশী সিগারেট।

.

২৫.

কিরীটী বলতে লাগল, চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল সর্বপ্রথম ফ্রান্সিস–আমাদের ঘটোৎকচ বা পিয়ারীলাল। তারপর এল, পানওয়লা ভিখন ও পান্থ পিয়াবাসের মালিক কালীকিঙ্কর সাউ। এবং সর্বশেষ আমাদের হ্যামিলটন ও তার সুন্দরী স্ত্রী সীতা হ্যামিলটন।

আর্থার হ্যামিলটনের মনের মধ্যে অর্থের প্রতি লোভ থাকলেও দুবুদ্ধি ছিল না আগেই বলেছি। এবং স্ত্রীর সঙ্গে তার নেশার ব্যাপারে প্রায়শই খিটমিটি লেগে থাকলেও কেউ তারা স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছ থেকে সেপারেশনের কথাও বোধ হয় ভাবতে পারে নি।

এমন সময় চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের আগমন ঘটল অকস্মাৎ একদিন ঘটোৎকচের সঙ্গে বর্ধমানে হ্যামিলটনের রেলওয়ে কোয়ার্টারে কোন এক নিদারুণ অশুভক্ষণে। এবং এবারের ইতিহাস যা আমাকে কিছু কিছু বলেছিল আর্থার হ্যামিলটন এবং বাকিটা আমার অনুমানের উপরে নির্ভর করে আমি গড়ে তুলেছি।

এতক্ষণে যেন কিরীটীর কথায় অকস্মাৎ আমাদের সকলেরই আর্থার হ্যামিলটনের কথাটা মনে পড়ল।

বর্তমান নাটকে বিশিষ্ট একটি স্থান নিয়েও আর্থার হ্যামিলটনকে যেন আমরা সীতার করুণ ট্রাজেডির সঙ্গে জড়িত হয়ে ও চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের প্রসঙ্গে একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম।

তাই হ্যামিলটনের কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও বললাম, আর্থার এখন কোথায় তুই জানিস কিরীটী?

জানি।

কোথায়?

বর্তমানে সে আসানসোলে তার এক আত্মীয়ের বাসায় পুলিসের সতর্ক প্রহরায়। রয়েছে।

আসানসোলে?

হ্যাঁ।

কবে সেখানে গেল?

কাল রাত্রের ট্রেনে। আমিই অবিশ্যি ডি. সি.-কে বলে ব্যবস্থা করেছি।

সীতার ব্যাপারটা আর্থার জানে না বোধ হয়?

না।

কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না কিরীটী–

কি?

আর্থারের ব্যবস্থা যখন তুই করেছিলিই, সেরাত্রে সীতাকে চায়না টাউনে যেতে দিলি কেন?

না যেতে দিলে চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালকে আজ তো হাতেনাতে ধরতে পারতাম না। কিন্তু তাকে যেতে দিয়ে আমি ভুল করি নি-ভুল করেছি তাকে একা যেতে দিয়ে। কারণ আমার ধারণা ছিল—

কি?

কাঞ্জিলাল হয়তো শেষ পর্যন্ত হত্যা করবে না!

হঠাৎ অমন বিদঘুটে ধারণাটা কেন হল আপনার মিঃ রায়? প্রশ্নটা করলে নির্মলশিববাবু।

কারণ আমি জানতাম, সীতাকে সত্যি ভালবাসে কাঞ্জিলাল।

কিসে বুঝলেন সেটা?

শেষ মুহূর্তে যে কাঞ্জিলাল সীতাকে চরম আঘাত হেনেছিল, সেই একটিমাত্র ঘটনা থেকেই। যাকে ভালবসেছি বলে আগাগোড়া জেনে এসেছি এবং সেও আমাকেই ভালবাসে বলে জেনে এসেছি হঠাৎ যখন কোন এক মুহূর্তে সেই জানাটা মিথ্যা হয়ে যায়—অর্থাৎ জানতে পারি আমার জানাটা ভুল, সেই মুহূর্তে যে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে তা বড় ভয়ঙ্কর। কাঞ্জিলালেরও হয়েছিল ঠিক তাই। কাঞ্জিলাল যে মুহূর্তে জানতে পারলে সীতা আজও আর্থার হ্যামিলটনকে ভুলতে পারে নি, যতই দূরে যাক সে আজও তার সমস্ত বুকটা জুড়ে রয়েছে তার ভূতপূর্ব স্বামী হ্যামিলটনই, খুব সম্ভবত চিরঞ্জীবের বুকের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠেছিল হিংসার ভয়াবহ আগুন, যে আগুনে সীতাকে তো সে ধ্বংস করলই, নিজেরও চরম সর্বনাশকে ডেকে আনল। যে পুলিশ গত এই কয় বছর ধরে তার বহুবিধ দুষ্কৃতির সন্ধান পেয়েও তাকে ধরতে বা ছুঁতে পারে নি, সেই পুলিসের হাতেই ধরা পড়ল আজ সে।

চিরঞ্জীব যে সীতাকে ভালবাসে জানলেন কি করে মিঃ যায়? নির্মলশিব প্রশ্ন করে।

কেন, আপনার লোকরা চায়না টাউনের প্রোপাইটার চিরঞ্জীবের ঘর সার্চ করে যেসব জিনিসপত্র নিয়ে এসেছিল সেদিন, তার মধ্যে আপনি কোন উল্লেখযোগ্য বস্তু না পেলেও তার ঘরে যে বাঁধানো বাইবেলটি আপনার লোকরা এনেছিল তার মধ্যে একটি ফটো আমি পেয়েছিলাম—বলতে বলতে কিরীটী ছোট একটা ফটো বের করে আমাদের সামনে তুলে ধরল।

ফটোটা চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালের।

নির্মলশিব ফটোটার দিকে তাকিয়ে বললে, এ তো চিরঞ্জীবের ফটো দেখছি, মিঃ রায়। হ্যাঁ তারই, তবে

তবে আবার কি? এর পিছনের লেখাটা পড়লেই আপনার ঐ তবের উত্তর পাবেন। এই দেখুন–কিরীটী ফটোটা উলটে ধরল।

দেখলাম তার পিছনে ইংরাজীতে লেখা আছে কালি দিয়ে

To my darling Sita
Chiranjib

এবং তার নিচে যে তারিখটা রয়েছে সেটা এক বৎসর পূর্বের।

কিরীটী বলতে লাগল, ফটো এবং এই লেখাটুকুই চিরঞ্জীব-সীতা-রহস্য আমার কাছে। পরিষ্কার করে দিয়েছিল।

কিন্তু এ ফটো চিরঞ্জীবের ঘরে বাইবেলের মধ্যে এল কি করে? প্রশ্ন করল নির্মলশিববাবু।

খুব সম্ভবত–আমার অনুমান, পরে দুজনার মধ্যে আর্থার হ্যামিলটনকে নিয়ে মনোমালিন্য হওয়ায় হয় সীতাই চিরঞ্জীবকে ফটোটা ফিরত দিয়েছিল, না হয় চিরঞ্জীবই চেয়ে নিয়েছিল সীতার কাছ থেকে। সে যাক, হ্যামিলটন পর্বটা এবারে শেষ করি। হ্যামিলটনকে দলে সম্ভবত চিরঞ্জীব টেনে নিয়েছিল সীতার আকর্ষণে। যদিচ চিরঞ্জীবের জীবনে সেটাই সর্বাপেক্ষা বড় ভুল হয়েছিল।

কেন? নির্মলশিব আবার প্রশ্ন করে।

কারণ চিরঞ্জীব যে মারাত্মক খেলায় মেতেছিল—অর্থাৎ নোটজাল ও সোনার চোরাকারবার, তার মধ্যে দুর্বল প্রকৃতির নারীর স্থান নেই। এবং সীতা যদি তার জীবনের সঙ্গে ঐভাবে জড়িয়ে না পড়ত, চিরঞ্জীবের আজকের এই পরাজয় ঘটত কিনা সন্দেহ।

.

২৬.

কিরীটী বলতে লাগল, যাই হোক হ্যামিলটনকে দলে নিলেও চিরঞ্জীব কোনদিন তার উপরে সম্ভবত পূর্ণ আস্থা রাখতে পারে নি। তাই দলের মধ্যে তাকে সক্রিয় হতে দেয় নি।

তবে?

কিন্তু সীতার জন্য তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখার প্রয়োজন ছিল, তাই হাতে রেখেছিল তাকে নেশার খোরাক যুগিয়ে।

নেশা।

হুঁ, নেশা। মদের নেশা। এবং বোকা সরল প্রকৃতির আর্থার হ্যামিলটনকে সেইভাবে নেশাগ্রস্ত করে হাতের মুঠার মধ্যে নিতে কাঞ্জিলালকে খুব বেশি বেগ পেতে হয় নি। যাই হোক ঐভাবে চলছিল, এমন সময় দ্বিতীয় মারাত্মক ভুল করল কাঞ্জিলাল।

কি?

হ্যামিলটনকে নেগলেকটেট করে। সীতাকে হাতের মুঠোর মধ্যে পাওয়ার পর চিরঞ্জীব হ্যামিলটনের আগের মত নেশার খোরাক যোগানোর ব্যাপারে যখন হাত গুটিয়ে নিল তখনই শুরু হল গোলমাল। তা ছাড়া আর একটা গোলমাল ইতিমধ্যে শুরু হয়েছিল।

কি?

লাভের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে গোলমাল। যার ফলে দলের কেউ হয়তো আক্রোশের বশেই পুলিশকে উড়ো চিঠি দেয়। এবং যার ফলে একজনকে ইহজগৎ থেকে সরতে তো হলই, সেই সঙ্গে মোহিনীমোহনকেও চিরঞ্জীরের ব্যাপারে মাথা গলানোর জন্য সরতে হল। এবং শেষ পর্যন্ত এসব ক্ষেত্রে যা হয়, দলপতির সন্দেহটা তখন ক্রমশ এত তীব্র হয়ে উঠতে থাকে দুচারজনকে সেই সন্দেহের আগুনে পুড়ে মরতে হয়—ভিখনকে সেই কারণেই প্রাণ দিতে হয়েছে।

একটা কথা মিঃ রায়। নির্মলশিব প্রশ্ন করে ঐ সময়।

কি বলুন?

সীতা কি চিরঞ্জীবের সব ব্যাপার জানত?

সীতা ভিতরের ব্যাপরটা পুরোপুরি প্রথম দিকে না জানতে পারলেও শেষটায় বোধ হয় সন্দেহ করেছিল।

আর হ্যামিলটন?

হ্যামিলটন বোধ হয় তা জানতে পেরেছিল। তবে জানতে পারলেও বেচারীর তখন আর মুখ খুলবার শক্তি নেই, কারণ রেসের ময়দান ও মদের বোতল তখন তাকে গ্রাস করেছে। ঐ দুটি মারাত্মক নেশায় কাঞ্জিলালই হ্যামিলটনকে মজিয়েছিল ক্রমে ক্রমে এবং সেই নেশার সুযোগেই তাকে একদিন সম্পূর্ণ গ্রাস করেছিল সে কথা তো আগেই বলেছিল।

তারপর?

তার পরের ব্যাপারটাই শেষোক্ত ট্রাজেডির মূল।

কি রকম?

নেশায় ও অর্থের দৈন্যে এবং সীতাকে হারিয়ে পর্যদস্ত ও নিষ্পিষ্ট আর্থার হ্যামিলটন এসব ক্ষেত্রে যা হয় শেষ পর্যন্ত তাই করেছিল।

কি?

সেও শেষ পর্যন্ত মাত্র দশদিন পূর্বে মরণ কামড় দিল।

কি রকম?

পুলিসের কর্তাকে বেনামী চিঠি দিল। কিন্তু ধূর্ত কাঞ্জিলাল ব্যাপারটা জেনে ফেলল। এবং সঙ্গে সঙ্গে হ্যামিলটনকে একেবারে দুনিয়া থেকে সরাবার জন্য ভিতরে ভিতরে প্রস্তুত হতে লাগল।

কিন্তু হ্যামিলটনকে সরানো কি কাঞ্জিলালের মত লোকের পক্ষে খুব কষ্টসাধ্য ছিল? প্রশ্ন করলাম আমি।

ছিল না নিশ্চয়ই, তবে সে পারেনি দুটো কারণে!

দুটো কারণে?

হ্যাঁ, প্রথমত কাঞ্জিলাল খুব ভালবাবেই জানত আর্থার হ্যামিলটনের সঙ্গে সীতার সেপারেশন হয়ে গেলেও সীতা আজও তাকে ভুলতে পারে নি। দ্বিতীয়ত হ্যামিলটনকে। সরালে সীতাকে হারাতে হবে তার। সীতাকে কাঞ্জিলাল সত্যিই ভালবেসেছিল সে তো আগেই বলেছি। মদনের ফুলশর নয়, এখানে রতির বঙ্কিম কটাক্ষই শেষ পর্যন্ত অঘটন ঘটাল। তবে একটা কথা এখানে স্বীকার না করলে অন্যায়ই হবে।

কি? প্রশ্ন করে নির্মলশিববাবু।

সারা দক্ষিণ কলকাতার রাস্তা জুড়ে যদি মোহিনীমোহনের লাসটা অতিরিক্ত দম্ভে কাঞ্জিলাল টুকরো টুকরো করে না ছড়িয়ে দিত তো বিশেষ করে দক্ষিণ কলকাতার উপরেই দৃষ্টি আমার আকর্ষিত হত না। এবং সেদিনও রাত্রে বের হয়ে ঘুরতে ঘুরতে ওভারসিজ লিঙ্কের উপরে আর নজর পড়ত না। এবং ওভারসিজ লিঙ্কে নেহাত কৌতূহলের বশে প্রবেশ করার পর সেখানে ঘটোৎকচ ও সীতা দেবীর দর্শন না পেলে ও সেদিনকার সেই ঘটনাটা না ঘটলে হ্যামিলটনকে ঘিরে ওভারসিজ লিঙ্কের উপরে সন্দেহটা আমার ঘনীভূত হত না।

কিন্তু এসব কথা তুই জানলি কি করে?

কিছুটা অনুমান, কিছুটা অন্তদৃষ্টি, কিছুটা অনুসন্ধান ও বাদবাকি আর্থার হ্যামিলটনের মুখে।

আর্থার হ্যামিলটনের মুখে!

হ্যাঁ।

কি আশ্চর্য! তাহলে চিরঞ্জীব কাঞ্জিলালই সব রহস্যের মেঘনাদ! শুধালেন নির্মলশিববাবু।

হ্যাঁ, তবে আর একটা মাস দেরি হলে চিরঞ্জীব ঠিক নাগালের বাইরে চলে যেত, কারণ যে সোনা সে চুরি করে হস্তগত করেছিল তার বোধ হয় সবটাই সে মোটা মুনাফা রেখে বিদেশে পাচার করে দিতে পেরেছিল। ওভারসিজ লিঙ্কের কারবার। সে হয়তো এভাবে শীঘ্রই গুটিয়ে নিত। কিন্তু কথায় বলে-ধর্মের কল। ঠিক সময়েই ঘটনাচক্রে যোগাযোগটা এমন হয়ে গেল যে চিরঞ্জীবের আর পালানো হল না।

পালাত মানে? পালালেই হল নাকি? নির্মলশিব সদম্ভে বলে ওঠে।

পালাত? আর একবার জাল গুটিয়ে নিলে স্বয়ং কিরীটী রায়েরও সাধ্য ছিল না চিরঞ্জীবের চুলের ডগাটি স্পর্শ করে।

সত্যি বলছেন মিঃ রায়?

এতটুকুও অত্যুক্তি নয়। ও যে কত বড় শয়তান আপনারা জানেন না এখনও, কিন্তু আমি তার সম্যক পরিচয় পেয়েছি। তবে দুঃখ রয়ে গেল, শেষ পর্যন্ত সীতাকে

বাঁচাতে পারলাম না।

কি আশ্চর্য! তার জন্য আর দুঃখ কি? গিয়েছে ভালই হয়েছে—যেমন ও পথে পা দিয়েছিল।

হ্যাঁ, সবই সত্যি, তবু কখনও বোধ হয় ভুলতে পারব না শেষ পর্যন্ত যে আমার শেষ মুহূর্তে ঐ ভুলটা না হলে বুঝি তাকে অমন করে কাঞ্জিলালের হাতে প্রাণ দিতে হত।

নির্মলশিব শেষবারের মত বললে, কি আশ্চর্য।

আগের পর্ব :

০১-০৫. সেই মুখখানা যেন আজও
০৬-১০. বসলাম পাশাপাশি দুজনে দুটি চেয়ারে
১১-১৫. তারপরও কিরীটী একটা সপ্তাহ
১৬-২০. তারপরের দিন ও রাত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত